জন্মদিন নিয়ে এমনিতে খুব একটা কিছু প্রত্যাশা থাকে না তুত্তুরীর, একটু মায়ের হাতের পায়েস, একটা কেক আর মধ্যাহ্ন ভোজনে পাঁচরকম সাজিয়ে দেওয়া পদ। জন্মদিনের সকালে খেতে বসে বাটি গোনে তুত্তুরী, আর নির্ভেজাল মুখস্থ বলে যায় কোন বছরের জন্মদিনে কটা বাটি সাজিয়ে দিয়েছিলাম আমি। ভিতরের রান্না যতই ছাপোষা ঢ্যাঁড়স সিদ্ধ বা আলু পোস্তই দিই না কেন, শেষ বিচারে বাটির সংখ্যাই নির্ধারণ করে জন্মদিন তথা আমার সেই বছরের মাতৃত্বের সাফল্য। বিগত বছরের জন্মদিন বরবাদ করে অতিমারিতে আক্রান্ত হয়েছিলাম আমরা মা আর মেয়ে দোঁহে। তাই এবছরের জন্মদিন ঘিরে একটু বেশিই উৎসাহী ছিল কন্যা আমার।
কিন্তু জীবন থোড়াই এগোয় পরিকল্পনা মাফিক। জন্মদিনের ঠিক দু সপ্তাহ আগে ‘বিনা মেঘে বজ্রপাত’। ইনটেনসিভ কেয়ারে ভর্তি করতে হল মাকে। সাড়ে তিন বছর অবধি বুকে করে তুত্তুরীকে মানুষ করেছে মা। তুত্তুরীর বিরহে তলিয়ে গেছে গভীর মানসিক অবসাদে। আজ এই একাদশ বর্ষ অন্তেও মায়ের প্রাণ ভোমরার নাম শ্রীমতী তুত্তুরী।
একদিকে ইনটেনসিভ কেয়ারে লড়াই করছে মা, অপরদিকে বাক্সপ্যাঁটরা গুছিয়ে বাড়ি ছাড়ছে শৌভিক। জেনেশুনেই তো এই চাকরীতে ঢুকেছি আমরা, ভোগ করেছি যাবতীয় গৌরব, সুবিধা এবং ক্ষমতা। আজ পারিবারিক বিপর্যয়ের অজুহাতে তাকে আটকাই কোন মুখে।
ফ্ল্যাট জোড়া শূণ্যতা আর চরম অসহায়তা মেখে পড়ে থাকি আমি আর আমার তুত্তুরী। মায়ের জন্য ছুটি নিই, ছুটির নাম, ‘চাইল্ড কেয়ার লিভ। ’ হাওড়া-কলকাতা, হাসপাতাল-ঘর, বৃদ্ধ অসহায়তর ভোম্বল বাবা আর জীবনের সাথে লড়াই করা মা সামলে, ক্লান্ত দেহে বাড়ি ফিরি রাত আটটা/নটা বা সাড়ে নটা। বৃষ্টি নামলে আগেভাগে ফোন করে সাবধান করে দেয় তুত্তুরী। ‘ওলাতে এসো না কিন্তু।’
গভীর রাতে, রাতপ্রদীপের নীলচে আলোয় হাত ধরাধারি করে গল্প করে ক্লান্ত মা, আর মেয়ে। লুকিয়ে চুরিয়ে ওঠে জন্মদিনের কথা। চোখের জল চেপে বলি, ‘বাবা যদি ছুটি না পায়। আর মামমাম যদি হাসপাতাল থেকে না ফেরে-। ’ পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে মায়ের মা হয়ে, মাকেই সামলাতে বসে তুত্তুরী। ‘কোন ব্যাপার নয় মা। তুমি একটু পায়েস করে দিও শুধু। তাও যদি সময় না পাও, কাকিমা করে দেবে।’ সমঝদার মেয়েকে বুকে আঁকড়ে কখন যে ঘুমিয়ে পড়ি কে জানে-
