অনেক দিন আগের কথা,
তখন পশ্চিম বঙ্গে রাজনৈতিক পালাবদল, মুষ্টিমেয় জনগণের দিবাস্বপ্ন মাত্র। রেড জোন
আছে বটে, তবে জঙ্গলমহল তখনও লাল হয়নি। মাঝে মাঝেই বিরাপ্পনের নাম শোনা গেলেও,
কিষান জীর সাথে বঙ্গবাসী তখনও অপরিচিত। শিলালিপি, লিপিলেখা, ঊষাঙ্গিনি আর নবনী চার
ঘনিষ্ট বন্ধু। চার জনেই ডেইলি পাষণ্ড। ১১৩ নং মেদিনীপুর লোকাল এবং ১১৫ নং খড়গপুর
লোকালের মহিলা কামরার সব নিত্যযাত্রী এবং সব হকার ওদের চেনে। ওরা একসাথে যায় আবার
এক সাথে ফেরে। নবনী এবং উষাঙ্গিনিী এ লাইনে পুরানো পাপী, বহুদিন ধরে যাতায়াত করছে,
উষাঙ্গিনির বয়স দেখে যদিও মনে হয় পঞ্চাশ, বাহান্ন এমনকি পঞ্চান্নও হতে পারে, তবে
তিনি দাবী করেন তাঁর বয়স নাকি সবে চল্লিশ পেরিয়েছে। কয়েক বৎসর পূর্বেও দোহারা
চেহারা ছিল, আজকাল একটু ভারির দিকে। ঘোর কৃষ্ণ বর্ণ। সস্তার কলপ করা চুলে গদগদে
করে সিঁদুর পরেন। হাতে শাঁখা, পলা। অধিকাংশ দিনই সিনথেটিক শাড়ি পরেন, কদাচিৎ তাঁত
বা সিল্ক। চান করে ভেজা চুল বেঁধে ট্রেনে ওঠেন, উঠেই আগে চুলটা খুলে দেন। চটি খুলে
সিটের ওপর বাবু হয়ে বসা ওনার প্রিয়তম অভ্যাস। জোরে জোরে কথা বলেন, কথায় কথায়
অট্টহাস্য করেন, মাঝে মাঝে সুর করে গানও গান, অবশ্য চলতি বাংলা সিনেমার গান, না
হলে বড় জোর স্বর্গীয় মান্না দে বা সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গান। গান গাইতে গাইতে
সিটে বসে এক পাক নেচেও নেন। অবশ্য কামরা খালি থাকলে তবেই। কোন এক কেন্দ্রীয় সরকারি
অফিসে চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী।
উষাঙ্গিনির পুত্র কন্যা উভয়েই বিবাহিত। বড় নাতিটিরই সপ্তম শ্রেণী হল। স্বামীও ঐ
একই অফিসে চাকরী করেন। তবে কলকাতায় পোস্টেড। একদিন কথা প্রসঙ্গে বলেই ফেলেছিলেন,
স্বামীর কাজে খুশি হয়ে কোন এক বড় সাহেব ঊষাঙ্গিনিকে অনুগ্রহ পূর্বক এই চাকরীটী
যোগাড় করে দেন। যাই হোক মহিলা কামরার নিত্যযাত্রীদের কাছে উনি খুব একটা জনপ্রিয়
নন। কারণ উনি নাকি অনেকের কাছেই টাকা ধার করে রেখেছেন। হকাররাও ওনাকে দেখলে সরে
সরে যায়। তবে টাকার পরিমান ৫০০-১০০০ এর মধ্যেই থাকে। উনি সময় সুযোগমত ৫০-১০০ করে
শোধও দেন, তবু শিলালিপি আর লিপিলেখাকে নিরালায় পেলেই অন্যান্য মহিলা যাত্রীরা
সাবধান করে দেয়। সব মিলিয়ে মানুষটা মন্দ নন। শহুরে পালিশ বিহীন গ্রাম্য মহিলা।
শিলালিপি আর লিপিলেখা
সদ্য সদ্য ডেইলি পাষণ্ডগিরি শুরু করেছে। দুজনেরই দপ্তর খড়্গপুর। ওদের বয়সও
কাছাকাছি, সমবয়সীই বলা যায়। দুজনেই গৌরী, বেশ হৃষ্টপুষ্ট। শিলালিপি আসে হাওড়া থেকে
