Sunday 7 July 2019

অনির ডাইরি ৬ই জুলাই, ২০১৯







রথের মেলা তো বসতো, আমাদের হাওড়া ময়দানে, সে না জানি কবেকার কথা। তখনও শরৎসদন তৈরি হয়নি। মোটামুটি পঞ্চাননতলা থেকেই বসে যেত কাঠের হাতে ঘোরানো চৌকো বাক্সের মত নাগর দোলা, তারপাশে লাল ঝালর দেওয়া চাঁদোয়ার নীচে গোল করে  ঘুরত, ঝুলন্ত হাতি- ঘোড়া-কুমীরের দল।পুঁইইইই করে বাজত তালপাতার বাঁশি।করররকটকট করে চিৎকার করে উঠত ব্যাংবাজি। ঘোলাটে মেঘলা আকাশে ওড়ার তাল কষত রঙ বেরঙের গ্যাস বেলুন, ফুঁ দিলেই বনবন করে ঘুরত নীলগোলাপি কাগজের পাখা। ত্রিপল টাঙিয়ে বসত, মাটির পুতুলের পসরা। তাদের মধ্যেই যে গুলো কৃষ্ণনগরের, তাদের দেমাক ছিল খুব, হাত দিলেই ছাঁকা লাগত, কি দাম বাপস। সারি সারি বসত গরম জিলিপির দোকান, বিক্রি হত, সর্ষের তেলে ভাজা ইয়া বড় বড় পাঁপড়, চুড়া করে বিক্রি হত, গুড়/চিনি কটকটি, খোলা শুদ্ধ বাদাম ভাজা, বিক্রি হত বটি, কাটারি, কাঞ্চননগরের ছুরি, কাঁচি, কাঠের চিরুনি,খাঁচায় ভরে বিক্রি হত,ঝিমনো টিয়া পাখির দল। গলার কণ্ঠীর ওপর কারো মাথাটা লাল, কারো নীল, কারো বা হলদে-সবুজ। বাবার হাতেপায়ে ধরে, একবার আদায় করেছিলাম একটা টিয়া। ২০টাকা দিয়ে কেনা পাখি, ঐ টাকায় তখন এক ব্যাগ বাজার হত, মেয়ের জেদের কাছে পরাভূত বাবার অবিমৃষ্যকারিতার জন্য কত কথাই যে শুনতে হয়েছিল বাবাকে। পাখি নয়তো, প্রাণপাখি, শখ করে নাম রেখেছিলাম, মদনমোহন। সপ্তাহখানেকের বেশী বাঁচেনি মদনমোহন। মনকে আজও প্রবোধ দি, হয়েই তো এল, শীঘ্রই আবার দেখা হবে, ভবসিন্ধুর ঐ পাড়ে-
রথ নিয়ে কত যে স্মৃতি, সেই যে সেবার এক তুতো মাসির শাশুড়ি কাউকে কিছু না জানিয়ে ঠিক করে বসলেন, জগন্নাথ দেবের রথের রশির খণ্ডিতাংশ ওনার চাইই চাই। ঐটি যদি জোটাতে পারেন, তো ব্যাস, স্বয়ং সৌভাগ্যলক্ষ্মী স্বযাচিত হয়ে আপনার করতলগত হবেন। কিন্তু, জগন্নাথে ভেজাল থাকলে চলবে না, রশি হতে হবে, নির্ভেজাল  অকৃত্রিম “জগন্নাথ দেব অব শ্রীক্ষেত্রের” রথের। শ্রীক্ষেত্রে পদার্পণ করে, যখন উনি নিজের অভীপ্সা ব্যক্ত করলেন, বাকিদের অবস্থা কি হল, বুঝতেই পারছেন। ছোট মাসি আর মেসোমশাই, রীতিমত সারাদিন ধরে কাউন্সেলিং করলেন, বিদেশ বিভূঁই বলে কথা, একটা মারও বাইরে পড়বে না। অতি কষ্টে তাঁকে নিরস্ত করে, সকলে বেরোলেন রথ দেখতে। রিস্ক না নিয়ে, খোদ ছোট মেসো আর বড় মাসি দুদিক থেকে ঘিরে রইলেন ভদ্রমহিলাকে,আশেপাশে চক্রব্যূহ বানিয়ে রইল বাকিরা। কোন বেচাল দেখলেই, সোজা গোল করে ঘিরে ফেলা হবে। রথ কাছাকাছি আসতেই, পড়ে গেল হুড়োহুড়ি। কে যেন, বড় মাসির সিটিগোল্ডের হারটা ধরে মারল এক হ্যাঁচকা টান, বড় মাসি, চিৎকার করে উঠল, “আমার হার, আমার হার”। ছোট মেসোমশাই ঘাবড়ে গিয়ে বললেন, “ কি হল?কি হল? কি গেল?কি গেল?” প্রাথমিক ঘেঁটে যাওয়া অবস্থা কাটিয়ে,  সবাই যখন সম্বিৎ ফিরে পেলেন, ভদ্রমহিলা ততোক্ষণে বেপাত্তা। খুঁজে খুঁজে হয়রান হয়ে, বাসায় ফিরে দেখা গেল, উনি প্রসন্নবদনে, আমাদেরই প্রতীক্ষারত। শুধু আশ মিটিয়ে রথই টানেননি, সকলের অগোচরে, শাড়ির ভাঁজ থেকে নতুন ব্লেড বার করে, কুচ করে কেটে নিয়েছেন, খানিকটা সুতো।
