আনলক ডাউন শুরু হতে তখনও বাকি বেশ কয়েকটা সপ্তাহ, ঘোরতর গৃহবন্দী ভারতবর্ষ। মাঝ সপ্তাহেও জনশূন্য আমাদের চুঁচুড়ার আপিসপাড়া। হাতে গোণা কর্মী নিয়ে ভর দুপুরেও বুড়ো কালেক্টরেটটা যেন হানাবাড়ি।
এমনই এক দুপুরে হঠাৎ এসে হাজির হয়েছিলেন বাপন বাবু (নামটা পাল্টে দিলাম)। এসেছিলেন মহকুমা শাসকের কাছে নালিশ ঠুকতে। তিন মাস হয়ে গেল, বেতন পাননি। রীতিমত ভেঙে পড়েছেন ভদ্রলোক, জরুরী পরিষেবা দেন উনি, ধরে নিন কোন পঞ্চায়েতে জল সংক্রান্ত কোন কাজ করেন। ঘোরতর লকডাউনের মধ্যেও তিনমাস কাজ করে গেছেন অনর্গল। অথচ পাননি মজুরী। সংসারে নিত্য অনটন, বাড়িতে অসুস্থ সন্তান- বলতে বলতে হাউহাউ করে কেঁদে ফেললেন ভদ্রলোক।
কান্না আর ফোঁপানি থামাতে বেশ বেগ পেতে হল। পর্যায়ক্রমে সুজয় বাবুর ঘোর কালো চা আর বাতানুকূল যন্ত্রের হাওয়া খাইয়ে খানিকটা শান্ত করার পর দেখতে চাইলাম কাগজপত্র কি আছে।
ওণার গলায় ঝোলানো জনৈক সরকারী দপ্তরের আইকার্ড। কিন্তু বাকি কাগজপত্র তেমন উৎসাহ ব্যঞ্জক নয়। সবই ঐ দপ্তর থেকে পঞ্চায়েতের কোন কমিটির সাথে পত্রালাপ- অর্ডার ইত্যাদি। কোথাও ওণার নাম নেই। শুনে বুঝতে পারলাম, জলসম্পদ সম্পর্কিত কোন পরিকাঠামো নির্মাণ করার পর, বাপন বাবু সমেত সমস্ত দায়িত্ব পঞ্চায়েতের কমিটির হাতে তুলে দিয়েছে সরকারী দপ্তর। টাকাপয়সা এখনও তাঁরাই দেন বটে, ব্যবস্থাপনাটা দেখে কমিটি।
মাসে ২৮দিন কাজ করেন বাপন বাবু, ফেব্রুয়ারি মাস অবধি ঠিকঠাক বেতনও পেয়েছেন। মার্চে লকডাউন ঘোষণা হওয়াতে বিলম্বিত হয়ে পড়ে বেতন। অনটনের সংসার। উনি লকডাউনের মাঝেই নিয়ম করে তাগাদা দিতে থাকেন। ইতিমধ্যে আচমকা অসুস্থ হয়ে পড়ে ওণার কন্যা, একে অর্থাভাব তায় ওণার আবেদনে কেউ কর্ণপাত করছে না দেখে, স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে বেতনের অনুরোধ জানান ওণার স্ত্রী।
এখান থেকেই শুরু হয় মূল সমস্যা। ঘরের মেয়েছেলে কেন ফোন করে টাকা চাইবে? এই নিয়ে যৎপরনাস্তি ভর্ৎসনা করে ভাগিয়ে দেওয়া হয় ওণাকে।
সেই থেকে বেতনের দাবীতে নানা আপিসে ঘুরছেন উনি। আজ এসেছেন মহকুমা শাসকের কাছে ফরিয়াদ জানাতে।
যেহেতু সমস্যাটা বেতন সম্পর্কিত, তাই মহকুমা শাসকের কাছে যাবার আগে দিন দশেক সময় চেয়েনিলাম। লকডাউনে বন্ধ পোস্টাফিস, অগত্যা মেইলই ভরসা। আমাদের ইন্সপেক্টর নির্মলের এলাকা, ওর মাধ্যমেই পঞ্চায়েতের মেইল আইডি যোগার করে ওণার আবেদনের কপিটা পাঠানো হল। সংশ্লিষ্ট দপ্তরের মূখ্য ইঞ্জিনিয়ার সাহেবকেও জানানো হল ব্যাপারখানা। সাথে মূখ্য সচীবের নির্দেশ, লকডাউনের বেতন অবশ্যই দিতে হবে। আর এ বেচারা তো নিয়মিত কাজ করেছে।
দিন দুয়েকের মধ্যেই জবাব পেলাম। পঞ্চায়েতের তরফ থেকে জানানো হল, ওণার চেক তৈরি আছে। উনি নিয়ে নিলেই ল্যাটা চুকে যায়। ওণাকে জানানো হল- ভাবলাম যাক ঝামেলা মিটল তাহলে। পরের দিন আবার এসে হাজির বাপন বাবু। চেকটা নেননি উনি। কেন রে?
