ডাক্তারের পরামর্শে আমাকে আশ্বাসন দেওয়া হল, ক্ষত সারলেই তুত্তুরী সহ আমাকে মাদপুর নিয়ে যাওয়া হবে। এক সপ্তাহ নার্সিং হোমে অতিবাহিত করে মেয়ে নিয়ে বাড়ি ফিরলাম রবিবার সকালে। সোমবার ভোরে বিদায় জানাতে হল শৌভিককে। এক সপ্তাহব্যাপী ছুটি উবে গেল কর্পূরের মত। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে তখন ইলেকশনের সামারি রিভিশন চলছে। কোনমতেই বিডিওর ছুটি পাবার কথা নয়। পেত ও না, যদি না তদানিন্তন মহকুমা শাসক শ্রী অরিন্দম দত্ত নিজ উদ্যোগে না ছাড়তেন। এই নিয়ে কিছু প্রশাসনিক জটিলতার সৃষ্টি হয়, তবে দত্ত সাহেব একাকী তার মোকাবিলা করেন। আঁচটুকুও লাগতে দেননি শৌভিকের গায়ে। শুধু তাই নয় আমার দুশ্চিন্তা বৃথা করে উনি প্রতি সপ্তাহান্তেই শৌভিককে ছেড়ে দিতেন, যাতে সদ্যোজাত সন্তানের সাথে অন্তত কিছুটা সময় অতিবাহিত করতে পারে।
সাড়ে চার মাসের মাতৃত্বকালীন অবকাশযাপন অন্তে নভেম্বরে যখন মাদপুরে প্রত্যাবর্তন করলাম, মাদপুর বড়ই বিবর্ণ লাগল। চারমাসের তুত্তুরী রয়ে গেল হাওড়ায় আমার মা বাবার সাথে। সকলের সম্মিলিত আপত্তিতে আর ওকে আনা সম্ভব হল না। সত্যি তো এত পোকামাকড়, ব্যাঙ সর্বোপরি ধেড়ে ইঁদুর। তাও হয়তো আনতাম কিন্তু সারাদিন লক্ষ্য রাখার মত লোক অনেক খুঁজেও পাওয়া গেল না।
মাদপুরের সেই ন্যাড়া কোয়ার্টর ইতিমধ্যে আমূল পরিবর্তিত। চতুর্দিকে উচু প্রাকার পরিবেষ্টিত , সামনে বিশাল গেট। গেটে নিওন সাইন “সমষ্টি উন্নয়ন আধিকারিকের নিবাস” তাতে শৌভিকের নাম লেখা। বাদবাকি সবই পূর্বাবৎ। জীবন আবার গড়াতে লাগল নিজ ছন্দে। কিন্তু শতচেষ্টাতেও আর খড়্গপুর বা মাদপুরকে ভাল লাগাতে পারছিলাম না। কানাঘুষো শোনা যেতে লাগল শীঘ্রই ট্রান্সফার হব। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই ভোটের দামামা বেজে উঠল। সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম থেকে নেতাইগ্রাম হয়ে লালগড় নানাঘটনা তুফান তুলছে বাঙালির চায়ের কাপে। দেখতে দেখতে এসে পড়ল পরিবর্তনের ইলেকশন।
এই সময় বেশ কিছুদিেনর জন্য বাবা- মা তুত্তুরীকে নিয়ে মাদপুর ঘুরে যাওয়াতে আমরা কিছুটা অক্সিজেন পেলাম।
মাদপুরবাসের দিনগুলিতে কোন অথিতি এলেই আমরা তাঁদের নিয়ে পাতরা যেতাম। মনোরম কাঁসাই নদীর বেশ কিছু পুরাতন ভগ্নপ্রায় টেরাকোটা মন্দির যা স্থানীয় এক মুসলিম ভদ্রলোকের একার প্রচেষ্টায় সংরক্ষিত হয়েছে। ওনার নাম দুর্ভাগ্যবশত এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না। ইয়াসিন মালিক বা ইয়াসিন পাঠান সম্ভবত । আমার বাবা এবং শ্বশুর মশাই দুজনেই ওনার সাথে আলাপে উৎসাহী ছিলেন। যদিও সময়াভাবে তা আর হয়ে ওঠেনি। পাতরার অপর এক বৈশিষ্ট্য ছিল, অধিকাংশ মন্দির বিগ্রহশূন্য ছিল। কারণ অজ্ঞাত । এছাড়াও আমাদের যুগলের প্রিয় ঘোরার জায়গা ছিল খড়্গপুরের একমাত্র মল, নাম ছিল “পূজা মল। ” একতলায় সদ্য খোলা ক্যাফে কফি ডের আমরা নিয়মিত অতিথি ছিলাম।