Friday, 20 August 2021

অনির ডাইরি ২০শে আগস্ট, ২০২১

 


বাড়ির বিয়ের আনন্দই আলাদা।  বিশেষ করে আমাদের মত অভাগাদের জন্য, যাদের জীবনের শেষ বিয়েবাড়িটা বোধহয় ২০১৯ এ পড়েছিল। নাকি ২০১৮? তা কি আর মনে আছে বাপু।  


প্রায় এক বচ্ছর আগে থেকে চলছে পরিকল্পনা, পাল্টা পরিকল্পনা। কি পরব, কবে পরব। কি আছে, কি কিনতে হবে ইত্যাদি। কেন জানি না, প্রতিটা বিয়ে বাড়ির আগেই আমার মনে হয়, না তো পরার মত ভালো শাড়ি আছে, না মানানসই গয়না। বললেই চশমার ওপারে গোলগোল হয়ে যায় শৌভিকের চোখ। আলমারি ভর্তি, ওগুলো কি তাহলে? বরের কথা বাদ দিন। বরেরা অমনি বলে। 


পাড়ার হাবিব এর অমিতের একটা মেকআপ চ্যানেল আছে, তাতে অমিত নিজেই মেকআপ করে আপলোড করে সুন্দর সুন্দর ছবি আর ভিডিও। দেখে মেয়েরা পাগল হয়ে যায়, আর অচেনা পুরুষ সিংহের দল গাল দেয় ‘ছক্কা’ বলে। আমি অবশ্য অমিতের গ্রাহক নই, আমার মাথায় অমিতকে হাতও দিতে দেয় না সুরজিৎ, তবুও গেলেই ফাঁকফোকর খুঁজে গল্প করে অমিত। দেখায় ওর করা মেকআপের ছবি। আর বলে, ‘তুমি এসো, তোমায় আমি ডিসকাউন্টে করে দেবো। তোমার রেফারেন্সে কেউ এলেও-’। 


পিসতুতো দেওরের বিয়ে ঠিক হতেই তাই অমিতকে বলে রাখি, আগামী আগস্টে আমার বিয়ে বাড়ি। দেওর-ননদদের আর মাত্র জনা কয়েকেরই আইবুড়ো নাম খণ্ডানো বাকি। তাই ভালো করে সাজতে গুজতে তো হবেই। সম্পর্কে পিসি শাশুড়ী হলেও,বিয়ের জন্মলগ্ন থেকেই মণিকে নিজের পিসির মতই পেয়েছি  আমরা দুই বউ অর্থাৎ উমা আর আমি। যেহেতু উমার থেকে বেশ কিছুটা বড় আমি, এসেছিও বেশ কিছু বছর আগে, তাই আমার সাথে পিসিমণির সম্পর্কটা কিছুটা বন্ধুত্বপূর্ণও বটে। আর পিসেমশাই থুড়ি ছোটে কাকা তো আমাদের ডার্লিং। শ্বশুরবাড়িতে এসে থেকে এত ভালোবাসা পেয়েছি এই ভদ্রলোকের কাছ থেকে লিখতে গেলে আদ্র হয়ে ওঠে হৃদয়। আমাদের দুই বউয়ের বিয়েই হোক বা শ্রীমতী তুত্তুরীর অন্নপ্রাশন বা ভট্টাচার্য বাড়ির কোন শুভকাজই হয় না এই দম্পতি বিনা। তাদের জীবনের সবথেকে বড় শুভকাজ, এতে অনুপস্থিত  থাকলে গর্দান থাকবে নাকি? 


রীতিমত প্যাড পেন্সিল নিয়ে বসে হিসেব করি উমা আর আমি, কবে কি রঙ পরব। দুজনের আলমারির শাড়ি মিলিয়ে চলে হিসেব নিকেশ, আমারটা তুই পরিস,তোরটা আমি- তাহলে কি হবে? আর গয়না? অমিত বুদ্ধি দেয়, ওসব সোনারূপা ছাড়ো, বাগড়ি মার্কেট থেকে গয়না কিনে আনো। যেমন ফিনিশ তেমনি সস্তা। প্লানও বানাই আমরা দুই অসমবয়সী বধূ, ৪৬ নম্বর বাসে করে গিয়ে, বকুলতলা বা রাইটার্সের কাছে নেমে, পায়ে হেঁটে বাগড়ি মার্কেট যাব আমরা। আর দর করব কোমর বেঁধে। 


