Thursday 18 July 2019

অনির ডাইরি ১৮ই জুলাই,২০১৯



কি সব দিন ছিল, সোনায় মোড়া। স্বয়ং মা লক্ষ্মী বাস করতেন এই গাঁয়, তাই বোধহয় গাঁয়ের নাম শ্রীপুর। শ্রীপুর হল নৌশিল্পীদের গ্রাম। প্রায় ঘরে ঘরে তৈরি   হত নৌকা,দেড় হাজার শ্রমিকের পেটে ভাত যোগাত এই নৌকা। পাতি বাবলা কাঠও এখানকার শ্রমিকদের হাতের ছোঁয়ায় পরিণত হত লজ্জাবতী অনাঘ্রাত পৃথুলা সুন্দরী নৌকায়। তারপর ভাসত তরী গাঙের জলে। ভরা শ্রাবণে উছলে উঠত নদী, ছাপিয়ে দুকূল, লেলিহান জিহ্বা বিস্তার করে গ্রাস করতে চাইত চরাচর, তখন সেই রাক্ষুসী নদীর হাত থেকে আবালবৃদ্ধবনিতাকে উদ্ধার করতে নামত শ্রীপুরের নৌকা। দূরদূরান্তে ছড়িয়ে পড়ত শ্রীপুরের নাম। আসেপাশের গাঁ ছাড়ুন সেই সুদূর পুরুলিয়া থেকেও আসত বায়না। তারপর কি যে হল, কার যে নজর লাগল। ক্রমশঃ কমতে লাগল বিক্রি। ইতিউতি গড়ে উঠতে লাগল সেতু।  একটা কৃশকায় সেতু গড়ে ওঠার অর্থ  হল, এপাড়-ওপাড় মিলিয়ে অন্তত সাতটা ঘাট বন্ধ হয়ে যাওয়া। আর বাস বা গাড়ি চললে তো কথাই নেই, ভাবতেও শিউরে ওঠে শ্রীপুরবাসী। তারওপর আছে ডিজেল চালিত স্টিমারের আক্রমণ। গড়ে ঘন্টায় চল্লিশ থেকে আটচল্লিশ কিলোমিটার বেগে দৌড়ানো পক্ষীরাজে সাথে পাল্লা দেবে গদাইলস্করি চালে দুলতে থাকা নৌকো? দুয়ো! দুয়ো!
সোনার দিনগুলো  কবে যে হারিয়ে গেল। নুন আনতে পান্তা ফুরানো শিল্পর সাধ্য কি এত লোকের পেটে ভাত জোগায়? শ্রীপুরবাসীর দ্বিতীয় উপার্জন বলতে ছিল টালিখোলায় কাজ। কিন্তু সেখানেও যেন শনি লেগেছে, টালি আজকাল কেনে কয় জনা? দুবার হনুমান লাফালেই তো টালির দফা গয়া। বন্ধ না হলেও খুউব কমে গেল টালি উৎপাদনের হার। বন্ধই পড়ে আছে বেশীর ভাগ চুল্লি। কোথাও আবার শুধুই ইঁট তৈরি হয় আজকাল। এই শ্রীপুরেই গিয়েছিলাম কাজের স্বার্থে। কাজ বলতে সামাজিক সুরক্ষা যোজনায় নাম নথিভুক্তকরণ।  শ্রীপুর গ্রামটা চুঁচুড়া থেকে বেশ অনেকটাই দূর, প্রায় কালনার সীমানা ঘেঁষে।হাওড়া থেকে কাটোয়া লাইন যদি ধরেন, চুঁচুড়া-ব্যাণ্ডেলের পর অনেকগুলো ছোট ছোট স্টেশন পড়বে, স্টেশনের নামগুলো বেশ মিষ্টি- মগরা, বাঁশবেড়িয়া, ত্রিবেণী, কুন্তিঘাট,জিরাট, বলাগড়। এই বলাগড় স্টেশন থেকে ফাঁকা পাটক্ষেত আর টলটলে পুকুরের বুক চিরে বেশ কিছুটা গেলে শ্রীপুর বলাগড় কল্যাণসমিতি প্রাথমিক লাইব্রেরি। এই লাইব্রেরিতেই জমায়েত হবার কথা এই নৌশিল্পীদের,অর্থাৎ যাঁরা এখনও এই পেশায় পড়ে আছেন।প্রায় শ খানেক লোক ধরে এই লাইব্রেরিতে, গিয়ে দেখা গেল মেরে কেটে জনা কুড়ি। তাও অধিকাংশই মহিলা, যাঁরা কেউ বাড়িতে বসে লেলাইফোঁড়াইয়ের কাজ করেন, কেউ বা আয়ার কাজ করেন। জনা কয়েক মাটির ঠাকুর গড়েন,স্যাকরার দোকানে কাজ করেন।  কিন্তু নৌশিল্পীরা কই? যাদের জন্য এভাবে দৌড়ে আসা? এত অনীহা কিসের ভাই?
স্যার বললেন, “চল কয়েকটা কারখানা থেকে ঘুরে আসি। এণারা বসুন।” এমন নয়,যে এণাদের আমরা চাই না, কিন্তু যাদের এত করে ডাকাডাকি, তারা কেন আসে না।
কারখানা বলতে বাঁশঝাড়, বা বটতলা। বা কোন খোলা মাঠ। বেলা দুটো বাজছে, জনা কয়েক খেতে গেছে, বাকিরা রীতিমত নিরাসক্ত। কি হবে, বাবু/দিবিমণি এসব করে? গরীব মানুষের কে আছে? এই যে কুতুবের বাপ, বয়স হয়েছে, ভালো খাটতে পারে না, ওর তোমরা কি উপকারে আসবে? সরকার তো আমাদের দেখে না। আমরাই বা কেন শুনব?
অনেক বোঝালেন স্যার। মোটরগাড়ি আর গরুরগাড়ির গল্প শোনালেন।  শুনলেনও ওঁদের কথা। ছবিটবিও তোলা হল কিছু। আমাদের সুশান্ত দিব্যি একটা নৌকার ওপর উঠে সেল্ফি তুলে নিল এন্তার। এবার ক্যাম্পে ফেরার পালা। স্যারের সনির্বন্ধ অনুরোধ ফেলতে না পেরে, ওণারা গুটি গুটি এসে জড় হলেন ক্যাম্পে। ঘর ভর্তি হয়ে উপচে যায় আর কি। এলেন ওণাদের বউ/বাড়ির অন্যান্য সদস্যরাও। কারণ,“তুমি আর কি বুঝবা? আমায় শুনতে দাও দিকি”। 
স্যার আর আমাদের বর্মণ সাহেব গুছিয়ে বোঝালেন সবকিছু। রমেশ প্রজেক্টর দিয়ে অনলাইন রেজিস্ট্রেশন কি করে করে দেখালো। অনেকেই এসে এসে ফর্ম নিয়ে গেলেন। আমরা যে ভাঁওতা দিয়ে টাকা তুলতে আসিনি, তা বোঝাবার জন্যই,আসেপাশের গাঁ থেকে কয়েকজন নথিভুক্ত শ্রমিককে ডাকা হয়েছিল। তাঁরাও শোনালেন তাদের কথা। বিলি করা হল সামাজিক মুক্তি কার্ড। এবার ফেরার পালা, ফেরার সময় ভাবলাম, শুকনো ডাঙায় একবার নৌকা চড়েই দেখি না-

