Sunday 5 July 2020

অনির ডাইরি ৪ঠা জুলাই, ২০২০


আনলক ডাউন শুরু হতে তখনও বাকি বেশ কয়েকটা সপ্তাহ, ঘোরতর গৃহবন্দী ভারতবর্ষ। মাঝ সপ্তাহেও জনশূন্য আমাদের চুঁচুড়ার আপিসপাড়া। হাতে গোণা কর্মী নিয়ে ভর দুপুরেও বুড়ো কালেক্টরেটটা যেন হানাবাড়ি।
এমনই এক দুপুরে হঠাৎ এসে হাজির হয়েছিলেন বাপন বাবু (নামটা পাল্টে দিলাম)। এসেছিলেন মহকুমা শাসকের কাছে নালিশ ঠুকতে। তিন মাস হয়ে গেল, বেতন পাননি। রীতিমত ভেঙে পড়েছেন ভদ্রলোক, জরুরী পরিষেবা দেন উনি, ধরে নিন কোন পঞ্চায়েতে জল সংক্রান্ত কোন কাজ করেন। ঘোরতর লকডাউনের মধ্যেও তিনমাস কাজ করে গেছেন অনর্গল। অথচ পাননি মজুরী। সংসারে নিত্য অনটন, বাড়িতে অসুস্থ সন্তান- বলতে বলতে হাউহাউ করে কেঁদে ফেললেন ভদ্রলোক।
কান্না আর ফোঁপানি থামাতে বেশ বেগ পেতে হল। পর্যায়ক্রমে সুজয় বাবুর ঘোর কালো চা আর বাতানুকূল যন্ত্রের হাওয়া খাইয়ে খানিকটা শান্ত করার পর দেখতে চাইলাম কাগজপত্র কি আছে। 
ওণার গলায় ঝোলানো জনৈক সরকারী দপ্তরের আইকার্ড। কিন্তু বাকি কাগজপত্র তেমন উৎসাহ ব্যঞ্জক নয়। সবই ঐ দপ্তর থেকে পঞ্চায়েতের কোন কমিটির সাথে পত্রালাপ- অর্ডার ইত্যাদি। কোথাও ওণার নাম নেই। শুনে বুঝতে পারলাম, জলসম্পদ সম্পর্কিত কোন পরিকাঠামো নির্মাণ করার পর, বাপন বাবু সমেত সমস্ত দায়িত্ব পঞ্চায়েতের কমিটির হাতে তুলে দিয়েছে সরকারী দপ্তর। টাকাপয়সা এখনও তাঁরাই দেন বটে, ব্যবস্থাপনাটা দেখে কমিটি।

মাসে ২৮দিন কাজ করেন বাপন বাবু, ফেব্রুয়ারি মাস অবধি ঠিকঠাক বেতনও পেয়েছেন। মার্চে লকডাউন ঘোষণা হওয়াতে বিলম্বিত হয়ে পড়ে বেতন। অনটনের সংসার।  উনি লকডাউনের মাঝেই নিয়ম করে তাগাদা দিতে থাকেন। ইতিমধ্যে আচমকা অসুস্থ হয়ে পড়ে ওণার কন্যা, একে অর্থাভাব তায় ওণার আবেদনে কেউ কর্ণপাত করছে না দেখে, স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে বেতনের অনুরোধ জানান ওণার স্ত্রী।
এখান থেকেই শুরু হয় মূল সমস্যা। ঘরের মেয়েছেলে কেন ফোন করে টাকা চাইবে? এই নিয়ে যৎপরনাস্তি ভর্ৎসনা  করে ভাগিয়ে দেওয়া হয় ওণাকে।
সেই থেকে বেতনের দাবীতে নানা আপিসে ঘুরছেন উনি। আজ এসেছেন মহকুমা শাসকের কাছে ফরিয়াদ জানাতে।
যেহেতু সমস্যাটা  বেতন সম্পর্কিত, তাই মহকুমা শাসকের কাছে যাবার আগে দিন দশেক সময় চেয়েনিলাম।  লকডাউনে বন্ধ পোস্টাফিস, অগত্যা মেইলই ভরসা। আমাদের ইন্সপেক্টর নির্মলের এলাকা, ওর মাধ্যমেই পঞ্চায়েতের মেইল আইডি যোগার করে ওণার আবেদনের কপিটা পাঠানো হল। সংশ্লিষ্ট দপ্তরের মূখ্য ইঞ্জিনিয়ার সাহেবকেও জানানো হল ব্যাপারখানা। সাথে মূখ্য সচীবের নির্দেশ, লকডাউনের বেতন অবশ্যই দিতে হবে। আর এ বেচারা তো নিয়মিত কাজ করেছে।

দিন দুয়েকের মধ্যেই জবাব পেলাম।  পঞ্চায়েতের তরফ থেকে জানানো হল, ওণার চেক তৈরি আছে। উনি নিয়ে নিলেই ল্যাটা চুকে যায়। ওণাকে জানানো হল- ভাবলাম যাক ঝামেলা মিটল তাহলে। পরের দিন আবার এসে হাজির বাপন বাবু। চেকটা নেননি উনি। কেন রে?

শুনলাম ওণার যা প্রাপ্য তার থেকে অনেক কম টাকা ধার্য করা হয়েছে ওণার জন্য। ফেব্রুয়ারী মাসেও যিনি বেতন পেয়েছেন বারো হাজার টাকারও বেশী, সেখানে আমার চিঠির গুঁতোয় বর্তমানে ওণার জন্য ধার্য হয়েছে তিন মাসে থোক ১৪হাজার। এতো মহা জ্বালা। আনলক ডাউন শুরু হওয়া অবধি আর অপেক্ষা করা গেল না, তার আগেই ডাকতে হল মিটিং। কমিটি এবং দপ্তরের ইঞ্জিনিয়ার সাহেব উভয়কেই অনুরোধ করা হল কাউকে পাঠান। দপ্তর থেকে নির্দিষ্ট দিনে এসে হাজির হলেন জুনিয়র ইঞ্জিনিয়র সাহেব। পাত্তা নেই পঞ্চায়েতের কমিটির। এদিকে বাপন বাবু রোজই এসে বসে থাকেন আমাদের দপ্তরে। দেখতে পেলেই সামাজিক দূরত্ব ভেঙে ধরতে আসেন পা। সংসার চলছে না। মেয়ে অসুস্থ। নিজেই বলেন, “মাথার ঠিক নেই ম্যাডাম।”
প্রথম মিটিং ব্যর্থ হলেও দেখলাম ইঞ্জিনিয়ার সাহেব বাপন বাবুর প্রতি অত্যন্ত সহানুভূতিশীল। ওণারা শ্রম কমিশনারেটের সাথে পূর্ণ সহযোগিতা করতে চান, কিন্তু ফেঁসে আছেন নিয়মের গেরোতে।

