Tuesday 13 September 2022

অনির ডাইরি ৭ই সেপ্টেম্বর, ২০২২

 


মাঝে মাঝে ভিতরটা কি রকম যেন ফাঁপা লাগে। কিছুই যেন ঠিকমত সামলে উঠতে পারি না। বাবাকে ডাক্তার দেখানো হয় না। ডাক্তারের কাছে যাবার কথা বললেই বাবা বলে,‘ওসব এখন থাক। তুত্তুরীর দিকে নজর দাও। পুজোর পর হবে খন।’ বুঝতে পারি, আমাদের বিব্রত করতে চায় না বৃদ্ধ। আমাদের মুখ চেয়ে ক্ষুদ্র শারীরিক সমস্যা গুলোকে ফুৎকারে উড়িয়ে দেয় হয়তো, কিন্তু সমস্যা গুলো তো আর সত্যিই উড়ে যায় না। জমে থাকে, বংশ বাড়ায় অজানা, অচেনা কোন খন্দে। 


শ্বশুরমশাইয়ের এই সঙ্কোচটা নেই। শারীরিক অসামর্থতা নিয়ে নেই কোন লুকোচুরিও। নিজেই বলেন, ‘অ্যাপয়ন্টমেন্ট আমি নিয়ে নেব, তোদের মধ্যে যে হোক কেউ যদি একটু কষ্ট করে চলে আসিস।’ বৃদ্ধের কাতর স্বরে ভিজে যায় চোখ। কষ্টের কি আছে? এটা তো আমাদের কর্তব্য। সেই কর্তব্যটুকুও কি ঠিকঠাক পালন করতে পারি সবসময়? বয়স সুলভ ছোট একটা অপারেশন করতে হবে বৃদ্ধের, ডাক্তার বলেছে, ‘জলদি নেই। ধীরে সুস্থে করিয়ে নিন। না হলে কিডনিতে চাপ পড়বে কিন্ত।’ ঐ বয়সী বৃদ্ধের অপারেশন তো আর এমনি এমনি হয় না, তার আগে দেখাতে হয় অন্য বেশ কিছু বিশেষজ্ঞকে। তেমনি কোন বিশেষজ্ঞের সাথে মোলাকাতের দিনই পড়ে যায় মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীর ভিসি। না শৌভিক নড়তে পারে, না আমি। কাতর নিবেদন করতে হয় বৃদ্ধের কাছে, অনুগ্রহ করে ডেটটা যদি একটু পিছিয়ে দেওয়া যায়। অন্য যে কোন ডেট, যে কোন সময় হোক না কেন ঠিক পৌঁছে যাব যে কেউ একজন।


মন খারাপ থাকে তুত্তুরীর জন্যও। আর একটু ভালো করে যদি দেখতে পারতাম মেয়েটাকে। আর একটু খেটে যদি পড়াতে পারতাম। কিছুই পারি না। কিছুই হয় না আমার দ্বারা। পরীক্ষা চলছে মেয়েটার, কে জানে কেমন দিচ্ছে সে। পরীক্ষার আগে চেপে পড়াতে নিষেধ করে শৌভিক আর পরীক্ষা হয়ে গেলে প্রশ্নোত্তর মেলানোয় ভয়ানক অলসতা আমার। সব মিলিয়ে বেপোট মজায় আছে তুত্তুরী। পরীক্ষা কেমন হল রে, জিজ্ঞাসা করলেই জবাব আসে, ‘খুব ভালো।’দাঁড়ান, দাঁড়ান সত্যি সত্যি ভালো ভেবে বসবেন না আবার তাই বলে। ফল বেরোলে রীতিমত ব্যাগে করে নম্বর আনতে হয় আমায়। বাবা যদিও উৎফুল্ল হয়ে যায় ঐ পচাগলা রেজাল্ট দেখেও। ভদ্রলোকের এক কথার মতই শৌভিকের এক বুলি,‘তুই কোনদিন এত নম্বর পেয়েছিস? আমি তো পাইনি।’ নাঃ আমিও পাইনি। তখন এত নম্বর দেবার দস্তুর ছিল নাকি? কে বোঝাবে বাপ আর মেয়েকে? 


