‘এই মা, একটা বিরাট গড়বড় হয়ে গেছে!' তাম্রলিপ্ত নগরী ছেড়ে চলেছি মহানগরের উদ্দেশ্যে,কিছুক্ষণ আগে সদ্য টপকেছি রূপনারায়ণ নদ তথা কোলাঘাট ব্রীজ, এমন সময় তুত্তুরীর আর্ত চিৎকার। ঘচাং করে ব্রেক কষল আমাদের উত্তমকুমার, সামনের সিট থেকে হায় হায় করে উঠল তুত্তুরীর মাসিও,‘ কি হয়েছে সোনা মা?’
সোনামা ওরফে তুত্তুরীর মুখ চুন, কাচুমাচু হয়ে জানাল মহানগরে ফেরৎ আসার উন্মাদনায় অন্তিম মুহূর্তে জুতো না বদলে, বাড়িতে পরার হাওয়াই চপ্পলটাই পায়ে গলিয়ে চলে এসেছেন তিনি। গাড়ির সামনের সিটে বসে কপাল চাপড়ায় মাসি, উৎকণ্ঠিত স্বরে জানতে চায়, ‘গাড়িটা কি একবার ঘোরাবে?’ স্টিয়ারিং উল্টোদিকে ঘোরাতে প্রস্তুতও হয়ে যায় অামাদের উত্তমকুমার, প্রয়োজন বলতে শুধু আমার অনুমতিটুকু। অনুমতি কে দেবে, আমি তো হেসেই খুন। কি ভোম্বল বাবু তুই। এবার থাক হাওয়াই চটি পরে,গাড়ি ঘোরানোর সময় কি আমার আছে? সময় মত পৌঁছাতে হবে মহানগর, প্রথমে জমা করতে হবে তুত্তুরীর পরীক্ষার খাতা, তারপর গিয়ে কথা বলতে হবে হাসপাতালের ডাক্তারবাবুর সঙ্গে, তারপর ভিজিটিং আওয়ারে গিয়ে মোলাকাৎ হবে শ্রশ্রুমাতার সঙ্গে। গত সোমবার থেকে যিনি হাসপাতালবাসিনী। এত ব্যস্ত শিডিউলের মধ্যে তুত্তুরীর হাওয়াইচটির জন্য ব্যয় করার মত সময় বিলাসিতা আমার সত্যিই নেই।
কিসের উন্মাদনায় তিনি হাওয়াই চটি পরেই চার চক্র যানে সওয়ার হয়েছেন তা টের পেলাম অচীরেই। বিমানবন্দরের এক নম্বর গেট গলে গাড়ি দৌড়তে শুরু করেছে মসৃণ ভিআইপি রোড ধরে, বাইরে চোখ ধাঁধানো রোদে ঝলসে যাচ্ছে চোখ, এমন সময় তুত্তুরীর প্রাণের বান্ধবীর জননী, যিনি আবার সম্পর্কে আমার অন্যতম ঘনিষ্ঠ বান্ধবী,তাঁর ফোন। বক্তব্য অত্যন্ত সরল, শ্রীমতী তুত্তুরী ওরফে পুরোযা এবং শ্রীমতী ঈশাণী উভয়ে মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, আজ তাঁরা মিলিত হবেনই। মায়েরা সঙ্গে থাকতে পারলে ভালো, নতুবা আবাসনের দুর্গা পুজোর মাঠেই সমবেত হবেন দোঁহে। এতদিন দেখা হয়নি, আর কি দেখা না করে থাকা যায়, বিশেষতঃ যাদের বার্ষিক পরীক্ষার পাঠ বিগতকালই চুকেছে।
বেচারা মায়েরা আর কত কাবাবের হাড় তথা কন্যাদের চক্ষুশূল হবে। অগত্যা জানালাম, ঠিকই আছে, দেখা তো করতেই হবে,সন্ধ্যা ছটার পর বাড়ির সবথেকে কাছের রেঁস্তোরায়।
মাসি সমেত শ্রীমতী তুত্তুরীকে বাড়ি পৌঁছে, টুকটাক দোকানবাজার সেরে গেলাম তাঁর স্কুলে। আর এই স্কুলে আর পড়বে না তুত্তুরী, ভাবতেই ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে হৃদয়। এই তো সেদিন ছেড়ে গিয়েছিলাম আমার পুঁচকে দুধের বাচ্ছাটাকে, এই স্কুলের মস্ত গেটে। গিয়েছিলাম আর কোথায়, দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে ভিড়ের নজর এড়িয়ে অঝোরে কাঁদছিলাম আমি, ভাবছিলাম যা ন্যাদোশ, ভোম্বল বাচ্ছা আমার, নিজের ক্লাশরুমটা কি খুঁজে পাবে? আর দরজার এপারে দাঁড়িয়ে আমার জন্য কেঁদে ভাসিয়েছিল তুত্তুরী। শেষ পর্যন্ত অবশ্য কি ভাবে যেন কার হাত ধরে নির্ধারিত ক্লাসে পৌঁছেও গিয়েছিল। ছুটির ঘন্টা পড়ার পর, প্রি নার্সারির ক্লাশে গিয়ে আর খুঁজে পাই না মেয়েকে, কোথায় গেল!তারপর দেখি, কাঁদতে কাঁদতে সামনের বেঞ্চে মাথা রেখে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছে মেয়েটা আমার। প্রথম দর্শনেই এত ভালোবেসে ফেলেছিল, ক্লাশ টিচার, যে বকা তো দূরস্থান, ঘুমটুকুও ভাঙ্গায়নি মেয়েটার। আট বছর সেই স্কুলে কাটিয়ে, প্রিয় মিস, প্রিয় স্যার, প্রিয়তম বন্ধুবান্ধবদের সবাইকে ছেড়ে আজ অন্য স্কুলে ভর্তি হবে আমার তুত্তুরী।