দ্বিতীয় মিটিং ডাকা হল। এবার এলেন জনৈক পদাধিকারী খোদ। জানালেন উনি ব্যস্ত মানুষ,পকেটে বিডিও সাহেবের ডাকা মিটিং এর চিঠি, জরুরী মিটিং ফেলে এসেছেন একটা পেটি ব্যাপার নিয়ে বারবার আমরা গুঁতো মারছি তাই। ইঞ্জিনিয়ার সাহেব এবং আমার যুগপৎ ধমকে একটু থমকে গেলেন অবশ্য। ভেবেচিন্তে জানালেন, বাপন বাবুর বেতন কত হওয়া উচিৎ তা ওণারা জানেন না। জানলে মিটিয়ে দেবেন বটে। ঠিক হল একটা চিঠি করে ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের সংশ্লিষ্ট দপ্তর জানিয়ে দিলেই ওণারা সেই মত দিয়ে দেবেন।
বাপন বাবুকে বলা হল, দিন দশেক ধৈর্য্য ধরুন। হয়েই যাবে এবার। দিন কয়েকের মধ্যেই মজুরীর চিঠিও করে দিলেন মূখ্য ইঞ্জিনিয়ার সাহেব। একেবারে আমার বলে দেওয়া বয়ানে, শ্রমদপ্তরের নির্ধারিত ন্যূনতম মজুরী মেনে। ভাবলাম মিটেই গেল কেসটা। একটা সংসার অন্তত বাঁচল আমাদের ধমক-ধামকে।

ও হরি। এক সপ্তাহ বাদে নির্মলের ফোন, “ম্যাডাম, লোকটা রোজ ফোন করে কান্নাকাটি  করছে। বেতন তো দেয়ই নি। উল্টে ধমকাচ্ছে শ্রম কমিশনারের ক্ষমতা নেই, পঞ্চায়েতের ব্যাপারে নাক গলায়। দেখে নেব, কেমন করে বেতন পাও তুমি। ” ধমকের কথা শুনে মজা লেগেছিল, সাহস থাকলে আমার সামনে এসে বলে যেত -।
কিন্তু মুস্কিল হচ্ছে না দিলে এবার কি করব? বেসরকারী সংস্থান হলে,সোজা ইন্সপেক্টর পাঠিয়ে তুলে আনাতাম খাতাপত্র। গুনে গুনে প্রতিটা শ্রম আইনের প্রতিটি ধারা-উপধারায় কেস দেবার ভয় দেখাতাম হয়তো, কিন্তু সরকারে থেকে সরকারের বিরুদ্ধে কেস করা এত্ত সোজা নয়। অনুমতি লাগে অনেক উচ্চ মহল থেকে, যা প্রায় কখনই আসে না। এমনি একখানি কেসের আবেদন করে নির্মল আর আমি বসে আছি বছর দেড়েক। ততোদিনে তো লোকটা সপরিবারে আত্মঘাতী হবে। অন্তত মুখে তো তাই বলছে।
পঞ্চায়েতের বিরুদ্ধে কি শ্রম আইনে ইন্সপেকশন বা কেস করব আমরা? ওপরতলার সমর্থন ছাড়া ব্যাপারটায় এগিয়ে যাওয়া অসম্ভব। অবশেষে বড় সাহেবের শরণাপন্ন  হলাম আমরা। স্যার অর্ধেকটা শুনেই জারি করলেন ফরমান, “অত ভাবার দরকার নেই। ইন্সপেকশন করাও এবং পে কেস ঠুকে দাও।”

যুগ্ম ইন্সপেকশনে পাঠানো হল, আমার দুই তুখোড় ইন্সপেক্টর নির্মল আর সঞ্চিতাকে, আগের দিন বদ্ধ কামরায় তিন মাথা এক হয়ে ঠিক করা হল, কি ভাবে এগোবে ওরা। কে যেন ইতিমধ্যেই হুমকি দিয়েছে নির্মলকে জনৈক দাদার নামে-

দিদির জমানায়, দাদাদের অত ডরাই না আমরা, তবে সামান্য বেচাল হলে কেসটা কেঁচে গণ্ডুষ হবে। নির্মল আর সঞ্চিতার মাখন মার্কা ভয় দেখানোতেই হয়তো অবশেষে ওনারা রাজি হলেন বেতন দিতে। গত শুক্রবার তিন মাসের বেতন একসাথে পেয়েই ছুটে এসেছিলেন বাপন বাবু। বারবার কৃতজ্ঞতা জানিয়ে গেলেন স্যারের উপস্থিতিতে, জানতে চাইলাম, “চেকে আপনার নামটা ঠিক লিখেছে তো?” উনি ঘাবড়ে গিয়ে বললেন, “তা তো দেখিনি ম্যাডাম। পেয়েই ছুটে এসিছি আপনার কাছে। যদি আপনার সাথে না দেখা হয়- সেই টেনশনে আর নামের বানানটা দেখা হয়নি। এখন দেখলে হবে ম্যাডাম?” ফাইলটা ক্লোজ করতে করতে জানালাম, তা দেখুন আর একটা ছবি না তুলে যাবেন না যেন- এই ছবিগুলোই আমাদের ট্রফি। আর এই ট্রফি কখনই জেতা যায় না যদি না টিমে খেলা হয়- আর বড় সাহেব থেকে আমি হয়ে সুকন্যা ঘুরে নির্মল-সঞ্চিতা আমাদের টিমটাই যে ছিল জবরদস্ত। ছবিতে নির্মলের সাথে বাপন বাবু।

পুনশ্চঃ- সুকন্যার নামটা কেন করলাম? আমাকে যাবতীয় আইনি বদবুদ্ধি কে দেয় বলুন তো? নামটা উহ্যই থাক বরং।

