#কাঁথিরকিস্যা
“একবার তো একটা মেয়ে সুইসাইডই করে ফেলল। রাত তখন আড়াইটা। সে কি ক্যাচাল ম্যাডাম।’ বক্তা মহকুমা শাসকের বাহন চালক।
মাস খানেক আগের কথা, তখনও শীত পড়েনি। সদ্য রঙ বদলেছে রোদ। বাতাসে লেগেছে সামান্য হিমেল স্পর্শ। যত্ন করে নতুন সাহেবকে শুঁটকি মাছ চাষ দেখাচ্ছিলেন ভদ্রলোক। মাছ ধরার পাশাপাশি, মাছ শুকানোও এই উপকূলীয় অর্থনীতির এক গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। অনভ্যস্ত শহুরে নাক হলে গন্ধটা বড় তীব্র লাগে। আগে জানলে সত্যিই আসতাম না। শৌভিক বলেছিল, পেটুয়াঘাট মৎস বন্দর দেখতে যাবে। বন্দর শুনে হ্যাংলার মত লেজুড় হয়েছিলাম তুত্তুরী আর আমি।
বন্দর দেখলাম, শৌলা আর জুনপুটে তারে ঝোলানো সারি সারি শুঁটকি মাছ দেখলাম। রঙবেরঙের ট্রলার দেখলাম। দেখেই অকুল দরিয়ায় ভেসে পড়তে ইচ্ছে করে। সাহস হয় না যদিও। বড় গন্ধ। বাঁধের ওপর দিয়ে পাকা রাস্তা চলে গেছে। পথের দুধারে দিগন্তপ্রসারী ফাঁকা মাঠ। মাঠ জুড়ে চলেছে মাছ শুকানোর কাজ। কোথাও খুঁটি পুঁতে, দড়ি টাঙিয়ে ঝোলানো রয়েছে সারি সারি বিভিন্ন প্রজাতির মাছ, কোথাও বা মাটিতে গর্ত করে পোঁতা, কোথাও বা সেই পুঁতে রাখা মাছকে তুলে ঝাড়াই-বাছাইয়ের কাজ চলছে। মাটি থেকে মাছ আলাদা করে জড় করা হচ্ছে স্তুপাকারে। মাছ শুকানোর কাজ মূলত বাড়ির মহিলারাই করছেন। হাত লাগিয়েছে সদ্য তারুণ্যে উপনীত হওয়া ফ্রক পরা মেয়ের দল ও।
এদিকের মাটিটা বেশ বালি মেশানো। ড্রাইভার সাহেব বললেন কয়েক দশক পূর্বেও এই অঞ্চল ছিল সমুদ্র গর্ভে। রীতিমত ঢেউ খেলত। বাঁধের গায়ে আছড়ে পড়ত লবণাক্ত জলরাশি। এখন অবশ্য তিনি পিছিয়ে গেছেন বেশ অনেকটা। জোয়ারের সময় অবশ্য বেশ কিছুটা এগিয়ে আসেন আজও। বাঁধের দুদিকে যত খানাখন্দ আছে, তাদের মধ্যে একদিকের জল মিষ্টি, অন্যদিকে লবণাক্ত। একদিকে প্রচুর সব্জি ফলেছে, অন্যদিকে পুকুর কেটে চলছে মাছ চাষের কাজ। প্রকৃতি হেথায় বড়ই উদার। সবকিছুই দিয়েছেন উজাড় করে। সবকিছুরই বড় প্রাচুর্য হেথা। ড্রাইভার সাহেব বললেন, ‘এদিকের লোককে মাছ কিনে খেতে হয় না স্যার।’
দেখতে দেখতে, শুনতে শুনতে, গ্রাম বাংলার রূপ- রস- গন্ধ- বর্ণে মোহিত হয়ে ফিরে চলেছি আমরা কাঁথি শহরের দিকে। একথা অনস্বীকার্য যে সমুদ্র দেখার সুপ্ত ইচ্ছে নিয়ে এসেছিলাম, ব্যর্থ মনোরথ হয়েই ফিরছি, তবে তাই নিয়ে তেমন ক্ষুন্নি বোধ নেই আমাদের।
বেশ অনেক বছর ধরে কাঁথির মহকুমা শাসকের বাহন চালাচ্ছেন ভদ্রলোক। মহকুমাটাকে হাতের তালুর মত চেনেন। অনেক গল্প জানেন,বলতেও ভালোবাসেন। সাহেবের অনুমতি নিয়ে সামান্য ঘুরপথে নিয়ে চলেছেন আমাদের। উদ্দেশ্য হল মৎস দপ্তরের কি যেন একটা দীঘি দেখানো। সে দীঘি নাকি আয়তনে তেপান্তরের মাঠের সমান। কাকচক্ষুর মত টলটলে তার জল। অতি দক্ষ সাঁতারুও নাকি এপাড়- ওপাড় করতে হারিয়ে ফেলেন দম। চুনোপুঁটিদের পাশাপাশি রাঘববোয়ালরাও সেথা হাত-পা ছড়িয়ে সাঁতার কেটে বেড়ায়। শুধু ছিপ ফেলার অপেক্ষা। অবশ্য ছিপ ফেলতে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের অনুমতি লাগে।
