Thursday, 10 March 2022

অনির ডাইরি ১০ই মার্চ, ২০২২

 


‘এই মা, একটা বিরাট গড়বড় হয়ে গেছে!' তাম্রলিপ্ত নগরী ছেড়ে চলেছি মহানগরের উদ্দেশ্যে,কিছুক্ষণ আগে সদ্য টপকেছি রূপনারায়ণ নদ তথা কোলাঘাট ব্রীজ, এমন সময় তুত্তুরীর আর্ত চিৎকার। ঘচাং করে ব্রেক কষল আমাদের উত্তমকুমার, সামনের সিট থেকে হায় হায় করে উঠল তুত্তুরীর মাসিও,‘ কি হয়েছে সোনা মা?’ 


সোনামা ওরফে তুত্তুরীর মুখ চুন, কাচুমাচু হয়ে জানাল মহানগরে ফেরৎ আসার উন্মাদনায় অন্তিম মুহূর্তে জুতো না বদলে, বাড়িতে পরার হাওয়াই চপ্পলটাই পায়ে গলিয়ে চলে এসেছেন তিনি।  গাড়ির সামনের সিটে বসে কপাল চাপড়ায় মাসি, উৎকণ্ঠিত স্বরে জানতে চায়, ‘গাড়িটা কি একবার ঘোরাবে?’ স্টিয়ারিং উল্টোদিকে ঘোরাতে প্রস্তুতও হয়ে যায় অামাদের উত্তমকুমার, প্রয়োজন বলতে শুধু আমার অনুমতিটুকু। অনুমতি কে দেবে, আমি তো হেসেই খুন। কি ভোম্বল বাবু তুই। এবার থাক হাওয়াই চটি পরে,গাড়ি ঘোরানোর সময় কি আমার আছে? সময় মত পৌঁছাতে হবে মহানগর, প্রথমে জমা করতে হবে তুত্তুরীর পরীক্ষার খাতা, তারপর গিয়ে কথা বলতে হবে হাসপাতালের ডাক্তারবাবুর সঙ্গে, তারপর ভিজিটিং  আওয়ারে গিয়ে মোলাকাৎ হবে শ্রশ্রুমাতার সঙ্গে। গত সোমবার থেকে যিনি হাসপাতালবাসিনী। এত ব্যস্ত শিডিউলের মধ্যে তুত্তুরীর হাওয়াইচটির জন্য ব্যয় করার মত সময় বিলাসিতা আমার সত্যিই নেই।  


কিসের উন্মাদনায় তিনি হাওয়াই চটি পরেই চার চক্র যানে সওয়ার হয়েছেন তা টের পেলাম অচীরেই। বিমানবন্দরের এক নম্বর গেট গলে গাড়ি দৌড়তে শুরু করেছে মসৃণ ভিআইপি রোড ধরে, বাইরে চোখ ধাঁধানো রোদে ঝলসে যাচ্ছে চোখ, এমন সময় তুত্তুরীর প্রাণের বান্ধবীর জননী, যিনি আবার সম্পর্কে আমার অন্যতম ঘনিষ্ঠ বান্ধবী,তাঁর ফোন। বক্তব্য অত্যন্ত সরল, শ্রীমতী তুত্তুরী ওরফে পুরোযা এবং শ্রীমতী ঈশাণী উভয়ে মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, আজ তাঁরা মিলিত হবেনই। মায়েরা সঙ্গে থাকতে পারলে ভালো, নতুবা আবাসনের দুর্গা পুজোর মাঠেই সমবেত হবেন দোঁহে। এতদিন দেখা হয়নি, আর কি দেখা না করে থাকা যায়, বিশেষতঃ যাদের বার্ষিক পরীক্ষার পাঠ বিগতকালই চুকেছে। 


বেচারা মায়েরা আর কত কাবাবের হাড় তথা কন্যাদের চক্ষুশূল হবে। অগত্যা জানালাম, ঠিকই আছে, দেখা তো করতেই হবে,সন্ধ্যা ছটার পর বাড়ির সবথেকে কাছের রেঁস্তোরায়। 


 মাসি সমেত শ্রীমতী তুত্তুরীকে বাড়ি পৌঁছে, টুকটাক দোকানবাজার সেরে গেলাম তাঁর স্কুলে। আর এই স্কুলে আর পড়বে না তুত্তুরী, ভাবতেই ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে হৃদয়। এই তো সেদিন ছেড়ে গিয়েছিলাম আমার পুঁচকে দুধের বাচ্ছাটাকে, এই স্কুলের মস্ত গেটে। গিয়েছিলাম আর কোথায়, দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে ভিড়ের নজর এড়িয়ে অঝোরে কাঁদছিলাম আমি, ভাবছিলাম যা ন্যাদোশ, ভোম্বল বাচ্ছা আমার, নিজের ক্লাশরুমটা কি  খুঁজে পাবে? আর দরজার এপারে দাঁড়িয়ে আমার জন্য কেঁদে ভাসিয়েছিল তুত্তুরী। শেষ পর্যন্ত অবশ্য কি ভাবে যেন কার হাত ধরে নির্ধারিত ক্লাসে পৌঁছেও গিয়েছিল। ছুটির ঘন্টা পড়ার পর, প্রি নার্সারির ক্লাশে গিয়ে আর খুঁজে পাই না মেয়েকে, কোথায় গেল!তারপর দেখি, কাঁদতে কাঁদতে সামনের বেঞ্চে মাথা রেখে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছে মেয়েটা আমার। প্রথম দর্শনেই এত ভালোবেসে ফেলেছিল, ক্লাশ টিচার, যে বকা তো দূরস্থান, ঘুমটুকুও ভাঙ্গায়নি মেয়েটার। আট বছর সেই স্কুলে কাটিয়ে, প্রিয় মিস, প্রিয় স্যার, প্রিয়তম বন্ধুবান্ধবদের সবাইকে ছেড়ে আজ অন্য স্কুলে ভর্তি হবে আমার তুত্তুরী।


ডাক্তার বাবু বললেন, আরো দুই ইউনিট রক্ত লাগবে। বড় আশা নিয়ে এসেছিলাম আজ, ভেবেছিলাম হয়তো ছেড়ে দেবার কথা বলবেন ডাক্তার বাবু। তেমনিই আভাষ দিয়েছিলেন গতকাল শৌভিককে। তাই না আজ ও তমলুক গেছে আর আমি এসেছি হাসপাতাল। শাশুড়ি মায়ের হিমোগ্লোবিন নেমে গিয়েছিল তিনেরও নীচে। চার পাউচ রক্ত ইতিমধ্যেই দেওয়া হয়েছে তাঁকে, রক্ত দিতে গিয়েছিলাম আমরাও, আমার হিমোগ্লোবিন সাড়ে এগারোরও বেশি, তাও নেয়নি ব্লাড ব্যাঙ্কের দিদি। ১২বা সাড়ে ১২র নীচে হলে নেবে না। রক্তের রিকুইজিশন নিয়ে এবাড়ি সেবাড়ি দৌড়চ্ছি, ডোনার ছাড়া দিতে চাইছেন না ওণারা। রাগও করতে পারছি না,সত্যিই তো, ওণারাই বা পাবেন কোথা থেকে, টাকা দিয়ে তো আর রক্ত কেনা যায় না। তমলুক থেকে ফোন করে শৌভিক, আর একজন ডোনার মিলেছে। ওরই সহকর্মী। কিন্তু আজ তো আর আসতে পারবে না, কাল দুপুরের আগে সম্ভব নয়। তাই বলে, রাজি করিয়ে, বিল মিটিয়ে, দু পাউচ রক্ত নিয়ে দেখা করতে গেলাম শাশুড়ী মাতার সঙ্গে। 