অনির ডাইরি, ১৭ই জুলাই, ২০১৯


কি কালান্তক গরম মাইরি। বিদিকিচ্ছিরি তাল পাকানো ভাদ্দুরে গরম। উত্তরবঙ্গে উপুড়হস্ত, উদার প্রকৃতির, কেন যে দক্ষিণবঙ্গের প্রতি এমন বিমাতৃসুলভ আচরণ, কে জানে? সেই কথাই শোনাচ্ছিলাম বাবাকে, রোজই ট্রেনে উঠে ফোন করি কি না। নাঃ এবারে বুঝি, বর্ষা আর হল না। আর কবেই বা হবে? বাবার যদিও উৎসাহে বিন্দুমাত্র ঘাটতি চোখে ইয়ে মানে কানে ধরা পড়ল না। বৃদ্ধ বরাবরই ভয়ানক আশাবাদী।
আজও যথারীতি, “আরেঃ দাঁড়া। কে বলেছে বর্ষা হবে না? সুদ সমেত সব ফেরত পাবি। পুজোটা আসতে দে।“ কি আজগুবি কথা মাইরি, বছরের সবথেকে আনন্দের দিনগুলোতে কে চায় বর্ষার পানি? বলতে গিয়ে দেখি, বৃদ্ধ ততোক্ষণে বহুদূর পাড়ি দিয়েছে, “ সে বছর মহালয়া পড়েছিল, ১৯শে সেপ্টেম্বর। তার ঠিক আগের দিন আমাদের বাড়িতে হামলা হয়েছিল। হামলা যে হবে, খবর ছিল। স্থানীয় এমপি, যুগল মণ্ডল, স্বয়ং বাবাকে খবরটা দিয়েছিল। সন্ধে সন্ধে অসিত (স্বর্গীয় ছোটকাকু) আর আমি খেতে বসেছি। ব্যাগ গোছানো। খেয়ে উঠেই বেরিয়ে পড়ব। রাত ৯টার ট্রেন। খুব সম্ভবত দুন এক্সপ্রেস। গভীর রাতে গিয়ে নামব কোডার্মা।“
ব্যারাকপুরের আগে, অকারণে দাঁড় করিয়ে দিল ট্রেনটাকে, বাবাও চুপ। বাড়িতে হামলার গল্পটা আমি জানি। রাত দশটা থেকে প্রায় দুটো আড়াইটে অবধি অবাধে ভাঙচুর হয়েছিল, মহল্লার মুষ্টিমেয় প্র-নকশাল বাড়ি। গলা ঝেড়ে আবার শুরু করল বাবা, “প্রচণ্ড মারে, সংজ্ঞা হারিয়েছিলাম। ব্যাটরা থানার মেঝেতে যখন জ্ঞান এল, তখন সবে শুরু হচ্ছে মহালয়া। পুজোর মরশুম। আদালত বন্ধ। আমাদের চালান করে দিল, মল্লিকফটকের জেলে।“
খানিকটা কেশে নিয়ে, “ সেবারেও এমন দম চাপা গরম। পঞ্চমী, ষষ্টী কেটে সপ্তমী পড়ল। আমার আর ছোট কাকুর পুজো বলতে, জেলের তিনতলার জানলা দিয়ে উঁকি মেরে দেখা, বাইরে পুলিশ লাইনের পুজো।“ থাকতে না পেরে জানতে চাইলাম, “আর মা? মা কি করছিল?মা তোমার সাথে দেখা করতে যেত?জেলে?”প্রসঙ্গত আমার বাবা এবং মায়ের শুভদৃষ্টি জেলে আর আদালত চত্বরেই সম্পন্ন হয়েছিল।সুদূর মুর্শিদাবাদের অজ গাঁ রামনগরের ঘোষ বাড়ির মেয়েরা বরাবরই ভয়ানক রকমের আবেগপ্রবণ এবং বাস্তবজ্ঞানহীন (মা,মুষ্টু এবং ছোটো কেলিও না প্লিজ)। বৃদ্ধ বলল, “তা তো মনে নেই,  হ্যাঁ গো, তুমি আসতে আমার সাথে দেখা করতে?” মায়ের বলে রক্তে সোডিয়াম নিম্নগামী,মুহূর্তে মুহূর্তে সব ভুলে যায়, তার কাছে জানতে চাইছে, না জানে কোন মান্ধাতার যুগের কথা। সর্বোপরি মা আপাতত তার ছায়ার সাথে মধুর বাক্যালাপে নিমগ্ন। ট্রেনের ঝমঝম ছাপিয়ে, দুজনের গলা কানে সুড়সুড়ি দিচ্ছে। এই নিয়ে কতবার যে ছায়াকে বরখাস্ত করা হল, আর ডেকে আনা হল তা ঈশ্বরই জানেন। মা যে শোনা মাত্র মুখঝামটা দিল, বেশ বুঝতে পারলাম। বাবা দেখলাম তাও আশা ছাড়ল না,এবার আমায় পাকড়াও করল, “গুগল করে দেখ না, কোন সালে ১৯শে সেপ্টেম্বর মহালয়া পড়েছিল।“ ইল্লি আর কি? গুগুল যেন আমার আলাদিনের জিন।
বাবা দেখি, তখনও বিড়বিড় করে চলেছে, “৭৩ না ৭৪ রে বাবা? এ হে হে, দাদা থাকলে, এখুনি বলে দিত। বলো না গো, আমি দ্বিতীয়বার কবে জেলে গেলাম?” মা বোধহয় বলল, তখনও মা, বাবাকে চিনত না। বাবা সোল্লাসে শুরু করল, “তখনও বিয়ে হয়নি, বুঝলি। যা বলছিলাম, ষষ্টি অবধি, আকাশ ঝকঝকে, গরমে নাভিশ্বাস ওঠে, হঠাৎ সপ্তমীর দিন সন্ধে সাতটা থেকে শুরু হল বৃষ্টি। সে কি সাংঘাতিক বৃষ্টি রে, তিনদিন এক নাগাড়ে বৃষ্টি। নবমীর দিন দুপুর বেলা, হো- হো চিৎকার। আমরা জেলের তিনতলার জানলা থেকে দেখছি, হাফ প্যান্ট আর সাদা স্যান্ডো গেঞ্জি পরে, দৌড়চ্ছে পুলিশগুলো। পুলিশ লাইনের প্যান্ডেল, তুমুল বৃষ্টিতে ক্রমশ হেলে পড়ছে। দড়ি-দাড়া দিয়ে তাকে খাড়া করার যতই চেষ্টা করে, ততোই তিনি হেলে পড়েন। শেষে, হুড়মুড় করে ভেঙ্গে পড়ল, আমাদের চোখের সামনে। দশমীর দিন বিকালে, বৃষ্টি থামতে, দেখা গেল, প্রতিমা গলে মাটিতে মিশে গেছে। ঘটটা কি ভাগ্যি খাড়াই ছিল, সেটাতে নমঃ নমঃ করে পুজো করে, বেলচা করে ঠাকুরকে তুলে, ভাসান দেওয়া হল।“বাবার দেখি গল্প শেষ করার কোন ইচ্ছেই নেই, আমাকে বোধহয় তুত্তুরী ঠাউরেছে। শুনতে দারুন লাগলেও, ইতিমধ্যে ট্রেন অনেকটা এগিয়ে গেছে, পরের স্টেশনে নামতে হবে। কথা ঘোরাতে বললাম, “এবার রাখি? কাল এই এলাকায় ব্যাপক বোমাবাজি হয়েছে, জানতো।ক্ম্যুনাল টেনশন- “ বৃদ্ধ কথা শেষই করতে দিল না, “আরেঃ দূর দূর, সেসব কিছু নয়। খবর দেখিসনি,দু ব্যাগ পেটো পেয়েছে পুলিশ। এরকম প্রচুর পেটো জমানো আছে, মাঝে মাঝে দু একটা তো পেটো মারবেই। তোর কাছে থাকলে, তুইও-।“ কথা না বাড়িয়ে, ফোনটা রেখে দিলাম। বলেছিলাম না, বৃদ্ধ ভয়াবহ রকমের আশাবাদী।

