Saturday, 4 April 2020

অনির ডাইরি, ৪ঠা এপ্রিল, ২০২০



ঘুম ভাঙলেই ছুটে যাই বারন্দায়। সূর্যের আলো তখন সদ্য এসে পড়ে সোনালী পয়সা পাতার ওপর। অকাতরে ঘুমায় আমার ঘৃতকুমারী। জলের ঝাপটায় আড়ামোড়া ভাঙে আধ ঘুমন্ত গোলাপ আর জবা।ঘুমঘুম চোখে মাথা তুলে তাকায় ঘণ সবুজ পয়সা পাতা। নয়নতারার শাখায় তখন গোলাপী আবিরের আঁকিবুকি। ভেজা মাটির সুবাসে মিশে যায় বেল ফুলের সৌরভ।এই মুহূর্ত আমার বড় প্রিয়। করিডরে রাখা ক্যাকটাস্, যাকে তুত্তুরী আদর করে নাম দিয়েছে ক্যাকটু, কে যেন ভেঙে দিয়ে গেছে তার শাখা প্রশাখা। শৌভিকের মতে গৃহবন্দী থাকতে থাকতে পাগলে গেছে মানুষজন। তাদেরই কেউ আর কি-

 যবে থেকে রজার ফেডেরার দেওয়ালে বল পেটানোর ভিডিও আপলোড করেছে, শৌভিক পদে পদে হেসে গড়াগড়ি যাচ্ছে। মুখে একটাই বুলি, “লকডাউনে পাগলে গেছে সবাই।” সাধের ক্যাকটাসের দুঃখ এত সহজে মরে না। দীর্ঘ অভিসম্পাতের ফাঁকেফোকরে মাথায় ঘোরে জটিল ষড়যন্ত্র তত্ত্ব। হত্যাকারী কে? দোতলায় সদ্য ভাড়া আসা অবাঙালি পরিবারের হনুমান মার্কা দুলাল, নাকি তিনতলার নিঃসঙ্গ বিধবা ভদ্রমহিলার সর্বক্ষণের সঙ্গী অল্পবয়সী গৃহপরিচারিকা? তুত্তুরীর মতে এটা লেলো-কেলোর কাজ। শৌভিক গ্যালারিতে বসে উপভোগ করে আমাদের চাপানউতোর। “দোতলা থেকে লোক সিঁড়ি ভেঙে আসবে, তোর গাছ ভাঙতে? হোঃ হোঃ।” নাঃ কুকুর নয়, কোন মানুষ অথবা মানুষীরই কাজ। এসেছিল একটা ডাল ভেঙে নিয়ে যেতে। জানে না তো আমাদের ক্যাকটু কি জিনিস। এমন কাঁটা ফুটিয়েছে বাপঃ বাপঃ বলে পালিয়েছে বাছাধন।

বাজারওয়ালার একগাল হাসিতেও যায় না বিরক্তি। মুড়ো ফেরৎ চাই আবুর কাছে। গোটা মাছ কেনা সত্ত্বেও কেন মুড়োটা দাওনি বলে ধমকাইও।  আবু একগাল হেসে জানায়, “বিশ্বাস করেন বউদি, আজ একটাও মুড়া নাই। কাল সকালে আমি নিজে মুড়া দিয়ে আসব আপনার বাড়ি। ”
মার্কেট আজ বেশ ফাঁকা। জনগণও নিরাপদ দূরত্বে লাইন দিয়ে শান্ত ভাবে কেনাকাটা করছে। রাস্তায় গাড়ির সংখ্যা কি একটু বাড়ল? অখণ্ড নীরবতার মাঝে দু একটা গাড়ির হর্ণের আওয়াজ আরও বিরক্তিজনক।  কেত মারা হাফপ্যান্ট আর হাতকাটা টি শার্ট পরা দোকানীর গা ভর্তি ট্যাটু। বিগলিত হেসে জানতে চায়, “বউদি, এ মাসের মাসকাবারিটা আমার থেকেই নিচ্ছেন তো?” দাদাকে আগেই পটিয়ে রেখেছে। আমাকে পটাতে পারলেই কেল্লা ফতে। মাল না দিয়ে মুণ্ডপাত করে বিগবাস্কেট আর গ্রোফার্সের। জানায় যা চাইব, তাই পাব ওর কাছে। দাদাকে এত ভালোবাসে, যে এই দূর্মূল্যের বাজারেও এমআরপির থেকে কমই নেবে সবকিছু। কাকুতি-মিনতি করে বলে চলে, “তেমন হলে বউদি চাল-ডালটা ওদের থেকে নিন। বাকি সব আমিই দিয়ে দেব”। ঠিক এই কথাটাই  গত রাত্রে শৌভিক বলছিল, বাতাসে গভীর ষড়যন্ত্রের গন্ধ পাই।  ব্যাগের মধ্যে মালপত্র গুলো গোছাতে গোছাতে বলে চলে দোকানদার,  “সব ভ্যারাইটি পাবেন বউদি। সব কিছুতে এমআরপির থেকে চার পাঁচ টাকা কম নেব। মাল গুছিয়ে আপনার বাড়ি পৌঁছে দেব, শুধু একবার জানিয়ে দেবেন কি চাই-”।  একহাত দূরে দাঁড়ানো ভদ্রলোক নির্বিকার মুখে বলে ওঠেন, “তাই? আমাকে এক বোতল ভ্যাট আর একটা ওল্ড মঙ্ক দিও তাহলে। ” এক গলা  জিভ কাটে ট্যাটুওয়ালা। “আরেঃ দাদা। ওটাই তো পারব না। সব খালি দাদা। আমার আবার রোজ একটু না খেলে পেট সাফ হয় না। কন্সটিপেশন হয়ে গেছে দাদা বিশ্বাস করুন। দুঃখের কথা কি জানেন? আমার বাড়িতে দুটো বোতল রাখা আছে, একটা টিচার্স আর একটা ডবল ব্ল্যাক। আমার এক বন্ধু কিনে রেখে গেছে। লকডাউনের জন্য ও আসতেও পারছে না বেচারা, নিতেও পারছে না। রোজ ফোন করে আর ধমকি দেয়, ‘সালে হাত ভি লাগায়া না, তো তেরা শির ফোড় দেগা।’কি মুস্কিল দাদা। ঘরেই আছে, অথচ খেতে পারছি না।  পেট সাফ হচ্ছে না দাদা।” খুচরো পয়সা ফেরৎ নিতেও ভুলে গিয়েছিলাম কয়েক মুহূর্তের জন্য। মুদির দোকানে লোকে মদ খুঁজছে? হরি হরি। পয়সা মিটিয়ে চলে আসছি, দোকানি ষড়যন্ত্রের সুরে বলেই চলেছে, “তবে ব্ল্যাকে পাওয়া যাবে দাদা। আপনি বলেন তো এনে দেব। তবে দাম একটু বেশী। এক বোতল ব্লেন্ডারস্ প্রাইড তিন হাজার মত পড়বে-”। ভদ্রলোকের জবাবটা আর শোনা হল না, বেলা বেড়ে যাচ্ছে। শৌভিক বোধহয় ঠিকই বলেছিল, লক ডাউনের বাজারে জনগণ সত্যিই পাগলে গেছে রে বাবা।