গাড়ি চালাতে চালাতে বিভিন্ন সাহেব-মেমসাহেবদের সময় ঘটে যাওয়া না না ঘটন- অঘটনের গল্প শোনাচ্ছিলেন ভদ্রলোক। জনৈক সরকারী কর্মচারীর আত্মহত্যা তারই অঙ্গ। কোন এক নিশুতি রাতে গলায় দড়ি দেয় মেয়েটি। পাকেচক্রে কাঁথির তৎকালীন মহকুমা শাসক সে রাতেই কাঁথিতে উপস্থিত ছিলেন না। কি যেন দপ্তরী কাজে আটকে পড়েছিলেন দীঘায়। মধ্যরাত্রি অবধি দিব্যি জেগেই ছিলেন তিনি, ফোন সাইলেন্ট করে শুয়েছেন তার কয়েক ঘন্টার মধ্যেই এত বড় অঘটন ঘটায় মেয়েটি।
অকালে ঝরে যাওয়া এক অপরিচিতা কন্যার জন্য বেদনার্ত হয়ে ওঠে হৃদয়। আহা রে। না জানি, কত যতনে লালনপালন করে বড় করে তুলেছিল বাবা মা। সেই সন্তান যদি এমন অবিবেচকের মত, নিজেকে শেষ করে দেয়, কিছু বলার থাকে না। উনিও সম্মতি জানান,‘ ঠিক বলেছেন ম্যাডাম।’ জানতে চাই, মেয়েটি কেন এমন করেছিল,কারণ জানা গেছে কি? কাজের চাপ নাকি মানসিক অবসাদ? জবাব আসে, ওসব তো ছিলই, সাথে অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছিল প্রেম।
আবার গল্পে ফিরে যান ভদ্রলোক। বলতে থাকেন গভীর রাতে যখন আবিষ্কৃত হয় মেয়েটি অমন অঘটন ঘটিয়েছে, কতৃপক্ষ আতঙ্কিত হয়ে ফোন করে মহকুমা শাসককে। তখন রাত আড়াইটে। ওণার ফোন সাইলেন্ট ছিল, ফলে ফোন ধরতে কিঞ্চিৎ বিলম্ব হয়। ইত্যবসরে মেয়েটিকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় এবং মৃত বলে ঘোষিত হয়। পরে যখন সাহেব/মেমসাহেব জানতে পারেন তিনি কিছুক্ষণের জন্য মানসিক ভাবে রীতিমত বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। এমন নয় যে সেরাতে তিনি ফোন ধরলে মেয়েটি বেঁচে যেত, তবুও-।
প্রাক্তন ওপরওয়ালা(ঈ) র প্রতি একরাশ মায়া মাখানো কণ্ঠে ঘাড় ঘুরিয়ে প্রশ্ন করেন ভদ্রলোক, ‘ আপনিই বলুন স্যার, এতে সাহেব/মেম সাহেবের কি দোষ? রাত আড়াইটের সময় আপনাকে যদি কেউ ফোন করে, আপনি ধরবেন-’!
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে, “হ্যাঁ” বলে লম্বা ঘাড় নাড়ে শৌভিক। ‘ আমার ফোন সারা রাত খোলা থাকে, কখনও সাইলেন্ট থাকে না। খুব গুরুত্বপূর্ণ মিটিং এ না থাকলে আমি সব ফোন ধরি।’ থতমত খেয়ে গাড়ি চালানোয় মন দেন ভদ্রলোক। হাসি চাপি আমি, সত্যিই আমার বর ফোন ধরে ভাই। রাতবিরেতে , সময়- অসময়ে সবসময় ধরে। ধরতে পারে না কেবল যখন ইয়ে করতে যায়। কপালের এমন গেরো,যে ওই ঘরের চৌকাঠ ডিঙানো মাত্রই লাইন দিয়ে আসতে থাকে ফোন। ঘন্টি শুনে ছুট্টে এসে দরজার বাইরে থেকে চিল্লাই আমি বা তুত্তুরী, অমুকের ফোন/ তমুকের ফোন/ অজানা নম্বর থেকে আসা ফোন ইত্যাদি প্রভৃতি।
এই অজানা নম্বর থেকে আসা ফোন গুলির মধ্যে আবার কেউ কেউ থাকেন, যাঁরা ফোনটি না ধরা পর্যন্ত করতেই থাকেন- একবার, দুবার, তিনবার। ওদিকে ফোন চিৎকার করে এদিকে আমি, ‘ওরে আমার বরটাকে ইয়েটা করতে দে বাপ।’ কতবার হয়েছে দাঁত মাজতে মাজতেও ফোন ধরেছে শৌভিক। এমনকি কুলি থুড়ি কুলকুচি করতে করতেও। বিগত বছর দেড়েকে আমাদের দাম্পত্য আলাপ তথা কলহও হয়েছে অমনি, থেমে থেমে, পূর্ণচ্ছেদ, কমা, কোলন, সেমি কোলন ইত্যাদি দিয়ে। ওটা যে কাজেরই অঙ্গ, সেটা বুঝে, মেনে নিয়েছি আমরা। অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি আমরা।