হুগলীতে এসে ইস্তক শুনছি, গুপ্তিপাড়ার রথের কথা। মাহেশের তুলনায় প্রচার অনেক কম, তবে ঐতিহ্য এতটুকুও কম না। দূরদূর থেকে মানুষ আসেন, গুপ্তিপাড়ার রথ দেখতে। জমিয়ে বসে রথের মেলা বসে। রথের দিন কয়েক কিলোমিটারের মধ্যে গাড়ি নিয়ে ঢোকা যায় না, অন্যদিন তুলনামূলক ভাবে ফাঁকা। শুক্রবার, যাচ্ছি যাব করে কাজ গুটিয়ে,অফিস থেকে বেরোতে বেরোতেই বেজে গেল সোয়া পাঁচটা। পথপ্রদর্শক আমাদের শ্যামল। পিপুলপাতির মোড় হয়ে, হুগলী ঘাটের তলা দিয়ে, গাড়ি গড়াল আসাম রোডের পথে। হাইরোডের সমান্তরালে দৌড়য় রেলপথ, কখনও দৃশ্যমান, কখনও অদৃশ্য। গুপ্তিপাড়া কাটোয়া লাইনে একটা ছোট্ট ষ্টেশন। এদিকের ষ্টেশনের নাম গুলো খুব মিষ্টি, মগরা, বাঁশবেড়িয়া, ত্রিবেণী, কুন্তিঘাট,জিরাট, বেহুলা, গুপ্তিপাড়া-। ঘিঞ্জি শহর ছাড়ালেই, খোলা সবুজ মাঠ। জানলা দিয়ে বিনা অনুমতিতে ঢুকে আসে, টাটকা জোলো হাওয়া। বলাগড় ব্লক শুরু হতে না হতেই, শ্যামল সাধতে শুরু করল, “ম্যাডাম, আমাদের গাঁয়ের মন্দিরটা একবার দেখতে চলুন। বেশীক্ষণ লাগবে না। মন্দিরের গায়েই গাড়ি দাঁড় করাব, পাক্কা দুমিনিটের বেশী নেব না। দেখবেন কত বড় মন্দির। সাড়ে তিনশ বছর আগের মন্দির ম্যাডাম। কত লোক ভোগ খায়, একটি বার চলুন-।“
গ্রামের নাম, ডুমুরদহ নিত্যানন্দপুর। মন্দিরটি আপাত বিশেষত্বহীন, তবে পরিবেশটি বড় মনোরম। কোন দেবতার মন্দির সেটি উল্লেখ করে, চাকরিটিকে আর বিপদগ্রস্ত করতে চাই না।
 মেলায় পৌঁছতে পৌঁছতে বাজল সাড়ে ছয়। মেলায় ঢুকেই প্রথম যে অনুভূতিটা হল, আরেঃ এতো আমার শৈশবের হারানো মেলা। সেই রেশমি চুড়ি, মাটির পুতুল, হাড় জ্বালানো ব্যাঙ বাজি, বাসনপত্র, সারিসারি জিলিপির দোকান থেকে ভেসে আসা মনমাতান সৌরভ। চুড়ো করে রাখা খোলা শুদ্ধ বাদাম আর গুড় কটকটি। পাঙ্খা বরফ, কাগজের ফুল, ঘর সাজানোর জিনিসপত্র। পুরো মেলা ঘুরে দেখার সময় ছিল না। তারই মধ্যে তুত্তুরীর জন্য কেনা হল কাঁচের চুড়ি।কেনা হল মাটির পুতুল, শ্যামল কিনল কাগজের ঘুরঘুরে নীল-গোলাপি পাখা, রমেশ বোধহয় যা পাওয়া যাচ্ছে সবই কিনে ফেলল, কেনা হল, গরম গরম মথুরা কেক। পাতি বিলিতি ডোনাট, শুধু বেকড নয়, খলখলে করে তেলে ভাজা। কাগজে মোড়ার আগে তার ওপর ছড়ানো হল আইসিং সুগার। কেনা হল লেবু লেবু গন্ধ আর নুন মাখানো পপকর্ণ। গুড় না চিনি তর্ক করতে করতে কেনা হল, গরম গরম জিলিপি। গুপ্তিপাড়া হল সন্দেশের জনক, এখানকার গুপো সন্দেশ অমৃতসমতুল। গুপ্তিপাড়ায় গিয়ে, গুপো সন্দেশ  না কেনা গর্হিত অপরাধ, কাজেই? 
কলাবেচা তো হল, এবার রথ দেখার পালা, ঘড়ি বলছে, সাড়ে সাত। এখান থেকে চুঁচুড়া যেতেই লাগবে আরও ঘণ্টা দেড়েক, সেখান থেকে বাড়ি বোধহয় মধ্যরাতে পৌঁছব। সে হোক। রথ দেখে জুড়িয়ে গেল প্রাণ। কি অপরূপ সুন্দর রথ, হ্যাংলার মত ছবি তুলছিলাম আমরা, বর্মণ সাহেব, প্রীতি আর আমি, শ্যামল, ছুটে এসে বলল, “করেন কি? এটা তো রথের পিছন দিক।“  ইয়ে যার পশ্চাৎদেশই এত মনোরম, না জানি, তার অগ্রভাগ কি হবে? আশা করি বলার অপেক্ষা রাখে না। স্বয়ং বিচার করুন। প্রায় মিট্মিটে আলোয়, ঘিঞ্জি দোকান বাঁচিয়ে মুঠোফোনে ভাগাভাগি করে তোলা। আটটা নাগাদ যখন তাড়িয়ে সকলকে নিয়ে ফিরছি, শ্যামল তখন জনে জনে জিজ্ঞেস করতে ব্যস্ত, “ কোনটা দিয়ে রথে চড়া যায় গো? ও ম্যাডাম, দাঁড়ান, যাবেন না। এতদূর থেকে এলেন, রথে একবার চাপবেন না?” গুটি কয়েক গুড়গুড়ে রথে চেপেছে বটে, তাই বলে, আমি?ছেলেটার জীবনে বুদ্ধি হবে না মাইরি, সাধে শ্যামলের ওপর চটে যাই?