Sunday 14 July 2019

তুত্তুরী উবাচ, ১৪ই জুলাই, ২০১৯


-মা, এসবিআই কি বলো তো?
-( অন্যমনস্কভাবে ) স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইণ্ডিয়া।
-হলো না। এস বি আই মানে হল, সো বি ইট। মানে আমেন। আমেনকে তো এসবিআই ও লেখা যায়, নাকি?
- পরীক্ষায় লিখে আসিসনি তো? তোদের যা গোঁড়া ক্যাথলিক স্কুল, রসগোল্লার হাঁড়ি উল্টে দেবে খাতায়।
- নাঃ। এমনি বলছি। ( খানিকবাদে) যাই গিয়ে টিভিটা নিভিয়ে দিয়ে আসি।
-কেন? বাবা খেলা দেখছে তো?
-সেই জন্যই তো। পাঁচ ঘন্টা ধরে বসে বসে টিভি দেখছে-
-তাতে তোর কি? তুই ঘুমো। ছেলেদের খেলা দেখলে মন ভালো হয়।
-আর মেয়েদের?
-(বিরক্তি এবং হাই চেপে) শাড়ি দেখলে। (অতঃপর শুধরে নিয়ে) না মানে, এভাবে ক্যাটেগরাইজ করা অনুচিত।  যার যেটা দেখলে মন ভালো থাকে, মেয়েরাও খেলা দেখে।
-আর ছেলেরা?ছেলেরা শাড়ি দেখে মা?
-(বিরক্তির শেষ সীমায় পৌঁছে) দেখতেও পারে। পরতেও পারে। তাতে তোর কি? যার যা ইচ্ছা করতে পারে। তুই ঘুমো তো।
-(সবজান্তার ভঙ্গীতে)হ্যাঁ। ঠিক বলেছো। আমি একবার একটা বিজ্ঞাপনে দেখেছিলাম, একটা মেয়ে রাস্তা দিয়ে শাড়ি পরে যাচ্ছিল। যেতে যেতে হঠাৎ তার শাড়িটা খুলে গেল। তখন সে ব্যাগ থেকে তার বরের লুঙ্গিটা বার করে পরে নিয়ে চলে গেল।
-ওরে বাপরে বাপ। কোথা থেকে এসব গাঁজাখুরি গপ্প শিখিস বাবু তুই?হাসতে হাসতে পেট ব্যথা হয়ে গেল-
   

Thursday 11 July 2019

অনির ডাইরি ১০ই জুলাই ২০১৯




ঠ্যাং খোঁড়া হয়ে বাড়িতে বসে আছি। কখন যে মচকালাম, তাও বুঝতে পারছি না। অবশ্য, এতদিন কেন যে মচকায়নি,সেটাই আশ্চর্যের। বিধাননগর স্টেশনের যে কোন প্ল্যাটফর্ম থেকে লোকাল ট্রেনে চড়া বা নামার আগে বীমা থাকা অবশ্য প্রয়োজন। কি অখাদ্য স্টেশন মাইরি! কোন প্ল্যাটফর্মে কোন পাখা পাবেন না। শুধু কি তাই? কি নীচু প্ল্যাটফর্ম গুলো বাবারে। ঐ প্ল্যাটফর্ম থেকে প্রতিদিন হাঁচোড় পাঁচোড় করে,জনা কয়েক নিত্যযাত্রিনীকে কোঁৎকা মেরে ট্রেনে ওঠা, তথা ফেরার পথে, গেট অালো করে হাওয়া খাওয়া পাবলিকদের পুনঃ কোঁৎকা মেরে, তথা নামতে না দিয়েই ঠেলে উঠতে চাওয়া যাত্রীদের গুষ্টি উদ্ধার করে ঝপাং করে নামা চাট্টি খানি কথা নয়। তাও মাঝে মাঝে আবার শাড়ি পরে। সাধের হিলস্ গুলোতে ঘরবাড়ি বানিয়েছে মাকড়সারা। বৃষ্টির দিনে পাতি চপ্পল আর শুকনো কালে স্নিকার ছাড়া গতি নেই ।
আমার যদিও ধারণা, পা মচকানোর সাথে বিধাননগরের কোন যোগ নেই। কালপ্রিট আমার কন্যা। ঘুমের ঘোরে নির্ঘাত আমার পায়ে চেপেছিল। অবশ্য তাতে আমার ঘুম কেন ভাঙল না, সেটা একটা লাখ টাকার প্রশ্ন বলতে পারেন। আমার বরের মত যথারীতি অন্য। মারুতি ৮০০র ইঞ্জিনের ঘাড়ে টাটার ট্রাক চাপালে যা হয়-। ভাবনা চিন্তা গুলোও কেমন যেন হুল ফোটানো মাইরি। বলল, আমার জন্য ছুটি নিয়েছে, একা নড়তে চড়তে পারছি না বলে, পরে বুঝলাম কারণ ম্যানচেস্টারনগর।