Monday 29 June 2020

তুত্তুরী উবাচ ২৯শে জুন, ২০২০


তিনি আজকাল কথায় কথায় বলেন, “বুদ্ধিতে দুর্ভিক্ষ লেগেছে নাকি?” তিনি দাবী করেন, তিনি এক আজব লিপি আবিষ্কার করেছেন, যার জন্য তাঁর নোবেল পাওয়া উচিত। সাক্ষী আমাদের ফ্ল্যাটের দেওয়াল। লিপি তো নয়, এক্কেরে শিলালিপি, স্কচব্রাইট দিয়ে ঘষে ঘষেও তোলা যায় না। তিনি গভীর ঔৎসুক্য নিয়ে লক্ষ্য করেন, বাবা-মায়ের সম্পর্কের জোয়ার-ভাঁটা। অথচ যখন লাগে ষাঁড়াষাড়ি বান, তাঁকে বলা হয় যে কোন একজনের মূখপাত্র হয়ে অপরজনকে ভর্ৎসনা  করতে, ওমনি তিনি ভুলে যান, কি ভাবে যেন ভাজা মাছটা উল্টাতে হয়? তিনি বন্ধ দরজার ওপারে নিঃশব্দ শশকের মত কান খাড়া করে শোনের বাবা-মায়ের দাম্পত্য কলহ এবং অবস্থাবিশেষে বিনানুমতিতেই বিবেকের ভূমিকায় অবতীর্ণ  হন মঞ্চে। মাঝখান থেকে ভুলে যাই আমরা, কি নিয়ে যেন চলছিল কোঁদল পর্ব?
শুধু কি তাই, তিনি নানা বিষয় নিয়ে রীতিমত রসালো আলোচনা করেন বাবার সাথে-যেমন জানতে পারলাম মাসির সাথে খানিকটা দেখলেও গুরুদক্ষিণা সিনেমাটা তেমন পছন্দ হয়নি তাঁর। তবে নায়কের প্রেমে রীতিমত হাবুডুবু। নায়কটা কে ছিল গো বাবা? বাবা রহস্যময় হেসে জানায় নায়কের নাম। তুত্তুরী জানায় তার ওমন গোলুগালু ছোটখাট নায়ক দারুণ পছন্দ। বাবা জানতে চায় সদ্য দেখা রয়াল বেঙ্গল রহস্যের ভাস্কর বন্দোপাধ্যায়কে কেমন লেগেছে? ভালই লেগেছে তাঁর, তবে আপাততঃ তিনি দ্বিধাবিভক্ত  রঞ্জিত মল্লিক আর ভিক্টর ব্যানার্জীর মধ্যে। স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে মা, কিছুদিন ধরেই মায়ের প্রিয় পুরুষদের ওপর নজরদারি চালাচ্ছিলেন তিনি। মাঝে মাঝেই জানতে চাইছিলেন, “তুমি একে বিয়ে করবে?” ইশ্ সত্যিই যদি ক্যারি গ্রান্ট বা স্যার লরেন্স অলিভিয়ার এই প্রশ্নটা করত? নিদেন পক্ষে পিয়ার্স ব্রসনন বা কিল্ট পরা স্যাম হিউয়ান। মায়ের দীর্ঘশ্বাসকে বিশেষ পাত্তা না দিয়ে বাবা জানতে চায় আর আবির? আবিরকে কেমন লাগে তাঁর? আর প্রসেনজিৎ?
গল্পে গল্পে গড়িয়ে যায় রাত। আবির-প্রসেনজিৎ এর জায়গা দখল করে দীনু  খুড়োর পোষ্যপুত্র  বাঁটুল চন্দ্র। তাঁর এবং তাঁর পিতার আব্দারে বাঁটুলের ফটোল্যাব করা হয়, দুঃখের কথা কি আর বলি, আপদ ফটোল্যাব বাঁটুল বাবুর ছবি থেকে কোন ফেসই ডিটেকশন করতে পারে না। আরেঃ ভাই, জলজ্যান্ত বাঁটুল চন্দর বসে অাছে, তাও পাচ্ছ না তোমরা? এরপর যদি তিনি ক্রন্দসী হন, তখনও আপনারা বলবেন যে তিনি ছিঁচকাঁদুনে। বহুৎ না ইনসাফি হ্যায়, মাইরি!

Thursday 25 June 2020

ছবি

আমার কাছে কালও ছিল, তোমার রঙীন ছবি-
হাসিখুশি-গোমড়া তুমি, কখনও বা উদাস কবি-কবি।
 যতই গুছিয়ে-লুকিয়ে রাখি, উড়ে বেড়াত রঙীন প্রজাপতি-
আমার কাছে কালও ছিল,তোমার সুগন্ধী কিছু ছবি-।
আজ বুঝি সেই ছবিতে রঙীন অন্য খুশির ঘর,
বুনো কস্তুরীর সৌরভে মাখা অন্য চরাচর-
আমার কাছে কালও ছিল,তোমার মনকেমন করা ছবি-।
রদ্দি দিস্তায় আজ অগোছাল অতীত স্মৃতির রবি-
বেরঙ- বিস্বাদ ধূলোমাখা তোমার যতেক ছবি।

অনির ডাইরি ২৩ই জুন, ২০১৬

অনির ডাইরি ২৩ই জুন, ২০১৬
আমাদের বাড়িটা বেশ পুরানো। বাবার ঠাকুরদা যখন বানিয়েছিলেন তখন বাস্তুভিটা সহ সংলগ্ন জমির পরিমাণ ছিল সাড়ে সাত বিঘা। যার মধ্যে দুটি বিশাল পুকুর ছিল, একটি সর্বসাধারণের জন্য এবং অপরটি বাড়ির মেয়েদের জন্য খিড়কি পুকুর। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধান্তে যখন ভাঙন ধরল, তখন অনেকটা জমিই বিক্রি করে দেওয়া হল। আমাদের জ্ঞানত শুধু বাস্তুভিটাটুকুই ছিল, যার পরিমাণও কিছু কম ছিল না, খাতায় কলমে চোদ্দ কাটা। যদিও পরবর্তীকালে মেপে এগারো কাটা পাওয়া গিয়েছিল, বাকি তিনকাটা জমি কবে যেন চুরি হয়ে যায়।

