‘চা খাবে দিদি?’ দিদি অর্থাৎ বাবার দিদি, আমার সবে ধন নীলমণি একমাত্র পিসি। বাপের বাড়িতে পা রাখার সাথে সাথেই খুড়তুতো ভাই শ্রীমান অয়ন চিৎকার জোড়ে, ‘ও দিদি, তোমার ঝুনু এসেছে-’, আর পিসিও ওমনি ধড়মড় করে নেমে আসে দোতলা থেকে। এসেই প্রথম প্রশ্নটাই করে, ‘কখন এলি? কটা দিন থাকবি তো?’ এই ‘কটা দিন থাকবি তো’ তে মাখানো থাকে বুড়ি পিসির একরাশ আকুতি। বেশীর ভাগ দিনই ঝটিকা সফরে যাই, আর যেদিন থাকব বলি, পলকে পিসির মুখে জ্বলে ওঠে সাবেকী একশ ওয়াটের এক ডজন বাল্ব।
এই তো সেদিন পর্যন্ত, জমজমাট প্রভাতী চায়ের আড্ডা বসত আমাদের একতলার বৈঠকখানায়, বাবা-মা আর পিসি। কথায়, কথায় লেগে যেত দুই ভাইবোনের তুলকালাম, পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যেতে উদ্যত হলেই, ভাইবোনের উত্তপ্ত বাদানুবাদের ওপর গরম চা ঢেলে দিত মা। চাটুজ্জে বাড়ির ছেলেপিলেরা বড্ড চাতাল। আজও পরিস্থিতি মেঘলা দেখেই চায়ের প্রস্তাব দিলাম আমি, যত বেয়াড়া-বেখাপ্পাই হোক না সময়, এক কাপ চায়ে সব ঠাণ্ডা।
টলটলে কাঁচের কাপে সোনা সোনা রঙা সুগন্ধী চায়ের লিকার ঢালছি, সিগারেট ধরানোর অজুহাতে বাবা এসে কানে কানে বলে গেল, ‘দিদি কিন্তু জিঞ্জার বিস্কুট খেতে খুব ভালোবাসে। নিষেধ করলেও শুনবি না। আর একটা নয়, দুটো করে দিস। ’ কিটকিটে মিষ্টি আদা গন্ধী বিস্কুট আমার দু চক্ষের বিষ, কিন্তু এ বাড়িতে সবার প্রিয় মশলাই হল আদা। ঠাকুমা যে কিসে আদা দিত না, ভগবান জানে, মায় টমেটোর চাটনিতেও। একবার তো পিসি আমার অমলেটেও এক ছটাক আদা দিয়েছিল বলে যা হল্লা করেছিলাম, বাপরেঃ।
সেই গল্প শুনতে শুনতে পিসির গালে লাগে লালিমা। ‘ ধন্যি মেয়ে ছিলি বাবা তুই। চান না করালেই নাক দিয়ে রক্ত পড়ত, আর ভালো করে তেল মাখিয়ে চান করালেই জ্বর আসত তোর। আর মা (মানে আমাদের স্বর্গীয়া ঠাকুমা) আমায় ঝেড়ে কাপড় পরিয়ে দিত।’ আমরা তিন খুড়তুতো-জেঠতুতো ভাইবোন আমাদের ঠাকুমা-পিসির কাছেই মানুষ। মা এবং ছোট কাকি উভয়েই ছিলেন সরকারী কর্মচারী, মাতৃত্বকালীন অবকাশ শেষ হবার সাথে সাথেই দুধের বাচ্ছাকে শাশুড়ী-ননদের কাছে রেখে আপিস যেতে বাধ্য হতেন তাঁরা। উভয়েই বাচ্ছা দেখার লোক রাখতে চেয়েছিলেন, এমনকি মা তো আমাকে একদিন নীল রঙা বালতি ব্যাগে করে আপিসেও নিয়ে গিয়েছিল নাকি। বাড়ি ঢুকতেই ঠাকুমার সেই বিখ্যাত ঝাড়।
একটা বাচ্ছা সামলাতেই লোকজন নাকের জলে, চোখের জলে হয়ে যায়, আমাদের ঠাকুমা-পিসি তিন-তিনটে ‘দুর্ধর্ষ দুশমন’ কি ভাবে যে সামলাত ওরা বাপরেঃ।