একে তো ঠ্যাঙ খোঁড়া হয়ে বসে আছি, তারওপর কি বিষফোঁড়া মাইরি এই হোয়াট্স অ্যাপ। কেন যে এই অফিশিয়াল গ্রুপ গুলো তৈরি হয়? হ্যাঁ গা বিতান দা, রজত স্যার, সুকন্যা আর নবীন, যত কাজ কি আজই করার ছিল ভাই তোমাদের?
পৌনে ছটা নাগাদ বাধ্য হয়েই ছাতের উদ্দেশ্য রওণা দিলাম, প্যারাসিটামলের দাক্ষিণ্যে ব্যথাটা আপাততঃ কিঞ্চিৎ প্রশমিত আর বসার ঘরে বাপ মেয়েতে যা “আপনা ধোনি আয়েগা” শুরু করেছে। বিশেষতঃ ছোটটার চিড়িংবিড়িং বেড়ে গেছে আড়াইগুণ। বড়টা তো শুধু খেলা নিয়েই মগ্ন, ছোটটা আবার খেলার সাথে সাথে যাবতীয় বিজ্ঞাপন নিয়েও সমান উৎসুক। পারলে সবই কিনে ফেলে আর কি। 

হাঁটতে  যে খুব একটা পারলাম তা নয়, তবে সাময়িক ভাবে সব ব্যথা সব হীনমন্যতা, অপদার্থতা  বোধ ভুলিয়ে দিল আকাশ। ঘিঞ্জি, দূষিত, জনবিস্ফোরনে ক্লান্ত, ক্লেদাক্ত রোজকার শহরটা, চোখের সামনে সামান্য মেঘের প্রসাধনীতে পলকে তিলোত্তমা।এমনকি ফাঁকা  বিলবোর্ডের কঙ্কাল বা ছাতে গজানো আগাছার ফাঁক দিয়ে উঁকি মারা কালো মেঘ আর ঝোড়ো হাওয়াও কি অপরূপ মোহময়। বারংবার এটা হয়, জানেন তো, যতবারই বিরক্ত হয়ে উঠি জীবনের প্রতি,একঘেঁয়ে লাগে সবকিছু,  প্রকৃতি ততোবারই স্বতোঃপ্রণোদিত হয়ে মনে করিয়ে দেয়- বড় ভাগ্যবান আমরা। বড় সুন্দর এ পৃথিবী, বড় বেশী মোহময় এ জীবন। ভালো থাকুন আর আশ মিটিয়ে ভালোবাসুন। আকাশও বোধহয় তাই শেখায়-