এতবড় বাড়িতে যত না মানুষ, তার থেকে অনেক বেশী ছিল গাছপালা। সুউচ্চ সদর দরজা দিয়ে ঢুকলে প্রথমেই চোখে পড়ত এক বিশাল কাঁঠাল গাছ। আমাদের বাড়ির নামই ছিল “কাঁঠালগাছওয়ালা বাড়ি”। কাঁঠাল গাছের তলা দিয়ে এগিয়ে এলেই অতিকায় শান বাঁধানো উঠোন। উঠোনের পূর্ব দিকে ছিল একটা আম গাছ, এত মিষ্টি আম আমি জীবনে খাইনি। তার পাশে ছিল একটা নাগকেশর গাছ, উঠোনের পশ্চিম কোনে ছিল বিশাল বেল আর পেয়ারা গাছ। আবার বলছি এত মিষ্টি পেয়ারা খুব কম খেয়েছি। এই আম এবং পেয়ারার লোভে আসত হনুমানের দল। আমাদের বাড়িতে হনুমানের উৎপাত ছিল প্রবাদ প্রতিম।
তখনও চাটুজ্জে বংশের দুর্দিন শুরু হয়নি। দাদু ছিলেন খুব শৌখিন।দোতলার দালানে বিশাল বেলজিয়াম গ্লাসের আয়না ওলা টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে দাড়ি কামাতেন। টেবিল ভর্তি থাকত দামি দামি ফরাসি আফটার শেভ আর পারফিউমের বোতলে। সেসব কাটগ্লাসের বোতলের ভগ্নাংশ মাত্রই আমরা দেখেছি। যাই হোক দোতলার দালান জুড়ে ছিল ৯টা গারদহীন ফ্রেঞ্চ উইন্ডো।  পাশেই ছিল আম গাছটা, একদিন হনুমান ঢুকে দাদুর দামি আফটার শেভ খেয়ে নিয়েছিল। তারপর সেই মাতাল হনুমান নাকি শোলের ধর্মেন্দ্রর মত দোতলার বারন্দা থেকে “সুসাইড” করতে গিয়েছিল। পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায় যে মেজদাদু আর ছোটদাদু নীচে শতরঞ্চি নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল সেই মাতাল হনুর মাৎলামির গল্প আমরা রোজ একবার করে ঠাকুমার কাছে শুনতে চাইতাম।
জেঠুর সাথে হনুমান গুলোর ছিল বেজায় দোস্তি। দোতলার বারন্দায় দাঁড়িয়ে, জেঠু উদাত্ত গলায় ডাকত, “আয়-আয়-আয়-আয়-আয়”। অমনি দুদ্দাড় করে ছুটে আসত হনুমানের দল। জেঠু একটা একটা করে কলা বাড়িয়ে দিত, ওরাও লক্ষ্মী ছেলের মত নেমে এসে একে একে নিয়ে যেত। এরকমই একদিন জেঠু হনুমানকে কলা  খাওয়াচ্ছিল, উল্টো দিকে রান্নাঘরের সামনের রোয়াকে বসে বাবা ভাত খাচ্ছিল, পাশে ঠাকুমা বসেছিল। শেষ পাতে দুধভাত খেতে খেতে হঠাৎ কি ভাবল বাবা কে জানে, এক গাল দুধ ভাত নিয়ে ওপর দিকে দেখিয়ে বলল, “খাবি?”হনুমানটা তৎক্ষণাৎ কলার খোসাটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে সড়সড় করে নেমে এসে সোজা বাবার কোলে। কোলে বসে হাত বাড়িয়ে দিল, হনুমানের গায়ে নাকি সাংঘাতিক দুর্গন্ধ হয়, বাবার অন্নপ্রাশনের ভাত গলা দিয়ে বেড়িয়ে আসতে চাইছিল, তারওপর হনুমানের বিখ্যাত চড়ের ভয়। ভয়ে বাবার গলা দিয়ে আওয়াজ বের হচ্ছিল না, কোনমতে ঠাকুমাকে জিজ্ঞেস করল, “মা কি করব?” ঠাকুমার বরাবরই ভয়ানক সাহস,  নির্বিকার চিত্তে বলল, “ডেকেছ যখন, ওর হাতে ভাতটা দাও।“একগাল ভাত খেয়েই কিন্তু হনুমানটা বাবার কোল ত্যাগ করে, আর জ্বালায়নি।
আমার মা এবং কাকিমা দুজনেই চাকুরীরতা ছিলেন। আমরা তিন জেঠতুতো খুড়তুতো ভাইবোন ঠাকুমা-পিসির কাছেই মানুষ। তারমধ্যে আমি আর আমার খুড়তুতো ভাই অয়ন হলাম কয়েক মাসের ছোটবড়। দুটো সমবয়সী বাচ্ছার দেখাশোনা করা মোটেই সহজ কাজ ছিল না। বাচ্ছা দেখার কোন লোক ঠাকুমা রাখতে দিত না, বিশাল সংসার এবং দুটো দুধের বাচ্ছার দায়িত্ব একাহাতে সামলাতে হত ঠাকুমা-পিসিকে। দুপুর বেলা খাইয়ে দাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে আমাকে রেখে আসা হত দোতলার উত্তর পশ্চিমের ঘরে, ঠাকুমার বিয়ের বিশাল উঁচু খাটে, চারদিকে বালিশ দিয়ে ঘিরে। আর ভাইকে শোয়ানো হত একতলার দক্ষিণ পশ্চিম দিকের ঘরে একই ভাবে। মাঝে মাঝে পিসি এসে দেখে যেত ঘুম থেকে উঠেছি কি না। একদিন এরকমই দেখতে এসে দেখে দুটি অতিকায় কালো মুখো হনুমান আমার পাশে খাটে বসে আছে। পিসিকে দেখেই দুজনে দাঁত খিঁচিয়ে উঠেছে, ভয়ে পিসি তো প্রবল চিৎকার জুড়ল। কি ভাগ্যি সেদিন ও জেঠু বাড়িতে ছিল, ঝুল ঝাড়া নিয়ে দুটোকে তাড়া না করলে কি হত কে জানে। আমৃত্যু অবশ্য জেঠু আমাকে খেপাত যে আসলে ওটা ছিল হনুমান রুপী রাজপুত্র। জেঠু অবশ্য সর্বত্রই আমার জন্য ছদ্মবেশী রাজপুত্র দেখত। আমাদের একটা বিশাল হুমদো হুলো ছিল। তাকে দেখলেই ভয় করত। নাম ছিল “অমিতাভ”। মাঝে মাঝেই সে চার হাতপা উল্টে মরার ভান করে পড়ে থাকত। গোটা বাড়ির লোক এককাট্টা হয়ে যখন সিদ্ধান্ত নিত, যে এই মরা বিড়ালটাকে কে কোথায় ফেলতে যাবে, অমনি তিনি আড়ামোড়া ভেঙ্গে উঠে বসতেন। যখনি আমি একা দোতলা থেকে একতলায় নামতে যেতাম, ঠিক তখনি তার একতলা থেকে দোতলায় ওঠার প্রয়োজন পড়ত, মাঝপথে দেখা হত দুজনার, অমিতাভ মুচকি হাসত, মানে হাসত কিনা জানি না,মনে হত। আসলে আমি তখন বড়ই ছোট, আমি কিছুতেই  হাসতে পারতাম না, উল্টে চিল চিৎকার জুড়তাম, যতক্ষণ না সকলে লাঠিসোটা নিয়ে দৌড়ে আসত এবং অমিতাভ সিঁড়ির জানলা গলে ফুড়ুৎ হত। প্রতিবারই জেঠু বলত, “এ হে হে, ভয় পেলে হবে? ওটা বেড়াল ছিল না, ওটা ছিল বেড়াল রূপী রাজপুত্র।“ সত্যি কি মিথ্যা অবশ্য শৌভিক ভট্টাচার্যই বলতে পারবে।
(চলবে?)