তবুও স্কুল বেরোনোর সময় বলি, ভালো করে পরীক্ষা দিও। সাবধান করি,ছুটির সময় আমি বা শৌভিকের ড্রাইভার পলাশ ছাড়া অন্য কারো সাথে না ধেই ধেই করে নাচতে নাচতে বেরিয়ে পড়ে স্কুল থেকে। কেউ যদি বলে, খুকি তোমার মা ডাকছে তাহলে তার ওপর যেন ভুলতে বসা ক্যারাটের দুচারটে মার প্রয়োগ করে ইত্যাদি প্রভৃতি। শৌভিকের ভ্রু কুঞ্চন অপেক্ষা করে বাগুইআটির গল্পটা শোনাই।  গাড়িতে উঠতে উঠতে ঘুরে প্রশ্ন করে তুত্তুরী, ‘তোমাদের দেরী হলে কি করব?’ চেহারাটাই বড় হয়েছে, মগজে যদি ছিটেফোঁটাও ঘিলু থাকে মেয়েটার,হেঁকে বলি, অপেক্ষা করবি। আবার কি? প্রিন্সিপাল স্যারের ঘরে গিয়ে বসে থাকবি। ‘আচ্ছা এবার থাম’ বলে থাবড়া মেরে থামিয়ে দেয় শৌভিক। 


সাড়ে ১২টার মধ্যে হাজিরা দিতে হবে ভিসিতে। তার আগে টুকটাক কাজ গুছিয়ে নিই। রঙিন প্রিন্ট নিয়ে নিই রিপোর্টের। বড় সাহেবের সঙ্গে আরেকবার ঝালিয়ে নিই পড়া। উনি হলদিয়া থেকে থাকবেন আর আমি তমলুক থেকে। নিমতৌড়ি ডিএম আপিসের এ ব্লকের তিন তলার সব থেকে বড় মিটিং হলে হবে ভিসি। সাড়ে বারোটা নাগাদ যখন পৌঁছালাম বেশ ভিড় হয়ে গেছে। পিছনের সিট গুলোর আকর্ষণ শক্তি বড়ই প্রবল, কিন্তু ঐ ফাঁদে পা দিলেই চিত্তির। ঠিক মিটিং শুরুর আগে কেউ না কেউ অনুরোধ করবেন,‘পিছনের রো এর লোকজন একটু সামনে চলে আসেন-।’


মাঝাামাঝি রো সবথেকে সেফ। মাঝামাঝি লাগানো টিভির সামনে বসলাম জমিয়ে। পৌনে একটা নাগাদ মাননীয় মহকুমা শাসক ফোন করে জানতে চাইলেন,‘পৌঁছেছিস?’ জবাবে জানতে চাইলাম,‘তুই কোথায়?’ যেখানে বলল, বেশ খানিক উঁকিঝুঁকি মেরে চেনা মাথাটা খুঁজে পেলাম বটে। সময় গড়ায়, মস্ত মিটিং হলের দু প্রান্ত থেকে চলে খুনসুটি ভরা মেসেজ আদানপ্রদান। নবান্ন থেকে কে যেন ধমকে ওঠে,‘সবাই ঢুকেছেন? ম্যাডাম কিন্তু এখুনি এসে পড়বেন। আর কাউকে ঢুকতে দেওয়া হবে না কিন্তু-’।  


মাননীয়া তাঁর আসন গ্রহণ করেন। আসন নেন অন্যান্য মান্যগণ্য প্রশাসক এবং মন্ত্রীবর্গ। মিটিং শুরু হয়, সাময়িক ভাবে বন্ধ হয়ে যায় আমাদের মেসেজ চালাচালি। গোটা কয়েক ফোন এসে, বেজে কেটে যায়। পৌনে দুটো নাগাদ ফোন করে শৌভিকের ড্রাইভার পলাশ। যেদিন আমি যেতে পারি না, তুত্তুরীকে স্কুল থেকে আনতে পলাশই যায়। মেয়েটাকে স্কুল থেকে বাড়িতে নামিয়ে প্রত্যেক বারই আমায় জানিয়ে দেয়। ‘ম্যাডাম, তুত্তুরীকে লাবিয়ে দিলাম।’ ভাবলাম আজও তাই বলছে হয়তো।তাই জন্যই ধরলাম, নতুবা পলাশের স্যার ফোন করলেও ধরতাম না ঐ মুহূর্তে।  কিন্তু পলাশের আজকের বক্তব্যটা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন, হতভম্ব গলায় পলাশ বলল,‘ ম্যাডাম, তুত্তুরীকে কি আনতে হবে?’