Thursday, 2 April 2020

অনির ডাইরি, ২রা এপ্রিল, ২০২০

হ্যাঁ, দশটা-পাঁচটার দমবন্ধ করা আপিসের সীমারেখাটা আপাততঃ বিলুপ্ত। ঘুম ভাঙার তাড়া নেই, আমার আগেই ওঠে সূর্য। আরাম করে চায়ের কাপে চুমুক মারতে বসে শুধু ছুঁয়ে যায় হাল্কা একটু দুশ্চিন্তা,বড় মূল্যবান এই সুগন্ধী চা। আপাততঃ দুষ্প্রাপ্য। মনে পড়ে যায় দোকানদারের দেওয়া হুঁশিয়ারি, “চা তো পাবেন দাদা। তবে টাটা টি। আর নইলে গ্রীন টি ব্যাগ।” দাদার চা নিয়ে কোন মাথা ব্যথা নেই, কফি নিয়ে আছে। কফির শিশি অমিল, আতঙ্কিত হয়ে দশটাকার কফির পাউচের মালা নিয়ে এসেছে শৌভিক। কেটে কেটে ঢেলে রাখতে হবে খালি হতে বসা শিশিতে। নইলে বড় জমে যায়। প্রথম প্রথম দুধ আনতে লাইন দিতাম। দুধ আর দইয়ের রেশনিং। এক প্যাকেটের বেশী কাউকে দেবে না। দইটা আবার শাশুড়ী মা আর তার ছেলে দুজনেরই বড় প্রিয়। নিয়ম মেনে দূরত্ব বজায় রেখে লাইন দি। পিছনের ভদ্রমহিলা, “আমার দুটো চাই” করতে করতে প্রায় উঠে আসতে চান ঘাড়ে। উনি মাস্ক পরেছেন। আমার নাকমুখ খালি। মাস্ক পরলে দমবন্ধ হয়ে আসে। তুত্তুরী ঠিকই বলে, মাস্ক পরলে নিজের নিশ্বাসের যাবতীয় সুবাস মিশে যায় প্রশ্বাসে। দুবার বললাম, আরেঃ সরে দাঁড়ান না দিদি। কাকস্য পরিবেদনা। চেটে দেওয়া দিদিই এদের যথার্থ ওষুধ। এক্কেবারে বাঘা তেঁতুল।
আমাকে দুধের লাইনে দাঁড় করিয়ে, বাজার গেছে শৌভিক। চাল নাকি কমতির দিকে। ওদিকে মাছওয়ালা আবু সকাল সকাল কুর্নিশ ঠুকেছে,“ ভালো মাছ এনিছি দাদা। জলদি আসেন।” শাহদাবও নাকি ছবি পাঠিয়েছে, টাটকা শিম-বিন-বরবটি-পেঁপে আর উচ্ছে এনিছি দাদা। জলদি আসেন।
শৌভিক ঝানু বাজারু, এখন তো আরও বিকশিত ওর প্রতিভা। চাল পায়নি, দু কেজি বাসমতী চালের প্যাকেট কিনেছে। মাছ কিনে মাথাটা ভুলে এসেছে। এই নিয়ে কিছু বলতে গেলেই শুনতে হচ্ছে পাতিলেবু দশটাকা পিস্। শাহদাব বলেছে, লেবু আসে চেন্নাই থেকে। এখন আসতে পারছে না, তাই আর কি-। অবশ্য কমলালেবু নাকি ভীষণ সস্তা এখন-। ভাতে মেখে খেলেই হয়। হায়রে মারিঁ আতোঁনিয়েৎ।

বেলা বাড়ার সাথে সাথেই শুরু হবে অফিস। কটা কারখানা খোলা, কটা বন্ধ? যারা খোলা, তারা কি জেলাশাসকের অনুমতি নিয়ে খুলেছে? কতজন কাজ করে এই খোলা-বন্ধ কারখানায়? বেতন পেল কি তারা? পায়নি? কবে পাবে তাহলে? এরই মধ্যে ভেসে আসে কাতর আবেদন, “আমরা এতজন শ্রমিক, মজুরি পাই নাই ম্যাডাম। আমরা খাব কি?বউ ছেলে নিয়ে শুকিয়ে মরতে হবে আমাদের। ” ফোন ধরে না আপদ মালিক। অন্য নম্বর যোগাড় করতে বাড়ে বেলা। ধমকে ওঠে কোথাও ইন্সপেক্টর, কোথাও আমরা। “বেতন দেননি কেন?” ব্যাঙ্কের ওপর দায় চাপিয়ে পালাতে চায় মালিক। ব্যাঙ্ক ম্যানেজারের গলায় অসহায়তার সুর। দৈনিক দুজন কর্মী নিয়ে খোঁড়াচ্ছে চুঁচুড়ার বড় ব্যাঙ্ক। আপিসের সময় দশটা থেকে দুটো। অনুরোধ উপরোধ করে অবশেষে গৃহিত হয় ফাণ্ড ট্রান্সফারের আবেদন। সময় লাগবে দিন দুয়েক। তা হোক। তাতে আপত্তি নেই শ্রমিকদের।
জলখাবারে মাখন দিয়ে সেঁকা মুচমুচে পাঁউরুটি।  শৌভিক ফিসফিসিয়ে বলে বাজারে মাখন নেই কিন্তু। ডিমও মাত্র কটা পড়ে আছে। খেতে বসলেই মনে পড়ে সুকন্যার কথা। কালরাতেই বলছিল, “আমার খেতে বসলেই মনে পড়ে বাসন মাজতে হবে।” সত্যি ভিম আর প্রিলের সৌজন্যে রীতিমত খসখস করছে হাত। বাসনের হাত থেকে বাঁচতে, দুপুরে তুত্তুরীর প্রিয় পার্টি লাঞ্চ। প্রেশার কুকারে, চাল-মুসুর ডাল আর খামি খামি আলু নুন দিয়ে সিদ্ধ করে, গরম গরম ঘি ছড়িয়ে খাওয়া।  লক ডাউন উঠলে দরজা দিয়ে গলতে পারব তো?
দুটোর মধ্যে পাঠাতে হবে সব রিপোর্ট। বর্মন সাহেব আর শুভজিৎ সকাল থেকে পড়ে আছে রিপোর্ট বানাতে। রিপোর্ট পাঠাতে গিয়ে চোখ পড়ে, কোণে পড়ে থাকা এক রাজনৈতিক ব্যক্তির মেসেজ। অন্য সময় খুলি না। আজ পড়তে গিয়ে চোখ কপালে। অভুক্ত পড়ে আছে মুর্শিদাবাদ থেকে আসা কয়েকজন শ্রমিক। বন্ধ নির্মাণকাজ। কে দেবে মজুরী? দীর্ঘ প্রচেষ্টায় তাদের চাল-আলু পৌছিয়ে দিতে পেরে, সামান্য স্বস্তি।
দিন ঢলতে বসেছে। একতাড়া অর্ডার লেখা বাকি।  ফাইল পড়তে বসেছি, মহকুমা শাসকের ফোন। অমুক জায়গায় নাকি চলছে কোন ফ্যাক্টরি। কিসের ফ্যাক্টরি? যিনি লুকিয়ে খবর পাঠিয়েছেন, সেটা বলতে পারেননি। শুধু বলেছেন দুই আড়াইশ লোক খাটছে। সর্বনাশ! জ্বালিয়ে খেল এরা। খোঁজ, খোঁজ কোন ফ্যাক্টরি। ইন্সপেক্টর সাহেবের নির্দেশে স্থানীয় এসএলও মুখে মাস্ক আটকে রীতিমত স্টিং অপারেশন চালিয়ে খুঁজে বার করে ব্যাটাদের। আরেঃ এরা তো আমাদের রীতমত জানিয়ে ঘটা করে বন্ধ করেছিল ফ্যাক্টরি। আপৎকালীন পরিষেবাও তো দেয় না এরা-। গলা চড়াতে গিয়েও পারি না। জানি কাজ না করলে বসিয়ে মজুরী এরা দেবে না। আবেগ আর কর্তব্যে লেগে যায় ঝটাপটি। রীতিমত ক্লান্ত অবসন্ন লাগে নিজেকে।
ঢলে সন্ধ্যা।আকাশে মেঘেদের হুটোপাটি। কিছুটা ম্রিয়মান নবমীর চাঁদ।  গতকাল ছিল অন্নপূর্ণা অষ্টমী। সারা দিন সিদ্ধ মুগকড়াই খেয়ে কাটিয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছি আগামী ছ মাস আর তড়কার পথ মাড়াব না। আজ রামনবমী। আজ থেকে শুরু রামঠাকুরের উপাসনা। রামরাজাতলা সন্নিবিষ্ট মধ্যহাওড়ায় আজ বিশাল উৎসব হয়। পুরনারীরা কাকডাকা ভোরে পদব্রজে রওণা দেয় পুজো দিতে। এবার যদিও কোন উৎসব হবে না। দর্শনার্থীদের প্রবেশ নিষেধের নোটিশ ঝুলিয়েছে কতৃপক্ষ। বাবাকে ফোন করি, ভিডিও কলের দৌলতে অন্তত প্রত্যহ একদুবার দেখা হয় আমার বৃদ্ধ-বৃদ্ধার সাথে। ডানপিঠে বুড়ো বড়ই মনমরা। বাইরে বেরোতে না পেরে নাকি লকড্ হয়ে যাচ্ছে হাঁটু। শৌভিক পাশ থেকে ইন্ধন দেয়, “ঠিক বেরোচ্ছে দেখ। সিগারেট পাচ্ছে কোথা থেকে-”। এটা একটা চিন্তা বটে। বিগ বাস্কেটে সিগারেটের আব্দার জানিয়েছিল বৃদ্ধ। মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে বিগ বাস্কেট। বৃদ্ধ বলে, “সিগারেট নেই বাজারে। রেশন করতে হচ্ছে-”। কি করে জানলে নেই? প্রশ্ন করলে অভিমান হয় বৃদ্ধের। বড় নিঃসঙ্গ বোধ করে আজকাল। একে একে ঝরে গেছে সব বন্ধু। প্রাণোচ্ছল শিবু কাকু চলে গেছেন অনেকদিন। চলে গেছে, আপদে বিপদে ছুটে আসা সমীরকাকু।চলে গেছে অকৃতদার নেপাল ওরফে নেপু কাকু।ব্রজেশ কাকু। যোগাযোগ রাখে না ভূতনাথ কাকু।  দেবা কাকু বড় অসুস্থ। ভবাই কাকু হয়ে পড়েছেন স্থবির। জানতে চাই, “আর সেই যে কাকুটা? যোধপুর পার্কে বাড়ি? ” শুনতে পাই, তিনি ভুগছেন চূড়ান্ত মানসিক অবসাদে। ব্যাচের অন্যতম সেরা ছেলে হওয়া সত্ত্বেও উপার্জনের দিক থেকে তেমন সবল হতে পারেননি কখনও। বরাবর রেজাল্টে পিছিয়ে থাকা অমুক কাকু সেখানে বানাতে পেরেছিলেন বিশাল ধনসম্পত্তি। অমুক কাকুর স্ত্রীও ছিলেন করণিক থেকে পদোন্নীত আমলা। আর বেহালার কাকুর স্ত্রী ছিলেন সরকারী হাসপাতালের নার্স। এটাও নাকি অবসাদের কারণ। রেগে বলি, ওটা অবসাদ নয়। ছিট কাপড়। সরকারী হাসপাতালের নার্স অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তথা সম্মানীয় পদ। কত মানুষের জীবন বাঁচান ওণারা। পরিচিত বেশ কয়েকজন আমলা তথা অর্ধআমলার স্ত্রী নার্স। আর ঐ নার্স কাকিমাই তো এতকাল টেনে আসছেন সংসার।  বিরক্ত হয় বাবা। “আঃ আমি বলছি না। ও বলে। অমুকের সাথে পদে পদে নিজের তুলনা করে আর মশারি টাঙিয়ে বসে থাকে। ”
উত্তরবঙ্গ থেকে ফোন করে এক সার্ভিসতুতো ভাই। “কি ফাঁসান ফেঁসেছি দিদি”। বয়স্ক বাবা-মা পড়ে আছেন দক্ষিণবঙ্গে। আগামী কাল থেকে ছুটি নেওয়া ছিল। পরশু কাটা বিমানের টিকিট। বৃদ্ধ-বৃদ্ধাকে নিয়ে কটা দিন ঘুরতে যাবার বন্দোবস্ত সব পাকা। খরচা হয়ে গেছে অনেকগুলো টাকা। আপাততঃ আপদকালীন পরিস্থিতিতে বাতিল ছুটি। আর ছুটি থাকলেই বা কি হত? “কি করে যেতাম গো দিদি? হেঁটে হেঁটে”। ব্যাপারটা কল্পনা করে হো হো করে হেসে উঠি দুজনায়। ফোন রাখতে রাখতে প্রার্থনা করি, জলদি মিলিত হোক, বিচ্ছিন্ন পরিবার যত। তৃপ্ত হোক তৃষিত আত্মা যত। ফুসফুসে আরেক ঝলক ভরেনি প্রিয়জনদের দৈহিক সুবাস। দূরত্ব রাখতে পারলাম না বলে ধমকে ওঠে বর। স্যানিটাইজারের বোতল উপুড় করে তুত্তুরী। ওসবে কান দিতে নেই। যাই রান্না বসাই- কাল আবার একটা কর্মব্যস্ত দিন।

