Thursday, 15 July 2021

অনির ডাইরি, ১৩ই জুলাই, ২০২১

 অনির ডাইরি, ১৩ই জুলাই, ২০২১



পাঁচশ বছরের বুড়ি শহরটার অলিতে-গলিতে, হাড়ে-পিঞ্জরে একা-একা পায়ে হেঁটে ঘুরে বেড়াতে আজও কি যে ভীষণ ভালো লাগে। মনে মনেই চলে কথোপকথন, কখনও আমি ছোটাই কথার ফুলঝুরি, তো কখনও বা কান পেতে শুনি, কি কয় এই বুড়ি শহর। 


এই ভর দুপুরে ঝিম ধরে থাকা এই বাড়িটায় প্রতি বুধবার সন্ধ্যায় বসত বিশাল সৎসঙ্গের আসর। সিংহাসনারূঢ় প্রায় এক মানুষ সমান অনুকূল ঠাকুরের সাদা-কালো ছবির গলায় ঝুলত টাটকা রজনীগন্ধার মালা। পুষ্পের সুবাসে, আগরবাতির সৌরভে মথিত হয়ে উঠত আমাদের গলি। রাস্তা জুড়ে পাতা সারি সারি কাঠের বেঞ্চে হত বিপুল ভক্ত সমাগম। হত ভজন সংকীর্তন। সাদা ধুতি পাঞ্জাবি পরিহিত নাতিদীর্ঘ, ছিপছিপে চেহারার বাংলার স্যার শ্রীনাথ বাবু ছিলেন ঋত্বিক। শ্রীনাথ বাবু যখন ঋত্বিক হিসেবে মাইক ধরতেন, পলকে থমকে যেত সব গুঞ্জন। এমনিতে মোটেই মারকুটে নয়, বরং বেশ অমায়িকই ছিলেন স্যার, একবারই কেবল গাঁট্টা খেয়েছিলাম স্যারের হাতে। তখন আমি দশম শ্রেণী, কোচিং ক্লাশের সরস্বতী পুজোর চাঁদা, খামে ভরে, ক্লাশ-ব্যাচ এবং ‘স্বরস্বতী পূজা' লিখে যেই স্যারকে দিয়েছি, ওমনি ঠকাস্। 


আমাদের ক্ষীরেরতলা গলির মুখোমুখি রাস্তার নামটা ভারী সুন্দর, জয়নারায়ণ বাবু আনন্দ দত্ত লেন। এখেনে পা রাখলেই, মনে হয়, কেমন যেন থমকে আছে হারিয়ে যাওয়া সহস্রাব্দ। 


ঢুকতেই বাঁদিকে বড়কালীর পাকা মণ্ডপ।  আমাদের মধ্য হাওড়ার সবথেকে লম্বা কালী বলেই ওণার এমন নাম। ফি বছর বাড়ত বড়কালীর উচ্চতা এবং বিসর্জনের দিন অন্ধকারে নিমজ্জিত হত আমাদের শহর, বিপদের আশঙ্কায় কেটে দেওয়া হত যাবতীয় ওভার হেড তার। এতদসত্ত্বেও বেশ কয়েকবার মাথার চুল পুড়িয়েছিলেন বড়কালী। শেষে ক্লাবের ছেলেরা বলল, 'তুই আর কমপ্ল্যান খাস নে মা।' আজকাল তাই একটু খর্বাকার হয়েছেন বটে, তবুও মায়ের মুখ দেখতে হলে, ব্যথা করে ঘাড়।  


 ডানদিকের ঐ যে বিবর্ণ সবুজ কাঠের দরজাওয়ালা বাড়িটা দেখা যায়, ঐ বাড়ির বুড়ি মালকিনকে দেখতে ছিল পুরো মেম সাহেবদের মত। টকটকে ফর্সা রঙ, লালচে কেশদাম, গোলপানা মুখ, চোখে মোটা কালো ফ্রেমের চশমা। কানাকানি শুনতাম যে, অল্প বয়সে রীতিমত ডানাকাটা পরী ছিলেন উনি, বাড়ির অমতে অসবর্ণ বিবাহ করে রীতিমত আলোড়ন ফেলে দিয়েছিলেন সে যুগের মধ্য হাওড়ার বুকে। ওনার স্বামীও ছিলেন তেমনি অপরূপ রূপবান, সদ্য স্বাধীন ভারতে জনৈক প্রসিদ্ধ মাল্টিন্যাশানাল কোম্পানির ইস্টার্ন জোনের সবথেকে বড় ম্যানেজার ছিলেন তিনি। কর্পোরেট রেষারেষির জন্য খুব বাজে ভাবে ফেঁসে গিয়ে আত্মহনন করতে বাধ্য হন তিনি। বারান্দায় দাঁড়িয়েই থাকত মেম বুড়ি আর রাস্তায় চেনা পরিচিত যাকেই দেখতে পেত, জুড়ে দিত খোশ গল্প।ছোট্ট বেলায় ওনার পীড়াপীড়িতে বেশ কয়েকবার গেছিও এণাদের বাড়ি। গোটা মহল্লায় তখন শুধু এই একটি বাড়িতেই ছিল টেলিফোন। 


