Friday, 20 August 2021

অনির ডাইরি ১৩ই আগস্ট, ২০২১

 


নামটা শুনেছিলাম বিয়ের আগেই। সে অনেককাল আগের কথা। এক যুগ তো বটেই, তারও বেশী। আইনানুগ বিবাহ হয়ে যাবার পর থেকেই শ্বশুরমশাইয়ের নির্দেশ ছিল, সপ্তাহান্তে একটি বেলা যেন আমি হবু শ্বশুরবাড়িতে কাটাই। গোঁড়া রক্ষণশীল পরিবার আমাদের, এসব সাহেবীয়ানায় ঘোর আপত্তি মায়ের। কিন্তু সদ্য কর্কটরোগাক্রান্ত শ্বশুরমশাইকে না বলার সাধ্য কার? 


অগত্যা প্রতি শনিবার, সামান্য বেলায় ঘুম ভেঙে মায়ের হাতের এককাপ চা খেয়েই উঠে বসতাম তেঘরিয়া মিনিতে। প্রাতঃরাশ না করে বসে থাকত বৃদ্ধ আর তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র। তারপর হবু বরের হাতে সেঁকা কড়কড়ে টোস্টে জবজবে করে মাখানো মাখন দিয়ে প্রাতঃরাশ সারতাম তিনজনে। শাশুড়ী মা যথারীতি কিছুই খেতেন না। তবে আমাদের সাথে বসে গল্প করতেন অনেক। তেমনি একদিন শুনেছিলাম তাঁর কথা।  ‘কাল তোমার কাকিমারা সব এসেছিলেন- কেকা, স্বপ্না, সন্ধ্যা। ’ শুনলাম বটে, চিনলাম না কাউকে। পাশ থেকে হবু বর জানালো, 'এনাদের মধ্যে কেকা অর্থাৎ মণি কাকিমা হল তোমার বড় সাহেবের বউ।'


 বড় সাহেব অর্থাৎ মণিকাকা অর্থাৎ তৎকালীন অ্যাডিশনাল কমিশনার শ্রী অরুণকান্তি ভট্টাচার্য মহাশয়। বসের,বসেরও  বস।আমাদের সার্ভিসের সিনিয়রতম সদস্য। দূর থেকেই দেখেছি কেবল মিটিংএ। ডায়াসের ওপর রাখা মস্তচেয়ারে গম্ভীর মুখে বসে থাকতে। যিনি মুখ খুললে তো বটেই, গলা খাকরি দিলেও স্তব্ধ হয়ে যেত যাবতীয় গুঞ্জন। এহেন বড় সাহেবের ভ্রাতুষ্পুত্রের আমি ঘরণী হতে চলেছি- 


যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই সন্ধ্যে হয়, কয়েক সপ্তাহ পরের এক শনিবার। দ্বিপ্রাহরিক মধ্যাহ্নভোজের মধ্যেই মণিকাকার ফোন, কোথায় যেন বেরিয়েছিলেন সস্ত্রীক, পথে একবার ঢুঁ মেরে যাবেন তাঁর আদরের ছোটদার বাড়ি। শুনে তো এঁটো হাতেই বাড়ির বাস ধরি আমি, কান ধরে বসালেন শ্বশুরমশাই, ‘আরেঃ এত ভয়ের কি আছে? অফিসের চৌহদ্দির মধ্যে উনি তোমার বস্। বাড়িতে তো নয়। এখানে শুধুই মণিকাকা। ’ 


দরজার বেল বাজল। স্টাডিরুমে সিঁটিয়ে  আছি আমি, কিছুতেই যাব না, এত বড়,মস্ত বড় সাহেবের সামনে। বসার ঘর থেকে ভেসে এল কার যেন রিনিরিনি কণ্ঠস্বর, ‘ওমা ভয় পাচ্ছিস কেন? আয় আয় দেখি।’  চৌকাঠের অপর পারে এক অপরূপা মধ্যবয়সী ভদ্রমহিলা। মাথায় অবশ্য আমারই মত ছোট্টখাট্ট, ধপধপে গায়ের রঙ। চোখে সরু ফ্রেমের চশমা। পরণে গুজরাতি কাজ করা সুতির শাড়ি আর ঠোঁটে মোহন হাসি। সেই দণ্ড থেকে মণিকাকা স্যার রয়ে গেলেন বটে, ম্যাডাম হয়ে গেলেন মণি কাকিমা। 


