Tuesday, 20 December 2022

অনির ডাইরি ২০শে ডিসেম্বর, ২০২২

 


দাঁড়িয়েই আছি, মিনিট দশেক হয়ে গেল। আমি অবশ্য একা নেই, আসেপাশে দাঁড়িয়ে আছেন আরো অনেকেই। দূর পাল্লার একেকটা বাস আসছে, অমনি ছুটে যাচ্ছে লোকজন। কোনটা এগরা যাচ্ছে তো কোনটা পটাশপুর, কোনটা বা নন্দীগ্রাম।  আমাকে ধরতে হবে দীঘার বাস। পাশেই দাঁড়িয়ে আছে উত্তমকুমার, বললাম,  চলে যাও। তাও গেল না। আজ দিনের আলো থাকতে থাকতেই বেরিয়েছি, প্রথমবার বাসে ফিরব। সকাল বেলা পাখি পড়া করে বুঝিয়েছে উত্তমকুমার,“অনেক বাস পাবেন ম্যাডাম। দু চারটে ছেড়ে দিবেননি। সিট আছে কিনা দেখে উঠবেন। নিমতৌড়িতে সিট না পেলেও নন্দকুমার মোড়ে পেয়েই যাবেন। কন্টাক্টরকে একটু বলে রাখবেননি।”  


বেশি জল খেতেও নিষেধ করেছে উত্তমকুমার। জল যদিও আমি বেশ কমই খাই। “বুঝে শুনে জল খাবেন ম্যাডাম। অনেকটা রাস্তা। একবার আমার যা হয়েছিল নি-”। পূর্ব মেদিনীপুর সত্যিই কেমন যেন লম্বাটে জেলা। তমলুক এবং কাঁথি যদিও একই জেলার দুইটি শহর, তাও খাতায় কলমে আমার বাসা থেকে আপিসের দূরত্ব প্রায় সত্তর কিলোমিটার ছুঁইছুঁই। 


ঘটাং করে একটা বড় বাস এসে দাঁড়াল। দরজা খুলে ব্রুস লির মত লাফিয়ে নামলেন এক চশমা পরা ভদ্রলোক, অতঃপর হাঁকতে লাগলেন কাঁথি, কাঁথি করে। উত্তমকুমারকে পিছনে ফেলে, হন্তদন্ত হয়ে এগিয়ে গিয়ে কিঞ্চিৎ  ভীতু স্বরে জানতে চাইলাম, ‘সেন্ট্রাল বাসস্ট্যান্ড?’ লোকটা পাত্তাও দিল না, তাচ্ছিল্যপূর্ণ ভাবে বলল,‘উঠুন, উঠুন।’ উঠেই পড়লাম, কপাল ঠুকে। সিট থাকলে বাঁচি। 


বেশ উঁচু আর লম্বা দূর পাল্লার বাস। একদিকে তিনজন আর একদিকে দুজন বসার ব্যবস্থা। আমার আগে যারা উঠেছিলেন, তারা পিছন দিকে এগিয়ে গেলেন। দূরপাল্লার বাসের পিছনে বসাটা কতটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে বুঝলাম না, তাই সামনে থেকে গুটি কয়েক সিট পরেই যে সিট পেলাম, তাতেই বসে পড়লাম। দুই শুঁটকে চেহারার ভদ্রলোক এতক্ষণে হাত পা ছড়িয়ে বসে গপ্প করছিলেন, ‘দাদা’ বলে আমি গিয়ে দাঁড়াতে, ধারের ভদ্রলোক ভিতরে ঢুকে গেলেন। 


বাস ছাড়ল, ছাড়ার সাথে সাথেই রুদ্ধশ্বাস দৌড়। অধিকাংশ জানলারই কাঁচ বন্ধ, ফলে ভিতরটা একটু গুমোট। জানলার বাইরে ক্রমশঃ কমে আসছে আলো। সূর্য ডুবেছে কিছুক্ষণ পূর্বেই। অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম, চমকে উঠলাম কার যেন স্পর্শে। এক বিকলাঙ্গ ব্যক্তি উঠেছেন বাসে, সবার কাছে ভিক্ষা চাইছেন। বাস তো থামেনি এর মধ্যে, নির্ঘাত আগেই উঠে বসেছিলেন।  কয়েকবার মৃদু স্বরে দিদি/মা বলে ডেকেছেন বোধহয়, সাড়া না পেয়ে রড ধরে থাকা হাতটায় টোকা দিয়েছেন। বয়স কম না লোকটার, মসিকৃষ্ণ গাত্রবর্ণ। পিঠে মস্ত কুঁজ। এই শীতেও খালি গা, পরনে একটা ট্যানা। কারা কেন জিজ্ঞাসা করল,‘গরম জামা নেই?’ বিরক্ত হয়ে মাথা নেড়ে এগিয়ে যায় লোকটি। 