আর লিপিলেখা ট্রেনে ওঠে বাগনান থেকে। ট্রেনেই ওদের আলাপ, আলাপ থেকে ঘনিষ্টতা হয়ে
বর্তমানে ওরা একে অপরের প্রিয়তম বান্ধবী। শিলালিপির বদলির চাকরী, খড়গপুর ওর প্রথম
পোস্টিং। বাবা মায়ের দুলালী, প্রথম দিন বৃদ্ধ বাবা সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন। সমুদ্র
নীল জিন্স, সাদা শার্ট আর উঁচু গোড়ালির ফ্যাশন দুরস্ত জুতো পড়ে প্রথম দিন অফিস
গিয়েছিল শিলালিপি। বাড়ি থেকে বেড়িয়ে অফিস পৌছতে লেগেছিল পাক্কা চার ঘণ্টা। জুন
মাসের তীব্র গরমে তথা পথশ্রমে ক্লান্ত মোমের পুতুলকে দেখে মেদিনিপুরিয়া বড় সাহেবের
মনেও দয়া হয়েছিল, তাই সেদিন তড়িঘড়ি ছেড়ে দেন। সাড়ে তিনটের ট্রেন, লোকাল অবশ্যই, ঐ
সময় কোন এক্সপ্রেস ট্রেন থাকে না, ধরার জন্য তিনটের সময় অফিস থেকে বেড়িয়ে যথারীতি
চার ঘণ্টা পর সন্ধ্যা সাতটার সময় বাড়ি ঢুকে শিলালিপি হাত পা ছড়িয়ে কাঁদতে বসে।
সাথে সাথে মাও খানিক কেঁদে নিলেন। সে কি নাটক বাপ রে বাপ। অবশেষে শিলালিপির বাবা
প্রবল চিৎকার চেঁচামিচি করে পাড়ার লোকের ঘুম চটকিয়ে নাটকে যবনিকাপাত করেন। সেদিনের মত নাটক বন্ধ হলেও পরদিন থেকে নতুন নাটক
শুরু করে শিলালিপি। মোবাইলের অ্যালার্ম বেজে বেজে থেমে যায়, মা ডেকে ডেকে ক্লান্ত
হয়ে পড়েন, বাবার চিৎকারে পাড়ার তন্দ্রাচ্ছন্ন সারমেয় কূলের আমেজ নষ্ট হয়ে যায়,
কিন্তু শিলালিপির ঘুম আর ভাঙে না। অবশেষে যখন নিদ্রাভঙ্গ হয়, তখন বেলা নটা। অতএব ঐ
দিন আর অফিস যাওয়া হয় না। তাতেও শিলালিপির কোন অপরাধ বোধ ছিল না, দিব্যি চান করে
ভাত খেয়ে, বাতানুকূল যন্ত্র চালিয়ে একটা সুখী সুখী দিবানিদ্রার উদ্যোগ নিচ্ছিল, সব
আমেজ নষ্ট করে দিল একটা ফোন। আগের দিনের স্নেহশীল বড় সাহেবের ফোন, আজ অবশ্য গলায়
স্নেহ ছাড়ুন, বিন্দুমাত্র মিষ্টতাও ছিল না। হিমশীতল গলায় ধমকালেন, পুনরায় বিনা
সংবাদে বা কোন অগুরুতর কারণে অফিস না গেলে, উনি যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নেবেন।
শিলালিপি অনুভব করল বাস্তবিকই গরিবের কথা বাসী হলে কতটা মিষ্টি হয়, বিগত রাত থেকে
নানা ভাবে বাবা এই কথাটাই বোঝাবার নিরলস চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন। জনমানসে রাজ
কর্মচারীদের সম্পর্কে যাই ধারণা থাকুক না কেন, সরকারি চাকরীতে আদৌ যেমন খুশি চলা
যায় না। ঢুকেছ কি মরেছ। বাবা যথার্থই বলেন, “সরকারি চাকরী হল আদতে চাকরগিরি। আর
তোরা হলি জনগণের চাকর বাকর, public servant?”