অগ্নিসাক্ষী করে বিয়ের পরদিন আয়লা মাথায় নিয়ে প্রবেশ করলাম শ্বশুরবাড়ি। সর্বত্র এক হাঁটু জল। ঝড়ের দাপটে ছিঁড়েছে ইলেক্ট্রিকের তার, আছড়ে পড়ছে গাছের পর গাছ। পথে আটকে পড়েছে বাকি আত্মীয়স্বজনেরা। বধূবরণ করবে কে? পূর্ববঙ্গীয় নিয়মনীতি কিছুই তেমন জানেন না শাশুড়ী মা, ভয়েই অস্থির। উপস্থিত শুধু মণিকাকা আর কাকিমা। আজ মধ্যরাতে, নিকষ আঁধারে ঘেরা এই বাংলোর বারন্দায় বসে বারবার মনে পড়ছে সেইদিনটার কথা, আমায় বরণ করে ঘরে তুলেছিল মণিকাকিমা। 


ঝড়ে কাঁপছে কলকাতা, সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মনখারাপের বোঝা। ফুঁপিয়ে-ফুঁপিয়ে, ডুগরে-ডুগরে কাঁদছি শুধু আমার মায়ের জন্য। চিরকালই বাবার মেয়ে আমি। মা যেন বড় বেশী নিঃসঙ্গ, হয়তো অবহেলিতও।  প্রতিটা পলে মনে পড়ছে, কবে কি দুর্ব্যবহার করেছি মায়ের সাথে,শুনিয়েছি কি কটু কথা আর সরু ব্লেড দিয়ে যেন কেউ চিরে দিচ্ছে হৃদপিণ্ডটাকে। বড় আদরের পুত্রবধূ আমি, আমার কান্না সহ্য হয় নাকি বৃদ্ধ শ্বশুরের। অসহায় শ্বশুরমশাই গিয়ে ধরলেন মনিকাকিমাকে,‘কেকা মেয়েটাকে থামাও। ’ হাত ধরে ঘরের বাইরে টেনে আনল মনিকাকিমা,‘ তুই খামোকা কাঁদছিস কেন আমায় বল? আমরা কি এতই খারাপ লোক?’ 


না মণি কাকিমা, মোটেই খারাপ নও, বরং ভীষণ ভীষণ ভালো তোমরা। আমরা অর্থাৎ আমি এবং উমা অনেক ভাগ্য করে পেয়েছিলাম তোমাদের সবাইকে। বিয়ের জন্মলগ্ন থেকে শ্বশুরবাড়ি সুলভ কোন অনুভূতি কখনও জাগতে দাওনি তোমরা। কখনও ভিন্ন চোখে দেখোনি এবাড়ির মেয়েদের আর বউদের। পুঁচি, বুজান, দুষ্টু,সোনাইয়ের থেকে যে আলাদা অনিন্দিতা আর উমা, তা কখনও মনে হয়নি আমাদের। আজও হয় না। ভুলেই যাই আমরা ভট্টাচার্য বাড়ির মেয়ে নই, বধূ।  


এইভাবে, এত জলদি তোমার চলে যাওয়াটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না মণিকাকিমা। কল্পনাও করতে পারছি না মণিকাকার মানসিক অবস্থা। বাইরে থেকে বড় রুঠা মণিকাকা, একদম তোমার উল্টো। স্থিতধী।  কিন্তু ভিতরটা যে বড় নরম, নইলে ঠিক চারদিন আগে, লিখত না মণিকাকা যে, ‘সামান্য বেপরোয়া হলেই যিনি আমাকে শাসন করতেন, তিনি এখন অর্দ্ধ-চেতন। অসহ্য এ-স্বাধীনতা।’ সেদিন সর্বান্তঃকরণে প্রার্থনা করেছিলাম, সুস্থ হয়ে ওঠো তুমি। সেজেগুজে মিষ্টি হেসে আবার এসে দাঁড়াও সবার মাঝে, আমার মতই বরণ করে নাও আমার উত্তরসূরীদের। সব প্রার্থনা কেন যে সত্যি হয় না।

No comments:

Post a Comment