#জাস্টমনেহল

এই আকালে স্বপন দেখি, দিন পাল্টেছে নিশ্চিন্দিপুরে। সরকারী আবাস যোজনায় পাকা হয়েছে মাটির বাড়ি। ঢালা হয়েছে ছাত। আজকাল বিধবাভাতাও পান ইন্দিরঠাকরুন। খাটুনি বেড়েছে সর্বজয়ার। সংসার সামলে যেতে হয় অঙ্গনওয়ারি কাজে। দুই বেণী দুলিয়ে, সবুজসাথীতে পাওয়া সাইকেলে চেপে ইস্কুলে যায় দুর্গা। অপুও পাবে। একটু বড় হলেই। দুর্গার সম্প্রতি নাম উঠেছে কন্যাশ্রীতে। হরিহর পুরোহিতেরও নাম উঠেছে সামাজিক সুরক্ষা যোজনায়। এতদিন তাও মাসে ২৫টাকা জোগাড় করতে হত, এখন মুকুব। বিনামূল্যে ঘোষণা করেছেন মাননীয়া। হরিহরের প্রদেয় টাকাও দেবে সরকার। ষাট পেরোলেই থোক অনেকটা টাকা পাবে হরিহর।  আছে ডিজিটাল রেশন কার্ড। স্বাস্থ্যসাথীর কার্ড। বিনামূল্যে চিকিৎসা পাবে হরিহর পুরুত আর তার পরিবার। আর যদি খরচা করতেও হয়, সেই টাকা ফেরৎ দেবে সামাজিক সুরক্ষা যোজনা। দুর্গার এখনও জ্বর হয়, তবে ভয় পায় না হরিহর পুরুত বা তার পরিবার।
#জাস্টমনেহল

