Saturday 24 June 2023

অনির ডাইরি ২৪ শে জুন, ২০২৩

 

#অনিরডাইরি 

সেদিন মোদের বড়ই খুশির দিন, আজ আর অফিস ফেরতা একা বাড়ি ফিরব না। বাবা মাকে সঙ্গে করে নিয়ে ফিরব কাঁথি। কিছুতেই বাড়ি ছেড়ে নড়তে চায় না বাবা। কোথাও যাবার কথা বললেই, সেন্টু দেয়। বলে, "এটা আমার বার্ধক্যের বারাণসী। আমাকে এখানেই থাকতে দাও।" দুটো পুকুর সহ সাড়ে সাত বিঘে বাস্তুভিটের, আজ কেবল মেরে কেটে সাতকাটাই দৃশ্যমান। যার আধ কাটার উপর উঠে দাঁড়িয়েছে পাড়ার দোতলা ক্লাব। বাবার ভাগে পড়েছে কাটা দেড়েক। খন্ডিত ভগ্নপ্রায় ভাগের বাস্তুভিটে সহ এই দেড় কাটা জমির উপর বাবার মায়া সাংঘাতিক।


এই ভিটেতে শেষ নিঃশ্বাস ফেলেছেন আমার স্বর্গীয় পিতামহ-পিতামহী। জেঠু মারা যান হাসপাতালে, ছোট কাকু বাড়ি থেকে হাসপাতাল যাবার পথে। বাবার ইচ্ছে এই ভিটেতেই যেন চোখ বুঝতে পারে বাবা। প্রায়ই বলে," এই বাস্তুটুকু কে বাঁচিয়ে রাখতে কি অসীম লড়াই করতে হয়েছিল বাবা আর আমাদের তিন ভাইকে, তোরা জানিস না।" 

ব্যাপারটা বা কথাগুলো বাবার কাছে যতটা রোমান্টিক আমার কাছে ততোটাই বেদনাদায়ক।  সেকথা বলতে গেলেও হুলো বেড়ালের মত ফাঁসিয়ে ওঠে বৃদ্ধ। "কেউ কি সাধ করে মরতে চায়? তুমি বারবার এই কথাগুলো বলো আর আমার মনে হয় চলে যাবার দিন আগত বুঝি।" ঠিকই তো, আমিই বলি, বাবা তো মাছ ভাজার সোজা-উল্টোই চেনে না। 


এহেন জেদি, একবগ্গা বৃদ্ধকে, কিভাবে যে পটিয়ে হাওড়া থেকে কাঁথি যেতে রাজি করিয়েছি, সে কেবল আমিই জানি। মিথ্যে বলব না, আমার জন্য মোটেও বাড়ি ছাড়তে রাজি হয়নি বাবা। রাজি হয়নি প্রাণাধিকা তুত্তুরীর জন্যও। রাজি হয়েছিল কেবল মায়ের মুখ চেয়ে। কিছু দিন ধরেই বেশ মনমরা হয়ে পড়ছিল মা, ভুগছিল অপরিসীম নিঃসঙ্গতায়। তুত্তুরীর পড়াশোনা এবং অন্যান্য আনুষঙ্গিক ব্যস্ততার জন্য আজকাল আর অত ঘনঘন হাওড়া যেতে বা গিয়ে থাকতে পারি না আমরা। একলা নিঃসঙ্গ জীবনে হাঁপিয়ে উঠছিল মা। মনের প্রভাব পড়ছিল শরীরে। এমতবস্থায় হাওয়া বদল আর অষ্টপ্রহর তুত্তুরীকে আলিঙ্গন_আঘ্রাণ করলেই যে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যাবে মা, এই বলেই পটিয়েছিলাম বৃদ্ধকে।


তাও নোটিশ দিতে হয়েছিল এক মাস আগে,  ঈশ্বরকে হাজির নাজির জেনে কথা দিতে হয়েছিল ঠিক কোন তারিখে কোন ঘটিকায় বাড়ি থেকে বের করব এবং কোন তারিখে কোন মুহূর্তে বাড়ি ছেড়ে আসব। তুত্তুরীর গরমের ছুটি চলছিল বেশ কিছুদিন ধরে, তখন ছুটি নিইনি। এখন চাইল্ড কেয়ার লিভ নিলাম শুধুমাত্র ওদের জন্যই। আহাঃ ওরা যে আমার তুত্তুরী থেকেও পুঁচকে ছানা। আর তেমনি অবাধ্য ছানা। 


কোন এক দুর্বল মুহূর্তে, আমার সুড়সুড়িতে রাজি হয়ে গেলেও আবার পিছু হঠছিল বাবা, দেখাচ্ছিল নানা ওজর আপত্তি। যেমন ধরুন কিভাবে প্যাকিং করবে, কিসে প্যাকিং করবে, কি কি নেবে কিছুই নাকি বাবার মাথায় ঢুকছিল না। ভিডিও কলে বলতে পারেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলাম, কোথায় রাখা আছে চাকা লাগানো ঝকঝকে ট্রলি ব্যাগ। এমন দিনের কথা ভেবেই উপহার দিয়ে ছিলাম প্রায় অর্ধ দশক পূর্বে। এখনও কাটা হয়নি তার ট্যাগ। রীতিমতো লিস্ট বানিয়ে দিলাম এত জোড়া জামাকাপড়, যার মধ্যে এতগুলি বাইরে পরার আর অতগুলি ঘরে পরার। এছাড়া চার্জার ( এবাড়িতে বেশ অনেকগুলি চার্জার আছে,কিন্তু কোনটাই ওদের ফোনে গলবে না), টুথব্রাশ আর ওষুধ। ব্যাস এইটুকুই আর কিছু না আনলেও চলবে। উৎসাহের আতিশয্যে শ্রীমতী তুত্তুরী বললেন, টুথব্রাশও না আনলে চলবে, এ বাড়িতে বিস্তর আছে।


ছুটিতে থাকা সত্ত্বেও কিছু দপ্তরী কাজের ধারবাকি ছিল, তাই নিয়েই গিয়েছিলাম মহানগর। ঠিক ছিল ফেরার পথে তুলে আনব, মিঃ অ্যান্ড মিসেস চ্যাটার্জিকে। সেই মোতাবেক কাঁথি থেকে রওনা হবার শুভ মুহূর্তে যখন ফোন করলাম, বাবা বলল, " কি সর্বনাশ! এখনও তো কিছুই গোছানো হয়নি-"। এত কি যে গোছাচ্ছে, ভাবতে ভাবতেই কাঁথি থেকে কলকাতা পৌঁছে গেলাম। কাজকর্ম মিটে ও গেল সব।ভেবে ছিলাম কাজ মিটতে মিটতে বুঝি গড়িয়ে যাবে বেলা, দেড়টার মধ্যেই মিটে গেল সব কাজ। এখান থেকে হাওড়া বড়জোর ঘন্টা আধেক। এতক্ষণে নির্ঘাত মধ্যাহ্নভোজ সেরে নিয়েছে বৃদ্ধ বৃদ্ধা, একটু জিরিয়ে নিক বরং। অনেকটা রাস্তা। তিনটে নাগাদ যদি বেরোতে পারি, দিনের আলো থাকতে থাকতেই  ঢুকে যেতে পারব কাঁথি। 


এত কিছু ভাবার পর বাড়িতে ফোন করে জানতে পারলাম, এখনও স্নান পর্যন্ত করেনি বাবা। মা ঝেঁঝে বলল," তোর বাবা সকাল থেকে সারা বাড়ি গোল গোল করে ঘুরছে, আর সিগারেটের পর সিগারেট ফুঁকে যাচ্ছে। দশ পনেরো প্যাকেট সিগারেট ছাড়া, আর কিছুই গোছায়নি এখনও পর্যন্ত। আমার গোছানো শেষ। ওকে ফেলে রেখেই চলে যাব আজ।" 

 মায়ের কথার ফাঁকেফোকরে শুনতে পাচ্ছিলাম, ফোনের ওপারে তীব্র চিৎকার জুড়েছে বাবা, মিথ্যে অপবাদ দেওয়া হচ্ছে বলে। হাওড়া পৌঁছালাম যখন, ঘড়ির কাটা ২ আর আড়াই এর মাঝামাঝি। স্নান সেরে নিয়েছে বটে বাবা, বসেনি মধ্যাহ্নভোজে। জেদ ধরেছে, আমি না এলে খাবে না নাকি। দুপুরে ভাত খাব বলে জানিয়ে রাখিনি, এখন হঠাৎ করে এদের ভাতে ভাগ বসালে হয় নাকি। তাছাড়া ব্যাগে করে টিফিন এনেছি আমি।  

ওসব ওজর আপত্তি টিকলো না, ভাত নাকি অঢেল আছে। ডাল তরকারি বন্যা বয়ে যাচ্ছে নাকি এই বাড়িতে। বাবা বলল তোর টিফিনটা সেরকম হলে আমি খেয়ে নেব। তুই ভাত খা। হাত ধুয়ে খেতে বসে চোখ ফেটে জল এল, ঠিক কয়েক চামচ ভাত নিয়েছে বাবা। মায়ের পাতে তার থেকে গোটা দুই/চার চামচ বেশি ভাত। একটা ছোট্ট মুরগির ডিম,, আধাআধি করে পাতে নিয়েছে দুজনে। আমার পাতে উপচে পড়ছে ভাত, আমার থালায় জ্বলজ্বল করছে, একটা গোটা ডিম।


বেশ বুঝতে পারলাম কদিন থাকবে না বলে ফ্রিজ ফাঁকা করে ফেলেছিল মা। যা ছিল কুড়িয়ে বাড়িয়ে তাই খেতে বসেছিল দোঁহে। রান্না করে যে মেয়েটি সে আমাকে অনুযোগের সুরে বলল," দেখুন না দিদিভাই, বললাম প্রেসারকুকারে দুটো ভাত বসিয়ে দিই, দোকান থেকে একটা ডিম কিনে আনি। তো মেসোমশাই বললেন, এই রোদে আর কত খাটবি? কত ছুটবি?  যা আছে, তাই ভাগ করে খাব সবাই। বলে নিজেদের ভাতগুলো সব আপনাকে তুলে দিল। বললাম আমার থেকেও একটু দিই তো কি চিৎকার। বলল, বেশি পাকামি করিস না।"