পাশের লোকটি হঠাৎ বলে ওঠে, ‘ গান্ধী বুড়ি’! বাইরে দিকে না তাকিয়েও বুঝতে পারি নন্দকুমার মোড় ঢুকছি। গোল চক্কর কেটে ডান দিকে বাঁকব আমরা। বাঁদিকে বাঁকলে তমলুক শহর আর সোজা চলে গেলে হলদিয়া। চৌমথার মোড়ে উন্নীত  নিশান কাঁধে দাঁড়িয়ে আছেন তমলুকের ঘরের মেয়ে। সঙ্গে তাঁর অনুগামী বৃন্দ। বাস গুলো এখানে বেশ কিছুক্ষণের জন্য দাঁড়ায়, আগেই বলে রেখেছে উত্তমকুমার। এর মধ্যে একবার ফোন করে খোঁজও নিয়ে নিয়েছে,‘ম্যাডাম সিট পেয়েছেন তো?’ ছোলা,বাদাম,মশলা মুড়ির ঝাঁকা নিয়ে হকাররা ওঠে। অনেকে নেমে গিয়ে চা খেয়ে আসেন, টুকটাক কেনাকাটা করে আনেন পথে খাবার জন্য। 


বেশি ক্ষণ দাঁড়াল না অবশ্যি বাসটা। চাকা গড়াল কাঁথি শহরের দিকে। টিকিট কাটতে এগিয়ে এলেন কন্ডাক্টর দাদা। জানতে চাইলাম, ‘সেন্ট্রাল বাসস্টান্ড কত?’ জবাব এল,‘সেন্ট্রাল বাসস্টান্ড তো যাবেনি। আপনাকে বাইপাসে নামতে হবে।’ কোন বাইপাস রে ভাই? এখানে তো গণ্ডা গণ্ডা বাইপাস। জবাব দিল বটে লোকটি, একে তো কাঁথির লোকের কথা বুঝতে সামান্য একটু সমস্যা হয় আমার তার ওপরে বাসের তীব্র গর্জন। লোকটি আশ্বস্ত করল,‘বেশী দূর নয়। আপনি হেঁটে চলে যাবেন।’ এদিকের লোকের ‘বেশি দূর নয়’ এই সংলাপটিকেও বড় ভয় পাই আমি। কতটা দূর যে ঠিক বেশি দূর এদের কাছে, বুঝতে আজও অপারগ আমি। 


একটু আগেই মেসেজ করেছিলাম শৌভিককে, ‘বাসে উঠেছি। সিট পেয়েছি।’ জবাবে একগাল হাসির ইমোজি পাঠিয়েছিল আমার বর। আবার মেসেজ পাঠালাম, ‘ ওরে, এখন বলছে, এটা সেন্ট্রাল বাস স্ট্যান্ড যায় না। কি যেন বাইপাসে নামাবে আমাকে।’ এবার ওদিক থেকে একটা কান্নার ইমোজি এল। রাগে দুঃখে আমারই চোখে জল আসছে তখন। কোন বাইপাসে নামাবে রে বাবা। বাড়ি পৌঁছাব তো ঠিকঠাক- 


নরঘাট ব্রিজ পেরিয়ে যায় গাড়ি, নীচে হলদি নদীতে তখন মিশছে সন্ধের আঁধার। পেরিয়ে যায় বাজে চণ্ডীপুর-চণ্ডীপুর-বাজকুল-হেড়িয়া। দরজার সামনের জোড়া সিটে বসা লোকটি নেমে যেতেই লটবহর সহ তার আসনটি দখল করে বসি আমি। কাতর স্বরে কন্ডাকটরকে মনে করিয়ে দিই, ভাই প্লিজ বোলো। আমি কিন্তু কিছুই চিনি না। তিনি আবার হেল্পারকে বলেন, ‘বৌদিটাকে মনে করে খড়্গপুর বাইপাসে নামিয়ে দিস তো।’ যাক এতক্ষণে বাইপাসটার নামটা অন্তত বুঝলাম। 


বাস ছুটে চলে রুদ্ধশ্বাসে মারিশদা-দুর্মুঠ-নাচিন্দা। কাঁথি বাইপাস বলে চিৎকার করে ওঠে হেল্পার ভদ্রলোক। তড়িঘড়ি উঠতে যাই আমি, পাশের অল্পবয়স্ক সহযাত্রীটি বলে ওঠে,‘দিদি আপনি পরেরটায় নামবেন।’ কৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ভালো করে কান মাথা ঢেকে নিই। কি প্রচণ্ড হাওয়া ঢুকছে বাসে। ড্রাইভার আমি আর হেল্পার ছাড়া আর কেউ জেগে আছে বলেও মনে হচ্ছে না। প্রায় পৌনে দুই ঘন্টা হল বাসে উঠেছি। 


