“মেলা বসাবে তুত্তুরী, রথের মেলা। মা যেমন বসায় শ্রমিক মেলা, ঠিক তেমনি। কোন এক পাহাড়ের কোলে, ছলছলে কোন নদীর তীরে, ঘন সবুজ গাছপাতায় মোড়া কোন উপত্যকায় বসবে তুত্তুরীর রথের মেলা। উপত্যকাকে ঘিরে বাস করে অনেক দীনদরিদ্র মানুষ, জঙ্গল থেকে কাঠকুটো জোগাড় করে, কখনও বা বুনো শুয়োর শিকার করে চলে তাদের সংসার। তাদের নিয়ে, তাদের জন্যই মেলা বসাবে শ্রীমান তুত্তুরী।
ঝড়ে উপড়ে পড়া জংলী গাছ দিয়ে তৈরী হবে রথ, তিনতিনটে রথ- কাঠ কি কম পড়িতেছে? চিন্তা নেই, বিগত দুর্গাপুজোয় যখন দাদু-মামমাম আর তুত্তুরী গিয়ে পৌঁছেছিল স্বপ্নময় উপত্যকায়,তখন বসতি স্থাপন করার জন্য সাফ করা হয়েছিল অকিঞ্চিৎ জঙ্গল। সেই সব কাঠ যত্ন করে গুছিয়ে রেখেছে মামমাম।আর উপত্যকার অধিবাসীদের জন্য অবারিত দাদুর তুত্তুরী ভিলা।
তৈরি হওয়া রথগুলিকে টানতে টানতে চিত্রকরদের কাছে দিয়ে আসে তুত্তুরী। বারেঃ রঙ করতে হবে তো? ওদিকে মাটির পুতুল গড়িয়েরা বানাতে শুরু করল হাত কাটা তিন ভাইবোন। মাঝে মাঝেই নজরদারী করে আসে তুত্তুরী, উৎসাহের আতিশয্যে ব্যাটারা আবার হাত-পা না বানিয়ে বসে-
এমনি একদফা পর্যবেক্ষণ করে ফিরছিল দাদু আর তুত্তুরী, চতুর্দিকে শালপ্রাংশু মহাভুজের সারি মাঝখান দিয়ে সরু পায়ে চলা পথের ওপর আড়ামোড়া ভাঙা কচি মেঘের দল, গল্প বলতে বলতে এগিয়ে চলেছে দাদু পাশাপাশি তাল মিলিয়ে হাঁটার চেষ্টা করছে মন্ত্রমুগ্ধ তুত্তুরী, আচমকা কি যে হল, চেনা পথটা হঠাৎ করে শেষ হয়ে গেল- আর তুত্তুরী সবিস্ময়ে দেখল সামনে দাঁড়িয়ে আছে এক পোড়ো মন্দির। কোন মান্ধাতার আমলে তৈরি কে জানে, কত বছর কোন জনমনিষ্যির পা পড়েনি কে জানে। মন্দিরের চালের ওপর গজিয়ে উঠছে বিশাল বটের চারা। যার মোটা মোটা শিকড় আর ঝুড়ি নেমেছে মন্দিরের গা বেয়ে। মন্দিরের ভাঙা দুয়ার। ভিতরে শূণ্য বেদীতে লেপা আছে কবেকার সিঁদুর- তুত্তুরী চিৎকার করে উঠল, “ইউরেকা! পেয়েছি দাদু। পেয়েছি। মাসির বাড়ি পেয়েছি। এই বেদীতেই বসাব মাসির মূর্তি।” এই অবধি শুনেই বিষম খায় মাসি। চোখ গোলগোল করে ধমকে ওঠে তুত্তুরী, “আহঃ তুমি নয়। জগন্নাথদেবের মাসি। ”
ওদিকে তুত্তুরীর উপত্যকায়, তৈরি হতে থাকে মাসির মূর্তি। মামমামকে (দিদা) নিয়ে দূরের ছোট্ট শহরে পৌঁছয় তুত্তুরী। গয়না গড়াতে হবে যে। জগন্নাথ-বলরাম আর সুভদ্রার জন্য এই মোটা মোটা সোনার হার আর সুভদ্রার নাকের নথ। মাসির জন্য কিছু বানাবি না, প্রশ্ন করে মামমাম, “নাঃ। মাসি তো গরীব। জঙ্গলে থাকে। ঝুটো গয়না পরে মাসি।”