Wednesday, 25 March 2020

অনির ডাইরি ২৫শে মার্চ, ২০২০


সেই বউটার কথা খুব মনে পড়ছে। নাঃ আমার সাথে প্রত্যক্ষ আলাপ নেই। আমি তার গল্প শুনেছি। শিয়ালদা মেন লাইনের কোন প্রত্যন্ত স্টেশনে বাড়ি মেয়েটার।  ঘরে অসুস্থ স্বামী। ছোট বাচ্ছা। স্বামী হঠাৎ শয্যাশায়ী হয়ে পড়ায়, অকস্মাৎ পেটের ধান্ধায় বেরিয়ে পড়েছিল মেয়েটা। রাজমিস্ত্রির  জোগাড়ের কাজ করে। সকাল সকাল রান্না সেরে,বর-বাচ্ছার খাবার গুছিয়ে বেরিয়ে পড়ে। গন্তব্য- বিধাননগর রোড স্টেশন। স্টেশনের আসেপাশেই, পুরুষ-নারী নির্বিশেষে জমায়েত হয়, এই রকম কাজের ধান্ধায় ঘোরা অদক্ষ শ্রমিকের দল। ঘোরে কন্ট্রাক্টরের লোকজন। পুরুষদের কাজও বেশী আর রোজও। মেয়েদের কাজ পেতে গেলে চুকাতে হয় অন্য মূল্য। অভ্যাস হয়ে গেছে মেয়েটার। ওর ভাষায়, “কাজ পেতে গেলে কাপড় খুলতে হবে। ” কোনদিন দেরী হয়ে যায়। ট্রেন মিস করে। দৌড়ে এসে দেখে, ময়দান শুনশান। কাজে চলে গেছে সব। প্রথম প্রথম ভেঙে পড়ত মেয়েটা। টাকা না নিয়ে বাড়ি গেলে খাবে কি? ঘরে ফেরার ট্রেন থেকে নেমেই বাজার করতে দৌড়য় মেয়েটা। দরদস্তুর করে বাজার করে নিয়ে যায়,তবে তো হাঁড়ি চড়ে। এখন আর ভাঙে না। জানে ফাঁকা ময়দানে ঘোরে আড়কাঠি। কখনও কখনও খরিদ্দার সোজাসুজি কথা বলে নিয়ে যায়। প্রশ্নকর্তা জিজ্ঞাসা করেছিল, এই ভাবে প্রত্যক্ষ দেহব্যবসা করতে সঙ্কোচ বা  লজ্জা বোধহয় কি না। মেয়েটা একই কথা বলেছিল, হিসাব খুব সোজা, একজন অদক্ষ মহিলা শ্রমিককে কাজ পেতে গেলে কাপড় খুলতেই হবে। সংসারটাতো চলছে-।
এখন কি করছে মেয়েটা কে জানে? কেই বা ভাবে ও বা ওদের মত মেয়েদের কথা। গোটা দেশ আপাততঃ মত্ত কোভিড আর করোণাকে নিয়ে। ব্যস্ত সোশাল ডিসট্যান্সিং আর “সমাজ কে দুশমন” ঠেকবাজদের নিয়ে। আপনি বাঁচলে বাপের নাম, একটু খারাপই না হয় থাকুক, খারাপ মেয়েরা। 

তুত্তুরী উবাচ, ২৫শে মার্চ, ২০২০

  তুত্তুরী উবাচ, ২৫শে মার্চ, ২০২০
 🧔🏻-এই! সক্কাল সক্কাল প্যাঁ-পো, প্যাঁ-পো বন্ধ কর।
🙍🏻‍♀️- তাহলে ও কি করবে? পরীক্ষা শেষ। সারাদিন ঘরে বসে আছে। একটু বাঁশিও বাজাতে পারবে না? যা বাবু বারন্দায় গিয়ে বাজা। সারা বিল্ডিংএর লোককে উত্যক্ত  কর।
👧🏻-(বারন্দায় গিয়ে বেশ খানিক প্যাঁ-পো করার পর) মা। মা। কুকুরটা- 🐕
🙍🏻‍♀️-(প্রবল হাসি চেপে) কুকুরটা তোর বাঁশি শুনে কি বলল?😝
👧🏻-  কেলেটাতো🐕 শুয়েই রইল। নড়লই না। লেলেটা🐩 এল বটে, তবে আমার বাঁশি শুনল না। (প্রসঙ্গতঃ আপাতত আমাদের কোঅপারেটিভে দুইটি নেড়িই রাজত্ব করে। একটির গাত্র বর্ণ কালো। তাই তার নাম কেলে🐕। আরেকটির পাঁশুটে লাল।🐩 তিনি লেলে। তুত্তুরীর মতে কেলে আর লেলে স্বামী-স্ত্রী। লেলেটা রীতিমত খাণ্ডারনি। কেলেটাকে দেখলেই চমকায়। আর কেলেটা অশান্তি এড়াতে, সিকিউরিটির ঘরের পিছনে মনখারাপ করে শুয়ে থাকে। আজও যেমন তুত্তুরীর বাঁশি শুনেও নড়েনি।) জানো মা, লেলেটা না নিজের তলার লোকটাকে খুব ভালোবাসে। একজায়গায় দেখলাম ওরা ময়লা জমিয়ে রেখেছিল, লেলেটা খুঁজে খুঁজে প্লাস্টিক এনে ওখানে জমা করছে। আমি ধমকালাম, “এই কি করছিস?” তখন আমার দিকে তাকিয়ে, বসে পড়ে একটা প্লাস্টিককে ছিঁড়তে লাগল। ও খুব বাজে- 🐕‍😔

Monday, 23 March 2020

অনির ডাইরি ২৩শে মার্চ, ২০২০


বাপরে কি ডানপিটে বুড়ো। গোটা দেশ ভয়ে জড়সড়, অাকাল লেগেছে বাজারে। জনতা কার্ফুর মধ্যেই বিশাল তালিকা নিয়ে প্রস্তুত ঝানু বাজারুরা, আর আমার বৃদ্ধ বলে কি না, “আমার কিসের অভাব?” লকডাউনকে থোড়াই ডরায় আমার বাবা। যৌবনে লড়াই করেছিল সম্পদের সমবন্টনের দাবীতে, অপ্রয়োজনে দ্রব্যসামগ্রী গুদামজাত করাকে ততোটাই ঘৃণা করে, যতটা কালোবাজারী। যে কোন সমস্যার সরল সমাধান মজুত আছে আমার বৃদ্ধের কাছে, “থাকলে ভাত খাব। না থাকলে ফ্যান খেয়ে থাকব-”। 
ইশ এই উদ্দামতা বা দুঃসাহস যদি আমার থাকত-। নেই যখন, তখন বাধ্য হই আঙুল বেঁকাতে। কথায় কথায় জানতে পারি,ফুরিয়েছে চায়ের ব্যাগ, দুধওয়ালা বলেছে আগামী সাতদিনের জন্য গৃহবন্দী থাকবে সে ও। তুলনায় শ্বশুরমশাই বরাবরই স্পষ্টবক্তা এবং বাস্তববাদী। অনেক ভেবে চিন্তে তাঁর আব্দার একটাই, চিনি ছাড়া গুঁড়ো চিনি। “যদি পারিস। তোর মা দই দিয়ে মেখে খেতে বড় ভালোবাসে-”। অধৈর্য হয়ে ওঠে শৌভিক, আর কিছু না? চাল-ডাল- আনাজপাতি- তেল- সাবান? ফেলু মিত্তির-তপসে মিত্তির হয়ে কৌটো-চুপড়ি হাঁটকে দেখা যায়, মার্চ মাসের সাথে সাথেই ফুরিয়ে এসেছে অনেক খাদ্যসামগ্রীই। গুছিয়ে বলতে পারে না, শৌভিকের বৃদ্ধ-বৃদ্ধা। থতমত খায়। বয়স নুইয়ে দেয় ঋজুতম শিরদাঁড়াকেও।
জনতা কার্ফু কাটতেই, দুটো ছালা নিয়ে বাজারে যাই আমরা। ভালো করে তখনও ফোটে না আলো। বাজারে লেগেছে আকাল। গরুড়ের মত মাস্ক পরা নরনারীর দল, বিধিনিষেধ ভুলে ঝাঁপিয়ে পড়তে চায়-।  আমাদের যে ফিরিস্তি অনেক লম্বা। তিন-তিনখানা পরিবারের প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি খুব কম কিছু তো নয়। বুড়ো অবাঙালী দোকানী ফুটিয়ে দেয় অনিয়মিত খরিদ্দারদের। শৌভিক তার নয়নমণি, রোজই অফিস ফেরৎ ঢুঁ মারে যে। আর আমি? নয়নকাঁটা বলতে পারেন। যেটাই আমি চাই, গম্ভীর মুখে শুনি, “নাই, নাই।” ওকে ছেড়ে বিগ বাস্কেট ধরেছিলাম যে। বেইমান অনলাইন শপিং সাইটের দল, অর্ডার তো নেবে। কবে দেবে প্রশ্ন করলেই জুটছে  --।
এবার যাত্রা আপিস পথে- নইলে আক্ষরিক অর্থেই বেতন পাবে না কেউ। সই হয়নি যে বেতনের বিল। পথে আসে না না ফোন। “আমরা কেন বন্ধ করব এজ্ঞে? অমুক সাহেব আমার মামা হয়-”।  অথবা, “ম্যাডাম, মালিক কারখানা বন্ধ করবে না বলছে। আমাদের কি করোণা হতে পারে না? বন্ধ করান আইজ্ঞা-”।  কাউকে নরম ভাবে বোঝাতে হয়, “ আপনাদের কারখানার ছাড় আছে মশাই। আমি নিরুপায়।” কাউকে বা দেখাতে হয় ভয়। বন্ধ করবেন না বলব বড় সাহেবকে? পাঠাব নাকি ইন্সপেক্টর?
ফাঁকা পথ। রেললাইনের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা মৃত ট্রেনের দেহাংশ। বন্ধ সারি সারি দোকানপাট। আগল খোলা দোকানে ভিড় জমানো মানুষ। ছোট্ট বাজার ব্যাগ হাতে নিঃসঙ্গ বৃদ্ধ বা বৃদ্ধা। কারো মুখ মাস্কে ঢাকা। কারো তাও নয়। সদ্য হাঁটতে শেখা বাচ্ছার মুখে মাস্ক লাগিয়ে, হাত ধরে বাজারে বেরিয়েছে মা। মাস্ক পরা চাওয়ালা। মাস্ক নামানো খরিদ্দার। 
হাতে সাবান দিয়ে ঢুকতে হয় জেলাশাসকের করণে। ভেজা তোয়ালে এগিয়ে দেয় জনৈক অস্থায়ী কর্মী। পাগল নাকি? ঐতে হাত মুছি, আর ইয়ে হোক আমার। মন খারাপ হয়ে যায় অলিন্দে লাগানো সাধের গাছগুলোকে দেখে। লকডাউনে কে জল দেবে এদের?
অজিত দা নাকি আসবে। অাপিসই অজিত দার ঘরবাড়ি। গোটা চাকরী জীবনে চারদিন মাত্র ছুটি নিয়ে ছিলেন, দুদিন নিজের বিয়ের জন্য আর একটা করে দুই মেয়ের বিয়ের দিন। কালেক্টরেট অচল এই কর্মঠ বৃদ্ধকে ছাড়া। রীতিমত মাস্ক পরে, পকেটে স্যানিটাইজার নিয়ে টার্মিনেটর সেজে দৌড়ন অজিত দা। নজর রাখেন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। নজর রাখি আমরাও। কত হল? গতকাল রাতেও আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৩৬৫। এখন কত? ৪০০?৪৩৫? এই দোদুল্যমানতার মধ্যেই শেষ হয় দিনটা। ফোন করে তুত্তুরী, “বাড়ি এস মা।” আকাশ ভেঙে তখন শিলাবৃষ্টি।

