Friday 4 September 2015

অনির ডাইরি ১ লা সেপ্টেম্বর,২০১৫


 আমাদের আড়াই বছর মাদপুর বাসের সবথেকে রোমহর্ষক অংশ অবশ্যই রাত্রি বেলা ভূূল ট্রেনে উঠে আমার কলাইকুন্ডায় পথ হারানো এবং শৌভিক শৈবালদা ডুয়োর উদ্ধার করা।  তবে সেটা “শ্রমিক আমির” অংশ। আগেই বলেছি ♣।

তখন শীতকাল , শৌভিককের এক গ্রাম পঞ্চায়েত থেকে এএলসিকে নিমন্ত্রণ জানানো হল “ পানিশিউলির মেলা”য়। শুধু নিমন্ত্রন পত্র পাঠিয়েই ওণারা ক্ষান্ত হলেন না, উপর্যুপরি অনুরোধ আসতেই থাকল।  এক হোমরাচোমরা নেতা নিজে এসে অনুরোধ  করে গেলেন পদধূলিধন্য করার জন্য। এমনি নয় অবশ্যই, মূল উদ্দেশ্য স্থানীয় অধিবাসীবৃন্দকে আমাদের সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্প গুলি সম্পর্কে সচেতন করা এবং নামনথিভুক্তি।খড়্গপুর ২ এর তৎকালীন নূন্যতম মজুরি পরিদর্শক ছিলেন সমীর সর্দার । সমীর বাবু আর আমাকে একত্রে ডিএলসি শৈবাল দা বলতেন “হাইপার এ্যাক্টিভ টিম”। বিনা অর্থব্যয়ে  তথা বিনাআয়াসে সচেতনতা শিবির তখন চরম কাঙ্ক্ষিত বস্তু । আমরা একপায়ে খাড়া। মেলা যদিও সন্ধ্যা বেলায়, পথ অনেকটা এবং বেশ রিমোট জায়গায় ।  বিকাল চারটে নাগাদ আমরা এএলসি ইন্সপেক্টর মিলে রওনা  দিলাম।  যাবার আগে স্যার বেশ কিছুক্ষণ ধরে জেরা করলেন, বুঝতে পারলাম আমাদের উত্তর ওণার আদৌ মনঃপূত হয়নি। চলে আসছি উনি ডেকে বললেন,“দেখ তোমাদের অভিজ্ঞতা কম।  সব শুনে আমার বেশ চিন্তা হচ্ছে কোন বিপদ আপদ না হয়।  যাবে মনস্থ করেছ যাও,  কাল জানিও কটা রেজিস্ট্রেশন হল। ” আমরা অকুতোভয় বেড়িয়ে  পড়লাম।  শৌভিক সকালে জানিয়েছিল ও যাবে। ফোনে জিজ্ঞাসা করাতে বলল ব্লক থেকে ওকে তুলে নিতে।  শেষ পর্যন্ত যখন আমরা রওনা  দিলাম সূর্য পাটে বসতে চলেছে।  আমাদের গাড়ি ছেড়ে বিডিওর গাড়িতেই আমরা সওয়ার হলাম। কারণ আর কিছুই না ঐ রাস্তা কেবল ড্রাইভার শৈবালদাই চিনতেন।
মরা গোধূলিরআলোয় সে এক রোমহর্ষক সওয়ারি ।  হাইওয়ে থেকে নেমে সরু কাঁচা মাটির রাস্তা, বাঁশ ঝাড়, পুকুরের পাশ  দিয়ে টলটলিয়ে চলল এ্যাম্বাসাডর। মাঝে মাঝে উঁচু রাস্তা থেকে ডাইভ মেরে নীচে নামছে, আবার কখনও হড়কে পড়তে পড়তে উপরে উঠে যাচ্ছে।

