Thursday 13 February 2020

অনির ডাইরি, ৯ই ফেব্রুয়ারি, ২০২০


ঝুমা বলল, “ম্যাডাম, একটা অনুরোধ করব?” বাপরেঃ এদের এত ভালোবাসি, তাও এদের এত সঙ্কোচ আর ভণিতা। বললাম, ঝট করে বলেই ফেলো। আব্দেরে  আর্জি জানালো, “ সামনে আমার মেয়ের জন্মদিন। ওর জন্মদিনের কার্ডটা আপনি লিখে দেবেন-”। কার্ড অর্থাৎ নিমন্ত্রণ পত্র? এ আর এমন কি ব্যাপার? জানতে চাইলাম কার নামে কার্ড হবে? কবে? আর ঝুমার মেয়ের ভালো নামটা-
শুনলাম- সুদ্যুতি। বাপরেঃ ঐ পুঁচকেটার এত ভারি নাম? যাকে দেখলেই বলি, “মিষ্টি খাবো?” প্রথম দেখেছিলাম, টিম চুঁচুড়ার অফিস পিকনিকে, সে বিগত বছরের কথা। কয়েক মাস হল এনসিএলপির চার্জ নিয়েছি। ঝুমা তার ম্যানেজার। ঠিক টিম চুঁচুড়ার প্রত্যক্ষ সদস্য নয়। সত্যি? বললে ঝুমা মানবে?
পিকনিকে ঝুমার হাত ধরে যিনি এলেন তাঁকে দেখে তো পুরো চুঁচুড়া টিম ক্লিন বোল্ড। তিনি এলেন- লকড়ি কি কাঠি গাইলেন- সকলের প্রাণেশ্বরী হয়ে বিদায় নিলেন। শুনলাম তাঁর নাম মিষ্টি। সেই থেকেই শুরু, “মিষ্টি খাবো” উপাখ্যান। তিনি আবার তুত্তুরীর প্রগাঢ় অনুরক্তা। তুত্তুরী হল, তাঁর ভট্টাচার্য দিদি। ভাবুন খালি !
তো মিষ্টি ওরফে সুদ্যুতির জন্মদিনের নিমন্ত্রণ পত্র লিখে ফেললাম সময় করে, এ আর এমন কি কথা। বাঁধা গৎ- মাননীয় মহাশয়, অমুক তারিখে আমাদের পৌত্রী/দৌহিত্রীর শুভ জন্মদিন উপলক্ষে মদীয় বাসভবনে/ অমুক স্থানে প্রীতিভোজে যোগদান করিয়া বাধিত করিবেন ইত্যাদি-। ঝুমার মুখটা হাঁড়ি হয়ে গেল পড়ে। পছন্দ হল না। লিখতে হবে, প্রাণের কথা-
লিখতে বসে দেখলাম, ব্যাপারটা বেশ কঠিন। আমি পাতার পর পাতা লিখে যেতে পারি তুত্তুরীকে নিয়ে। অতটা না পারলেও পারি ভাইপোদ্বয় বাবু বা বুল্লু বাবুকে নিয়ে। যাদের শৈশবের সাক্ষী আমি। কিছুটা হলেও সুকন্যার উটো বাবুকে নিয়েও- রোজই শুনি যে তাঁর কৃতকর্মের উপাখ্যান। মিষ্টিকে নিয়ে লিখতে গিয়ে দেখলাম- কিছুই জানি না তো মিষ্টি খাবোর সম্বন্ধে। অগত্যা শরণাপন্ন  হলাম ঝুমার। কিছু তো বলো- কেমন ছিল সে? কেমন অনুভূতি হয়েছিল প্রথম দর্শনে? টেকো ছিল কি? নাকি একমাথা ঝুমুর ঝুমুর চুল? কি বলে ডাকে, দাদু-ঠাম্মা বা দাদু-দিদা? শোনাও কিছু দুষ্টুমির গল্প। মায়ের চোখ দিয়ে দেখি মিষ্টির শৈশব-
দিন দুয়েক বাদে পেলাম এক সদ্যোজাত এক নিঁখুতির ছবি। ভ্রু কুঁচকে কি যেন ভাবছিল সে। সাথে ঝুমার কিছু হাতে লেখা, কিছু টাইপ করা চিঠি- মায়ের থেকে ভালো বোধহয় কেউ আঁকতে পারে না, শৈশবের ছবি। ঝুমার চোখ দিয়ে দেখলাম, ওয়াকার চড়েই, দাদুর দই বাটি ধরে চম্পট দেওয়া- দেখলাম, ঘুরে ঘুরে সবার পাত থেকে চিংড়ি মাছ তুলে নেওয়া- ঠাম্মার সাথে প্রবল ঝগড়া এবং ভাব, প্রথমবার পাহাড় দেখার উত্তেজনা- পাহাড় থেকে নেমে ঠাম্মার ঘরের দেওয়াল জুড়ে পাহাড় রচনা। অনুভব করলাম, প্রথম কথা বলতে পারার আনন্দ- প্রথমবার খাট থেকে ডিগবাজি খেয়ে পড়ার যাতনা।
ঝুমার কথাগুলোই গুছিয়ে দিলাম কার্ডে। যথারীতি এবার সবার দিলখুশ। ছেপে এল হলদে সোনালী কার্ডে মিষ্টির জন্মদিনের আমন্ত্রণ পত্র। সাথে নির্দেশ- ভট্টাচার্য দিদিকে নিয়ে না গেলে মিলবে না প্রবেশাধিকার। ভট্টাচার্য দিদির এদিকে হেবি গোঁসা। আমি কোন ওর জন্মদিনে যাব? ও তো আসেনি? কি উদ্ভট লজিক মাইরি। অগত্যা দিতে হল কানমলা। সেজেগুজে গেলাম মা-মেয়েতে। ওদিক থেকে এলেন বর্মন সাহেব, অরুণ বাবু, রমেশ আর বিদ্যুৎ। সেজেগুজে পরী হয়ে ঘুরছিল মিষ্টি। দেখেই যথারীতি,“মিষ্টি খাবো” বলার সিথে সাথেই চকাস্।  আজ রীতিমত দরাজ দিল আমাদের মিষ্টি-
বনেদী বাড়ির হার্দিক অভ্যর্থনায় অভিভূত হয়ে, ম্যাজিক দেখে, পর্যায়ক্রমে তপসে মাছের জিভ পোড়ানো ফ্রাই, টক দই আর সর্ষে মাখোমাখো ঘটৎকচ মার্কা পার্শে, কলাপাতা মোড়া আঙুল পোড়ানো পাতুরী, সুগন্ধী পোলাও, মুর্গীর ঠ্যাং, ক্ষীরের মত পায়েস খেয়ে যখন উঠতে যাচ্ছি, পাতে পড়ল ইয়া বড় একখানি দরবেশ। আরেঃ এতো আমার ছোটবেলার দরবেশ- ফ্যাকাশে হলদে রঙের বোঁদের লাড্ডুর মাঝে একখানি কাজু, একটা দামড়া কিশমিশ, আর ইতি উতি লুকিয়ে থাকা খোয়া ক্ষীরের ডেলা। মনে পড়ে গেল, চাটুজ্জে বাড়ির সমস্ত শুভ কাজে বসত ভিয়েন, তৈরি হত এমনি দরবেশ। মনস্থ করে ফেললাম- এবার থেকে টিম চুঁচুড়ার সমস্ত খাবার প্রোগামের মিষ্টির কনট্র্যাক্ট ঝুমাকেই দেওয়া হবে। মিষ্টির মা যদি না মিষ্টি আনে, আনবে কেটা শুনি-