Tuesday 23 June 2020

অনির ডাইরি ১৯ শে জুন, ২০২০


মনেরও বুঝি মরশুম আছে, কখনও প্রবল সুখেও কেন যে, ঘনিয়ে আসে আষাঢ়ে বাদল? প্রিয়জন সান্নিধ্যে, বাতানুকূল যন্ত্রের সোহাগে, গাল বালিশের আদরে ভিজতে ভিজতে কেন জানি না, মনে পড়ে যায়, কোন এক আত্মঘাতী কিশোরীর কথা। কে জানে, কোন সে সেই বিস্মৃত কালের, কোন অলস দুপুরে, লাল হয়ে আসা কোন এক শারদীয়ার পাতায় আলাপ হয়েছিল তার সাথে। ঝিম ধরা দুই চোখের তারায় উঁকি মেরে যায় সময়, “পারবে না হে, পারবে না। আমায় ধরে রাখতে তুমি পারবে না।“ বারন্দার ওপর থেকে উঁকি মারে এক জোড়া বিষণ্ণ চোখ, “ আমি যাব, তোর কাছে?” ঊর্ধ্বপাণে তাকিয়ে থাকি আমি, কতদিন তোমায় স্পর্শ করিনি দিদি। মুঠোয় ভরা বালির মত ঝরে যাচ্ছে সময়-

সকালের সংবাদপত্র বড় বেশী বাজারু, সীমান্তে বুঝি লাগল আগুন। তেরঙ্গায় মোড়া শবের মিছিল। যেন উন্মাদ হয়ে উঠেছে, নরমাংসভোজী পিশাচের দল, যুদ্ধ চাই যুদ্ধ। বেদনাও এখন পণ্য। স্টিল ফ্রেমে ধরা থাকে মূল্যবান শোক। দুরাভাসের ওপারে গমগমিয়ে ওঠে দীনু খুড়োর মাই ডিয়ার কণ্ঠ, “ কি রে বেটি কি চাস?” প্রদোষ মিত্তিরের যেমন সিধু জেঠা, আমার তেমনি দীনু খুড়ো। হ্যামলিনের বাঁশিওয়ালার সুর, খুড়োর গল্পে। আজ যুদ্ধের গল্প শুনব খুড়ো। আমাদের প্রজন্ম যুদ্ধ দেখেনি। “কেন রে? তোর আপিস নেই বুঝি?” জানতে চায় খুড়ো। আছে তো, এঁকেবেঁকে চলেছি আপিসেরই পথে। নিবেদতা সেতুর মাথার ওপর গহন মেঘের চাঁদোয়া। ফোনের সীমান্ত পেরোলেই খুড়ো আর আমি, বসে আছি বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের জনৈক ছাত্রাবাসের কোন এক নিঝুম কামরায়। সন ১৯৭১।ঘনিয়ে এসেছে রাত্রি, আনমনে রেডিওর নব ঘোরাতে ঘোরাতে আচমকা ধরা পরেছে  পাকিস্তান রেডিও। ওপার থেকে সহর্ষ সংবাদ পাঠক চোস্ত বাংলায় বলে উঠলেন, “খবর পাওয়া যাচ্ছে, এই মাত্র বর্ধমান শহর দখল করেছে ইয়াইয়া খানের সেনাদল। বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যাপক বোমাবাজি এবং অগ্নিসংযোগ।“ কিন্তু? “তবে আর বলছি কি?” অট্টহাস্যে ফেটে পড়ে খুড়ো। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় বাপি, ম্যাডাম এমন হাসতে হাসতে বিষম খেল কেন?

বড় সাধ করে লাগিয়ে ছিলাম গাছগুলো, বুড়ো কালেক্টরেটের ঝুলবারন্দা জুড়ে, প্রত্যেকের নামে একটা করে গাছ। যেখানে জুঁই গাছের নাম সঞ্চিতা, পাম গাছের নাম কৌশিক। ক্রোটনের নাম নির্মল আর প্রীতির হাজারি গোলাপ। জিজ্ঞাসা করেছিলাম, “আপনার নামে কি গাছ লাগাব স্যার?” চন্দননগরের বড় সাহেব, অনেক ভেবে জানিয়েছিলেন, “একটা লেবু গাছ লাগাতে পারো?  লেবু পাতার গন্ধটা বড় বেশী মনকেমনিয়া।”। শুভজিৎ চেয়েছিল তুলসী গাছ। চুপড়িতে করে নীল রঙের কি যেন ফুলের গাছ এনে বসিয়েছে রমেশ। আপিসের দিনগুলোতে নিয়ম করে জল দেন বর্মণ সাহেব। আর ছুটির দিনে ? কেন, অজিত দা আছে না। অথচ অজিত দার নামেই বসানো হয়নি কোন গাছ। এই শীতে বসাতেই হবে, যদি থাকি। প্রথম বর্ষার দাপটে সব কটা টবে গজিয়ে উঠেছে আগাছা। কম্প্যুটর ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় সোমনাথ, “একটা খুরপি লাগবে ম্যাডাম। আর এক প্যাকেট সার।“ “চা পাতা দিয়ে দেব নাকি?” কাঁচের গ্লাসে চা ঢালতে ঢালতে মাতব্বরি ধাঁচে জানতে চান কালেক্টরেটের সুজয় বাবু। আমার জন্য চা আনলেই, কৌশিক দৌড়ে জানতে চায়, “গ্লাস ধুয়ে এনেছেন তো?” বললেই তিড়িং করে চটে যান সুজয় বাবু।
পিছন থেকে ডাকেন অজিত দা, “ম্যাডাম, আপনি কোথায় আগাছা দেখলেন?” প্যারেড করি দুজনায়, সব টব চাঁচাপোঁচা, সদ্য খুঁড়ে দেওয়া হয়েছে সবার মাটি। হেসে উঠি দুজনায়, এই না হলে অজিত দা, বুড়ো হাড়ে এখনও তাক লাগিয়ে দেন। সোমনাথ আর আমার কথোপকথনের মাঝেই সারা সব কাজ। নাঃ দাঁড়ান, এখনও বাকি একটা কাজ, এক লিটার রং এনেছে অমৃতাপতি কৌশিক। করিডরে দু মিটার ছাড়া ছাড়া গোল্লা পাকাতে হবে, বড় ভিড় হচ্ছে আজকাল। পঞ্চাশ টাকারও মেডিক্যাল ক্লেম করছে মানুষ। সেদিন একটা ৪৩টাকার ক্লেম নাকচ করা হয়েছে আপিস থেকে, বিলে নাম বা তারিখ লেখা ছিল না। কাঁচা বিল। আজ একটা ক্লেম পেলাম, বাচ্ছাটা অপুষ্টিতে ভুগছে, দামি হেলথ ড্রিঙ্ক কিনেছে মা। এর ওপর বেতন না পাওয়ার অনুযোগ আসছে ভুরি ভুরি।