Sunday, 22 March 2020

বেণী ও সখা



-নমস্কার  স্যার।
-আবার তুমি?
-আজ্ঞে।
- দেখ বাপু, তুমি যা চাও তা অসম্ভব। দিব্য তো আছো, খাচ্ছো,দাচ্ছো, ঘুরে বেড়াচ্ছ-- তোমার মনের মত মরসুম এখানে। আজ তো দেখছি সকাল থেকে ঘুড়ি ওড়াচ্ছিলে, বেশ তো আছো, তা এই বদ খেয়ালটা কি মাথায় না এলেই নয়????
-ভাল আছি স্যার। এটা হক কথা। যেদিন যা খেতে চাই খেতে পাই। যা পড়তে ইচ্ছে হয় পড়তে পারি। যেমন আজ এই রেড ইন্ডিয়ান ওয়ার বনেটটা পড়েছি---
-ঐ ভয়ানক দর্শন জিনিসটার নাম ওয়ার বনেট নাকি?
-হ্যাঁ স্যার।  রঙ বেরঙের পাখির পালক দিয়ে--
-তা এ তোমার কি সাজ বাপু? খালি গায়ে ধুতিটাকে লুঙ্গির মত পড়ে মাথায় ঐ কিম্ভুতকিমাকার টুপি পরে ঘুড়ি ওড়াচ্ছ?
- ভালো লাগে না স্যার।  কিছু ভালো লাগে না।
- একা লাগে বুঝি? তা আসে পাশের লোকজনের ওখান থেকে তো একটু আধটু ঘুরে আসতে পারো।
-  কি হবে স্যার? সেদিন গিয়েছিলাম প্রমথেশ বড়ুয়া  সাহেবের ওখানে। গোটাটাই সেট। উনি একাই অভিনয় করে যাচ্ছেন।  মাঝে মাঝে নিজে নিজেই ডাইরেক্টর হয়ে যাচ্ছেন। ক্যামেরার পিছনরথেকে প্রচণ্ড ধমক দিচ্ছেন নিজেকে---আবার কখনও গান গাইছেন-কাল্পনিক নায়িকার হাত ধরে। ওনার গলায় খেলা ভাঙার খেলা গানটা আমার খুউউউব পছন্দের--- কত অনুরোধ করলাম দেখলেনই না।
-হুঁ। প্রমথেশের স্বর্গ ঐ রকমই। সিনেমা আর গানই তো ছিল ওর জীবন। আর একটা জিনিসও ছিল অবশ্য। তবে এখানে ওসব খেলে কিছু হয় না, যতক্ষণ  না তুমি নিজে মদমত্ত হতে চাইছ।
-স্যার আমার অনুরোধটা একবার বিবেচনা করে দেখুন স্যার-প্লিইইইইজজজ।
-আরে ধুৎ। মানুষ নীচে থেকে ওপরে আসে--, যে যা করেছে সেই হিসেবে।  কিন্তু ওপর থেকে কেউ নীচে যায়? কেউ গেছে কোনদিনও?
-স্যার। প্লিজ। আপনি চাইলেই পারেন---
-পারি না রে বাবা। এখানে সব নিয়মে চলে। আমিও। ব্যতিক্রম মানেই প্রলয়-- ওটা শিউজীর জুরিসডিক্সন। আমার নয়।
-স্যার, আমি জানি, মা বলত- কলি যুগের শেষে আপনি পৃথিবীতে যাবেন, কালো ঘোড়ায় চেপে হাতে তরবারি নিয়ে---
-কালো ঘোড়া? তাই কি? সাদা শুনেছিলাম যেন? নাকি বাদামি?যাই হোক,কলি তো এখনও শেষ হয়নি বাবা।  সব পারমানবিক বোমা গুলো আগে তোমরা দমাদ্দম ফাটাও, আর আমাকেও মানুষ হয়ে জন্মাতে হবে। আমার মায়ের নাম হবে সুমতি--হেঃ হেঃ দেখছ বাপু সব মনে আছে। তুমি আবার জন্ম নিতেও তো চাও না?
-না স্যার।  না । আমাকে এই অবস্থায় পাঠান স্যার। কিছু কাজ বাকি রয়ে গেছে--_কিছু হিসাব চোকাতে হবে।
-জানো দেবদূতেরা তোমাদের কি বলে? রোমহীন বাঁদরের দল। মরা লোকের আবার হিসেব নিকেশ। ও সব চিত্রর হাতে ছেড়ে দাও। ও সবার সব হিসাব রাখে। সেই মোতাবেক নোটশীট দেয়, ফাইল তোলে। যেমন তুমি--তোমার ফাইল আমায় দিল। কিন্তু তোমায় তো কিছুতেই খুশি করা যায় না বাপু। সুচরিতার মত সুন্দরী অপ্সরাকেও তুমি দিদি বলে ভয় দেখিয়েছো।
-স্যার। প্লিজ। একবার যেতে দিন। একটিবার স্যার। আপনিও তো কাউকে ভালবেসেছিলেন---
-কাউকে কি হে?বল কাকে নয়? দেবী,দেবদূতী,অপ্সরা-- কে নেই। আমি হলাম দ্বাপরের কেষ্ট। কলির নয়।
-আর শ্রীরাধিকা?কি হল স্যার?গম্ভীর হয়ে গেলেন যে? মনে পড়ে তার কথা? যদি তাকে আপনার কাছে থেকে বলপূর্বক  সরিয়ে নেয় কেউ? তার সামনে আপনাকে পিটিয়ে থেঁতলে খুন করে? আর মরার আগে দেখেন যে কেউ তাকে জবরদস্তি ----তিষ্ট প্রভু তিষ্ট। যা শুনেই আপনার এই অবস্থা, আমি তা সয়েই এখানে এসেছি। আমায় যেতে দিন প্রভু। যেতে দিন।
-বেশ। দিলাম। কিন্তু এখানকার নিয়ম বড় কড়া। তোমাকে আমার মধ্যে বিলীন হতে হবে। আমি মর্তে পৌছলে তবে তুমি মুক্ত হতে পারবে। শুধু মনে রেখ মর্তে আমি তোমার কোন কাজে আসব না। কারণ আমার দৈব শক্তি ত্যাগ করে তবেই যেতে পারব। যা করবে, তোমাকে নিজের জোরেই করতে হবে। রাজি?
-রাজি প্রভু। রাজি।
-দয়া করে আবার মরো না। মরলেই লাইনে দাঁড়াতে হবে, চিত্রগুপ্তর সামনে আসতে হবে। আর চিত্রটা মহা হারামজাদা।
বেণী ও সখা- (part 2)
বিশাল শুষ্ক উপকূল।   রূপালী বালি মোড়া। সময়টা সন্ধ্যার কিছু আগে, সূর্য সদ্য অস্ত গেছে আবার সন্ধ্যার অন্ধকার ও নামেনি। জনা চার পাঁচ জেলে তাদের জেলে ডিঙি গুলিকে নিরাপদ স্থানে রেখে পাশে বসে বিড়ির ধোঁয়া সহ দুদণ্ড জিরিয়ে নিচ্ছে। হঠাৎ একজন চিৎকার করে উঠল, সমুদ্রের বুক থেকে উঠে আসছে এক ছায়া মূর্তি। আবছায়া তেও স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে সে দীর্ঘ দেহী। ঋজু টানটান চেহারা। মাথায় বেশ লম্বা, ভেজা চুল, কাঁধের ওপর লেপ্টে আছে। ওরা দৌড়ে গেল। আগন্তক বেশ কালো। শ্যাম বর্ণ যাকে বলে। পাথরে কোঁদা চোখ, নাক, চেহারা। পরনে মালকোঁচা মেরে পড়া ধুতি। কানে সোনার মাকড়ি। কোমরে একটা বাঁশি। ডান বাহুতে একটি বিশাল ময়ূরের পালকের উল্কি। যা ঐ প্রায়ান্ধকারেও জ্বলমান । আগন্তুক হাসল। দুই গালে গভীর টোল পড়ল। পুরুষ মানুষ এত সুদর্শন  এত মোহময় হতে পারে? বাকরুদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছিল ওরা। হঠাৎ  আগন্তক এক জনের দিকে ভিজে আঙুল তুলে বলল,“তুমি। দূরে থাক। স্বাদবদলের কোন শখ নেই বৎস ইয়ে মানে বাছাধন। ”লোকটি ভূত দেখার মত চমকে গেল, তারপর ছুটে পালিয়ে গেল। বাকিরা তখনও মন্ত্রমুগ্ধ । আগন্তুক একটি ধারালো ছুরি চাইল আর জানতে চাইল, “ রণছোড়দাসের বড় মন্দিরটা কতদূর?”

