তুত্তুরী বলল, “তোমার বাড়ি যাব। ডাকাতী করতে। ” পাপাই (নামটা না হয় পাল্টেই দিলাম) একগাল হেসে বলল, “কিন্তু তুত্তুরী মা, আমার বাড়িতে তো কুকুর আছে-”। “ বুঝলে না তো, তোমার কুতুয়াটাকেই তো চুরি করতে যাব।” কুতুয়া অর্থাৎ শ্রীমান (নাকি শ্রীমতী) শ্যাডো তখন ব্যস্ত পাশের বিল্ডিং এর গেটের ফাঁকে পুঁচকে নাকটা গলাতে। কুচকুচে কালো একরাশ উমনোঝুমনো লোমে ইদানিং ধরেছে গাঢ় কফি রঙের ছোপ। তাই নিয়ে পাপাই আর ওর বউয়ের আফশোসের অন্ত নেই। আমাদের বাড়ির পাশেই কোথায় যেন মোজাম্মেল সাহেবের চেম্বার। পাপাইয়ের চোখে উনি ঈশ্বর। পেশায় কুতুয়াদের সার্জন, উনিই ছোট থেকে বাঁচিয়ে রেখেছেন শ্যাডোকে। শ্যাডোর আসল মালকিন পেশায় ছিল বারগার্ল। প্রতিসন্ধ্যায় হাইরোডের ধারে কোন বারে নাচতে যেত মেয়েটি। একলা ফ্ল্যাটে গলায় দড়ি বেঁধে রেখে যেত মাত্র কয়েকদিন (নাকি মাসখানেকের) বয়সের শ্যাডোকে। শখ করে কিনে তো ছিল, পোষার ক্ষমতা ছিল না। আর পুষবেই বা কখন? সারারাত মেহনত করে, কাক না ডাকা প্রভাতে ফ্ল্যাটে ফিরে ক্লান্তিতে ভেঙে পড়া দেহে ঘুমিয়ে পড়ত মেয়েটি। ঘুম ভাঙতে ভাঙতে বেলা গড়িয়ে যেত মধ্যাহ্ন। তারমধ্যেই যতটা পারত দেখভাল করত- অসুস্থ হয়ে পড়ছিল শ্যাডো, তখন অবশ্য শ্যাডো নামটা হয়নি। এরই মধ্যে কোন একটা ছুটির দিনে পাপাই আর ওর বউকে নিমন্ত্রণ করেছিল শ্যাডোর পুরাতন মালকিন। পাপাইয়ের ছোটবেলার বান্ধবী।ততোদিনে শ্যাডোর লোম ঝরেছে, গা ভর্তি ঘা। তবুও ঐ অবস্থাতেও পাপাইয়ের বউকে দেখে, তার কোলে উঠে পড়েছিল শ্যাডো। ঘেয়ো শ্যাডোকে কোলে নিয়েই সোনালী বলেছিল, “একে আর ফেরৎ দেবো না কিন্তু। ” পরে বহুবার বলেছে পাপাই, “জানেন তো ম্যাডাম, সোনালী বলেছে বলে, পুরো দাম দিয়ে কিনে নিয়েছিলাম ওকে। দেখেছেন তো, কেমনি কুচকুচে কালো রঙ, অন্ধকারে দেখাই যায় না। তাই ওর নাম রেখেছিলাম শ্যাডো। ”
কিনে তো নিল, কিন্তু শ্যাডো যে বড় অসুস্থ। তখনই মোজাম্মেল সাহেবের কাছে আসা। ওণার ওষুধ ছাড়া খায়ই না শ্যাডো। মুস্কিল হল এই লকডাউনে আর বসছেন না ডঃ মোজাম্মেল। ফলতঃ চুঁচুড়ারই কোথা থেকে যেন নৈমিত্তিক কি একটা ইঞ্জেকশন দেওয়া হয়েছে শ্যাডোকে। পাপাই বলে, “কি ব্যথা হয়েছিল ওর দুই পায়ে ম্যাডাম। দুরাত নাড়াতে পারেনি।” তারপর থেকেই নাকি, শ্যাডোর পশ্চাৎদেশের কালো রঙের রোমগুলো খয়েরী