জেদি বৃদ্ধের ভালোবাসাকে অমর্যাদা করা আমার সাধ্যাতীত। মোটামুটি চোখের আন্দাজে সমান ভাগ করার চেষ্টা করলাম ভাতের। পুরোপুরি সফল হলাম না যদিও। ঘড়িতে তিনটে বাজে। তাড়া লাগালাম। আর এক ঘন্টার মধ্যে অবশ্যই বেরোতে হবে।

বাবা বেজার মুখে এক গ্লাস জল আর ওষুধের বাক্স নিয়ে বসল। মা তৈরি হতে গেল, আর আমি হাঁক পাড়লাম পিসিকে। যারা আমার পিসিকে চেনেন না, তাদের উদ্দেশ্যে বলি পিসি হল বাবার দিদি। যদিও আমরা সব খুড়তুতো জেঠতুতো ভাইবোন, এমনকি আমাদের ছানাপোনারাও ওনাকে দিদি বলে সম্বোধন করে।


এ হেন দিদির বয়স অষ্টাশি। কিন্তু আপাততঃ, তিনিই এ বাড়িতে সব থেকে সুস্থ। আমার ঠাকুমার আত্মজা কি না, জরা, ব্যধিকে তিলমাত্রও পাত্তা দেয় না আমার পিসি। হ্যাঁ উপর্যুপরি কয়েকবার পড়ে যাওয়ার জন্য হাঁটু গুলো ইদানিং কিঞ্চিৎ মচমচ করে,কানেও সামান্য কম শোনে পিসি। ব্যাস ওইটুকুই। তেমনি মানসিক জোর। বারবার সনির্বন্ধ অনুরোধ করা সত্ত্বেও আমার বাবা মা, শ্বশুর শাশুড়ি কেউ আসে নি তমলুকে, শুধু পিসি এসেছিল। এক ডাকে বেরিয়ে পড়েছিল আমার সাথে।  


 দুই খুড়তুতো ভাই প্রায়ই খোঁচা দেয়, আমি নাকি পিসির নয়ন মনি। যদিও তা সর্বৈব মিথ্যা। পিসির কাছে তার চার ভাইপো ভাইঝিই সমান আদরের।  আজও যেই দিদি বলে চিৎকার জুড়েছি, অয়ন লাফিয়ে এসে বলল, " ওরে খেতে বসেছে। খাওয়া হোক বলছি। না হলে তুই এসেছিস শুনে, খাওয়া ফেলে এঁটো হাতেই ছুটবে।" তা অবশ্য পিসি করে।


অয়ন কখন খবর দিয়েছিল জানিনা, পাঁচ মিনিট বাদেই দেখি টলমল করতে করতে পিসি এসে হাজির। টেনে আমার পাশে বসালাম। সাদাসিধে করে পড়া বিবর্ণ সুতির শাড়ি, হাত কাটা রঙ চটা ব্লাউজ, দুহাতে দুটো সরু সোনার চুড়ি, এক পিঠ কাঁচা পাকা খোলা চুল, এক মুখ হাসি এই আমার পিসি।

অয়ন অনিন্দ্য মাঝেমধ্যে চিৎকার করে, " ও দিদি,  ওই শাড়িগুলো এবার ফেলে দাও।" পিসির শাড়ির অভাব নেই তা সত্ত্বেও কিছু ফেলে না। দেরাজ খুললে থরে থরে সাজানো না জানি কবেকার সব শাড়ি। ছোটবেলায় বাবা বলত," এটা লর্ড ক্লাইভ দিয়েছিল দিদিকে, ওটা বাদশা আকবরের দেওয়া। শুধু সম্রাট অশোক যে জামাটা দিয়েছিলেন ওইটা ছিড়ে গেছে।" মনে করে অজান্তেই হাসির রেখা ফুটে উঠলো ওষ্ঠাধরে। এককালে আর পাঁচটা মধ্যবিত্ত পরিবারের মতই চূড়ান্ত অভাবে দিন কেটেছে পিসিরও। সেই সব দিনের কথা ভেবেই হয়তো কিছু ফেলে না পিসি। কিছু অপচয় করে না। 


টুকটাক কুশল বিনিময়ের ফাঁকফোকরে পিসি বলে, " খুব ভালো করেছিস তোর বাবা-মাকে নিয়ে যাচ্ছিস। আমাকেও আরেকবার নিয়ে যাস তো। কি ভালোই না লেগেছিল সেবার তোর ওখানে গিয়ে। তবে আমি গেলে কিন্তু সাত দিন থাকব  -।" বলতে বলতে আচমকা থেমে যায় পিসি। বাবার দিকে ঘুরে বলে," হিটলার ওটা দে?" বাবাকে নাম ধরে ডাকার মত মানুষ আর খুব কেউ নেই। তখনও জামাকাপড় পরেনি বাবা। তখনও বেজার মুখে জলের গ্লাস  আর ওষুধের বাক্স নিয়ে নাড়াচাড়া করছিল বাবা, যেন কতই না ওষুধ খাচ্ছে। পিসির ধমক খেয়ে আচমকা ধড়মড় করে উঠে, একটা খাম এনে পিসির হাতে দিল। খামটা মুড়ে আমার হাতে দিয়ে পিসি বলল, " এটা শৌভিককে দিস। জামাইষষ্ঠীতে তো আসতে পারেনি।"


বাড়ি ফিরে শৌভিকের হাতে খামটা দিয়ে বললাম, এর মধ্যে যা আছে, সেটাকে টাকার অঙ্কে যদি ফেলিস তবে খুবই নগন্য কিছু হবে। কিন্তু এক সম্বলহীন বৃদ্ধার অন্ধ ভালোবাসা আর আশিস মিশিয়ে যদি দেখিস তবে এত মূল্যবান কিছু আদানি- আম্বানিদের ঘরেও পাবি না। যত সামান্যই হোক প্লিজ এটা দিয়ে কিছু কিনিস, বুড়ি খুব খুশি হবে। 

  টাকাটা বার করে নেবার পর খামটাকেও ফেলতে পারিনি আমি, রেখে দিয়েছি শৌভিকের ঝুলন্ত এক কোটের পকেটে। চূড়ান্ত আবেগপ্রবণতা Aquarian দের বৈশিষ্ট্য।  তারপর যা হয় ভুলেই গেছি, আজ অফিস বেরোচ্ছি, একটা প্যাকেট হাতে নিয়ে ঘরে ঢুকল শৌভিক, "এই দেখ,তোর পিসির দেওয়া টাকায় এটা কিনেছি। পিসিকে জানাস।" ভিতরে খলখল করছে একটা বডি স্প্রে। পঞ্চায়েত নির্বাচনের শত ব্যস্ততার মাঝেও ভোলেনি, ঠিক মনে রেখেছে। মুখ ফুটে কোনদিন ভালোবাসি শব্দটা বলে না আমার বর, চেপে ধরলে বলে, "ভালো টাটকা হতে পারে, বাসি কেন হবে।" তবে এই ভাবে আমার প্রতিটা ঘ্যানঘ্যানে কথা কান করে শোনা, আমার প্রতিটা প্রিয়জনকে শ্রদ্ধা সম্মান করা, এগুলো যদি ভালো টাটকা হয়, তো আমার টাটকাই ভালো, বাসি কে চায়।

তুতুরি উবাচ, ২৩ শে জুন ২০২৩

 

#তুত্তুরীউবাচ 

👧🏻- আজকে মিস্ ক্লাসে সবাইকে জিজ্ঞাসা করছিলেন, স্কুলের সাইন্স এক্সিবিশনের জন্য কে কি করছে। 

👩🏻- তুই বললি? 

👧🏻- হুঁ। সবাই বলল।এমনকি ঋতুরাজও(নাম পরিবর্তিত) হাত তুলেছিল। 

👩🏻- সে কে যেন? 

👧🏻- ওই যে আমাদের ক্লাসে একটা দুষ্টু ছেলে আছে না, যে মিসকে খুব জ্বালাতন করে, জোর করে ফার্স্ট বেঞ্চে বসালেও, লাস্ট বেঞ্চে পালিয়ে যায়, টেবিল বাজিয়ে গান গায়, মিসকে ভ্যাঙায় ---

👩🏻- আচ্ছা আচ্ছা বুঝেছি। সে হাত তুলেছে তো কি সমস্যা? তুই যদি বানাতে পারিস, (কন্যার কুঞ্চিত ভ্রু যুগলের দিকে তাকিয়ে, হাসি চেপে) তারও নির্ঘাত তোরই মত রঞ্জিত কাকু আর মাসি আছে, যারা আসল কাজটা করে দেবে- 

👧🏻- (কিঞ্চিৎ ক্ষুব্ধ হয়ে) আমি শুধু ওদের ভিডিওটা দেখিয়েছি, করে দিতে বলিনি😡। (খানিক বিড়বিড় করে মায়ের মুণ্ডপাত করে, একটু দম নিয়ে) মিস তো অবাক, বললেন, " তুমি সত্যি সত্যি সাইন্স প্রজেক্ট করবে তো? মস্করা মারছো না তো?" ছেলেটা উঠে দাঁড়িয়ে বলল, "হেঁঃহেঁঃ"। 

মিস জিজ্ঞাসা করলেন, "মডেল বানাবে, না পাওয়ার পয়েন্ট?" ছেলেটা জবাব দিল," মডেল"। 


 মিস জানতে চাইলেন, " কিসের মডেল বানাবে?" আবার বলল, "হেঁঃহেঁঃ"। মিস খুব ভালো, খুব ঠাণ্ডা মাথা, অন্য স্যার হলে তো, খেত এক থাবড়া। মিস কিন্তু ধৈর্য ধরে আবার জিজ্ঞাসা করলেন, " বল বাবু কিসের মডেল বানাবি?" তখন বলল, " সাইন্স ফর গ্লোবাল ওয়েলবিইং"।  


👩🏻- বাঃ। খুব ভালো টপিক তো। 

👧🏻-( হেসে উঠে) দূর ওটা থিম হতে পারে। টপিক তো কংক্রিট হতে হয়। মিস ও তাই বললেন। তখন বলে কি না," ওয়াশিং মেশিন"।

 👩🏻- (ভ্রু কুঁচকে) এতেই বা হাসির কি হল?