এর মধ্যে শুধু একদিনই ফোন সাইলেন্ট রেখেছিল শৌভিক, যেদিন প্রযুক্তি গত কি যেন গড়বড় হয় আর লক্ষ্মীর ভাণ্ডার সংক্রান্ত একটা মেসেজের সাথে সাথে ওর মোবাইল নম্বরটা পৌঁছে যায় তমলুক মহকুমার ঘরে ঘরে, মা লক্ষ্মী দের মুঠোয় রাখা মুঠি ফোনে। পরিণতি সহজেই অনুমেয়। মিনিটে মিনিটে আছড়ে পড়তে থাকে, ৩০/৪০ খানা ফোন প্রবাহ। একটা ফোন ধরে, ছাড়ার আগেই হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ছিল গুচ্ছ গুচ্ছ কল ওয়েটিং। সে এক রাত গেছে বটে। আক্ষরিক অর্থেই ছেড়ে দে মা (লক্ষ্মী), কেঁদে বাঁচি।
তখন কি আর জানতাম যে বছর ঘোরার আগেই ঘটতে চলেছে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি । দিন তিন চার আগের কথা, কাক ডাকা ভোর থেকে বানের জলের মত আসতে শুরু করল ফোন। সেবার ফোনের ওপারে শুধু মা লক্ষ্মীরা ছিলেন, এবার অবশ্য কোন লিঙ্গবৈষম্য পরিলক্ষিত হল না। সবার একই প্রশ্ন, একই অনুরোধ " স্যার, অমুক প্রকল্পে নাম ওঠেনি। একটু আমার ব্যবস্থা করে দিন স্যার।" যে প্রকল্পের জন্য ফোন,তা আদৌ মহকুমা শাসকের দপ্তর থেকে দেখা হয় না। প্রথম জনা পঞ্চাশকে সেটাই বলল শৌভিক। শান্ত ভাবে জানাল,কোন অফিসে যোগাযোগ করতে হবে। এমনকি এটা যে আপাতত কেবল পঞ্চায়েত এলাকায় হচ্ছে, পুরসভায় নয়,তাও বোঝালো কাউকে কাউকে। এই জেলা তথা মহকুমার লোকজন এমনিতে খুব বাধ্য,বললে অযথা তর্ক করে না। অবশ্য ব্যতিক্রম তো সর্বত্র বিদ্যমান। তেমনি এক ব্যক্তি বেশ বকেই দিলেন আমার বরটাকে। " আপনার অফিসে হবে না যখন, আপনার নম্বর দিয়েছেন কেন?"
কোথায় নম্বর দিলাম রে বাবা,আকাশ থেকে পড়ে শৌভিক। ধীরে ধীরে ঝুলি থেকে বেরোন বাঘের মাসি। এক স্থানীয় সংবাদ পত্রের জনৈক সাংবাদিক মহাশয়, উক্ত প্রকল্পটি নিয়ে এক আগুনে প্রতিবন্ধ লিখেছেন। লিখতে লিখতে উদ্দীপনার বশে তিনি এই জেলার চার মহকুমা শাসকের ব্যক্তিগত নম্বরগুলিও টুকে দিয়েছেন। বিশদ জানতে ফোন করুন বা নালিশ জানান- এই ধরণের কোন শিরোণামে।
পত্রিকাটি যেহেতু কাঁথিতেই প্রকাশিত হয়, স্থানীয় লোকজনই কেবল পড়েন ফলে নম্বরটা হাতে হাতে ছড়িয়ে পড়েছে আগুনের মত। পরিণতি অনুমেয়।আপদে বিপদে মানুষ অবশ্যই ফোন করবে, করেও, কিন্তু তাই বলে ওটা যে আদৌ কোন প্রকল্পের হেল্পলাইন নম্বর নয়, ওই সংক্রান্ত রিপোর্টে করো নম্বর ছাপতে হলে অন্তত তার মৌখিক অনুমতি টুকু নেওয়া দরকার, তথাকথিত সাংবাদিকদের থেকে এইটুকু নৈতিকতা কাঙ্ক্ষিত বটে, কে আর তার মর্যাদা দেয়। ভাগ্যে জনগণের স্মৃতিশক্তি অত্যন্ত দুর্বল, আজকের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলি গুণোত্তর প্রগতিতে হারাতে থাকে তাদের তাৎপর্য, সেটাই আপাতত আমাদের ভরসা।
No comments:
Post a Comment