জন্মদিনের ঠিক পাঁচদিন আগে ছাড়া পায় মা। সেই মুহূর্তেই ঠিক করেছিলাম, শৌভিক যদি নাও ছুটি পায় তবুও অন্তত গোটা দশেক বাটি সাজিয়ে দেবোই এবার মেয়েকে। দোকান বাজারের অভ্যাসটা এখনও তেমন রপ্ত হয়নি, তা নাই হোক। শেষ পর্যন্ত অবশ্য জন্মদিনের আগের সকালেই বাড়ি ফেরে শৌভিক। কাঁধ থেকে ব্যাগ নামাতেই হাতে ধরাই ফর্দ। টুকটাক জিনিসপত্র কিনেছি বটে, মাছ বিশেষতঃ মাংসটা ওকেই আনতে হবে বাপু। চোখের সামনে মুরগি বা ছাগল কাটলে ওখানেই অক্কা পাব আমি।
জন্মদিন যদিও সোমবার, তবুও রবিবার সকাল থেকেই শুরু তোড়জোড়। চাটনি, পায়েস আমি বরাবরই আগের রাতে করে রাখি। অনেকটা সময় বাঁচে। বেটে রাখি মশলা। থোড়-মোচার ঝামেলা থাকলে কুটে রাখি তাও। আর চেষ্টা করি ম্যারিনেট তো বটেই পারলে কষে রাখতে মাংসটাকে। আগের রাতে কষা মাংসের সোয়াদ কেন জানি না ডবল হয় পরদিন। হয়তো ঝাল মশলাগুলো একটু বেশীই গভীরে প্রবিষ্ট হয়।
আমি নিজে চিকেন রাঁধতে এবং খেতে ভালোবাসি। কিন্তু কন্যার আব্দার জন্মদিনে মায়ের হাতের তুলতুলে মাটন। কিন্তু মা তো জীবনে মাটন রাঁধেইনি। অন্য বছর হলে ভাগিয়ে দিতাম, এবছর এত পাশে থেকেছে মেয়েটা আমার, মায়ের হাসপাতালবাসের মধ্যেই পরীক্ষা পড়েছিল মেয়েটার, ছিটেফোঁটাও দেখার অবকাশ ছিল না আমার। একাকী পড়াশোনা করে পরীক্ষা দিয়েছে মেয়ে। এমনকি হিন্দিও। যার প্রশ্নপত্রই পড়তে পারছিল না প্রথমে। তাই ঠিক করেছিলাম, শৌভিক যদি নাও আসতে পারে, মাটন তো আসবেই। শ্বশুরমশাই আশ্বস্ত করেছিলেন, চোখের সামনে ছাগল কাটা দেখতে হবে না আমায়। কারণ, ‘ম্যায় হুঁ না। ’
রবিবার সকালে অবশ্য শৌভিকই নিয়ে আসে মাংসটা। আর আমি তাতে বেশটি করে সর্ষের তেল, বেশ অনেকটা নুন, হলুদ গুঁড়ো, লঙ্কা গুঁড়ো আর বেশ খানিকটা মধু মাখিয়ে জরতে দিই । মধু মাখালে কেন জানি না, মাংসের স্বাদটাই যায় বদলে। ম্যারিনেট করা মাংস ঢাকা দিয়ে ফ্রিজে তোলার পর মনে পড়ে, একবার পার্লার গেলে মন্দ হয় না। কদিনের ঘোরাঘুরিতে রোদে পুড়ে, ঘামে ভিজে মুখচোখের যা চেহারা হয়েছে- দেখে আঁতকে না ওঠে পার্লারের দিদি, এটাই যা ভয়।
পার্লার থেকে ফিরে, দ্বিপ্রাহরিক মাছের ঝোল ভাত খেয়ে,বহুদিন বাদে সপরিবারে ছোটখাট দিবানিদ্রা দিয়ে, সূয্যি মামা পাটে বসলে, চাটনি চাপাই আগুনে। প্রথমে ভেবেছিলাম আমের অম্বল করব। কিন্তু কি বাজে মাইরি, এখনকার কাঁচা আমগুলোর সোয়াদ। একেবারে আলুর মত-। তার থেকে সাবেকী টমেটো-খেজুর- আমসত্ত্বের চাটনিই ভালো।
টমেটো গুলো চার টুকরো করে অল্প নুন ছিটিয়ে ঢাকা দিয়ে সিদ্ধ করতে বসাই, পাশ থেকে চিন্তিত স্বরে তুত্তুরীর মাসি বলে, ‘প্রেশারে দিতে পারতে। এখনকার টমেটো গুলো যা-’।
