Wednesday, 28 July 2021

অনির ডাইরি ১৫ই জুলাই, ২০২১

 



দুপুরের খাওয়া শেষ হতে হতে বিকেল চারটে। এটা অবশ্য চাটুজ্জে বাড়ির বরাবরের দস্তুর। সারাদিন গৃহস্থালির কাজ সামলে, স্নান সেরে, কুঁচিয়ে রাখা ধপধপে কাচা কাপড় পরে যখন খেতে বসত তৎকালীন জ্যেষ্ঠ কুলবধূ ওরফে আমাদের ঠাকুমা, তখনও ঘড়ি বলতো চারটে বাজে। ঠাকুমা চলে গেছেন আজ ষোল বছর হল, চাটুজ্জে বাড়ির এই প্রজন্মের বড় বউ অর্থাৎ আমাদের আদরের চৈতি যখন সব সামলে খেতে বসে,তখনও ঘড়ি বলে, চারটে তো বাজল রে।  


মধ্যাহ্নভোজের পাট মিটিয়ে পাওয়া যৎসামান্য অবসরে, বৈঠকি মেজাজে কাঠের সোফায় পাশাপাশি বসি আমি আর পিসি, সমকোণে রাখা বড় কেদারায় আরাম করে বসে সিগারেট ধরায় বাবা। বৃদ্ধ এমনিতে ভয়ানক শক্ত, কিন্তু আপাততঃ যুগপৎ আঘাতে কিঞ্চিৎ হতভম্ব তথা জবুথবু। মায়ের অসুস্থতার জন্য কষ্ট পায় বাবা, কষ্ট পায় আমার দৌড়াদৌড়ি দেখে,  আর কষ্ট পায় নিজের অক্ষমতার জন্য। আশি পেরানো দেহে, কমে আসা গায়ের জোরে, জগৎ জোড়া মহামারীর আতঙ্কে, বদলে যাওয়া পরিমণ্ডলে অসম্ভব অসহায় বোধ করে বাবা। মুখে স্বীকার করে না যদিও- 


পশ্চিমের জানলা গলে এক ঝাঁক মশা সমেত আসে পড়ন্ত সূর্যের কমলা রোদ, কফি টেবিলের ওপর রাখা সিঙ্গোনিয়াম গাছের কচি কলাপাতা রঙের পাতায় ঠিকরে আসে আলো। মা না থাকায়, কিঞ্চিৎ অগোছালো বাড়িটা, অনেকটাই ধূলিমলিন। ওসব ভাবলে আরো খারাপ হয়ে আসে মন। মনখারাপের ভারী পর্দা সরিয়ে রসালো গল্প শোনায় পিসি ।বাবাদের জনৈক তুতো পিসেমশাইয়ের গল্প। যেমন রূপবান ছিলেন তিনি, তেমনি ছিলেন ধনী। আর তাঁর নারীলোলুপতা ছিল প্রায় কিংবদন্তি তুল্য। সদ্য স্বাধীন চূড়ান্ত হতদরিদ্র ভারত, সেই সময় গুণে গুণে তেরটা মোটরগাড়ির মালিক ছিলেন উনি। ছিল দুটি স্ত্রী এবং অন্তত হাফ ডজন রক্ষিতা। 


 প্রবাসী বনেদী বাঙালী পরিবারের ছেলে, বাবা বলে, ‘প্রদীপ কুমারকে দেখেছিস তো? নায়ক। ঠিক অমনি দেখতে ছিলেন, একেবারে রাজপুত্র। যেমন চোখ-নাক- মুখ, তেমনি টকটকে ফর্সা গায়ের রঙ। বোনেদের বিয়ে হয়েছিল গাঙ্গেয় বঙ্গের বিভিন্ন ছোটবড় রাজপরিবারে। ওনারা তিনভাই, মরার সময় ওনার বাপ, উইল করে তিন ছেলের প্রত্যেককে দিয়ে গিয়েছিলেন চল্লিশ হাজার করে টাকা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগের কথা, তিরিশ সাল ধর, আইন অমান্য আন্দোলনে কাঁপছে ভারত, তখন চল্লিশ হাজার টাকা, মানে বুঝতে পারছিস, এ কালে চল্লিশ লাখ বা চার কোটিও হতে পারে-।’ তারপর? তারপর আর কি, বড় ছেলে ছিল রেসুড়ে। সবটাকা রেস খেলে উড়িয়ে দিয়েছিল।’ 