ডাক্তার বাবু বললেন, আরো দুই ইউনিট রক্ত লাগবে। বড় আশা নিয়ে এসেছিলাম আজ, ভেবেছিলাম হয়তো ছেড়ে দেবার কথা বলবেন ডাক্তার বাবু। তেমনিই আভাষ দিয়েছিলেন গতকাল শৌভিককে। তাই না আজ ও তমলুক গেছে আর আমি এসেছি হাসপাতাল। শাশুড়ি মায়ের হিমোগ্লোবিন নেমে গিয়েছিল তিনেরও নীচে। চার পাউচ রক্ত ইতিমধ্যেই দেওয়া হয়েছে তাঁকে, রক্ত দিতে গিয়েছিলাম আমরাও, আমার হিমোগ্লোবিন সাড়ে এগারোরও বেশি, তাও নেয়নি ব্লাড ব্যাঙ্কের দিদি। ১২বা সাড়ে ১২র নীচে হলে নেবে না। রক্তের রিকুইজিশন নিয়ে এবাড়ি সেবাড়ি দৌড়চ্ছি, ডোনার ছাড়া দিতে চাইছেন না ওণারা। রাগও করতে পারছি না,সত্যিই তো, ওণারাই বা পাবেন কোথা থেকে, টাকা দিয়ে তো আর রক্ত কেনা যায় না। তমলুক থেকে ফোন করে শৌভিক, আর একজন ডোনার মিলেছে। ওরই সহকর্মী। কিন্তু আজ তো আর আসতে পারবে না, কাল দুপুরের আগে সম্ভব নয়। তাই বলে, রাজি করিয়ে, বিল মিটিয়ে, দু পাউচ রক্ত নিয়ে দেখা করতে গেলাম শাশুড়ী মাতার সঙ্গে।
অকাতরে ঘুমোচ্ছিলেন তিনি। নার্স দিদি ঠেলে তুলে দিলেন, ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। জানতে চাইলাম, আমায় চিনতে পারছ? বাধ্য বালিকার মত ঘাড় নাড়লেন তিনি, জিজ্ঞাসা করলাম,‘ আমি কে বলো তো?’ জবাব এল, ‘তুমি তো নার্স।’ পাশ থেকে আসল নার্স বলল, ‘অনেকটা রক্ত ঢুকেছে তো দিদি, একটু ভুল বকবেই। আমাদের যা বকাঝকা করছেন, বাপরে বাপ-। তবে বাড়ির লোককে খুব মিস করছেন। বার বার ওণার স্বামীকে খুঁজছেন।’ যাঁকে নিয়ে এত আলোচনা, তিনি শিশুর মত ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাচ্ছেন এদিক, ওদিক। বোধহয় খুঁজছেন শ্বশুরমশাইকেই। জানতে চাইলাম, ‘কেমন আছ? কি খেয়েছ? এবং তোমার বাড়ির লোক এসেছিল?’ সরল স্বরে সব প্রশ্নের উত্তর দিল, শুধু বাড়ির লোকের প্রসঙ্গে দরজার দিকে তাকিয়ে বলল,‘নাঃ কেউ আসেনি। আমি সকাল থেকে এদের বলছি, আমার বাড়িতে ফোন করো, এরা আমার একটা কথা শুনছে না।’ স্যানিটাইজ করা দু হাতে ওণার সূঁচ ফোটানো হাতটা ধরে বললাম,‘ কেন আমি তো এসেছি!’ দুষ্টু মেয়ের মত হেসে বললেন,‘ধ্যাৎ।’ তারপর ভালো করে তাকিয়ে আধ হাত জিভ কাটলেন। ‘হায় গো, অনিন্দিতা তোমায় চিনতে পারিনি।’
অনুমতি নিয়ে বৃদ্ধ-বৃদ্ধাকে সংযুক্ত করলাম ভিডিও কলে। কি ভাগ্যি আমার ব্যাগে সব সময় হেড ফোনটা থাকে। আট মিনিট পর নার্স দিদির তাড়ায় যখন কাটতে বাধ্য হলাম ফোনটা, শাশুড়ি মাতার দুগালে লেগেছে হাল্কা গোলাপী ছোঁয়া। হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে শ্বশুরমশাইকে বিশদ রিপোর্ট করে, বাপবেটিতে একসাথে এক কাপ চা খেয়ে, মেয়ে বগলে রওণা দিলাম তার বন্ধু সকাশে। কতদিন বাদে যে দেখা হল মেয়েগুলোর- কত যে বদলে গেছে মেয়েগুলো- হ্যাংলা মা দুটো শুধু হাঁ করে দেখেই গেল। আর ভেবেই গেল, এমনিই থাক তোরা, সরল, সাধাসিধে,নিষ্পাপ, বেশ খানিকটা ন্যাদোশ আর অনেক অনেকটা ভোম্বল। বাকিটা ঠিক হয়েই যাবে।
No comments:
Post a Comment