বেশ কয়েকঘন্টা পর, রাত গাঢ় হয়ে এসেছে, হু হু হাওয়া দিচ্ছে, লোকগুলি চলে গেছে, আগন্তুক ধারালো ছুরি দিয়ে নিজের বাঁ হাতের ওপর এক গভীর দাগ কাটল। জ্বলন্ত লাভার মত উজ্জ্বল লালচে সোনালী রক্ত ফিনকি দিয়ে বেরিয়ে নীচে বালিতে পড়তে লাগল। মুহূর্তমধ্যে  দেখা গেল এক মাঝারি উচ্চতার সাদামাটা দেখতে বছর তিরিশের ছেলে আগন্তুকের পায়ের কাছে হাত জোড় করে বসে আছে। “প্রভু। ”
“বেণী”।
“ধন্যবাদ স্যার। ”
“কিসের ধন্যবাদ হে? তোমার বাড়ি তো সেই সুদূর বাংলা। এটা যে গুজরাত সে খেয়াল আছে? ”
“গুজরাত?কেন প্রভু?”
“এটা, বন্ধ কর। হয় প্রভু বল। নয় স্যার। নয় তো আমার এত নাম, তার একটা ধরে ডাকো।”
“গুজরাত কেন দীনু?”
“দীনু? দীনবন্ধু?ওটা তো তেত্রিশ কোটির যে কোন কাউকেই বলা যায় রে ভাই? আর গুজরাত হবে নাতো কোথায় হবে? আমার বাড়িই তো ছিল এখানে। দ্বারকা?সমুদ্র বেটা হিংসুটে । কতবার যে গিলে নিয়েছে আমার শহর, কিন্তু আবার গজিয়ে উঠেছে--- আমার দ্বারকা। তাই আর কি--”
“সেন্টু দিও না সখা। এবার আমি বাংলায় ফিরব কি করে শুনি? কপর্দকশূন্য অবস্থায়?

“উড়োজাহাজে করে। আর সখা বলেই ডাক। দীনু কেমন যেন বুড়োটে নাম। ”
“হাওয়াই জাহাজের পয়সা কি আমার বাপ দেবে? তোমায় তো উল্টো করে ঝাড়লেও কিছু বেরোবে না। ”
“তোমার বাপ একটা ছিঁচকে কালোবাজারী চোর ছিল। এখন নরকে পচছে। তার ভরসা করে লাভ নেই। কে বলল আমার টাকা নেই? এত যে মন্দির আমার জন্য, এতটাকা ভেট পরে সেসব কার?”
“সেগুলো তোমার জন্য ওরা সাজিয়ে রেখেছে-চল নি। ”
“ব্যঙ্গ করছ? চল। কোথায় কোন মন্দিরের কোন গর্ভগৃহে কি লুকোন আছে তুমি জানো না বেণী। আমি জানি। কোন মহন্তের কোন বাড়ির কোন সিন্দুকে আমাকে দেওয়া কোন জিনিস লুকোন আছে তুমি জানো না---। কি যেন বলে আগে আগে দেখো কি খেলা দেখাই---কোন খেলা যে খেলব কখন-- ”

বেণী ও সখা (পর্ব ৩) -
রাডিশন ব্লু হোটেল, দ্বারকা। দরজায় খটখট করল বেণী। তারপর ইতস্ততঃ করে নব ঘুরিয়ে প্রবেশ করল,“সখা?”
 “হুঁ?” অন্যমনস্ক ভাবে জবাব দিল সখা। হাতে একটা ঝাঁ চকচকে আই প্যাড।পাশে খুলে রাখা ল্যাপটপ, তার পাশে মূল্যবান মোবাইল ফোন। সখার  পরনে ব্রান্ডেড্ ঢোলা পাজামা আর গোল গলা টি শার্ট। খাটের সামনে দুটো তুলতুলে নরম জুতো খোলা আছে। ঢলঢলে পোশাক ভেদ করে ভিতরের পেশীবহুল সুগঠিত শরীরের প্রতিটি বিভঙ্গ বেশ সুস্পষ্ট । এক মাথা ঝাঁকড়া অবাধ্য চুল, মুখে চোখে ঝাঁপিয়ে পড়ছে, ঋজু চৌকো  চোয়াল, হাসলে গালে টোল পড়ে, সখা যে এত রূপবান তা আজ বেণী প্রথম খেয়াল করল। সাধে শ্রীচৈতন্যদেব সখার প্রেমে উন্মাদী হয়েছিলেন? বেণীর মনে হল, সে ও সখার প্রেমে পড়েছে। এ অন্য প্রেম, কাম বিবর্জিত। এ প্রেমে মানুষ হারিয়ে যেতে চায়, মিশে যেতে চায় দয়িতের সঙ্গে। বেণীর ইচ্ছে করছে সখার পদতলে গিয়ে বসে, আলতো করে মাথাটা নামিয়ে আনে সখার শ্রীচরণে। বেণী শুধু বলল,“আই লাভ ইউ । ”
সখা করুণ হেসে বলল,“বেসো না। আমি বড় অপয়া সখা। যে যখন আমায় ভালবেসেছে শুধু কষ্টই পেয়েছে। রাধা-রুক্ষ্মিণী-অর্জুন-অভিমন্যু-মীরা এমন কি হালের শ্রীচৈতন্য অবধি। আমাকে ভালবেসে নিজেদের বিকিয়ে দিয়েছে এরা,অথচ আমি এদের জন্য কিছুই করতে পারিনি। আমি বড় সাধারণ দেবতা হে। ভালবাসা ছাড়া আর কিছুই পারি না। যুদ্ধ, কলহ-দ্বেষ, অশান্তি আমি নিতে পারি না। যদি পারতাম, আমার একমাত্র ভাগ্নেকে ওরা ঐ ভাবে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মারতে পারত না। ”

