Friday, 20 August 2021

অনির ডাইরি ১৫ই আগস্ট, ২০২১

 


‘এই খানেই গুলি খেয়ে লুটিয়ে পড়েছিলেন না শহীদ মাতঙ্গিনী হাজরা?’ প্রশ্ন করল শৌভিক। শ্যাওলা ধরা এক বাঁধানো পুকুরের ধারে সবে দাঁড়িয়েছে শৌভিকের গাড়ি। পুকুরের একধারে সাদা রঙের দোল মঞ্চ বা নহবৎ খানার মত একখান ইমারত, যার বুক এফোঁড়-ওফোঁড়  করে চলে গেছে পিচের রাস্তা। ঐ রাস্তা ধরেই হেঁটে যেতে হবে আমাদের। এটাই আজ আমদের তিন নম্বর গন্তব্যস্থল।  সেই সকাল সোয়া আটটা থেকে শুরু হয়েছে পতাকা উত্তোলন পর্ব। 


সবার আগে শৌভিকের নিজের দপ্তরে। শুনেছি জেলা যখন যখন অবিভক্ত মেদিনীপুর ছিল তখনও এখানেই বসতেন তমলুকের মহকুমা শাসক। পিছনে লাগানো বোর্ড অনুসারে আমার বর তমলুকের ৮০তম মহকুমা শাসক। জেলা যখন ভাগ হল, তখন তড়িঘড়ি এই অফিসের ওপর তোলা হল নতুন মঞ্জিল। আর মহকুমা শাসকের দপ্তর রাতারাতি ভোল বদলে হয়ে গেল জেলা শাসকের করণ। এই তো সেদিন পর্যন্ত এই আপিসেই বসতেন জেলা শাসক। নিমতৌড়ির ঝাঁ চকচকে নতুন কালেক্টরেট তো জীবন পেয়েছে গত বছরের ডিসেম্বর মাস থেকে। আর পুরাতন মহকুমা শাসকের দপ্তর হয়েছে পুনর্মুষিক ভবঃ।  


নিমতৌড়ির কালেক্টরেটে ঠিক নটার সময় পতাকা তুলবেন মাননীয় জেলা শাসক মহোদয়, সেখানে হাজিরা দিয়ে তমলুক জেল। গাল ভরা নাম, তমলুক সাব-কারেকশনাল হোম। দণ্ডাজ্ঞা  প্রাপ্ত আসামী নয়, কেবলমাত্র বিচারাধীন বন্দীরাই এই হোমের বাসিন্দা। পদাধিকার বলে তমলুকের মহকুমা শাসক আবার এই জেলের সুপারও বটে। জেলের প্রতি আমাদের বংশানুক্রমিক দুর্বলতা। রীতিমত দাগী পরিবার বলতে পারেন। স্বর্গীয় পিতামহ তো জেল খেটেছেন খাস মান্দালয়ে, তস্য ভ্রাতা জেল খেটেছেন, 'ইয়ে আজাদী ঝুটা হ্যায়' আন্দোলন করতে গিয়ে। জেঠু জেল এড়িয়ে যেতে পারলেও, পারেনি বাবা এবং ছোটকাকু। নকশাল পিরিয়ডে হাজতবাসের কথা বলতে বলতে আজও কেমন যেন স্মৃতিমেদুর হয়ে ওঠে বাবা। 


শৌভিক জেলে পতাকা তুলবে, শুনেই অনুরোধ করেছিলাম, যদি সঙ্গী হিসেবে গণ্য করে এ অধমে। জবাবে শুনেছি, জেলের নিয়ম ভীষণ কড়া। প্রবেশাধিকার অত্যন্ত দুর্লভ। এমনকি সুপার হওয়া সত্ত্বেও, সশস্ত্র দেহরক্ষীকে বাইরে রেখে ঢুকতে হয় আমার বরকেও। তবুও মেয়ে- বউয়ের আব্দার বলে কথা, সসঙ্কোচে জেলার সাহেবকে অনুরোধ করেছিল শৌভিক, যদি আর কি- 