Sunday 7 July 2019

অনির ডাইরি ৬ই জুলাই, ২০১৯







রথের মেলা তো বসতো, আমাদের হাওড়া ময়দানে, সে না জানি কবেকার কথা। তখনও শরৎসদন তৈরি হয়নি। মোটামুটি পঞ্চাননতলা থেকেই বসে যেত কাঠের হাতে ঘোরানো চৌকো বাক্সের মত নাগর দোলা, তারপাশে লাল ঝালর দেওয়া চাঁদোয়ার নীচে গোল করে  ঘুরত, ঝুলন্ত হাতি- ঘোড়া-কুমীরের দল।পুঁইইইই করে বাজত তালপাতার বাঁশি।করররকটকট করে চিৎকার করে উঠত ব্যাংবাজি। ঘোলাটে মেঘলা আকাশে ওড়ার তাল কষত রঙ বেরঙের গ্যাস বেলুন, ফুঁ দিলেই বনবন করে ঘুরত নীলগোলাপি কাগজের পাখা। ত্রিপল টাঙিয়ে বসত, মাটির পুতুলের পসরা। তাদের মধ্যেই যে গুলো কৃষ্ণনগরের, তাদের দেমাক ছিল খুব, হাত দিলেই ছাঁকা লাগত, কি দাম বাপস। সারি সারি বসত গরম জিলিপির দোকান, বিক্রি হত, সর্ষের তেলে ভাজা ইয়া বড় বড় পাঁপড়, চুড়া করে বিক্রি হত, গুড়/চিনি কটকটি, খোলা শুদ্ধ বাদাম ভাজা, বিক্রি হত বটি, কাটারি, কাঞ্চননগরের ছুরি, কাঁচি, কাঠের চিরুনি,খাঁচায় ভরে বিক্রি হত,ঝিমনো টিয়া পাখির দল। গলার কণ্ঠীর ওপর কারো মাথাটা লাল, কারো নীল, কারো বা হলদে-সবুজ। বাবার হাতেপায়ে ধরে, একবার আদায় করেছিলাম একটা টিয়া। ২০টাকা দিয়ে কেনা পাখি, ঐ টাকায় তখন এক ব্যাগ বাজার হত, মেয়ের জেদের কাছে পরাভূত বাবার অবিমৃষ্যকারিতার জন্য কত কথাই যে শুনতে হয়েছিল বাবাকে। পাখি নয়তো, প্রাণপাখি, শখ করে নাম রেখেছিলাম, মদনমোহন। সপ্তাহখানেকের বেশী বাঁচেনি মদনমোহন। মনকে আজও প্রবোধ দি, হয়েই তো এল, শীঘ্রই আবার দেখা হবে, ভবসিন্ধুর ঐ পাড়ে-
রথ নিয়ে কত যে স্মৃতি, সেই যে সেবার এক তুতো মাসির শাশুড়ি কাউকে কিছু না জানিয়ে ঠিক করে বসলেন, জগন্নাথ দেবের রথের রশির খণ্ডিতাংশ ওনার চাইই চাই। ঐটি যদি জোটাতে পারেন, তো ব্যাস, স্বয়ং সৌভাগ্যলক্ষ্মী স্বযাচিত হয়ে আপনার করতলগত হবেন। কিন্তু, জগন্নাথে ভেজাল থাকলে চলবে না, রশি হতে হবে, নির্ভেজাল  অকৃত্রিম “জগন্নাথ দেব অব শ্রীক্ষেত্রের” রথের। শ্রীক্ষেত্রে পদার্পণ করে, যখন উনি নিজের অভীপ্সা ব্যক্ত করলেন, বাকিদের অবস্থা কি হল, বুঝতেই পারছেন। ছোট মাসি আর মেসোমশাই, রীতিমত সারাদিন ধরে কাউন্সেলিং করলেন, বিদেশ বিভূঁই বলে কথা, একটা মারও বাইরে পড়বে না। অতি কষ্টে তাঁকে নিরস্ত করে, সকলে বেরোলেন রথ দেখতে। রিস্ক না নিয়ে, খোদ ছোট মেসো আর বড় মাসি দুদিক থেকে ঘিরে রইলেন ভদ্রমহিলাকে,আশেপাশে চক্রব্যূহ বানিয়ে রইল বাকিরা। কোন বেচাল দেখলেই, সোজা গোল করে ঘিরে ফেলা হবে। রথ কাছাকাছি আসতেই, পড়ে গেল হুড়োহুড়ি। কে যেন, বড় মাসির সিটিগোল্ডের হারটা ধরে মারল এক হ্যাঁচকা টান, বড় মাসি, চিৎকার করে উঠল, “আমার হার, আমার হার”। ছোট মেসোমশাই ঘাবড়ে গিয়ে বললেন, “ কি হল?কি হল? কি গেল?কি গেল?” প্রাথমিক ঘেঁটে যাওয়া অবস্থা কাটিয়ে,  সবাই যখন সম্বিৎ ফিরে পেলেন, ভদ্রমহিলা ততোক্ষণে বেপাত্তা। খুঁজে খুঁজে হয়রান হয়ে, বাসায় ফিরে দেখা গেল, উনি প্রসন্নবদনে, আমাদেরই প্রতীক্ষারত। শুধু আশ মিটিয়ে রথই টানেননি, সকলের অগোচরে, শাড়ির ভাঁজ থেকে নতুন ব্লেড বার করে, কুচ করে কেটে নিয়েছেন, খানিকটা সুতো।
হুগলীতে এসে ইস্তক শুনছি, গুপ্তিপাড়ার রথের কথা। মাহেশের তুলনায় প্রচার অনেক কম, তবে ঐতিহ্য এতটুকুও কম না। দূরদূর থেকে মানুষ আসেন, গুপ্তিপাড়ার রথ দেখতে। জমিয়ে বসে রথের মেলা বসে। রথের দিন কয়েক কিলোমিটারের মধ্যে গাড়ি নিয়ে ঢোকা যায় না, অন্যদিন তুলনামূলক ভাবে ফাঁকা। শুক্রবার, যাচ্ছি যাব করে কাজ গুটিয়ে,অফিস থেকে বেরোতে বেরোতেই বেজে গেল সোয়া পাঁচটা। পথপ্রদর্শক আমাদের শ্যামল। পিপুলপাতির মোড় হয়ে, হুগলী ঘাটের তলা দিয়ে, গাড়ি গড়াল আসাম রোডের পথে। হাইরোডের সমান্তরালে দৌড়য় রেলপথ, কখনও দৃশ্যমান, কখনও অদৃশ্য। গুপ্তিপাড়া কাটোয়া লাইনে একটা ছোট্ট ষ্টেশন। এদিকের ষ্টেশনের নাম গুলো খুব মিষ্টি, মগরা, বাঁশবেড়িয়া, ত্রিবেণী, কুন্তিঘাট,জিরাট, বেহুলা, গুপ্তিপাড়া-। ঘিঞ্জি শহর ছাড়ালেই, খোলা সবুজ মাঠ। জানলা দিয়ে বিনা অনুমতিতে ঢুকে আসে, টাটকা জোলো হাওয়া। বলাগড় ব্লক শুরু হতে না হতেই, শ্যামল সাধতে শুরু করল, “ম্যাডাম, আমাদের গাঁয়ের মন্দিরটা একবার দেখতে চলুন। বেশীক্ষণ লাগবে না। মন্দিরের গায়েই গাড়ি দাঁড় করাব, পাক্কা দুমিনিটের বেশী নেব না। দেখবেন কত বড় মন্দির। সাড়ে তিনশ বছর আগের মন্দির ম্যাডাম। কত লোক ভোগ খায়, একটি বার চলুন-।“
গ্রামের নাম, ডুমুরদহ নিত্যানন্দপুর। মন্দিরটি আপাত বিশেষত্বহীন, তবে পরিবেশটি বড় মনোরম। কোন দেবতার মন্দির সেটি উল্লেখ করে, চাকরিটিকে আর বিপদগ্রস্ত করতে চাই না।
 মেলায় পৌঁছতে পৌঁছতে বাজল সাড়ে ছয়। মেলায় ঢুকেই প্রথম যে অনুভূতিটা হল, আরেঃ এতো আমার শৈশবের হারানো মেলা। সেই রেশমি চুড়ি, মাটির পুতুল, হাড় জ্বালানো ব্যাঙ বাজি, বাসনপত্র, সারিসারি জিলিপির দোকান থেকে ভেসে আসা মনমাতান সৌরভ। চুড়ো করে রাখা খোলা শুদ্ধ বাদাম আর গুড় কটকটি। পাঙ্খা বরফ, কাগজের ফুল, ঘর সাজানোর জিনিসপত্র। পুরো মেলা ঘুরে দেখার সময় ছিল না। তারই মধ্যে তুত্তুরীর জন্য কেনা হল কাঁচের চুড়ি।কেনা হল মাটির পুতুল, শ্যামল কিনল কাগজের ঘুরঘুরে নীল-গোলাপি পাখা, রমেশ বোধহয় যা পাওয়া যাচ্ছে সবই কিনে ফেলল, কেনা হল, গরম গরম মথুরা কেক। পাতি বিলিতি ডোনাট, শুধু বেকড নয়, খলখলে করে তেলে ভাজা। কাগজে মোড়ার আগে তার ওপর ছড়ানো হল আইসিং সুগার। কেনা হল লেবু লেবু গন্ধ আর নুন মাখানো পপকর্ণ। গুড় না চিনি তর্ক করতে করতে কেনা হল, গরম গরম জিলিপি। গুপ্তিপাড়া হল সন্দেশের জনক, এখানকার গুপো সন্দেশ অমৃতসমতুল। গুপ্তিপাড়ায় গিয়ে, গুপো সন্দেশ  না কেনা গর্হিত অপরাধ, কাজেই? 
কলাবেচা তো হল, এবার রথ দেখার পালা, ঘড়ি বলছে, সাড়ে সাত। এখান থেকে চুঁচুড়া যেতেই লাগবে আরও ঘণ্টা দেড়েক, সেখান থেকে বাড়ি বোধহয় মধ্যরাতে পৌঁছব। সে হোক। রথ দেখে জুড়িয়ে গেল প্রাণ। কি অপরূপ সুন্দর রথ, হ্যাংলার মত ছবি তুলছিলাম আমরা, বর্মণ সাহেব, প্রীতি আর আমি, শ্যামল, ছুটে এসে বলল, “করেন কি? এটা তো রথের পিছন দিক।“  ইয়ে যার পশ্চাৎদেশই এত মনোরম, না জানি, তার অগ্রভাগ কি হবে? আশা করি বলার অপেক্ষা রাখে না। স্বয়ং বিচার করুন। প্রায় মিট্মিটে আলোয়, ঘিঞ্জি দোকান বাঁচিয়ে মুঠোফোনে ভাগাভাগি করে তোলা। আটটা নাগাদ যখন তাড়িয়ে সকলকে নিয়ে ফিরছি, শ্যামল তখন জনে জনে জিজ্ঞেস করতে ব্যস্ত, “ কোনটা দিয়ে রথে চড়া যায় গো? ও ম্যাডাম, দাঁড়ান, যাবেন না। এতদূর থেকে এলেন, রথে একবার চাপবেন না?” গুটি কয়েক গুড়গুড়ে রথে চেপেছে বটে, তাই বলে, আমি?ছেলেটার জীবনে বুদ্ধি হবে না মাইরি, সাধে শ্যামলের ওপর চটে যাই?