👧🏻-(থতমত খেয়ে) শোন না। মিস বললেন, "বেশ ঠিক আছে। তাই বানাও। তোমার হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরটা বলো।" তখন বলে কি, "মিস নম্বরটা আপনি এসে নিয়ে যান। চেঁচিয়ে বলব না, তাহলেই মেয়েরা নিয়ে নেবে।" এমন ভাবে বলল, হাসি চাপা দায়। মিস খানিকক্ষণ তাজ্জব হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে রইলেন, তারপর বললেন, "কেউ টুকবে না বাবু।তুই গিয়ে গিয়ে মেয়েদের দিয়ে এলেও ওরা নেবে না। তবে আমি আসছি।"

তুত্তুরী উবাচ ২২ শে জুন, ২০২৩

 

#তুত্তুরীউবাচ 

👧🏻- (Plant and Animal Kingdom পড়তে পড়তে, দৃঢ় স্বরে) একদিন আমি মিস্‌কে জিজ্ঞাসা করবই, করব। 

👩🏻- কি? 

👧🏻- ওরা তো কই আমাদের সম্পর্কে পড়াশোনা করে না। তাহলে আমরা কেন পড়ব? 

👩🏻- (ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে)কারা রে?

👧🏻- এই যে Protista, Monera এরা।( আচমকা উত্তেজিত হয়ে, উঠে দাঁড়িয়ে) কোন অ্যামিবা, কোন অ্যামিবাটা এখন আমার সম্পর্কে পড়ছে আগে তুমি বলো, যে আমাকে এসব পড়তে হবে? 😡😡😡😡😡

অনির ডাইরি ২০শে জুন, ২০২৩

 

#অনিরডাইরি #কাঁথিরকিস্যা 

বিগত দুই বছর ধরে রথটা কেমন যেন ঘেঁটে গেছে তুত্তুরী আর আমার জীবনে। Dবিশ্রী একটা পারিবারিক দুর্ঘটনা ঘটে যায় ২০২১ সালের রথের দিন। সে বছরও লফট্ থেকে ঝেড়েঝুড়ে বার করা হয়েছিল তুত্তুরী থুড়ি জগন্নাথ দেবের তিনতলা মজবুত কাঠের রথ। রথের মধ্যে উঠেও পড়েছিলেন ভাই বোন সমেত জগন্নাথ দেব। তারপরই যে কি হয়ে গেল। মেয়ে আর মেয়ের রথ ফেলে বেরিয়ে পড়তে হল দুজনকে। বাকি দিনটা কেটে গেল হাসপাতালের চক্কর কেটেই। দ্বিপ্রাহরিক আহার জুটল পড়ন্ত বিকেলে, আহার বলতে হাওড়ার সুরকি কলের কাছে, নর্দমার ধারে বসে ভাজা শুটকো কয়েকটা জিলিপি মাত্র। 


লাটেই উঠতে বসেছিল সে বছরের রথ যাত্রা। যদি না উমারানি থাকত। আজও বলছিল তুত্তুরী, " তোমরা বেরিয়ে যাবার পর, কি কান্নাই না কেঁদে ছিলাম। একে তো বুঝতে পারছিলাম না ঠিক কি হয়েছে হাওড়ায়, তার ওপর পরের দিনই বাক্স প্যাঁটরা গুছিয়ে Rতমলুক চলে যাবে বাবা। শোক উথলে উথলে উঠছিল। মাসি অনেক চেষ্টা করছিল ভোলাতে। পারেনি। দুপুর বেলা বেল বাজিয়ে যখন কাকিমা এসে ঢুকল, ফুল, মালা, গাছের পাতা নিয়ে কি যে আনন্দ হল। কাকিমা বসল, তবে ভাত খেয়েছিলাম সেদিন।" উমার সাথেই সেবার রথ টেনেছিল তুত্তুরী। বাড়ি ফিরে, শুকনো মুখে, ভারাক্রান্ত হৃদয়ে সঙ্গী হয়েছিলাম বটে আমিও। তবে অনুভব করতে পারিনি কিছুই। 


২০২২ সালে, আমরা তখন তাম্রলিপ্ত নগরীর বাসিন্দা। সবই ঠিক ছিল সে বছর, কোথাও কোন সমস্যা ছিল না, আমরাও Kমা-মেয়েতে অধীর ছিলাম জগন্নাথ দেবার রথ যাত্রার জন্য। বাংলোয় রান্না করতেন যে দিদি, ঝাড়পোঁচ করতেন যে দিদি, বাংলো পাহারা দিত যে ছেলে দুটি সবাইকে বলাও ছিল, রথের দিন এসো কেমন। সপরিবারে এসো। রথ টানব সবাই মিলে। সবই ঠিক ছিল শুধু বেঁকে বসলেন জগন্নাথ দেব স্বয়ং। গোটা তাম্রলিপ্ত নগরী ঢুঁড়েও মিলল না টানার মতন একখানিও রথ। আমরা সবে এসেছি, দোকান বাজার কিছুই চিনি না। সবকিছুর জন্যই নির্ভর করতে হয় শৌভিকের তৎকালীন ড্রাইভারের ওপর। তাকেই বলেছিলাম, একটা রথ কিনে আনতে। রোজই আশ্বস্ত করত ছেলেটি, "আজ পেয়ে যাব ম্যাডাম। আজ নিয়েই আসব ম্যাডাম।" দেখতে দেখতে রথ এল, চলেও গেল। জগুদা এণ্ড কোং আর এসে উপনীত হলেন না, তমলুকের মহকুমা শাসকের সরকারি নিবাসে।


হয়তো এই Dজেলার এমনিই নিয়ম। আমাদের হাওড়া-কলকেতার মত পথেঘাটে ঢেলে বিক্রি হয় না রথ, এই ভেবে এবারে তাই আর কোন আশাই রাখিনি Rতুত্তুরী আর আমি। ছিল না,রথ টানার বিন্দুমাত্র পরিকল্পনা। সাম্প্রতিক তাপ প্রবাহের সৌজন্যে, ইদানিং মাত্রাতিরিক্ত ভোরে স্কুল বসছে তুত্তুরীর। ঢুলতে ঢুলতে মেয়েকে Kস্কুলে ছেড়ে এসে আর এক দফা ঘুমিয়ে, কপালে করাঘাত করে, চটজলদি নাকে মুখে গুঁজে অফিস বেরিয়েছি, দেখি মহকুমা শাসকের করণ ছেড়ে বেরোতেই রাস্তার দু'ধারে সারি সারি সাজানো রয়েছে রথ। অধিকাংশই শোলা থুড়ি থার্মোকলের। কি অপূর্ব দেখতে সবকটা। মেয়েটার জন্য কেঁদে উঠল মন।  বাইরে থেকে অনেকটাই বড় হয়ে গেছে, আমার মাথায় ছুঁইছুঁই প্রায়, তবে ভিতরে তো এখনও তেমনি ভোম্বলই রয়ে গেছে।


Dমহকুমা শাসকের বাহনচালক নূপুর বাবুই নিয়ে যাচ্ছিলেন বাসে তুলে দিতে, থাকতে না পেরে হ্যাংলার মতই তাকে বলে বসলাম," নূপুর বাবু, আমার মেয়েটাকে একটা রথ কিনে দেবেন গো?"

নূপুরবাবু জিভ কেটে বললেন, "এ বাবা ম্যাডাম, কেন কিনে দেবোনি! এ আর এমন কি ব্যাপার, আমরা তো অমুক সাহেবের মেয়েকেও কিনে দিতুম। রথ টানা হত,জিলিপি খাওয়া হত।"

এ আর এমন কি ব্যাপার, রথের দিন জিলিপি তো হবেই। পৃথিবী উল্টে গেলেও হবে। তবে তার আগে একবার মহকুমা শাসকের অনুমতি নেওয়া, বাধ্যতমূলক। তারও আগে এ ব্যাপারে শ্রীমতী তুত্তুরীর কি অভিমত তা জানা জরুরী।


Rতুত্তুরীর ছুটির সময় হিসেব করে, মাসির ফোনে, ফোন করলাম। প্রসঙ্গত কাঁথির মহকুমা শাসকের নিবাসে একখানি ল্যান্ড ফোনের দেহাবশেষ পড়ে আছে বটে, তবে তা সম্পূর্ণ নিষ্প্রাণ। বিগত ৮ মাসে তিনি একটি বারই ধড়মড় করে জীবিত হয়ে উঠে ছিলেন। অতঃপর কিছুক্ষন প্রবল ক্যাঁওম‌্যাঁও করে পুনরায় দেহ রাখেন। ল্যান্ডফোন আজকাল কেউই ব্যবহার করেন না, আর তুত্তুরীর নাগালের মধ্যে একখানি জ্যান্ত ফোন রাখা সমীচীন নয়, বলে আমরা আর তাকে খোঁচাইনি। অগত্যা মাসির ফোনই ভরসা।


এমনিতেও আমাদের Kঅনুপস্থিতিতে মাসির ফোনটা আর মাসির থাকে না। অন্য কারো কুক্ষিগত হয়ে পড়ে। যথারীতি তিনিই ধরলেন ফোনটা এবং রথ কিনে আনার কথা শুনে বেশ উদাস স্বরে বললেন "আমার কি আর রথ টানার বয়স আছে মা?" বেশ তবে টানিস না, বলে ফোন রেখে দিলাম।  যার জন্য চুরি করব মনস্থ করেছি, সেই যদি চোর ভাবে তাহলে আমি নাচার।