জেলের বাইরেই সাজানো ছিল শহীদ বেদী। গেরুয়া- সাদা-সবজে আবিরে আঁকা এবং লেখা, '৭৫ তম স্বাধীনতা দিবস।' প্রতীক্ষায় ছিলেন জেল কর্মীরা। সুপার পৌঁছাতেই শুরু হল, অভিবাদন। তারপর পতাকা তোলা, জাতীয় সঙ্গীত গাওন। তারপর হাজিরা খাতায় সই করে, ভিতরে ঢোকা।


 তেরঙা বেলুন দিয়ে সাজানো হয়েছে জেল। বানানো হয়েছে মস্ত শহীদ বেদী। তাকে সাজানো হয়েছে ফুল আর আবির দিয়ে। শহীদ বেদীকে ঘিরে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে পুরুষ কয়েদিরা। পুষ্পস্তবক, ব্যাজ নিয়ে আমাদের স্বাগত জানাতে এগিয়ে এলেন মহিলা বন্দিনীদের দল। সংখ্যায় বেশ কম। তাদের মধ্যে কয়েকজনকে দেখে অবাঙালি মনে হয়, চপচপে করে তেল দিয়ে বাঁধা খোঁপা, সিঁথিতে ডগডগে লাল বা মেটে সিঁদুর। হিজাব পরা রমণীও আছেন। আর আছে কয়েকটি তরুণী কন্যা। যে মেয়েটি ফুলের তোড়া দিল বা ব্যাজ আটকাল,  জেলের প্রটোকলের ভয়ে তার নাম ছাড়া আর কিছুই জানতে পারলাম না। শুনলাম ২০১৮ সাল থেকে বিচারের প্রতীক্ষায় জেলে আছে মেয়েটি। কি অপরাধে কে জানে? আর এক মহিলা জানালেন ওনার হাজতবাসের মেয়াদ শুরু সেই ২০১৬ থেকে। কে জানে মুক্তি কবে, আর কি সংবাদ বয়ে আনবে সেই মুক্তির বাতাস। 


বক্তৃতা দিতে উঠে এটাই বলল শৌভিক, ' আজ স্বাধীনতা দিবস, আর স্বাধীনতার অর্থ সেই জানে, এক লহমার জন্য হলেও ক্ষুণ্ন হয়েছে যার স্বাধীনতা। আজকের দিনটির তাৎপর্য তাই আপনাদের থেকে বেশি কেউ বুঝবে না।' 


জেলের অধিবাসী এবং বাসিনীদের সঙ্গে সামান্য সময় কাটিয়ে, একরাশ শুভেচ্ছা আর শুভকামনা বিলিয়ে আমরা চলেছি তৃতীয় গন্তব্যের অভিমুখে। জনৈক স্থানীয় সমাজ সেবী খোদ নিমন্ত্রণ করেছেন শৌভিককে। 


 ধুতি আর খদ্দরের পাঞ্জাবি আর মুখে ডবল মাস্ক পরে ভদ্রলোক সটান হাজির হয়েছিলেন শৌভিকের চেম্বারে। দোতলায় উঠে হাঁফাতে হাঁফাতে বলেছিলেন, 'আমার বয়স ৮২ বছর, আমি অমুক শিশু নিকেতনের সাথে জড়িত। একটু যদি স্বাধীনতা দিবসের দিন দয়া করে আমাদের হোমে পদধূলি দেন।' ওনার বয়স শুনেই এককথায় রাজি হয়ে গিয়েছিল আমার বর। 