Thursday 4 July 2019

অনির ডাইরি ৪ঠা জুলাই,২০১৯


 এক,একটা দিন অমন হয়। ঘুমটা ভাঙলেই মুচড়ে   ওঠে বুক। শতাব্দী প্রাচীন বাড়িটা যেন তার শত বৎসরের ওজন নিয়ে চেপে বসে বুকের ওপর। কুহকিনীর মত ডাকে পাঁচশ বছরের বুড়ি শহর। ঘুম চোখে কোনমতে জিভ পোড়ানো চাটা ঢকঢক করে গলায় ঢেলেই বেরিয়ে পড়লাম।
সবে সোয়া সাতটা, এরই মধ্যে আকাশে দেদীপ্যমান সূর্যদেব। ঐ যাঃ সানস্ক্রীনটাও লাগাতে ভুলে গেছি। চানটাও করে বেরোলেই বোধহয় ভালো হত। কি চিড়বিড়ে গরম বাপস্। কানে উপলের মধুঢালা কণ্ঠ,“তুমি জ্বরের শেষে সূর্য ধোয়া ঘর-”

খলবল করে একছুটে রাস্তা টপকে যখন গলিতে ঢুকলাম, তখনও সুবেশ অফিস বাবুদের দর্শন নেই। কালি বাড়ির মা সিদ্ধেশ্বরীকে স্যালুট ঠুকে, বন্ধ রেশন দোকানের পাশ দিয়ে, মনসাতলা টপকে এগিয়ে গেলাম। কোন এককালে খুব জাগ্রত ছিল এই মনসাতলা। পুত্রার্থে মানুষ ক্ষীরের পুতুল মানত করত নাকি, কতদিনের শখ, এমনি একটি ক্ষীরের পুতুলের ঘাড় মটাকানোর।
নটা বাজল বুঝি, দ্বিতীয় দফার চা বানাচ্ছে মা। “মা। মা। ”করে প্রবল চিৎকার জুড়েছে টুঁইটুঁই। মাকে চোখে হারায়। বাবাকে অবশ্য তেমন পাত্তা দেয় না। দরজা খুলে দিলেই, গিয়ে বসবে মায়ের কাঁধে।সবকাজ ফেলে আদর করো মা। শীতে বুকে জড়িয়ে চাদর মুড়ি দিয়ে টিভি দেখে মা। চাদরের ফাঁক দিয়ে উঁকি মারে টুঁইটুঁই। একবার মায়ের হাত ফস্কে ধড়াম করে পড়ে গিয়েছিল খাঁচা সমেত। তুই আমায় ফেলে দিলি মা? অভিমানে উড়ে গিয়েছিল টুঁইটুঁই। দুই দিন তার টিকিও দেখা যায়নি। মা উদভ্রান্তের মত ঘুরেছে বাগানে,বারন্দায়, ছাতে। দূর থেকে সমানে ডেকেছে টুঁইটুঁই-মা। মা। মা। টুঁইটুঁই ফিরে তো এসেছে, কিন্তু মাকে আর ছাড়ে না এক দণ্ডও। ভীষণ ঈর্ষা করে টুঁইটুঁই আর তুত্তুরী একে অপরকে। তুত্তুরীর মামমামকে কেড়ে নেওয়া? টুঁইটুঁইএর ঝোল একদিন খাবেই তুত্তুরী।
বাসি কাপড় কেচে শুকোতে দিচ্ছে পিসি। রোয়াকের ঐ প্রান্তে দাঁড়িয়ে মায়ের দৃষ্টির অগোচরে দিনের তৃতীয় সিগারেটটা ধরিয়েছে বাবা, হাওয়ায় মাথা দোলাচ্ছে শখের কাঁঠাল গাছ। নীল অপরাজিতার ঝুমকো ফুল ফিসফিস করে কথা কইছে, কচি উচ্ছের কানে। বুড়ো সূর্যটা এক চিলতে রোদ পাঠালো বুঝি ওদের গপ্প শুনতে।
একা এলি? তুত্তুরী একদিন স্কুল না গেলে কি মহাভারত অশুদ্ধ হত বাপু? মায়ের অভিমানী কণ্ঠের আড়ালে, বাবার ফিসফিসানি,“মাকে বললেই রেগে যাবে, একটু চা বানা না?” ব্যাগের মধ্যে তুত্তুরীর জোড়া চিঠি। “মা রোজ রাতে আমার চাদর কেড়ে নেয় মামমাম। বকে দিও তো।” “আই লাভ ইউ দাদু”।