মাঝে মাঝে চোখজুড়ানো সূর্যমুখী আর গাঁদার ক্ষেত।  হঠাৎ ঝাঁকুনি খেয়ে থমকে  দাঁড়ালো গাড়ি।  সামনে বাঁশ দিয়ে রাস্তা আটকানো। একদল ফচকে ছেলে দৌড়ে এল একটা বিল বই নিয়ে।  শৈবাল দা সবে হুঙ্কার  দিতে যাবে, শৌভিক ইশারায় নিষেধ করল।  পুচকে গুলো যখন গাড়ির খুব কাছে এসে গেছে, ধড়াম করে দরজা খুলে তীব্র হুঙ্কার  ছুড়ল শৌভিক,“বিডিওর থেকে চাঁদা নিবি?”দুদ্দাড় করে দৌড়ল সবকটা।  “কিসের পুজো রে এই?” বলতে বলতে খানিক ধাওয়া করল বিডিও আর তাঁর ড্রাইভার। ভয় দেখানোই আসল উদ্দেশ্য ।  ফিরে এসে শৈবাল দা বাঁশ খুলে দিয়ে আবার ইঞ্জিন চালু করলেন।  পথে একই নাটকের আরো দুবার পুনরাভিনয় হল। যত মেলাপ্রাঙ্গনের দিকে এগোতে লাগলাম যত্র তত্র ছোট ছোট জটলা চোখে পড়তে লাগল।  আমার চোখে কোন অস্বাভাবিকতা ধরা না পড়লেও শৈবাল দা চাপা গলায় বলে উঠল ,“দেখছেন স্যার এখন থেকেই নেশা করে বসে আছে। ”

অবশেষে যখন  আমরা মেলা প্রাঙ্গণে পৌছলাম তখন সন্ধ্যা নামছে।  মেলা প্রাঙ্গণ শব্দটা একটু বাড়াবাড়ি , একটা মাঝারি সাইজের মাঠ।ইতিউতি হাতে গোনা কয়েকজন ছেলে মেয়ের জটলা ছাড়া কোন কর্তা ব্যক্তি চোখে পড়ল না।  আদৌ কোন স্টল ছিল কি না আজ আর মনে নেই।  একটা অন্ধকার অর্ধনির্মিত মঞ্চ অবশ্য অপেক্ষা করছিল আমাদের জন্য।  সমীর বাবু আর আমি হতভম্ব কিংকর্তব্যবিমূঢ়  হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম।  শৌভিক খানিক এদিক ওদিক পায়চারি করে নিল।  শৈবাল দা অসহিষ্ণু হয়ে বলল, “কাছেই প্রধান সাহেবের বাড়ি। ” অনুমতি পেলে উনি প্রধানকে পাকড়ে  আনতেন, আমার কাছে নম্বর না থাকায় ইশারায় সমীর বাবুকে বললাম সেই নেতামশাইকে ফোন করতে।  ফোনে যা কথা হল, বুঝতে  পারলাম উনি অপেক্ষা করতে বললেন।  শৌভিক অবশ্য আর এক মুহূর্ত নষ্ট করতে রাজি হল না।  আমরাও দেখলাম অন্ধকার ক্রমে ঘন হচ্ছে এমতাবস্থায় অযথা সময় অপচয় করে কোন লাভ নেই।  সর্বোপরি মেলায় উপস্থিত জনগনকে দেখে হতাশা আরো বাড়ছিল।  অসংগঠিত শ্রমিকদের সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পে যে এরা আদৌ উৎসাহী হবে না, অন্তত সেই মুহূর্তে তো হবেই না তা অনুমান করা কষ্টকর ছিল না। একরাশ হতাশা নিয়ে গাড়িতে উঠলাম, সাথে উৎকণ্ঠা, কাল ডিএলসি শৈবাল দা যখন জানতে পারবেন কি অমৃতবাণী যে শুনতে হবে। কি আর করা যাবে? পথে শৌভিক কুবুদ্ধি দিল ,“ডি এল সি সাহেব বকাবকি করলে বলিস,গোটা পঞ্চাশেক ফর্ম দিয়ে এসেছিস, ওরা ফিল আপ করে টাকা সমেত  ব্লক অফিসে পাঠিয়ে দেবে। ” অগত্যা আমরা ফিরে চললাম, নিকষ অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে ফেরাটা রীতিমত রোমহর্ষক ছিল।  অনেক পরে সমীর বাবুকে নামিয়ে যখন আমরা ফিরছি, শৌভিক বলল, “আজকে তোদের নিয়ে আমি বেশ টেনশনে ছিলাম।  জায়গাটা ভাল নয়।  আমার দুই পূর্বসুরীকে ওখানে হেকলড্ হতে হয়েছিল।  তাই একা ছাড়ার সাহস পাইনি। ”
প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে দিন দুয়েক বাদে শৈবাল দা যখন জিজ্ঞাসা করলেন,“এই তোমাদের পানিশিউলির মেলা কেমন হল?” আমরা মিথ্যা বলতে পারিনি।  সব শুনে উনি শুধু বলেছিলেন,“ জানতাম। ”