মিটিং এর ফাঁকেই ঢলে আসে বেলা। পশ্চিম আকাশে এক রাশ লালিমা ছড়িয়ে অস্ত যায় শুক্রবারের সূর্য। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে যায় বিদ্যুৎ আর রমেশ। স্যার কি এলেন? আর কখন আসবেন রে বাবা? তিনটে নাগাদ কেক কিনে এনেছে ওরা, সাত বার গুণে গুণে ফোন করেছে আমায়, কি লেখা হবে কেক-এ? “হ্যাপ্পি বার্থ ডে জেএলসি স্যার?” এই না, এটা লিখলে হেব্বি খচে যাবেন স্যার। লকডাউনের মাঝেই কেটে গিয়েছিল স্যারের জন্মদিন, সেদিন শুকনো শুভেচ্ছা জানানো ছাড়া করা যায়নি কিছুই। আজ পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক, আপিস তো আসতেই হচ্ছে সকলকে। আর চুঁচুড়া আপিসের একটা দস্তুর তো আছে না কি- 
 তবে কি লেখা হবে? শুধু স্যার? অধৈর্য হয়ে ওঠে ওরা, কেক আসার আগেই যদি স্যার এসে যান তাহলেই কেস জন্ডিস। শুধু কিংশুক? নাকি কিংশুক স্যার? রীতিমত ব্রেন স্টর্মিং করে লেখা হল স্যারের নাম। কেনা হল মোমবাতি। রঙ মশাল গুলো থেকে বড় ঝরে পড়ে বারুদ। নিপুণ হাতে সাজানো হল মোমবাতির চক্রব্যূহ, রাংতায় মোড়া হল টুকটাক উপহার। চন্দননগরের বড় সাহেবকে বড় ভালোবাসে এরা। কেমন মাটির মানুষ। বকাবকি করেন না, উলটে প্রশ্রয় দেন অঢেল। একরাশ শুভেচ্ছার মাঝে, আগে পিছে স্যানিটাইজ করে, বাতি না নিভিয়েই কেক কাটলেন স্যার। বুড়ো অজিতদা নালিশ করে গেল, কাজ বাড়িয়েছে মেয়েগুলো। ছদ্ম বিরক্তি মিশিয়ে, কোথায় কোথায় ক্রিম লাগিয়েছে তার লম্বা ফিরিস্তি দিয়ে গেল অজিত দা, তার মধ্যে ছিল অজিতদার গালও। হাসব না রেগে যাব, এই দোদুল্যমানতার মধ্যেই শেষ হয়ে আসে দিনটা, বুঝতে পারি আবার বদলাচ্ছে মরশুম- মনেরও বুঝি মরশুম থাকে। ভালো থাকতে গেলে, বুঝি ভালো রাখতেও হয়।

Thursday 18 June 2020

অনির ডাইরি ১৮ই জুন ২০১৬

অনির ডাইরি ১৮ই জুন, ২০১৬
(বাবা তোমার জন্য, আরও একবার)
 সালটা সম্ভবত ১৯৫৮। ছেলেটা সবে হাওড়া আইজ্যাক রাফায়েল বেলিলিয়াস স্কুল থেকে স্কুল ফাইনাল পাশ করে নরসিংহ দত্ত কলেজে ভর্তি হয়েছে। আই এস সি ফার্স্ট ইয়ার। মহানগর তখন উত্তাল খাদ্য আন্দোলনে। খাদ্য আন্দোলন ব্যাপারটাযে ঠিক কি, ভালো বোঝে না ছেলেটা। পুজোর আগে প্রতিবছরই খাদ্য আন্দোলন হয়। জন মুখে শোনা কথা, যে অবশ্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির অগ্নিমূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে, বামপন্থীরা (সিপিআই, ফরোয়ার্ড ব্লক, বলশেভিক পার্টি ইত্যাদির সমষ্টি) প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে সমর্থকদের মিছিল করে কলকাতায় নিয়ে আসে এবং এসপ্ল্যানেডে অবস্থান বিক্ষোভ হয়।

আরো শুনেছে, যে প্রতি দিন ঠিক রাত দশটা বাজার কিছুক্ষণ আগে, পুলিশের কমিশনার সাহেব নিজে আসেন, বিশাল দলবল নিয়ে, এবং মাইকে ঘোষণা করেন, যে ঠিক পাঁচ মিনিট সময় দেওয়া হল, এর মধ্যে অবস্থান বিক্ষোভ না তুললে পুলিশ মেরে তুলে দেবে। ঘোষণা হতে থাকে এক মিনিট- দুই মিনিট-তিন মিনিট-। ইতিপূর্বে নির্বিকল্প রক্তপাত ঘটে গেছে খাদ্য আন্দোলনকে কেন্দ্র করে, “বিমলা-অমিয়া-প্রতিভার” গল্প অন্য একদিন লিখব, যদি সুযোগ পাই। যাই হোক কেউ তার দুঃসাহস দেখাতে সাহস পায় না, তিন, চার মিনিট গোনা হতে না হতেই পার্টির হুলিয়া অগ্রাহ্য করে, পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে সব দৌড়তে থাকে অদুরে দাঁড় করানো গোটা পঞ্চাশ স্টেট বাসের দিকে। গ্রামের গরিব গুর্বো চাষিভুষির দল, পুলিশ গ্রেপ্তার করার আগেই বাসে উঠে বসে পড়ে, যারা সিট পায়না তারা দাঁড়িয়ে বা মেঝেতে বসে পড়ে।পুলিশের বীভৎস মারের হাত থেকে বাঁচতে এভাবেই স্বেচ্ছা গ্রেপ্তার বরণ করে নেয়। তারপর সেই বাস নিয়ে যাওয়া হয় প্রেসিডেন্সী বা দমদম সেন্ট্রাল জেলে।