ফোনটা রাখার পর দুই মিনিটও কাটল না। পুনরায় ঝনঝনিয়ে উঠল মুঠোফোন। নম্বরটা তুত্তুরীর মাসির হলেও, ফোনের ওপারে তিনি স্বয়ং। "এই মা, ভাবছি রথটা টেনেইনি।" বেশ, এর পরের ধাপ মাননীয় মহকুমা শাসক মহোদয়কে পটানো। তিনি আসন্ন পঞ্চায়েত নির্বাচন উপলক্ষে ইদানিং যা ব্যস্ত থাকছেন, তাঁকে ফোন করার উপরেও চেপেছে হাজার খানেক বিধিনিষেধ। যেমন ধরুন জীবনমরণ সমস্যা হলে তবেই যেন তার অফিসিয়াল নম্বরে ফোন করা হয়। তাহলে যে পরিস্থিতিতেই থাকুন না কেন, তিনি ফোনটা ধরবেন। অন্য যাবতীয় সমস্যার জন্য ফোন করতে হবে তার ব্যক্তিগত নম্বর। সেটি তিনি ধরতেও পারেন, নাও ধরতে পারেন। আর দরকার ছাড়া নিছক খোশ গল্প করার জন্য কোন অবস্থাতেই যেন তাকে ফোন না করা হয়।


অনেক ভেবেচিন্তে, ফোন করা না করার উপপাদ্য সম্পাদ্য তত্ত্বটা মাথার মধ্যে বেশ কয়েকবার ঝালিয়ে, শেষে ব্যক্তিগত নম্বরেই ফোন করলাম। তিনি ধরলেন, গলায় সামান্য ব্যস্ততার ছোঁয়া থাকলেও বিরক্তি বা ধমক নাই। বললাম," ওগো তুমি কি এখন কোথাও বেরোবে? যদি না বেরোও তাহলে নূপুর বাবুকে একটি বার বাংলোয় পাঠাও না, তুত্তুরী একটা রথ কিনতে যাবে। বেশি দূর নয়, এই তো তোমার অফিসের সামনের বাজারে ঢেলে বিক্রি হচ্ছে।"তিনি কইলেন," অ। আমি নূপুরকেই বলছি বরং, একটা রথ কিনে দিয়ে আসতে।"


বাতাস অনুকূল দেখে নিজের কাজে মন দিলাম। কাজ করার কি যো আছে, কাকে যেন সাঁকো নাড়ানো দেখাতে নেই, কি কুক্ষণে যে রথ কেনার কথাটা বলেছিলাম। শ্রীমতী তুত্তুরী আক্ষরিক অর্থেই ফোন আর মেসেজের বন্যা বইয়ে দিলেন। "মা, নূপুর কাকু শোলার রথ কিনে এনেছে। এটা টানব কি করে?"  বললাম, তোর বাপকে বল। নূপুরকে পাঠিয়ে বদলে আনবে। সেটুকু সাহসটুকুও তার নেই। যত জোর কেবল মায়ের উপর।


যাইহোক সন্ধ্যা নামার আগে শোলার রথ বদলে যা আনা হল, তিনি পাতলা কাঠ বা পিচবোর্ডের হলেও তার চাকাগুলি মাটির। সামনে ঘোড়াটিও নেই, দড়ি বাঁধা হবে কোথায়? আর বাঁধলেও টানবে কি করে, বুঝতে পারলাম না। কারণ টানতে গেলেই তিনি সটান উল্টে যান। সন্ধ্যাবেলায় পাকশাল সামলায় যে ছেলেটি, সে আশ্বস্ত করল, "ও আমি কাল এসে সব ঠিক করে দেব সোনা মা(তুত্তুরী)। তুমি নিশ্চিন্ত থাকো।"


আজ সত্যিই বিকাল তিনটে থেকে একগাদা পেরেক, সুতো, রাংতা, মার্বেল পেপার, সোনালী জরি কিনে এনে রথটা সাজাল ছেলেটা, সঙ্গতে ছিল তুত্তুরীর মাসি। শ্রীমতী তুত্তুরী কয়েকবার মাতব্বরি করতে গিয়েছিলেন বটে, তেমন পাত্তা পাননি। বাগান থেকে তুলে আনা টাটকা ফুলে সেজে উঠলেন তিন ভাইবোন। এবার রথ টানার পালা। তুত্তুরীর হাতে তুলে দেওয়া হল রথের দড়ি থুড়ি জরি। 

দড়ি ধরে হ্যাঁচকা টান মারল তুত্তুরী, রথের চাকা গুলো দাঁড়িয়ে রইল অনড় হয়ে, রথ ফেলে ছিটকে বেরিয়ে যেতে চাইল তিন ভাইবোন। কোন মতে,তাদের শান্ত করে, পুনরায় রথে প্রবিষ্ট করা হল। ছেলেটা পর্যায়ক্রমে রথের সামনে-পিছনে, চাকার উপরে-নীচে সর্বত্র পেরেক আর দড়ি বেঁধে দিল। তাও টলমল করেন তিন ভাই বোন। শেষে আমি বললাম, "চল বাবু তুই রথ টান। আর আমি রথের মাথাটাকে ধরে থাকি। দেখি যদি নড়ানো যায় তেনাদের।" তাও তাঁরা দোদুল্যমান। তখন মাসি বলল, " দাঁড়াও দাঁড়াও, আগে দক্ষিণা দিই। দক্ষিণা না নিয়ে নড়বেন না মনে হচ্ছে।" দক্ষিণা দেওয়া হল, নকুলদানার প্রসাদ বিতরণ করা হল, অতঃপর জয় জগন্নাথ ধ্বনি সহ যাত্রা শুরু করলেন তাঁরা।


 জগন্নাথ দেবের টলমলে রথের জন্য খোলা হল বাংলোয় গাড়ি ঢোকার মস্ত সবুজ ফটক খানি। রাস্তায় নামলাম আমরা। এবার যাব কোথা। "বাবার অফিসে যাবে মা?" প্রশ্ন করেই উত্তরের অপেক্ষা না করে রথ টানতে লাগল তুত্তুরী। জগুদাদা এন্ড কোং এরও মনে হয় বাবার অফিস দেখারই ইচ্ছে ছিল, তাই দিব্য টলটল করতে করতে এগিয়ে গেলেন তেনারা। কে বলবে, একটু আগে এনাদের নড়ানোই ছিল দুষ্কর। বাংলোর গেট থেকে শৌভিকের অফিস সাকুল্যে আড়াইশো মিটার হবে।  অফিসের ঢুকতে হয় ঢালু রাম্প ডিঙিয়ে। সেখানে আর রথ টানার সাহস হল না কারো। কোলেই নিলাম তিন গুড়গুড়ে ভাইবোনকে সবাহন। 


শৌভিকের চেম্বারে ঢুকতে যাব, নূপুর বাবু দৌড়ে এলেন, "ম্যাডাম স্যার তো মিটিং করছেন। ইলেকশনের মিটিং, এডিএম স্যারও রয়েছেন।"

অতিরিক্ত জেলাশাসক (সাধারণ) মহোদয় প্রেস দেখতে আসবেন বলেছিল বটে শৌভিক। থমকে দাঁড়িয়ে ভাবছি কি করব, ফিরে আসব কিনা, ততক্ষণে চেম্বারের দরজা খুলে ধরেছে মহকুমা শাসকের আর্দালি কানাই বাবু। আমার সম্মতি ছাড়াই দিব্য গটগট করে ঢুকে গেল তুত্তুরী সহ তিন ভাই বোন। এডিএম স্যার এবং মহকুমা শাসক দুজনেই দেখলাম অত্যন্ত সহরষে স্বাগত জানালেন চারজনকে। নকুল দানার প্রসাদও হাত পেতে গ্রহণ করলেন দোঁহে। এমন কি দক্ষিণাও পাওয়া গেল বেশ। যা নাকি যে রথ টানে কেবল তারই প্রাপ্য। যে রথ ঠেলে বা সামলায় বা কোলে নেয় তার ভাগ্যে কচু ঘেঁচু এবং টিকটিকি।


এবার ফিরে আসার পালা। আমরা বাংলো প্রত্যাবর্তন করলাম বটে, তিন ভাইবোন রয়ে গেলেন মহকুমা শাসকের চেম্বারের এক পরিচ্ছন্ নকোণায়। ওটাই নাকি ওদের মাসির বাড়ি। অন্তত শ্রীমতি তুত্তুরী তাই ঘোষণা করলেন। কন্যার আব্দার দেখলাম হাসিমুখে মেনেও নিল শৌভিক। বাইরের আবরণটা যতই জাদরেল অফিসারের হোক না কেন, ভিতরে তো নিখাদ স্নেহপ্রবণ মধ্যবিত্ত বাঙালি বাপ।


Monday 19 June 2023

অনির ডাইরি ১লা মে, ২০২৩

 

#অনিরডাইরি #হাওড়ারগপ্প 


আমার বাবা-মায়ের কোনদিনই ঠিক সেই ভাবে বিবাহবার্ষিকী পালন করা হয়ে ওঠেনি। অবশ্য আশি/নব্বইয়ের দশকে আমাদের রক্ষণশীল মধ্যবিত্ত পরিবারে কারই বা সেভাবে পালন করা হত।

বছরের আর পাঁচটা দিনের মতোই আসত বিশেষ দিনটা আর নীরবে বিদায় নিত। বাবা-মায়ের রুদ্ধশ্বাস রোমান্সের গল্প যদিও চলত সারা বছর। কিভাবে জেলে প্রথম দেখা, বাবা তখন বিচারাধীন রাজনৈতিক বন্দি। কিভাবে বাবার অজান্তে, গ্রামে ফিরে গিয়ে ফসল বিক্রি করে, সেই টাকা দিয়ে বাবার জামিন করিয়েছিল সদ্য পরিচিত মা, সেই গল্পটাই ছিল আমার শৈশবের রূপকথা।