দেখতে দেখতে এসে যায় রথের দিনটা। তার আগের রাতে সমগ্র উপত্যকা জুড়ে গড়ে ওঠে অসংখ্য চালা দোকান। কি নেই তাতে, খাবার-দাবার- এই অবধি বলেই থামে তুত্তুরী, “খাবার স্টলে থাকবে খাজা, জিলিপি,পেরাকি,রসগোল্লা আর লবঙ্গলতিকা। আর থাকবে কাঠি বরফ আর কুলফির দোকান।”। এছাড়া থাকবে অনেকজন গ্যাসবেলুনওয়ালা। তারা সবাই জোকারের মত ঝলঝলে পোশাক পরে, সাইকেলে চেপে ঘুরে বেড়াবে মেলাময়। প্রতিটি সাইকেলের সামনে বাঁধা থাকবে চৌকো গ্যাসের ট্যাঙ্ক আর সাইকেলের কেরিয়ারে বাঁধা থাকবে বিভিন্ন আকৃতির গ্যাসবেলুন। গ্যাসবেলুনের দামও বেঁধে দিয়েছে তুত্তুরী, ১টাকায় ১টা। আর কুলফি/ কাঠি বরফের দাম ১টাকায় ২টো। বাচ্ছারা যাতে চুটিয়ে উপভোগ করতে পারে রথের মজা। আর থাকবে বাঁশ, কাঠ আর মাটির পুতুলের দোকান। থাকবে তালপাতার বাঁশি,ঢোল আর ঢুগঢুগি। থাকবে কাঁচের রেশমি চুড়ি, ঝুটো গয়নার দোকান। বিক্রি হবে নানা ধরণের কলম আর সাবানের বুদবুদ তৈরির খেলনা। থাকবে নাগরদোলা, মেরি-গো-রাউণ্ড আর টয় ট্রেন। ছলছলে নদীর সাথে পাল্লা দিয়ে ছুটবে খেলনা ট্রেন। গন্তব্য মাসির বাড়ি।
রথের দিন সকাল থেকেই যাতে বাচ্ছারা চুটিয়ে আনন্দ করতে পারে,সেদিকে কড়া নজর রাখে তুত্তুরী। তুত্তুরীর নির্দেশে উপত্যকাবাসী নিঃসহায় বিধবারা সানন্দে বানিয়ে ফেলে রসগোল্লার পাহাড়। বিশাল বিশাল পাত্রে টগবগ করে ফোটে রস, ছপাছপ ঝাঁপিয়ে পড়ে কাঁচা রসগোল্লার দল। তুত্তুরী ভিলার সামনে এসে পৌঁছয় তিন তিনটে রথে সওয়ার তিন ভাইবোন। এসে পৌঁছয় ফুল আর গয়না। রথের দিন সকাল আটটা থেকে রথ সাজাতে বসে মামমাম। হাঁটুর ব্যথা তাই ওপরে তো উঠতে পারবে না, তাই উপত্যকাবাসী তুত্তুরীর বন্ধুরা এগিয়ে আসে সাহায্য করতে। ফুলে ফুলে অপরূপ সেজে ওঠে তিন ভাইবোনের বাহন। ঘনিয়ে আসে মাহেন্দ্রক্ষণ, তিন ভাইবোনের গলায় ঝুলিয়ে দেওয়া হল সোনার কণ্ঠহার। সুভদ্রার নাকে ঝোলে নোলক। কুচানো ফুলের সাজি নিয়ে রথে চাপে পাণ্ডাবেশী কুচোকাচার দল। তুত্তুরী নিজে ওঠে সুভদ্রার রথে। শুরু হয় তুত্তুরীর রথের মাসির বাড়ি যাত্রা। উপত্যকা জুড়ে বয়ে যায় আনন্দধারা- পথের ধারে সমবেত হয় হাসিখুশি উপত্যকাবাসী। পিঁ পিঁ করে বেজে ওঠে তালপাতার বাঁশি, প্রত্যুত্তরে শিলাবৃষ্টির মত রথের ওপর থেকে ধেয়ে আসে ফুলের কুচি আর বাতাসা। হুড়োহুড়ি লেগে যায় কুচোকাচাগুলোর মধ্যে। খিলখিলিয়ে ওঠে তুত্তুরীর উপত্যকা-”
✍🏼©তুত্তুরী থুড়ি পুরোযা ভট্টাচার্য
No comments:
Post a Comment