অনির ডাইরি, ১৩ই ফেব্রুয়ারি ২০২০


রক্তাক্ত আনন্দবাজারটা লাট খেয়ে পড়েছিল ডাইনিং টেবলের ওপর। তার উপরে দুইটি রক্তাভ গোলাকার চুলের ব্যাণ্ড। ঠকঠক করে ঢুকল তুত্তুরীর বাবার মেসেজ, সকালেও কচিঘাসের মত শ্যামল বরণ ছিল যাদের, তারাই আপাততঃ সুকন্যার উপহার দেওয়া জল রঙ মেখে, মেটে লাল। লাল রঙ মেখেছে তুত্তুরীর দুই হাত, গাল, গলা এবং জামা। শিয়ালদহ মেন লাইনের বিখ্যাত সিগন্যালিং এর কাজের দৌলতে, আটকে আছে তুত্তুরীর মা দুটি স্টেশনের মাঝে, দীর্ঘক্ষণ। বেশ কয়েকবার বেজে গেছে তুত্তুরীর ব্যগ্র তথা আর্ত কণ্ঠস্বর, “ব্যাণ্ড কিনে আনো মা।কালই লাগবে- ”
স্কুল থেকে চিড়িয়াখানায় নিয়ে যাবে, মেয়ের আমার খুশির সীমা নেই। আপদ স্কুলের ফরমাইশ, দুহাতে দুইটি লাল ব্যাণ্ড পরে যেতে হবে চিড়িয়াখানা। নতুবা, আবাসিক ভেবে খাঁচায় পুরে দেয় যদি-। কখন ফিরবে মা? হাঁ করে ঘড়ি দেখে তুত্তুরী। দৌড়ে চলা মিনিটের কাঁটা টেনে নিয়ে যায় ঘন্টার স্থূলাকৃতি কাঁটাকে- । তাও বাড়ি ফেরে না মা।
  ভারি হয়ে আসে মায়ের চোখের পাতা, মনের কোণে জমতে থাকে, দিনভর ছায়াযুদ্ধের ক্লেদ আর তিক্ততা।  আসেপাশে সকলেই চলেছে কাজে। রাতভর ডিউটি করবে এরা, তারপর ভোরের ট্রেন ধরে বাড়ি। বাড়ি ফিরে নিজের হাতে বড় গ্লাস ভর্তি চা আর দুটো বিস্কুট খেয়ে চড়াবে রান্না। কারো বর, খেয়ে কাজে বেরোবে। তো কারো ছেলে। রান্না শেষে, কাচতে বসবে জামাকাপড়। মধ্যাহ্নভোজের পর সামান্য জিরিয়ে নিয়েই শুরু করবে রাতের রান্না। বর-ছেলের খাবার গুছিয়ে, রাতের খাবার টিফিন বাক্সে ভরে কাজে বেরোবে আবার। এত ব্যস্ততার মধ্যে এই ট্রেন যাত্রাটুকুই এদের বিনোদন। কত যে খোশ গল্প করে এরা, সামনের আয়ামাসি যেমন শুনিয়েই চলেছে, প্রথম উড়োজাহাজে চড়ার অভিজ্ঞতা। হাঁ করে শুনছে, দুটো সিটে বসা আটজন মানুষ। শুনছে তুত্তুরীর মাও। যে বাড়িতে রাতের আয়ার কাজ করেন, তাদের সৌজন্যেই সম্প্রতি প্লেনে চড়েছেন- গিয়েছিলেন সুদর চেন্নাইয়ের লাগোয়া কোন সমুদ্র শহরে। সেখানকার পাঁচতারা হোটেলে কার যেন বিয়ে ছিল-। পাঁচতারা হোটেলের খাবার বিন্দুমাত্র মুখে রোচেনি ওণার। “ম্যা গো! কোন সোয়াদ নেই-। বিরিয়ানিতে নেই কোন খুশবু-। ” বিরিয়ানি ছেড়ে এবার সদলবলে ঢুকলেন উড়োজাহাজের শৌচাগারে। যাবার সময় ভয়ে ওপথ মাড়াননি। ফেরার সময় বমি করতে গিয়ে তো রীতিমত উচ্ছ্বসিত। মিথ্যা ভয় দেখিয়েছিল, বৌদি, পুঁচকে শৌচাগারে ঢুকলে যদি আটকে যায়-। তুত্তুরীর মা বলতে গেল,“ তুত্তুরী আর আমি দুজনে একসাথে ঢুকি তো, মা না গেলে জিন্সের ইয়ে-।” বলতে গিয়েও বলতে পারে না মা। আমি কত্ত বার প্লেনে চেপেছি- বলাটা অকারণ বড়লোকী দেখানো হয়ে যাবে না? এই দুঃসহ ভিড়ে একা হয়ে যাবে না তুত্তুরীর মা? আয়া দিদি ততোক্ষণে অবশ্য শৌচাগার থেকে মূত্রে উপনীত হয়েছেন। সাইন্স সিটি টপকে কোন নির্মীয়মান আবাসনের ভিতর যেন ঢুকেছিল দাদা। অন্ধকারে ঝোপের ঘাড়ে, যেই না- অমনি এসে হাজির এক অনামুখো ট্রাফিক পুলিশ। সটান ফাইন- ৫০০ট্যাকা। দাদা যত বলে, “ আমি তো ডায়বেটিস রুগী, আমি তো ওষুধ খাই। আমি তো চাপতে পারি না-”। পুলিশ তাও শোনে না। শেষে কড়কড়ে ৩০০টি হিসুর টাকা দিয়ে মুক্তি পেল দাদা। বাড়ি এসে দাদা সমানে বলে যাচ্ছে, “আমার হিস্যুর ট্যাকা, তোর হজম হবে?” আয়া দিদির চোখ ছলছলিয়ে উঠল, “তুই ট্যাফিক পুলিশ, তুই রাস্তা দেখ। তা না। কে কোথায় মুতছে, ঝোপে ঝাড়ে, তোর দেখার কি দরকার শুনি? ৩০০ ট্যাকায় দু পেলেট বিরিয়ানি হয়ে যায়- ।” কেউ বুঝি ফেলল দীর্ঘশ্বাস। এক রাতের রোজ ৩০০ টাকা পায় এরা- 
কোন স্টেশনে যেন থমকে দাঁড়াল ট্রেনটা, দুজন নামল তো ছয়জন উঠে পড়ল গোঁতাগুতি করে। এত ভিড়ের মধ্যেও একজনকে পথ ছেড় দিল বাকিরা। আহাঃ পোয়াতি না। ঢাউস উদর মহিলা জমিয়ে বসলেন জানলার ধারে। এতক্ষণ ঐ সিটটি ছিল সবৎসা এক মহিলার। তাঁর বাচ্ছাটির বয়স বড় জোর দুই-ইতিমধ্যে দুপ্যাকেট পাঁপড় ভাজা নষ্ট থুড়ি উদরস্থ  করেছেন তিনি। মা জানলা দিয়ে বাইরে তাকালেই, উঃ উঃ করে মায়ের মুখটা ঘুরিয়ে নিচ্ছিল নিজের দিকে। মা উঠে যাবার পর দিব্যি বসে আছে, স্ফীতোদরা রমণীর পাশে। দিব্যি গল্প ফেঁদেছেন যিনি সিট ছেড়েছেন, আর যিনি সিট দখল করেছেন দুজনে। এপাশ ওপাশ থেকে পড়ছে ফোড়ন। পোয়াতি মেয়েমানুষের কি করা উচিৎ- অনুচিৎ এই আলোচনার ফাঁকে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছে বাচ্ছাটা। একটা হাতে ঝুলছে দুই পায়ের ফাঁকে, অন্যটি রাখা আছে পার্শ্ববর্তিনীর স্ফীত উদরের ওপর। যাদের জাত-ধর্ম ছাড়ুন, ভাষাটাও আলাদা। অন্যমনস্ক ভাবে জানলা দিয়ে বাইরে তাকায় তুত্তুরীর মা-  কাল বুঝি ভালোবাসার দিন? ধীর গতিতে চলতে থাকা ট্রেনের জানলা দিয়ে ভয়ে ভয়ে ঢুকে আসে বসন্তগন্ধী হাওয়া। অন্য কি যেন গল্প জোড়ে আয়া মাসিরা- এইটুকই প্রাণখুলে বাঁচা। ট্রেন থেকে নামলেই তো আবার শুরু প্রাত্যহিক ইঁদুর দৌড়-

