Monday, 6 July 2020

অনির ডাইরি ৬ই জুলাই,২০২০



বেশ কিছুদিন আগের কথা, করোণা তখনও মেলেনি ডানা। চীনে কি সব ঝকমারি বিমারি হচ্ছে বটে, আঁতেল বন্ধুবান্ধব এবং আমার বর সেটা নিয়ে বেশ গুরুগম্ভীর আলাপ-আলোচনাও করছে, তবে তার ছাপ পড়েনি আমার চুঁচুড়ায়। ভর দুপুর নিজের চেম্বারে বসে কাজ করছি, সন্ত্রস্ত পায়ে মেয়েটা ঢুকল। সন্ত্রস্ত হয়ে জানাল আমার সাথে একটু একা কথা বলতে চায়। সকাল থেকে বেশ কয়েকবার চেম্বারের কাঁচের ঘুলঘুলি দিয়ে উঁকি মেরে গেছে, সবসময়ই ঘর ভর্তি ছিল।
একা একা কি কথা রে? জানতে চাইলাম। হাত কচলে বলল,“অমুক তারিখে আমাকে একটু অর্ডার করে ডেকে নেবেন?” মানে? খামোকা অর্ডার করে ডাকার কি আছে, ওরা তো এমনিতেই আসে, যখন কাজ থাকে। আজও তো এসেছে। বেশ খানিকক্ষণ মাথা নত করে বসে থাকল মেয়েটা, দেরী হয়ে যাচ্ছে পরের মিটিংএ। এখনও হয়নি টিফিন। সুজয় বাবু দুবার মুণ্ডু গলিয়ে গেলেন, ঘুঘনি তৈরি, বললেই রুটি সেঁকে দিয়ে যাবে। মেয়েটা আর ওঠেই না। বললাম, “ আচ্ছা সে একটা হাবিজাবি মিটিং ডেকে দেব খন। তুমি এমনি এসে ঘুরে যেও। ” বলতে বলতে থমকে গেলাম, মেয়েটার কাজল চোখে তখন আষাঢ়ের মেঘ। টুসকি মারলেই ঝরে পড়বে ঘন বর্ষার ধারা। এবার ঘাবড়ে যাবার পালা আমার, ব্যাপার কি?
বলতে বলতেই ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল মেয়েটা, বাঁহাতে দরজার বাইরের লাল আলোটা জ্বালিয়ে দিলাম, এই মুহূর্তে কেউ মাথা গলালে বড় বাজে হবে। মেয়েটা ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, “আমার শ্বশুরবাড়ি খুব খারাপ ম্যাডাম। ” এ আর নতুন কথা কি? শতকরা ৯৮জন মেয়েই এই কথা বলে। যত মহিলা ক্ষমতায়নের কর্মশালা করেছি,সবেতেই সব ছাপিয়ে উঠে আসেন শাশুড়ী মা। বন্ধুদের অাড্ডাতেও সেলিব্রিটি গুটি কয়েক বন্ধুর শাশুড়ী মা। ওরা শাশুড়ী চর্চা না করলে বরং চিন্তা হয়, শরীর টরীর বিগড়াল না তো? সেই ভাবেই হেসে উড়িয়ে দিতে গেলাম- তাতে ফোঁপানী বেড়ে গেল মারাত্মক।
