অবশেষে ট্রেন এল, লোকাল ট্রেন বেশি ক্ষণ দাঁড়াবে না, ঐ অতি স্বল্প সময়ে মেয়ে ঠিকঠাক ট্রেনে উঠতে পারবে কি না, এই নিয়ে উর্বশী দেবীর বেজায় দুশ্চিন্তা ছিল, মাকে সাময়িক ভাবে ভুল প্রমাণিত করে তড়িঘড়ি মহিলা কামরায় উঠেও পড়ল শিলালিপি। হাওড়া থেকেই মোটামুটি ভর্তি হয়ে এসেছে ট্রেনটা। তবুও কিছু বসার সিট খালি ছিল, দৌড়ে গিয়ে বসতে গিয়ে এক চোট ধাক্কা খেল শিলালিপি, ভাবলেশহীন মুখে এক সুসজ্জিতা রমণী, তৎক্ষণাৎ ঐ সিটের ওপর তাঁর ব্যাগটি রেখে জানানলেন, “জায়গা আছে।” কার জায়গা, কিছু বুঝতে পারল না শিলালিপি, সবাই বসেই আছেন, মহিলাকে প্রশ্ন করার অবকাশ পেল না, কারণ ততক্ষণে তিনি পার্শ্ববর্তী মহিলার সাথে, পুনরায় গল্পে মসগুল হয়ে পড়েছেন। মন খারাপ করে অন্য সিটে বসতে গেলেও পুনরায় একই অভিজ্ঞতা হল। ইতিমধ্যে পরবর্তী স্টেশন এসে গেল, বেশ কিছু সুদর্শনা রমণী, ওর পাশ কাটিয়ে গিয়ে সংরক্ষিত সিটে বসেও পড়লেন, বোকার মত কাঁধে ব্যাগ আর হাতে টিফিনের ঝোলা নিয়ে কিংকর্তব্যবিমুড় হয়ে দাঁড়িয়েই রইল শিলালিপি। কান্না পাচ্ছিল, কোনমতে ঠোঁট কামড়ে উদ্গত কান্না সংবরণ করল, কারণ অজান্তেও অনুভব করছিল, বেশ কয়েক জোড়া চোখ তীব্র দৃষ্টিতে ওকে পর্যবেক্ষণ করছে। কি করা যায়? তবে কি আবার বাড়িতেই ফোন করে জিজ্ঞেস করবে? নাকি জলপাইগুড়িতে সৌরকে ফোন করবে? সে তো মাঝে মাঝে নাকি লোকালে সওয়ারি করত। নাকি অপেক্ষা করবে? এমন সময় হঠাৎ কলাবতী অর্থাৎ রম্ভার ফোন, “কি রে? ট্রেনে উঠতে পেরেছিস?” কোন মতে গলা ঝেড়ে জবাব দিল, শিলালিপি, “হ্যাঁ মাসিমণি।”
“হুঁ। বসতে পেয়েছিস?” চোখ ছলছলিয়ে উঠল শিলালিপির, কিছু বলতে গেলেই কেঁদে ফেলবে, তাই চুপ করে রইল। রম্ভা আবার বললেন, “পাসনি তো? জানতাম। কি বলছে? আসন সংরক্ষিত?” “হ্যাঁ।”
“বুঝেছি। এই জন্যই এদের ডেইলি পাষণ্ড বলে। তাও তো সাউথ ইস্টার্ন অনেক ভাল। শোন এমনি জায়গা পাবি না। দেখ কোথায় তিন জন বসে আছে, সেখানে গিয়ে বল, একটু চেপে বসুন তো। বললেই অভ্যাস বশতঃ ওরা একটু সরে বসবে। একটু কষ্ট করে বসে যা, বাগনানে সব নেমে যাবে। বুঝেছিস?” মাসির প্রতি কৃতজ্ঞতায় শিলালিপির মনটা ভরে উঠল, আপাত কঠিন রম্ভার মনে যে ন্যাদোশ আলু ভাতে মার্কা বোনঝির জন্য কতখানি দরদ আছে, তার পরিচয় অবশ্য এর আগেও ও বহুবার পেয়েছে। রম্ভার উপদেশ অব্যর্থ। কোনমতে কষ্টেসৃষ্টে বসতে পেল শিলালিপি।
গভীর মনোযোগের সাথে সহযাত্রী দের পর্যবেক্ষণ করতে লাগল শিলালিপি, প্রায় সকলেরই পরনে পরিপাটি করে পড়া সুতির শাড়ি, হাল্কা প্রসাধন, গম্ভীর মুখ, পরিমিত হাসি, এক কথায় ভয়াবহ রকম মার্জিত। মাঝে মাঝে দু একজন অবশ্য সিল্ক বা সস্তার সিন্থেটিক শাড়ি পড়েছেন। ওনাদের বাক্যালাপ অল্পক্ষণ শুনলেই বোঝা যায়, এঁরা সকলেই শিক্ষিকা। বাপরে সবাই শিক্ষিকা আর মাঝে একজন ছাত্রী। মনে মনে প্রমাদ গুনল শিলালিপি।