Thursday 6 February 2020

অনি এবং তুত্তুরীর ডাইরি, ৫ই ফেব্রুয়ারি, ২০২০


শেষ শীতের কামড় কি না জানি না, সামান্য জ্বরজ্বর  ভাব, কাতর হয়ে কিয়ৎক্ষণের জন্য বন্ধ করেছিলাম চোখের পাতা- আচমকা-“মা। মা। শিগ্গির ওঠো। ” তুত্তুরীর আর্ত স্বরে ঘুম পালাল জানলা দিয়ে- কি হল? ধড়মড় করে উঠে বসছি, তুত্তুরী বলল,“ সব্বনাশ হয়েছে মা। গিজার বার্স্ট করেছে-”। অ্যাঁ? গিজার বার্স্ট করল কি করে? পড়িমরি করে বাথরুমের দিকে যেতে গিয়ে খেয়াল হল, আমার কন্যার ওষ্ঠাধর প্রগাঢ় তথা ঝিকিমিকি বেগুনী। ঐ একই রঙ শোভা পাচ্ছে তুত্তুরীর নাকে, গালে, দুই হাতে তথা জামায়। এতক্ষণে অনুধাবন করলাম, ঘুমের ঘোরে শুনতে ভুল করেছি। তুত্তুরী বলেছে বা বলতে চেয়েছে, তা হল- গ্লিটার পেনটা বার্স্ট করেছে। বেচারা গ্লিটার পেনের আর দোষ কি, তাকে খুলে তার রিফিলের পিছন দিকটা যদি মুখে ঢোকানো হয়-

টুকটুকে পার্পল রঙা ছোট্ট জিভটা আর অপরাধী আঁখিদ্বয় যেন টাইম মেশিন, চোখের সামনে ভেসে উঠল এমনি এক অলস দ্বিপ্রহর। বাবা- মা অফিসে, মস্ত বড় বাড়িটা যেন খাঁ খাঁ করছে। উত্তরপশ্চিমের ঘরের চারটে জানলা দিয়ে ছুটে আসছে রোদ আর হাওয়া। খুলে রাখা জানলার কাঠ পাল্লায় বসে,গম্ভীর গলায় ডাকছে কাক-কদাচিৎ এসে বসছে পায়রা আর ঘুঘু। একলা একটা মেয়ে কেবলই ঘুরপাক খাচ্ছে ঠাকুমার বিয়ের সাবেকী কারুকাজ করা খাটটাকে ঘিরে। দেওয়াল ঘেঁষে রাখা দেরাজের ওপর বসানো বাবার ঠাকুরদার আমলের নীলরঙা দেওয়াল গিরি। যার তলার পাত্র তথা পলতের কলটা ব্রোঞ্জের। দুটো পলতে।  চিমনিটাও কেমন চ্যাপ্টা। লোডশেডিং হলে বুড়ো দেওয়ালগিরি একাই একশ। কান ধরে পড়তে বসায় মা-। ব্রোঞ্জের নক্সী বাটির ওপর পলকাটা কাঁচের পাত্রের ভিতর টলটলে কেরোসিন। নিজের অজান্তে কখন যে পলতে ধরে টানাটানি করতে শুরু করেছিল মেয়েটা। যখন খেয়াল হল- দেখা গেল দুদুটি পলতেই তলার কেরোসিন তেলের পাত্রে সাঁতার কাটার বৃথা চেষ্টা করে টুপ করে ডুবে গেল। অতঃপর? অফিস ফেরৎ মায়ের স্কেল পেটা? দৌড়ল মেয়েটা- বিশাল দালান টপকে, একুশ খানা সিঁড়ি দিয়ে তরতর করে নেমে, একতলার দালানকে আড়াআড়ি পার হয়ে, কালো ঠাকুরঘরের রোয়াকের বুক বরাবর ছুট্টে উঠোনের ওপাড়ে সাবেকী রান্নাঘর।ঘড়িতে বেলা বারোটা বাজল বুঝি, সবে জলখাবার খেতে বসেছেন বৃদ্ধা ঠাকুমা। জলখাবার বলতে যৎসামান্য এক-দুখানি হাতে গড়া রুটি, খানিকটা  ট্যালট্যালে গরম ডাল আর চিনি। কখনও বা ডালও হত না, নিছক চিনি-জল দিয়েই রুটি খেতেন চাটুজ্জে বাড়ির দোর্দণ্ডপ্রতাপ গিন্নী। মেয়েটা গিয়ে কেঁদে পড়ল- ঠাকুমা বাঁচাও। ঠাকুমার নির্দেশে, জলখাবার না খেয়েই দৌড়ে এল মেজো পিসি। বাবাদের দিদি। ভাইপো-ভাইঝিরাও বলে দিদি। কি দস্যি মেয়ে বাবা- বলতে বলতে, কাঁচ খুলে পরিয়ে দিল পলতে। মুছেও দিল কাঁচটা। যাবার সময়ে বলে গেল-“চুপ করে ঘুমিয়ে পড়ো।” ঘুম? ঘুম তো আসে না। বালিশে মাথা দিয়ে  ঢিমে তালে ঘোরা সাবেকী ডিসি পাখার দিকে তাকিয়ে খানিক নিজের মনেই রাজারাণীর গল্প বলে মেয়েটা। খানিকভাব জমানোর চেষ্টা করে, জং ধরা কড়ি বরগার ফাঁক গলে ছোটাছুটি করা চড়াইদের সাথে।এমনকি পায়রা ধরার লোভে উঁকি মারা জেঠুর পোষা বেড়ালের সাথেও- পাত্তা পায় না মেয়েটা।  বড় ব্যস্ত সবাই।  ব-ড় বে-শীইইই ব্যস্ত। তারপর?

