Wednesday 9 September 2015

অনির ডাইরি ৩রা সেপ্টেম্বর ২০১৫



 নাঃ এবার এটা শেষ করতেই হবে।  অনির ডাইরি আমার মনের খোলা জানালা, দৈনন্দিন একঘেয়েমি যখন অসহনীয় হয়ে ওঠে আমার মধ্যে না লেখা গল্পের চরিত্রগুলো সম্মিলিত ভাবে ক্যাঁচোর ম্যাচোর শুরু করে অথচ লেখার অবকাশ বা উদ্যম পাই না তখন নানা ছোটখাট আপাত সাধারণ ঘটনাবলী নিয়ে দু চার কথায় ডাইরি লিখতে বসি।  বেশিটাই বাড়ি ফেরার পথে চার্টার্ড বাসে আধো অন্ধকারে লেখা।
এদিকে ক্যান্সার রোগাক্রান্তা চম্পু মাসিকে প্রতিশ্রুতি দিয়ে বসে আছি চম্পু আর ফেলুকে নিয়ে “একটি নিটোল প্রেমের গল্প ” লিখব। খানিকটা লিখে আর লেখাটা পছন্দ  হচ্ছে না। সম্পূর্ণ অপরিচিত এক ব্যক্তির চিত্রাঙ্কন  কি এতই সোজা? এদিকে আমার প্রাক্তন সহপাঠী রঞ্জা গত সপ্তাহ থেকে  উত্যক্ত  করছে ওদের বংশ নিয়ে একটি গল্প লিখতে হবে। রঞ্জাকে আজকাল দূরদর্শনে প্রায়শই দেখা যায় নারীর অধিকার এবং নারী স্বাধীনতা বিষয়ক আলোচনা চক্রে। দিল্লীর নামজাদা কলেজের অধ্যাপক এবং প্রবাসী বাঙালি আমলার সাথে সহবাসী। রঞ্জার প্রতি আমার দুর্বলতার প্রধান কারণ ওর বাবাও আমার বাবার মত জেলখাটা  নক্শাল নেতা ছিলেন। ওর বাবার প্রতি প্রতিহিংসা বশতঃ ওর জেঠুকে সত্তরের দশকে কারা যেন কুপিয়ে খুন করেছিল।  লাশ পাওয়া যায়নি।  রঞ্জা বলত ওর জেঠু যে কলেজে পড়াতেন সেখানকার কেয়ারি করা বাগানে কোথাও  পুঁতে রাখা আছে জেঠুর লাশ। শুধু তাই নয় রঞ্জার পিতামহ তাঁর যৌবনে পালিয়ে রেঙ্গুন গিয়েছিলেন  সশস্ত্র বিপ্লবীদের জন্য অস্ত্র আমদানি করতে। রঞ্জার ছোটদাদু নাকা “ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায় ” আন্দোলন করতে গিয়ে শহীদ হন।  পুরো ঘটনাবহুল ইতিবৃত্ত ।
ওদিকে “কিছুই হারায় না” ও আধখেঁচড়া পড়ে আছে। অমিয়া রহমত আর ফরজানাকে নিয়ে লিখতে গিয়ে, লিখে বসলাম অমিয়ার সহকর্মী দীপক আর তার স্ত্রী মিলির “পরকীয়া”।  বেচারা রহমত মুম্বাই এর পতিতা পল্লী গুলিতে ফরজানাকে খুঁজেই চলেছে।