অকাতরে ঘুমোচ্ছিলেন তিনি। নার্স দিদি ঠেলে তুলে দিলেন, ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। জানতে চাইলাম, আমায় চিনতে পারছ? বাধ্য বালিকার মত ঘাড় নাড়লেন তিনি, জিজ্ঞাসা করলাম,‘ আমি কে বলো তো?’ জবাব এল, ‘তুমি তো নার্স।’ পাশ থেকে আসল নার্স বলল, ‘অনেকটা রক্ত ঢুকেছে তো দিদি, একটু ভুল বকবেই। আমাদের যা বকাঝকা করছেন, বাপরে বাপ-। তবে বাড়ির লোককে খুব মিস করছেন। বার বার ওণার স্বামীকে খুঁজছেন।’ যাঁকে নিয়ে এত আলোচনা, তিনি শিশুর মত ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাচ্ছেন এদিক, ওদিক। বোধহয় খুঁজছেন শ্বশুরমশাইকেই। জানতে চাইলাম, ‘কেমন আছ? কি খেয়েছ? এবং তোমার বাড়ির লোক এসেছিল?’ সরল স্বরে সব প্রশ্নের উত্তর দিল, শুধু বাড়ির লোকের প্রসঙ্গে দরজার দিকে তাকিয়ে বলল,‘নাঃ কেউ আসেনি। আমি সকাল থেকে এদের বলছি, আমার বাড়িতে ফোন করো, এরা আমার একটা কথা শুনছে না।’ স্যানিটাইজ করা দু হাতে ওণার সূঁচ ফোটানো হাতটা ধরে বললাম,‘ কেন আমি তো এসেছি!’ দুষ্টু মেয়ের মত হেসে বললেন,‘ধ্যাৎ।’ তারপর ভালো করে তাকিয়ে আধ হাত জিভ কাটলেন। ‘হায় গো, অনিন্দিতা তোমায় চিনতে পারিনি।’


অনুমতি নিয়ে বৃদ্ধ-বৃদ্ধাকে সংযুক্ত করলাম ভিডিও কলে। কি ভাগ্যি আমার ব্যাগে সব সময় হেড ফোনটা থাকে। আট মিনিট পর নার্স দিদির তাড়ায় যখন কাটতে বাধ্য হলাম ফোনটা, শাশুড়ি মাতার দুগালে লেগেছে হাল্কা গোলাপী ছোঁয়া। হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে শ্বশুরমশাইকে বিশদ রিপোর্ট করে, বাপবেটিতে একসাথে এক কাপ চা খেয়ে, মেয়ে বগলে রওণা দিলাম তার বন্ধু সকাশে। কতদিন বাদে যে দেখা হল মেয়েগুলোর- কত যে বদলে গেছে মেয়েগুলো- হ্যাংলা মা দুটো শুধু হাঁ করে দেখেই গেল। আর ভেবেই গেল, এমনিই থাক তোরা, সরল, সাধাসিধে,নিষ্পাপ, বেশ খানিকটা ন্যাদোশ আর অনেক অনেকটা ভোম্বল। বাকিটা ঠিক হয়েই যাবে।

অনির ডাইরি ৮ই মার্চ,২০২২


#HappyWomensDay2022 #তাম্রলিপ্তকড়চা 

আজ যা হল, তা আমার এত বছরের সরকারী কর্মজীবনে কখনও হয়নি। বেলা তখন কত, একটা, খুব জোর দেড়টা হবে। কি যেন কাজ করছিলাম, কারা যেন দেখা করতে এসেছিল- হঠাৎ করে অতিরিক্ত জেলা শাসক ম্যাডামের ফোন,‘ আপনি কি অফিসে? সেমিনার হলে মিটিং চলছে, একবার আসতে পারবেন?’ খাতাপত্র গুছিয়ে, চোখে চশমা এঁটে রওণা দিলাম, যাবার আগে আমার টিমকে বলে গেলাম, দাঁড়াও আমার ভাগের বকাটা খেয়ে আসি,তারপর খুব বকব সবকটাকে। 


মস্ত সেমিনার হল, জমিয়ে চলছে মাসিক উন্নয়নের মিটিং। জেলার প্রতিটি প্রান্ত থেকে বিডিও সাহেবেরা এসেছেন, এসেছেন জেলার হোমরাচোমরা অফিসার কুল। উঁচু মঞ্চে বসে আছেন ডিএম সাহেব, পাশাপাশি এডিএম স্যার এবং ম্যাডামেরা, আছেন তিনজন মহকুমা শাসকও। অনুপস্থিত কেবল আমার ব্যক্তিগত মহকুমা শাসকটাই। সম্প্রতি ঘটে যাওয়া এক পারিবারিক বিপর্যয়ের জন্য আপাততঃ ভাগ করে অফিস করছি আমরা। আজ যেমন আমি তমলুক, আর শৌভিক মহানগর। 


দুয়ারে সরকারের ফলাফল নিয়ে গম্ভীর ভাবে কি যেন বলছেন ডিএম সাহেব। হোয়াটস্অ্যাপ গ্রুপে পোস্টানো আজকের মিটিং এর অর্ডারটা আবার ভালো করে পড়লাম, নাঃ লেবার তো নেই আজ। তাহলে? যাই হোক, কর্তার ইচ্ছেয় কর্ম, মুস্কিল হল আমার নিজের মহকুমার রিপোর্টটুকু আমার ঠোঁটস্থ, জেলার রিপোর্ট তো নয়। হে ঠাকুর দয়া করে পোর্টালটা খুলিয়ে দাও। 


কি ভাগ্যি আমার বড় সাহেবের আইডি পাসওয়ার্ডটা কি কারণে যেন দিয়েছিলেন স্যার কিছুদিন আগে, তাই দিয়ে ঢুকে ডাউনলোড করতে দিলাম রিপোর্ট। একটা নয় দু- দুই খান এক্সেল, তাও এই ঘোর কর্মব্যস্ত সময়ে। একি আর আজ নামবে? হে মা বর্গভীমা, হে বাবা ব্যবত্তার ভীম, হে মা নাচিন্দা নামিয়ে দাও মা। আরও কারো নাম কি দেখেছি কোন রিক্সা বা টোটোর গায়ে, মনে করতে পারলাম না। যাই হোক, এই সব দেবদেবীদের ত্র্যহস্পর্শে অবশেষে নামল রিপোর্ট। টুকেও নিলাম খাতায়। ভালো করে মুখস্থও করে নিলাম। ডিএম সাহেব প্রশ্ন করলেই এমন ধ্যাড়াই আমি। এত তোতলাতে থাকি,যে ওণার নির্ঘাত মনে হয়, ব্যাটা এক নম্বরের ফাঁকিবাজ। 


সব তথ্য জলের মত মুখস্থ করে, শতকরা কষে, গ্রাফ এঁকে যখন রেডি করেছি, একগাদা ফুল আর ব্যাগে করে কি সব যেন এসে ঢুকল মিটিং হলে। এই রে, কলকাতা থেকে নির্ঘাত কোন বড় সাহেব এসেছেন। রাজ্যের রিপোর্টটাও নির্ঘাত লাগবে। মেল খুলে তড়িঘড়ি সেটা খুঁজতেই যাচ্ছিলাম এমন সময় বোমা ফাটালেন ডিএম সাহেব, ‘আজ বিশ্ব নারী দিবস, আসুন আমরা সম্মান জানাই আমাদের লেডি অফিসারদের।’ সম্মানই বটে, ফুল-চকলেট তো ছিলই, তার সাথে ছিল, ‘মন কি বাত।’ ধুর আকাশবাণীর মন কি বাত নয়,আমাদের ঘরোয়া মনের কথা। 


ডিএম সাহেব শুনলেন প্রতিটি মহিলা অফিসারদের অনুভব এবং অভিজ্ঞতা। শুধু মেয়েরাই নয়, পুরুষ অফিসাররাও ভাগ করে নিলেন তাঁদের মনোভাব। কি ভাবেন তাঁরা নারী তথা নারী দিবস নিয়ে। ঘড়ির কাঁটা ঘুরছিল এক মহিলা অফিসার থেকে আরেক মহিলা অফিসার, জানতাম আমার পালা আসবেই, কি বলি! সবই তো বলে দিয়েছেন আমার পূর্বসুরীরা,  ছুঁয়ে গেছেন কন্যা ভ্রুণ হত্যা থেকে শিশু নির্যাতন, লিঙ্গ বৈষম্য থেকে যৌন হয়রানি হয়ে পণপ্রথা। আর বাকি রইল কি? 