হে ভগবান, পরীক্ষা বলে তুত্তুরীর ছুটি হবার কথা সোয়া একটায়, আধ ঘন্টা আগে। এখনও তাকে আনতে যায়নি পলাশ? ভয়ে আঁতকে উঠলাম আমি। পলাশ ও প্রচণ্ড ভয় পেয়েছে, তোতলাতে তোতলাতে বলল,‘এই মাত্র বললেন স্যার। আমি এখুনি যাচ্ছি। এখুনি যাচ্ছি।’ কাঁপা কাঁপা হাতে ফোনটা রাখতে না রাখতেই পলাশের স্যারের মেসেজ,‘ বুজুকে( অর্থাৎ তুত্তুরী) আনার কথা বলতেই ভুলে গিয়েছিলাম। এখন বললাম।’ সাথে একটা দুঃখের ইমোজি। ভাগ্যে মিটিং হলটা মস্ত, আর দুজন দুপ্রান্তে বসেছি। নইলে খুনই করতাম ব্যাটাকে। মিটিং এর এমনি মোহ যে মেয়েকে ভুলে গেছে। 


উদ্গত ক্রোধ চেপে বললাম, ‘আধ ঘন্টা আগে ওর ছুটি হয়ে গেছে। CA (আপ্ত সহায়ক)কে বল স্কুলে ফোন করতে এখুনি। কি যে হল আমার মেয়েটার।’ ১টা ৫০ এ মেসেজ ঢুকল,‘বলে দিয়েছি। CA সাহেব খোদ প্রিন্সিপ্যালকেই বলেছেন তাঁর ঘরে বসিয়ে রাখতে।’ এর পরের ১৫টা মিনিট যে কি ভাবে কাটল তা শুধু ভগবানই জানে। মনে মনে হিসেব করছিলাম আমি, কতক্ষণে স্কুলে পৌঁছাবে পলাশ। দুটো পাঁচে ফোন করলাম পলাশকে। হাঁপাতে হাঁপাতে পলাশ বলল,‘তুত্তুরীকে খুঁজে পেয়েছি ম্যাডাম।’ এর ঠিক দুমিনিটের মাথায় পলাশের স্যারের মেসেজ,‘গাড়িতে উঠে গেছে।’ দাঁত কিড়মিড়ের ইমোজিটা খুঁজে পেলাম না, তাই এমনিই লিখলাম, ‘জানি। বাড়ি আয়, তোকে আজ খুনই করব।’ ভেবেছিলাম আরেকটা স্যাড ইমোজি আসবে বা দুঃখ প্রকাশ করে কোন মেসেজ, কচু, ঘেঁচু, টিকটিকি। উল্টে তিনি বললেন,‘সব তোর দোষ। উত্তমকুমারকে তো পাঠাতেই পারতিস-’। 

সবথেকে মজার কথা যেটা, তুত্তুরী এবং খোদ উত্তমকুমারও দেখলাম ঐ একই কথা বলল। ‘ আপনি আমায় একবার বললেই তো পারতেন ম্যাডাম। আমি তো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পলাশদার সাথেই গল্প করছিলাম।’ আর তুত্তুরী বলল, ‘বেচারা বাবাটা আমার। তুমি কেন বলোনি উত্তম মামাকে।’ মানতে বাধ্য হলাম, সবই আমার দোষ রে বাবা। শাশুড়ী মা কি সাধে বলেন,‘বেঁচে থেকে আর লাভ নেই।’

Sunday 11 September 2022

অনির ডাইরি ১০ ই সেপ্টেম্বর, ২০২২

 


আজ ভাবতে বসলে মনে হয় যেন ভিন্ন কোন যুগের গল্প। ভীষণ লোডশেডিং হত তখন, প্রায় প্রতি রাতই থাকত নিষ্প্রদীপ। হ্যারিকেন বা লম্ফের আলোয় রাতের রান্না খাওয়ার পাট চুকিয়ে, শতরঞ্চি আর বালিশ বগলে বাবা-মায়ের সাথে ছাতে শুতে যাবার সে কি উন্মাদনা। আজও চোখ বন্ধ করলেই দেখতে পাই,  চাঁদোয়া টাঙানো মসিকৃষ্ণ আকাশ, আকাশ জুড়ে ছড়ানো হীরের কুচির মত অগণিত ঝকঝকে তারা। মায়ের যে ছাতে শুতে যাবার খুব একটা উৎসাহ থাকত তাও নয়, ভোর পাঁচটা থেকে উঠে যৌথ পরিবারের যাবতীয় সাংসারিক কাজকর্ম সেরে, পোস্ট অফিসের কাউন্টার ডিউটি করে বাড়ি ফিরে আমাকে পড়ানো, রাতের রান্না- খাওয়ার ব্যবস্থা করতে করতে এতই ক্লান্ত হয়ে পড়ত মা, যে শুলেই ঘুমিয়ে পড়ত, সে মাথার ওপর ঘরঘরে ডিসি পাখা চলুক আর ছাই নাই চলুক।  খোলা ছাতে শুয়ে আকাশের তারা দেখতে দেখতে তাত্ত্বিক আলোচনা করাটা ছিল বাবার আর আমার সবথেকে প্রিয় সময়। সদ্য ‘অ লেখ রে ভাই দাগে দাগে’ শুরু করেছে মা, তাতে কি, তাও  বাবা গল্প শোনাত শ্রেণীহীন এক সমাজের। 


