Wednesday 12 June 2019

অনির ডাইরি ১২ই জুন, ২০১৯


তখনও জুন মাস পড়েনি, নির্বাচনের দামামা সদ্য স্তব্ধ হয়েছে। পথ ভোলা পাখি মোর, সদ্য ফিরেছে কুলায়। তুত্তুরীর স্কুলেও পড়ে গেছে ছুটির ঘন্টা। আর আমার চাইল্ডকেয়ার লিভের আবেদনে পড়েছে মঞ্জুরীর শিলমোহর। গরমটাও পড়েছে জব্বর, ঘোর দ্বিপ্রহরে, জানালাদরজায় অর্গল এঁটে, বাতানুকূল যন্ত্র চালিয়ে, “আমার ছুটি,তোমার নয়’ মার্কা একটা  দিবানিদ্রার তোড়জোর করছি, গোপীবল্লভ বাবুর ফোন। “ম্যাডাম,১২ই জুন আসছে। ”
গোপীবল্লভ বাবু, হুগলী জেলায় চাইল্ডলাইনের হর্তাকর্তা। ফিরিঙ্গী ভাষায় যারে কয় ডিস্ট্রিক্ট কোঅর্ডিনেটর।হুগলী জেলায় চাইল্ডলাইন এবং শ্রম দপ্তরের তাল মিলিয়ে কাজ করার বেশ সুখকর অভিজ্ঞতা আছে। আমরা যেখানেই একসাথে হামলা করেছি, কোথাও অসফল হইনি। সে না হয় হল,তাই বলে ছুটির মধ্যে এ কি জ্বালাতন বাপু।
আপনাদের অবগতির জন্য জানিয়ে রাখি,রাষ্ট্রসংঘের নির্দেশানুসারে প্রতিবছর ১২ই জুন দিনটিকে আমরা পালন করি,“বিশ্ব শিশুশ্রম বিরোধী দিবস” হিসেবে।বিগত বছরেও আমরা একসাথে ব্যাণ্ডেল স্টেশনে “স্টেশনশিশু” দের নিয়ে পালন করেছিলাম এই দিনটিকে। কিন্ত এ বছর তো আমি ছুটিতে আছিরে বাপ। গোপী বাবু নাছোড়বান্দা,“না ম্যাডাম। আপনার সাথেই এই দিনটা পালন করতে চাই আমরা। ” বড় সাহেব সব শুনে বললেন,“খুব ভালো। করো। আমিও থাকব। তবে লোক দেখানো, পিলে চমকানো কিছু করার থেকে,এমন কিছু কর, যাতে এক রত্তি হলেও প্রকৃত জনকল্যাণ হয়। ”
শুরু হল গোপী বাবুর আর আমার ব্রেন স্টর্মিং। এমনিতে হুগলী ঘোষিত শিশুশ্রমিক মুক্ত জেলা। দু চারজন এদিকে ওদিকে ধরা পড়ে বটে,তবে শ্রমদপ্তর এবং চাইল্ডলাইনের অতি তৎপরতার জন্য তাদের সংখ্যা নগন্য। সমস্যা অন্য জায়গায়। এই জেলা থেকে প্রচুর ছেলে মেয়ে স্কুল ছু্ট হয়ে চলে যায় ভিনরাজ্যে কাজ করতে। ছেলেরা যায় মূলতঃ সুরাট থেকে বম্বে। আর মেয়েরা? মেয়েরা নাচতে যায়। আজ্ঞে হাঁ। বাবা মায়েরা জানে তাদের মেয়েরা নাচতে গেছে,কখনও ১৫দিন তো কখনও ১/২/৩মাসের জন্য। বদলে বাবা মায়ের হাতে তুলে দেওয়া হয়- ৫/১০/১৫ হাজার টাকা। “পয়সা ফেক, তামাশা দেখ” এর ‘শিলশিলা’ চলে বেশ কিছুদিন। তারপর একদিন সবার অজান্তে হারিয়ে যায় মেয়েগুলো। কোথায় যে যায়? কেন যে ফিরে আসে না?

গোপীবাবু গল্প শোনাচ্ছিলেন, এমনি দুটি অল্প হারিয়ে যাওয়া ছেলের।  ষষ্ঠ বা সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র, চেনা ছকে বাঁধা গল্প।  পড়াশোনায় অমনোযোগী,সংসারে অভাব। বাবা-মা দিল পাঠিয়ে ভিনরাজ্যে। যা খেটে দুটো পয়সা তো আনবে। কতদিন আর ঘরের খেয়ে মনের মোষ তাড়াবি?
দুটি ১২-১৩র বাচ্ছা, যারা না জানে হিন্দি,না ইংরেজি।পরিচিত দাদার সাথে গিয়ে হাজির হল হিন্দি বলয়ের এক শহরে। অতঃপর তাদের ঘাড়ে পড়ল,বিশাল আবাসনের অগুনতি ফ্ল্যাটের শৌচাগার সাফাইয়ের দায়িত্ব। মলমূত্র সাফ করতে নারাজ হলে বা কান্নাকাটি করলে জুটত অকথ্য নির্যাতন। সাথে সাথে বন্ধ করে দেওয়া হত খানাপিনা। মর ব্যাটারা। এত গোঁ। পায়খানা সাফ করবি না,তো ভুখা মর। কিভাবে যে চাইল্ডলাইন এদের উদ্ধার করে মায়ের কোলে ফিরিয়ে দিয়েছিল সে এক রোমহর্ষক উপন্যাস।