বাঁধা মেনু গ্রিলড্ চিকেন স্যান্ডউইচ আর ডেভিলস্ ওন। সাথে নিভৃত আলাপচারিতা । তিনতলায় ছিল একটি হাবিবস্ শ্যালোন। কলকাতার তুলনায় অন্তত দেড়গুণ সস্তা ছিল সবকিছু । ওদের নিয়মিত খরিদ্দার ছিলাম আমি। তখনও এত খারাপ অবস্থা ছিল না আমাদের, মাত্র ১০ শতাংশ ডিএ কম পেতাম। একদিন সন্ধ্যা বেলা হাবিবস্ এ আছি, হঠাৎ শৌভিকের ফোন ফিসফিস করে জিজ্ঞাসা করল, আমার আশেপাশে কোন কালো মোটা লোক ফেসিয়াল করাচ্ছে কি না। যার মাথায় রিং টাক অথচ চাপদাড়ি। পাশে চোখে শশার টুকরো আর মুখে প্যাক মেখে গোল গলা গেঞ্জি পরা একটি লোক বসেছিল, ভয় পেয়ে গেলাম, বর্ণনা অনেকটাই নামি দুষ্কৃতি তথা হাজতবাসকারী রামবাবুর সাথে মিলে যাচ্ছে। তবে তার মুক্তি আসন্ন জানতাম, তবে কি ছাড়া পেয়েই গেল? পরে শুনলাম উনি জনৈক অবজার্ভার। ওণার বায়নাক্কার ঠেলায় প্রশাসনের নাভিশ্বাস উঠছিল। তাতে নতুন যোগ হয়েছিল হাবিবস্ এর আতিথ্যগ্রহন।
সেবার শৌভিকের এ্যাসেম্বলী কনস্টিটিউয়েন্সীর অবসার্ভার হয়ে এলেন ডঃ গনি। কাশ্মীরি ক্যাডারের আই এ এস। প্রথম দর্শনে মনে হবে কবির বেদির যমজ ভাই। কাশ্মীরি আপেলের মতই গাত্র বর্ণ, নীল চোখ, খড়্গনাসা। নির্মেদ, কবির বেদির থেকেও লম্বা। এপ্রিল মে মাসের ঐ চাঁদিফাটা গরমে উনি কাহিল হয়ে পড়ছিলেন। বাধ্য হয়ে জয়েন্ট বিডিও সাহেবের অপেক্ষাকৃত ছোট চেম্বারটিকে বাতানুকূল করার ব্যবস্থা করা হয়। যতদূর মনে পড়ে যন্ত্রটি ধার করা হয়েছিল এবং সম্ভবত জেনারেটরের মাধ্যমে চালানো হত। গনি সাহেবের জন্য স্করপিও গাড়ি বরাদ্দ করা হয়েছিল। ঝকঝকে নতুন গাড়ি। কিন্তু জনাবের ঐ গাড়ি নাপসন্দ। ওনার কাম্য ইনোভা। তৎকালে মফঃস্বলে ইনোভা গাড়ি দুষ্প্রাপ্য ছিল। অবজার্ভার সাহেবের আবদারে অনেক অন্বেষণের পর যোগাড় হল ইনোভা গাড়ি। সাহেবের নির্দেশে উনি গাড়িতে সওয়ার হবার অন্তত আধঘন্টা পূর্বে এসি চালিয়ে রাখতে হত। বাঙালি খাবার উনি পূর্বে কখনও চাখেননি। পোস্ত খেয়ে মোহিত হয়ে গিয়েছিলেন। ওণাকে খাওয়ানোর দায়ভার অবশ্য শম্ভু নিমাই কে দেওয়া হয়নি। নামি ক্যাটারার সরবরাহ করত। তবে গনি সাহেব যখন অন্নগ্রহণ করতেন পাশে কাউকে থাকতে হত, প্রতিটি পদ সম্পর্কে সবিস্তারে বর্ণনা করতে হত। আগে শুক্তো শেষে দই মিষ্টি না বলে দিলে বুঝবেন কি করে। দ্বৈপ্রাহরিক আহার উনি বিডিওকে ছাড়া করতেন না। বেচারা শৌভিক সকালে আমার সাথে ভাত না খেয়ে অফিস গেলে আমি রুষ্ট হতাম, খেয়ে গেলে গনি সাহেব। এতো গেল বায়নাক্কা, তবে কাজের বেলা অসম্ভব খুঁতখুঁতে ছিলেন উনি। বুথ দর্শন থেকে ভোটার টার্ন আউট রিপোর্ট সব কিছু খোদ ‘সক্রুটিনি’ না করলে ওনার শান্তি হত না। প্রসঙ্গত না বলে পারছি না সেবার উপমন্যু চট্টোপাধ্যায়ও অবসার্ভার হয়ে আসেন মেদিনীপুরে।