তেমনি কোন রাতের কথা, পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়েছে মা, গল্পে মত্ত আমরা বাপ আর মেয়ে। আচমকা গল্প থামিয়ে ধড়ফড় করে উঠে পড়ল বাবা, লাফিয়ে উঠে পড়ল মাও। কোথা থেকে যেন ভেসে আসছে এক ভয়ংকর কটুগন্ধ। মা বলল, "এতো মানুষ পোড়া গন্ধ। কোথাও আগুন লাগল নাকি?" তখনও নিষ্প্রদীপ, অন্ধকারে আচ্ছন্ন আমাদের মহল্লা। শুধু আমরাই নই, দোতলায়  জেঠু আর একতলায় ঠাকুমাও পেয়েছে গন্ধটা। আমাদের বাড়িতে তখন সাকুল্যে বারো - তেরো জন অধিবাসী। দম দেওয়া একতলা আর দোতলার দেওয়াল ঘড়ি একটু আগেই জানিয়েছে যে মধ্য রাতি পার করেছি আমরা। ফলতঃ আমরা কজন ছাড়া মোটামুটি সবাই গভীর তন্দ্রাচ্ছন। তবুও সব ঘর দেখা হল, ছাত থেকে, দোতলার বারন্দা থেকে  এদিক ওদিকও দেখল ভালো করে বাবা আর জেঠু। আসেপাশের কোন বাড়ি থেকে আসছে না কোন সাড়া শব্দ। তাহলে কি নিছক মনের ভুল? ঘুমঘুম গলায় জ্যাঠাইমা ধমক দিল জেঠুকে, "তোমাদের যত আজগুবি ব্যাপার স্যাপার।"  ভোর পাঁচটায় উঠতে হবে জ্যাঠাইমাকেও, আটটার মধ্যে ভাত খেয়ে, টিফিন বাক্স বগলে আপিস বেরোবে জেঠু। তাই জ্যাঠাইমার বিরক্তি ভয়ানক ন্যায়সঙ্গত। বাড়ির বড় গিন্নিমার ধমক খেয়ে সবাই ফিরে গেল যে যার শয়নকক্ষে। বাবা মায়ের হাত ধরে ছাতে গেলাম সেদিনের আমি। এক অজানা আতঙ্কে ছাতে শোবার ইচ্ছে ততোক্ষণে উধাও। মাও আর ছাতে শুতে ইচ্ছুক নয়, কিন্তু বাবার জেদ, ছাতেই শোবে। গন্ধটা আর নেই বটে কিন্তু ছাতের দক্ষিণ পশ্চিম কোণে ঝাঁপিয়ে পড়া বেলগাছের ডালপালার নীচে জমাট বাঁধা অন্ধকারটা কেমন যেন সচল মনে হল। চোখ বন্ধ করে নাকটা বাবার খোলা পিঠে ঠেকিয়ে বলেই ফেললাম বাবাকে, ‘ ওখানে মনে হচ্ছে কেউ আছে। আমার ভীষণ ভয় করছে, নীচে চল।’ বরাবরই ডাকাবুকো আমার বাপ, হো হো করে হেসে উঠল প্রথমে। তারপর বলল, ‘কিসের ভয়? ভূতের? একটা জিনিস সব সময় মাথায় রাখবি, মানুষ যতটা ভূতকে ভয় পায়, তার থেকে ঢের বেশি ভূত মানুষকে ভয় পায়। ভূত হোক বা মানুষ যখনই কেউ ভয় দেখাবে, তার থেকে পালাবি না। চোখ সরিয়ে নিবি না, বরং ঘুরে চোখে চোখ রেখে তাকাবি, দেখবি সে কেমন তোকে ভয় পায়।’ 