একটু এগোলেই, ইংরেজি ভি অক্ষরের মত দু ভাগ হয়ে গেছে রাস্তাটা। ডানদিকের গলি ধরে খানিক এগোলেই আগে একটা খাটাল পড়ত। ও পথে পা বাড়ালেই, দখিনা পবন বয়ে আনত ভুরভুরে গোবরের গন্ধ। এখন অবশ্য আর নেই খাটালটা। সরকারী নির্দেশে সরে গেছে বহুদিন। 


বাঁদিকের রাস্তাটা ধরব আমি। আগে বাংলা বছরের প্রথম চার মাস জুড়ে এ রাস্তার ধারে শুকাতেন পুঁচকে পুঁচকে মুণ্ডহীনা রক্ষে কালী। পূজার ঠিক দু এক দিন আগে, তাদের ঘাড়ে চাপত মাথা। তারপর হত অঙ্গরাগ। শরৎ নামার সাথে সাথেই, পাট চুকত উলঙ্গিনীর। বিক্রি না হওয়া মূর্তিগুলিই সামান্য ছাঁচ বদলে হয়ে যেতেন কোজাগরি। কার্তিকে একরাশ কালি আর কার্তিক, আর পৌষে শুকাত সরস্বতী। রাস্তার ধারে আজও কিছু অসমাপ্ত খড়ের কাঠামো পড়ে আছে, আকার দেখে মনে হয়, হয়তো কালে কালে বিশ্বকর্মা হবেন তাঁরা। অথবা নব কার্তিক। যাই হোন না কেন,আজ নিছক কন্ধ-কাটা। 


সামনে মল্লিকদের বিশাল অট্টালিকার একতলার ঘর গুলি নিয়ে চলত অজিত বাবুর কোচিং। সাদা কালো দাবার বোর্ডের মত মেঝেতে শতরঞ্জি পেতে গাঁতিয়ে পড়তে বসত ছেলে আর মেয়েদের দল। রামকৃষ্ণ শিক্ষালয়ের অঙ্কের শিক্ষক অজিত বাবুর  বিশাল নামডাক ছিল সেকালে। মল্লিকদের ঠাকুর বাড়ি ছাড়ালেই বাঁহাতে  ছিল একখানা ভাঙাচোরা ইয়ুথ হোস্টেল। সেটা যে কবে কোথায় হারিয়ে গেল-। কব্জা থেকে ভেঙে ঝুলছে সাবেকী ভারী লোহার গেট আর বাকি ফাঁকা এলাকার দখল নিয়েছে বর্ষার বেবাগা সবুজ জঙ্গল। 


একটু এগোলেই উত্তর খুরুট বারোয়ারির বিশাল রঙচঙে চারতলা ক্লাব ঘর। আরো খানিক এগোলে ডান হাতে একটি বাড়ির গায়ে আজও লাগানো আছে,  একটি ছোট বোর্ড।  যাতে লেখা, ‘এখানে দশম শ্রেণী অবধি যত্ন সহকারে পড়ানো হয়।‘ যোগাযোগের জন্য দেওয়া আছে শম্পার বাবার নাম। শম্পা শুধু আমার সহপাঠীই নয়, লতায়পাতায় তুতো বোনও বটে।  শম্পার ঠাকুমা দনুজদলনী দেবী সম্পর্কে ছিলেন আমার ঠাকুমা স্বর্ণলতা দেবীর মাসতুতো বোন। 


 তৃতীয় বা চতুর্থ শ্রেণীতে থাকাকালীন,  স্কুল ছুটি হলেই শম্পাদের বাড়ি যাবার প্রবল বায়না ধরতাম আমি। আর প্রতিদিনই ঢোঁক গিলে, একই কথা বলত শম্পা, ‘না রে অন্য সময় আসিস, এখন প্রচণ্ড ব্যস্ত থাকে মা।’ চার পুত্রকন্যা সামলে, নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের যাবতীয় গৃহকর্ম মিটিয়ে, কয়লা ভেঙে, গুল দিয়ে, বাতিল শাড়ি দিয়ে পর্দা বানিয়ে, শম্পার গৃহশিক্ষিকার দায়িত্বভার সামলাতেন যে মহীয়সী মহিলা, তিনি যদি ব্যস্ত না থাকেন তাহলে ব্যস্ত থাকবে কে? ব্যস্ত থাকতে থাকতেই একদিন মারা যান জেঠিমা, শুনেছি আছড়ে কাপড় কাছতে কাছতেই নাকি ঢলে পড়েন চিরঘুমে। 