পরের চৌরাস্তায় যত্ন করেই নামিয়ে দেয় হেল্পারটি।  আঙুল দিয়ে দেখায় কোন রাস্তাটা ধরব আমি। ছুট্টে রাস্তা পেরিয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ি আমি। রাত একটু ঘন হয়েছে। রাস্তাও বেশ ফাঁকা মহানগর বা শহরতলীর তুলনায়।কিছুই চিনি না। এবার কি করব? তাকে ফোন করব কি?পরক্ষণেই মত বদলাই, এভাবে নিজেকে তাচ্ছিল্য করা ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ। এই সামান্য কারণে তাকে বিব্রত করার মত অসহায়া অবলা অন্তত আমি নই। পাশের চায়ের দোকানের বৃদ্ধকে শুধাই, দাদা অমুক জায়গায় যাব। কি ভাবে যাব একটু বলুন না। 


গনগনে কয়লার উনুনে চায়ের কেটলি চাপাচ্ছিলেন ওণার বৃদ্ধা স্ত্রী, স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে বললেন,‘ঐ দেখো টোটো দাঁড়িয়ে আছে। ধরে চলে যাও।’ জানতে  চাই ভাড়া কত? হাবলা পেয়ে ঠকায় যদি। সে প্রশ্নেরও  জবাব দেন উনি। টোটোয় উঠি, গন্তব্য জানাই, টোটোওয়ালা জানায়, অত দূর যাবে না। কাছাকাছি একটা জায়গায় নামিয়ে দেবে। সেখান থেকে মহকুমা শাসকের করণ থুড়ি নিবাস খুব বেশি দূর না। 


রাতের কাঁথি শহরের বুক চিরে হাঁটতে থাকি আমি। দুদিকে আলোকমালায় সাজানো দোকানের সারি। কোথাও গরম পকোড়া ভাজছে তো কোথাও রসে টইটম্বুর জিলিপি। জামাকাপড়-গয়নাগাটি- বইপত্র-চশমার দোকানের সারির বুক চিরে অবশেষে যখন আপিস চত্বরে ঢুকছি, জনৈক টোটোওয়ালা জানতে চাইল, ‘যাবেন নাকি?’ কেমন রাগটা হয়! 


পরপর আপিসগুলোর অনেককটাই তখন অন্ধকারে ডুবেছে। শৌভিকের চেম্বারে যদিও আলো জ্বলছে। গাড়িও দাঁড়িয়ে আছে বাইরে। দেশোদ্ধার করছেন আমার বর বাবাজী। এর জন্য মহানগর ছেড়ে আসা একেবারে বেকার। একটুও ভালোবাসে না। দুটো সহানুভূতির কথা বলে না, কেবল ইমোজি পাঠায়।  আপদ 


বিড়বিড় করতে করতে খানিকটা এগিয়েই থমকে দাঁড়ালাম, আধো অন্ধকারে গা এলিয়ে বসে আছে দু-দুটো গাব্দা ষাঁড়। তাদের একজন সুপ্ত বটে অপরজন জুলজুল করে তাকিয়ে আছে আমারই দিকে। কোন মতে ইষ্টনাম জপতে জপতে তাদের পাশ কাটিয়ে বাংলোয় ঢুকলাম। ভেবেছিলাম সবাই আহাঃ আহাঃ করবে। উল্টে বাংলোর পাকশালা সামলায় যে ছেলেটি, সে বলল,‘মাত্র দুটো দেখতে পেলেন ম্যাডাম? ওখানে তো পনেরো বিশটা ষাঁড় থাকে। মাঝে মধ্যে কন্টাই বাজারে খেতে যায়। খেয়ে আবার পালিয়ে আসে।’ 


মা গো। আমি আর থাকব না এখানে। রোজ সন্ধ্যে বেলা এই ভাবে, ভোলে বাবা পার করে গা করতে আমি নাচার। আসুক আজ বুজুর বাবা। আগে ষাঁড় তাড়াবে তারপর অন্য কথা। ছেলেটি একগাল হেসে বলল,‘ ওরা কিচ্ছু বলে না ম্যাডাম। এই তো আমি বাজার করে ওর গায়ের পাশ দিয়ে নিয়ে এলুম, কিচ্ছু বলল না।’ দুধের কাপে চুমক দিয়ে নৈর্ব্যক্তিক ভাবে তুত্তুরী বলল, ‘বলবে না তো। সোজা উঠে গুঁতিয়ে দেবে।’ হে ভগবান সবাই আমার বিপক্ষে- আসুক আজ বুজুর বাপ।

No comments:

Post a Comment