আলমারির পাল্লা খুলতেই, থরে থরে সাজানো ফেলে আসা সময়। এই সবুজ জামাটা পরে পড়তে যেতাম। এই ফ্লুরোসেন্ট ইয়েলো সালওয়ারটা পরে কতবার ডেটে গেছি।ফ্রেঞ্চ ম্যানিকিওর করা নখগুলোকে শৌভিক ভাবত নকল বুঝি। আর এই গেরুয়া সবুজ জামাটা পরে প্রথম দেখা। সেই যে সেবার ইগারো খুলল হাওড়া ময়দানে, কত দাম দিয়ে কিনে দিয়েছিল  বাবা গোলাপী সালোয়ারটা। পিঠে নীলচে এম্বর্য়ডারি ড্রাগনটা। আর এই ক্রীম কালারের টপ আর কালো রাপ আপ স্কার্টটা-
মগজ জুড়ে কুয়াশা। ক্রমেই প্রগাঢ় হচ্ছে নেশা। বহুদৃর থেকে মা বলল বুঝি,“অয় ঘুমিয়ে পড়ল বোধহয়। ” বাবা বা পিসি কে যেন বলে উঠল,“আহাঃ ঘুমোক। ঘুমোক।”
তারপর অভিমানী গলায় ক্লুনি সাহেব বললেন,“কি হবে, আর পুরোনো দিনের কথা আজ তুলে?”সেই যে উঠতি বয়সে মাথা চিবানো বুদ্ধদেব গুহ, “ভালোবাসার পুরুষকে কখনই বিয়ের বাঁধনে বেঁধো না।” সেই জন্যই তো ক্লুনি সাহেব-। তুমি বুঝি আজও আমায়-। তাই বলে পায়ের আঙুল মটকাচ্ছ কেন? আর এত ডাকাডাকিই বা কিসের।
বাতানুকূল যন্ত্রের মৃদু বুঁমরো বুঁমরোর তালে ফুরফুরিয়ে ঘুরছে পাখা। গায়ে কখন যেন চাদর চাপা দিয়েছে মা, নাকি বাবা। তাই বলে, এত মধুর স্বপ্ন কেউ ভাঙায়? জবাবটা শোনা হল না যে, পিসির হাতে গরম জিলিপি। “ওঠ রে। তোর জন্য এই রোদে আধঘন্টা লাইন দিয়ে নিয়ে এলাম। ” ঘড়িতে দেড়টা। মা হাঁ হাঁ করে উঠল,“ভাত খাবি তো। এখন নয়।” ততোক্ষণে খাঁটি বাঙালী টকটক বিউলির ডালের কিটকিটে মুখ পোড়ানো জিলিপি মন্থন করছে অমৃতসাগর।
প্রিয়তম ক্লুনি সাহেব, তুমি একটু জিরোও। পরে দেখা হবে। আপাততঃ অনেক কাজ বাকি। ভাত খেয়েই দৌড়তে হবে বাড়ির পথে, একজন বসে আছে যে, তিন তিনটে হাত পা কাটা পুতুল ছানা “জগু-বলু আর সুভু”কে নিয়ে। তারা রথে চাপতে চায়। রথ চেপেছে বাঙ্কের মাথায়। নামাতে হবে,সাজাতে হবে।তালপাতার  সেপাই ঘোড়ার গলায় পরাতে হবে দড়ি, তারপর টানতে টানতে ঠাম্মার বাড়ি। পথে লুটিয়ে পড়বে ঘোড়া। চিৎপটাং হবে, জগু আর তার ভাইবোন।ধুৎ তেরি বলে রথের রশি ছেড়ে দেবেন সারথী। অতঃপর সদলবলে মায়ের ঘাড়ে চাপবেন, চালাও পানশি ঠাম্মা-দাদুর বাড়ি। ধেড়েটা বাদে আগামী সাতদিন, তেনারা সেখানেই থাকবেন কিনা। সেই আনন্দে জিলিপি খাওয়াবে দাদু। আপনারাও খান না, গরম গরম জিলিপি আর মুচমুচে পাঁপড় ভাজা।শুভ রথযাত্রা। ভালো থাকবেন সকলে। 

Monday 1 July 2019

অনির ডাইরি ১লা জুলাই, ২০১৯


#স্বপ্নের_মত_ইস্কুলবাড়ি


  সে অনেককাল আগের কথা। আশির দশক। সকাল হত উনুনের ধোঁয়া আর বহুদূর থেকে ভেসে আসা আকাশবাণীর প্যাঁপো প্যাঁপো সুরে। অতঃপর যেন ইথারে ভেসে আসত, কার মধুঢালা কণ্ঠস্বর,“নমস্কার। ইয়ে আকাশবাণী হ্যয়”।

 তখনও আমাদের হাওড়া শিল্পনগরী। বার্ন স্টান্ডার্ড, গেসকিন উইলিয়ামস্ রমরমিয়ে চলছে।  আনন্দবাজার আর যুগান্তর হাতে, মেরি( এখনকার মারি) আর থিন অ্যারারুটের সাথে তুফান ওঠে  চায়ের কাপে। পাড়ার চায়ের দোকান গুলোতে চলে কত যে দুনিয়া কাঁপানো, তাত্ত্বিক আলোচনা। তারই সাথে পাল্লা দিয়ে চলে পাড়ার পুজোর নাটকের প্রস্তুতি, নববিবাহিত দম্পতির বাড়ির দোরগোড়ায় কার্তিক ফেলে তাদের হাড় জ্বালাবার ষড়যন্ত্র। বাঙালী তখন গাঁতিয়ে বই পড়ে। গমগম করে পাড়ার লাইব্রেরি গুলো।

কদমতলা বাজারের একপাশে ছিল বিশাল ঐতিহ্যশালী ব্যাঁটরা পাবলিক লাইব্রেরী।বাজারু বাবুরা বাজারে ঢোকার আগে ঢুঁ মারতেন হেথায়।  একতলার বিশাল হলঘরে মধ্যমণি পালিশচটা লম্বাটে কাঠের টেবিলের ওপর স্তুপিকৃত বিভিন্ন প্রকাশনীর খবরের কাগজ। দোতলা জুড়ে বইয়ের গোলকধাঁধা। এই লাইব্রেরির একপাশে ছোট্ট স্কুল, যার নামও ব্যাঁটরা পাবলিক লাইব্রেরি স্কুল। লাইব্রেরির দাক্ষিণ্যেই চলত বোধহয়। তবে চলত ভালোই। দুটি মাত্র ক্লাশ- নার্সারি আর প্রিপেরেটারি।

বাবামায়ের কোলে চেপে লাইব্রেরিতে প্রথম প্রবেশ। জনৈকা বয়স্কা মহিলা, পরণে সাদাসিধে করে পরা সাদা থান, কোল থেকে নামিয়ে হাত ধরে নিয়ে গেলেন একটা ছোট্ট ঘরে। অনেকটা দইলে ডাক্তারের(পেট টেপা, গলায় চামচে ঢোকানো আর তেঁতো ওষুধ খেতে দেওয়া পারিবারিক ডাঃ দলুই) চেম্বারের মত। শুধু ওষুধের কটু গন্ধ, আর “শুয়ে পড়” মার্কা খাটটাই যা মিসিং। বসে ছিলেন এক তুলনামূলক স্থূলাঙ্গী মহিলা। অনেকটা কালো ফ্রেমের, মোটা চশমা পড়া বয়স্কা সুমিতা স্যান্যালের মত দেখতে। তিনি কোলে তুলে নিলেন। পরে জেনেছিলাম ,উনি হেডমিস্ট্রেস। নাম শীলা দি। শীলাদির কোলে বসে,ছবির বই দেখে, কি যে পাকামি মারলাম। বাড়ি ফেরার পথে, ঐটুকু রাস্তাও বাবা রিক্সা করে নিয়ে এল।মা বোধহয় ৪০টা চুমুই খেয়ে ফেলল। এমন স্কুল যদি স্বপ্নের মত না হয়,কোনটা হবে হে টানটিন। হোক না বাজারের মধ্যে পুঁচকে স্কুল।
মেরুন রঙের টিউনিক, সাদা জামা। পিঠের জন্য হলদে চটের ব্যাগ। পিট্টু টাইপ। নতুন গোল স্টিলের টিফিনে বক্স। তাতে খোদাই করা আমার নাম। যাকে আমি কর্মজীবন পর্যন্ত ব্যাগে করে বহন করেছি। তিনি আজও বহাল তবিয়তে বিরাজমান, মায়ের রান্নার ক্যাবিনেটে। টিফিনে একচেটিয়া আব্দারি(মানে প্রায় জুলুম করে আদায় করা) মিল্ককেক। স্কুল চালু হতে না হতেই স্বপ্নভঙ্গ।অফিস ফেরতা মায়ের পায়ের ওপর দিয়ে চলে গেল সিমেন্টের বস্তা বোঝাই ঠেলা গাড়ি। স্কুলে যাওয়া ডকে উঠল।