“না ম্যাডাম, আমার শাশুড়ী মা নেই। আমার বর যখন কলেজে পড়ত তখনই মারা গেছেন। আমার ভাসুর আমার বরের থেকে অনেকটাই বড়, ওর বৌদিই ছিল বাড়ির গিন্নী।“ বাঙালীর আরেক সমস্যা এই বৌদি। নির্ঘাত ক্ষমতায়নের লড়াই। মেয়েটা তখনও কেঁদে চলেছে, “জানেন ম্যাডাম, আমার ভাশুর তেমন কিছুই করত না। আমার বরই বড় হয়ে চাকরী পেয়ে লোন নিয়ে বাড়িটা তৈরী করে। আমার শ্বশুর মশাই ওপার থেকে এসেছিলেন তো, আজন্ম ভাড়া বাড়িতে থেকেছেন। ওণার একটাই স্বপ্ন ছিল, নিজের ভিটেতে শেষ নিশ্বাস ফেলবেন। তাই আর কি-”।
দুজনেই চুপচাপ বসে আছি, ঘরঘর করে ঘুরছে দেওয়ালে লাগানো পাখা দুটো। কাঁচের কাগজ চাপার তলা থেকে উড়ে যেতে চাইছে একদিস্তা নানা সরকারী কাগজ। জানতে চাইলাম “জল খাবে?” ঘাড় নেড়ে অসম্মতি জানাল মেয়েটা। ওড়নায় নাক-চোখ মুছে এতক্ষণে আমার দিকে চোখ তুলে তাকাল-“জানেন ম্যাডাম ওরা চায়নি আমাদের বিয়েটা হোক। আমাকে দেখতে এসেই নাকচ করে গিয়েছিল ওরা। আমার মায়েরও পছন্দ হয়নি ওর বৌদির হাবভাব। বড় বেশী ক্যাটক্যাটে কথা ওণার। পরে শুনেছি ওরা এটাই করত। ওরা আসলে চায়নি আমার বরের আদৌ বিয়ে হয়। বেশ কয়েকবার নানা ছুঁতোনাতায় অনেকগুলো সম্বন্ধ নাকচ করায়, ওর সহকর্মীদের সন্দেহ হয়। আমার বেলাতেও ওরাই ফোন করেছিল আমার বাবাকে। বাড়ির লোকের অপছন্দ হলেও, ওর পছন্দ হয়েছিল আমায়। মা অবশ্য নিষেধ করেছিল- কিন্তু-”।
ঘরঘরে পাখার হাওয়া আবার এলোমেলো করে দেয় সব কথা। নীরবতাও হয়ে ওঠে বাঙ্ময়। বুঝি মেয়েটির অপছন্দ ছিল না পাত্র। উভয় পক্ষের সম্মতিতে ভেঙে পড়ে প্রতিবন্ধতার পাঁচিল। কিছুটা দম নিয়ে, ব্যাগ থেকে একটা ছোট বোতল বার করে দু ঢোঁক জল খায় মেয়েটা। আমিও বেল বাজিয়ে বলি,টিফিনটা দিয়ে যেতে-।
কুচি কুচি কাঁচা লঙ্কা ছড়ানো আগুন গরম রুটি-ঘুঘনীর সাথে গড়ায় কিস্যা। মেয়েটি অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে ওঠে। বরের গল্প করতে থাকে, বলতে বলতে আবার বেজে ওঠে বেসুরো ভায়োলিন। “জানেন ম্যাডাম আমার শ্বশুর মশাই প্রথম দিকে আমাকে একেবারেই মেনে নেননি। বাড়ির অমত থাকা সত্ত্বেও ওণার ছেলে নিয়ম ভেঙে আমায় ঘরে এনেছে এই অভিযোগ প্রায়ই করতেন। বলতেন, যারা বাড়ির মতের বিরুদ্ধে যায়, তারা কখনও সুখী হয় না। কিন্তু আমরা তো সুখী হয়েছি ম্যাডাম। খুব সুখী আমরা একে অপরকে পেয়ে।” কেমন যেন গুলিয়ে যায় মাথা। তাহলে সমস্যাটা কি?