দেখতে দেখতে মাতৃত্বকালীন ছুটি নেবার সময় ঘনিয়ে এল। জুলাই মাস।   প্রাক পরিবর্তন রাজনৈতিক  পরিস্থিতি বেশ উত্তপ্ত হয়ে উঠছে।  ইলেকশন আসতে আর দশ মাস মাত্র।  ওদিকে কিশনজী আর যৌথ বাহিনীর দ্বৈরথ।  খড়্গপুরের এস ডি ও তখন শ্রী অরিন্দম দত্ত। দত্ত সাহেবের ব্যক্তিগত উদ্যোগে মাত্র পাঁচ দিন ছুটি মঞ্জুর  হল শৌভিকের।  আমার বাবার ইচ্ছায় মধ্য হাওড়ার এক সাবেকী নার্সিংহোমে জন্ম হল তুত্তুরীর।  আমাদের বৃহত্তর পরিবারের অনেকেরই পুত্র কন্যা ঐ প্রৌঢ় ডাক্তারবাবুর হাতে হয়েছে।  স্বামী গাইনি, স্ত্রী শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ।  নিজেদের বাড়িতেই নার্সিং হোম।  চিকিৎসা  পদ্ধতি  ও বেশ সাবেকী ।  সাত দিনের আগে ওণারা কাউকে ছাড়েন না।  সেলাই কেটে সপ্তম দিন রেহাই দেন।  রবিবার ভরতি হয়েছিলাম অর্থাৎ পরবর্তী রবিবার সকালের পূর্বে  মুক্তি পাবার সম্ভবনা নেই।  সোম মঙ্গল তো সিডেটিভের ঘোরে কাটালাম কিন্তু বুধবার  সন্ধা থেকে শুরু হল আকুল ক্রন্দন । মনের মধ্যে বারংবার অনুরণিত হচ্ছিল, আর মাত্র কটা দিন, সোমবার ভোরেই ওকে চলে যেতে হবে।  আবার কবে ছুটি মিলবে? আবার কবে দেখা হবে? বারবার তো আর এসডিও সাহেব দাক্ষিণ্য দেখাতে পারবেন না।  শৌভিক সাধ্যমত বোঝাবার আকুল চেষ্টা করতে লাগল।  কান্না আর থামে না। বৃহস্পতিবার কান্নার বেগ বাড়ল বই কমল না।  দীর্ঘ দিনের পরিচিত প্রৌঢ় ডাক্তার দম্পতি প্রায় আত্মীয় সমতুল, প্রথমে সস্নেহে পরে ধমকে বোঝাবার অনেক চেষ্টা করলেন।  বেচারা আমার বৃদ্ধ বাপ বিনা দোষে আমার জন্য বকুনি খেল ডাক্তারের কাছে।  বেশি কিছু তো চাইনি শুধু অনুরোধ করেছিলাম আমাকে মুক্তি দিন।  শনিবার এসে সেলাই কাটিয়ে যাব।  সম্ভবত সবটুকুই ছিল পোস্টন্যাটাল ডিপ্রেসন্। অথবা নয়।  তবে সেদিনের কথা ভাবতে বসলে আজও হৃদয় ব্যথিত হয়। জানি যদিও এরকম  তো কতই হয়-----󾌮󾌮󾌮

(?)

No comments:

Post a Comment