সেটাই বললাম, আর বললাম যে অনেক শিক্ষা দিয়েছি আমরা আমাদের মেয়েদের, এবার একটু ছেলেগুলোকে মানুষ করার সময়। ছোট স্কার্ট পরাটা সমস্যা নয়, সমস্যা স্কার্টটাকে ছোট করে দেখাটা। আর এই শিক্ষা কে দিতে পারে বলুন তো, দিতে পারে কেবল একজন নারী। উঁহু যে সে নারী নয়, সেই নারী, যিনি শেখান শিশুকে তার প্রথম পাঠ, যাঁকে আমরা মা বলে এক ডাকে চিনি। মায়েরা যত শিক্ষিত হবে, ততো শিক্ষিত হবে আমাদের ছেলেরা।  মায়েরা যত সবলা হবে, ততো সবল হবে আমাদের সমাজ। তারপর আবার এমন ভাবে একদিন সমবেত হব আমরা, ‘লিঙ্গ নিরপেক্ষ দিবস’ পালনে। 


বাড়ি ফিরে আজকে পাওয়া সমস্ত উপহার তুলে দিলাম শ্রীমতী তুত্তুরীর হাতে। আর জনৈক রাজনৈতিক নেতার মন্তব্য কোট করে বললাম, ‘জগৎটা তোমাদের, জগৎটা আমাদেরও। কিন্তু তোমরা হলে সকাল বেলা আটটা নটার সূর্য।’ আমি যতই বলি, খবরদার লক্ষ্মী মেয়ে হোস না বাবু, লক্ষ্মী  বাঈরা কোনদিন লক্ষ্মী মেয়ে হয় না।

Monday, 28 February 2022

অনির ডাইরি ১৯শে ফেব্রুয়ারি, ২০২২

 



#তাম্রলিপ্তকড়চা 


ভীম দেখবেন নাকি দাদা দিদিরা? চলুন, চলুন আজ আপনাদের ভীম দেখিয়ে আনি। এই তমলুক শহরের সবথেকে বড় ভীম। ব্যবত্তার ভীম।  

যবে থেকে ই জেলায় বসতি স্থাপন করেছি, ব্যবত্তার ভীম বাবাজীর প্রশস্তি শুনে আসছি। কে না করেছে ব্যবত্তা নিবাসী মধ্যম পাণ্ডবের জয়গান, বাংলোতে ঘাস ছিঁড়তে আসা মাসির দল, বাংলোর সিকিউরিটির দায়িত্বে থাকা ছেলে দুটি, রান্নার দিদি এবং তার কন্যা, বাসন মাজার দিদি এবং তার ছানাপোনা, শৌভিকের ড্রাইভার, আমার ড্রাইভার সবার মুখে এক কথা, ‘ভীম তো ভীম, ব্যবত্তার ভীম।’ 


ভীম নয়তো রাজা বিশেষ। ভয়ানক জাগ্রত ব্যবত্তার ভীম সেন। মাঘী পূর্ণিমার আগে যে একাদশী, যার পোশাকী নাম ভীম একাদশী, সেই দিনই অভিষিক্ত হন ভীম সেন, আর সেইদিন কম করে হলেও লাখ পাঁচেক মানুষ সমবেত হন ভীম সেনের দরবারে। ভীম সেনের গলায় ঝোলে টাকার মালা আর থাকে বাতাসার মালা। যার এক একটি বাতাসা হাতের পাঞ্জা এমনকি বড় থালার মাপেরও  থাকে। সবই মানত পূরণের পরিণাম। যার যেমন সামর্থ মানত করে লোকজন। কেউ বাতাসা তো কেউ পুঁচকে ভীম। মাথার মুকুট, কানপাশা, রূপা/ সোনার চোখ এমনকি গদাও মানত করে মানুষ। সোনা-রূপা- কাঁসা-পিতলের গদা, যার যেমন সামর্থ। 


শৌভিকের ড্রাইভার তো প্রথম দিনেই আমাদের নিয়ে যেতে ব্যগ্র ছিল, ব্যগ্র ছিল তুত্তুরী আর তার মাসিও। লাখ পাঁচেক দর্শনার্থীর ভয়ে পিছ পা ছিলাম আমি খোদ। হাল ছাড়েনি পলাশ, প্রতিদিনই শৌভিককে নিয়ে আপিস যাবার সময় বলে যেত, ফিরে এসে আমাদের লিয়ে যাবে। এও বলে যেত, মন্দির অবধি গাড়ি যাবেনি। সরু রাস্তা। খানিকটা হাঁটতে হবে, নাহলে টোটো যায় অবশ্য। এক সপ্তাহের বেশীই থাকেন ব্যবত্তার ভীম, বসে জমজমাট মেলা, কিন্তু নানা কারণে যাওয়া আর  ওঠে না। 


ভেবেছিলাম এ যাত্রা বোধহয় আর হলনি। সেদিন ব্যবত্তাতেই গিয়েছিলাম দুয়ারে সরকারের ক্যাম্প দেখতে। ব্যবত্তা পুর্ব এবং ব্যবত্তা পশ্চিম হল নন্দকুমার ব্লকের দুটি পঞ্চায়েত। ভাগ্যক্রমে একই দিনে ক্যাম্প পড়েছে দুটি পঞ্চায়েতে। ব্যবত্তা পশ্চিমের ক্যাম্পেই প্রথম গেলাম। যাবার সময় সঙ্গে করে নিয়ে গেলাম সুপ্ত বাসনা, যদি দেখা হয় তাঁর সাথে। মুখ ফসকে বলে ফেলতেই আঁতকে উঠল  আমাদের উত্তমকুমার, ‘ঐ দেখেন ম্যাডাম, কি ভিড়।’ সত্যিই সারি বেঁধে এগিয়ে চলেছে বিভিন্ন বয়সী নারী পুরুষদের দল।  


তাহলে বোধহয় আর হল না। ক্যাম্প দর্শন সেরে আপিস ফিরতে যাচ্ছি, ইন্সপেক্টর সাহেব বললেন, ‘ব্যবত্তা পূর্বে যাবেন নি ম্যাডাম? ঐ তো রাস্তার ও পাড়ে।’ পাশ থেকে আমাদের এসএলও শিবু বলল,‘আর ভীম দেখবেননি ম্যাডাম? এত কাছে এলেন-।’ বললাম আমি তো যেতেই পারি রে বাপ, কিন্তু আমাদের উত্তমকুমার যা ভয় দেখাচ্ছে, আর সত্যিই রাস্তা বেশ সরু এবং বেশ ভিড়। শাহরুখ খানের ‘ম্যায় হুঁ না’ র ঢঙে শিবু আশ্বস্ত করল,‘ চলুন। চলুন আমিও যাচ্ছি। আমি গেলে সবাই রাস্তা ছেড়ে দেবে।’ 


শিবুর চাপাচাপিতে গাড়ির চাকা তো ঘুরল ব্যবত্তার ভীমের মন্দিরের পানে, তবে এগোল না বটে। যেমনি সরু রাস্তা, তেমনি দর্শনার্থীদের ভিড়। তার ওপর ভিড় দুয়ারে সরকার থেকে ফিরতি জনগণ। গাড়ির কাঁচ তোলা, বাইরে বেশ ঠান্ডা, তাও দরদর করে ঘামছে উত্তম। পাড়ার বউদি,মাসিমারা হাতপা নেড়ে আমাদের গুষ্টি উদ্ধার করছে, চুনোপুঁটি গুলো মহানন্দে বনেটে তবলা বাজাচ্ছে এবং শিবু গাড়ি থেকে নেমে চিল্লাচ্ছে। অন্তত মিনিট পনেরো এই নাটকের পর, বাহুবলীর শিব লিঙ্গ তোলার মত, রাস্তার ধারে দাঁড় করিয়ে রাখা গুটি কয়েক সাইকেলকে শিবু যখন তুলে পাশের ধানক্ষেতে নিক্ষেপ করল, পলকে একটু ফাঁকা হল বুঝি রাস্তা। 