অতীতের গল্পে কেমন যেন হারিয়ে যাই আমরা, সেই যে সেবার ঝুটো মুক্তোর হারটা ছিঁড়ে ফেলে কেঁদে ভাসিয়ে ছিলাম আমি। একটাই তো ইমিটেশন গয়না ছিল আমার, পাঠশালার মোড়ের সোনা ইমিটেশন থেকে মায়ের কিনে দেওয়া তিন ছড়া মুক্তোর মালা। সব বিয়ে-শাদি অনুষ্ঠানে ঐটাই গলায় পরিয়ে নিয়ে যেত মা, সেটাই ছিঁড়ে ফেললাম? হায়!হায়! বেঁচে থেকে আর লাভ কি? এমনিতেই আপিস থেকে ফিরে কোতল করবে মা। ঠাকুমাকে একটু ভয় পেতাম থুড়ি সমীহ করতাম আমি, যা প্রবল ব্যক্তিত্ব ছিল ভদ্রমহিলার, কিন্তু পিসি, পিসি ছিল আমার সবথেকে নরম কুশন, সারাদিন পিসির পিছনে ঘুরছি আর কাঁদছি, ‘ও দিদি, কি হবে গো?’ পিসি ভুলোনোর অনেক চেষ্টা করে, শেষে বলল, ‘কি আর হবে? তোর মা এলে বলবি, আমি ছিঁড়ে দিয়েছি। ’ শুধু কি হার? আমার মেয়েবেলায় করা যাবতীয় অপাটের দায়ভার স্বেচ্ছায় নিজের কাঁধে নিয়ে নিত পিসি। ‘মা এলে বলিস, আমি করেছি’ এর থেকে বড় স্বস্তিবচন কিছু ছিল না আমার ছোটবেলায়। মা অবশ্য একটিবারও বিশ্বাস করত না এবং যথারীতি উদোম ঠ্যাঙাত। তবে সে তো অন্য গল্প।
আমার আর পিসির বৈঠকী গল্পে বারবার ঢুকে পড়ে বাবা, আমরা বিশেষ পাত্তা দিই না, তাও। খালি হয়ে যায় চায়ের কাপ, এঁটো কাপ তুলে নিয়ে যায় মা, নামে ক্ষণিক বিরতি। সবাই নিজের নিজের মত করে হারিয়ে যাই অতীতে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে পিসি, ‘আমি তোর বাবাকে জন্মাতে দেখলাম সেদিন, আর আজ তোর মেয়ে কত বড় হয়ে গেল রে-। তাহলে ভাব, কত বয়স হল আমার! ’ বয়স বাড়ানোটা ঠাকুমা এবং তাঁর পুত্রকন্যাদের বৈশিষ্ট্য। ঠাকুমার বয়স মাসে মাসে বাড়ত। শেষে বাবা একবার ধমকে বলেছিল, ‘আচ্ছা মা, তুমি কি বাবার থেকেও বয়সে বড় ছিলে? বাবার জন্ম ১৯০৫ সালে, বেঁচে থাকলে বাবার বয়সই ৯০ হত না। তোমার হয়ে গেল কি করে?’
অভিমান ভরে এত ক্ষণ দূরে বসেছিল বাবা, ছদ্ম মনোযোগ দিয়ে ব্যস্ত ছিল হিসেবনিকেশে। ধীরে ধীরে উঠে এসে জমিয়ে বসল আমাদের সামনে, আয়েস করে ধরালো আরেকটা সিগারেট। ‘দূর!বিরক্তিকর’ বলে উঠে গেল মা। বাবার এই সারাদিন ধরে গোছা গোছা সিগারেট টানাটা আমাদের সবথেকে বড় অশান্তির দ্যোতক। বলে বলে ক্লান্ত সবাই। বাবা যথারীতি পাত্তা দিল না, এক রাশ ধোঁয়া ছেড়ে বলল, ‘তবে আমারও একটা গল্প আছে, যেটা কেউ জানে না। এমনকি দিদিও নয়।’ একটু আগের তর্কাতর্কি ভুলে উদগ্রীব হয়ে বসল দিদি, বাবা আবার ধোঁয়া ছেড়ে বলল,‘ তখন আমি বোধহয় ক্লাশ নাইন বা টেন এ পড়ি। একদিন সন্ধ্যে বেলা হঠাৎ হাবু এসে হাজির। হাবু আমার সাথে স্কুলে পড়ত, ক্লাশ ফোর এ ফেল করে পড়াশোনা ছেড়ে দেয়। আমাদের বাড়ির পিছন দিকের গলিতেই তখন থাকত ওরা। হাবু ছিল মেজো ভাই। ওর বড় দাদা, সুকুমার দা থিয়েটার করত। তাকে দেখতেও ছিল তেমন সুপুরুষ। টকটকে গৌর বর্ণ, ছিপছিপে চেহারা, তিরতিরে চোখ-নাক-মুখ। শ্যামলী নাটকে, খোদ উত্তম কুমারের সাথে অভিনয় করার সুযোগ পেয়েছিল। যদিও সাইড রোলে।
সুকুমার দার ইচ্ছে ছিল সিনেমায় নামার। পরিচিতিও হচ্ছিল একটু একটু করে। তারপর কি যে হল, হঠাৎ একদিন বেপাত্তা হয়ে গেল সুকুমার দা। হাবুদের বিশাল পরিবার, কোন মতে নুন আনতে পান্তা ফুরোয়। আসেপাশে সামান্য খোঁজখবর করল কদিন। তারপর ধামাচাপা পড়ে গেল।