“ঠাকুমা।লাল ওষুধ আছে?” ঘড়িতে বোধহয় আড়াইটে-তিনটে। সদ্যস্নাতা ঠাকুমা,উঠোনের তারে মেলছিল সাদা শাড়ি। ও পাশের রোয়াকে ফ্যান গালছিল পিসি, ভাতের ডেকচি ফেলে দৌড়ে এল- লালে লাল মেয়েটার মুখ, সাদা টেপ ফ্রক। দুহাত দিয়ে টপটপ করে ঝরছে রক্ত। হাঁউমাউ করে উঠল বৃদ্ধা, “কি সর্বনাশা কাণ্ড রে। তোর বাপ-মা যে আমাদের ভরসায় রেখে গিয়েছিল-কি জবাব দেবো তাদের?” ঘাবড়ে গিয়ে মেয়েটা কিছুক্ষণ বাকহারা। তারপর, বাড়িয়ে দিল একটা খালি  লাল ওষুধের শিশি। নতুন কেনা লাল ওষুধ, রাখা ছিল দেওয়াল আলমারিতে। হাত দিয়ে কর্কটা না খুলতে পেরে লাগিয়েছিল দাঁত- পরিণামে-- এখন শুধু একটু লাল ওষুধ যদি জোগাড় করে দেয় ঠাকুমা, বাকিটা জল ভরে আবার সাজিয়ে রাখবে আলমারিতে। বাবা বুঝতেও পারবে না-

বেগুনী জিভ বার করে বোদাকালী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তুত্তুরী, আর তার মা না জানি অতীতের কোন গলিতে হারিয়ে হেসেই চলেছে। যা ব্যাটা- আজকের মত মাপ করে দিলাম তোকে। তোর মধ্যে দিয়েই তো ফিরে পাই হারিয়ে যাওয়া শৈশব। আর সেই মানুষটাকে,না জানি কোথায় হারিয়ে গেছে যে। আকাশের কোন তারাটায় তার বর্তমান বসবাস কে জানে?

Monday 3 February 2020

তুত্তুরী উবাচ- ৩রা ফেব্রুয়ারি, ২০২০


- “মা, এ দেখো।” জুতো খোলার আগেই সোল্লাসে বলল, তুত্তুরী। মুখেচোখে সহস্র ওয়াটের উজ্জ্বলতা।
কি দেখব? হাতে এক টুকরো, ছেঁড়া গোল কাগজ। তাতে পেন্সিল দিয়ে হিজিবিজি  কাটা। তুত্তুরী জানালো, ওটা “ক্লাব অর্ঘ্য”র সদস্য হবার অঙ্গীকার।ক্লাব অর্ঘ্যটা কি বস্তু? বুঝলাম না। বোধহয় মুখে চোখে ফুটে উঠেছিল অজ্ঞতা। তুত্তুরী জ্ঞান দেবার ভঙ্গীমায় হাত নেড়ে চোখ ঘুরিয়ে বলল, “অর্ঘ্য একটা ক্লাব খুলেছে। আমি তার সদস্য-”। তা ভালো।
জুতো খুলে, ব্যাগ রাখতে না রাখতেই, শুরু পরের পর্ব। “ মা, তুমি লেবু খাওনি? তোমার ব্যাগে চারটে লেবু আর একটা আপেল রয়েছে। ” বোঝালাম, লেবুটা ট্রেনে কেনা। আপেলটা- ইয়ে মানে,খাবার টাইম পাইনি। বিনতি করলাম, বাপকে যেন না বলে। তিনি পারলে এই বুড়ো বয়সে, কান ধরে ডনবৈঠক দেওয়ান আর কি-
হাত নেড়ে, এক চোখ বুজতে গিয়ে দুই চোখ পিটপিট করে, তুত্তুরী জানাল, বলবে না। বিনিময়ে শুনতে হবে সারাদিনের গপ্প। “মা জানো তো, যত এমব্যারাসিং ব্যাপার স্কুলেই ঘটে। আজ আমার পেট এত গোঁ গোঁ করছিল,যে সামনে-পিছনের বেঞ্চ থেকে বন্ধুরা বলল, ‘হাস্। কোয়ায়েট।’  বললাম, “নট মি। মাই টামি-”।” হাসব না কাঁদব বুঝতে পারলাম না। তুত্তুরী ততোক্ষণে অটোপাইলট মোডে, বকেই চলেছে,“অদ্রিজা দাস,বলল, ‘ডিডন্ট ইউ হ্যাভ ব্রেকফাস্ট?’” এটা অবশ্য আমারও মনে হয়েছিল। প্রাতঃরাশ ছাড়ুন। ও তো ভাত খেয়ে ইস্কুলে যায়। টিফিনে মনপসন্দ চিজ টোস্ট। তাও বেশী করে দেওয়া হয়, বন্ধুদের সাথে যাতে ভাগ করে খেতে পারে। তা সত্ত্বেও পেট গোঁ গোঁ করে কেন? জবাব পেলাম, টিফিন টাইমে,হাত ধুতে যাবার সময়, একটি টোস্ট কেউ সাবড়ে দিয়েছে। এতো নৈমিত্তিক ব্যাপার। রোজই তুত্তুরীর টিফিন কেউ সাবড়ে দেয়-। ঐ বয়সে আমারও দিত। তবে মজার কথা, আজ যিনি সাবড়েছেন, তিনি অপরাধ বোধে ভুগে, শেষ বেলায়, ঐ চোতা কাগজটি তুত্তুরীকে গছিয়েছেন। চীজ টোস্টের বিনিময়ে ক্লাব মেম্বারশিপ। মন্দ হয়। উপরি পাওনা প্রতিশ্রুতি, তার মা অচীরেই মটন চাউমিন করে দেবেন টিফিনে,তার ভাগ পাবে তুত্তুরী। কে জানে, চীজ টোস্টের দুঃখে না মটন চাউমিনের লোভে গোঁ গোঁ করে পেট-
মুখহাত ধুয়ে, চা নিয়ে বসেছি, উল্টো দিকে গুছিয়ে বসে পরের,পরের পর্ব শুরু করল তুত্তুরী। “মা জানো, সানরাইজ না সর্ষে, পোস্ত পাউডার বার করেছে-”। বিশেষ পাত্তা পেল না, দেখে আরও উৎসাহ নিয়ে শুরু  হল,“ ইমামি হেলদি এন্ট টেস্টিও বার করেছে মা। পাশের ফ্ল্যাটের ঠাম্মার রান্নাঘরে-”। এতক্ষণে চমক ভাঙল মায়ের, প্রায় বিষম খেতে খেতে জানতে চাইলাম, পাশের ফ্ল্যাটের রান্নাঘর দেখল কি করে। প্রশ্ন করার অবশ্য দরকার ছিল না, তুত্তুরী বলেই চলেছে,“ওদের রান্নাঘরে কি বিশাল একটা চিমনি লাগিয়েছে। হ্যাঁ গো মা। আমি দেখেছি। সেদিন ওদের ফ্ল্যাটে যখন রঙ হচ্ছিল,স্কুল থেকে ফেরার সময়,  আমি ওদের গ্রীলের গেটের বাইরে থেকে দেখছিলাম। ও বাড়ির ঠাম্মাটা খুব ভালো। উনিই তো ডেকে নিয়েগেলেন। সব ঘর-রান্নাঘর ঘুরিয়ে দেখালেন-। জানো ওদের বাড়ির ভাইটার সবে দুমাস বয়স, ঠাম্মা বলছিল।  আমি শুনে বললাম-এ হে হে,তোমরা এখনই ফ্ল্যাট রঙ করে নিলে? আমি তো এত্ত বড়। তাও আমি দেওয়ালে ছবি আঁকি। দেওয়াল নষ্ট করি-”।  এতদিনে বুঝলাম,কেন পাশের ফ্ল্যাটের কাকিমা দেখা হলেই তুত্তুরীর তত্ত্বতলাশ করেন। দেওয়াল রঙ করা নিয়ে মা নতুন করে কিছু বলছে না দেখে, তুত্তুরীর বোধহয় সাহস বেড়ে গেল,“মা একটা সত্যি কথা বলব? তুমি জানো আমি কি কি দিয়ে দেওয়ালে এঁকেছি আজ অবধি?” শুনে কি অষ্টাবক্র লাভ হবে জানি না, তবে কান তো বন্ধ করা যায় না। “আমি প্রথমে আঁকতাম পেন্সিল দিয়ে, তারপর চামচ দিয়ে। তারপর তোমার পুজোর ধূপ দিয়ে। স্কেচপেন দিয়ে, ফেব্রিক কালার দিয়ে, তারপর গ্লিটার পেন দিয়ে-পার্মানেন্ট মার্কার দিয়ে- ”। আর কি যে শুনতে বাকি রইল- হে ধরিত্রী দ্বিধা হও মা।