অতঃপর ‘হে ঠাকুর টমেটো গুলো সিদ্ধ করে দাও প্রভু’। প্রার্থনা না নির্মম ভাবে আধসিদ্ধ টমেটো গুলোকে থেঁতলানো কার দয়ায় জানি না, মাসিকে ভুল প্রমাণ করে অচীরেই গলে যায় টমেটোর দল। চিনির কৌটো উল্টে দিই, একফোঁটাও টক খেতে পারে না যে আমার গৃহকর্তা। ছড়াই খেজুর আর অল্প কিশমিস। খেজুর গুলো সামান্য গলে না গেলে কিছুতেই আসে না ঐ অমৃতের স্বাদ আর গন্ধ। ঠিক উল্টো কথা প্রযোজ্য অবশ্য আমসত্ত্বের ক্ষেত্রে। যাতে গলে না যায়, নামানোর ঠিক আগে মেশাই কেটে রাখা আমসত্ত্বের টুকরো। রান্নাঘরের জানলার বাইরে ঘনায় সন্ধ্যে। দীর্ঘদিন বাদে ঘরে ফেরা বাবার সাথে দাবা খেলতে খেলতে টেরিয়ে তাকায় তুত্তুরী, ওই চাটনি নামল বুঝি।
চাটনি শেষে পায়েসের পালা। দুটো পাত্রে দুধ ফোটাতে বসাতে হয়। 'ছোটা সনসার হামার', তেমন বড় পাত্র কোথা পাই। তাই মিটমিটে আঁচে বিটবিট করে ফোটে ভাগের দুধ। লাল লাল চাপচাপ পায়েস ভালোবাসে এরা দাদু থেকে বাপ আর মেয়ে। আর ভালোবাসে কাকিমা। তবে জনা দশেকের জন্য পায়েস বানালে অত ঘন তো করা যাবে না, তারপর যদি কারো ভাগে কম পড়ে। ফ্রিজে রাখলে কিঞ্চিৎ বসে যাবে এটাই যা সান্ত্বনার-। শেষ পর্যন্ত অবশ্যি বেশ জমিয়েই বসেছিলেন তিনি।
পায়েসের ভাগের দুধ ঘন হয়ে এককাট্টা হয়, অন্য গ্যাসে রাতের রান্না বসায় মাসি। বউয়ের ব্যস্ততা দেখে শৌভিক প্রস্তাব দেয়, রাতের খানা না হয় বাইরে থেকে হোক আনা-। সটান নাকচ করে দেয় মাসি। পাঁচ দিন বয়স থেকে মানুষ করেছে তুত্তুরীকে, মায়ের শাসন থেকে আগলে রেখেছে পাখির মত। তুত্তুরীর পাকযন্ত্র মাসির থেকে ভালো কে বোঝে। কাল যদি ঐ সব চর্ব্য চোষ্য খেতে হয়, আজ রাতে নিছক ডাল-ভাত-আলুসিদ্ধ-ডিম সিদ্ধ খাবে বাড়ি শুদ্ধ সব্বাই।
রাত সাড়ে নটায়, গ্যাস ফাঁকা পেয়ে অবশেষে চাপে মাংস। সাবেকী পদ্ধতিতে কড়ায় সর্ষের তেল গরম করে, তাতে গুটি চারেক শুকনো লঙ্কা, অল্প গোটা গরম মশলা, তেজপাতা, আর জিরে দিয়ে ভাজতে দিই আগে কুচিয়ে রাখা সরু সরু করে কুচানো পিঁয়াজ। ভাজা হতে থাকা কুচানো পেঁয়াজে মেশে নুন, হলুদ গুঁড়ো, লাল লঙ্কা আর কাশ্মীরী লঙ্কা গুঁড়ো। হলুদ আর লঙ্কা গুঁড়া দিয়ে ভাজলে দারুণ সুন্দর লালচে রঙ আসে মাংসে। এটা আমি আবিষ্কার করেছি ইউটিউব ঘেঁটে। আর যা যা আবিষ্কার করেছিলাম সবই প্রায় ভুল প্রমাণ হলেও, এই টোটকাটা দারুণ কাজে আসে। অল্প তেল মশলায়ও কি লাল গরগরে ঝোল হয় মাইরি।
কুচানো পেঁয়াজ কাদা হয়ে এলে, তাতে পরপর মেশে রসুন বাটা, আদা বাটা। পড়ে জিরে আর ধনে গুঁড়ো। গ্যাস কমিয়ে মেশাই ফেটানো টক দই। ইয়ে এটাও ইউটিউবের দৌলতে শেখা। আগে যতবার দিতাম, জল কেটে পুরো ম্যাচাকার হয়ে যেত সব। আজকাল গ্যাস কমিয়ে বা সময় থাকলে নিভিয়ে মেশাই টকদই। ভালো করে একবার মিশিয়ে নিন, তারপর বাড়ান না গ্যাস যত চান। কে আটকাচ্ছে আপনাকে।