এই গল্প শুনতে শুনতেই মনে হল,যে সব এলাকা থেকে এই স্কুলছুট বা বাইরে কাজে চলে যাবার ঘটনা বেশী ঘটছে, সেই রকম কোন এলাকার স্কুলের বাচ্ছাদের সাথে দিনটি কাটালে কেমন হয়? বাচ্ছাগুলোও তো জানুক, তাদের অনাগত বিপদ তথা সেই বিপদ হতে পরিত্রানের পন্থা।

স্যারকে বলতেই স্যার এক কথায় রাজি। শুধু স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গীতে একবার বললেন,“তোমরা ঐ সব পদযাত্রা শোভাযাত্রা টাইপ কিছু করবে না তো?দেখো বাবা। বড্ড গরম। বাচ্ছা গুলো না কষ্ট পায়। আর এমন জাঁকজমকী কিছু কোর না, যার সাথে ওরা একাত্ম হতে না পারে। ওদের বোধগম্য করে পেশ করো তোমাদের বক্তব্য।”
বন্ধ ডানলপ কারখানার ভিতরে, বেবাগা ডানা মেলেছে প্রকৃতি। যতদূর চোখ যায়, শুধু সবুজের সমাহার। আর এই সবুজ সাগরের মাঝে সাহাগঞ্জ হাইস্কুল।নির্জন বিশাল জঙ্গুলে এলাকা জুড়ে ছড়ানো ছিটানো একতলা স্কুল।মাঝখানে বিশাল মাঠ। মাঠকে ঘিরে মহীরুহদের জটলা। এককালে সুদিন দেখেছে এই স্কুল। এখন ক্রমেই নিভছে দেউটি। বড়দি অবসর নিয়েছেন। সাকুল্যে দিদিমণি ১৪/১৫জন। আর ছাত্রছাত্রী ৩৫০।হাইস্কুল, বারো ক্লাস অবধি আছে বটে তবে শুধুই কলা বিদ্যা। ছাত্রছাত্রীরা  সকলেই সমাজের পিষে যাওয়া শ্রেণীভুক্ত। তবে প্রাণোচ্ছলতায় পরিপূর্ণ।
 ১০তারিখে সবে খুলেছে স্কুল। ইনচার্জ শ্রীমতী মালা চক্রবর্তীর কাছে প্রস্তাব রাখা মাত্রই উনি রাজি।

এরপর আর কি?আমাদের এনসিএলপির প্রজেক্ট ম্যানেজার ঝুমা রাতারাতি বানিয়ে ফেলল ব্যানারের ডিজাইন। গোপীবাবু আর আমি মিলে ঠিক করলাম,শুধু গপ্প বলে বাচ্ছাদের টিকিয়ে রাখা যাবে না। হয়ে যাক পোস্টার প্রতিযোগীতা। বিষয়-শিশুশ্রম তথা শিশুশ্রমিক। ওদের চোখ দিয়েও দেখা যাক। ওরা কি বুঝল,“শিশুদের কাজ না করার দিন”এর মানে?
বিজেতাদের জন্য কেনা হল পুরষ্কার। বাকিদের জন্য সান্ত্বনা টফি(ট্রফি নয়)। নীরবে অনুসরণ করছিল তুত্তুরী, গতকাল রাত থেকে তীব্র বায়না,“আমিও যাব মা।” স্যারকে ভয়ে ভয়ে বললাম,“নিয়ে যাব স্যার?” সম্মতি এল দশ সেকেণ্ডে। বিকট ভয়ে ভয়ে গেল তুত্তুরী,যদি ঢুকতে না দেয় দিদিমণিরা।
সাহাগঞ্জ হাইস্কুলের মাঝারি হলঘরে, মাটিতে ত্রিপল পেতে, কাঁচা কাঠের বেঞ্চে বসে হল অঙ্কন থুড়ি পোস্টার প্রতিযোগিতা। কি ভালো আঁকল ছেলেমেয়ে গুলো। আর কি ভালো গল্প শোনালেন গোপীবাবু। বাচ্ছারা তো বাচ্ছারা আমি শুদ্ধ মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনছিলাম। গল্প হলেও সত্যি। অবশেষে পুরষ্কার বিতরণ।
বিজয়ীদের তালিকা থেকে তুত্তুরী যথারীতি বাদ। শুকনো, ঘেমো অথচ হ্যাংলা মুখটা দেখে  কিংশুক মামা সদ্য প্রাপ্ত পুষ্পস্তবকটাই তুলে দিল তুত্তুরীর হাতে। আর সুখেন মামা আর রমেশ মামা মিলে দিলো রঙ পেন্সিল আর টফি। শেষে,বাইরের বিশাল মাঠে গ্রুপ ফটো তোলার সময়, মাও সে তুংয়ের সেই কথাটা বারবার মনে হচ্ছিল,“জগৎটা তোমাদের। জগৎটা আমাদেরও। কিন্তু তোমরা হলে,সকাল বেলা আটটা নটার সূর্য। ” ভালো থাকুক এই তরুণ তপনেরা,আগত সমাসন্ন আঁধার কাটাতে এদেরই আজ বড় দরকার।




No comments:

Post a Comment