অখণ্ড নীরবতা গ্রাস করল ঘরটাকে। দুজনেই চুপ, তারপর সখা উৎফুল্ল হয়ে বলে উঠল “বুঝেছি। এমন কিছু শক্ত নয় হে-। এটা উয়িন্ডোজ, এটা অ্যান্ড্রয়েড আর এটা হল আইওএস। ” মৃদু মোহক হেসে বলল সখা। “ নির্লোম বাঁদরের দল কিন্তু বেশ বুদ্ধিমান। একথা মানতেই হয়। ”
নরম সোফায় পশ্চাদ্দেশ ঠেকাতেই অর্ধেক ডুবে গেল বেণী। হ্যাঁচোরপ্যাঁচোর করে উঠে বসল একটি অপেক্ষাকৃত শক্ত চেয়ারে। “সখা এবার আমায় বিদায় দাও--”।
ভ্রু কুঞ্চিত করে সখা বলল,“এখুনি?আচ্ছা বলে দেখছি কাল সকালের ফ্লাইট কিছু আছে কি না?”
“ফ্লাইট লাগবে না সখা। আহমেদাবাদ থেকে ট্রেন--। ” 
“না।  প্লেন। ”দৃঢ় ভাবে বলল সখা।
বেণীও ততোধিক ঋজু হয়ে বলল,“না প্রভু। এটাকা আপনার। লোকে আপনার উদ্দেশ্যে ভেট করেছে। এর ওপর অধমের কোন অধিকার নেই। আর তাছাড়া আপনি যে হারে খরচ করছেন---কুবেরের ঐশ্বর্য্যও জলদি ফুরিয়ে যাবে। ”
“ফুঃ।” বলে একটুকরো পিৎজা মুখে দিল সখা। চোখ বুজে এল আবেশে। “চিজ্। আঃ কি জিনিস বানিয়েছো গুরু।  চিজ্, আইসক্রীম, চকলেট। নাহে পৃথিবী বেশ মজার জায়গা। আর কি বলছিলে, ঐশ্বর্য্য ফুরিয়ে যাবে? আরেঃ লোকে আজ পর্যন্ত যত  আমায়  হাতি দান করেছে, তাদের দাঁত বেচেই-”

মাস তিনেক পরের কথা, হ্যাভেলকের ব্যয় বহুল হোটেলের নিজস্ব নির্জন বীচে বসে, ডুবন্ত সূর্যের কমলা আলোয়  বঙ্গোপসাগরের শোভা দেখতে দেখতে ডাবের জল খাচ্ছিল সখা। হঠাৎ ফোনটা জোরে জোরে কাঁপতে লাগল। প্রতিবার ফোন এলেই সখার মনে হয় বেণী। কিন্তু এই তিন মাসে বেণী একটিবার ও ফোন করেনি। আজো অচেনা নম্বর।
“হেলোঃ। ”
“সখা?” কাঁপা কাঁপা গলা ভেসে এল বহুদূর থেকে।
“বেণী?” করে উঠল সখা। ডুবন্ত সূর্য চমকে উঠল। মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেল সমুদ্র। “কি হয়েছে? তোমার ফোন কোথায়?এটা কার নম্বর? কোথায় তুমি?ঠিক আছো তো”
“তিষ্ট প্রভু। তিষ্ট। আমি কথা রাখতে পারিনি প্রভু।  আমি আহত। মরণাপন্ন। আমার মোবাইল  পুলিশের হেফাজতে। নার্স দিদির থেকে ফোন চেয়ে লুকিয়ে ফোন করছি। আমায় পারলে ক্ষমা কোর সখা---”
“মানে?মরণাপন্ন? পুলিশ?তুমি কোথায়? আমি আসছি। আর সিম গুলো পুলিশের হাতে গেল কি করে? ও গুলো তো পারভেজের আধার কার্ড দিয়ে কেনা। কি করেছ?  মোটা ভাল ছেলেটা ফেঁসে যাবে যে?”
“এত প্রশ্নের জবাব দেবার ক্ষমতা নেই সখা। আমি খুন করেছি। চারজনকে। একা চারজনের সাথে লড়ে গেছি, ফলে আমার অবস্থা বুঝতেই পারছ। দুটো আঙুল নেই। হাত পা পাঁজর ভাঙা। আর প্রচুর রক্তক্ষরণের ফলে রক্তাল্পতায় ভুগছি। বাইরে পুলিশ পাহারায় আছে। মরলে ভাল। নইলে ফাঁসি। ”
“কোথায় আছো তুমি?”চিৎকার  করে উঠল সখা। এতক্ষণ স্তব্ধ থাকার পর গর্জন  করে উঠল সমুদ্র। ভয়ে ঝুপ করে ডুবে গেল সূর্য ।