আটান্ন সালেও এর ব্যতিক্রম হল না। অবস্থান বিক্ষোভ ছত্রভঙ্গ হয়ে যাবার পর পার্টি গুলো সাহায্য চাইল ছাত্রদের কাছে। তখন এসএফআই ছিল না,বামপন্থী ছাত্র সংগঠনের নাম ছিল, এআইএসএফ, তারা ছাত্র আন্দোলনের ডাক দিল। এলিট ছাত্র পরিষদের কিছু ছাত্রও এগিয়ে এল গরিবগুর্বো চাষিভুসি গুলোর সমর্থনে। নরসিংহ দত্ত কলেজকে বলা হত, “হাওড়ার প্রেসিডেন্সী”। ছাত্র রাজনীতিতে বরাবরই অগ্রণী, বিশাল মিছিল বের হল ছাত্রদের। আমাদের সদ্য কলেজে ঢোকা ছেলেটিও যোগ দিল। ব্রেবর্ণ রোড দিয়ে যেতে দিল না এদের, টি বোর্ডের পাশ দিয়ে ডেকার্টস লেন হয়ে বেন্টিঙ্ক স্ট্রীট আটকে দিল আমাদের হাওড়ার ছেলে গুলো। অন্যান্য কলেজ থেকেও ছাত্রদের মিছিল এসে মিলিত হল, স্টেটসম্যানের অফিসের সামনে চলতে লাগল অবস্থান বিক্ষোভ। ঘড়ির কাঁটা সন্ধ্যা পেরিয়ে এগোতে লাগল রাতের দিকে। পৌনে দশটা নাগাদ এলেন কমিশনার সাহেব,পাঁচ মিনিটের ঘোষণাও চলতে লাগল, কিছু ছেলেপুলে পালিয়েও গেল, আমাদের ছেলেটি কিন্তু পালাল না, মানে দৌড়ল, কিন্তু  দাঁড়িয়ে থাকা স্টেটবাস গুলোর দিকে।
ছাত্রদের নিয়ে যাওয়া হল প্রেসিডেন্সী জেলে। ছেলেটির মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল, তার মানে আজ রাতে হাজতবাস? কি হবে? বাড়ির লোক তো কিছুই জানে না? আর জানতে পারলে কি আর বাড়িতে ঢুকতে দেবে? রাতটা যে কি ভাবে কাটল, কে জানে, সকাল বেলায়, সেল থেকে বার করে, খাইয়ে দাইয়ে, খানিকক্ষণ জেল ইয়ার্ডে ঘুরিয়ে আবার সেলে পুরে দেওয়া হল। মন খারাপ করে বসে আছে ছেলেটা, আচমকা শুনতে পেল, অবাঙালি ওয়ার্ডেন সেলের সামনের করিডর বেয়ে ছেলেটির নাম, হাওড়া এবং কলেজের নাম হাঁকতে হাঁকতে যাচ্ছে। পাশ থেকে একজন সিনিয়র বলল, “খবরদার সাড়া দিসনি। বার করে নিয়ে গিয়ে পিটিয়ে মেরে ফেলবে।“ ছেলেটি তো ভয়ে টুঁ শব্দ করেনি, কিন্তু অন্য সেল থেকে পরিচিত ছেলেরা কমরেড, কমরেড করে চিৎকার করতে থাকায়, ছদ্ম বীরত্বের সাথে ষোল সতেরো বছরের ছাতি ফুলিয়ে সাড়া দিতে বাধ্য হল।
ছেলেটিকে বার করে নিয়ে আসা হল, একটি বড় ঘরে, প্রতি মুহূর্তেই ভয় তাকে কাবু করে ফেলছে, আর কোনদিন মায়ের মুখ দেখতে পাবে না, উদ্গত কান্না গিলতে গিলতে গিয়ে হাজির হল একটা সাবেকী সিনেমার কাউন্টারের মত খুপরির সামনে, ওয়ার্ডেন বলল, “লো বাত করো।“ অবাক ছেলেটি তাকিয়ে দেখে খুপরির ওপাশে তার বাবা। এইরে হাত ঢুকিয়ে নির্ঘাত এক চড় মারবে, তারপর বলবে, “তোর মত কুলাঙ্গারের আর বাড়ি ফেরার দরকার নেই। তুই জেলেই পচে মর!!” ওমা ছেলেটির বাবা বরং সোৎসাহে জিজ্ঞাসা করল, “কেমন লাগছে? মারধর খেয়েছিস নাকি?” হতবাক ছেলেটি শুধু বলল, “বাবা? তুমি কি করে জানলে, আমি জেলে?” সৌম্য দর্শন ভদ্রলোক বললেন, “তুই পালাসনি বটে কিন্তু অনেকেই পালিয়ে ছিল, তেমনি একাধিক বন্ধু আজ তোর খবর নিতে আসাতে জানতে পারলাম।“ তখন সরি বলার রেওয়াজ ছিল না, ছেলেটি মাথা নিচু করে বসেছিল। জানলা গলিয়ে বাবা ছ প্যাকেট চারমিনার সিগারেট ছেলেটির হাতে দিলেন। তখন ৭৫ পয়সায় পাঁচ প্যাকেট সিগারেট পাওয়া যেত। ছেলেটি তো অবাক, বাবা সিগারেট কেন দিল? ভদ্রলোক হেসে বললেন, “জেলের নিয়ম তুই জানিস না, এখানে একটু ভদ্র ব্যবহার, এক হাতা বেশী ভাত বা একটু ঘণ ডাল পেতে গেলেও সিগারেট ঘুষ দিতে হয়।আমি চলে গেলেই এরা তোকে হাতড়ে দু প্যাকেট সিগারেট নিয়ে নেবে, বাকি প্যাকেট গুলো সামলে রাখিস, কাজে আসবে। আর একটা প্যাকেটের গায়ে ক্রশ দেওয়া আছে, ওটা লুকিয়ে ফেল, ওতে দশটা টাকা আছে, ছাড়া পেলে বাড়ি ফেরার রাহা খরচ আর যদি কিছু লাগে।সাবধানে ফিরিস, অনেক গল্প করার আছে।“

সেদিনের সেই  ছেলেটি ছিল আমার বাবা, আর সেই ভদ্রলোক? আমার দাদু। আজ সকাল থেকেই কেন জানি না, বাবার মুখে সহস্রবার শোনা দাদুর এই গল্পটাই মনে পড়ছে। হয়তো আজ ফাদার্স ডে তাই। বাবারা তো সত্যিই এ রকমই হয়, পরিস্থিতি যতই নিম্নগামী হোক না কেন, সারা দুনিয়া আপনাকে ভুল বুঝুক না কেন, সবাই, এমনকি আপনার ছায়াও আপনাকে ছেড়ে চলে যাক না কেন, বাবারা সব সময় পাশেই থাকে, নিরন্তর সাহস যুগিয়ে চলেন, “লড়, লড়ে যা। না লড়ে হারিস না। আর যদি হেরেও যাস, তাতে কি? হার জিত তো জীবনেরই অঙ্গ।“ তাই বোধহয় বাবারাই আমাদের প্রকৃত এবং ব্যক্তিগত সুপার হিরো।
 #HappyFathersDay #Makingmemories