তারপর! তারপর আর কি, আমরা ঝাঁ করে পৌঁছে গেলাম মেলার মাঠে। গাড়ি থেকে নামলাম, শিবুকে অনুসরণ করে মন্দিরে ঢুকলাম, আশ মিটিয়ে ভীমের ছবি তুললাম। শিবুর ‘হেড ম্যাডাম’ শুনে কতৃপক্ষ কয়েকজন বেশ খাতির করে সবকিছু দেখাল। গল্প শোনাল যে এ বছর কম করে লাখ তেরো টাকার মালা ঝুলেছে ভীমের গলে আর জমা পড়েছে শ পাঁচেক পুঁচকে ভীম। পুজো শেষ হলে, বিসর্জন যাবে এই পাঁচশত পুঁচকে ছোঁড়া ভীম। ধুয়ে ফেলা হবে বড় ভীমের গায়ের মাটিও। তবে কাঠামোটা থেকেই যাবে। শিবুর বড় দিদিমণির জন্য দুপ্যাকেট খাস পুজোর ফুল আর জাম্বো বাতাসার মালাও দিয়েছিল কতৃপক্ষ, যার একটি গোটা প্যাকেটই আমি ধরিয়ে এসেছি ইন্সপেক্টর সাহেবকে। আর বকেছি খুব। আজব ছেলে মাইরি তুমি, আমি না হয়  হাওড়ার মেয়ে, তুমি তো খাস এই জেলার ছেলে। এদ্দিনেও ভীম দেখোনি! ভাগ্যে আমি এলাম। শুধু কাজ করলে হবে?  


 দ্বিতীয় প্যাকেটটা উত্তম, আমি, বাংলোর সিকিউরিটি অমিত, এমনকি শ্রীমতী তুত্তুরীর সৌজন্যে বাংলোর পিঁপড়ে গুলো মিলে ভাগ করেও শেষ করতে পারিনি। কে যেন শিখিয়েছিল মা, নাকি ঠাকুমা, প্রসাদ যত ভাগ করে খাবে, ততো বাড়বে তার প্রসাদগুণ, শ্রীমতী তুত্তুরী তাকে আক্ষরিক অর্থেই গ্রহণ করেছে আর কি।

Tuesday, 22 February 2022

অনির ডাইরি ১৮ই ফেব্রুয়ারি, ২০২০ #তাম্রলিপ্তকড়চা

 



শুনলাম ছেলেটা কোল্ড ড্রিঙ্কস্ খেতে ভীষণ ভালোবাসে। ভালোবাসে চিকেন-মটন বা ভালো মাছের মুখরোচক পদ সমূহ। দুচক্ষে দেখতে পারে না কেবল দুধ আর ডাল-ভাত- নৈমিত্তিক তরিতরকারি। সকাল বিকেল ছেলেকে খাওয়াতে জিভ বেরিয়ে যায় মায়ের। মুখে ভাত নিয়ে চুপ করে বসে মোবাইল ঘাঁটে,মোবাইল কেড়ে নিলে তিড়িং বিড়িং করে নেচে বেড়ায়, মুখ ভর্তি মাখা ভাত নিয়ে। গলায় আটকে যাবার ভয়ে কাঁটা হয়ে থাকে মা-ঠাকুমা-দাদু। 

আমি অসময়ের অতিথি, এসেছিলাম দুয়ারে সরকারে, ছেলেটার বাবার নিমন্ত্রণে একটি বারের জন্য এসেছি তাঁকে দেখতে। যাঁর দর্শনের অভিলাষ এসে এসেছি, তিনি অবশ্যি আমায় পাত্তাই দিলেন না। জবরদস্তি তাঁকে আমার পাশে এনে বসানো হয়েছে বটে, তিনি মগ্ন মুঠো ফোনে। বাড়ির আদরের কচি, এই জেলা শিশুদের ঐ নামেই সম্বোধন করে। ছেলেটির নাকের ডগা দিয়ে আমার সামনে এক প্লেট মিষ্টি আর এক গ্লাস ঠাণ্ডা পানীয় রাখা হল। আমিও খাব না, ছেলেটির মা ঠাম্মাও ছাড়বে না। উভয় পক্ষের দর কষাকষির ফাঁকে তিনি দৌড়ে এলেন খপ করে আমার পানীয়ের গ্লাসে একটা আঙুল ডুবিয়ে সটান চুষে নিলেন আঙুলটা। পরের বার ডোবানোর তাল করেছিলেন বটে, কিন্তু তার আগেই খপ করে নড়া ধরে টেনে নিয়ে গেল মা। ঠাকুমা-দাদু-বাবা-কাকা লজ্জায় লাল। আর আমি তো হেসেই খুন। 


ওকে না দেওয়া হলে আমিও খাব না। আমার এবং কচির যুগপৎ জেদের কাছে পরাস্ত হয়ে একটা স্টিলের পুঁচকে গ্লাসে অল্প একটু কোল্ড ড্রিঙ্ক ঢেলে দেয় ওর মা। পিছনের জানলা দিয়ে কে যেন জানতে চায়, ‘গোলাপ গুলা কি তুমি ছিঁড়তেছ কচি?’ কচি ততোক্ষণে হারিয়ে গেছে মুঠো ফোনের দুনিয়ায়। স্নেহান্ধ ঠাকুমা বলল, ‘না না। ও ছিঁড়েনি।’ তুলনায় অনেক বাস্তববাদী মা, জানাল পুঁচকেটা ঐ দিকে ঘুরঘুর করছিল বটে, ছিঁড়েছে কি না সে জানে না। তাকিয়ে দেখলাম অপূর্ব সুন্দর সুন্দর গোলাপ ফুটে আছে।  দেখে আমারই লোভ লাগল আর ও তো বাস্তবিকই কচি।  


যাদের গোলাপ ছিঁড়েছে, তারা দেখলাম খুব একটা কিছু বলল না, বার দুয়েক মজা করে শূন্যে ঘুঁষি দেখিয়েই ক্ষান্ত দিল। যাকে দেখাল সে গ্রাহ্যই করল না, করলে বিপদ ছিল। ছেলেটির বাবা হেসে কইল,‘ওনারা সব আমাদেরই জ্ঞাতি ম্যাডাম। আমার দাদুরা চার/পাঁচ ভাই। সবাই ওকে(কচিকে) খুব ভালোবাসে। ওকে আমরা বকলে/মারার ভয় দেখালে ওণারা এসে ঝগড়া করেননি। ছেলেটা যখন হাসপাতালে ছিল, ওদের সবার নাওয়া-খাওয়া বন্ধ হয়ে গেছিল।’


আঁতকে উঠলাম, এইটুকু ছেলে হাসপাতালে কেন ভর্তি হয়েছিল? ছেলেটির বাবা বলল, ‘আর বলবেননি ম্যাডাম, একবার তো আমাদের চোখের সামনেই ধপাস করে পড়ে গেল। আমরা খেতে বসিছি, ওর খাওয়া হয়ে গেছে ও নেচে বেড়াইছে। ঠাকুরের সামনে জলছড়া দিয়েছিল মা,তাইতে পা হড়কে এমন পড়ল-। তখুনি কিছু বোঝা গেলনি, আমরা তো তাড়াতাড়ি মাথায় বরফ-টরফ দিলাম। তখন কিছু বোঝা গেলনি বটে, রাতে দেখি মাথা ফুলে ঢোল। আর ছেলেও কেমন ঝিমিয়ে পড়তেছে। কোন মতে রাতটা কাটিয়েই ছেলেকে নিয়ে দৌড়লাম তমলুক সদর হাসপাতালে। যে ডাক্তার পাব, তাকেই দেখাব। তো যে ডাক্তার পেলাম, তিনি বললেন বাবুর মাথার পিছনে রক্ত বেরিয়ে জমে গেছে। অপারেশন করে সিরিন(সিরিঞ্জ)ফুটিয়ে বার করতে হবে। বারো হাজার টাকায় রফাও হল আমার সাথে। তারপর আমার কি মনে হল, আমি ছেলেকে লিয়ে পাল্যে আসলাম। এইটুকুন ছেলের মাথায় অপারেশন করবে কি বলুন ম্যাডাম।’ 


