Monday 19 July 2021

অনির ডাইরি ১২ই জুলাই, ২০২১

 


আজ দীর্ঘ আটদিন বাদে বাড়ি ফিরলেন জগুদা এন্ড কোং। বিগত এক হপ্তা আটদিন ধরে তেনাদের নিবাস ছিল ঠাম্মার গৃহ। ঠাম্মাই জগুবাবুর মাসি কি না। ফেরার সময় একরাশ দইবড়া, কোল্ড ড্রিঙ্ক, বেলজিয়াম চকলেটের আইসক্রিমও নিয়ে ফিরলেন তিনি। সাথে প্রায় তিনশ টাকার প্রণামী। যার গরিষ্ঠাংশই দুই দাদু এবং কাকাইয়ের দেওয়া। বাকিটুকু দিয়েছে তুত্তুরীর মাসি আর আবাসনের জনৈক দাদু, যিনি রথের দিন তুত্তুরীর কাছে ‘পেসাদ’ চেয়ে হাত পেতেছিলেন। 


অথচ জগুবাবুদের যাত্রাটা কিন্তু মোটেও এমন শুভ হয়নি।  কি সাংঘাতিক যে কেটে ছিল রথের দিনটা। কোন কোন সকাল এমনি আসে, যখন একটু বেলা করে ভাঙে ঘুম। কোন কোন সকাল বয়ে আনে হাল্কা জাতি বিদ্বেষের গন্ধ।  কেমন, দিল তো ইতালী, ইংলণ্ডের নাকে আচ্ছা করে ঝামা ঘষে! 


বেলা গড়ায়, ক্রমে স্তিমিত হয়ে আসে গত রাতের বাসি উত্তেজনা। আর কি কখনও কবে, এক সাথে কোপা- উইম্বলডন আর ইউরো হবে? সে চিন্তা ঝেড়ে ফেলে চিলেকোঠার গুপ্ত কুঠুরি থেকে সহোদর- সহোদরা সমেত বেরিয়ে আসেন জগন্নাথ। 


বেলা বাড়ে, তুত্তুরীকে ছুটি দেয় না গোঁড়া ক্যাথলিক স্কুল। পড়ার ঘরে ল্যাপটপ চালিয়ে ঘাড় গোঁজ করে পড়তে বসে তুত্তুরী। ব্যাগ গোছাতে বসে শৌভিক। আগামী কালই বাক্সপ্যাঁটরা গুছিয়ে রওণা দেবে নতুন পোস্টিং এর উদ্দেশ্যে। ব্যাগ গোছাতে গিয়ে আবিষ্কৃত হয়, টুকটাক কত কিছু কেনা বাকি। চটজলদি বেরোনোর তোড়জোর করি আমরা। তুত্তুরীর ক্লাশ শেষ হবার আগেই ফিরে আসব, মাত্র ঘন্টা খানেকের ব্যাপার। স্নানাহার ফিরে এসেই না হয়- 


ঠিক এগারোটা পয়ত্রিশে বাবার ফোন, আজও ভাসছে কথা গুলো ইথার তরঙ্গে, ‘তুমি কি ব্যস্ত আছ, আসতে পারবে? মা যেন কেমন-’।  ঠিক এই ভয়টাই পাই আমি সবসময়। ঠিক এই কথাগুলোই দুঃস্বপ্নে শুনি আমি, অসময়ে বাড়ি থেকে ফোন এলেই ধড়াস করে ওঠে বুক। যদিও প্রতিবারই প্রমাণ হয়, অকারণ আশঙ্কা করি আমি, আর যেদিন সত্যিই হয়, সেদিন কেন যে বাজে না কোন বিপদঘন্টি।  


এরপরের দৌড়দৌড়ি, মানসিক উত্তেজনা, মনোবেদনার গল্প জানে সময় আর জানি আমরা চার খুড়তুতো-জেঠতুতো ভাইবোন, আমার বর আর অয়নের গিন্নি তথা আমাদের আদরের ভাই বউ চৈতি।ক্ষয়িষ্ণু হলেও যৌথ পরিবারে বেড়ে ওঠার বোধহয় এটাই সবথেকে বড় সুবিধে, আমি আর শৌভিক পৌঁছানোর আগেই, ন্যূনতম প্রাথমিক চিকিৎসার পর অ্যাম্বুলেন্স ডেকে, মাকে হাসপাতালে নিয়ে হাজির হয় মায়ের ভাসুর ঝি, দুই দেওর পো আর চৈতি। বাড়িতে নড়বড়ে বাবার কাছে থেকে যায় পিসি আর বুল্লু বাবু। 


হাসপাতালের কাজ মিটিয়ে, বাড়ির পথে যখন গড়াল গাড়ির চাকা, মায়ের পাশাপাশি বড় মন খারাপ করছিল মেয়েটার জন্যও। সারাদিন নাকি, আমাদের অনুপস্থিতিতে ফুলে ফুলে কেঁদেছে মেয়েটা। মামমাম অর্থাৎ দিদার প্রাণ যে তুত্তুরী। তুত্তুরী যদি কাঁদে, মন খারাপ করে থাকে, মামমাম কি আদৌ ভালো থাকতে পারে? 


এত সাধ করে, বাবার হাতে পায়ে পড়ে উঁচু লফট থেকে রথ নামিয়েছিল মেয়েটা। দূরভাষের ওপার থেকে উমা বলল, 'দিদিভাই, পারলে একটু ফুল আনবে?' নমোঃ নমোঃ করেও নাহয় বেরোক তুত্তুরীর রথ-। গত বছরেও করোনার দৌলতে বাক্সবন্দি ছিলেন জগুদা আর তাঁর ভাইবোনেরা। 


সন্ধ্যা নামার মুখে, হাসপাতালের পোশাক বদলে, স্নান সেরে, উদরপূজা করার ফাঁকে ফাঁকে দেখলাম প্রবল কোস্তাকুস্তি করতে করতে কেমনি সেজে উঠছে কাকিমা আর তুত্তুরীর রথ। সেজে ওঠা রথে আসীন হলেন জগুদা এন্ড ফ্যামিলি। প্রথম প্রণামী দিল তুত্তুরীর মাসি, অতঃপর দুই বীরাঙ্গনা রওণা দিলেন রথ এবং জগন্নাথদেব সহ মাসির বাড়ির উদ্দেশ্যে। পড়ন্ত বিকেল, ফাঁকা পথঘাট আর গোটা আবাসন সাক্ষী রইল কাকিমা আর তার সোনাইয়ের খুনসুটি, ঝগড়া আর গভীর বন্ধুত্বের। কে বলবে, এই মেয়েই সারাদিন কেঁদে কেঁদে ফুলিয়ে ফেলেছিল চোখ। যৌথ পরিবারে বেড়ে ওঠার এটাই তো সবথেকে বড় সুবিধা, একা থাকে না কেউ।

No comments:

Post a Comment