শিলালিপির স্বর্গীয়
মাতামহ রবীন্দ্রনাথের অনুপ্রেরণায় প্রথমা কন্যার নাম রেখেছিলেন উর্বশী। এই নিয়ে
মাতামহের সাথে ওনার মাতা ঠাকুরানীর তীব্র বিবাদ হয়, অপ্সরার নামে ভদ্র পরিবারের
মেয়ের নাম রাখা সেই প্রাচীনপন্থী মহিলার মতে ছিল নিতান্তই “অলপ্পেয়ে” ব্যাপার
স্যাপার। জাই হোক কয়েক বৎসর পর যখন শিলালিপির মাসিমণির জন্ম হল, তখন সেই মহিলা জেদ
ধরলেন নাতনির নাম রাখতে হবে রম্ভা। মাতামহ হয়তো অন্য কোন শ্রুতিমধুর নাম কল্পনা
করেছিলেন, কিন্তু বৃদ্ধার জেদের সামনে অস্ত্র ত্যাগ করতে বাধ্য হন। যাইহোক রম্ভার
জন্মের পর ঠাকুমা খুব অল্পকালই জীবিত ছিলেন, ওনার মৃত্যুর পর যতবার রম্ভার নাম
পরিবর্তনের প্রচেষ্টা হয়েছে, প্রতিবার রম্ভা তা ব্যর্থ করতে সক্ষম হয়েছে। বৃদ্ধ
পিতামহী মৃত্যুর পূর্বে যেন তাঁর সমস্ত জেদ এবং ব্যক্তিত্ব ঐ ক্ষুদ্রিকাকে দিয়ে
গিয়েছিলেন, বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত কেউ রম্ভার নাম নিয়ে ফাজলামি করার
সাহস পায়নি। উর্বশী এবং রম্ভা সহোদরা হলেও চরিত্রগত ভাবে সম্পূর্ণ বিপরীত । শিলালিপির
মা স্বভাবত বেশ মিষ্ট এবং কোমল, সর্বংসহ প্রকৃতির রমণী। কেন্দ্র সরকারের মাঝারি
শ্রেণীর কর্মচারী। রম্ভা ততোধিক দৃঢ়, রূঢ় বলাই বাহুল্য তীব্র ব্যক্তিত্বের
অধিকারিণী। কেন্দ্র সরকারের অডিট সংক্রান্ত দপ্তরের বেশ দরের অফিসার। জামাই বাবু
অর্থাৎ শিলালিপির বাবার সাথে ওনার ব্যক্তিত্বের সংঘাত নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার।
উভয়েরই ব্যক্তিত্ব প্রবল। তবে দিদি বা শিলালিপির প্রতি ওনার ভালবাসায় কোন খাদ নেই।
শত ব্যস্ততার মধ্যেও দিনান্তে একবার উনি দুরাভাষ মারফৎ খবরাখবর নিয়েই থাকেন। যদিও
ওনার সর্বদাই মনে হয়, উর্বশী তাঁর মেয়েকে অতিরিক্ত আদরে একটি “আব্দেরে আলু ভাতে”
তৈরি করেছে। সেদিন যখন উনি শুনলেন, শিলালিপি অফিস যায়নি, তীব্র বিরক্তির সাথে উনি
জিজ্ঞাসা করলেন, “অফিস যায়নি কেন?”
উর্বশী ভয়ে ভয়ে বললেন,
“না, আসলে কাল এত ক্লান্ত হয়ে ফিরেছিল, তাই আজ আর ঘুম থেকে উঠতেই পারেনি।”
“ঘুম থেকে উঠতে পারেনি
বলে অফিস যায়নি???”