শুনলাম ওণার যা প্রাপ্য তার থেকে অনেক কম টাকা ধার্য করা হয়েছে ওণার জন্য। ফেব্রুয়ারী মাসেও যিনি বেতন পেয়েছেন বারো হাজার টাকারও বেশী, সেখানে আমার চিঠির গুঁতোয় বর্তমানে ওণার জন্য ধার্য হয়েছে তিন মাসে থোক ১৪হাজার। এতো মহা জ্বালা। আনলক ডাউন শুরু হওয়া অবধি আর অপেক্ষা করা গেল না, তার আগেই ডাকতে হল মিটিং। কমিটি এবং দপ্তরের ইঞ্জিনিয়ার সাহেব উভয়কেই অনুরোধ করা হল কাউকে পাঠান। দপ্তর থেকে নির্দিষ্ট দিনে এসে হাজির হলেন জুনিয়র ইঞ্জিনিয়র সাহেব। পাত্তা নেই পঞ্চায়েতের কমিটির। এদিকে বাপন বাবু রোজই এসে বসে থাকেন আমাদের দপ্তরে। দেখতে পেলেই সামাজিক দূরত্ব ভেঙে ধরতে আসেন পা। সংসার চলছে না। মেয়ে অসুস্থ। নিজেই বলেন, “মাথার ঠিক নেই ম্যাডাম।”
প্রথম মিটিং ব্যর্থ হলেও দেখলাম ইঞ্জিনিয়ার সাহেব বাপন বাবুর প্রতি অত্যন্ত সহানুভূতিশীল। ওণারা শ্রম কমিশনারেটের সাথে পূর্ণ সহযোগিতা করতে চান, কিন্তু ফেঁসে আছেন নিয়মের গেরোতে।
দ্বিতীয় মিটিং ডাকা হল। এবার এলেন জনৈক পদাধিকারী খোদ। জানালেন উনি ব্যস্ত মানুষ,পকেটে বিডিও সাহেবের ডাকা মিটিং এর চিঠি, জরুরী মিটিং ফেলে এসেছেন একটা পেটি ব্যাপার নিয়ে বারবার আমরা গুঁতো মারছি তাই। ইঞ্জিনিয়ার সাহেব এবং আমার যুগপৎ ধমকে একটু থমকে গেলেন অবশ্য। ভেবেচিন্তে জানালেন, বাপন বাবুর বেতন কত হওয়া উচিৎ তা ওণারা জানেন না। জানলে মিটিয়ে দেবেন বটে। ঠিক হল একটা চিঠি করে ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের সংশ্লিষ্ট দপ্তর জানিয়ে দিলেই ওণারা সেই মত দিয়ে দেবেন।
বাপন বাবুকে বলা হল, দিন দশেক ধৈর্য্য ধরুন। হয়েই যাবে এবার। দিন কয়েকের মধ্যেই মজুরীর চিঠিও করে দিলেন মূখ্য ইঞ্জিনিয়ার সাহেব। একেবারে আমার বলে দেওয়া বয়ানে, শ্রমদপ্তরের নির্ধারিত ন্যূনতম মজুরী মেনে। ভাবলাম মিটেই গেল কেসটা। একটা সংসার অন্তত বাঁচল আমাদের ধমক-ধামকে।
ও হরি। এক সপ্তাহ বাদে নির্মলের ফোন, “ম্যাডাম, লোকটা রোজ ফোন করে কান্নাকাটি করছে। বেতন তো দেয়ই নি। উল্টে ধমকাচ্ছে শ্রম কমিশনারের ক্ষমতা নেই, পঞ্চায়েতের ব্যাপারে নাক গলায়। দেখে নেব, কেমন করে বেতন পাও তুমি। ” ধমকের কথা শুনে মজা লেগেছিল, সাহস থাকলে আমার সামনে এসে বলে যেত -।