কি বলি আমি,শুনেই তো হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। তবে সে যাত্রা জনৈক অন্য ডাক্তারবাবুর ওষুধে বিনা অপারেশনেই সুস্থ হয়ে ফেরে কচি এবং তার মা-ঠাকুমার বয়ানানুসারে দৌরাত্ম্যও বেড়ে যায় কয়েকগুণ। ছেলেটির বাবা বলে,‘ওর থিকেও সাংঘাতিক কি হয়ছিল জানেন নি ম্যাডাম?বাড়িতে কি যেন একটা কাজ চলতেছিল, সবাই তাতেই ব্যস্ত। সেই ফাঁকে ও করছে কি, বড় লোহার মুড়ির টিনের মধ্যে মাথা খানা গলাই দিছে।’ আঁতকে উঠি আমি। বাবা গো, কি ডানপিটে হোঁদল-কুৎকুতে ছেলে বাপু তুই কচি। 


ওর বাবা বলে,‘শুনেননি ম্যাডাম, মাথাটা বার করতে গিয়ে তলার ঠোঁটের ভিতর দিকটা কেটে গেল ছেলেটার। সে কি রক্ত!বন্ধই হয় না। আমি ছেলে কোলে দৌড়লাম তমলুক হাসপাতাল। ডাক্তারবাবু দেখে ভিতরে তিনটে সিলাই করদিলেন। ছেলে সমেত বউকে আমি ওদের মামার ঘরে রেখে এলাম। বাড়িতে থাকলে তো বউকে সংসারের কাজও করতে হয় টুকটাক, তাই আর কি। বাকি দিনটা ঠিকই কাটল, রাত আড়াইটে নাগাদ বউয়ের ফোন,বাবু ঘুমোচ্ছে আর রক্তে ভেসে যাচ্ছে ওর বালিশ।’


‘ সে যে কি রাত কেটেছে ম্যাডাম আপনি জানেননি। আমি বউকে বললাম,রাতটা যাহোক করে কাটাও কাল সকাল হলেই যাচ্ছি। ভোর পাঁচটার সময় বেরোলাম, সাড়ে ছটার মধ্যে ছেলেকে নেয়ে হাসপাতাল। আমাদের বাইরে বসিয়ে রেখে ছেলেকে ওটিতে ঢুকাল। ভিতর থেকে তারস্বরে কাঁদছে বাবু আর বাইরে আমরা দুজন।’ শুনতে শুনতে কখন ভিজে গেছে আমার দুচোখ। 


‘পঁয়তাল্লিশ মিনিট পর, পুরাণো সেলাই কেটে নতুন করে সেলাই করে ছাড়ল বাবুকে ম্যাডাম। সে রক্ত আর বন্ধ হয় না। পাগলের মত ছেলেকে নিয়ে ছুটিছি আমরা এ ডাক্তার থিকে সে ডাক্তার।’ শুনতে শুনতে কেমন যেন সন্দেহ হল, এ ব্যধি আমার চেনা। জানতে চাইলাম বাচ্ছাটার কি রক্তের কোন বিশেষ বৈশিষ্ট্য  আছে? জবাব এল, জবাব প্রত্যাশিত, হিমোফিলিয়ায় আক্রান্ত শিশুটি। রক্তের এক বিশেষ ধরণের ব্যধি,যেখানে জমাট বাঁধতে চায় না রক্ত। জানতে চাইলাম এমন জটিল জেনেটিক ব্যধি শিশুটি পেল কি করে, জবাব পেলাম নীলরতন সরকার মেডিকেল  কলেজের বোর্ড কিসব বিশদ পরীক্ষা নিরীক্ষার পর জানিয়েছে যে শিশুটির মাতৃকুলে কারো ছিল এই অসুখটি। পরবর্তী বেশ কয়েকটি প্রজন্মকে ছেড়ে কচির ঘাড়ে চেপেছেন তিনি। 


হিমোফিলিয়া এমনিতে তেমন ঘাতক নয়, শুধু রক্তক্ষরণ যত দূর সম্ভব এড়িয়ে গেলেই মঙ্গল। আজকাল চিকিৎসা ব্যবস্থাও অনেক উন্নত হয়ে গেছে, আমাদের শৈশবে দেখা একমাত্র হিমোফিলিয়া আক্রান্ত পাড়া তুতো দাদুটি তো আশি পার করেছিলেন হাসতে হাসতে। শুধু যখনই রাস্তায় বেরোতেন দেখতাম আপাদমস্তক ঢেকে বেরোতেন। ঘোর গ্রীষ্মেও পায়ে থাকত মোজা। যাতে কোন পেরেক না ফুটে যায়। সেই কথাটাই বললাম শিশুটির পিতামাতাকে। চার বছরের কচির জনকজননী তাতে কতটা আশ্বস্ত হল জানি না। শুধু বলল,‘ তাই আশির্বাদ করেননি ম্যাডাম।’ প্রাণ ভরে আশির্বাদ করে এলাম শ্রীমান কচিকে, খুব ভালো থাক, চুটিয়ে দস্যিবৃত্তি কর, শুধু একটু সাবধানে থাকিস বাবা।

অনির ডাইরি ১৭ই ফেব্রুয়ারি, ২০২২ #তাম্রলিপ্তকড়চা

 



একটা গরম সিঙারা, একটা নিমকি, একটা মোতিচুরের লাড্ডু, দুটো সন্দেশ আর এক বড় কাঁচের গ্লাস ভর্তি মাজা। আমাকে নাকি খেতেই হবে। ঘড়ি বলছে সাড়ে বারোটা, বাইরে রূপোর থালার মত চকচকে চোখ ধাঁধানো রোদ। বাড়ির ভেতরটা অবশ্যি খুব ঠাণ্ডা। আজ দুয়ারে সরকারের দ্বিতীয় দিন।কোলাঘাট হয়ে এসেছিলাম শহীদ মাতঙ্গিণী ব্লকে।প্রতিদিন প্রতিটা ব্লকে দুটো করে ক্যাম্প হচ্ছে, বিভিন্ন পঞ্চায়েতে। মাতঙ্গিণী ব্লকের দ্বিতীয় ক্যাম্পটা যে স্কুলে পড়েছে, আমাদের উত্তম কুমার নাকি ঐ স্কুলেরই ছাত্র।

স্কুল থেকে বেরোতেই উত্তম ঘোষণা করল, ‘বাড়ি চলুন ম্যাডাম।’ এই ঘোরতর মধ্যাহ্নে কোন গেরস্তর বাড়ি গিয়ে তাঁদের বিব্রত করতে আমি মোটেই ইচ্ছুক নই, কিন্তু গাড়ির স্টিয়ারিং কি আর আমার হাতে। গ্রামের মধ্যে খালের ধারে, গাড়ি দাঁড়াল। বাকি পথটুকু পদব্রজে যেতে হবে বলে সংকুচিত বোধ করছিল উত্তম, বাকি পথ বলতে একটা না দুটো বাড়ি। সব বাড়ির সামনে ছোটখাট সব্জি বাগান, ধরে আছে থোকা থোকা কাঁচা টমেটো। ফুলের গাছও প্রচুর। হরেক রকম গোলাপ গাছের টবে শোভা পাচ্ছে এত্ত বড় বড় হরেক রঙের গোলাপ।