তার পরপরই ঘটে যায় কত্ত কি-। বেরিয়ে যায় শৌভিকের মহকুমা শাসকের অর্ডার, হাসপাতালে ভর্তি হয় মা, আর কলেজে নতুন সেশনের অ্যাডমিশনের দায়িত্বটা পুরোই চাপে টুকলু অর্থাৎ আমার আদরের দেওরের কাঁধে। বরের সঙ্গে দুর্গাপুর রওণা দেয় উমা। ঘেঁটে যায় যাবতীয় পরিকল্পনা, মাথায় ওঠে বাগড়ি মার্কেট, তুমি আমায় ডোবালে আর তুই আমায় ডোবালির দ্বন্দ্বে কে যে কাকে মির্জাফর বলব ভেবে পাই না আমরা। 


এরই ফাঁকফোকর গলে, এক ফোঁটা সময় বার করে, এক বর্ষণ মুখর দুপুরে পিসিমণির বাড়ি হামলা করি দুই বউয়ে। যাবার পথে উমাকে নিয়ে যাই ছুঁচ ফুটিয়ে, মহা বদ ব্যাটা, ভ্যাকসিন না নিয়ে বসে থাকা! চেনে না তো আমায়। গাড়িতে গোটা রাস্তা ভয় দেখাতে দেখাতে নিয়ে যায় উমা, ‘দিদিভাই, আমার কিন্তু মাথা ঘুরছে। জ্বর আসছে, কাশি আসছে-’। সত্যি সত্যি ভয় পেলেই হেসে গড়িয়ে পড়ছে, কি জ্বালা।  


পিসিমণির দ্বিপ্রাহরিক নিদ্রার তেরোটা বাজিয়ে ঘেঁটে দেখি আমরা নতুন বউয়ের নতুন নতুন শাড়ি,কুর্তি, গয়না, আশির্বাদী হার আর ফুলশয্যার আংটি। প্ল্যাটিনামের ওপর জ্বলজ্বলে এক কুচি হীরে দেখে মোহিত হয়ে বাড়ি ফিরি আমরা। কোভিড বিধি মেনে বিয়ে, বিয়ের রাতের প্রথম পঞ্চাশের মধ্যে নেই আমরা, থাকবই বা কেন, প্রথম পঞ্চাশের অর্ধেক তো কনের বাড়ির লোকজনই থাকবেন আর বাকি অর্ধেকে অগ্রগণ্য বয়োজ্যেষ্ঠরা। তাতে কি? বাড়ির বিয়ে বলে কথা- বিয়ের দিন সকালটা তো আমাদের, আছে বধূবরণের দিন সকালটাও আর বৌভাতের রাত। বৌভাতের সকালে বউয়ের হাতের ঘি ভাত বা পায়েসের ওপর অধিকার বাড়ির বয়োজ্যেষ্ঠদের। রাতটা অবশ্য আমাদের কুচোকাঁচাদের। আমাকে কুচোকাঁচাদের মধ্যে ধরার জন্য বিগলিত হয়ে যাই মাইরি। 

প্রতি মুহূর্তে বদলায় কবে ‘কি পরব তালিকা“। গায়ে হলুদে হলুদ পরাই রীতি, কিন্তু মায়ের সাদা গোলিপী মুগা যে বড় নজর কাড়ে। শুনে একটা অফ হোয়াইট শাড়ি বার করে বসে উমাও। শুনেই আঁতকে ওঠে পিসিমণি,পাগল নাকি, কে কোথায় হলুদ লাগিয়ে দেবে শাড়িতে, ও দাগ আর জম্মে উঠবে। ধ্যাৎ তেরি।  শেষ পর্যন্ত কমলা একখান শাড়ি মনোমত হয় বটে, শেষ পরেছিলাম কোন একবছর মেলায় যেন। ঠিক কমলা না পেলেও একটা চুনেহলুদে রঙ খুঁজে বার করে উমা। 