ঐতিহাসিক মে দিবসের দিন বাবা মায়ের ছোট্ট করে আইনানুগ বিবাহ, বাবার কিনে দেওয়া নীল বেনারসি শাড়ি আর বড় মাসির কাছ থেকে ধার করা গয়নায় লাজবন্তি মা আর বাবার যুগল সাদাকালো ছবিটা, সপ্তপদীর থেকে কম রোমান্টিক লাগত না আমার। ভালোবাসায় মোড়া ছিল দিনগুলো, ছিল না কেবল ভালবাসার দিনটার উদযাপন।


আশি- নব্বইয়ের দশককে পিছনে ফেলে, Y2K এর যাবতীয় জটিলতাকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ট প্রদর্শনপূর্বক হুড়মুড় করে এসে পড়ল সহস্রাব্দ। আশেপাশে ঝুপঝুপ করে ভেঙে পড়ল কত যে রক্ষণশীলতার প্রাচীর। কত কিছু যা এককালে দৃষ্টিকটু বা অবাস্তব গণ্য হত, স্বাভাবিক হয়ে দৈনন্দিন জীবনের অঙ্গ হয়ে উঠল, তার ইয়ত্তা নেই। বদলে গেল অনেক কিছুই, বদলানো না কেবল আমার ফুটো কপাল। আশেপাশে যতদূর চোখ যায়, চাকরি পেয়ে গেল, বিয়ে হয়ে গেল, এমনকি বাবা মাও হয়ে পড়ল না জানি কতজন তুতো ভাই বোন, সহপাঠী, সমবয়স্ক বন্ধুবান্ধব। আমিই রয়ে গেলাম নিঃসঙ্গ কাঠ বেকার। 


কানাঘুষো শুনি,"আমাদের মধ্যে কেবল অনিন্দিতাটারই কিছু আর হল না।" আর মাটিতে মিশে যাই। হল নাই তো, মায় একটা টিউশনিও জোটে না মাইরি। বাস ভাড়ার জন্যও হাত পাততে হয় অবসর নেওয়া প্রৌঢ় বাপের কাছে। অন্তর্বাস, ন্যাপকিনটাও কিনে দিতে হয় মাকে। আমার মত ব্যর্থ অপদার্থ মেয়ের জন্য কেন যে ধরিত্রী দ্বিধা হত না। 

 এমন সময় আমার অন্ধকার ভবিষ্যতের জন্য জনে জনে কুম্ভীরাশ্রুপাত করা এক প্রাক্তন সহপাঠী প্রস্তাব দিল তার কোচিংয়ে পড়ানোর জন্য। সপ্তাহে একটা ক্লাস, অঙ্ক আর বিজ্ঞান পড়াতে হবে, বেতন মিলবে দেড়শ টাকা।


টাকার অঙ্কটা শুনে তাচ্ছিল্য করতেই পারেন, বিশেষতঃ আজকের বাজার দরে। তবে মূল্য তখনই বুঝবেন যদি আপনি কখনও বেকারত্বের জ্বালা অনুভব করে থাকেন। সাদা ছোট্ট খামে মোড়া একটা ১০০ আর একটা ৫০ টাকার নোট। রবিবার সকালের ফাঁকা ৫২ নম্বর বাসের লেডিস সিটে বসে, জনগণের চোখ বাঁচিয়ে কতবার যে শুঁকে ছিলাম টাকার গন্ধটা। "শালা ম্যায় তো সাহাব বান গ্যয়া" মার্কা কেমন যেন একটা অনুভূতি হচ্ছিল। বাসের জানলা দিয়ে চোখ গেল রাস্তার ধারের একটা ছোট্ট দোকানে ঝোলানো হলুদ সাদা একটা পাঞ্জাবির দিকে। আজ আমার বাবা-মায়ের বিবাহবার্ষিকী না, ঝট করে বাস থেকে নেমে পড়ে কিনেই ফেললাম পাঞ্জাবীটা বাবার জন্য। দাম পড়ল ৯০ টাকা। আর মায়ের জন্য পাড়ার দোকান থেকে কিনলাম এক লিটারের একটা মেট্রোর বাটারস্কচ আইসক্রিম। চকলেট ফ্লেভার মায়ের ঘোরতর নাপসন্দ ছিল যে। কোচিং সেন্টার থেকে বাড়ি এই পৌনে তিন কিলোমিটার পথ আসতেই উড়িয়ে দিলাম সারা মাসের মাইনে।


এমন কপাল, সেই বছরই নভেম্বর মাসে নিউমোনিয়া বাঁধাল বাবা। এক সপ্তাহ ধরে যমে মানুষে টানাটানি। সুযোগ পেয়ে গেল মাও, "দেখলি তো,ওই সব বিবাহবার্ষিকী- টার্ষিকী করলে কি হয়।" তারপরের কয়েকটা বছর সত্যিই কিছু করিনি। করার সুযোগ ও পাইনি। ওই বছর গুলো ছিল আমার লড়ার এবং জেতার বছর। কিচ্ছু না হওয়া থেকে একসাথে অনেক অনেক  কিছু হবার বছর। থিতু হতেই আবার শুরু হল বিশেষ দিনের বিশেষ উপহার কেনা। সবাই মিলে সামান্য খাওয়াদাওয়া, আড্ডা, গল্পগুজব, সামান্য স্মৃতিচারণ এই আর কি। ব্যাপারটা যে বাবা বা মা খুব ভালো ভাবে নেয়, এমন ভাবার কিন্তু কোন কারণ নেই। বেশ বিরক্ত হয় বুড়োবুড়ি। প্রতিবারই বলে, ও সব আদিখ্যেতা এবার বন্ধ কর। নেহাৎ আমি শুনি না।


এটা বৃদ্ধ বৃদ্ধার ৪৯ তম বিবাহবার্ষিকী, কিন্তু এবার কিছু করাটা ছিল বেশ দুষ্কর। বাড়ি থেকে প্রায় শ দেড়েক কিলোমিটার দূরে রয়েছি। এত স্বল্প অবসরে বাড়ি যাই যে বাজার দোকান, রান্নাবাড়া কোন কিছুই আমার একার পক্ষে করে তোলা সম্ভব নয়। তারওপর আবার বৃদ্ধ-বৃদ্ধার সাজগোজ। একটু পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন পোশাক পরতে বললে, কিছুই নাকি খুঁজে পায় না বাবা। আর মা অনেক খুঁজে বার করে একটা ন্যাতা শাড়ি। কারণ, " ওরে বাবা কি গরম! তুমি কি চাও, এই গরমে আমি বেনারসী পরব নাকি?" 


ভাগ্যে অয়ন ছিল। শ্রীমান অয়ন কুমার চট্টোপাধ্যায় আমার বাবার ভ্রাতুষ্পুত্র। মেন্যু নির্ধারণ আমি করে দিলেও, আগের দিন রাত থেকে বসে লিস্ট করে, নিজে বেছে সব থেকে ভালো মালপত্র কিনে এনে, এই গা চিড়বিড় গরমে যা রাঁধল ছেলেটা, আহা অসাধারণ। দুটো মালাও কিনতে বলেছিলাম, সেটা অবশ্য কেনেনি, " এই বয়সে মার খাওয়াবি নাকি? মালা দেখে মেজ জেঠু রেগে ফায়ার হয়ে যাবে জানিস না। আসল বিয়ের দিনই মালা পরল না, সে নাকি বিবাহবার্ষকীতে পরবে।"

দই মিষ্টিটা অবশ্য আমার ফরমায়েশ মত কাঁথি থেকে নিয়ে গিয়েছিল শৌভিক। ভাগ্যে গিয়েছিল,তাই না ওমন সোনা মুখ করে সাজুগুজু করল বুড়ো বুড়ি। ভগিনী, কন্যা, জামাতা, ভ্রাতুষ্পুত্র, পুত্রবধূ, নাতি, নাতনী পরিবৃত হয়ে এক কথায় কেকটাও কেটে ফেলল। দেদার নকল বরফ ওড়ালো বুল্লু বাবু আর তুত্তুরী। বৃদ্ধ দম্পতির মাথায় হাত দিয়ে প্রাণ ভরে আশীর্বাদ করল সাতাশি বছরের তরুণী তন্বী পিসি। " তোরা দুজনেই তো আমার শিব রাত্রির সলতে। আর তো সবই হারিয়ে গেছে আমার। খুব ভালো থাক। আরো আরো ঝগড়া কর। ঝগড়া করলে ফুসফুসের জোর বাড়ে, আমি পড়েছি।"  সময় ও আজব খেলা খেলে মাইরি, বছর বিশেক আগে এ দৃশ্য ছিল অকল্পনীয়। এমনিই থাকুক না, এমনিই চলুক না। বাকি সব অঙ্ক সময় আর কর্মফল ঠিক মিলিয়েই দেবে। অন্তত জীবন তো আমায় তাই শিখিয়েছে।

অনির ডাইরি ১১ই মে, ২০২৩

 

#অনিরডাইরি #কাঁথিরকিস্যা 


আজ ২৫শে বৈশাখ সরকারি ক্যালেন্ডার এ লাল থাকার সৌজন্যে আমার আজ ছুটি। শৌভিক অবশ্য বেরোবে। দিনভর নানা অনুষ্ঠানে হাজিরা দিয়ে বেড়াবে। প্রথমেই যাবে কাঁথি উপসংশোধনাগারে। পাতি বাংলায় জেল। পদাধিকার বলে এই জেলের সুপার কাঁথির মহকুমা শাসক। কেবলমাত্র বিচারাধীন বন্দিরাই থাকেন এই জেলে। বিচার শেষে হয় মুক্তি, নয়তো যতদূর জানি, মেদিনীপুর জেলে স্থানান্তরিত করা হয় আবাসিক বন্দীদের।এই আবাসিক বন্দীদের নিয়েই রবীন্দ্রজয়ন্তীর সামান্য আয়োজন। 


আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতে খুব একটা যে উৎসুক ছিল শৌভিক তা নয়, বলতে পারেন গায়ে পড়েই সঙ্গী হয়েছি। জেল পরিদর্শনের লোভ আমার বরাবরই। আমার পূর্বতন দুই প্রজন্মের একাধিক পুরুষ তাঁদের তারুণ্যের বেশ কিছুটা করে অংশ জেলে কাটিয়েছেন, রাজনৈতিক বন্দী হিসেবে। বাবা আর ছোট কাকুর সময় ছিল নকশাল আন্দোলন। ছোট দাদুর ক্ষেত্রে ছিল," ইয়ে আজাদি ঝুঠা হ্যায়"। আর পিতামহ ছিলেন অনুশীলন সমিতির সক্রিয় সদস্য, বাঘা যতীনের অনুরাগী। স্থান হয়েছিল খাস মান্দালয় জেলে। ছেলেকে দেশে ফেরাতে কালাপানি পেরিয়ে একঘরে হতে হয়েছিল প্রপিতামহকে। তাই আমাকে নিরস্ত করা অত সহজ নয়।


 মহকুমা শাসকের নিবাসের ঢিল ছোড়া দূরত্বেই জেলটা। বর্তমান জেলার সাহেবের তীব্র অনুরাগী আমার বর। কথায় কথায় ওনার প্রশংসা করে, উনি নাকি অত্যন্ত উদ্যোগী পুরুষ। জেলারের কাজটাকে নিছক গতানুগতিক ভাবে নয় বরং প্রগাঢ় ভালোবেসে করেন। সীমিত সামর্থ্যের মধ্যেই এমনকি কখনও কখনও নিজের পকেট থেকে পয়সা দিয়েও আবাসিকদের দিয়ে নানা রকম হাতের কাজ করান। বর্তমানে মুক্ত এমনই এক আবাসিকের স্বহস্তে তৈরি মূর্তি শোভা পায় শৌভিকের অফিস চেম্বারে, উপহার দিয়েছিলেন জেলার সাহেব। 


নামকাওয়াস্তে গাড়িতে ওঠা আর নামা। রাস্তা পেরিয়েই দাঁড়িয়ে গেল গাড়িটা। শৌভিকের ব্যক্তিগত দেহরক্ষী যেহেতু অস্ত্র বহন করেন, তাই জেলে তার প্রবেশ নিষিদ্ধ। যুগলে ঢুকলাম জেলের মস্ত গেটটা দিয়ে। ভিতরে এক সহাস্য ভদ্রলোক প্রতীক্ষা করছিলেন আমাদেরই জন্য। শৌভিক আলাপ করিয়ে দিল, ইনিই জেলার সাহেব। ভদ্রলোক বয়সে আমাদেরই সমান হবেন। মাঝারি উচ্চতা, মাঝারি চেহারা। চোখে চশমা, পরনে চেক শার্ট আর প্যান্ট। জেলারের উর্দি না থাকাতেই আমি চিনতে পারিনি ওনাকে।


নমস্কার -প্রতিনমস্কারের পালা মিটতে উনি হাসিমুখে জানালেন," ম্যাডামকে এনেছেন, এতে আমরা ভীষণ খুশি হয়েছি।" অতঃপর ওনার ইশারায় খুলে গেল মস্ত তালা লাগানো, "কারার ঐ লৌহ কপাট।" ভিতরটা ঝকঝক করছে, কেয়ারি করা ফুলের বাগান। সর্বত্র যত্ন আর আন্তরিকতার ছাপ। শৌভিক ফিসফিস করে বলল, " এই সমস্ত গাছের বীজ এবং চারা জেলার সাহেব ওনার পকেট থেকে টাকা দিয়ে কিনিয়েছেন। বাগান করলে আবাসিকের সুকুমার প্রবৃত্তির বিকাশ ঘটবে শুধু সেই জন্য। বলেছিলাম না এই লোকটা অত্যন্ত উদ্যোগী এবং ভালো।"


বাঁদিকে বেঁকে একতলা মস্ত হল ঘর। সেখানেই অনুষ্ঠানটি চলছে। লম্বাটে হল ঘর, মাটিতে কালো কম্বল পাতা। বাইরে অনেকগুলি জুতা ছাড়া ছিল, আমরা জুতো খুলতে গিয়েও জেলার সাহেবের আপত্তিতে খুলতে পারলাম না। দেওয়ালের চুনকাম সময়ের অভিঘাতে বিবর্ণ। ইতি ইতি দেওয়ালে এবং ছাদে ফাটল ধরেছে। দৈর্ঘ্য বরাবর দুই দিকেই নির্দিষ্ট দূরত্ব ছাড়া ছাড়া মানুষ সমান বেশ অনেকগুলি লম্বা জানালা। ফলে ঘরটা তেমন গরম নয়। রংবেরঙের বেলুন টাঙ্গানো হয়েছে জানলা জুড়ে যার কয়েকটা মাঝেমধ্যেই সশব্দে ফাটছে। 


প্রস্থ বরাবর একদিকের দেয়াল হলুদ সাদা সস্তার কাপড়ে মোড়া। তার সামনে, একদম বাঁদিকে একটি কাঠের চেয়ারের ওপরে বসে আছেন রবি স্বয়ং। তার ডানদিকে দুটি পালিশ চটা কাঠের টেবিল জুড়ে একটি উত্তরীয় পেতে তৈরি হয়েছে মঞ্চ। টেবিলের উপর রাখা রেকাবিতে গুটি কয়েক পুষ্পহার সাজানো আছে। টেবিলের পিছনে গোটা চার পাঁচ চেয়ার রাখা, তারই দুটি দখল করে বসলাম দোঁহে। আরো মান্য-গণ্য অতিথিরা আসতে পারেন ভেবে, ভয়ে এক কোনায় বসে ছিলাম শৌভিক ইশারায় পাশের চেয়ারটি দখল করতে বলল। সামনাসামনি বসে আছেন আবাসিক বৃন্দ। সংখ্যায় খুব কম নয়। মাথা গুনে দেখলাম ১১ জন মহিলা আর শতাধিক পুরুষ। দশটা থেকে শুরু হয়েছে অনুষ্ঠান, এখন সোয়া এগারোটা। উপস্থিত শ্রোতা এবং দর্শকদের মুখে চোখে ক্লান্তি বা বিরক্তির কোন চিহ্ন নেই।


প্রথমে মাল্যদান পর্ব। মহকুমা শাসকের জায়া হিসেবে গৌরবার্থে বহুবচন, আমাকেও মালা পরানোর অনুরোধ করা হল। দাড়ি বুড়োর গলায় মালা পরিয়ে, প্রণাম সেরে বসতেই শুরু হল অনুষ্ঠান। আমাদের জন্যই থমকে ছিল কিছু ক্ষণ।  মঞ্চের ডান দিকে একটি বিবর্ণ টেবিল এর উপর হারমোনিয়াম বাজাচ্ছেন এক প্রৌঢ়। তার পাশে ঢোলক বাজাচ্ছেন এক অতি বৃদ্ধ বন্দী, তার পাশে দাঁড়িয়ে করতাল বাজাচ্ছে একটি অল্প বয়সী ছেলে। ঘোষক ঘোষণা করতেই করতাল বাজানো ছেলেটি গান ধরল, " মন মোর মেঘেরও সঙ্গী"। সঙ্গে "নীল নবঘনে আষাঢ় গগনে তিল ঠাঁই আর নাইরে" র যুগলবন্দী। কতই বা বয়স হবে ছেলেটির, খুব জোর ২৫-২৬।  শ্যামলা দোহারা চেহারা, ওষ্ঠের ওপর সরু গোঁফের রেখা, তেল দিয়ে, সাইডে সিঁথি কেটে পরিপাটি করে আঁচড়ানো চুল। পরণে সস্তার ফুল প্যান্ট এবং হলুদ মেরুন টি শার্ট। দেখে দেখেই পড়ল এবং গাইল ছেলেটা, উচ্চারণে সামান্য জেলার টান থাকলেও এত ভালো গাইল যে আমরা দুজনে অভিভূত হয়ে পড়লাম। গান শেষে শৌভিক শুধাল, " তুমি আগে থেকে গানটা জানতে? কবিতাটা আগে পড়েছ?" ছেলেটি ঢিপ করে প্রণাম করে বলল, "কবিতাটা ছোট বেলায় ইস্কুলে পড়েছিলাম আজ্ঞে। গানটাও শুনেছিলাম মনে হয়। তবে গাইনি কখনও। এই অনুষ্ঠানের জন্য স্যারই শেখালেন।" 


দুজোড়া সার্চ লাইটের মত, শৌভিক আর আমার চোখ সঙ্গে সঙ্গে ঘুরে গেল জেলার সাহেবের দিকে। শৌভিক মুগ্ধ হয়ে জানতে চাইল, " আপনি শিখিয়েছেন? আপনি গান বাজনা করেন?"  উনি লাজুক হেসে বললেন,"ঐ আর কি? কয়েকদিন রিহার্সাল দিইয়েছিলাম ওদের নিয়ে।"  শৌভিক আবার প্রশ্ন করল, " এখানে যারা আজ পারফর্ম করছেন, তারা কি সবাই আপনার জেলের আবাসিক বন্দী?" উনি ঘাড় নেড়ে বললেন, "আজ্ঞে হ্যাঁ স্যার। বাইরের বলতে কেবল আমাদের এক সহকর্মীর ভাইঝি। বাচ্ছা মেয়ে। সেজেগুজে এসেছে, নাচবে বলে।  বাকি সবাই এই জেলের বাসিন্দা।"


এবার গান ধরলেন বুড়ো ঢোলক বাজিয়ে। কাঁপা কাঁপা হালকা বিষাদ মাখানো সুরে, "এ মণিহার আমায়, নাহি সাজে-"। নুব্জ চেহারা, মাথা ভর্তি পাকা চুল, গালে বেশ কয়েকদিনের না কাটা খোঁচা খোঁচা পাকা দাড়ি,পরণে সাদা ধুতি পাঞ্জাবি। চোখে কালো ফ্রেমের  পুরু কাঁচের চশমা। চশমার পিছনে একজোড়া ঘোলাটে চোখ। ঈষৎ ধরা গলায়, সামান্য ঝুঁকে গেয়ে চলেছেন বৃদ্ধ, 