Thursday 4 July 2019

অনির ডাইরি ৪ঠা জুলাই,২০১৯


 এক,একটা দিন অমন হয়। ঘুমটা ভাঙলেই মুচড়ে   ওঠে বুক। শতাব্দী প্রাচীন বাড়িটা যেন তার শত বৎসরের ওজন নিয়ে চেপে বসে বুকের ওপর। কুহকিনীর মত ডাকে পাঁচশ বছরের বুড়ি শহর। ঘুম চোখে কোনমতে জিভ পোড়ানো চাটা ঢকঢক করে গলায় ঢেলেই বেরিয়ে পড়লাম।
সবে সোয়া সাতটা, এরই মধ্যে আকাশে দেদীপ্যমান সূর্যদেব। ঐ যাঃ সানস্ক্রীনটাও লাগাতে ভুলে গেছি। চানটাও করে বেরোলেই বোধহয় ভালো হত। কি চিড়বিড়ে গরম বাপস্। কানে উপলের মধুঢালা কণ্ঠ,“তুমি জ্বরের শেষে সূর্য ধোয়া ঘর-”

খলবল করে একছুটে রাস্তা টপকে যখন গলিতে ঢুকলাম, তখনও সুবেশ অফিস বাবুদের দর্শন নেই। কালি বাড়ির মা সিদ্ধেশ্বরীকে স্যালুট ঠুকে, বন্ধ রেশন দোকানের পাশ দিয়ে, মনসাতলা টপকে এগিয়ে গেলাম। কোন এককালে খুব জাগ্রত ছিল এই মনসাতলা। পুত্রার্থে মানুষ ক্ষীরের পুতুল মানত করত নাকি, কতদিনের শখ, এমনি একটি ক্ষীরের পুতুলের ঘাড় মটাকানোর।
নটা বাজল বুঝি, দ্বিতীয় দফার চা বানাচ্ছে মা। “মা। মা। ”করে প্রবল চিৎকার জুড়েছে টুঁইটুঁই। মাকে চোখে হারায়। বাবাকে অবশ্য তেমন পাত্তা দেয় না। দরজা খুলে দিলেই, গিয়ে বসবে মায়ের কাঁধে।সবকাজ ফেলে আদর করো মা। শীতে বুকে জড়িয়ে চাদর মুড়ি দিয়ে টিভি দেখে মা। চাদরের ফাঁক দিয়ে উঁকি মারে টুঁইটুঁই। একবার মায়ের হাত ফস্কে ধড়াম করে পড়ে গিয়েছিল খাঁচা সমেত। তুই আমায় ফেলে দিলি মা? অভিমানে উড়ে গিয়েছিল টুঁইটুঁই। দুই দিন তার টিকিও দেখা যায়নি। মা উদভ্রান্তের মত ঘুরেছে বাগানে,বারন্দায়, ছাতে। দূর থেকে সমানে ডেকেছে টুঁইটুঁই-মা। মা। মা। টুঁইটুঁই ফিরে তো এসেছে, কিন্তু মাকে আর ছাড়ে না এক দণ্ডও। ভীষণ ঈর্ষা করে টুঁইটুঁই আর তুত্তুরী একে অপরকে। তুত্তুরীর মামমামকে কেড়ে নেওয়া? টুঁইটুঁইএর ঝোল একদিন খাবেই তুত্তুরী।
বাসি কাপড় কেচে শুকোতে দিচ্ছে পিসি। রোয়াকের ঐ প্রান্তে দাঁড়িয়ে মায়ের দৃষ্টির অগোচরে দিনের তৃতীয় সিগারেটটা ধরিয়েছে বাবা, হাওয়ায় মাথা দোলাচ্ছে শখের কাঁঠাল গাছ। নীল অপরাজিতার ঝুমকো ফুল ফিসফিস করে কথা কইছে, কচি উচ্ছের কানে। বুড়ো সূর্যটা এক চিলতে রোদ পাঠালো বুঝি ওদের গপ্প শুনতে।
একা এলি? তুত্তুরী একদিন স্কুল না গেলে কি মহাভারত অশুদ্ধ হত বাপু? মায়ের অভিমানী কণ্ঠের আড়ালে, বাবার ফিসফিসানি,“মাকে বললেই রেগে যাবে, একটু চা বানা না?” ব্যাগের মধ্যে তুত্তুরীর জোড়া চিঠি। “মা রোজ রাতে আমার চাদর কেড়ে নেয় মামমাম। বকে দিও তো।” “আই লাভ ইউ দাদু”।

আলমারির পাল্লা খুলতেই, থরে থরে সাজানো ফেলে আসা সময়। এই সবুজ জামাটা পরে পড়তে যেতাম। এই ফ্লুরোসেন্ট ইয়েলো সালওয়ারটা পরে কতবার ডেটে গেছি।ফ্রেঞ্চ ম্যানিকিওর করা নখগুলোকে শৌভিক ভাবত নকল বুঝি। আর এই গেরুয়া সবুজ জামাটা পরে প্রথম দেখা। সেই যে সেবার ইগারো খুলল হাওড়া ময়দানে, কত দাম দিয়ে কিনে দিয়েছিল  বাবা গোলাপী সালোয়ারটা। পিঠে নীলচে এম্বর্য়ডারি ড্রাগনটা। আর এই ক্রীম কালারের টপ আর কালো রাপ আপ স্কার্টটা-
মগজ জুড়ে কুয়াশা। ক্রমেই প্রগাঢ় হচ্ছে নেশা। বহুদৃর থেকে মা বলল বুঝি,“অয় ঘুমিয়ে পড়ল বোধহয়। ” বাবা বা পিসি কে যেন বলে উঠল,“আহাঃ ঘুমোক। ঘুমোক।”
তারপর অভিমানী গলায় ক্লুনি সাহেব বললেন,“কি হবে, আর পুরোনো দিনের কথা আজ তুলে?”সেই যে উঠতি বয়সে মাথা চিবানো বুদ্ধদেব গুহ, “ভালোবাসার পুরুষকে কখনই বিয়ের বাঁধনে বেঁধো না।” সেই জন্যই তো ক্লুনি সাহেব-। তুমি বুঝি আজও আমায়-। তাই বলে পায়ের আঙুল মটকাচ্ছ কেন? আর এত ডাকাডাকিই বা কিসের।
বাতানুকূল যন্ত্রের মৃদু বুঁমরো বুঁমরোর তালে ফুরফুরিয়ে ঘুরছে পাখা। গায়ে কখন যেন চাদর চাপা দিয়েছে মা, নাকি বাবা। তাই বলে, এত মধুর স্বপ্ন কেউ ভাঙায়? জবাবটা শোনা হল না যে, পিসির হাতে গরম জিলিপি। “ওঠ রে। তোর জন্য এই রোদে আধঘন্টা লাইন দিয়ে নিয়ে এলাম। ” ঘড়িতে দেড়টা। মা হাঁ হাঁ করে উঠল,“ভাত খাবি তো। এখন নয়।” ততোক্ষণে খাঁটি বাঙালী টকটক বিউলির ডালের কিটকিটে মুখ পোড়ানো জিলিপি মন্থন করছে অমৃতসাগর।
প্রিয়তম ক্লুনি সাহেব, তুমি একটু জিরোও। পরে দেখা হবে। আপাততঃ অনেক কাজ বাকি। ভাত খেয়েই দৌড়তে হবে বাড়ির পথে, একজন বসে আছে যে, তিন তিনটে হাত পা কাটা পুতুল ছানা “জগু-বলু আর সুভু”কে নিয়ে। তারা রথে চাপতে চায়। রথ চেপেছে বাঙ্কের মাথায়। নামাতে হবে,সাজাতে হবে।তালপাতার  সেপাই ঘোড়ার গলায় পরাতে হবে দড়ি, তারপর টানতে টানতে ঠাম্মার বাড়ি। পথে লুটিয়ে পড়বে ঘোড়া। চিৎপটাং হবে, জগু আর তার ভাইবোন।ধুৎ তেরি বলে রথের রশি ছেড়ে দেবেন সারথী। অতঃপর সদলবলে মায়ের ঘাড়ে চাপবেন, চালাও পানশি ঠাম্মা-দাদুর বাড়ি। ধেড়েটা বাদে আগামী সাতদিন, তেনারা সেখানেই থাকবেন কিনা। সেই আনন্দে জিলিপি খাওয়াবে দাদু। আপনারাও খান না, গরম গরম জিলিপি আর মুচমুচে পাঁপড় ভাজা।শুভ রথযাত্রা। ভালো থাকবেন সকলে। 