সব হিসেব করে গুছিয়ে তমলুকের উদ্দেশ্যে রওণা দিই আমি। হতাশ পিসিমণি আর উমাকে আশ্বস্ত করি বারবার, বিয়ের দিন সকালে ঠিক হাজির হব নটার মধ্যে, সে আমি যেখানেই থাকি না কেন। মাঝপথে কোথায় যে হারিয়ে ফেলি নথটা, শুনে উল্লসিত হয়ে ওঠে উমারাণী, ‘বেশ হয়েছে দিদিভাই।  আমি সাতসকালে ন্যূনতম সেজে যাবারও সুযোগ পাব না, আর তুমি পরবে নথ-’। আরেঃ সে সাজিয়ে দেব খন আমি,যা যা লাগবে বুঝিয়ে বলে দিই আনতে। 


সময়মতো পেয়েই যাই নথটা খুঁজে,বিয়ের দিন পৌনে ছটায় উঠে, ঘুমন্ত মেয়েকে টেনে তুলে স্নানিয়ে সাজিয়ে সাড়ে সাতটায় বেরিয়ে পড়ি, শুধু এক কাপ চা খেয়েই। আঃ বাড়ির বিয়ে বলে কথা। নটা দশের মধ্যে পৌঁছে খুঁজি উমাকে। কোথায় গেল মেয়েটা? সময়মতো ঢুকতেও পারে না? আজব অপদার্থ মাইরি। আমি তমলুক থেকে বালি এলাম, আর মহারাণী কলকাতা থেকে আসতে পারে না। বেলা বাড়ে, গায়ে হলুদের তেলের পাত্র আর হলুদের বাটি ধরানো হয় আমায় আর তুত্তুরীকে। পইপই করে বুঝিয়ে দেন পিসিমণির ননদ, মুন্নি পিসি,‘অনিন্দিতা ঠিক সে সমঝো, পহলে গণেশ জী নামবেন। তারপর তেলের ঘটি, তারপর পানপাতা দিয়ে সাজানো, হলুদ আর মেহেন্দির পাত্র।’ তাকে ঘিরে রাখা সবুজ কাঁচের চুড়ি হাতে পরবে নববধূ। দীর্ঘদিন বঙ্গদেশের অধিবাসী, বাঙালী রমণীর পতি তবুও আদতে তো উত্তরপ্রদেশের বাসিন্দা পিসেমশাইয়ের পূর্বপুরুষ। কাশীর কাছে ওণাদের ‘পুস্তেইনি হাভেলী’ আজো বর্তমান আভিজাত্যের চিহ্ন কাঁধে। ছবি দেখিয়েছিল ছোটেকাকা থুড়ি পিসেমশাই। যদিও কাজের দরকারে গোবলয়ে গেলে লোকে ওণাকে বাঙালী বলেই মনে করে। বিয়ের পর থেকে ছোটেকাকা পিসিমণির হাতের উচ্ছে চচ্চড়ি আর কুমড়োর ঘ্যাঁটই খেয়ে আসছেন, ইস্টবেঙ্গলকে সাপোর্ট করেন এবং সুযোগ পেলেই আমাকে ঘটি বলে খ্যাপান। তুমুল রেগে গেলে বলেন, ‘আমি কি বাঙালী রে?আমার কাছে তোরাও যা, ওরাও তাই। ’ মহা সুবিধাবাদী ভদ্রলোক মাইরি।  