" ফুলমালার ডোরে বরিয়া লও মোরে--

তোমার কাছে দেখাই নে মুখ মণিমালার লাজে",   বৃদ্ধের গান শুনতে শুনতে কেন যে করকর করে ওঠে দুই চোখ। কে জানে কি অপরাধে এই বয়সে বিচারাধীন বন্দীর তকমা জুটেছে লোকটার।  


 ছোট মেয়েটি এসে নেচে গেল বার দুয়েক। অনুষ্ঠান শেষে সেলফি তোলার আব্দার জানিয়ে গেল। তারপর গান ধরল আরেকটি আবাসিক ছেলে। বয়স কুড়ি থেকে বাইশের মধ্যে। পরণে সস্তার জিন্স আর গোলাপি রঙের ক্যাজুয়াল শার্ট। হাতে গলায় নীলচে ট্যাটু। মাথায় পাঁশুটে রঙের খাড়া খাড়া চুল। হাঁটেও অল্প বয়সী মিঠুন চক্রবর্তীর মত করে। স্টিলের বালা পরা হাতে মাইক্রোফোন ধরে ছেলেটা গান ধরলো, " যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে,তবে একলা চল রে।" সুস্পষ্ট উচ্চারণ, অটুট সুর, তাল এবং লয়। আবার বিমোহিত হলাম দুজনে।


অনুষ্ঠান চলতে লাগল, জেলার সাহেব ফাঁকে ফাঁকে জানালেন, " এখানে যোগব্যায়ামও হয় জানেন তো ম্যাডাম। প্রতিদিন সকাল সাড়ে ছটা থেকে। ওদের দিয়ে বাগান করাই, এই দেখুন ওদের জন্য লাইব্রেরী করেছি।" আমার পিছনে রাখা কয়েকটি আলমারিকে দেখিয়ে বললেন, "ওদের নিয়মিত বই পড়তে দিই। তবে অনেকেই আছেন, যাঁরা লিখতে পড়তে পারেন না, তাদের আমরাই পড়ে শোনাই। আপনাদের একবার ডাকব, আমাদের গল্প বলার আসরে।"  করজোড়ে বললাম, প্লিজ ডাকবেন। অবশ্যই মনে করে ডাকবেন। ব্যক্তিগতভাবে আপনার এই কর্মযজ্ঞের সামান্যতম অংশ হতে পারলেও আমি অন্তত নিজেকে ধন্য মনে করব। তুত্তুরীকেও সঙ্গে করে আনব। 


বেলা গড়ায়। শৌভিকের নিজের অফিসেও রবীন্দ্রজয়ন্তী উদযাপন হবে। মহকুমা তথ্য এবং সংস্কৃতি আধিকারিক বারবার ফোন করছেন।  ওখানে আজ আবৃত্তি প্রতিযোগিতা হবে স্থানীয় একটি সরকারি হোমের দশ থেকে বারো বছর বয়সী মেয়েদের নিয়ে। জীবনে প্রথমবার জনসমক্ষে রবি ঠাকুরকে আবৃত্তি করে শোনাবে মেয়ে গুলো। দর্শক হিসেবে আমাকেও নিয়ে যাবার বায়না করে রেখেছি আগে থেকেই। তবে সে তো অন্য গল্প। মোদ্দা কথা, অনুষ্ঠান মনোজ্ঞ হলেও আমাদের এবার উঠতে হবে।


জেলার সাহেব বাইরে অব্দি আমাদের ছাড়তে এলেন। ভিতরে তখন গান ধরেছে জনৈক আবাসিক, " গোধূলি গগনে মেঘে, ঢেকেছিল তারা-"। মানুষ সমান লম্বা জানালাগুলোর পাশ দিয়ে হেঁটে বেরোতে বেরোতে এক ঝলক ভিতর দিকে তাকিয়ে মনে হল যেন, চোখ মুচছে কোন কোন বন্দী। লুঙ্গি পরা একটা লোক তো দুই আঙ্গুলে চোখ টিপে মাথা নীচু করে বসেই রইল। কি জানি, কার জন্য ছল ছলিয়ে উঠছে এই বিচারাধীন বন্দীদের চোখ। সে যেখানেই থাকুক, যেন খুব ভালো থাকে।


পুনশ্চঃ ছবির পুতুল গুলি কাঁথি উপ সংশোধনাগারের এক প্রাক্তণ আবাসিকের হাতে তৈরি। বর্তমানে শোভা পায় মহকুমা শাসকের টেবিলে


অনির ডাইরি ১২ই মে, ২০২৩

 

#অনিরডাইরি #কাঁথি_থেকে_তমলুক


একটা লাল বাস আসে, বাতানুকূল বাস। বাসের গায়েও বড় বড় করে লেখা, "রেড বাস"। ভিতরে লোকনাথ বাবার ছবি টাঙানো। এমন তিতো, বিরক্ত মুখের লোকনাথ বাবা ইতিপূর্বে দেখিনি। তাঁর মুখের  সামনের রডে, একটা কালো প্লাস্টিকের ব্যাগ ঝোলানো থাকে, ব্যাগ ভর্তি একই রকম কালো প্লাস্টিক। পাশেই দরজার উপরে বড় বড় করে লেখা, "বমি করলে প্লাস্টিক ব্যবহার করুন"। হরদমই কেউ না কেউ যায় আর লোকনাথ ব্রহ্মচারীর মুখের সামনে থেকে প্লাস্টিক নিয়ে আসে, বৃদ্ধের বিরক্ত হবার যথেষ্ট এবং যুক্তিসঙ্গত কারণ আছে।


তবে, বাসটাতে বসে বড় আরাম। দুজনের সিটে আমার মত চেহারার দুজন আরাম করে ধরে যায়। কাউকে 'ব্যাবিলনের ঝুলন্ত উদ্যান' হয়ে সফর করতে হয় না। কন্ডাক্টার ড্রাইভার হেল্পারের ব্যবহারও খুব ভালো। মাত্র পঞ্চাশ টাকায়, এসির হাওয়া খেতে-খেতে, ঢুলতে-ঢুলতে, অফিস পৌঁছে যাই। যদি ঘুমিয়েও পড়ি, হেল্পার বা কন্ডাক্টর ঠিক ডেকে তুলে দেয়। তবে বাসটাকে পাওয়াই দুষ্কর। ব্যাটার কোন সময় জ্ঞান নেই, কোনদিন নটা ১৩য় ন্যাজ তুলে পালায়, তো কোনদিন নটা ২৪ এও তার দেখা মেলে না। কোন কোন দিন আবার থাকেও না অযথাই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হয়রান হই আমি।


গতকালই যেমন বেরোতে একটু দেরি হয়ে গিয়েছিল। নূপুর বাবু, মহকুমা শাসকের ড্রাইভার যিনি প্রত্যহ 'দাবাং' স্টাইলে আমাকে বাসে তুলে, একটা সিটের ব্যবস্থা করে দেন, আশ্বাস দিলেন, "কুন ব্যাপার নয় ম্যাডাম, ঐ বাসটাই ধরিয়ে দেব আপনাকে।" অন্য দিন আমরা কিছুটা পিছিয়ে গিয়ে দীঘা বাইপাস থেকে বাসে উঠি, যাতে সিট পাওয়া যায়। বাসটা ওখান থেকে সেন্ট্রাল বাসস্ট্যান্ড হয়ে রূপশ্রী বাইপাসে এসে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। নুপুর বাবু আজ না পিছিয়ে সোজা গাড়ি ঘোরালেন রূপশ্রী বাইপাসের দিকে।


রূপশ্রীতে দুটো বাস দাঁড়িয়ে আছে বটে, তবে, তারা আমার লাল্টু বাসটা নয়। "হুঁ" বলে গাড়ি ঘুরে গেল সেন্ট্রাল বাসস্ট্যান্ডের দিকে। পথে যদি দেখা মেলে তার। দেখতে দেখতে, পৌঁছেও গেলাম। অপেক্ষা করতে লাগলাম লাল্টু বাসটার জন্য। বাস আসে, বাস যায়, আমার বাসটাই কেবল গরহাজির। একটা স্টেট বাস তাকাতে তাকাতে পাশ দিয়ে চলে গেল। নূপুর বাবু উঠতে দিলেন না, " দেখতেছেন ম্যাডাম কি ভিড়! এই গরমে নন এসি বাসে যাবেন কেমন করে? বসেন না আপনার লাল বাসটাই ধরাব আপনাকে।" 


 শেষমেষ অবশ্য জানা গেল যে আমার বাসটা আজ আদৌ যাবে না। তাড়াহুড়ো করে যে বাসটায় উঠলাম, সেটিও নন এসি। উঠে, বসে, স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে, মনে হল, নন এসি বাসই ভালো। বাসের নিজস্ব লড়ঝড়ে আওয়াজে আর অন্য কিছু শোনা যায় না। এসি বাসের ভিতরে বাইরের শব্দ ঢোকে না বটে, সে অভাব পূরণ করে দেয় সজোরে বাজা গুটিকয়েক মোবাইল। ঝাড়া দু ঘন্টা রিলস্ দেখতে দেখতে যায় লোকে। এতটুকুও ভাবে না, সহযাত্রীদের মাথায় কেমন দমাদম হাতুড়ি পিঠছেন ওনারা।