মেয়েটা বলে চলে, “ আমাদের যখন বিয়ে হয়, তখন একতলাটা খুব সাজানো গোছানো ছিল। দোতলাটা আধখেঁচড়া পড়ে ছিল। কিন্তু আমার ভাশুর আর জা জোর করে আমাদের দোতলায় থাকতে বাধ্য করে। কি কথা শোনাত ম্যাডাম। জানেন না। উঠতে বসতে খোঁটা দিত। ভালো করে খেতেও দিত না ম্যাডাম”। আবার হাপুস নয়নে কাঁদতে লাগল মেয়েটা। আবার জ্বালিয়ে দিলাম দরজার বাইরের লাল বাতি। মহাজ্বালায় পড়েছি তো-
“যখন কনসিভ করলাম ম্যাডাম, কতদিন না খেয়ে পঞ্চায়েত আপিসে গেছি কাজ করতে আপনি জানেন না। ইচ্ছে করে আমায় খেতে দিত না। চাইত না আমার পেটেরটা বাঁচুক। যা দু পয়সা পেতাম রাস্তায় যা পেতাম কিনে খেতাম ম্যাডাম-”। সুজয় বাবুর রুটি হঠাৎ বড় বেসোয়াদ লাগল। এদের বড় ভালোবাসি। সব সাব স্টাফ, এজেন্ট-এসএলও যাদের সাথেই নিয়মিত দেখা হয়,সবাইকেই ভালোবাসি। যখন ধমকাই, জ্ঞানশূণ্য হয়েই ধমকাই। কাঁদিয়েও ছাড়ি অবস্থাবিশেষে। তবে তার স্থায়িত্ব বড় জোর পাঁচ থেকে দশ মিনিট। বাকি সময়টা যতটা পারি ভালোবাসি। এরাও বাসে, সব গোপন কথা অকপট ভাবে উন্মুক্ত করে যায় আমার ঘরের চার দেওয়ালের ভিতর। সব মিলিয়ে কেটে যায় টক-ঝাল-মিষ্টি দিনগুলো, আপিসে আসতে কখনও বিরক্তি লাগে না, না আমার- না এদের। আজ সম্পূর্ণ অন্য কারণে কাঁদতে দেখে বড় কষ্ট হচ্ছে,। এ এমন কারণ যার সমাধান এদের ম্যাডামের হাতে নেই।
“জানেন ম্যাডাম, ঐ অবস্থায় আমাদের ওরা আলাদা করে দিল। অজুহাত দেখাল, আমি কাজে বেরোই কি না, আমার বাচ্ছা হলে ওদের ঘাড়ে চাপিয়ে আমি বাইরে হাওয়া খেতে যাব- সেসব হবে না। জানত শ্বশুরমশাই আমাকে দেখতে পারেন না, তাও তাঁকে ঠেলে দিল আমাদের ঘাড়ে। ওণাকেও তুলে দিল দোতলায়। অর্ধেক জানলায় পাল্লা বসেনি। দালানের মেজে হয়নি, ঘরগুলো সব প্লাস্টারও হয়নি। তারমধ্যেই আমরা তিনজন থাকতে বাধ্য হলাম। ঐ ঢাউস পেট নিয়ে সব কাজ করতে হত ম্যাডাম। বাপের বাড়িতে গিয়ে যে থাকব এরা বাপছেলে তো ভুখা মরবে। একতলা থেকে বালতি করে জল টেনে আনতে হত জানেন ম্যাডাম। একদিন এমনি জল আনতে গেছি, ওরা দুজনে চলে এল ঝগড়া করতে।” একটু দম নিয়ে বলল মেয়েটা,“আমার গায়ে সেদিন ওরা হাতও তুলেছিল ম্যাডাম। আমায় ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়েছিল-”।
সে কি? থানায় জানাওনি? ৪৯৮এ? মৃদু হেসে ওঠে মেয়েটা। “জানিয়েছিলাম তো ম্যাডাম। কিছুই হয়নি। হাসপাতালের কাগজের কপিও দিয়েছিলাম। লেখা ছিল অল্পের জন্য বেঁচে গেছে আমার বাচ্ছাটা। নইলে হয়তো দুজনেই-। থানা থেকে বলে মিটমাট করে নিন। আমার বরও হয়তো নিমরাজি ছিল, বাড়ির কলঙ্ক বাইরে-”।