যাই হোক আবার মাদপুরে ফিরে যাই, এল পি সি নিয়ে খড়্গপুর তথা মাদপুরকে আপাত বিদায় জানিয়ে ফিরে এলাম মহানগরে।  মনে বারংবার অনুরণিত হতে লাগল শৌভিকের দীর্ঘশ্বাসযুক্ত উক্তিগুলি, সত্যই ঐ নিঃসঙ্গতা অবর্ণনীয় । দিন পাঁচেক বাদে অফিস থেকে ফিরছি, বাসে অকথ্য ভিড়। আমার মত দু একজন অফিস ফেরতা হতভাগ্য  বাদে বেশির ভাগই পুজোর বাজার করে ঢাউস ব্যাগ নিয়ে সুখী সুখী দম্পতি, সবৎসা জননী বা মনপসন্দ মার্কেটিং করে ফেরা কলেজ পড়ুয়া মেয়েদের দল।  অতি কষ্টে বসার জায়গা পেলাম, উপবেশনের  পর হঠাৎ মনটা দুখী হয়ে উঠল আমার হতভাগ্য বরের জন্য।  মা আসছে, আনন্দস্রোতে ভাসমান মহানগর ।  একাতীত্ব নিঃসঙ্গতা সাময়িক  ভাবে বিজাতীয়  শব্দ মনে হচ্ছিল। যদিও অবহিত ছিলাম ঐ মুহূর্তে   এস ডিও সাহেবের চেম্বারে মিটিং চলছে তবু একবার দুরাভাষে জ্বালানোই যায়।  বড়জোর ফোন কেটে দেবে। এমন তো কতই হয়।  শৌভিক ফোন ধরে কি যে বলছে কিছুই বুঝতে  পারছিলাম না। সাময়িক  ভাবে অসহ্য লাগছিল মহানগরীর আনন্দ কলতান।  এক কান চেপে ধরে যা অনুধাবন করতে পারলাম শৌভিক যথাসম্ভব  সোচ্চারে কোন ট্রান্সফারের কথা বলছিল।  শুনতে অপারগ অগত্যা ও বলল একটু পরে জানাচ্ছে।  তীব্র উৎকণ্ঠা নিয়ে গুঁতোগুঁতি করে বাস থেকে  নেমে আবার ফোন করাতে শৌভিক বলল,“আমারও ট্রান্সফার হয়ে গেছে।  ”
“কার?” আমি চিৎকার  করে উঠলাম।
“আমার।  ”
“ কোথায় ??”
“জানি না!”
“মানে?”
“মানে আমার উত্তরসুরীর অর্ডার বেড়িয়ে  গেছে।  আমারটা এখনও---”
বোধগম্য হল না।  বদলির কোন প্রার্থনা জানাবার  অবকাশ ও পায়নি।  বদলি অবশ্যই প্রয়োজন । কিন্তু স্পাউস পোস্টিং এর প্রার্থনা ছাড়াই বদলির অর্থ পশ্চিমবঙ্গের ৩৪১টি ব্লকের মধ্যে যে কোন একটিতে হতে পারে।  ততোদিনে প্রায় সমস্ত মহকুমাতেই আমাদের অফিস খুলে গেছে।  কিন্তু সদ্য কলকাতায় ঢোকার পক্ষকালের মধ্যেই যদি আবদার করি স্বামীর কর্মক্ষেত্রের কাছাকাছি আমাকেও বদলি করতে হবে, তাহলে তৎকালীন এ্যাডিশনাল লেবার কমিশনার শ্রী সুবল বিশ্বাসের যতই অমায়িক মিষ্টভাষী  হন বা আমি ওণার স্নেহধন্য হই না কেন, উনি কান ধরে চেম্বার থেকে বার করে দিতেন এ ব্যাপারে আমি নিঃসংশয় ছিলাম। সুতরাং সেই মুহূর্তে দমবন্ধ-করা প্রতীক্ষা ছাড়া করণীয় আর কিছুই ছিল না। দীর্ঘ কুড়ি একুশ দিনের নিদারুণ যাতনা এবং প্রার্থনার পর অবশেষে অর্ডার বের হল। ষষ্ঠীর দিন সন্ধ্যা বেলা জানা গেল পরবর্তী  গন্তব্য মগরাহাট। পরে জানতে পারি জায়গাটার আসল নাম উস্তি।
এই জীবন সম্পর্কে খুব বেশি কিছু লিখতে পারছি না কারণ এই ব্লকের সাথে আমার প্রত্যক্ষ যোগাযোগ কখনই স্থাপিত হয়নি। মেয়ে নিয়ে যে কয়বার গেছি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ডারমন্ড হারবারে থেকেছি। মগরাহাটের চার বছরে অনেক ঘটনা ঘটেছে যেমন সংগ্রামপুরের বিষমদ কাণ্ড।  তবে এই সাম্প্রতিক ঘটনাবলীর সাথে সকলেরই সম্যক পরিচয় আছে তাই চর্বিতচর্বণ আর এই মুহূর্তে করছি না। হয়তো আবার কখনও মনে হলে লিখব। আজ নয়।  শুধু অন্তিম লগ্নে এই বিডিও গিরি থেকে অব্যাহতির কাঙ্ক্ষিত অর্ডার বের হওয়া নিয়ে যে টানাপোড়েন চলছিল, তা আমাদের পাশাপাশি তুত্তরিকেও কতটা প্রভাবিত  করেছিল তা এই মুহূর্তেও বোঝা যায় যখন ও বাবাকে দেখলেই বলে ওঠে,“অর্ডার বেরোবে বাবা। ”


No comments:

Post a Comment