একেবারে অসহ্য না হওয়া অব্দি দাঁতে দাঁত চিপে সয়ে যাই। মনে মনে খিস্তি মেরে গুষ্টি উদ্ধার করে দিই। তারপর মুখ খুলতেই হয়। "একটু আসতে শুনুন না, প্লিজ-"। বললে কেউ কেউ, "হাঁহাঁ" বলে আওয়াজ কমিয়ে দেয়। কেউ আবার পাত্তাও দেয় না। দীঘা থেকে ছুটি কাটিয়ে কলকাতা ফেরা জনৈকা যাত্রী তো আমাকে গুচ্ছের জ্ঞানই দিয়ে দিলেন গতকাল, "বাবাঃ। এটা বাস দিদি, একটু এ্যাডজাস্ট করতে শিখুন।না পারলে গাড়িতে যান।" এমন ভয় পেয়ে গেলাম যে বাকি পথ মুখে কুলুপ এঁটে ওনার মোবাইলের আওয়াজ শুনতে শুনতে মাথা ধরিয়ে অফিস গেলাম। রাতে খেতে বসে শৌভিক শুনে বলল, " আরে এটা তো তোর ডায়লগ। ও বলল কেন? বলবি তো, আপনি গাড়িতে যান মোবাইল শুনতে শুনতে-"। চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে আর কি।


আজ অবশ্য সে যন্ত্রণা নেই, ঐ হুব্বা পাবলিক গুলো নন এসি বাসে চড়ে না। বাইরে থেকে হু হু করে ছুটে আসছে বোশেখের তপ্ত বাতাস। ড্রাইভারের কেবিনের পিছনে, ছোট্ট স্ক্রিনে পরিমিত ভল্যুমে চলছে, বাংলা কোন সিনেমা। বছর চল্লিশের প্রসেনজিৎ ছলছল চোখে কার দিকে যেন তাকিয়ে আছে। পাশ থেকে শুভাশিস মুখোপাধ্যায় উদয় হয়ে বললেন,"-আমার বাবা। পাগল হয়ে গেছেন। তাই ওইসব কথা বলে বেড়ান।" নায়ক জানতে চান কিভাবে পাগল হলেন উনি, শুভাশিস বাবু গোল গোল জবাব দেন বটে, মাঝখান থেকে দেখতে শুরু করেও আমার বুঝতে অসুবিধে হয় না, " তুঝে সব হ্যায় পতা" প্রসেনজিৎ।  

অজ্ঞ শুভাশিস বাবু, কলির মহানায়ক কে চিনতে পারেন না। তাই জানতে চান, তিনি কে এবং গ্রামে কেন এসেছেন। নায়ক নাম বলতে গিয়ে, ঢোঁক গিলে, চোখ ঘুরিয়ে বলেন, " সু -,  সুরেশ। আমার নাম সুরেশ।" শুভাশিস বাবু বিশ্বাস করলেও, আমি মোটেই বিশ্বাস করি না। ওনার নাম আর যাই হোক না কেন, সুরেশ নয় বাপু। 


সুরেশ গ্রাম দেখতে এসেছেন এবং হোটেল খুঁজছেন শুনেই ধরণী দ্বিধা হয়। এক গলা জিভ কেটে, শুভাশিস বাবু এক অজ্ঞাত কুলশীল বছর চল্লিশের শহুরে ছোকরাকে( তখনও জানি না যে এই শহুরে ছোকরা সদ্য কলেজ থেকে পাশ করে বেরিয়েছেন) বগলদাবা করে নিয়ে যান তাঁর গৃহে।  "আমার বাড়ি থাকতে হোটেলে থাকবেন কেন- হেঁঃ হেঁঃ।" 


বাড়িতে ওনার উন্মাদ পিতাকে দেখতে পাই না বরং দর্শন পাই এক অতীব রূপসী তন্বী ভগিনীর। নাম বোধহয় রীনা। অভিনেত্রী অপরিচিতা।  রীনা এখনও পুতুল খেলে, পুতুলের বিয়ে দেয়। ঠিক যেমন শৈশবের সাথীর সাথে খেলত। সেই সাথী নিরুদ্দেশ বহু বছর, কিন্তু "করণ-অর্জুন" সিনেমার রাখির মত রীনাও বিশ্বাস করে যে, সে ‘আয়েগা। জরুর আয়েগা। ’ ঢ্যাং করে ঘন্টা পড়ে। মঞ্চে ছলছল চোখে সুরেশের প্রবেশ দেখে আমি মাঝ পথেই বুঝে যাই, যে ইনিই তিনি। রীনা অব্যশই বোঝে না। বুঝে গেলেই তো গপ্প শেষ। 


দুজনের ন্যাকা প্রেম, খুনসুটি, চা বাগানে নাচানাচি দেখতে দেখতে বিরক্ত হয়ে ভাবছিলাম একটু ঘুমিয়ে নিই, ঠিক এই সময়, "কোন সাপের বাচ্ছা মহিম হালদারের ছেলের গায়ে হাত তুলেছে রে? যা গিয়ে সাপের বাচ্ছাটার ল্যাজ ধরে টেনে আন।"  বলে গর্জে ওঠে কে যেন। চোখ রগড়ে উঠে বসে দেখি যে মঞ্চে মহিম হালদার রূপী দীপঙ্কর দে প্রবিষ্ট হয়ে খেলা জমিয়ে দিয়েছেন। সঙ্গতে লাল পাড় সাদা শাড়ি, এলো চুল, ধ্যাবড়া সিঁদুরের টিপ পরা কটা চোখের অনামিকা সাহা। কতদিন বাদে দেখলাম ভদ্রমহিলাকে। সাধারণতঃ খলনায়িকার চরিত্রচিত্রন করতেন, এখানে যদিও মহিম হালদারের সাধ্বী স্ত্রী তথা বিবেকের ভূমিকায়। “ওগো এমন করো না গো। গরীব মানুষের চোখের জল সইবে না-“ইত্যাদি প্রভৃতি। আমার মতই দীপঙ্কর দেও শেষে বিরক্ত হয়ে বললেন, “ম্যালা ফ্যাচফ্যাচ করো না তো। যাও ছেলের জন্য এক গ্লাস মাল নিয়ে এসো। বেশ কড়া করে।” বাসের পিছনের সিট থেকে পটাপট কয়েকটা তালি পড়ে গেল। 


বাস গড়ায়, নাটক জমে। আরো একজন নায়িকার উদ্রেক হয়। মহিম হালদারের কন্যা তথা সুরেশের কলেজের প্রেমিকা। দুই নায়িকা মিলে সুরেশকে নিয়ে ব্যাপক দড়ি টানাটানি করে। মাঝখান থেকে জানা যায় সুরেশের আসল নাম সূর্য। মহিম হালদার সূর্যর বাপের হত্যাকারী। তাই প্রতিশোধ নিতে গাঁয়ে ফিরেছে সূর্য। একা ফেরেনি সঙ্গে রঞ্জিত মল্লিক সহ আরো চার বৃদ্ধকেও নিয়ে ফিরেছে। যাদের একজন দেবেশ রায়চৌধুরী, আরেকজন রাজেশ শর্মা। মাথায় গোঁফে ট্যালকম পাউডার ঢেলে পাকা চুলদাড়ি বানালেও, যাদের বৃদ্ধ বলে হজম হয় না। তো এই তরুণ বুড়োর দল আর্মির পোশাক আর টুপি পরে যত্রতত্র ঘুরে বেড়ায় আর ডিস্যুম ডিস্যুম করে। জানা যায় এরা আসলে সূর্যর স্বর্গীয় পিতৃদেবের দাস (পড়ুন গৃহপরিচারক) ছিলেন। শৈশবে সবাই মিলে স্টিলের দুধের গ্লাস নিয়ে শিশু প্রসেনজিৎকে তাড়া করতেন। দুষ্টু মহিম হালদার নিজে খুন করে সবকটাকে জেলে পাঠান। 


এরপর আরো অনেক কিছু হয়, প্রেম, কান্না, ত্যাগ, আত্মবলিদান, চোখের জল এমনকি মার্ডারও। মহিম হালদার আর তার কুপুত্রকে কোতল করে, এক ডজন চেলাচামুণ্ডাকে ঠেঙিয়ে হাসপাতালে পাঠিয়ে, মহিম হালদারের স্যাঙাত থানার ওসিকে বেল্ট পেটা করে মাথা ফাটিয়ে মাননীয় জেলা শাসক মহোদয়ের ভূয়সী প্রশংসা পায় প্রসেনজিৎ। ঠিকই তো, দুষ্টের দমন তো করারই কথা। যার ল্যাজে আগুন লাগবে সেই তো লঙ্কা পোড়াবে। ওসব আইন- আদালত- পুলিশ থাকার দরকারটাই বা কি। এই তো জীবন কালি দা। 


দিব্যি খোশ মেজাজে নিমতৌড়ি স্টপে নামলাম। আহা এমন সিনেমা কতদিন দেখিনি গো। আফসোস কেবল একটাই, রঞ্জিত মল্লিক একবারও বেল্টটা খুললেন না, এই যা। ঠিক করলাম আজ আমার সাথে যারই দেখা হবে তাকেই এই গপ্পটা শোনাব। কারা যেন ডেপুটেশন দিতে আসবে বলে ভয় দেখিয়ে রেখেছে, আসুক ব্যাটারা। আগে আমার গল্প শুনতে হবে, তবে অন্য কথা। 


আর রাত টা নামতে দিন, কি যেন বলছিল শৌভিক, বিলি ওয়াইল্ডারের ডবল ইনডেমনিটি দেখাবে? যা কিনা পৃথিবীর সর্বকালের সেরা সিনেমা গুলির মধ্যে অন্যতম? সত্যজিৎ রায়ের প্রিয়তম সিনেমা? যেটা দেখে বিমোহিত হয়ে উনি বিলি ওয়াইল্ডারকে ১১ পাতার এক খানা চিঠি লেখেন, ওনার জীবিত অবস্থায় যার কোন প্রত্যুত্তর আসেনি। অস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে প্রচারিত ওনার ভাষণে উনি সেই কথা জানাতে, বিলি ওয়াইল্ডার সাহেব চিঠি লিখতে বসেন বটে,তবে সে চিঠি পাবার আগেই ইহলোক ত্যাগ করেন সত্যজিৎ। অবশ্যই দেখব, তবে তার আগে আমার গপ্পটা শুনতে হবে।