ইলেকশন শেষ। কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন। গণনার পরের দিন শেষ বাবের মত জ্বালাতন করে কাশ্মীর ফিরে গেলেন ডঃ গনি। অপরাহ্নে আমরাও বাড়ি আসার জন্য তৈরি হঠাৎ সব পরিকল্পনা বানচাল করে দিল একটি বাঁদর। ৬ নং জাতীয় সড়কের ধারে বুড়ামালা বলে একটি অঞ্চল আছে। ঐটি খড়্গপুর ২নং ব্লকের অন্তর্গত । প্রতি শীতে ওখানে মহাবীর মেলা বসে। কস্মিনকালে একটি হনুমান রাস্তা পেরোতে গিয়ে ঐ স্থানে গাড়ি চাপা পড়েছিল। তারপর নানান আধিভৌতিক ঘটনা ঘটতে থাকে, পরিশেষে স্থানীয় অধিবাসীবৃন্দ মৃত হনুমানের উদ্দেশ্যে একটি মন্দির নির্মাণ করেন এবং প্রতি বৎসর মেলা বসাতে শুরু করেন। বিগত শীতে আমরা যুগলে সে মেলা উদ্বোধনও করে এসেছি। ইলেকশনের সময় যে কেন্দ্রীয় বাহিনী এসেছিল তাদের মধ্যে একটি নাগা ব্যাটেলিয়ন ছিল। যাদের সাময়িক ঠিকানা ছিল বুড়ামালার সন্নিকটে কোন স্কুল । নাগারা আসার পর রাস্তার সারমেয় কূল ক্রমহ্রাসমান হয়ে পড়ে, এই নিয়ে স্থানীয় বাসিন্দারা ক্ষুব্ধ ছিলই। সমস্যা আরো সঙ্গীন হয় যখন নাগা সৈন্যরা লোভ সংবরণ করতে না পেরে একটি হনুমানকে কাটতে যায়। দা জাতীয় কোন অস্ত্র দিয়ে কোপ মারা হয়। মারাত্মক আহত হলেও প্রাণীটি মরেনি। ঐ রক্তাক্ত অবস্থায় গাছের মগডালে উঠে প্রবল আর্তনাদ করতে থাকে।ঐ ভয়াবহ দৃশ্য দেখে স্থানীয়দের ক্ষোভ বাঁধ ভাঙে, খোদ মহাবীরের পীঠস্থানে হনুমান ভক্ষণের প্রয়াস? ঘোর পাপাচারের বিরুদ্ধে জাতীয় সড়ক অবরোধ করে ধিক্কার জানানো শুরু হয়। ভোট শেষে খবরের আকাল চলছিল, এইরকম চটকদার খবর পেয়ে বেশ কিছু বাঙলা সংবাদ চ্যানেল ও এসে জুটে যায়। শৌভিককে দৌড়তে হয়। খবর পেয়ে বনদপ্তরের আধিকারিক গণ আসেন। হনুমানটিকে পরিচর্যার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। সেদিন আমাদের বাড়ি ফেরা হয়নি বটে তবে বেশ কিছু আত্মীয় স্বজন দূরাভাষ মারফৎ জানান যে শৌভিককে বোকা বাক্সে দেখাচ্ছে। সত্যি রোদে পুড়ে তামাটে, চোখের নীচে কালি, ক্লান্ত, আধা ঘুমন্ত শৌভিক শেষ কাচা টি শার্টটি পড়ে বাঁধাগৎ আওড়াচ্ছে, তোতাপাখির মত।
সেদিন হনুমান হলে পরেরদিন একটি গরুর জন্য আমাদের বাড়ি ফেরা আরো বিলম্বিত হল। পূর্বরাত্রে ঠিক ছিল পরদিন কফি খেয়েই বেড়িয়ে পড়ব। প্রাতরাশ বাড়ি ফিরে করা হবে। সেই মত বের হতে যাব ফোন, প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের খোলা সেপটিক ট্যাঙ্কে একটি গরু পড়ে গেছে। উঠতে পারছে না,তাকে তোলার ব্যবস্থা করতে হবে!!!!