দরজার কড়া নাড়তেই শোনা গেল কচি গলার প্রবল উত্তেজিত কণ্ঠস্বর। ‘বাবা এসেছে, বাবা এসেছে।’ অচীরেই বুঝলাম, বাবার থেকেও বড় কথা, ‘ফোন এসেছে। ফোন এসেছে।’ বক্তার বয়স মাত্র চার, প্রায়শই তাঁর গপ্প শোনায় তার বাবা। বলে,‘উরি বাপরে ম্যাডাম, কি দুষ্টু, কি দুষ্টু। কারো বাড়িতে লিয়ে যাই না আমরা ওকে, বাচ্ছা মানুষ, কি টানবে, কি ফেলবে। দরকার নেই বাপ, বড় হোক আগে।’ আমি এও জানি, এহেন দস্যু রত্নাকর জব্দ শুধু ফোনের কাছে। ফোন দিয়ে দিলেই, পশ্চিম সীমান্তে নেমে আসে অখণ্ড শান্তি। প্রত্যক্ষ করলামও তাই। অসময়ে বাবা বাড়ি ফেরার প্রাথমিক উত্তেজনা টুকু কাটতেই তিনি একটা চেয়ার দখল করে বসে গেছেন ফোন ঘাঁটতে। 

উত্তমের মা এত আনন্দিত আমাকে পেয়ে, যে কিছুতেই জুতো খুলতে দেবেন না। ওণাদের নিকানো চকচকে লাল সিমেন্টের দালানে জুতো পরেই ঢুকতে হল আমায়। খোলার চেষ্টা করেছিলাম ধর্মাবতার কিন্তু পর্যায়ক্রমে উত্তমকুমার এবং তাঁর পিতামাতার যুগপৎ তথা সম্মিলিত আপত্তিতে আবার বকলেস লাগিয়ে নিলাম।

উত্তমের মুখে শুনেছিলাম, ওদের একফালি জমিতে সম্বৎসরের ধান চাষ করেন ওর বাবা। আর সেই ধান সিদ্ধ করা থেকে বাকি সব কাজ করেন ওর মা আর বউ। বউটি বাচ্ছা মেয়ে, তার ওপর চার বছরের দুর্ধর্ষ ছানার জননী, সে যতটা পারে শাশুড়ীর সঙ্গে হাত লাগায়, তবে মূল কাজটা ওর মা’ই করেন। সে কথা বলেই প্রমাদ গুনলাম, উত্তমের মা আমাকে পাকড়াও করে নিয়ে গেল দোতলায়। এবারেও প্রবল আপত্তি ছিল জুতো খোলায়, আমি আর গ্রাহ্য করতে পারিনি।

লাল চকচকে সিমেন্টের সিঁড়ি, সিঁড়ি দিয়ে উঠে দোতলায় লাল সিমেন্টের দালান। উত্তমের মা আমাকে জবরদস্তি প্রতিটা ঘরে নিয়ে গিয়ে দেখাল, কোন ঘরে সপরিবারে উত্তম থাকে, কোন ঘরটা ওর ভাইয়ের। উনি বললেন,‘বড় কচি আর ছোট কচি।’এই জেলায় শিশুদের কচি বলে সম্বোধন করা হয়। তুত্তুরীকে যেমন বাংলোয় কাজে আসা মাসিরা কচি বলে ডাকে। ঘরদোর অগোছাল বলে বারংবার দুঃখ করছিলেন ভদ্রমহিলা, আশ্বস্ত করলাম,এ আমার কাছে নতুন কিছু নয়। আমি স্বয়ং চূড়ান্ত অগোছাল এবং অলবড্ডে প্রকৃতির। তুত্তুরী তো আরেক কাটি সরেস।

ঝাড়াই ধানের বস্তার পাহাড় দেখলাম। উত্তম এবং তার জননী জানালো এটা অর্ধেক কেবল। বাকি ইতিমধ্যেই উদরস্থ হয়েছে। উত্তমের মা খুশি হয়ে বললেন,‘দাঁড়াও এবার ধান উঠুক, আপনাকে পাঠায়ে দিব।’ নীচের বাগানে চটের বস্তায় ধান শুকাচ্ছে, দেখতে নিয়ে গিয়ে জানালেন, ‘এই গুলা দিয়ে মুড়ি ভাজা হবে। তাই সিদ্ধ করে নুনাইছে।’ নুনাইছে মানে বুঝতে না পেরে জানতে চাইলাম। আমার ধারণা ছিল ভাতের আর মুড়ির চাল আলাদা গোত্রের হয়, উত্তমের মা আর বউ তো হেসেই খুন। বউটি বুঝিয়ে দিল, একই চাল দিয়ে সব হয়, তবে সিদ্ধ করার ধরণ আলাদা হয়। আর নুনাইছে মানে নুন মাখানো হয়েছে। নুন মাখিয়ে রোদে শুকানোকেই নুনাইছে বলে।

অতঃপর উত্তমের মায়ের সঙ্গে ওদের ঠাকুর ঘর দেখে, বললাম এবার উঠি। বলার সাথে সাথেই সমানে এনে রাখা হল, এত্ত কিছু। খেতেই হবে, না খেলে গেরস্থের অকল্যাণ হবে। সবই তো বুঝলাম, কিন্তু আমিও তো সাড়ে দশটায় ভাত খেয়েই বেরিয়েছি দিদি। সে কথা কে শোনে। ভদ্রমহিলা এবং তাঁর লক্ষ্মীমন্ত পুত্রবধূ একসাথে বললেন,‘আমরা মানুষ খুব ভালোবাসি, যখন ইচ্ছে আসবেন। ঘরের চালের ভাত আর ভাজা মুড়ি সবসময় পাবেন।’ এগুলো না বললেও বুঝতেই পারছিলাম এণারা কতটা অতিথি বৎসল। তবুও এত খাবার উদরস্থ করা অসম্ভব। মার্জনা চেয়ে শুধু সিঙারাটা তুলে নিলাম। হাঁ হাঁ করে উঠল উত্তমের মা,‘লাড্ডুটা আমার গোপালের প্রসাদ। ওটা খেতেই হবে। নাহলে খুব বকব। আর শোনো এই সন্দেশ দুটোও তুমি খুব খেতে পারবে, দেখো না। আর ঐ নিমকিটাও-’। 

হাসব না কাঁদব বুঝলাম না। পলকের আলাপে আমায় এত ভালোবেসে ফেলেছেন যে প্রথম আলাপের ‘ম্যাডাম আপনি’র সম্ভ্রম কখন যেন বাতাসে মিশে গেছে। এত ভালোবাসায় আমি আপ্লুত, কিন্তু তাহলেও এত খেতে পারব না দিদি। অনেক অনুনয় বিনয় করে ছুটি তো পেলাম, কথা দিয়ে আসতে হল, অচীরেই আবার যেতে হবে এবং এবার ভাত খেতেই হবে। ভাত না খাওয়ালে কি আর অতিথিকে যথোচিত আপ্যায়ন করা হয়? কারা যেন বলে, এপার বাংলার মানুষ অতিথি আপ্যায়ন জানে না, প্লিজ একবার মেদিনীপুরে আসুন দিকি।

পুনশ্চঃ-ছবিতে উত্তমকুমারদের গাঁয়ের ভীম। উত্তম বলে ভীষণ জাগ্রত। ভীম একাদশীর দিন থেকে নাকি দিন সাতেক এর মেলাও বসে ।

Saturday, 19 February 2022

অনির ডাইরি ১৬ই ফেব্রুয়ারি, ২০২২ #তাম্রলিপ্তকড়চা

 