‘আচ্ছা এখনও কেউ রেস খেলে?’ প্রশ্ন করে পিসি। বেশ খানিকক্ষণ রেস কোর্স আর ঘোড়া নিয়ে চর্চা করে আবার স্বর্গীয় পিসেমশাইতে ফিরে যাই আমরা। । ‘বড় দাদা রেস খেলে সব টাকা ফুঁকে দেয়, আর উনি ফুঁকে দেন বেশ্যা বাড়ি গিয়ে-।তারপর দুই ভাই মিলে, ছোটভাইকে পাগল সাজিয়ে, তার ভাগের টাকাটাও আত্মসাৎ করে। তারপর সেই পাগল ভাই, নাকি একদিন সবার অলক্ষে লোহার শেকল কেটে গোপনে নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। তোর ঠাকুমার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, ছোট ভাইকে বড় আর মেজ ভাই মিলে পিটিয়ে মেরে কোথাও পুঁতে দিয়েছিল।'


পড়ন্ত রোদে ভাসমান ধূলিকণাদের দেখতে দেখতে, সম্পুর্ণ অপরিচিত, দীর্ঘকাল আগে মৃত জনৈক হতভাগ্যের জন্য ভারী হয়ে ওঠে হৃদয়। আহা রে!


এমন খুনি, দুশ্চরিত্র, লম্পট ছেলের সম্বন্ধ কে এনেছিল জানতে চাই, ‘ হবু শালার সাথে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ত। ডিগ্রী নয় কিন্তু। ডিপ্লোমা। সেই সূত্রে ওদের বাড়ি আসা যাওয়া। দেখতে শুনতে ভালো, করিৎকর্মা। তখন বিশ্বযুদ্ধ চলছে, প্রচুর বিদেশি গাড়ি আসছে, বন্ধুর সাথে সেই গাড়ি সারানোর গ্যারেজ খুলে প্রচুর টাকাও কামাচ্ছিলেন। তারওপর পাল্টি ঘর।  ব্যবহারটাও ছিল খুব ভালো। সবার মন জিতে নিতে দেরী হয়নি। এই সব দেখে মলি পিসির সাথে বিয়ে দেওয়ার পর জানা যায়, সে কি জিনিস! মলি পিসি যখন আসন্নপ্রসবা, তখন জানাজানি হয় যে, তাঁর অবিবাহিত  ছোট বোনও সন্তানসম্ভবা-। আর দুই অনাগত শিশুর পিতা একই-।’ 


বেলা গড়ায় আরো একটু। সূর্যের গায়ে লাগে কমলা ছোপ। ঘড়ি তাড়া দেয়, এবার ফিরতে হবে নিজ গৃহে, কাল ইংরেজি পরীক্ষা শ্রীমতী তুত্তুরীর। আমি না পৌঁছানো পর্যন্ত বইপত্র স্পর্শও করবেন না তিনি। তবুও উঠতে পারি না, জানতে মন চায়, তারপর কি হয়েছিল। 


সিগারেট ধরিয়ে বাবা বলে ,‘এমনিতে লোকটা বেশ ফ্যাসিনেটিং ছিল বুঝলি। সে যুগে, ১৩টা বিলিতি মোটরগাড়ির গল্প তো শুনেইছিস, তাছাড়া কত যে সম্পত্তি কিনেছিল লোকটা তার ইয়ত্তা নেই। পয়সা যেমন উড়িয়েছে, তেমনি কামিয়েও ছিল লোকটা। তবে নৈতিক চরিত্র বলে কিছু ছিল না। যে বন্ধুর সাথে পার্টনারশিপে গ্যারেজ খুলে উপার্জনের হাতেখড়ি, তাকেই একদিন ঠকিয়ে পথে বসাল লোকটা। গুণ্ডা লাগিয়ে গ্যারেজে আগুন লাগিয়ে দিল। বিলিতী বীমা কোম্পানির থেকে মোটা টাকা ক্ষতিপূরণ পেল, কিন্তু পার্টনারকে একটা পয়সাও দিলে না। বেচারা সেই লোকটা এমন ধাক্কা খেল যে আর জীবনে ঘুরে দাঁড়াতে পারল না। 