তেল ছাড়া কষা মশলায় সবার শেষে মেশে সকাল থেকে ম্যারিনেট করে রাখা মাটন। আর কিচ্ছু করব না। মাঝে মাঝে হাল্কা নেড়ে দেওয়া ছাড়া। অল্প আঁচে, ঢাকা কড়ায় পাক হতে থাকে তুত্তুরীর মায়ের মাটন। রাত পৌনে বারোটা নাগাদ যখন গ্যাস অফ করি, দু আঙুলে ছিঁড়ে আসে মাটন।
ঘড়ির কাঁটা যখন মধ্যরাতি ছোঁয়, মটকা মেরে পড়ে থাকা মেয়ের ঘাড়ে পড়ে তাকে জন্মদিনের হাজার চুমু দিতে দিতেও একই চিন্তা ঘোরে মাথায়। সবে তিনটি বাটি হল। এখনও বানাতে হবে আরো সাতটা বাটির খানা। ‘কালিয়া- কোর্মা-পোলাও’ না, এমন কিছু, যা হবে, ‘সস্তায় পুষ্টিকর’।
তুত্তুরীর প্রিয় পেঁয়াজ, পাঁচ ফোড়ন আর শুকনো লঙ্কা ফোড়ন দিয়ে মুসুর ডাল না হয় ভরল চার নম্বর বাটি। পাঁচ নম্বর বাটির জন্য পেঁয়াজ দিয়ে ঝিঙে আলু পোস্ত বানাতে গিয়ে দেখি, ঝিঙেটাই আনেনি শৌভিক বাজার থেকে। বলতে গেলে চোখ রাঙায়। এখন ঝিঙে নাকি এমন পাকা, যে কেউ খায় না। বদলে চিচিঙে এনেছে আমার বর। তাই সই, পঞ্চম বাটি সাজুক চিচিঙে আলু পোস্তয়। ষষ্ঠ বাটিতে থাকবে আমার প্রিয় পনীর ভুনা মশলা। ভট্টচার্য বাড়ির কোন ছেলেমেয়ে পনীর ভালোবাসে না। তবে আমরা বউরা তো বাসি। না হয় আলোকিত করবে তুত্তুরীর জন্মদিনের থালা, কিন্তু এটা না হয় বানাব শুধু আমাদেরই জন্য।
ভুনা মশলা বানাতে হলে আগে ভুনা অর্থাৎ ভেজে নিতে হয় কাঁচা উপকরণ গুলি। যথা কুচানো পেঁয়াজ, গোটা আদা এবং রসুনের কোয়া। এরপর তাদের বাটতে হয় মিক্সিতে। এইটুকুই যা কাজ। বাকি ভীষণ সহজ।
কড়ায় অল্প তেলে একখান বড় এলাচ, অল্প জিরে আর তেজপাতা ফোড়ন দিয়ে ভুনা মশলাটা সামান্য নাড়াচাড়া করে, তাতে মেশাতে হয় টমেটোর কাত্থ, আর আমাদের চিরকালীন হলুদ- লঙ্কা-জিরে-ধনে গুঁড়ো। আর স্বাদমত সামান্য চিনি। সবার শেষে গ্যাস অফ করে টক দই। টমেটো আর টকদই দুটোই পড়ে তাই একটু সাবধানে করতে হয়, না হলে একে তো টক হয়ে যায় বেশী আর দ্বিতীয়ত জল বেরোয় এক কলসী। এরপর আর কি, কষে তেল বেরোলে, পরিমাণ মত জল দিয়ে ফুটতে থাকলেই মিশিয়ে দিতে হয় আগে থেকে কেটে রাখা পনীরের টুকরো। পনীর গুলো ভাজা হয় না বলে, অসম্ভব নরম আর ক্রিমই হয় বস্তুটা। শেষে গ্যাস অফ করে হাফ চামচ ঘি আর গুটি কয় গোটা চেরা কাঁচা লঙ্কা দিয়ে ঢাকা দিয়ে রাখতে হয়। করে দেখবেন, যেমন ভালো পোলাও এর সাথে চলে,তেমনিই ভালো চলে তন্দুরী, নান বা হাতে গড়া রুটির সাথে।