Wednesday 17 June 2020

অনির বচন

অনির বচন #৫ ১৬ই জুন, ২০২০
কি খোরাক মাইরি। ঘরে ঘরে বিশেষজ্ঞ। কত রকম থিয়োরি। পাইকারি হারে মনের যত্ন নিন। কত রকমের সদুপদেশ-
১।  চাপ নেবেন না। মনের কথা খুলে বলুন। কাকে মশাই? আপনাকে? আপনি শুনবেন তো? কখনও প্রকৃত মানসিক অবসাদ গ্রস্ত ব্যক্তির সান্নিধ্যে এসেছেন? না না, ব্যর্থ প্রেম বা পেশাগত ব্যর্থতা বা প্রিয়জন বিরহে সাময়িক কাতরতা  নয়, আসল হার্ডকোর ডিপ্রেসন- যদি এসে না থাকেন, তাহলে বুঝবেন না, ঐ ভাবে যার তার কাছে প্রাণ খুলে কথা  বলাটা ওণাদের পক্ষে কতটা দুরূহ। আরেঃ ওণারা তো জানেনই না যে ওণারা মানসিক অবসাদের শিকার। এত জোর গলায় কি করে বলছি? তাহলে শুনুন, জনৈক পরিচিত ব্যক্তি একদিন আচমকা অন্ধ হয়ে গেলেন। হাতড়ে হাতড়ে সারা বাড়ি ঘুরতে লাগলেন আর বারংবার বলতে লাগলেন, “আমি তো চোখে দেখতে পাচ্ছি না। কি হবে? হে প্রভু আমায় কানা করে দিলে?” অথচ দূরে দেওয়াল ঘড়িতে কটা বাজছে উনি দিব্যি বলে দিচ্ছেন, বাড়ির লোক বারবার বোঝাল, কোন লাভ নেই। সকাল দুপুর রাত শুধু একই বচন- পরিশেষে নিয়ে যাওয়া হল ডাক্তারবাবুর কাছে, তিনি রায় দিলেন ভদ্রলোক মানসিক অবসাদ গ্রস্ত। সুপার স্পেশিয়ালিটি হাসপাতালের বড় ডিগ্রীওয়ালা মানসিক ডাক্তার (গুগল করা নয়) দেখানো হল, দু এক ডোজ ওষুধ পরার সাথে সাথেই সরে গেল চোখের পর্দা। ভদ্রলোক এখনও নিয়মিত ওষুধ সেবন করে চলেছেন।
তো প্রশ্ন হচ্ছে, দৈনন্দিন কর্মব্যস্ত জীবনে একজন মানসিক অবসাদ গ্রস্ত মানুষের একঘেয়ে ঘ্যানঘ্যান( সচেতন শব্দপ্রয়োগ) আধ ঘন্টার বেশী সহ্য করতে পারবেন তো? আর মন খুলে যদি উনি আপনাকে ওনার সমস্যা জানানও আপনি কথা দিতে পারেন যে আপনি তা একদম গোপন রাখবেন? দিন বদলের দিনে পরচর্চার আসরে পান আর মৌরি মিশিয়ে পরিবেশন করবেন না গরম-গরম? আরেঃ ঘরের সামনে পরের বাচ্ছাদের কলকাকলিই সহ্য হয় না আমাদের, মাত্রাতিরিক্ত শোরগোলের অপরাধে ক্রন্দনরত দেড় বছরের শিশুকে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া ছাত থেকে, করোণার প্রকোপে সদ্য পিতৃমাতৃহীন অনাথ তরুণী মেয়েটাকে একঘরে করে তার দরজায় সাঁটিয়ে দিই নোটিশ- আর আপনি বুলি কপচাচ্ছেন প্রাণ খুলে কথা বলুন।

২।  আরও কত কি, আইকিউ-ইকিউ- একিউ এর ফাণ্ডা। আমার জনৈকা প্রিয়তম বান্ধবীও দেখলাম এই রকম একখানি জব্বর লেখা শেয়ার করেছে। ও জানে না বুঝলাম, কিন্তু প্রশাসনিক বিভিন্ন ট্রেনিং তথা নানা কর্পোরেট ট্রেনারদের সান্নিধ্যে থাকার দরুন এগুলি আমার অনেকটাই চেনা বুলি। কত রকমের কোশেন্ট হয়, কত রকম ইনটেলিজেন্স হয়- ইমোশনেরও ইন্টেলিজেন্স হয়। বিশাল দামী ট্রেনার এসে ঠাণ্ডা ঘরে, মস্ত বোর্ডে পিপিটি বা ভিডিও চালিয়ে, অথবা সাজানো বাগানে টানা অ্যাক্টিভিটি করাতে করাতে মৃদুমন্দ সুরেলা পেশাদারী স্বরে এসব বলেন- আবার বলি, একজন প্রকৃত অবসাদ গ্রস্ত প্রিয়জনকে এসব বোঝান দিকি। তিনি শুনবেন হয়তো। বুঝবেন কি? তার থেকে বড় কথা হল বোঝার কথা কি? বিশেষ সমস্যাগুলি বিশেষজ্ঞের সাথেই ছেড়ে দিলে ভালো হয় না?

৩। তৃতীয়তঃ যে পয়েন্টটা সবাই লিখেছেন দেখলাম, বাচ্ছাদের চাপ দেবেন না। আরে দূর মশাই, কোন বাবা-মা সচেতন ভাবে বাচ্ছাদের ওপর এমন চাপ দিতে চান বলতে পারেন, যাতে সে মানসিক অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ে? বাচ্ছার ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত রাখার জন্য তাকে পরীক্ষায় ভালো ফল করতে কি আমাদের বাবা-মা বলেননি? আপনি বলেন না বুঝি?  আর এই যৌথ পরিবার না থাকা বা ইঁদুর দৌড় এসব নিয়ে যদি আপনার আপত্তি থাকে তাহলে বিকল্প ব্যবস্থাটা কি সেটা তো বলুন।

সুশান্তর মৃত্যুটা ভয়ানক বেদনাদায়ক। আমার মতই আপনিও হয়তো ভুগছেন ডিনায়ালে। বাঁধা বুলি কপচে, গর্তের মধ্যে মাথা গুঁজে ভাবছেন খুব সহজ এই সমস্যার সমাধান। একবারও ভাবলেন না, এত যদি সহজ হত, সুশান্ত নিজেই কি করত না তার সুরাহা। বা মানসিক অবসাদে ভোগা সকলেই কমবেশী অবগত আছেন এই বিষয়গুলি নিয়ে। তবুও  হতাশার কোন চরম বিন্দুতে পৌঁছে মানুষ ছেড়ে দেয় জীবনের হাত তা অনুভব করা কি সহজ সহজ? ও পথে বরং না হাঁটাই ভালো।চে জানে, যদি না ফিরে আসা যায়। মোদ্দা কথা, করোনা ক্যান্সার বা এইডসের মত ডিপ্রেশনও এক মারাত্মক ব্যাধি। যার থাবা কতদূর বিস্তৃত কেউ জানি না, এটাই ধ্রুব সত্য আর কিছু না-