শুধু গাড়ি আর যন্ত্রাংশ নয়, আরো না না অবৈধ কাজে যুক্ত ছিলেন ভদ্রলোক, নিঁখুত জাল নোটের ছাঁচ হাতে তৈরী করে লাখো লাখো টাকা উপার্জন করে। তবে ঐ যে বলে না,পাপ তার বাপকেও ছাড়ে না,  অধঃপতনের কোন স্তরে নেমেছিল লোকটা কেউ জানে না,তবে শোনা যায়, তৎকালীন ভারত সরকারের জনৈক হোমরাচমরা নেতার সাথে জড়িয়ে পড়েছিলেন বখরার দ্বন্দ্বে। অসম তথা প্রবল প্রতাপশালী প্রতিদ্বন্দ্বীর কাছে নাকাল হয়ে, গোহারান হেরে অকালে পটাশিয়িম সায়নাইড খেয়ে আত্মহত্যা করতে হয় ওণাকে। রেখে যান দুই স্ত্রী আর কয়েক গণ্ডা বাচ্ছা।আর তারপরই নামে ধস। রাতারাতি উবে যায় কুবেরের ধন। তাতেও হাত ছিল দিল্লির সেই নেতার। মরেও নিস্তার পায়নি লোকটা। মূল্য চোকাতে হয় তার পরিবারকে-।'


 দীর্ঘশ্বাস ফেলে পিসি বলে, ‘এমন অদূরদর্শী, অবিবেচক লোক দেখিনি, এত টাকা, এত সম্পত্তি অথচ কাউকে কিছু জানিয়ে পর্য্ন্ত যায়নি কোথায় কি ভূসম্পত্তি রেখে গেছে। বাচ্ছাকাচ্চা সমেত বউরা পড়ল অথৈ জলে।  এমনকি জানিস বাস্তু ভিটেটুকুও করে দিয়ে যায়নি। ভাড়া বাড়িতে থাকত ওরা, যখন উনি সুইসাইড করেন-। ভাড়া বাড়িটাও অবশ্য ছিল রাজকীয়। বাড়িতে চারজন ভৃত্য, দুই বউয়ের বাচ্ছা দেখার জনা দুয়েক আয়া, ঠাকুর, দারোয়ান কি ছিল না। দুই গিন্নীকে যা গয়না দিয়েছিল না অকল্পনীয়। গলায় পরার বারোমেসে চেনগুলোই ছিল আঠারো ভরি করে। ছেলেদের কোমরে বাঁধার চেন গুলো ছিল আট-দশ ভরির। ছেলেদের খাবার জন্য বিশাল বিশাল শিশিভর্তি হরলিক্স আসত বম্বে থেকে। অত বড় কাঁচের শিশি আমি জীবনে দেখিনি।  অথচ একটা ছেলেকেও লেখাপড়া শেখানোর চেষ্টা করেনি লোকটা। ছেলেগুলোর যে  কি পরিণতি হয়েছিল-।'


ঘড়ি বলছে পাঁচটা, এখনই না বেরোলে, অফিস টাইমের জ্যামে পরার সমূহ সম্ভাবনা। উসখুস করছি দেখে সচকিত হয়ে ওঠে পিসি,‘তোর বোধহয় এসব মান্ধাতার আমলের গল্প ভালো লাগছে না, না রে?’ বাবা অভিমানী সুরে সঙ্গত করে,‘বুড়ো হয়েছি তো, একটু বেশীই কথা বলি আমরা-। ’ ব্যাগ সরিয়ে আবার বসে পড়ি, কি করে বোঝাই এদের, গতানুগতিক সাদাকালো দৈনন্দিন জীবনের সবথেকে রঙীন অংশ এই বুড়োবুড়ির গল্প। থাকি না হয় আরো কিয়ৎ ক্ষণ, মন- প্রাণ-কান ভরে শুনি হারিয়ে যাওয়া অতীত আর  ভুলে যাওয়া কিছু চরিত্রের কথা।  যারা আপাদমস্তক সাধারণ হয়েও আসলে ছিল অনন্যসাধারণ।

No comments:

Post a Comment