দিন কয়েক কাটল। মোটামুটি মুখ চেনা হয়ে গেছে, রম্ভা বলেই ছিলেন, যে অচিরেই শিলালিপিকেও ওরা ওদের একজন হিসাবে গণ্য করবে। ততটা না হলেও, আজকাল বসতে গেলে কেউ বলে না যে, সিট রাখা আছে। দীর্ঘ পথ তো আর মুখ বুঝে যাওয়া যায় না, অগত্যা সহযাত্রীদের নিয়ে গবেষণা শুরু করল শিলালিপি, শিক্ষিকাদের মধ্যে দুটি সুস্পষ্ট দল আছে, একদল প্রাক এস এস সি যুগের, অপর দল এস এস এস সি দিয়ে ঢোকা শিক্ষিকাকুল। প্রাক্তনিদের বক্তব্য হল, তাঁরাই প্রকৃত শিক্ষিকা। তাঁরা ভালবেসে পড়ান, নিছক চাকরী করেন না। বিদ্যালয়ের প্রয়োজনে তাঁরা সর্বদাই হেডুর সাথে সহযোগিতা করেন, বিশেষ কাজে ছুটির দিনেও আসতে ওনাদের আপত্তি নেই। বা থাকলেও তা মৃদু। উগ্র সাজগোজ করেননি,শাড়ি পরব না, সালোয়ার দাও বলে বায়নাক্কা করেননি, ইত্যাদি ইত্যাদি। অপর দিকে নবীনাদের বক্তব্য হল, তাঁরা রীতিমত পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হয়ে চাকরী পেয়েছেন, কোন দাদা দিদি মাসি মেসো ধরে নয়। সুতরাং অকারনে কাউকে খাতির করে চলার প্রশ্নই ওঠে না। প্রাক্তনিরা সকলেই বাড়ির কাছাকাছি স্কুলে পড়ান, তাই তাদের পক্ষে অতিরিক্ত সময় ব্যয় করা কোন সমস্যা নয়, কিন্তু সল্টলেক থেকে কোলাঘাট বা গড়িয়া থেকে পাশকুড়া যাকে দৌড়তে হয়, তাঁর পক্ষে ছুটির দিন স্কুল করা মোটেই আহ্লাদের কথা নয়। শুধু দীর্ঘ পথযাত্রাই নয়, অনেক শিক্ষিকাকেই বাস, ট্রেন, ট্রেকার এমনকি সাইকেলে চড়ে স্কুল যেতে হয়, শাড়ি পড়ে যা প্রায় অসম্ভব। সালোয়ার ও তো জাতীয় পোশাক, যথেষ্ট ভদ্র মার্জিত, শরীর ঢাকা পোশাক। পরলে অসুবিধা কোথায়? তবে ভিতরে ভিতরে সুস্পষ্ট বৈরিতা থাকলেও উপরে কিন্তু সহজ সৌজন্যমূলক সম্পর্ক বজায় ছিল। নবীনারাই অবশ্য ছিল সংখ্যা গরিষ্ট। তবে শিলালিপি কে একা পেলেই দু দলই একে অপরের নামে পরচর্চা শুরু করত। যেমন কলি। সুমি আর কলি সুদূর দক্ষিণ কলকাতার শহরতলী থেকে সুদূর কোলাঘাটে পড়াতে যেত। শিলালিপিরই সমবয়সী। সুমি বেশ স্থুলাকৃতি, নাদুস নুদুস, মিষ্টি মিষ্টি দেখতে, দেখলেই বোঝা যায়, শিলালিপির মতই বাবা মায়ের আবদেরে আলু ভাতে। প্রায় রোজই অপরূপ সুন্দর তথা অত্যন্ত মূল্যবান শাড়ি পড়ে রোজ স্কুলে যেত। ঐ বিশাল বপু বার হাত শাড়িতেও ঢাকা পড়ত না, তাই সুমির মা সর্বত্র যত্ন সহকারে সেফটি পিন লাগাতেন, সেই সেফটি পিন মাঝে মাঝেই খুলে গিয়ে সুমিকে তো ঘায়েল করতই, একবার শিলালিপির হাতেও ফুটে গিয়েছিল। তখনও ওদের সাথে ভাব জমেনি। শুধু মুখ চেনা, তবু সমবয়সী বলে, দেখা হলেই এক গাল হাসি বিনিময় হত। যেদিন সুমি প্রথম ওকে ডেকে নিজেদের পাশে বসালো, শিলালিপি বেশ পুলকিত বোধ করল, যাক এত দিনে হংস মধ্যে হংস যথা হতে পারল। কি কপাল, সেদিনই সুমির মায়ের সযত্নে আঁটা পিন, পট করে খুলে গিয়ে দুজনকেই ঘায়েল করল। সুমি বেচারা লজ্জায় লাল কালো হয়ে অনেক ক্ষমা চাইল। শিলালিপ ক্ষততে হাত বোলাতে বোলাতে শুধু বলল বলল, “ এত সেফটি পিন লাগাও কেন?” লজ্জায় সুমি করুণ মুখে বলল, “কি করি? পেট দেখা যায় যে? মোটা হবার কি কম জ্বালা? তুই তো বুঝিস।”
(চলবে)
No comments:
Post a Comment