তিন মাস পর, বাবা গিয়ে অনুরোধ করলেন শীলাদিকে। শীলা দি দোদুল্যমান চিত্ত, ‘ও কি পারবে?” অনুমতি পেয়ে শুরু হল স্কুল যাওয়া। বেশ মজার স্কুল।একতলায় অফিস আর শৌচালয়,বোধহয় কমনরুমও। দোতলায় নীলচে পর্দা দিয়ে ভাগ করা করা ক্লাশরুম। টিচার অন্যমনস্ক হলেই পর্দা সরিয়ে পাশের ক্লাশে মুণ্ডু গলানো। পর্দার ওপর নীচে দিয়ে এন্তার কেলাকেলি, চুলটানা, ভেঙচি কাটা আর গাঁট্টা। টিচার দেখতে পেয়ে হুঙ্কার ছাড়লেই,পেন্টুলের রঙ পরিবর্তন। এ হেঃ হেঃ।

 পড়াশোনা কম, নাচগান বেশী। প্রতিবেশী ক্লাসে মুণ্ডু গলানোর জন্য কি না জানি না, রোজই কেউ না কেউ ক্লাশে ইয়ে করে ফেলত। আয়া মাসিরা এমনিতে বেশ ভালোই ছিলেন। ছোট কাজ করলে দিব্যি সাফসুতরো করে, পাউডার মাখিয়ে, স্পেয়ার জামা পরিয়ে আবার ফিটফাট করে দিতেন। শুধু পেন্টুলের রঙ পাল্টে ফেললেই হয়ে যেত মটকা গরম। বিশেষতঃ এক বুড়ি মাসি ছিল, “কাল রাতে কি খাইছিলা?” বলে শুরু হত ঝাড়। ঝাড়ের চোটে অলিভিয়া বলতও না, গোটা ক্লাশ সুরভিত হয়ে জানান দিত, আজ অলিভিয়া মঞ্চে অবতীর্ন। তবে হাইট হয়েছিল, যেবার মাসির বকুনীর ঠেলায় দেবদত্ত আবার করে ফেলেছিল। রামঃ।  রামঃ।

বেলা বারোটায় ছুটি। ক্লাশ থেকে নীচে হলঘরে নেমে কোস্তাকুস্তি করা।কোঁৎকা মারার নেট প্রাকটিশ,  তারপর যার নাম ডাকা হবে সে বাকিদের ভেঙচে, গুঁতিয়ে একপাক নেচেই দৌড়। যার পরণে টাটকা জামা, বগলে পাউডারের খুশবু, তার বাবামায়ের সেদিন লজ্জায় অবনত মস্তক। “কাল রাতে কি খাইছিলা”!
কটা দিন বাবা-মা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নিয়ে এল। তারপর দেওয়া হল আয়া মাসির জিম্মায়। এণারা ঐ ইয়ে সাফ করা টাইপ নন, এণাদের কাজই হল, স্কুল থেকে একপাল এঁড়ে-বকনা বাছুরকে গলায় দড়ি বেঁধে নিয়ে বেরোনো, এবং পোস্টম্যানের মত বাড়ি বাড়ি দিয়ে খোঁটায় বাঁধা। হাতে একটা ছড়ি নিলে পাক্কা ডগ ট্রেনার মাইরি।
প্রথম কদিন কনক দি, তারপর পান্না দির ওপর দায়িত্ব পড়ল। কনকদি বেশ রাগী ছিলেন। পান্নাদি মাটির মানুষ। ফলে আমাদের বাঁদরামি বাড়তে লাগল লাফিয়ে লাফিয়ে। সবকটা ব্যাগ হাতে ঝুলিয়ে, সবার হাত ধরে, ঐ রোদে সাধাসিধে শাড়ি পরা পান্নাদি যখন কারো বাড়ি গিয়ে কড়া নাড়তেন, পলকে ময়দান সাফ। যে যার বাড়িতে পারতাম ঢুকে যেতাম। দিনকালও কত ভালো ছিল, এখন ভাবলে তাজ্জব লাগে। একজন দাদু বসে থাকতেন,বারন্দার ইজিচেয়ারে, আগে তাঁকে দেখতে যেতাম। দেখতে পেলেই,কপালে হাত ঠেকিয়ে বলতেন,“পেন্নাম হই মহারাণী।” কোনদিন বলতেন,“মহারাণী ভিক্টোরিয়া। ” উফ্ ফূর্তির প্রাণ গড়ের মাঠ। দ্বিতীয় বাড়িতে কড়া নাড়ার পর, পালিয়ে একটা বড় বাড়ির উঠোনে। চৌবাচ্ছায় খানিক জল ছপছপ করতে না করতেই পান্নাদি কোলে করে ধরে নিয়ে যেত। কি ভাবে টের পেত কে জানে? এমনই এক বাড়িতে এক বুড়ি ঠাকুমাকে একবার বলেছিলাম,“কি করছ?ডিম সিদ্ধ বুঝি? আমি ডিম খেতে খুউব ভালোবাসি”। উনিও চমকে যাওয়া সুরে বলেছিলেন,“হ্যাঁ মা, তোমার জন্যই তো করছি”। পান্না দি সেবার সময়মত শুধু উদ্ধার করেছিলেন তাই নয়, কান ধরে অনেকটা হাঁটিয়েছিলেন। হ্যাংলামোর একটা সীমা থাকা উচিৎ।

দেখতে দেখতে কবে যে নার্সারি-প্রিপেরেটরি শেষ হয়ে গেল। শেষ ফাংশনে নাচলাম,সেবার তাসের দেশ নৃত্যনাট্য হয়েছিল। সেই প্রথমবার মেক্যাপম্যান এসেছিল। নাচগান শেষে, শীলাদির মনকেমন করা ভাসন। ততোদিনে স্কুল শেষের মর্ম বুঝে গেছি সকলে,আর দেখা হবে না। কোনদিনও না। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে শুরু হওয়া কান্না ক্রমে ডুগরে ডুগরে উঠল। বাবা মায়েরাও অনেকে চোখের জল ধরে রাখতে পারলেন না। যেভাবে বাবার হাত ধরে প্রথম পা রেখেছিলাম,তেমনি এবার ফেরার পালা।যতই স্বপ্নের মত হোক ইস্কুলবাড়ি,স্বপ্ন তো একসময় ভাঙে নাকি? ভাঙতেই হয়, যখন ডাক পাড়ে জীবন, ঐ যে ফিরিঙ্গী ভাষায় বলে না,“লাইফ ইজ কলিং”।