Sunday 2 February 2020

কথা-

©Anindita Bhattacharya

-কথা বলো-
-এত রাতে? কি কথা?
-জানি না। যা মন চায়-।
-হুঁ।
-বিরক্ত হয়ো না প্লিজ। জানতে চাইছি না, তুমি আমায় ভালোবাসো কি না-,ইত্যাদি। ইত্যাদি। এমনি কথা বলো না,যা হোক কিছু-D
-হুঁ।
-সাদামাটা কথা। ঘর গেরস্থালির কথা। বা মন চায়- যদি মন চায়- আমার সাথে কইতে।
-হুঁ। সে বলাই যায়- কথা।
- তুমি কি জানো? রুবির মা একটি পাকা চোর? আজ রাতে ও তোমার জন্য দুটি পরোটা বানিয়েছিল- বাকি আটটা নিজের জন্য। তোমার নাকের ডগা দিয়ে ব্যাগে ভরে নিয়ে গেল- তুমি টেরটিও পেলে নাR।
- তাই নাকি?
- নয়তো কি? তোমার নাকি মাসে এক কিলো সার্ফ লাগে। লাগতে পারে? তোমার কি মনে হয়?
_ হুঁ । এটা আমারও মনে হয় মাঝে মধ্যে। আর তিন কিলো তেল আর দু কিলো চিনিটাও বাড়াবাড়ি যাই বলো। বুঁচকু থাকলেও না হয় মানা যেত-
- তবে? বোঝ তো সবই। কিছু বলো না কেন?
- ধুর। বুঁচকু বারবার বলে, “বাবা, আমার এখানে চলে এসো। ভাবছি, সত্যি কটা দিনের জন্য চলেই যাই-K
- চলে যাবে?
-হুঁ। কটা দিন থেকেই আসি না হয়। ওর বাচ্ছা গুলোও ছোট। আমি থাকলে একটু সুবিধে হয়-
-অ। চ-লে যা-বে।
অতঃপর? অন্তহীন নীরবতা। উঠে পড়লেন সুকুমার বাবু। গলায় বেশ ব্যথা করছে। রাত তিনটে। ঘুম আজ আর আসবে না। খুট করে জ্বলে উঠল রান্নাঘরের আলো। জ্বলল গ্যাস। মেপে জল নিলেন সস্ প্যানে। গ্যাসে চড়াবার আগের মুহূর্তে পিছন ফিরে জিজ্ঞাসা করলেন,“তুমি খাবে?” অখণ্ড নীরবতা। চরাচর যেন প্রাণহীন হয়ে পড়েছে। আরশোলা টিকটিকি, ব্যস্ত রাজপথ দিয়ে অনর্গল ছুটে চলা লরি বা বাসগুলোরও যেন লুপ্ত হয়েছে অস্তিত্ব। শ্বাস ছেড়ে চা বানাতে লাগলেন সুকুমার বাবু। অভিমান। অভিমান। কথায় কথায় অভিমান হয় এদের মা আর মেয়ের। ওদিকে মেয়ে ঠোঁট ফোলাচ্ছে, “আসছ না কেন বাবা?তুমি আমায় একটুও ভালোবাসো না।”  আর এদিকে মা-। দুজনেই চায় তাঁকে। দাঁড়িপাল্লার দুদিকে দুজনকে চাপিয়েই গোটা যৌবন কাটল সুকুমার বাবু। পান থেকে চুন খসলেই,পক্ষপাতিত্বর  অভিযোগ আনত অপরপক্ষ। অতঃপর চলত দুদ্ধর্ষ মান-অভিমানের পালা। নিজেকে বড় মূল্যবান বোধ হত তখন-। আজকাল সব কিছুই যেন কেমন বিমর্ষ, ধুসর, বিস্বাদ লাগে-। হাঁপিয়ে উঠছেন সুকুমার বাবু-।  বয়সটাও তো-
চায়ের কাপটা রাখলেন টেবিলের ওপর। বসলেন মৃণালিনীর মুখোমুখি। এক গাল হাসি দেখে জ্বলে গেল গা। সারাজীবন ঘুমোতে দিল না, মিনু ওকে। অল্পবয়সে চোখের পাতা জুড়লেই যত সোহাগ উথলে উঠত মিনুর। সেই “অল্পবয়স” চলেছে মধ্যপঞ্চাশ অবধি। তারপর শুরু হল রোগের বাহানা। পা ব্যথা, মাথা ব্যথা, অম্বল-গ্যাস-চোঁয়া ঢেঁকুর। জ্বর হলে তো কথাই নেই। সুকুমার বাবুর অসাক্ষাতে দিব্যি সব করে বেড়াত, যেই বুড়ো বরকে দেখত,অমনি কচি খুকি হয়ে যেত মিনু। কোলের কাছে গুটিসুটি হয়ে শুয়ে থাকতে চাইত-। মাঝে মাঝে চোখ বন্ধ থাকলেও হাত বাড়িয়ে দেখে নিত, সুকুমার আছে কি না। বাপের বাড়ি গেলেও আসত হুকুম- ফেরার পথে নিয়ে যেও কিন্তু।  সুকুমারকে ফেলে হাসপাতালেও গেল না মিনু- কি অনন্যসাধারণ লজিক,  না, “তোমাকে ছেড়ে গেলে তো এমনিই বাঁচব না-।” ঐ কথা আজকাল সুকুমারেরও বলতে ইচ্ছে হয়। বড় ইচ্ছে হয়- শুনবে কে? শুনছে কে? ডাইনিং রুমের দেওয়াল জোড়া সুন্দর সুন্দর ছবি, না না বয়সের মিনু। হাসি মুখে তাকিয়ে আছে সুকুমার বাবুর দিকে। বলেন। আজকাল ওদের সঙ্গেই কথা বলেন সুকুমার বাবু। ওদের সাথে কথা বলা সহজ।  সেই সব কথা, যা কখনও বলতে পারেননি মিনুকে। ভয় করত যে, দুর্বলতা দেখাতে- জানতে পারলে যদি কমে যায় মিনুর ভালোবাসা। তাই মিনুর সামনে কখনও বলতে পারেননি। আজও পারেন না। যখন স্বপ্নে মিনু আসে,ক্ষণিকের তরে- অব্যক্ত কথায় চাপে শুধু বড় ব্যথা করে গলা। বললেই যদি চলে যায় মিনু,চিরতরে-। স্বপ্নটুকুই তো শুধু সম্বল সুকুমার বাবুর- 
-