বছর কয়েক বাদে হঠাৎ একদিন উদয় হল সুকুমার দা।সঙ্গে এক অপরূপা রমণী। জানাল ওর স্ত্রী। সঙ্গে দামী দামী বিলিতি উপহার এনেছিল সুকুমার দা। আমরা সব দলবেঁধে দেখতে গিয়েছিলাম। বউদি আমাদেরও সবার হাতে একটা দুটো করে বিলিতি চকলেট দিয়েছিল।
কদিন থেকে, আবার ওরা ফিরে গেল কর্মস্থলে। সেটা কোথায়? কেউ জানে না। এর কিছুদিন পর, এক বর্ষার সন্ধ্যায় হাবুদের বাড়িতে কড়া নাড়ে ব্যাঁটরা থানার পুলিশ। গঙ্গার ওপাড়ে ওয়াটগঞ্জে এক বেওয়ারিশ লাশ উঠেছে, তাকে সণাক্ত করতে যেতে হবে। বাড়িতে পুরুষ বলতে হাবু একা। তার বয়স কতই বা হবে? আমারই সমান।বড়জোর বছর ষোল।
বাড়ির সামনে পুলিশের জিপ দাঁড় করিয়ে আমায় ডাকতে এসেছে হাবু। বাবাকে বললাম, বাবা বলল, ‘অবশ্যই যাবে। ফেরার সময় পুলিশের জিপটাকে বোলো যতটা বাড়ির কাছে পারে যেন নামিয়ে দেয়-’। আমরা গেলাম, অত রাতে ওয়াটগঞ্জ থানা। বডি থানায় নেই, বডি আছে মর্গে। বড়বাবু আমাদের বসতে বলে সবাইকে বার করে দিল। তারপর দরদী সুরে বলল, ‘মর্গে গিয়ে দেখো। যদি পরিচিত কারো হয় ও, তাও স্বীকার করার দরকার কি? তোমার বাড়িতে চারটে আইবুড়ো বোন- কখন কার কি বিপদ হয়ে যায়-’।
আমরা পুতুলের মত ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালাম। বর্ষার ভিজে অন্ধকার রাস্তা দিয়ে জিপ ছুটল মর্গে। কেমন যেন ভৌতিক পরিবেশ। একটা টিমটিমে আলো জ্বলছে, গম্ভীর মুখে এক সেপাই আমাদের নিয়ে গেল লাশ আইডেন্টিফাই করাতে।সাদা কাপড়টা সরাতেই, চোখের সামনে উলঙ্গ সুকুমার দার দেহ। জায়গায়, জায়গায় খুবলে খেয়েছে মাছে, তবুও দিব্যি চেনা যায়। হাবু খানিক টলে গেল, তারপর হড়হড় করে বমি করে দিল। নিজেকে সামলে বলল, মৃত ব্যক্তিকে চেনে না। ’
‘সেকি?’ এক সাথে বলে উঠলাম পিসি আর আমি। তাহলে তো লোকটার নূন্যতম সৎকারও হবে না। বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে পুড়িয়ে দেবে বা গর্তে পুঁতে দেবে। সিগারেটে লাস্ট টান মেরে বাবা বলল, ‘সে রাতে বড়বাবুর মুখেই শুনেছিলাম যে, সুকুমার দা আর ঐ ভদ্রমহিলা দুজনেই নানা বেআইনি কাজের সাথে জড়িত ছিল। ওদের কাজই ছিল স্বামী-স্ত্রী পরিচয় দিয়ে বিভিন্ন হোটেলে ওঠা, তারপর সেখান থেকে অপারেশন চালানো। এই করতে করতেই দুজনের মধ্যে প্রেম। বিয়ের পর ওরা ঠিক করে ঐ পাপের কাজ ওরা আর করবে না। যা টাকাপয়সা আছে তাই দিয়ে সাধারণ, শান্তিপূর্ণ জীবনযাপন করবে। কিন্তু গ্যাং এর লোকেরা সেটা আর হতে দেয়নি। পুলিশের ধারণা, দুজনকেই মেরে জলে ফেলে দেওয়া হয়েছিল। ভদ্রমহিলার দেহ আর মেলেনি। হয়তো ভেসে গেছে সাগরে, অথবা-। ’ আমাদের সাধের চায়ের আড্ডায় নামে থিকথিকে মনখারাপী কুয়াশা। বহুযুগ আগে মৃত এক তরুণ দম্পতির জন্য ব্যথায় মুচড়ে ওঠে হৃদয়। কেন যে এমনি হয়, ফিরে আসতে চাইলেও, কেন যে ফিরে আসতে পারে না মানুষ। কেন যে সুযোগ দেয় না জীবন- কে জানে!
No comments:
Post a Comment