শিশুনিকেতন থেকে বেশ খানিক দূরে শ্যাওলা ধরা পুকুর পাড়ে গাড়ি রেখে পায়ে হেঁটে যেতে হয়। বগলে শান্তিনিকেতনী ব্যাগ ঝুলিয়ে, খদ্দর পরা বৃদ্ধ নিজে অপেক্ষা করছিলেন আমাদের জন্য, সঙ্গে এক অপেক্ষাকৃত বৃদ্ধতর ব্যক্তি। শৌভিককে সপরিবারে পেয়ে কি যে অসীম খুশি দুই বুড়োতে। নিজেরাই কোথা থেকে বয়ে আনলেন প্লাস্টিকের চেয়ার, নিষেধ করার আগেই তাদের দিলেন স্যানিটাইজার দিয়ে স্নান করিয়ে। তারপর পীড়াপীড়ি করতে লাগলেন, ' একটু বসুন আজ্ঞে।' বিশাল হোমটা আপাততঃ খাঁ খাঁ করছে। করোনার জন্য বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে শিশুদের। তবুও কি উৎসাহ দুই বৃদ্ধের। তিনতলা তুলবেন, পাশের ফাঁকা জমিতে তুলবেন নতুন বিল্ডিং। জেলাশাসককে ধরে পাশ করিয়েছেন প্ল্যান।পেয়েছেন স্যাংশনও। টাকাও ঢুকে যাবে কিছুদিনের মধ্যে। বেলা এগারোটার পিঠ পোড়ানো রোদে, ঘুঘু পাখির ডাক শুনতে শুনতে, কড়া মিষ্টি দেওয়া দুধ চায়ে চুমুক দিতে দিতে শোনালেন কত যে গল্প,শোনালেন এক দামাল ছেলের গল্প।  পাশেই হ্যামিল্টন স্কুলে পড়ত সে ছেলে। তখন এই অঞ্চল ঢাকা ঘন জঙ্গলে। পড়ত থোড়াই, কেবল দস্যিবৃত্তি করে বেড়াত। গাছের মগডাল থেকে পেড়ে আনত ফলের গোছা, ঝপাং করে ঝাঁপ দিত পুকুরে। মাছ ধরে, ঘুড়ি উড়িয়ে দিব্যি কাটছিল দিন,তারপর কি যে হল- হঠাৎ একদিন বদলে গেল ছেলেটা। ঘুড়িলাটাই ফেলে তুলে নিল পিস্তল। তারপর কি যে হল, আর বয়স বাড়ল না ছেলেটার। ইতিহাস তাকে আজও চেনে শহীদ ক্ষুদিরাম বলে। 


 ইতিহাসই তো, তমলুক শহরের অলিতে গলিতে ছড়ানো শুধুই ইতিহাস। নাঃ ওই পুকুর পাড়ে গুলি খেয়ে লুটিয়ে পড়েননি বটে শহীদ মাতঙ্গিনী হাজরা। পড়েছিলেন আর একটু দূরে। সেদিন ওনার সাথে তমলুক শহরের বিভিন্ন রাস্তায়, মোড়ে গুলি বিদ্ধ হন আরো ১১জন মানুষ। আর পাশের মহিষাদলে আরো ১৩ জন। এই টুকু ছোট্ট শহরে সেদিন যথার্থই বয়েছিল রক্তগঙ্গা, সে গল্প শুধু জানে সময়, আর জানে চারণ কবিরা।তবে তারাই বা আজ কোথায়? 


 চলে আসার সময়, দুই বৃদ্ধ বারবার অনুরোধ করলেন, ‘আবার আসবেন, আর যদি পারেন দুটো কাজের লোক খুঁজে দেন আজ্ঞে। আমাদের যা বয়স হয়েছে, এই বুড়ো হাড়ে আর পারি না গো আমরা। কোন দিন সেরিব্রাল হয়ে মরে যাব দেখবেন আজ্ঞে।কত জনকে বললাম, একটু দায়িত্ব নে বাবারা, তা এরা তো কেউ ঘাড়ই পাততে চায় না স্যার।’

No comments:

Post a Comment