ঝমঝমে বৃষ্টি মাথায় গাড়িতে উঠি মা আর মেয়ে। ছোটে কাকা নালিশ করে যায়, ‘উমারা বেলুড় চলে গেছে-’। যেন উমার অভিভাবক আমি। গাড়ি আর ছাড়ে না, অন্যান্য গাড়িগুলিতে তত্ত্ব তোলা হতেই থাকে, সাড়ে নটা নাকি চল্লিশ, দরজা খুলে মুখ বাড়ায় ভীতু ভীতু এক জোড়া চোখ। ‘দিদিভাই!’ শুনেই রাগ ধরে যায়। ভাগো ইঁয়াসে। এই গাড়িতে জায়গা হবে না। 'আচ্ছা' বলে ভয়ে ভয়ে অন্য গাড়িতে জায়গা খুঁজতে যায় উমা। বাঃ দারুণ মেয়ে তো। একবার না বলে দিলেই চলে যায়? জানে না আমার রাগের স্থায়িত্ব আড়াই মিনিট। আবার হাঁক পাড়ি আমি,‘থাক। আর অন্য গাড়িতে উঠতে হবে না। এটাতেই চেপে আমায় ধন্য করো। ’ চোরের মত গাড়িতে ওঠে উমা। পৌনে দশটা বাজে, এখনও ছাড়ে না গাড়ি, পাশ থেকে করুণ স্বরে প্রশ্ন করে তুত্তুরী, ‘মা তোমায় বকেছে, তাই তুমি আর আমার সাথে কথা বলবে না, না কাকিমা?’ আমাকে টপকে আদরও করতে পারে না উমা তার সোনাইকে। কোন মতে বলে, ‘না না। বলব তো।  আগে দিদিভাইয়ের মাথাটা একটু ঠাণ্ডা হোক। ’ 


মাথা ঠাণ্ডা তো তখন হবে, যখন জানা যাবে দেরীটা হল কেন? নির্ঘাত টুকলুই কিছু করেছে। তৈরী হতে সময় লাগিয়েছে,অথবা দেরী করেছে ঘুম থেকে উঠতে। হাঁহাঁ করে ওঠে উমা,’না দিদিভাই,ওর কোন দোষ নেই। তুমি তো শুনলেই না কি হয়েছিল।’ উফঃ এত পতিগত প্রাণা এই ভদ্রমহিলা। অতঃপর শুনতেই হয় দেরী পুরাণ। সামাণ্য ভুলে নির্ধারিত গলি ছাড়িয়ে চলে যাওয়া এবং ঘুরে আসার পথে গাড়ি খারাপ হয়ে যাবার গল্প শুনে মন খারাপ হয়ে যায় আমার। ইশ! কিছু  না জেনেই বকেছি গো মেয়েটাকে। প্রশ্রয় পেয়ে গলার জোর বাড়ে উমার,‘হ্যাঁ গো দিদিভাই, সে কি ধোঁয়া। আমরা তো ভাবলাম গাড়িতে আগুনই লেগে গেল। ড্রাইভার খালি বলে, আভি হো জায়েগা। শেষে মিনিট দশ পনেরো পর, ঐ বৃষ্টিতেই নেমে পড়লাম আমরা। ওকে বলা হল, তুই বাবা গাড়ি নিয়ে গ্যারাজে যা। সারিয়ে নিয়ে আয়। আর আমরা কোন মতে রাস্তা পেরিয়ে একটা টোটো ধরে ছুটতে ছুটতে আসছি। ’


অতঃপর আমার সাড়ে ৫২বার ক্ষমা চাওয়া আর পুরষ্কার স্বরূপ তত্ত্বের দই এর হাঁড়িখানা উমার কোলে চাপিয়ে দেয় ছোটে কাকা। বাপরেঃ কি ভারী গো, বললে ছোটেকাকা বোধহয় শুনতেই পায় না, এক গাল হেসে বলে, ‘দেখছিস কি সুন্দর হাঁড়িটা দেখতে। খাস অর্ডার দিয়ে আনানো বুঝলি। ওপরে কেমন গোপাল আছে দেখ,দেখ। ননী চোরা বালগোপাল। ’ মাথা নাড়ে উমা। বালগোপাল গোটা রাস্তা লক্ষ্মী হয়ে হাঁড়ির মাথায় বসলে বাঁচি, লাফিয়ে পালিয়ে গেলেই চিত্তির। আর আমার শাড়িতে যদি দই লাগে, তো হাঁড়িওয়ালিকে রাস্তাতেই নামিয়ে দেব কিন্তু হাঁড়ি সমেত। সাথে তার সোনাইকেও- হাসিমস্করায় ছাড়ে গাড়ি। আরো বারো বার সরি বলি আমি,আর ওরা দুটোতে বলে, ‘এবার অন্য কথা বললে হয় না। সরি সরি করে মাথা ধরিয়ে দিল মাইরি। ’ আঃ বাড়ির বিয়ে বলে কথা-

No comments:

Post a Comment