Saturday 1 February 2020

অনির ডাইরি, ১লা ফেব্রুয়ারি,২০২০


সবে তো নাম দেখানো শুরু, এখনই সাজানো কাবার প্ল্যাটারের মত সদ্য কেনা বইয়ের ছবি দিচ্ছে জনগণ।কুয়াশা কুয়াশা ভোরে, গরম কফির কাপে ঠোঁট ডুবিয়ে শৌভিক বলল,“দাঁড়া, এখনও তো অমুক বইমেলায় যায়নি। দেখবি ছবি কাকে বলে-”। নিন্দুকে যাই বলুক, মন্দ লাগে না ব্যাপারটা। এদের মধ্যে কোথাও না কোথাও খুঁজে পাই, ফেলে আসা “আমি” কে। জীবনের প্রথম মোচি, (গুচি নয়) তাও ডিসকাউন্টে কিনে এমন পুলক জেগেছিল- সটান ছবি ফেবুতে। বিদিশা দি, সেই টুনটুনির গল্পে, টুনটুনি পাখি গেলা রাজার মত মুখ করে বলেছিল,“জুতোর ও ছবি দেয় মানুষ? অনিন্দিতা?” আহাঃ কি অপরূপ সুন্দর জুতো,পাক্কা ছয় ইঞ্চি হিল- শাশুড়ি মায়ের হাঁটুর ডাক্তার ওণার হাঁটু ফেলে হাঁ করে দেখেছিলেন আমার জুতো। অসাধারণ সুদর্শন মধ্যবয়সী ডাক্তারবাবু আবার সম্পর্কে আমার অন্যতম প্রিয় সখীর ভাসুরঠাকুর।  মস্তিষ্কস্থিত পদার্থটি সামান্য ধুসরতর হতেই সটান উড়িয়ে ছিলাম সেই ছবি। ছিছিছিছি ছিঃ।
তো যা বলছিলাম আর কি, বুঝলেন আসলে ব্যাপারটা আর কিছুই না, আমরা ঈর্ষান্বিত। সরস্বতী পুজো উপান্তে জমিয়ে বসেছে বইমেলা। বাতাসে এখনও মেলায়নি হিমের রেশ। মাননীয়া দিয়েছেন উপুড় করে ছুটির ভাণ্ড। মুস্কিল হচ্ছে,ব্যাপারটা অনেকটা তোমার ছুটি আমার নয় মত ব্যাপার। অনেক প্রশাসনিক দপ্তরই এই ছুটিতে খোলা- আর যে গুলি বন্ধ, তার হতভাগ্য কর্মীকুল বাড়ি বসেই সারছে কাজ।কারণ? আমার কাজ তো আমারই বাপ,তোমার তো নয়! যেমন শৌভিক দেখছে নির্বাচনে নাম তোলা বা পাল্টানোর আবেদনপত্র। আর আমি বসে বসে লিখছি গ্রাচুইটির অর্ডার। কাল মধ্যরাতে গিয়ে শেখ ইয়াকুবের (নামটা কাল্পনিক) হিসেব দাঁড়াল সুদ সমেত সাড়ে তিন লাখ। শৌভিক মুখ বেঁকিয়ে বলল, “দেবে? এত টাকা? মনে হয় না!“ বলবে নাই বা কেন? হতভাগা নচ্চার ম্যানেজার, লোকটার চাকরী জীবন থেকে, ২৩ খানা বছর সির্ফ ঝেড়ে ফেলে দিয়েছিল। দরিদ্র মূর্খ শ্রমিক, ডান থেকে বাঁয়ে সই করে নিজের নাম। সে নাকি ১৫বছর ধরে শিখেছে কাজ- আর বাকি ৮ বছরে মেরেছে ফাঁকি। তবুও ২৩বৎসরান্তে তাকে পার্মানেন্ট করেছে মালিক পক্ষ। গাঁজাখুরি  আর কাকে বলে- সরকারী চেয়ারে বসে তো আর দেওয়া যায় না খিস্তি- যেটা স্বচ্ছন্দে বলা যায় ডাইনিং টেবলে কাজ সারতে সারতে।
কাল শুতে শুতে রাত দেড়টা। ভোর বেলা ঘুমে ভারি চোখে দেখি জোর তাগাদা-পর্যায়ক্রমে সুবীরবাবু এবং রঞ্জন দার। আসতেই হবে বইমেলা। আজ আমাদের বইয়ের শুভ উদ্বোধন।  আমাদের বই! আজ্ঞে হ্যাঁ। সমগ্র ফেবু জুড়ে শয়ে শয়ে গ্রুপ। হাজারে হাজারে যার সদস্য। যার অনেকগুলিতে কে বা কারা যেন অ্যাডিয়েছে আমারে। কোথায় আঙুলও ছোঁয়াই না আমি। ব্যতিক্রম শুধু- হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা। কারণ? এটা আমাদের গ্রুপ। বছর ভর গ্রুপের দেওয়ালে ভাস্বরিত লেখা এবং ছবিগুলির সংকলন আজ প্রকাশ হবার কথা- সময় দুপুর তিনটে। স্টল-২১২র নান্দীমুখ।
আর দেখলাম জনৈক সুদূরপ্রবাসিনী প্রিয়তমা বান্ধবীর ভীষণ মন খারাপ। এবারের থিম বুঝি রাশিয়া- আমাদের শৈশব জুড়ে রাশি রাশি রাশিয়ার কথা। চকচকে সাদা পাতায় ঝকঝকে গল্প। রঙচঙে মলাট। পুজোর ছুটি হোক বা গ্রীষ্মের ছুটি, অথবা পরীক্ষা শেষের লম্বা ছুটি। নিঃসঙ্গ দুপুরে,ঘড়ঘড়ে পাখার তলায়,উপুড় হয়ে, পাতা উল্টোলেই গরমের দেশে লালিতপালিত একদল বাচ্ছা ঝপ্ করে গিয়ে পৌঁছত বরফের দেশে। তারপর? হত কত কি। কখনও তিমুর ও তার দলবলের সাথে অ্যাডভেঞ্চার- তো কখনও রাজপুত্র আর রাজকন্যার চিরকালীন প্রেম। কোথায় যেন হারিয়ে গেল বইগুলো, আমাদের ছোট বেলার মত- বন্ধু শুনেছে ঐ বইগুলোই নাকি পাওয়া যাচ্ছে বইমেলায়- রাশিয়ার স্টলে। অফিস-সংসার দশহাতে সামলে আর আসা হবে না এবছর। প্রচণ্ড দস্যি খুদেটার বোধহয় আর পড়া হল না কুড়ুলের জাউ বা দুষ্টু পেঁচার ছানার গল্প-