সপ্তম বাটিতে বরং থাকুক তুত্তুরীর প্রিয় মিষ্টি মিষ্টি চিংড়ি পোস্ত। মালাইকারি বানাবারই ইচ্ছে ছিল, কিন্তু নারকেল আর কোথায় পাই। এখন নারকেল আনতে বললে, ভস্মই করে দেবেন হয়তো গৃহকর্তা। তাই পোস্তর সাথে মেশাই চার মগজ বাটা।
বাকি অতি পরিচিত রেসিপি, চাপড়া চিংড়ির খোসা ছাড়িয়ে, সামান্য নুন হলুদ জলে ভাপিয়ে নিয়ে, সর্ষের তেলে অল্প নেড়েই তুলে নিই আমি। মা বলত নাহলে সিঁটে হয়ে যায়। এটা হাওড়া না মুর্শিদাবাদের ভাষা জানি না, সোজা কথায় একটু বেশি ভাজলেই ছিবড়ে হয়ে যায় মাছগুলো।
মাছ তুলে নেবার পর পড়ে থাকা তেলে, পাঁচ ফোড়ন পড়ে। অতঃপর ভাজা হয় সামান্য কুচানো পেঁয়াজ। পেঁয়াজের রঙ সোনালী হলে তাতে মেশে হলুদ গুঁড়ো, চারমগজ বাটা আর কাঁচা পোস্ত বাটা। মেশে দই আর চিনি। মশলা কষে জল ঢালার পর আগে থেকে ভেজে রাখা মাছগুলো মিশিয়ে দিই আমি। চিংড়ি- পোস্ত-মগজদানায় মাখো মাখো হয়ে এলে, হাল্কা লালচে তেল ছাড়লে তবে নিভবে গ্যাস।
বাড়ছে বেলা। বেদম হচ্ছে পা আর হাঁটু। অষ্টম আর নবম বাটিতে থাকুক ঝালঝাল ঝাঁঝালো ডিম সর্ষে আর মিষ্টি-মিষ্টি দই কাতলা। দুটো রান্নার মালমশলা প্রায় একই। একদিকের কড়ায় গরম সর্ষের তেলে পড়ে পাঁচফোড়ন আর একটা ছিঁড়ে দেওয়া শুকনো লঙ্কা। ভাজা লঙ্কার সৌরভে রান্নাঘর মথিত হলে তাতে মেশে, বাটা সর্ষে আর কাঁচা লঙ্কার অমৃত মিশ্রণ। বেশী ঝাঁঝালো হলে নাকের জলে, চোখের জলে হবে কন্যা আমার। তাই মেশাই সামান্য বাটা পোস্ত। মশলা ভাজা হয়ে এলে মেসে অল্প টক দই আর গোটা লঙ্কা। কষতে কষতে তেল বেরিয়ে এলে সামান্য জল আছড়া দিয়ে তারওপর জাস্ট রেখে দিই আগে থেকে সিদ্ধ করা শক্ত ডিমটা। বাটিতে ঢালার আগে ভালো করে ওলটপালট করে নিলেই হবে। চুপিচুপি বলি পিসিশাশুড়ীর থেকে শেখা রেসিপিটা তুত্তুরীর থেকেও আমার বেশী প্রিয়।
পাশের গ্যাসে ভাজা হন কাতলা দেবী। দইকাতলা একেকজন একেক রকম ভাবে রাঁধেন, সবথেকে সহজ আর চটজলদি রেসিপিটাই অনুসরণ করি আমি। নুন-হলুদ মাখিয়ে ভাজা মাছের তেলেই দিই জিরে, শুকনো লঙ্কা আর তেজপাতা, গোটা গরমমশলা ফোড়ন। মাছে পেঁয়াজ দিলে খুব অখুশি হন শাশুড়ি মা। তবে দইকাতলায় একটু পেঁয়াজবাটা না দিলে তেমন স্বাদ আসে না আর গ্রেভিটা ঘনও হয় না। তাই দিই একটা ছোট্ট বাটা পেঁয়াজ। ভাজা হয়ে এলে মেশাই অল্প আদা বাটা আর মগজদানা বাটা। মেশাই ছিটেফোঁটা হলুদ আর লঙ্কা গুঁড়ো, ঐ অনবদ্য রঙটার জন্য। কষা হয়ে এলে জল ঢেলে ভাজা মাছগুলো ফুটিয়ে নিলেই রেডি।
দশম বাটি নিয়ে চাপ নেই। ওটা তো মিষ্টি আর চকলেটেই ভরে উঠবে। যার চুলচেরা ভাগ হবে পরে। এত কষ্ট করে রান্না করছি কার জন্য? আর সে চকলেটের ভাগ দেবে না, আমায়?
