ভদ্রলোকের আজ জন্মদিন। যখন ভূমিষ্ঠ হয়েছিলেন, আক্ষরিক অর্থেই পৃথিবী কাঁপাচ্ছেন ওণার সমনামধারী জনৈক গুঁফো জার্মান সাহেব। অবিভক্ত ভারত। ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে আবেদন-নিবেদনের রাজনীতির উপর বীতশ্রদ্ধ হয়ে, সদ্য নতুন দল গঠন করেছে সুভাষ। ভারত ছাড়ো আন্দেলন থেকে নেতাজীর অন্তর্ধান, ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে থেকে দেশ ভাগ কিছুই তখনও লেখা হয়নি সময়ের খেরোর খাতায়।
বিশ্বাসই হয় না, দেখতে দেখতে ৮৩টা বসন্ত পার করে ফেললেন ভদ্রলোক। সাক্ষী রইলেন কত না উত্থান-পতন, কুশীলব থেকে পট পরিবর্তনের। ভদ্রলোক নিজেও কম বর্ণময় চরিত্র নন। ওণাকে নিয়ে একটা-দুটো নয়, গল্প লেখা যায় ভুরি ভুরি। যেমন সপ্তম শ্রেণীর সেই দিনটা, স্কুলের বড় গেট থেকে বেরোনোর সাথে সাথে যেদিন আমাকে ছেঁকে ধরেছিল একদল সুহৃদ। সবার চোখে উৎকণ্ঠা, মুখে একটাই প্রশ্ন ‘ কি রে,কি হল?’
উদ্বিগ্ন হওয়াটাই স্বাভবিক, যা কেলো বাঁধিয়েছিলাম আমি। সেই সময় হাওড়া গার্লস কলেজে যারা BT পড়তেন, তাদের প্রাকটিক্যাল পড়ত আমাদের স্কুলে। সে এক দারুণ মজার ব্যাপার। রোজ, রোজ নতুন দিদিমণিরা আসতেন ক্লাস নিতে। কেউ বকতেন না, গল্প বলার ছলে সামান্য হাসি মস্করা মিশিয়ে পড়াতেন। সময় যে কোথা দিয়ে কেটে যেত। এই নবাগতা সুবেশা তরুণী শিক্ষিকাকুলের রীতিমত অনুরাগী হয়ে পড়তাম আমরা।
কদাচিৎ আবার কেউ কেউ রাগী দিদিমণি সুলভ হাবভাবও দেখাতেন। ভাগ্যক্রমে তেমনি এক দিদিমণির সাথে সম্মুখ সমরে জড়িয়ে পড়েছিলাম আমি। ভূগোল পড়াতে এসে সামান্য ভুল তথ্য দিয়ে ফেলেছিলেন। হয়তো নার্ভাস হয়েই, কারণ ক্লাস চলাকালীনই চলত ওণাদের অ্যাসেসমেন্ট। ক্লাস রুমের পিছনের দরজা দিয়ে যখন তখন নিঃসাড়ে ঢুকে আসতেন ওণাদের শিক্ষক- শিক্ষিকারা। যদিও সেই সময় তেমন কেউ উপস্থিত ছিলেন না ক্লাসে। চিরকালের ডেঁপো আমি, দিদিমণির ভুল ধরতে পারার উত্তেজনা আর চাপতে না পেরে মুখ ফুটে বলেই বসলাম। সঙ্গত দিল আরো গুটি তিনেক সহপাঠী।
ভুল স্বীকার করে নিলেই ল্যাটা চুকে যেত, অথবা আমাদের ধমকে বসিয়ে দিলেও ব্যাপারটা ওখানেই মিটে যেত। উনি সেসব কিছু না করে সটান নালিশ করে বসলেন ওণাদের হেডুর কাছে। তিনি আবার অনুযোগ জানালেন আমাদের বড়দির কাছে। সালিশি করতে পাঠানো হল বাংলার কমলকলিদি দিকে। উনি ক্লাস এসে হাই তুলে বললেন, ‘ এই BTর বিটি(বেটি)দের নিয়ে আর পারি না। কে কি বলেছিস বাবা, যা গিয়ে মার্জনা চেয়ে ধন্য কর।’