Monday 1 July 2019

অনির ডাইরি ১লা জুলাই, ২০১৯


#স্বপ্নের_মত_ইস্কুলবাড়ি


  সে অনেককাল আগের কথা। আশির দশক। সকাল হত উনুনের ধোঁয়া আর বহুদূর থেকে ভেসে আসা আকাশবাণীর প্যাঁপো প্যাঁপো সুরে। অতঃপর যেন ইথারে ভেসে আসত, কার মধুঢালা কণ্ঠস্বর,“নমস্কার। ইয়ে আকাশবাণী হ্যয়”।

 তখনও আমাদের হাওড়া শিল্পনগরী। বার্ন স্টান্ডার্ড, গেসকিন উইলিয়ামস্ রমরমিয়ে চলছে।  আনন্দবাজার আর যুগান্তর হাতে, মেরি( এখনকার মারি) আর থিন অ্যারারুটের সাথে তুফান ওঠে  চায়ের কাপে। পাড়ার চায়ের দোকান গুলোতে চলে কত যে দুনিয়া কাঁপানো, তাত্ত্বিক আলোচনা। তারই সাথে পাল্লা দিয়ে চলে পাড়ার পুজোর নাটকের প্রস্তুতি, নববিবাহিত দম্পতির বাড়ির দোরগোড়ায় কার্তিক ফেলে তাদের হাড় জ্বালাবার ষড়যন্ত্র। বাঙালী তখন গাঁতিয়ে বই পড়ে। গমগম করে পাড়ার লাইব্রেরি গুলো।

কদমতলা বাজারের একপাশে ছিল বিশাল ঐতিহ্যশালী ব্যাঁটরা পাবলিক লাইব্রেরী।বাজারু বাবুরা বাজারে ঢোকার আগে ঢুঁ মারতেন হেথায়।  একতলার বিশাল হলঘরে মধ্যমণি পালিশচটা লম্বাটে কাঠের টেবিলের ওপর স্তুপিকৃত বিভিন্ন প্রকাশনীর খবরের কাগজ। দোতলা জুড়ে বইয়ের গোলকধাঁধা। এই লাইব্রেরির একপাশে ছোট্ট স্কুল, যার নামও ব্যাঁটরা পাবলিক লাইব্রেরি স্কুল। লাইব্রেরির দাক্ষিণ্যেই চলত বোধহয়। তবে চলত ভালোই। দুটি মাত্র ক্লাশ- নার্সারি আর প্রিপেরেটারি।

বাবামায়ের কোলে চেপে লাইব্রেরিতে প্রথম প্রবেশ। জনৈকা বয়স্কা মহিলা, পরণে সাদাসিধে করে পরা সাদা থান, কোল থেকে নামিয়ে হাত ধরে নিয়ে গেলেন একটা ছোট্ট ঘরে। অনেকটা দইলে ডাক্তারের(পেট টেপা, গলায় চামচে ঢোকানো আর তেঁতো ওষুধ খেতে দেওয়া পারিবারিক ডাঃ দলুই) চেম্বারের মত। শুধু ওষুধের কটু গন্ধ, আর “শুয়ে পড়” মার্কা খাটটাই যা মিসিং। বসে ছিলেন এক তুলনামূলক স্থূলাঙ্গী মহিলা। অনেকটা কালো ফ্রেমের, মোটা চশমা পড়া বয়স্কা সুমিতা স্যান্যালের মত দেখতে। তিনি কোলে তুলে নিলেন। পরে জেনেছিলাম ,উনি হেডমিস্ট্রেস। নাম শীলা দি। শীলাদির কোলে বসে,ছবির বই দেখে, কি যে পাকামি মারলাম। বাড়ি ফেরার পথে, ঐটুকু রাস্তাও বাবা রিক্সা করে নিয়ে এল।মা বোধহয় ৪০টা চুমুই খেয়ে ফেলল। এমন স্কুল যদি স্বপ্নের মত না হয়,কোনটা হবে হে টানটিন। হোক না বাজারের মধ্যে পুঁচকে স্কুল।
মেরুন রঙের টিউনিক, সাদা জামা। পিঠের জন্য হলদে চটের ব্যাগ। পিট্টু টাইপ। নতুন গোল স্টিলের টিফিনে বক্স। তাতে খোদাই করা আমার নাম। যাকে আমি কর্মজীবন পর্যন্ত ব্যাগে করে বহন করেছি। তিনি আজও বহাল তবিয়তে বিরাজমান, মায়ের রান্নার ক্যাবিনেটে। টিফিনে একচেটিয়া আব্দারি(মানে প্রায় জুলুম করে আদায় করা) মিল্ককেক। স্কুল চালু হতে না হতেই স্বপ্নভঙ্গ।অফিস ফেরতা মায়ের পায়ের ওপর দিয়ে চলে গেল সিমেন্টের বস্তা বোঝাই ঠেলা গাড়ি। স্কুলে যাওয়া ডকে উঠল।

তিন মাস পর, বাবা গিয়ে অনুরোধ করলেন শীলাদিকে। শীলা দি দোদুল্যমান চিত্ত, ‘ও কি পারবে?” অনুমতি পেয়ে শুরু হল স্কুল যাওয়া। বেশ মজার স্কুল।একতলায় অফিস আর শৌচালয়,বোধহয় কমনরুমও। দোতলায় নীলচে পর্দা দিয়ে ভাগ করা করা ক্লাশরুম। টিচার অন্যমনস্ক হলেই পর্দা সরিয়ে পাশের ক্লাশে মুণ্ডু গলানো। পর্দার ওপর নীচে দিয়ে এন্তার কেলাকেলি, চুলটানা, ভেঙচি কাটা আর গাঁট্টা। টিচার দেখতে পেয়ে হুঙ্কার ছাড়লেই,পেন্টুলের রঙ পরিবর্তন। এ হেঃ হেঃ।

 পড়াশোনা কম, নাচগান বেশী। প্রতিবেশী ক্লাসে মুণ্ডু গলানোর জন্য কি না জানি না, রোজই কেউ না কেউ ক্লাশে ইয়ে করে ফেলত। আয়া মাসিরা এমনিতে বেশ ভালোই ছিলেন। ছোট কাজ করলে দিব্যি সাফসুতরো করে, পাউডার মাখিয়ে, স্পেয়ার জামা পরিয়ে আবার ফিটফাট করে দিতেন। শুধু পেন্টুলের রঙ পাল্টে ফেললেই হয়ে যেত মটকা গরম। বিশেষতঃ এক বুড়ি মাসি ছিল, “কাল রাতে কি খাইছিলা?” বলে শুরু হত ঝাড়। ঝাড়ের চোটে অলিভিয়া বলতও না, গোটা ক্লাশ সুরভিত হয়ে জানান দিত, আজ অলিভিয়া মঞ্চে অবতীর্ন। তবে হাইট হয়েছিল, যেবার মাসির বকুনীর ঠেলায় দেবদত্ত আবার করে ফেলেছিল। রামঃ।  রামঃ।