নাঃ বাবার এই অমৃত নির্দেশ আমি আজও পালন করতে পারিনি। ভয় দেখানো পার্থিব বা বায়বীয় কারো দিকেই ফিরে তাকানোর হিম্মত আমার আজও হয়নি। নেহাৎ উপরে কেউ আছেন, নেহাৎ কর্মফল আছে তাই বোধহয় আমাদের মত ছাপোষা, মধ্যমেধা, মধ্যমানের মানুষ গুলো অতি প্রতিকৃল অবস্থার মধ্যেও লড়ে যায় এবং জিতেও যায়। তাই মনে হয় মাঝেমাঝে যে সবই তেনার ইচ্ছা। 


তো এহেন অমৃতবাণীতেও যখন আমার ভয় কাটল না, তখন হাই চেপে বাবা বলল,‘এক কাজ কর। মাকে ছুঁয়ে থাক। মা ছুঁয়ে থাকলে ভূত প্রেত দত্যি দানা তো কি, খোদ যমরাজও কিছু করতে পারে না।’ এই হল না, ‘মন কি বাত।’ খপ্ করে মায়ের হাতটা টেনে নিজের পেটের ওপর রাখলাম। ঘুমিয়ে পড়েছিল মা, আবার। অন্যদিন হলে ঘুমন্ত মায়ের গায়ে হাত দিলেও খ্যাঁক করে উঠত মা। সেরাতে কি যে হল, কিছু তো বললই না, উল্টে ঘুমের ঘোরে আর একটু কাছে সরে এল মা। জড়িয়ে ধরল সেদিনের ছোট্ট আমাকে। তাও কেন যে কাটে না ভয়টা। এবার বাবার একটা হাত টেনে নিলাম পেটের ওপর। দুদিক থেকে আমাকে ঘিরে ধরল দুজনে। পলকে গায়েব হয়ে গেল যত ভয়। মনে হল এর থেকে বড় নিরাপত্তাবলয় আর কি হতে পারে। সেদিনের সেই অনুভূতি আজও হৃদয়ে টাটকা। আজও ধাক্কা লাগলে, হোঁচট খেলে, সমস্যায় জর্জরিত, আতঙ্কিত হলে, হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়লে শুধু একটা ফোন করতে লাগে, ‘বাবা তুমি একবার বলো তো, যে এটা হয়ে যাবে। মা তুমি একবার বলো তো যে আমি পারব- ব্যাস্ তাহলেই আমি পারব। সব পারব।’ 


 ইয়ে একটা কথা বলতে ভুলে গেছি,যে রাতে অমন মানুষ পোড়া গন্ধে সাময়িক ভাবে ভরে গিয়েছিল চরাচর, তার পরের দিন জানতে পারা যায় যে কেউ আগুনে পুড়ে মরেনি বটে, গলায় দিয়েছিল,পাশের পাশের বাড়ির একটি বউ। মৃত্যুর সময়টা ছিল, আনুমানিক মধ্যরাত্রি।

অনির ডাইরি ৩রা সেপ্টেম্বর, ২০২২

 


#তুত্তুরী_আর_ফুলঝুরির_গপ্প 


“মা সব ন্যান খেয়ে ফেলে, তাই আমি হাত খেয়ে পেট ভরাই।” আপিস টাইম, মিটিং চলছে, তার মধ্যে যদি ফোনের স্ক্রিনে হঠাৎ ফুটে ওঠে এমন বার্তা, তো হাসি পাবে না? নেহাৎ অত্যন্ত গুরুগম্ভীর বিষয় নিয়ে মিটিং, তাই শিকারি বেড়ালের মত ফ্যাচ করে হেসে ফেলতে গিয়েও গিলে নিলাম হাসিটাকে। পেটের মধ্যে গুলাতে থাকা দমকা হাসির ঘূর্ণিঝড়কে শাসন করতে, ঠোঁট কামড়ে, দাঁতমুখ খিঁচিয়ে যত উদ্ভট আর তেঁতো ব্যাপারস্যাপারে মনোনিবেশ  করার চেষ্টা করলাম।  


সব দোষ উমার। নাতনী ফুলঝুরির সঙ্গে কিছুটা নিভৃত সময় কাটানোর আকাঙ্খা নিয়ে মাসিমা-মেসোমশাই অর্থাৎ উমারাণীর বাবা এবং মা যে কটা দিনের জন্য দুর্গাপুর এসেছেন এখবর গতকাল না পরশুই দিয়েছিল বটে উমা। এমতবস্থায় এমন মেসেজ করলে প্রথম চোটে তো এটাই মনে হবে যে মাসিমা ন্যান খাচ্ছেন আর উমা হাত খাচ্ছে। ব্যাপারটা কল্পনা করে কি আদৌ হাসি চাপা যায়? 