“ভালো হয়েছে দূরে
পোস্টিং হয়েছে, এবার তোর ঐ ন্যাদোশ মেয়েটা মানুষ হবে। ট্রেনে করে যাতায়াত করতে হলে
চটপটে হতেই হবে। এ তোমার কলকাতা হাওড়ার বাস নয়, যে পাঁচ মিনিট পর পরই পাওয়া যাবে।
কাল ও যদি না যায়, তো বলিস পরশু ঘুম ভাঙানোর দায়িত্ব আমার।”
শিলালিপির বাবা এত
ক্ষণ ভালো মানুষ সেজে কাগজ পড়ার ভান করে স্ত্রী এবং শ্যালিকার কথোপকথন শুনছিলেন,
বলাই বাহুল্য শ্যালিকাকে উনি খুব একটা পছন্দ করেন না, তবে স্ত্রীর ভয়ে সহ্য করতে
বাধ্য হন। আড়ালে আবডালে রম্ভাকে উনি কলাবতী বা কলা বলে সম্বোধন করেন। কাল শিলালিপি
অফিস না গেলে পরশু রম্ভা আসবেন, এত বড় গসিপ হজম করা ওনার পক্ষে অস্মভব। উর্বশী
দেবী বলার আগেই, উনি কাগজ বগলে দৌড়লেন, শিলালিপির ঘরে, বিছানার ওপর কাগজটা আছড়ে
বলে উঠলেন, “হল তো!” কৌতূহলী শিলালিপি বোকা বাক্স থেকে মুখ ঘুরিয়ে জিজ্ঞাসু
দৃষ্টিতে তাকাল, “ আমি অত ডাকলাম, উঠলি না। এবার কলা এসে তোর ঘুম ভাঙাবে। আসছেন
তিনি। ”
কলা অর্থাৎ রম্ভাকে বড়
ভয় শিলালিপির। শিক্ষা দেবার জন্য রম্ভা করতে পারেন না, এমন কিছুই নেই। নিজের
একমাত্র পুত্রকে একবার তিনি নিজের হিশি নুন দিয়ে চাটিয়েছিলেন। বারংবার নিষেধ
সত্ত্বেও টুবাই রাতে বিছানা ভেজাত।
অগত্যা বস এবং কলাবতী
অর্থাৎ মাসিমণির যুগ্ম আতঙ্কে পরদিন থেকে শুরু হল শিলালিপির ডেইলি পাষণ্ডগিরি।
প্রাতঃকালে মায়ের হাতের ডাল ভাত খেয়ে, যত্ন করে গুছিয়ে দেওয়া দুই সেট টিফিন ব্যাগে
পুরে, দুর্গা নাম নিয়ে বেড়িয়ে পড়ল শিলালিপি। বাবা সঙ্গে করে নিয়ে গিয়ে বাসে তুলে
দিলেন। দাশনগর স্টেশন থেকে ১১৩ নং মেদিনীপুর লোকাল। ট্রেন আসার কথা ৮টা ১১এ। পরের
ট্রেনের সময় হয়ে এলেও তেনার দেখা নেই। প্লাটফর্মে কারো যেন কোন তাড়া নেই। যে যার
মত, মুঠো ফোন নিয়ে ব্যস্ত। কোন টিকিট পরীক্ষক বা রেল পুলিশের পাত্তা নেই। কাকে
জিজ্ঞেস করা যায়? অগত্যা বাবাকেই ফোন লাগাল শিলালিপি, “ট্রেন তো এল না বাবা। কি
করি?”
“আসবে আসবে, অপেক্ষা
কর। সাউথ ইস্টার্ন রেলের নাম আগে ছিল, বি এন আর। বেঙ্গল নাগপুর রেলয়ে।আর স্থানীয়
লোকজন কি বলত জানিস, ‘ বি নেভার রেগুলার’। মাত্র আধ ঘণ্টায় হতাশ হয়ে পড়লে হবে?”
কৌতুকের সুরে জবাব দিলেন বাবা।
(চলবে)image courtesy- Google
No comments:
Post a Comment