পরদিন রাত এগারোটা। আসানসোল জেলা হসপিটালের ঘুমন্ত করিডরে হেঁটে যাচ্ছে এক আগন্তুক। পরনে নীল জিন্স আর হাল্কা সবুজ টি শার্ট। একটা ঘরের বন্ধ দরজার বাইরে এক হাবিলদার বসে ঢুলছিল। আগন্তুক নিঃশব্দে দরজা খুলে ঢুকে গেল ঘরের মধ্যে। খাটে শুয়ে আছে বেণী। একি চেহারা বেণীর। এক মুখ দাড়ি। কোটরগত চোখ। আগন্তুুকের জন্যই যেন প্রতীক্ষা করছিল বেণী। অস্ফুটে বলল,“ সখা তুমি এলে। এবার আমি শান্তিতে-”।
শশশশশ্। আওয়াজ করল আগন্তুক। বেণীর কপালে দুটো আঙুল ঠেকালো সখা, মুহূর্তের মধ্যে সমস্ত কাটা দাগ, ক্ষত মিলিয়ে গেল। আগন্তুকের আঙুল স্পর্শ করল বেণীর হাত, কড়কড় করে ভেঙে গেল প্লাস্টার। অবাক বিস্ময়ে বেণী দেখল দুটো হারিয়ে যাওয়া আঙুল আবার গজিয়ে গেছে। সখার আঙুল স্পর্শ করল পাঁজর---
বেণী ও সখা (part 4)
বেণী শুধু অস্ফুটে বলল,“কেন প্রভু? কেন এলে তুমি? এঘরে করিডরে সিসিটিভি ক্যামেরা লাগানো আছে। ওরা তোমায়ও অপরাধী ভাববে-”।  ফোৎ করে  তাচ্ছিল্যপূর্ণ ভাবে একটা নিশ্বাস ছেড়ে ব্যাগ থেকে এক সেট জামাকাপড় বার করে বেণীর হাতে দিল সখা। “ওহে নির্লোম বাঁদরের দল, ইএমএফ কি বোঝ? তোমাদের ঐ ক্যামেরার সাধ্য কি আমায় দেখে? আমার গা থেকে যে ই এমএফ বেরোয় তা ঐ ক্যামেরার কি যেন বলে ট্রান্সমিশন বোধহয়, ঐটাতে বাধা দেয়। যখনই আমায় দেখার চেষ্টা করবে শুধু অস্পষ্ট ঝিরিঝিরি একটা অবয়ব দেখতে পাবে। এমন কি আমার সংস্পর্শে  থাকলে তোমায় ও স্পষ্ট দেগতে পাবে না। ইএমএফ ডিস্টার্বেন্স এর জন্য। এবার চটপট চেন্জ করে নাও। ”
পোশাক পাল্টে বেণী আর সখা বেরোতে যাবে,  কর্তব্যরত নার্স ট্রে নিয়ে ঘরে ঢুকল। প্রথমেই বেণীকে থেকে ভ্রু কুঁচকে গেল,“ একি!একি! আপনি কোথায় যাচ্ছেন? প্লাস্টার কাটল কে?” পাশ থেকে সখা এগিয়ে এসে মৃদু হেসে নার্সের চোখে চোখ রেখে বলল,“আমি। ”
কুঞ্চিত ভ্রু মুহূর্তে সোজা হয়ে গেল। আবিষ্ট মোহক ঘণ দৃষ্টিতে সখার দিকে তাকিয়ে রইল নার্স কিছুক্ষণ । তারপর শুধু ঠোঁট দুটো নড়ল,“আই লাভ ইউ”।  সখাও হাসল। সম্মোহনকারী হাসি, তারপর বাঁশির মত সুরেলা সুরে বলল,“ আই নো। কিন্তু এখন যে বড় ব্যস্ত সখী। একটু পথ দেখিয়ে বার করে দাও আমাদের। ”
 নার্সের পিছন পিছন ঘর থেকে বেরোতেই, বাইরের ঢুলন্ত রক্ষী সটান উঠে দাঁড়ালো। “ইয়ে ক্যায়া চল রাহা হ্যায়? কোথায় নিয়ে যাচ্ছো আসামীকে?” বেণী এবং নার্সের মুখ এবং গলা শুকিয়ে গেল। সখা দুহাতে দুজনের কাঁধ স্পর্শ করে আশ্বস্ত করল। তারপর পিছন ফিরে রক্ষীর দিকে তাকাল সখা। সেই সম্মোহক হাসি। সেই একই প্রতিক্রিয়া , “ভালবাসি তোমায়। ”সত্যি সখাকে কি ভাল না বেসে থাকা যায়? গাড়িতে তুলে দিল ওরা। গাড়ি ছাড়ার আগে, সখা ডান হাতের তর্জনী আর মধ্যমা দুজনেরই কপালে ঠেকালো, মৃদু আচ্ছন্নতা গ্রাস করল দুজনকেই। আস্তে আস্তে মাটিতে শুয়ে পড়ল দুজনে, গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল ক্ষণেকের মধ্যে। বেণী আতঙ্কিত হয়ে বলল, “সখা!!একি করলে?ওদের মেরে ফেললে নাকি?” সখা ঠোঁট উল্টে বলল,“আমি শুধু ভালবাসতে পারি বেণী। রক্তপাত আমার দপ্তর নয়। ওরা আমায় ভালবাসল, ওদের জন্য আমারও তো কিছু করার আছে। এই ভাবে চলে গেলে ওরা বিপদে পড়ত না? তাই ওদের স্মৃতিটা একটু পাল্টে দিলাম। আমার কথা ওদের আর মনে থাকবে না।  চেতনা এলে ওরা বলবে, ওদের পিঠে বন্দুক ঠেকিয়ে তোমায় ছাড়িয়ে নিয়ে গেছি আমি। যাবার সময়, কোন ওষুধ স্প্রে করাতে ওরা বেঁহুশ হয়ে গিয়েছিল। ”
বেণী শুধু আবেগ বিহ্বল কণ্ঠে বলল,“এত ভাবো সখা? এত ভাবো আমাদের জন্য?”
সখা জবাব না দিয়ে বলল,“পারভেজ গাড়ি চালাও। ”
“পারভেজ?পারভেজ আপনাকে নিয়ে এসেছে?”
“হুঁঁ। ” অবাক স্বরে বলল সখা। “ওর আধার দিয়ে পাওয়া সিম পুলিশের হাতে তুলে দিয়ে যে ঝামেলা তুমি পাকিয়েছ, তা সামলাবে কে? তাছাড়া পারভেজ আমার বয়স্য। যেমন রাম আর হনুমান। নির্লোম বাঁদরদের নিয়মকানুন তো পারভেজই আমায় শেখায় হে। ”
একমুখ পান চিবোতে চিবোতে হোৎকা ঘাড়ে গর্দানে পারভেজ একগাল হেসে বলল,“আই লাভ ইউ সার”। বেণী রাগে গরগর করতে করতে শুধু বলল,“শালা গুজ্জুর আবার ভালবাসা। তোমায় নয় তোমার টাকাকে ভালোবাসে ও। ” সখা জবাব দিল না। হুশ করে আসানসোল ছাড়িয়ে গাড়ি ছুটল ঝাড়খণ্ডের দিকে। মাঝপথে গাড়ি থামিয়ে একবার নম্বর প্লেট বদল করল পারভেজ।

শিমূলতলা। সময়টা এপ্রিলের শেষ, তাই পর্যটকদের ভিড় প্রায় নেই বললেই চলে।অবশ্য আজকাল এমনিতেই কম লোকজন আসে এদিকে।  শিমূলতলার সেই গৌরব আর নেই। আগে  যারা আসত তাদের গরিষ্ঠাংশই ছিল বাঙালি। বাঙালিদের প্রিয় স্বাস্থ্যোদ্ধারের জায়গা ছিল শিমূলতলা। কত নামি অনামি লোক যে এককালে এখানে এসেছে, তারপর শিমুলতলার মোহে আবদ্ধ হয়ে থেকে গেছে তার ইয়ত্তা নেই।  তারপর একদিন আচমকাই স্থানীয় অধিবাসীদের মনে হল,“ এরা কারা? হাভাতে বাঙালীগুলো এখানে কি করছে? ভাগাও এদের। ” শুরু হল বাঙালীদের এক্সোডাস। আজকাল শিমুলতলার বেহাল দশা। হৃত যৌবনা সুন্দরীর মত, আজোও রূপচর্চা করে বটে, কিন্তু আদতে ঔজ্জ্বল্যহীন।   শিমুলতলার জনবহূল এলাকার বাইরে একটা লাল সিমেন্টের  দোতলা বাড়িতে আপাততঃ আস্তানা বেণী ও সখার। কড়ি বরগাওলা সাবেকী বাঙালি বাড়ি। বড় বড় ঘর। ঘরে বিশাল বিশাল কালো সেগুন কাঠের খাট, দেরাজ, দেরাজের গায়ে বিবর্ণ হলেও হিরের মত দ্যুতিময় বেলজিয়াম গ্লাসের আয়না। পারভেজ গেছে গাড়িটা বদলে আনতে। সখার ইচ্ছা ওরা কলকাতা হয়ে আহমেদাবাদে ফিরে যায়। নাহলে অন্তত গোয়া। বেণীর জেদ ও যাবে না। “কেন?” হতাশ স্বরে বলল সখা। প্রতিশোধ তো নিয়ে নিয়েছ? চার চারটে লোককে খুন করেছ! আর কি?এবার গোয়ায় কটা  দিন কাটিয়ে ফিরে যাই চল। ”
“নাঃ”দৃঢ় স্বরে বলল বেণী। “ওরা ছিল নিছক পেয়াদা। আমার রাজাকে চাই। যাকে এককালে নিজের বড় দাদা, বাবা এমনকি ঈশ্বরের মত শ্রদ্ধা করতাম। নিজের হাতে সব শিখিয়েছিল-- কি ভাবে অপারেশন চালাতে হয়।”
“অপারেশন মানে কাটাকুটি ?”
“না সখা। তোলাবাজি, মস্তানি। প্রয়োজনে -”
“কি? খুন? এঃ। তুমি স্বর্গে ঢুকলে কি করে? আর আমি তোমার ফাইল না পড়েই তোমাকে আজাদী দিলাম। রাধার নাম করলে আর আমি ও গলে গেলাম। না হে। আর কোন মানুষ খুন করতে আমি দেব না। চল ফিরে চল। ”
(চলবে)