বেলা বারোটায় ছুটি। ক্লাশ থেকে নীচে হলঘরে নেমে কোস্তাকুস্তি করা।কোঁৎকা মারার নেট প্রাকটিশ,  তারপর যার নাম ডাকা হবে সে বাকিদের ভেঙচে, গুঁতিয়ে একপাক নেচেই দৌড়। যার পরণে টাটকা জামা, বগলে পাউডারের খুশবু, তার বাবামায়ের সেদিন লজ্জায় অবনত মস্তক। “কাল রাতে কি খাইছিলা”!
কটা দিন বাবা-মা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নিয়ে এল। তারপর দেওয়া হল আয়া মাসির জিম্মায়। এণারা ঐ ইয়ে সাফ করা টাইপ নন, এণাদের কাজই হল, স্কুল থেকে একপাল এঁড়ে-বকনা বাছুরকে গলায় দড়ি বেঁধে নিয়ে বেরোনো, এবং পোস্টম্যানের মত বাড়ি বাড়ি দিয়ে খোঁটায় বাঁধা। হাতে একটা ছড়ি নিলে পাক্কা ডগ ট্রেনার মাইরি।
প্রথম কদিন কনক দি, তারপর পান্না দির ওপর দায়িত্ব পড়ল। কনকদি বেশ রাগী ছিলেন। পান্নাদি মাটির মানুষ। ফলে আমাদের বাঁদরামি বাড়তে লাগল লাফিয়ে লাফিয়ে। সবকটা ব্যাগ হাতে ঝুলিয়ে, সবার হাত ধরে, ঐ রোদে সাধাসিধে শাড়ি পরা পান্নাদি যখন কারো বাড়ি গিয়ে কড়া নাড়তেন, পলকে ময়দান সাফ। যে যার বাড়িতে পারতাম ঢুকে যেতাম। দিনকালও কত ভালো ছিল, এখন ভাবলে তাজ্জব লাগে। একজন দাদু বসে থাকতেন,বারন্দার ইজিচেয়ারে, আগে তাঁকে দেখতে যেতাম। দেখতে পেলেই,কপালে হাত ঠেকিয়ে বলতেন,“পেন্নাম হই মহারাণী।” কোনদিন বলতেন,“মহারাণী ভিক্টোরিয়া। ” উফ্ ফূর্তির প্রাণ গড়ের মাঠ। দ্বিতীয় বাড়িতে কড়া নাড়ার পর, পালিয়ে একটা বড় বাড়ির উঠোনে। চৌবাচ্ছায় খানিক জল ছপছপ করতে না করতেই পান্নাদি কোলে করে ধরে নিয়ে যেত। কি ভাবে টের পেত কে জানে? এমনই এক বাড়িতে এক বুড়ি ঠাকুমাকে একবার বলেছিলাম,“কি করছ?ডিম সিদ্ধ বুঝি? আমি ডিম খেতে খুউব ভালোবাসি”। উনিও চমকে যাওয়া সুরে বলেছিলেন,“হ্যাঁ মা, তোমার জন্যই তো করছি”। পান্না দি সেবার সময়মত শুধু উদ্ধার করেছিলেন তাই নয়, কান ধরে অনেকটা হাঁটিয়েছিলেন। হ্যাংলামোর একটা সীমা থাকা উচিৎ।

দেখতে দেখতে কবে যে নার্সারি-প্রিপেরেটরি শেষ হয়ে গেল। শেষ ফাংশনে নাচলাম,সেবার তাসের দেশ নৃত্যনাট্য হয়েছিল। সেই প্রথমবার মেক্যাপম্যান এসেছিল। নাচগান শেষে, শীলাদির মনকেমন করা ভাসন। ততোদিনে স্কুল শেষের মর্ম বুঝে গেছি সকলে,আর দেখা হবে না। কোনদিনও না। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে শুরু হওয়া কান্না ক্রমে ডুগরে ডুগরে উঠল। বাবা মায়েরাও অনেকে চোখের জল ধরে রাখতে পারলেন না। যেভাবে বাবার হাত ধরে প্রথম পা রেখেছিলাম,তেমনি এবার ফেরার পালা।যতই স্বপ্নের মত হোক ইস্কুলবাড়ি,স্বপ্ন তো একসময় ভাঙে নাকি? ভাঙতেই হয়, যখন ডাক পাড়ে জীবন, ঐ যে ফিরিঙ্গী ভাষায় বলে না,“লাইফ ইজ কলিং”।

Thursday 27 June 2019

চাটুজ্যেদের গল্প

চাটুজ্যেদের গল্প ২৬/০৬/২০১৯

-হেল্লো বাবা! আই লাভ ইউ।
-(আহ্লাদী সুরে)আই লাভ ইউ। এতে আবার কোন সন্দেহ আছে না কি? একটু আগেই তোমার মা আমি আর দিদি তোমার কথাই বলছিলাম।
-মাকে দাও।
-ও গো, শুনছ। মা। মা জননী। মেয়ে চাইছে। এই তো, এসে গেছে।
-(মা ফোন ধরে) হ্যালো বল। তুত্তুরী সাঁতারে গেল-
-মা, আই লাভ ইউ।
-অ্যাঁ? কেন রে? আজ আবার কি ডে?
#দিল_তো_বাচ্চা_হ্যায়_জী