হতে বসেছে। শ্যাডো বাবুর অবশ্য কোন হেলদোল নেই তাতে। তিনি দিব্যি আছেন। সারা দিন ঘুমান। সারা রাত জাগেন। মাঝেমাঝে আমার গাড়িতে উঠে আমায় বাড়িতে ছাড়তে আসেন। উদ্দেশ্য তুত্তুরী দিদির সাথে মোলাকাৎ। তুত্তুরী দিদিও আবাসনের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে উদগ্র প্রতীক্ষা নিয়ে। শ্যাডোকে পেলেই সটান কোলে। ওমনি কুচকুচে নখ দিয়ে খুরখুর করে আঁচড়ে দেয় শ্যাডো। তাতে যে লাগে তা নয়, তবে বেদম হাসি পায়। ওমনি গদাম করে ছেড়ে দেয় তুত্তুরী। ঠিক সময় মত ক্যাচ লুফে নেয় সোনালী। নইলে চোট লাগতে পারে না,ছোট্ট বেবিটার।
বেবিই তো। নিজে খেতেও পারে না, এমন ঢ্যাঁড়শ বেবি। সোনালী স্বহস্তে চটকে মুখে পুরে দেয়, তবে তিনি চিবোন। বড় বেশী আরাম প্রিয় বেবি, সোনালী বলে, “জানেন ম্যাডাম, খানিক দৌড়োদৌড়ি করেই উনি ক্লান্ত হয়ে পড়েন, তখন আমাদের বাসন মাজার জায়গায় যে জলের গামলাটা রাখা থাকে, তার মধ্যে পেট ডুবিয়ে বসে থাকেন উনি। তারপর পেট জুড়োলে, ঐ ভিজে গায়ে গোটা বাড়ি, দালান ঘুরে বেড়ায় আর গা ঝাড়া দিয়ে জল ঝাড়ে। আমি যেই রেগে গিয়ে বলি, এক চড় মারব, অমনি সটান খাটের তলায় ঢুকে বসে থাকে। ততোক্ষণ বেরোয় না, যতক্ষণ না ওর বাবা আসছে। ”
এহেন পাপাই-সোনালী আর শ্যাডোর সাদা-কালো-সোনালী দুনিয়ায় কিছুদিন আগে ঢুকেছিল এক অন্য ভাগীদার। কোথা থেকে যেন এক অসুস্থ কুতুয়াকে ধরে এনেছিল পাপাই। জাতে ল্যাব্রাডর। কিন্তু অনাথ। প্রথম মালিকের বাড়িতে ঠাঁই হয়নি। দ্বিতীয় যার কাছে থাকত, সে বছর খানেক শুধু বিরিয়ানি খাইয়েছে। নিজেও খেয়েছে, কুতুয়াকেও খাইয়েছে। ফলতঃ রীতিমত হাড় জিরজিরে চেহারা হয়েছিল কুতুয়াটার। প্রসাবে বেরোচ্ছিল লাল রক্ত। কালেক্টরেটের ড্রাইভারদের মুখে শুনে, আমাকে বাড়ি পৌঁছে ফেরার পথে সটান সেই বাড়ি গিয়ে হাজির নয় পাপাই। তারা তো এককথায় রাজি কুতুয়া হস্তান্তরে। ঘাড় থেকে নামাতে পারলেই বাঁচে। পাপাই বলে, “এমন লক্ষ্মী কুকুর ম্যাডাম, গলার দড়িটা ধরে টানলাম, চুপচাপ আমার পিছু পিছু চলে এসে টোটোয় উঠে পড়ল।” বাড়ি পৌঁছতে, শ্যাডোর চিৎকার দেখে কে? কে এলো রে ভাগীদার।