সত্যি মাইরি। মারাটা কলঙ্ক না। নালিশ করাটা কলঙ্ক। মেয়েটা বলে,“শুধু আমার মা। বেঁকে বসে আমার মা। মা বলেছিল, ‘আমি কোনদিন হাত তুলিনি আমার মেয়ের ওপর। কোন সাহসে হাত তোলে ওরা?’ আমরা ঐ বাড়ি ছেড়ে ভাড়া বাড়িতে উঠি। উকিলের কাছে যাই, আদালতে কেসও ওঠে ম্যাডাম। ওরা অামার বরের সাথে যোগাযোগ করে চাপ দেয় কেসটা তুলে নিতে হবে। শ্বশুরমশাই অবধি বলেছিলেন-ওসব একটু আধটু। তাই বলে ঘরের কেচ্ছা কেউ আদালতে টানে। ওদের মুখের দিকে তাকিয়ে কেস তুলতেও গেছিলাম। আমার উকিল যদিও আপত্তি করেছিলেন।  জজ সাহেব একজন মহিলা ছিলেন। উনি আমার মুখে শুনতে চান। আমায় কাঠগোড়াতে তোলা হয়। আমাকে জজ ম্যাডাম নিজে প্রশ্ন করেন, ‘আপনি স্বেচ্ছায় কেস তুলছেন? কেন?’ আমি না কিছু বলতে পারিনি। শুধু বারবার মনে পড়ছিল, ওরা আমার গায়ে হাত তুলেছিল। ওরা আমায় ঐ অবস্থায় ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়েছিল। আমার বাচ্ছাটা মরে যেত আরেকটু হলে-। এই সব ভেবে কি না জানি না,আমি একটা কথাও বলতে পারিনি, খালি টপটপ করে জল পড়ছিল চোখ দিয়ে। জজ ম্যাডাম তখন আমার বরকে ধমকান। বলেন কেস তোলার জন্য আমায় না চাপ দেয়-”।
তারপর? তারপর শুনলাম কেস চলছে, অনেক বছর ধরেই চলছে। সামনেই একটা ডেট আছে। যেদিন মেয়েটা ওকে আমার আপিসে ডেকে নেবার আর্জি নিয়ে এসেছে, ঐ দিনই ওর কেসের ডেট। তবে? ঐ দিন তো ওর আদালতে থাকার কথা, খামোখা আমার আপিসে আসতে চাইছে কেন? “ ওরা আবার কেস তুলে নেবার জন্য চাপাচাপি করছে ম্যাডাম। আমার বরের আপিসে গিয়ে ধর্ণা দিচ্ছে। ওদের মেয়েটা একটা সরকারী চাকরী পেয়েছে। আমি কেসটা না তুললে তো আর জয়েন করতে পারবে না। পুলিশ ভেরিফিকেশনেই আটকে যাবে। ” অবাক হয়ে জানতে চাইলাম,“তুমি ঐ মেয়েটা মানে তোমার ভাশুরঝির নামেও নালিশ করেছিলে নাকি? ও কি করেছিল?” জবাব পেলাম, “ও দাঁড়িয়ে ভিডিও তুলছিল ম্যাডাম। ওর বাবা মা আমায় পেটাচ্ছিল আর ও ভিডিও তুলছিল। আমি কেস তুলতে চাই না ম্যাডাম। এখনই চাই না। একটি বারও ক্ষমা চায়নি ওরা। একটি বারও কোনদিন আমায় কাকিমা বলে সম্বোধন করেনি মেয়েটা। আমার বর সবই বোঝে,কিন্তু রক্তের সম্পর্ক তো। জলের থেকেও ঘন। ও চায় আমি কেস তুলেনি। উকিল বাবু বললেন, আপনি যদি চিঠি করে ডাকেন, তাহলে সাপও মরবে- আর।”
নাঃ আর কথা বাড়াই নি। একটা মামুলী চিঠি করতে আর কতক্ষণ। তারপর যথারীতি কেটে গেছে অনেকগুলি  দিন। শুনলাম শেষ পর্যন্ত কেসটা তুলেই নিয়েছে মেয়েটা। ওরা আর ফিরে যায়নি ঐ বাড়িতে। ভাড়া বাড়িতেই থাকে। ভাবছে বাড়িটা বিক্রি করে দেবে। তবে যতদিন বৃদ্ধ জীবিত আছেন- ততোদিন না। ভাড়া বাড়িতে বাবা-বউ আর বাচ্ছা নিয়ে সংসার সাজিয়েও, নিজের ভিটেয় বৃদ্ধের শেষ নিশ্বাস ফেলার স্বপ্নটা পূরণ করার স্বপ্ন আজও দেখে চলে ওরা।
✍🏼©Anindita Bhattacharya

No comments:

Post a Comment