ছুটির ঘন্টা বাজার পর সেই মার্জনাই চাইতে গিয়েছিলাম চার ইয়ার মিলে, কমন রুমে। অভিযোগকারিণী এতটাও বোধহয় আশা করেননি, ফলে মার্জনাভিক্ষা পর্ব তো বেশ নির্বিঘ্নেই সমাপন হল। বাইরে বেরিয়ে দেখি, ‘যেখানে বাঘের ভয়,সেখানেই’ ইয়ে , পিসির পরিবর্তে সেদিনই বাবা আনতে এসেছে। বাবার সামনেই বন্ধুদের ঐ প্রশ্নবাণ যে কি মারাত্মক আতঙ্ক জাগিয়েছিল, তা শুধু আমিই জানি। কোন মতে মাছি তাড়ানোর মত সবকটাকে কাটিয়ে বাবার হাত ধরে টানলাম, বাড়ি যাব। বড় রাস্তা পেরানো অবধি বাবা নীরবই ছিল, গলিতে ঢুকে ফস্ করে একটা সিগারেট ধরিয়ে, এক মুখ ধোঁয়া ছেড়ে জানতে চাইল,‘স্কুলে এক্জাক্টলি কি করেছিলি?’
বিস্তর ঢোঁক গিলে, হেঁচে-কেশে, ‘ব্রহ্মা-বিষ্ণু-কালী’ ইত্যাদি তেত্রিশ কোটি দেবদেবীকে স্মরণ করে বলেই ফেললাম সবিস্তারে। ভেবেছিলাম খুব বকবে, বকা তাও ভালো, গৃহত্যাগ না করে বসে। একবার মায়ের কথায় খার খেয়ে, বাবার নেশা ছাড়াতে এক প্যাকেট সিগারেট কুচিয়ে নষ্ট করেছিলাম, যার জন্য করেছিলাম তিনি তো ধমকে আমার গুষ্টি উদ্ধার করেছিলেন, বাবা কিছু বলেনি, কেবল গৃহত্যাগের হুমকি দিয়ে আরেক প্যাকেট সিগারেট কিনতে বেরিয়ে গিয়েছিল। যখন ফিরেছিল, ততোক্ষণে কেঁদে গোটা বাড়ি মাথায় তুলেছি আমি। সেই থেকে বৃদ্ধের গৃহত্যাগের হুমকিকে বড় ভয় আমার। সেবার অপরাধ লঘু ছিল, ফিরে এসেছিল। এবার যে কি হবে।
আমার যাবতীয় শঙ্কাকে হাওয়ায় উড়িয়ে দিল বাবা। হো হো করে হেসে উঠে বলল, ‘বেশ করেছিস। স্কুল - কলেজে অমন আমিও অনেক করিছি, বুঝলি-। শুনবি নাকি সে সব গল্প?’।
ভদ্রলোক অমনিই। বেশ খানিকটা খামখেয়ালি, আর অনেকটা, ‘সৃষ্টিছাড়া-নিয়মহারা-হিসাবহীন।’ তা নাহলে কেউ কিশোরী কন্যার হাতে জ্বলন্ত সিগারেট ধরিয়ে বলে,‘টেনেই দেখ না, কেমন খেতে-’। দোষের মধ্যে আমি জানতে চেয়েছিলাম, যে সিগারেট খাওয়া নিয়ে নিত্য অশান্তি হয় এ বাড়িতে, সেটা খেতে কেমন? নির্ঘাত খুব সুস্বাদু। অতঃপর যা হয় আর কি, বাবাকে নকল করে ধোঁয়া টানা এবং প্রবল কাশি। কাশির দমক থামলে,মায়ের উদোম খিস্তির ঝড় শান্ত হলে জিজ্ঞাসা করেছিলাম,‘এটা কেন করলে?’ ফিচেল হেসে লোকটা বলেছিল,‘আমার মেয়ে, বড় হয়ে তো ফুঁকবিই। বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে গোল্লায় যাস না। খেতে ইচ্ছে হলে আমার থেকে চেয়ে খাস।’
বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে প্রথম ইয়ে খেয়েছিলাম যেদিন,সেদিনও একই কথা বলেছিল বাবা। তখন সদ্য চাকরী পেয়েছি। মনের মত চাকরী। খড়্গপুরে পোস্টিং। দীর্ঘ ট্রেন যাতায়াতের পথে গড়ে ওঠা কিছু বন্ধুর সাথে ছুটির পর, খড়্গপুর স্টেশনের কাছে এক পার্কে বসে, আক্ষরিক অর্থেই এক ছিপি করে খাওয়া আর কি। ডাক্তার কাকুর হোমিওপ্যাথি ওষুধের মত খেতে লেগেছিল মাইরি। তাও কি ভয়। এতটা রাস্তা একা ফিরব, বাকিরা নেমে যাবে মেচেদা থেকে দেউলটির মধ্যে। নবু পইপই করে সাবধান করে দিল,‘ আজ অন্তত হ্যাংলার মত ট্রেনে গজা বা পান্তুয়া উঠলে খাস না। পারলে জানলার ধারেও বসিস না। খোলা হাওয়ায় নেশা বাড়ে-।’ নেশা -টেশা কিছুই বুঝলাম না। দিব্য দাশনগর স্টেশনে নেমে,রিক্সাওয়ালার সাথে ব্যাপক দরাদরি করে গলির মুখে নামলাম। নবু বলেই দিয়েছিল, বাড়িতে ঢোকার আগে একটা পান খেতে। গন্ধ চাপার জন্য। পানের দোকানে গিয়ে দেখি, বাবাও এসেছে সিগারেট কিনতে। আমার বাড়ি ফেরার সময়, প্রায়ই কিছু না কিছু কেনার অছিলায় গলির মুখে চলে আসত বাবা। মিষ্টি পান আমি বরাবরি ভালোবাসি, তাতেও কোন অস্বাভাবিকতা নেই। পান কিনলাম, বাবা পয়সা দিল। পান গালে পুরে, সারাদিনের গল্প বলতে বলতে ফুরফুরে মনে বাড়ি ফিরছি, বাবা হঠাৎ বলল,‘পয়সা দিয়েছিলি?’ এ্যাঁ! কি? খেই হারিয়ে জানতে চাই আমি। দুই আঙুলের ফাঁকে জ্বলন্ত সিগারেট ধরে, বাতাসে স্বভাবসিদ্ধ আঁকিবুকি কাটতে কাটতে বাবা বলল ,‘ জীবনে আর যাই করিস, পরের পয়সায় নেশাটা করিস না। আর যদি খেতেই হয়, কি ব্রাণ্ড তোর বন্ধুরা খায়, জেনে বলিস, আমি কিনে এনে দেব। এতটা রাস্তা একা আসিস, পথে কি বিপদ আপদ হয়, তার থেকে বাড়িতে বসেই না হয়-’।
একই কথা বলেছিল বাবা, যেদিন আমি কলেজ থেকে বাড়ি ফিরে অশান্তি করেছিলাম, আমার সব বন্ধুরা ইয়ে সিনেমা দেখে ফেলেছে, আমি কেন দেখিনি। রীতিমত হ্যাটা দেয় সবাই। ' গুড গার্ল ', ' আব্দেরে আলুভাতে ' বলে খেপায় সবাই। তখনও ইন্টারনেট আসেনি, লাল-নীল ছবির জন্য সিডিই ভরসা। মা তো গালি দিয়ে ভূত ভাগিয়ে দিয়েছিল, মুড়ো খ্যাংরা যে জোটেনি কপালে এই ঢের। আর বাবা বলেছিল, ‘দুয়েকটা সিনেমার নাম জেনে আসিস, আমি পার্লার থেকে সিডি এনে দেব, বাড়িতে বসে দেখে নিস।’
বাবা অমনিই, ঘোরতর বাস্তব হয়েও কেমন যেন ইচ্ছে পূরণের স্বপ্ন। শুভ জন্মদিন বাবা। খুব ভালো থাকো,সুস্থ থাকো। যেমনি আছো, তেমনি থাকো। Love you to the moon and back.
No comments:
Post a Comment