Monday 24 June 2019

অনির ডাইরি ২৪শে জুন ২০১৯

অনেকদিন বাদে এলেন তিনি। বর্ষীয়ান ট্রেড ইউনিয়ন নেতা। শ্রম আইন সব গুলে খাওয়া। কোন এককালে নাকি তাঁর প্রবল দাপট ছিল। রীতিমত ধমক চমক চলত। জয়েন করার পর, যখন প্রথমবার ওণারা ডেপুটেশন দিতে এসেছিলেন তৎকালীন সহকর্মীবৃন্দের চাপে রীতিমত পুলিশ রিকুইজিশন করতে হয়েছিল। আমাকে অবশ্য চমকাবার চেষ্টাও করেননি। বেশ কয়েকবার হাল্কাফুল্কা চিল্লাচিল্লি হয়েছিল বটে, তবে সেটা পুরোটাই তাঁর সংগঠনের অনুগামীদের কাছে তাঁর ওজন বাড়ানোর জন্য। এখন তিনি আর সংগঠনের নেতা নন।মামুলী কর্মী মাত্র। তবে অভ্যেসবশতঃ প্রায়ই লেবার দপ্তরের চক্কর কাটেন, আর কি। পড়ন্ত বিকালে ফাঁকা আছি দেখে গল্প করছিলেন, “৩৮বছর ধরে এই পার্টির সাথে জড়িত ম্যাডাম জানেন। ভাইদের বলেছিলাম, বিয়ে থা করব না, তোরা যদি দুবেলা দুমুঠো খেতে দিস, তাহলে পার্টির হোল টাইমার হয়ে যাই।” গল্পে গল্পে পরিবর্তিত পরিস্থিতির কথা উঠল, উঠতে বাধ্যও। মে মাসের শেষ বেলাতেও, আসেপাশের অনুদান প্রাপ্ত যে ক্লাবগুলির সামনে জনৈকা নেত্রীর মাল্যশোভিত আবক্ষ চিত্র শোভা পেত, নির্বাচনের উপান্তে চাইল্ডকেয়ার লিভ কাটিয়ে জয়েন করে দেখলাম, “রঙ দে তু মোহে গেরুয়া”।  এত দ্রুত তো গিরগিটিও ভোল পাল্টায় না মাইরি। জাতটার হল কি? উনি মাথা নত করে কিছুক্ষণ বসে থেকে বললেন,“আসলে কি জানেন ম্যাডাম, আপনি যদি কোন বুভুক্ষুর পাতে শুধু একটা রসগোল্লা তুলে দেন, সে খুব খুশি হবে। কিন্তু আপনি তাকে কোন দর্শন তো দিলেন না। নীতিবোধ তথা মূল্যবোধ তো তৈরি করলেন না। পরিণতি? কাল যখনই অন্য কেউ এসে আরো বড় রসগোল্লার প্রলোভন দেখাবে, দেখবেন সে তাকেই ভোট দেবে। দর্শনটা বড় জরুরী । আমরা জাতির পাতে কোন দর্শন তুলে দিতে পারিনি। তৈরি করতে পারিনি কোন মূল্যবোধ। এ এক ঐতিহাসিক অবক্ষয় ম্যাডাম। এ অপ্রতিরোধ্য। ”

উনি চলে যাবার বেশ খানিকক্ষণ পরে ব্যাগপত্র গোচ্ছাচ্ছি, অপর এক নেতার আগমন। ইনি বেশ অল্পবয়সী তথা অত্যন্ত বিনয়ী।কালেক্টরেটে এলেই সাক্ষাৎ করে যান। পরণে দলীয় রঙের পাঞ্জাবি। প্রাথমিক কুশল বিনিময়ের পর বললাম,“বাঃ তুমি এখনও দল বদলাওনি তাহলে। দেখে ভালো লাগছে। ” ভেবেছিলাম অগ্নিগর্ভ বক্তৃতা পাব, বদলে মিইয়ে যাওয়া সুরে শুনলাম,“হ্যাঁ আছি। বছর দুয়েকের আগে কোন সিদ্ধান্ত নিচ্ছি না। আসলে কি জানেন ম্যাডাম, এই রঙের পাঞ্জাবি অনেকগুলো কিনে ফেলেছিলাম। তাই পরে নি। যতদিন পারি। তারপর-”।  দেরী হয়ে যাচ্ছে,লঞ্চ মিস হলেই ট্রেন পালাবে। বেরিয়ে আসতে শুধু বললাম,“বাপ তোকে দেয় কে? তোর মত সমর্থক থাকলে আর বিপক্ষের কি দরকার”। অবশ্যই মনে মনে।

Wednesday 12 June 2019

অনির ডাইরি ১২ই জুন, ২০১৯


তখনও জুন মাস পড়েনি, নির্বাচনের দামামা সদ্য স্তব্ধ হয়েছে। পথ ভোলা পাখি মোর, সদ্য ফিরেছে কুলায়। তুত্তুরীর স্কুলেও পড়ে গেছে ছুটির ঘন্টা। আর আমার চাইল্ডকেয়ার লিভের আবেদনে পড়েছে মঞ্জুরীর শিলমোহর। গরমটাও পড়েছে জব্বর, ঘোর দ্বিপ্রহরে, জানালাদরজায় অর্গল এঁটে, বাতানুকূল যন্ত্র চালিয়ে, “আমার ছুটি,তোমার নয়’ মার্কা একটা  দিবানিদ্রার তোড়জোর করছি, গোপীবল্লভ বাবুর ফোন। “ম্যাডাম,১২ই জুন আসছে। ”
গোপীবল্লভ বাবু, হুগলী জেলায় চাইল্ডলাইনের হর্তাকর্তা। ফিরিঙ্গী ভাষায় যারে কয় ডিস্ট্রিক্ট কোঅর্ডিনেটর।হুগলী জেলায় চাইল্ডলাইন এবং শ্রম দপ্তরের তাল মিলিয়ে কাজ করার বেশ সুখকর অভিজ্ঞতা আছে। আমরা যেখানেই একসাথে হামলা করেছি, কোথাও অসফল হইনি। সে না হয় হল,তাই বলে ছুটির মধ্যে এ কি জ্বালাতন বাপু।
আপনাদের অবগতির জন্য জানিয়ে রাখি,রাষ্ট্রসংঘের নির্দেশানুসারে প্রতিবছর ১২ই জুন দিনটিকে আমরা পালন করি,“বিশ্ব শিশুশ্রম বিরোধী দিবস” হিসেবে।বিগত বছরেও আমরা একসাথে ব্যাণ্ডেল স্টেশনে “স্টেশনশিশু” দের নিয়ে পালন করেছিলাম এই দিনটিকে। কিন্ত এ বছর তো আমি ছুটিতে আছিরে বাপ। গোপী বাবু নাছোড়বান্দা,“না ম্যাডাম। আপনার সাথেই এই দিনটা পালন করতে চাই আমরা। ” বড় সাহেব সব শুনে বললেন,“খুব ভালো। করো। আমিও থাকব। তবে লোক দেখানো, পিলে চমকানো কিছু করার থেকে,এমন কিছু কর, যাতে এক রত্তি হলেও প্রকৃত জনকল্যাণ হয়। ”
শুরু হল গোপী বাবুর আর আমার ব্রেন স্টর্মিং। এমনিতে হুগলী ঘোষিত শিশুশ্রমিক মুক্ত জেলা। দু চারজন এদিকে ওদিকে ধরা পড়ে বটে,তবে শ্রমদপ্তর এবং চাইল্ডলাইনের অতি তৎপরতার জন্য তাদের সংখ্যা নগন্য। সমস্যা অন্য জায়গায়। এই জেলা থেকে প্রচুর ছেলে মেয়ে স্কুল ছু্ট হয়ে চলে যায় ভিনরাজ্যে কাজ করতে। ছেলেরা যায় মূলতঃ সুরাট থেকে বম্বে। আর মেয়েরা? মেয়েরা নাচতে যায়। আজ্ঞে হাঁ। বাবা মায়েরা জানে তাদের মেয়েরা নাচতে গেছে,কখনও ১৫দিন তো কখনও ১/২/৩মাসের জন্য। বদলে বাবা মায়ের হাতে তুলে দেওয়া হয়- ৫/১০/১৫ হাজার টাকা। “পয়সা ফেক, তামাশা দেখ” এর ‘শিলশিলা’ চলে বেশ কিছুদিন। তারপর একদিন সবার অজান্তে হারিয়ে যায় মেয়েগুলো। কোথায় যে যায়? কেন যে ফিরে আসে না?