কিন্তু মুস্কিল হচ্ছে না দিলে এবার কি করব? বেসরকারী সংস্থান হলে,সোজা ইন্সপেক্টর পাঠিয়ে তুলে আনাতাম খাতাপত্র। গুনে গুনে প্রতিটা শ্রম আইনের প্রতিটি ধারা-উপধারায় কেস দেবার ভয় দেখাতাম হয়তো, কিন্তু সরকারে থেকে সরকারের বিরুদ্ধে কেস করা এত্ত সোজা নয়। অনুমতি লাগে অনেক উচ্চ মহল থেকে, যা প্রায় কখনই আসে না। এমনি একখানি কেসের আবেদন করে নির্মল আর আমি বসে আছি বছর দেড়েক। ততোদিনে তো লোকটা সপরিবারে আত্মঘাতী হবে। অন্তত মুখে তো তাই বলছে।
পঞ্চায়েতের বিরুদ্ধে কি শ্রম আইনে ইন্সপেকশন বা কেস করব আমরা? ওপরতলার সমর্থন ছাড়া ব্যাপারটায় এগিয়ে যাওয়া অসম্ভব। অবশেষে বড় সাহেবের শরণাপন্ন হলাম আমরা। স্যার অর্ধেকটা শুনেই জারি করলেন ফরমান, “অত ভাবার দরকার নেই। ইন্সপেকশন করাও এবং পে কেস ঠুকে দাও।”
যুগ্ম ইন্সপেকশনে পাঠানো হল, আমার দুই তুখোড় ইন্সপেক্টর নির্মল আর সঞ্চিতাকে, আগের দিন বদ্ধ কামরায় তিন মাথা এক হয়ে ঠিক করা হল, কি ভাবে এগোবে ওরা। কে যেন ইতিমধ্যেই হুমকি দিয়েছে নির্মলকে জনৈক দাদার নামে-
দিদির জমানায়, দাদাদের অত ডরাই না আমরা, তবে সামান্য বেচাল হলে কেসটা কেঁচে গণ্ডুষ হবে। নির্মল আর সঞ্চিতার মাখন মার্কা ভয় দেখানোতেই হয়তো অবশেষে ওনারা রাজি হলেন বেতন দিতে। গত শুক্রবার তিন মাসের বেতন একসাথে পেয়েই ছুটে এসেছিলেন বাপন বাবু। বারবার কৃতজ্ঞতা জানিয়ে গেলেন স্যারের উপস্থিতিতে, জানতে চাইলাম, “চেকে আপনার নামটা ঠিক লিখেছে তো?” উনি ঘাবড়ে গিয়ে বললেন, “তা তো দেখিনি ম্যাডাম। পেয়েই ছুটে এসিছি আপনার কাছে। যদি আপনার সাথে না দেখা হয়- সেই টেনশনে আর নামের বানানটা দেখা হয়নি। এখন দেখলে হবে ম্যাডাম?” ফাইলটা ক্লোজ করতে করতে জানালাম, তা দেখুন আর একটা ছবি না তুলে যাবেন না যেন- এই ছবিগুলোই আমাদের ট্রফি। আর এই ট্রফি কখনই জেতা যায় না যদি না টিমে খেলা হয়- আর বড় সাহেব থেকে আমি হয়ে সুকন্যা ঘুরে নির্মল-সঞ্চিতা আমাদের টিমটাই যে ছিল জবরদস্ত। ছবিতে নির্মলের সাথে বাপন বাবু।
পুনশ্চঃ- সুকন্যার নামটা কেন করলাম? আমাকে যাবতীয় আইনি বদবুদ্ধি কে দেয় বলুন তো? নামটা উহ্যই থাক বরং।
No comments:
Post a Comment