হোয়াটস্অ্যাপ বন্ধ করে ভাবলাম- নাঃ। এত চাপ নেওয়া যায় না। চালাও পানসি বইমেলা,ভায়া হাওড়া অবশ্যই। বাবা- মা- পিসিকে আলিঙ্গন করে, তরতরিয়ে বেড়ে ওঠা বুল্লু বাবুর, ফুটবল খেলে ফেরা নোংরা আঙুল কামড়ে খানিক থুঃ ছিটিয়ে(আহাঃ নজর না লাগে) পেটপুরে মায়ের হাতের মাংসভাত খেয়ে যখন বেরোচ্ছি, ছোট্ট কাগজে লেখা বাবার আব্দার- সৃষ্টিসুখ থেকে রোহন কুদ্দুসের লেখা রাজদ্রোহ বইটা যদি-।

হল। হল। সবই হল। ঘোরাও হল।  কেনা হল রাজদ্রোহ। রূপম দা-শর্মিষ্ঠাদিদের সাথে দেখাও হল। সেই খড়্গপুর থেকে শুনে আসছি ওণাদের গল্প- দাদাদিদি বলব না স্যার-ম্যাডাম বলব, সেই টেনশনে বেশ খানিকক্ষণ ধ্যাড়ালাম দুজনে। থাকলাম সপরিবারে হারিয়ে যাওয়ার বই উদ্বোধনে। মাথায় টুপি পরে,সুবীর বাবু- অদিতি দি আর রঞ্জনদার মাত্রাতিরিক্ত খাতিরে, ভিআইপি সুলভ বেজায় বেজার মুখে বই উদ্বোধন করল তুত্তুরী। পাশ থেকে সুবীর বাবু বললেন,“ফিশফ্রাই খেলেই দিলখুশ হয়ে যাবে তুত্তুরীর-”। কে যেন জানতে চাইলেন, “ও কি খেতে চেয়েছিল-”। প্রবল হাসি চেপে বললাম, ও আসলে কিছু চায়নি। না চাইতেই কেনা হয়েছে বেশ কয়েকখনা বই। যা তুত্তুরীর হিসেবে অ-ন-এ-এ-ক। আঁতকে বলেছিল,  বাংলা তো তেমন পড়তে পারি না। বাবা দিয়েছে ধমকে হাঁকিয়ে । হাঁদাভোঁদা বা বাঁটুল তো দিব্যি পড়তে পারিস, শুধু বিভূতিভূষণ বা অবন ঠাকুর দেখলেই পারিস না? সবশেষে মা আবার যমজ বই কিনেছে,দুটো মোটকা মোটকা রাশিয়ার উপকথা। আঁতকে উঠেছে তুত্তুরী!দুটোই আমার? বলা হল,একটি সেই গুণধরের যিনি কিছুদিন আগে,চিমনি পরিষ্কার করতে আসা মিস্ত্রিকে,মায়ের দামী শাল কেটে সরবরাহ করেছিলেন-। সেই থেকে সমানে মাপছে তুত্তুরী। কোনটা পাতলা বেশী, সেটাতেই হোক তুত্তুরীর নাম লেখা-
আর হ্যাঁ, প্রিয় টাইগার, আপনাকে আমরা ভুলিনি। আজও নিভৃতে আপনার কথা বলেছি রঞ্জনদা আর আমি।কি বলেছি,বলুন দিকি? বলেছি, উহ শের থা সাব। অউর শের কো পাকড়ে কিসমে হ্যায় ইতনা দম- যেখানেই থাকুন, ভালো থাকবেন। 

অনির ডাইরি, ২৯শে জানুয়ারী ২০২০


মা, বড়মামার মুখে গল্প শুনেছে তুত্তুরী আর বুল্লু দাদা। সেই যে আশির দশকের গপ্প- যখন ঘুম ভাঙাত, “ইয়ে আকাশবাণী হ্যায়-”।ভোরের বাতাসে উনুনের ধোঁয়ার বাস-দুধ চিনি দেওয়া চায়ের সাথে থিন অ্যারোরুট আর আনন্দবাজার নাকি যুগান্তর- । ঘড়ি বেঁধে দূরদর্শন সম্প্রচার- মাঝে মাঝেই অনুষ্ঠান প্রচারে বিঘ্ন ঘটায় দুঃখিত। নিয়ম করে ঘুরত সূর্য- চন্দ্র। বদলাত ঋতু। হত ষাণ্মাসিক বা বার্ষিক পরীক্ষা। ঝুড়ি আর বস্তা করে নম্বর আনত ক্ষীরেরতলা গলির কাঁঠাল গাছ ওয়ালা চাটুজ্জে বাড়ির তিনটে ছানা- যেমন আনে তুত্তুরী। অতঃপর? মা আর মামাদের মাথায় পড়ত সটাসট্ চাঁটি আর ঠকাঠক গাঁট্টা। দিদি( আসলে দাদুর দিদি) বলত, “সরস্বতী পুজোর আগে কুল খেয়েছিলি?আর খেও না। মা সরস্বতী রাগ করেন-। ” এটা অবশ্য মাও বলে তুত্তুরীকে। পাশ থেকে ফোড়ন কাটে বাবা- “হ্যাঁরে? তুই সত্যি ফিজিক্স নিয়ে পড়েছিলি?”
 হিমেল রেশ থাকতে থাকতেই এসে পড়ত সরস্বতী পুজো। পাল্লা দিয়ে লাফাত খুদে মা আর মামাদের দল।  ঠাকুর আনবে কখন? ঠাকুর সাজাবো কখন? রিক্সা চেপে কোলে করে ঠাকুর আনত দাদু/ছোট দাদু। সাজানোর গুরুদায়িত্ব ছিল দাদুর একার। সহকারী তিন খুদে মাতব্বর। একতলার ঠাকুর ঘরের পলেস্তারা ওঠা দেওয়াল ঢাকা পড়ত মামমামের(দিদা) দামী সবুজ দক্ষিণী সিল্কের আবরণে। কালো ফুটিফাটা রোয়াকে দণ্ডায়মান দুই থামের গায়ে বাঁধা হত কলাগাছ। তার সামনে বসত স্বস্তিকা আঁকা মাটির ঘট আর সশীষ ডাব। প্রায় মধ্যরাত জুড়ে বাড়ি সাজাত দাদু। বছর ভর জমানো সিগারেটের বাক্স থেকে বেরিয়ে আসত রাঙতার পাহাড়। নিপুণ হাতে ফুল কাটত দাদু। অ্যালুমিনিয়ামের বাটিতে ময়দা ফুটিয়ে আঠা বানিয়ে দিত বড় দিদা। সটাসট চিপকাত ফুল। মাঝে ছোট্ট ব্রেক। আটটা থেকে দূরদর্শনে বাংলা সিরিয়াল- সেবার সিরিয়ালের মাঝপথে আচমকা বস্ত্র উন্মোচন করে সুইমিং পুলে নেমে গেলেন নায়ক এবং নায়িকা। যাঁদের একজন এখনও মাননীয় মন্ত্রী আর অপরজন পরাজিত সাংসদ। জলে নেমে প্রগাঢ় আলিঙ্গন এবং ইয়ে- । ফিকফিক করে হেসেই চলেছিল মা আর বড় মামা- ছোট মামা তখন বড্ডই ছোট। কান মুলে ভাগিয়ে দিয়েছিল ছোট দাদু। সেই গল্পও শুনিয়েছে মা- তুত্তুরী যে মায়ের প্রাণের বন্ধু।