দুয়ারে সরকারে আমি আর কি করি। কিছুই করি না, শুধু পটের বিবির মত সেজেগুজে যাই, ক্যাম্পের দরজার বাইরে থেকে বরকর্তার মত অভ্যর্থনা করে নিয়ে যায় আমার ইন্সপেক্টর/ সিকেসিও বা ক্ষেত্র বিশেষে এসএলও। জনসমুদ্রের মাঝখান দিয়ে ভাসতে ভাসতে আমাদের দপ্তরের টেবিলে গিয়ে পৌঁছাই, দেখামাত্র কাজ ফেলে উঠে দাঁড়ায় বাকিরা। আমিও হেব্বি মাতব্বরী করে জিজ্ঞাসা করি, কটা ডিএস পড়ল? আর কটা পড়তে পারে ইত্যাদি। ইন্সপেক্টর সাহেব কাচুমাচু মুখে বলে, ‘আরও পড়ত, দুয়ারে সরকারটা যদি জানুয়ারীতেই হত। পিছিয়ে গিয়েই মুস্কিল হয়েছে। এরা আগে ভাগেই সব পাশবই রিনিউ করিয়ে বসে আছে।’ 


অতঃপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে, ছবি তুলে, দুটো শুভেচ্ছা বার্তা দিয়ে আমি বেরিয়ে পড়ি পরের গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। গ্রামের ছোট্ট নিম্নবুনিয়াদী বিদ্যালয়ে সেন্টারে পড়েছে, আসতে জিভ বেরিয়ে গেছে আমাদের। সরু ঢালাই রাস্তা দিয়ে কোনমতে গাড়ি নিয়ে এসেছে আমাদের উত্তমকুমার। এসে থেকে জনে জনে শুধিয়ে বেড়াচ্ছে, বের হবার অন্য কোন রাস্তা আছে কি না, ঐ রাস্তায় আবার গাড়ি ঢোকাতে হলেই চিত্তির। 


ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে দেখি, গাছের ছায়ায় ঝিমোচ্ছে আমাদের নিঃসঙ্গ গাড়িটা, উত্তমকুমার বেপাত্তা। আমার কোন হেলদোল নেই, ইন্সপেক্টর সাহেব ক্রমেই হয়ে উঠছে অধৈর্য। আমাকে বিদায় করার কি উদগ্র বাসনা মাইরি। তিনবার ফোন করে ফেলল, এর মধ্যে। একটি বারও বাজল না ফোনটা। বাজবে কি করে, প্রথমতঃ উত্তমকুমার তাঁর মহার্ঘ ফোনটি গাড়িতে রেখেই বেরিয়েছেন আর দ্বিতীয়তঃ এই প্রত্যন্ত অঞ্চলে কারো ফোনে কোন টাওয়ার নেই। মাঝে মাঝে চপলার মত ঝিলিক মারছে দুটি টাওয়ারের দাঁড়ি। তাতে ফোন যায়ও না আর আসেও না।


গাড়ির দরজা খোলাই ছিল, উঠে বার কয়েক হর্ন বাজাতে না বাজাতেই উদয় হলেন উত্তমকুমার। জানতাম, গাড়ি খোলা রেখে গেছে তো হর্নের আওয়াজে ছুটে আসবেই। আসতে না আসতেই চড়াও হল ইন্সপেক্টর সাহেব, ‘ম্যাডমকে একা ফেলে কোথায় গিয়েছিলে?’ রাস্তা দেখতে গিয়েছিল উত্তম। কোন দিশা পায়নি, আবার সেই সরু ঢালাই রাস্তা, আবার সেই নড়বড়ে সেতু-। এবারের গন্তব্য রাণীহাটি প্রাইমারি স্কুল। বললাম, ওখানকার ইন্সপেক্টরকে একবার ফোন করি, উত্তমকুমার শুনলে তো। ‘আপনি বসুন না, আমি ঠিক চলে যাব।’


 হাইরোডে এসে উঠলাম আমরা, আবার বললাম, একবার ফোন করি রে বাপ। নাঃ উত্তমকুমার সব চেনে। যখন বলবে  তখন ফোন করতে হবে। যদি বলে, তবেই গুগল ম্যাপ অন করতে হবে লতুবা নয়। ফাঁকা হাইওয়ে, দুদিকে ঘন সবুজ ধান জমি, দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়। ‘ঐ ধান ক্ষেতে আপনি যেতে পারবেননি ম্যাডাম,’ বলল উত্তম। কচি ধানগাছের পাতা নাকি ব্লেড-ছুরির মত ধারালো হয়। উত্তমদের আছে একফালি জমি, সেখানে ওর বাবা ধান বোয়। ‘বাবাই সব করে ম্যাডাম, আমরা ঐ ধান মাড়াইতে যাই। গেলে কি ব্যথা হয় ম্যাডাম গায়ে, জানেন নি। ইদিকে আর ধান জমি পাবেননি, জমি থাকলেই সব ঝিল হয়ে যায়। আমাদেরও কত বলেতেছে লোকে,টাকা লিয়ে এইছে। বাবা রাজি হয়নি। একটা জল জমি আছে, মানে নীচু জমি বুজলেননি, ঐ তে বছরের ধানটা হয়ে যায় ম্যাডাম। সারা বচ্ছর আমাদের ভাত আর মুড়ির ব্যবস্থা টুকুন হই যায়।’ 


ধান চাষ সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করতে করতে যেখানে এসে থামলাম জনমানবশূন্য। ‘এবার ইন্সপেক্টর সাহেবকে ফোন করুন’-হুকুম করে উত্তম। করে কি বলব?তেপান্তরের মাঠে এনে ছেড়ে দিয়েছে উত্তমকুমার, তুমি এসে উদ্ধার করো? কোথায় আছি জিজ্ঞাসা করলে কি বলব রে বাপ? যাই হোক তাও করলাম, ইন্সপেক্টর সাহেবও তেমনি, বলল,‘এগিয়ে আসুন।’ কোনদিকে এগোব, সামনে না পিছনে? এতো দিকশূণ্যপুর। বিস্তারিত কথাবার্তা এবং অতিকষ্টে হদিস পাওয়া এক সাইকেল আরোহীকে পাকড়াও করে আমরা বুঝলাম আমরা সম্পূর্ণ  উল্টোদিকে এগোচ্ছিলাম। আমাদের যেতে হবে প্রতাপপুরের মোড়। তা আরো কিলোমিটার পাঁচ দশেক তো হবেই। 


গাড়ি ঘুরিয়ে পুনরায় আমরা ফিরে গেলাম ধান চাষের বিশদ ব্যাখ্যায়। চাষ শেষে ধান যখন বস্তায় উঠছে, গাড়ি এসে প্রতাপপুরের মোড়ে এসে দাঁড়াল।  উত্তম বলল,‘ভীম দেখবেননি ম্যাডাম?’ ভীম অর্থাৎ মধ্যম পাণ্ডব হলেন এই জেলার অন্যতম আরাধ্য দেবতা। ভীম একাদশীর দিন শুধু যে বড় করে ভীম পুজো হয় তাই নয়, মেলাও বসে বিভিন্ন এলাকায়। আত্মীয় কুটুম্বরাও আসে। উত্তমকুমারদের বাড়িতেই নাকি গিজগিজ করছে কুটুম্বদের দল। 


প্রসাদগুণ অনুসারে সবথেকে জাগ্রত হল নন্দকুমার ব্লকের অন্তর্গত ব্যবত্তার ভীম,তারপর আসে তমলুক ব্লকের নিমতৌড়ির ভীম,শহীদ মাতঙ্গিনী ব্লকে উত্তমদের গ্রামের ভীম ইত্যাদি। ইনি অবশ্য অমন জমকালো বা কুলীন ভীম নন। এণাকে কেন্দ্র করে বসেনি কোন মেলা, তবুও ভীম তো রে বাবা। আমার দেখা প্রথম ভীম। হোক না বাজারের ভিতর একচালা পাকা মণ্ডপে দাঁড়িয়ে থাকা নিঃসঙ্গ ভীম। ভদ্রলোককে কিন্তু হেব্বি মিষ্টি দেখতে যাই বলেন। আমার দেখা প্রথম ভীম বলে কথা-