জেঠু অর্থাৎ শম্পার বাবার কথাও খুব মনে পড়ে, চাকরী থেকে অবসর নেবার পরও, লম্বা লম্বা পা ফেলে, একটা মস্ত কালো ছাতা মাথায় দিয়ে  সারাদিন টিউশনি করে বেড়াতেন তিনি। পথেঘাটে দেখা হলেই ঢিপ করে প্রণাম করতাম আমি, হাজার হলেও বাবার তুতো দাদা বলে কথা- শেষ খবর পেয়েছিলাম,পক্ষাঘাত গ্রস্ত হয়ে শয্যাশায়ী ছিলেন উনি। কে জানে কেমন আছেন! কোথায় আছেন! 


শম্পাদের বাড়ি ছাড়ালেই আমার প্রাণ চায়, সারদামণি ক্লাবের পাশ দিয়ে ডান দিকে বাঁকতে। ঐ ডান হাতি গলি এঁকে বেঁকে গিয়ে দাঁড় করায় রুণাদের বাড়ির সামনে। এককালে কত যে গেছি ও বাড়িতে তার ইয়ত্তা নেই। বন্ধ হয়ে যাওয়া যোগমায়া সিনেমা হলের পাশে, রুনাদের বাড়ি খানা আজও রয়ে গেছে একই রকম। পৌনে দুই দশক হল, বিয়ে হয়ে চলে গেছে রুনা,  কাকুও চলে গেছেন ফিরে না আসার দেশে। তবে কাকিমা আর রুণার পিসিমা আজও আছেন। গিয়ে কড়া নাড়লে কি আদৌ চিনতে পারবেন আমায়? পিসির পরিচয় দিলে নির্ঘাত পারবেন। স্কুলে পৌঁছে দেওয়া-নেওয়ার সূত্রে বড় গভীর বন্ধুত্ব ছিল আমার পিসির সাথে রুণার মায়ের। 


সোজা এগোলে ডান হাতে স্বপ্নের মত একখান মস্ত তিনতলা হলদে রঙের ইস্কুল বাড়ি পড়ত, বাবার মুখে শুনেছি, স্বাধীনতার আগে আমার বড় পিসিমারা স্লেট বগলে এখানে পড়তে আসত, তখন এর নাম ছিল, ‘দুর্গা বাবুর পাঠশালা’। পরবর্তী কালে শ্রীদুর্গা ইস্কুল নামে অন্যত্র সরে যাবার পর, স্বপ্নের মত ইস্কুল বাড়ির দখল নেয়, বিবেকানন্দ ইন্সটিটিউশন। ওদের প্রাথমিক বিভাগটা দীর্ঘদিন এখানেই বসত। তাঁরা চলে যাবার পরও কি যেন একটা স্কুল বসত এই বাড়িতে। বর্তমানে খণ্ডিত ধ্বংসস্তূপ হয়ে পড়ে আছে এক ফালি অংশ। বাকিটুকুতে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে কুৎসিত বহুতল। ঐতিহ্য বেচে ফ্ল্যাট কিনেছে হাওড়া বাসী। নাকের বদলে নরুন। 


 আর এগোলে, মা কালীর মন্দির আর বন্ধ হয়ে যাওয়া শ্যামাশ্রী সিনেমার গায়ে ধাক্কা খাব আমরা। এখান থেকে ডান দিকে বেঁকে যাব আমি। রিশেপশনের ছেলেটা বলেছে, আইসিইউ এর ভিজিটিং আওয়ার আধঘন্টা মাত্র।  অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষায় আছে জননী আমার। আসছি মা, আর দু মিনিট মাত্র। একটু দাঁড়াও প্রিয় শহর, আধেক ঘন্টা পর, ওষুধপত্র কিনে পৌঁছে দিয়ে আবার এ পথেই তো একলা ফিরব আমি। ফিরব অধীর আগ্রহে বসে থাকা এক ভীতু বৃদ্ধের কাছে, বউকে বড় ভালোবাসে যে সে, জানতে চায়, শুনতে চায় বিশদে,  কেমন আছে তার আব্দেরে আলুভাতে গিন্নি। খুব দ্রুত ফিরতে হবে আমায়, আর একলা ফিরতে আমার যে বড় ভয় করে-। প্লিজ পাশে থেকো-

No comments:

Post a Comment