দেখতে দেখতে আবার আমাদের বিবাহ বার্ষিকী এসে গেল। তৎকালীন উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে অর্ধদিবস ছুটি নেওয়াও দুষ্কর ছিল। অগত্যা ঠিক হল রাত্রি বেলা রোজভ্যালিতে ডিনার করতে যাওয়া হবে। মেদিনীপুর শহরে রোজ ভ্যালির ঐ রেস্টুরেন্টটি ছিল তৎকালীন সবথেকে বিলাসবহুল রেস্তোরাঁ । বাতানুকূল সুসজ্জিত স্বল্পকালের জন্য মনে হত পার্কস্ট্রীট। অফিস করে সেজে গুজে যুগলে গেছি রোজভ্যালি, কথাপ্রসঙ্গে শৌভিক জানালো একটি “কেলো” হয়েছে। জনৈক স্টাফ ছুটি চাইতে এসেছিল, উপলক্ষ্য নবপরিণীতা স্ত্রীর শুভজন্মদিন। আমার বর শুধু আবেদন নাকচ করেই ছাড়েনি, উল্টে খানিক সদুপদেশ দিয়ে শেষে বলেছে,“এই তো আজ আমাদের অ্যানিভার্সারি। ম্যাডাম ও অফিস গেছেন, আর আমি ও। ” কথা ছড়াতে সময় লাগেনি। সাব এ্যাসিস্টান্ট ইঞ্জিনিয়ার অরিজিৎ বাবুর নেতৃত্বে স্টাফেরা আবদার জানান ওণারা কিছু উপহারের মাধ্যমে শুভেচ্ছা জানাতে ইচ্ছুক । পত্রপাঠ আবেদন নাকচ হবার পরও ওণারা হতোদ্যম হননি। ছুঁতোনাতায় জেনে নিয়েছেন আমরা রাত্রে রোজ ভ্যালি যাব। বিরাট সুসজ্জিত ডাইনিং রুমের এক কোণে আমরা নিভৃত আলাপচারিতায় মগ্ন হঠাৎ শৌভিক আঁতকে উঠল, “এইরে অরিজিৎ বাবু উঁকি মেরে গেলেন, সদর দরজা দিয়ে। ” কিয়ৎক্ষণ পরেই অরিজিৎ বাবু ঢুকলেন দুটি পুষ্পস্তবক এবং রাংতা মোড়া তিনটি উপহার নিয়ে। সর্বসমক্ষে আমাদের সোচ্চারে শুভেচ্ছা জানালেন এবং আমাদের হাতে উপহার তুলে দিলেন। এমনকি অনুপস্থিত তুত্তুরীকেও ওণারা ভোলেননি। আমরা যৎপরনাস্তি আপ্লুত এবং অভিভূত। হঠাৎ পাশের টেবলে আহাররত অবাঙালি দম্পতির মধ্যে মৃদু বাকবিতণ্ডা আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করল। মহিলা অনুযোগের সুরে কিছু বলছিলেন, ভদ্রলোক অসহায় ভাবে ইংরেজিতে জানালেন আজ ওণাদের ও শুভদিন। ওণার স্ত্রী অনুযোগ করছেন কেন ওণাদের কেউ এমন উপহার বা শুভেচ্ছা জানাল না। চার জনেই হেসে উঠলাম।
মাস দুই তিনের মধ্যেই বহুকাঙ্খিত এবং বহুবিলম্বিত ট্রান্সফার। চার বছর তিনমাস পশ্চিম মেদিনীপুরে অতিবাহিত করার পর মহানগর কলকাতা। সদর দপ্তর থেকে তাগাদা এল সত্বর এস। প্রথম গড়ে তোলা সংসার, স্বামী, কোয়ার্টর, ধানক্ষেত, আমগাছ, রেললাইন, পোকামাকড়, ধেড়ে ইঁদুর সব ফেলে সানন্দে চলে এলাম কলকাতা, মেয়ের কাছে। চার দিন পর এলপিসি আনতে গিয়ে মন খারাপ হয়ে গেল। সব যেন আরো মলিন, ধুলি ধুসরিত, শৌভিককে এত বিমর্ষ অসহায় কখনও দেখিনি। রাতে খেতে যাওয়া হল রোজ ভ্যালি মেদিনীপুর। সেই রোজ ভ্যালি কেমন যেন বিবর্ণ। খেয়ে ফিরছি জনশূন্য অন্ধকার রাস্তা দিয়ে বুলেটের মত ছুটছে শৈবাল দার গাড়ি, শৌভিক বিমর্ষ হয়ে বলল,“এই নির্জনতা, এই একাতীত্ব অসহনীয়।বৃটিশ আমলে পর পর উত্তর পূর্বের তিনজন রেসিডেন্ট কমিশনার আত্মহত্যা করেছিল শুধু এই একাতীত্বের আতঙ্কে। ” আমি চলে যাবার দুই দিন পরেই প্রথম সাপ ঢুকেছিল কোয়ার্টরে।
(চলবে ?)
No comments:
Post a Comment