অনির ডাইরি ১৫ই ফেব্রুয়ারি, ২০২২ #তাম্রলিপ্তকড়চা

 


সকালের চায়ের কাপ হাতে আলোচনা করছিলাম দোঁহে, কে কবে কোথায় যাব। দুজনে এক সঙ্গে একই ক্যাম্পে না গিয়ে পৌঁছাই, সে বড় লজ্জার ব্যাপার হবে বটেক। ‘দুয়ারে সরকার আবার হবে নাকি?’ একরাশ বিস্ময় নিয়ে জানতে চায় তুত্তুরী। যুগলে ঘাড় নাড়ি, হবে মানে, আজ থেকে তো শুরু। অতঃপর অনুযোগের সুরে, ‘তুমি তো আমায় জানাওনি মা?’ এবার বিস্মিত হবার পালা আমার। খামোখা তোকে জানাব কেন রে বাপ, এতো নৈমিত্তিক অফিসের কাজ। কটা দিন একটু দৌড়ঝাঁপ বেশী হবে এই যা। ‘আমার বাবা-মা যে আগামী কটা দিন আমাকে মোটেই পাত্তা দেবে না, এটা আমায় জানতে হবে তো-’। ক্ষুব্ধ স্বরে জানায় কন্যা। কত কিছুর জন্যই যে মায়েরা অপরাধী হয়। 


বেলা এগারোটা নাগাদ বেরোলাম। ঠিক করেছিলাম আজ পাঁশকুড়া ব্লক, পাঁশকুড়া পৌরসভা আর শহীদ মাতঙ্গিণী ব্লকে যাব। আপিস গ্রুপে ফুটে ওঠা প্রথম ছবিটা এল তমলুক ব্লক থেকে। অন্ধকার এবং বেশ ঝাপসা ছবি। এরা ভয়ানক বাধ্য এবং কর্মঠ। শেখার ইচ্ছেও প্রবল কিন্তু ছবি তুলতে একদম পারে না। চায়ও না হয়তো। টিম চুঁচুড়ার দুয়ারে সরকারের ছবি ভিডিও গুলো ফেসবুক হোটাস্অ্যাপ থেকে নামিয়ে এদের দেখিয়েছি, কেমন তুলতে হয় ছবি, কেমন করে করতে হয় এডিট তাও শেখে না ব্যাটারা। এদের সেলফি তোলারও ইচ্ছে নেই, মাঝে মাঝে সত্যিই দুঃখ হয়, এ আমি কোথায় এলাম। 


যাই হোক, যত কালোই ছবি হোক, তিন সেট ফিল্টার মারলে একটু ধলা হয়েই যাবে। তবে ফার্স্ট বয় তো বটে। গোটা তাম্রলিপ্ত টিমের মধ্যে সর্বপ্রথম এরাই কাউন্টার খুলে বসেছে এবং ছবি পাঠিয়েছে। পাঁশকুড়া যাবার পথেই পড়বে বোধহয় জায়গাটা, ঠিক করলাম ওদের ওখান থেকে ঘুরেই যাই নাহয়।  ইন্সপেক্টরকে ফোনে বললাম, ‘তুমি ফার্স্ট বয় কিনা, তাই তোমার ক্যাম্পেই সবার আগে যাব।’ খুশি হল কিনা বুঝতে পারলাম না, উল্টে জানতে চাইল, ‘আমি ফার্স্ট হলাম কি করে-’। 


অত কথা বলতে পারব না বাপ, বল যাব কি করে? আমতা আমতা করে ফোনটা ধরিয়ে দিল স্থানীয় এসএলওকে। সত্যিই ইন্সপেক্টরের পক্ষে প্রত্যন্ত গ্রামের স্কুলের লোকেশন বলে বোঝানো সম্ভব নয়। স্থানীয় ভদ্রলোক অবশ্য ভালোই বোঝালেন, আর গুগলও দেখলাম চেনে জায়গাটাকে। আমাদের উত্তম কুমারকে বললাম, ‘বুঝেছ তো। তাহলে তুমি চালাও আমি একটু বাড়িতে ফোন করেনি।’ হাইরোড দিয়ে হুহু করে দৌড়চ্ছে গাড়ি, পাল্লা দিয়ে ঝগড়া করছে বাবা। যত বলি, কটা দিন আমাদের কাছে এসে থাকতে, পৈতৃক ভিটে ছেড়ে, কিছুতেই আমার কাছে আসবে না বৃদ্ধ। কি জেদ বাপরে। তেমনি গলার জোর। ঘুরিয়ে আমি একটু গলার জোর দেখালেই শুরু করে দেয় সেন্টু দেওয়া। সঙ্গতে থাকেন আমার গর্ভধারিণী। ‘লোকটা তোকে এত ভালোবাসে আর তুই কিনা তাকেই মেজাজ দেখাচ্ছিস, ইত্যাদি প্রভৃতি।’ যেন আমি তো লোকটাকে ভালোই বাসি না। 


যে যা পারে করুক, বিরক্ত হয়ে ফোনটা কেটে দেখি গুগলের দেখানো রাস্তা ছেড়ে আমরা অন্য বাঁকে ঢুকে বসে আছি। আমাদের উত্তম কুমারকে নাকি স্থানীয় এসএলও এই রাস্তাই বলেছে। গুগল ঠিক নয়,এসএলওই ঠিক। তাই সই। কিন্তু সে কি রাস্তা রে ভাই, বড় জোর টোটো গলতে পারে, গাড়ির পক্ষে বড়ই সংকীর্ণ। গোটা রাস্তা আমার মুণ্ডপাত করতে করতে গেল উত্তম,‘এত ভেতরে আর কোন ক্যাম্পে যাবেননি ম্যাডাম। অমুক স্যার তো গেতেননি। তমুক স্যার তো গেতেননি।’ অপরাধীর মত মুখ করে বসে আছি আমি, আর উত্তম কুমার বকেই চলেছে,‘এখানকার মানুষ গুলোকে দেখুন, রাস্তার উপ্রে বাড়ি বানিয়েছে, বাড়ির সামনে গজাল পুঁতছে, যাতে গাড়ির চাকা ওর আঙনায় না উঠে পড়ে। দেখছেননি ম্যাডাম। অয় দেখুন বাড়ির সামনে কেমনি কাঠের ঢাঁই রেখেছে, অয় দেখুন ইঁটের পাঁজা রেখেছে গাড়িটা আমি চাপব কেমনে বলুন। এখন উল্টো দিক থিকে কোন গাড়ি না আসলেই বাঁচি। ’ 


যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই সন্ধ্যা হয়, বাঁক নিলাম আর সামনে দাঁড়িয়ে একখান টোটো। টোটো ভর্তি গ্যাস সিলিণ্ডার। এই যাঃ এবার কি হবে? হর্ন বাজিয়েই যায়, বাজিয়েই যায় উত্তম। টোটোওয়ালা বেপাত্তা। গাড়িকে ঘিরে ভিড় জমায় আসেপাশের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসা গুড়গুড়েদের দল। রগড় আরো কত জমত কে জানে, এমন সময় দৌড়ে এল বর্ষীয়ান  টোটোওয়ালা এবং অসীম দক্ষতার সঙ্গে টোটোটাকে একটা বাড়ির একফালি উঠোনে ঢুকিয়ে দিল। টোটোকে টাটা করে একটু এগিয়েছি হঠাৎ করে সামনে এসে দাঁড়ালেন ইনি, উত্তম আর আমি যুগপৎ হাঁ হয়ে গেলাম,এমন অজ গাঁয়ে, এমন ঘিঞ্জি পরিবেশে এত ভালো, এমন সুউচ্চ মন্দির টো বানাইল কে? যানজট খানিক হল বটে, উত্তম কুমার আরেক চোট গজগজও করল, তাও নেমেই পড়লাম, এমন মন্দিরের একটা ছবি না তুললে হয়?