দশম বাটিটা এককালে ছিল তুত্তুরীর ভাত খাবার রূপার থালা। অন্নপ্রাশনে উপহার দিয়েছিল দাদু আর মামমাম। এতটুকু থালাতে এই সেদিনও জন্মদিনের ভাত খেতে বসত তুত্তুরী। এবছর সেই দাদুরই নির্দেশে বার করতে হয়েছে আমার বিয়ের দানের কাঁসার বাসনপত্তর। যার মধ্যে দুটো বাটি আমি বাতিল করেছি সাইজ দেখে। বাপস্ পাক্কা দৈত্যের বাটি দিয়েছিল বাবা। পান নেই যদিও, তবুও সাজিয়ে দিই নর্তকীর মুখের মত দেখতে পানের ডাবরটাও।
শুধু শুভ বিবাহ লেখা পালিশ করা দানের থালাটা সরিয়ে রেখে, বার করেছি আমার মুখে ভাতের কাঁসার থালাটা। সুদূর মুর্শিদাবাদের এক প্রত্যন্ত গাঁ রামনগর থেকে পাঠিয়েছিল আমার দিদা। খাস খাগড়ার কাঁসা। পিছনে কালো ছোপ। এতো নিছক থালা নয়। এতে মাখানো আছে আমার দিদার ঘ্রাণ। সবই তো ভাগ করেনি মেয়ের সাথে, আজ ভাগ করে নেবো আমার দিদার স্মৃতি আর আশির্বাদ।
ভাতের সাথে নাকি পাঁচ রকম ভাজা দেবার নিয়ম, অত আর পারব না বাপু। ব্যথায় টনটন করছে পায়ের প্রতিটা পেশী আর কোমর। আর তেমনি বেপোট গরম মাইরি। আরেকবার স্নান না করলে গলেই যাব মনে হয়। এ বছরের মত গোল গোল বেগুনী, পাঁপড় আর সপ্তাহের বাটা মাছ ভাজা দিয়েই জন্মদিন হোক। পাঁচ আর তিনে কি আর তফাৎ বাপু। আর তেমন কিছুই নেই ভাজার মত। আলু ছাড়া। যা ভাজতে আমি মোটেই আগ্রহী নই। ধীরে ধীরে গরম হচ্ছে মটকা। সমাধান বাতলে দেন শ্রীমতী তুত্তুরী স্বয়ং। 'কাকরোল আর করলা ভেজে দাও না মা'। কাকরোল আর করলা? কি অসাধারণ কম্বো মাইরি। এই নাহলে শ্রীমান শৌভিকের আত্মজা।
রেঁধে বেড়ে সাজিয়ে গুছিয়ে, ছবি তুলিয়ে তো দিলাম, শ্রীমতী তুত্তুরী খেলেন কেবল পায়েস, চাটনি, পাঁপড় ভাজা, ডাল, ভাত আর চিংড়ি মাছ। আহাঃ এই না হলে আমার মেয়ে। বাকি রান্না থাক তোলা। আর রান্নাঘরে ঢুকছি না আপাততঃ দিন তিনেক। অনেক হয়েছে মা। ভাগ্যে জন্মদিন বছরে একবার আসে-
No comments:
Post a Comment