গোপীবাবু গল্প শোনাচ্ছিলেন, এমনি দুটি অল্প হারিয়ে যাওয়া ছেলের।  ষষ্ঠ বা সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র, চেনা ছকে বাঁধা গল্প।  পড়াশোনায় অমনোযোগী,সংসারে অভাব। বাবা-মা দিল পাঠিয়ে ভিনরাজ্যে। যা খেটে দুটো পয়সা তো আনবে। কতদিন আর ঘরের খেয়ে মনের মোষ তাড়াবি?
দুটি ১২-১৩র বাচ্ছা, যারা না জানে হিন্দি,না ইংরেজি।পরিচিত দাদার সাথে গিয়ে হাজির হল হিন্দি বলয়ের এক শহরে। অতঃপর তাদের ঘাড়ে পড়ল,বিশাল আবাসনের অগুনতি ফ্ল্যাটের শৌচাগার সাফাইয়ের দায়িত্ব। মলমূত্র সাফ করতে নারাজ হলে বা কান্নাকাটি করলে জুটত অকথ্য নির্যাতন। সাথে সাথে বন্ধ করে দেওয়া হত খানাপিনা। মর ব্যাটারা। এত গোঁ। পায়খানা সাফ করবি না,তো ভুখা মর। কিভাবে যে চাইল্ডলাইন এদের উদ্ধার করে মায়ের কোলে ফিরিয়ে দিয়েছিল সে এক রোমহর্ষক উপন্যাস।

এই গল্প শুনতে শুনতেই মনে হল,যে সব এলাকা থেকে এই স্কুলছুট বা বাইরে কাজে চলে যাবার ঘটনা বেশী ঘটছে, সেই রকম কোন এলাকার স্কুলের বাচ্ছাদের সাথে দিনটি কাটালে কেমন হয়? বাচ্ছাগুলোও তো জানুক, তাদের অনাগত বিপদ তথা সেই বিপদ হতে পরিত্রানের পন্থা।

স্যারকে বলতেই স্যার এক কথায় রাজি। শুধু স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গীতে একবার বললেন,“তোমরা ঐ সব পদযাত্রা শোভাযাত্রা টাইপ কিছু করবে না তো?দেখো বাবা। বড্ড গরম। বাচ্ছা গুলো না কষ্ট পায়। আর এমন জাঁকজমকী কিছু কোর না, যার সাথে ওরা একাত্ম হতে না পারে। ওদের বোধগম্য করে পেশ করো তোমাদের বক্তব্য।”
বন্ধ ডানলপ কারখানার ভিতরে, বেবাগা ডানা মেলেছে প্রকৃতি। যতদূর চোখ যায়, শুধু সবুজের সমাহার। আর এই সবুজ সাগরের মাঝে সাহাগঞ্জ হাইস্কুল।নির্জন বিশাল জঙ্গুলে এলাকা জুড়ে ছড়ানো ছিটানো একতলা স্কুল।মাঝখানে বিশাল মাঠ। মাঠকে ঘিরে মহীরুহদের জটলা। এককালে সুদিন দেখেছে এই স্কুল। এখন ক্রমেই নিভছে দেউটি। বড়দি অবসর নিয়েছেন। সাকুল্যে দিদিমণি ১৪/১৫জন। আর ছাত্রছাত্রী ৩৫০।হাইস্কুল, বারো ক্লাস অবধি আছে বটে তবে শুধুই কলা বিদ্যা। ছাত্রছাত্রীরা  সকলেই সমাজের পিষে যাওয়া শ্রেণীভুক্ত। তবে প্রাণোচ্ছলতায় পরিপূর্ণ।
 ১০তারিখে সবে খুলেছে স্কুল। ইনচার্জ শ্রীমতী মালা চক্রবর্তীর কাছে প্রস্তাব রাখা মাত্রই উনি রাজি।

এরপর আর কি?আমাদের এনসিএলপির প্রজেক্ট ম্যানেজার ঝুমা রাতারাতি বানিয়ে ফেলল ব্যানারের ডিজাইন। গোপীবাবু আর আমি মিলে ঠিক করলাম,শুধু গপ্প বলে বাচ্ছাদের টিকিয়ে রাখা যাবে না। হয়ে যাক পোস্টার প্রতিযোগীতা। বিষয়-শিশুশ্রম তথা শিশুশ্রমিক। ওদের চোখ দিয়েও দেখা যাক। ওরা কি বুঝল,“শিশুদের কাজ না করার দিন”এর মানে?
বিজেতাদের জন্য কেনা হল পুরষ্কার। বাকিদের জন্য সান্ত্বনা টফি(ট্রফি নয়)। নীরবে অনুসরণ করছিল তুত্তুরী, গতকাল রাত থেকে তীব্র বায়না,“আমিও যাব মা।” স্যারকে ভয়ে ভয়ে বললাম,“নিয়ে যাব স্যার?” সম্মতি এল দশ সেকেণ্ডে। বিকট ভয়ে ভয়ে গেল তুত্তুরী,যদি ঢুকতে না দেয় দিদিমণিরা।
সাহাগঞ্জ হাইস্কুলের মাঝারি হলঘরে, মাটিতে ত্রিপল পেতে, কাঁচা কাঠের বেঞ্চে বসে হল অঙ্কন থুড়ি পোস্টার প্রতিযোগিতা। কি ভালো আঁকল ছেলেমেয়ে গুলো। আর কি ভালো গল্প শোনালেন গোপীবাবু। বাচ্ছারা তো বাচ্ছারা আমি শুদ্ধ মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনছিলাম। গল্প হলেও সত্যি। অবশেষে পুরষ্কার বিতরণ।
বিজয়ীদের তালিকা থেকে তুত্তুরী যথারীতি বাদ। শুকনো, ঘেমো অথচ হ্যাংলা মুখটা দেখে  কিংশুক মামা সদ্য প্রাপ্ত পুষ্পস্তবকটাই তুলে দিল তুত্তুরীর হাতে। আর সুখেন মামা আর রমেশ মামা মিলে দিলো রঙ পেন্সিল আর টফি। শেষে,বাইরের বিশাল মাঠে গ্রুপ ফটো তোলার সময়, মাও সে তুংয়ের সেই কথাটা বারবার মনে হচ্ছিল,“জগৎটা তোমাদের। জগৎটা আমাদেরও। কিন্তু তোমরা হলে,সকাল বেলা আটটা নটার সূর্য। ” ভালো থাকুক এই তরুণ তপনেরা,আগত সমাসন্ন আঁধার কাটাতে এদেরই আজ বড় দরকার।