গল্প শুনতে শুনতে মনে হয় যেন সাদা কালো চলচ্চিত্র দেখছে তুত্তুরী। বড় বাড়ি, যৌথ পরিবার। শতেক জটিলতা অস্বাচ্ছন্দ্য ছাপিয়ে উৎসবের অনাবিল আনন্দ। বড় রঙীন ছিল মা আর মামাদের শৈশব। আজও মায়ের চোখে-মনে লেগে আছে সেই রঙ। নিশ্বাসে ভালো লাগা তথা ভালো থাকার আস্বাদ। বড় সাধ হয় মায়ের,যদি ভাগ করে নিতে পারত ঐ আস্বাদ- তুত্তুরীর সাথে। সাধ তো হয়, কিন্তু কর্মক্ষেত্র আর ব্যক্তিগত জীবনের ভারসাম্য- ব্যাপারটা মায়ের একদমই বাগে আসে না। ট্রেনিং দেবার সময় তো মা দিব্যি শেখায়, দপ্তরী কাজই হোক বা বাড়ির কাজ নিজেকে নিঙড়ে দেবেন না, না বলতে শিখুন- দিনান্তে নিজেকে সময় দিতে কখনই ভুলবেন না, ইত্যাদি প্রভৃতি।
কিন্তু বাস্তব জীবনে কাজটা সাংঘাতিক দুরূহ। নাক কান মোলে মা।  সাংসারিক কাজকে অবহেলা করে যদি আপিসে মন বসায়, বাড়িটা হয়ে যায় শৌচাগার। আর শৌচাগারদ্বয় কি হয়, সে কথা নাই বা কইলাম। আর উল্টোপুরাণ পড়লে, অর্থাৎ দপ্তরী কাজকে পিছনে ফেলে যদি সংসারে মন বসায় মা- পরদিন অফিস যেতে নির্ঘাত ব্যথা করে পেট- জোড়ে নাকেকান্না। বাপরেঃ আপিসে গেলেই ঝাঁপিয়ে পড়বে কাজ। চামচ দিয়ে খুঁড়তে হবে পাহাড়।

এতদসত্ত্বেও উৎসবের সময় কেমন যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় মায়ের বাড়ি আর আপিস। আহাঃ ওটাও তো মায়ের পরিবারই। স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে বা বলতে পারেন গায়ে পড়েই এগিয়ে আসে সবাই- হয়েই যায় যোগাড়যন্ত্র। তুত্তুরীর বুজু সরস্বতী তো সাদা সেলোফেনের জামা পরে বসেই থাকে বছর ভর বইয়ের আলমারির মাথায়। বোতলে করে গঙ্গা জল এনে দেন ডিএম অাপিসের বৃদ্ধ অজিত দা। রমেশ আর বিদ্যুৎ মামা জোগাড় করে আনে পূজার যাবতীয়  উপকরণ। শাড়ির বস্তা নিয়ে হাজির হয় মাম্পি মাসি। “ম্যাডাম!হলুদ শাড়ি নেবেন না?তুত্তুরীর জন্য তো একটা নিন।  পয়সা না হয় নাই দিলেন-”। তুত্তুরীর যদিও একটা হলুদ শাড়ি আছে। প্রিয়াঙ্কা মাসি এসে শিখিয়ে যায় ভোগের খিচুড়ি রান্নার কৌশল- ঝুমা মাসি ঠেলে পাঠায় তুত্তুরীর জন্য হলুদ ঝুটো গয়না কিনতে।  “আমি পারব না-। ঝামেলা বাড়াস না তো” গজগজ করতে করতে করতে ফুল-ফল-বাজার করে আনে বাবা।ঝ্যাঁটা-ন্যাতার দাপটে পালায় ধুলো আর ময়লার গুষ্টি।  বাষট্টি বার ডাইনিং চেয়ারে ওঠানামা করে শিকলি টাঙায় মা আর তুত্তুরী- দরজায় দরজায় আঁকা হয় আল্পনা। ফ্ল্যাটের গ্রীলের গেটে বাঁধা হয় কলাগাছ- সকাল থেকে রান্না হয় খিচুড়ি- বেগুনী - কুলের অম্বল আর পায়েস। কুলের অম্বল রাঁধতে গিয়ে চক্ষু চড়কগাছ হয়ে যায় তুত্তুরীর মায়ের। এ কোন কুল এনেছে আমার বর? বোম্বাই কুল? এই কুলের অম্বল থুড়ি চাটনি রাঁধব? বাড়ি হয়ে যায় মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গেলর ম্যাচ- দ্বৈরথ চলতেই থাকে বাঙাল-ঘটির। স্নান সেরে টুকটুকে লাল শাড়ি পরে  ঘর আলো করে এলো চুলে ফল কাটতে থাকে তুত্তুরীর কাকিমা।নিপুণ হাতে সেজে ওঠে নৈবেদ্য। কাকাই এর পিছনে তেলের গামলা নিয়ে ঘোরে তুত্তুরী মা- “পুজোটা করে দে না টুকলু বাবা-সোনা ছেলে। ” বাঙাল-ঘটির দ্বৈরথ ভুলে সুর মেলায় তুত্তুরীর বাবা আর দাদুও। দাদু তো সটান হুমকিই দেয়-“বাড়ির পুজো বলে কথা। পরের বছর থেকে দায়িত্ব নাও টুকলু। ” কাকিমার মন খারাপ কাঁসর ঘন্টার জন্য। মা বুদ্ধি দেয়-“কাঁসার থালাকে বেলুন দিয়ে পেটা না বাপু- দিব্যি আওয়াজ হবে-”।  আর এত কিছুর মধ্যেই কোথা দিয়ে যেন মায়ের ছোটবেলায় পৌঁছে যায় তুত্তুরী-ধূপদীপ জ্বেলে ভুলভাল উচ্চারণে পাতি পাঁচালি খুলে পুজো করে মা- তুত্তুরী শোনে মা বলছে- “আই লাভ ইউ বুজু সরস্বতী। ভালো থেকো সোনা-”।