নতুন অতিথির নাম রাখা হল জন্টি। তার জন্য ডাব আনা হল। শ্যাডো শুধু দুধভাত বা জল দিয়ে চটকানো রুটি বা ডিম সিদ্ধ খেয়েও কাটিয়ে দিতে পারে দিনের পর দিন। এর জন্য নিয়মিত রান্না করতে হত। অফিস ফেরৎ দুটুকরো হলেও মাছ কিনে আনতে হত পাপাইকে, ভেজে শুধু সিদ্ধ ভাতের সঙ্গে মিশিয়ে দিলে, “কি সুন্দর তৃপ্তি করে খেয়ে নেয় ম্যাডাম, দেখলেও চোখে জল আসে।” খাওয়া বা শ্যাডোর হিংসুটে ধমকধামকের থেকেও বড়, বলা যায় সবথেকে সমস্যা হত জন্টি যখন বড়কাজটা করে ফেলত। সোনালী বলে, “শ্যাডোর তো সব আমিই করি বলুন। ওর ধাতও বুঝি। কিন্তু জন্টি যখন করেছিল আমি কাঁদতে শুরু করেছিলাম। কি গন্ধ!” পাপাই আরো ভালো করে বুঝিয়ে দেয়, “ছোট বাচ্ছার গু আর বড় মানুষের পাইখানা যেমন। বুঝলেন কি না-”।
ইত্যবসরে সংসারেও ঘনায় নানা অশান্তি। শাশুড়ী এবং মাসি শাশুড়ীর হাতে দুদফা মার খায় সোনালী। প্রথম বার শুধু কয়োকগাছা কেশ উৎপাটনেই সীমাবদ্ধ থাকে ব্যাপারটা। দ্বিতীয় দফায় মেরে ফাটিয়ে দেয় মাথা। হাসপাতাল থেকে যখন ভীত আতঙ্কিত স্বামী-স্ত্রী আমায় ফোন করে, বলি তৎক্ষণাৎ থানায় যেতে। ধারণা ছিল, থানায় গেলেই, বধূ নির্যাতনের নালিশ দাখিল করলেই, সবাই ঠাণ্ডা হয়ে যায়। বাস্তবে দেখলাম, আমিই ভুল ছিলাম। কোন ব্যবস্থা তো নেওয়া হলই না। উল্টে থানার জনৈক বাবু সোনালীকে বলল, “এত ভিড়ের মধ্যে এসব কথা আলোচনা করা যায় না। আমি তো একাই থাকি, আমার কোয়ার্টারে চলে আসুন বরং।” শুনে ওর থেকেও বেশী অসহায় বোধ করেছিলাম আমি। কি করি? কি ভাবে বাঁচাই মেয়েটাকে। সদ্য গেছে আমফান। জেলা প্রশাসন চরম ব্যস্ত ত্রাণের কাজে। ওদিকে নৈমিত্তিক অত্যাচার আর অশান্তি বেড়েই চলে বাড়িতে। যোগাযোগ করি পরিচিতি নামক এনজিওর সাথে। ওরা এই ধরণের নির্যাতিত মেয়েদের পাশে দাঁড়ায়। কর্ণধার শ্রীমতী অঞ্চিতা ঘটকের সাথে যোগাযোগ চন্দননগরের বড় সাহেবের মাধ্যমে। প্রথম যখন ফোন করি, অঞ্চিতাদি ওয়েবইনারে ব্যস্ত ছিলেন। বাইরে ঘোর লকডাউন, তারই মধ্যে আমার চেম্বারে বসে হাপুস নয়নে কেঁদে যাচ্ছে মেয়েটা। থানার বাবুর কণ্ঠ স্পিকার ফোনের দৌলতে সারা আপিস শুনেছে। ওয়েবইনার মিটতেই অঞ্চিতাদির ফোন, প্রথম প্রশ্নটাই ছিল, ‘বরটা কি বলছে?’ জানালাম বরটা নিজেও ভোম্বল হয়ে বসে আছে আমার ঘরে। নেহাত কাঁদলেই সবকটাকে দূর করে দেব বলে ভয় দেখিয়েছি তাই-। অঞ্চিতাদির কথা শুনে বুঝলাম, এই ধরণের বধূ নির্যাতনের কেসে যদি বরের সমর্থন থাকে, তাহলে অর্ধেকটা যুদ্ধ জেতাই হয়ে গেছে। বাকিটার জন্য নিয়োগ করা হল,ওণাদেরই এক সদস্যকে। লকডাউন, ট্রেন চলছে না, ফলে সশররীরে হয়তো আসতে পারেনি, তবুও বলতে বাধ্য যে,শুভ্রা নামক মেয়েটি, নিয়মিত শুধু সোনালী আর পাপাইয়ের সাথে যোগাযোগ রেখেছে তাই নয়, বাড়িয়ে গেছে ওদের মনোবল। নিজে কথা বলেছে থানায়। ওর নির্দেশমত চিঠির পর চিঠি নিয়ে গিয়ে বসে থেকেছে সোনালী।
এই টালমাটাল অবস্থায় একদিন পাপাই বলল, “জন্টিকে কাউকে দিয়ে দেব ম্যাডাম। এইভাবে হয় না। এত মনমেজাজ খারাপ আমাদের। অধিকাংশ দিন রান্নাই হয় না। অন্তত মাস দুয়েকের জন্য হলেও দিয়ে দেব। ” বাড়িতে এসে জানালাম, ‘ভাবছি আমিই নিয়ে আসব ধেড়ে কুতুয়াটাকে-”। তুত্তুরী লাফাতে লাগল ধেইধেই। “জন্মদিনে কুতুয়া পাব।” মাসিও গররাজি হল। দুইটা মাসের তো ব্যাপার। শৌভিক একেবারে অনড়। “আমি জানি, এই বাড়িতে কেউ এলে সব দায় আমারই হবে। তোরা তো মা-মেয়ে,কুতুয়ার পটি দেখেই অজ্ঞান হয়ে যাবি। তারপর তাকে ফেলবে কে? আর সকালবেলা কুতুয়াটাকে নিয়ে যখন হাঁটতে বা ইয়ে করাতে নিয়ে যেতে হবে, আবাসনের নেড়িগুলো তেড়ে আসবে? তোরা মা-মেয়ে হা-হা করে কুতুয়া ফেলে ছুটে পালিয়ে আসবি। আমার সব দেখা আছে। আমি নেই। কুতুয়া আনলে আমি গৃতত্যাগী হব। ”কথাগুলো যে খুব ভুল, তা জোর গলায় বলতে পারলাম না। তারওপর তখনও জানি না, সপ্তাহখানেকের মধ্যেই অতিমারিতে আক্রান্ত হতে চলেছি আমরা মা আর মেয়ে।
আপাততঃ একটা ভালো বাড়িতে ঠাঁই হয়েছে জন্টির। থানার বাবুকে টাইট দেওয়া গেছে। অন্য বাবু অত্যন্ত সহৃদয়তার সাথে নিয়েছেন সোনালীর কেস। কড়কে দিয়েছেন শাশুড়ী এবং তার বোন- বোনপো- বোনঝিকে। আদালত খুললে কেসও উঠবে। পরের সন্তানকে মেরে মাথা ফাটিয়ে দেওয়া বা চারজন মিলে একটি মেয়েকে মারধর করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। শুভ্রা তথা পরিচিতি এখনও নিয়মিত যোগাযোগ রেখে চলেছে।
জন্টি আপাততঃ খুব ভালো আছে। আর ফিরছে না। একথা অনস্বীকার্য যে জন্টি বিদেয় হতে সবথেকে খুশি শ্যাডো। একলা রাজকুমার(ঈ)। মানসিক ভারমুক্ত সোনালী আজকাল আমায় বারবার বলে, “জন্টিকে নেননি, খুব ভালো করেছেন ম্যাডাম। নিলেও ছোট কুতুয়া নেবেন, কেমন? বড় কুতুয়ার পটি- ম্যাগো। ওয়াক থুঃ। ” শুনতে শুনতে ঘরের একজনের কথা মনে পড়ে যায়, সাধে কি বলে গরীবের কথা, বাসি হলে-
No comments:
Post a Comment