Friday 7 June 2019

অনির ডাইরি ৭ই জুন ২০১৯


সিরিয়াসলি? খুব দুঃখ হয়েছে? বিদ্যা বালন বলেছেন বলে? আর আমরা যে এত বছর ধরে সরব নীরবে বলে আসছি,“তোর বাপের খেয়ে মোটা নাকি? অথবা আমি কালো তাতে তোর পিতৃদেবের কগাছা উৎপাটিত হল?” সেটা বুঝি কানে ঢোকেনি? আচ্ছা যাঁরা যাঁরা,বিদ্যার ভিডিওটি শেয়ার পূর্বক,  জ্ঞানগর্ভ পোস্ট দিলেন বা লিখলেন, ছিঃ এরকম করে বলা উচিৎ নয়, কবে যে আমরা শিখব, রোগাকে রোগা,মোটাকে মোটা, কালোকে কালো বলতে নেই, তাঁরা আজ অবধি কতজনকে ফোকটে জ্ঞান দিয়েছেন,একটু বলবেন? “আর খাস না। ভাত কম খা। আলু খাস না। মিষ্টির দিকে তাকাস না। তুই চকোলেটের কথা ভাবিস কি করে? সকালে খালি পেটে গরম জল আর লেবু খা। দেখছিস ও কেমন রোগা হয়ে গেছে, খালিপেটে কপালভাতি কর। তোর বাড়ির কাছে জিম নেই?এবার ভুঁড়িটা একটু কমা” শালা আমার ভুঁড়ি,তাকে কমাব কি বাড়াব সেটা আমি ঠিক করব। তুই কে রে বাপ? আমি তো কখনও ঘুরিয়ে ফিরিয়েও তোর গ্রে ম্যাটার নিয়ে আলোচনা করি না।

দাঁড়ান দাঁড়ান আরো আছে, কতজনকে বলেছেন, ওজন কমাও/বাড়াও না হলে বিয়ে হবে না/সন্তানধারণে সমস্যা হতে পারে? কতজনকে নিমাই-শ্রীচৈতন্য এইসব বলে তার সামনে/পিছনে ফস্টিনস্টি করেছেন? কতজনের চোখ/নাক/চিবুক নিয়ে বিশেষজ্ঞ মতামত দিয়েছেন? কতজনকে বলেছেন তোর যা উচ্চতা, তোর বাচ্ছারা ফুটপাতে বসে পা দোলাবে? কতজনকে বলেছেন, তোর যা চেহারা তোকে  ঐসব জামাকাপড় মানাবে না। তোর যা গায়ের রঙ, লাল/কমলাটা না পরাই ভালো। অথবা সর্ব দোষ হরে গোরাঃ। গায়ের রঙ ফর্সা হলেই বাকি সব খুঁত ঢেকে যায়? কতগুণ মশাই/মহাশয়া আপনার, একই সাথে ডাক্তার এবং পার্সোনাল স্টাইলিস্ট।  ম্যা গো! সাধে আপনার মস্তিষ্কস্থিত পদার্থটি  ভয়ানক দুর্গন্ধ ছড়ায়। তাও আমরা আপনার ঐ ম্যাটারটি নিয়ে আলোচনা করি না। একবার ভাবুন খালি কি অসীম সহনশক্তি আমাদের,মাইরি!

আজন্ম এই ধরণের “বুলি”দের নিয়ে ঘর করি আমরা, হয়তো আমৃত্যুও। কে বা কারা থাকে না, এদের মধ্যে? আত্মীয়-পরিজন- বন্ধু-প্রেমিক(ইকা)- সহকর্মী। বাপস্ কত শুভাকাঙ্খী আমাদের মাইরি। সকলের সামনে অথবা নিভৃতে আপনার বলা তুচ্ছতম ঠাট্টাটাও যে কতখানি হৃদয় বিদারক হতে পারে, কোন ধারণা নেই বোধহয় আপনার, থাকবেই বা কি করে, যাদের নিয়ে এসব ঠাট্টাতামাশা করেন,তারা মুখবুজে সয়ে যায় যে। হয়তো নকল দেঁতো হাসির আড়ালে লুকিয়ে ফেলে উদ্গত অশ্রু। কানে অহরহ বাজতে থাকে আপনার সবজান্তা তামাশা/জ্ঞান।
আত্মবিশ্বাসের প্রতিনিয়ত গণধর্ষণ সইতে সইতে বেড়ে উঠি আমরা। ক্রমশঃ মিশে যাই মাটিতে। কোন বিস্মৃত অতীতে এই অধমেরও মনে হত,পৃথিবীর কুৎসিততমা মেয়েটি হেঁটে চলেছে, হাওড়া সড়ক-গলি ঘুঁজি দিয়ে। যত ফাঁকা রাস্তা,ততো মঙ্গল। শুভাকাঙ্ক্ষীদের মুখদর্শনের বিড়ম্বনা থেকে তো মুক্তি। ঝুঁকতে ঝুঁকতে মাটিতে প্রথিত হয়ে টের পেলাম,“They buried us, but they didn't know we were seeds.” অতঃপর বুঝলাম দুইহাতের দুই মধ্যমার অস্তিত্বের তাৎপর্য। আর আজ যখন এই ডাইরি লিখছি, আমার উল্টোদিকের আয়নায় যে বসে বসে মোবাইলে কি যেন করছে, আমার চোখে সে সত্যিই অনিন্দিতা। সেসব দিন আজ শুধু নিছক কৌতুক জাগিয়ে যায়। তাই বলে কি ভাবছেন, “চোখে আঙুল দাদা/দিদি” আমার কম আছে? প্রতিনিয়ত কত যে শুভাকাঙ্ক্ষী, ফোকটে কত যে জ্ঞান দেবার জন্য ছটফট করে মরে! আর আমি কি বলি? শুননই না।চাইলে শিখেও রাখতে পারেন, কাজে আসবে। উর্ধ্বতন কতৃপক্ষ হলে মনে মনে, আর বাকিদের বলি সোচ্চারে,“আপলোগ না যা’কে টাট্টি খালো”।


https://m.youtube.com/watch?v=rOunvdHHNYU