 চেম্বার ফাঁকা হতে, ফোন খুলে গোটা মেসেজটা পড়ার পর ধরা পড়ল আসল কালপ্রিট। শ্রীমতী ফুলঝুরি, যিনি আপাততঃ  ন্যান(বেবি ফুড) ফেলে নিজের হাত চুষতে অতীব উৎসাহী। বাধা দিলে বা সামান্য বেচাল দেখলে তিনি আবার আজকাল ‘অ্যাও অ্যাও’ করে ধমকাতেও শিখেছেন। 


উমাকে ফোন করে আশ্বস্ত করলাম আহা একটু হাত খেয়েছে তো কি এমন অপরাধ করেছে বেচারা। হাত খাওয়া তাও ভালো, হামা টানলে তো পিপড়ে ধরবে আর সটাসট মুখে পুরবে 😂।  উমা বলল, ওয়াক থুঃ থুঃ। 


কচি মুখের মধ্যে মুঠি করে গোটা হাতটা পুরে চকাস্ চকাস করে চুষতে, প্রায় সব চেনা পরিচিত বাচ্ছাকেই দেখেছি। নিজের হাত চুষে যে কি এত আনন্দ পায় কচিকাঁচা গুলো তা জানতে শ্রীমতী তুত্তুরীর শৈশবে রীতিমত নেট ঘেঁটে রিসার্চ করেছিলাম আমি। তখনই জানতে পারি, এটা আসলে খুবই সাধারণ ব্যাপার। হাত বা আঙুল চুষলে যে সাময়িক  শিরশিরে অনুভূতি জাগে, সেটাকেই উপভোগ করে নবজাতকের দল। প্রথম চোটে বিস্মিত হয়, তারপর তারিয়ে তারিয়ে এই নতুন অনভূতিকে উপভোগ করে কচিকাঁচা গুলো। হাতের পাশাপাশি পায়ের আঙুলগুলোকেও মুখে পুরে চোষার চেষ্টা করে ব্যাটারা। প্রথম চোটে সবাই সফল হয়, তারপর দেখে ওবাবা এতো বেশ কষ্টসাধ্য ব্যাপারস্যাপার। ভরা পেটে পা'টাকে মুখের কাছে এনে চুষতে গেলে আবার বমি থুড়ি দই তোলার ঝামেলা থাকে। অত ঝামেলা কার পোষায়, তার থেকে হাতই ভালো। 


প্রসঙ্গতঃ একই কারণে হাত এবং পায়ের পাশাপাশি শরীরের অপর একটি অঙ্গ ধরেও রীতিমত টানাটানি করে বাচ্ছারা। অনুধাবন করার চেষ্টা করে, ব্যাপারটা ঠিক কি হচ্ছে, এমন ‘চড়াম্-চড়াম্’ মার্কা শিরশিরানি জাগছে কেন। জনৈকা স্বনামধন্যা লেখিকা,  ২০১০-১১ নাগাদ একবার দাবী করেন যে উনি নাকি তিন বছর বয়সে প্রথম প্রাপ্তবয়স্ক  সুলভ অপকর্মটি করেন। ওণার দুঃসাহসী আত্মকথনে তুফান ওঠে ফেবুতে, আগুন জ্বলে যায় বুদ্ধিজীবী তথা উচ্চ-মধ্যমেধা মহলে। শুধু আমিই যা ভেবেছিলাম যে লিখব, ‘তিন বছর বয়সে প্রথম করেছিলেন দিদি! এ হে বড্ড দেরী করে ফেলেছিলেন গো। কচিকাচা গুলো তো ওটা দু-তিন মাস বয়স থেকে করে, তাও গণমাধ্যমে জাহির করে না। কেমন অমায়িক ভাবুন আমাদের বাচ্ছাগুলো।’


ফোনে উমাকে সেই কথাগুলিই আবার বলে বললাম,‘ভাই আর যাই করিস, খবরদার ভুলেও ন্যান খাস না। অতি বাজে খেতে। নামেই বাচ্ছাদের দুধ, আদতে ভয়ানক লবণাক্ত, অতি বিদঘুটে স্বাদের সাদা রঙ পানীয়। আশ্বস্ত করে বললাম, যদি বেবি ফুড খেতেই হয় তো ভিল্যাক হুইট টা খাস। ওটা বেড়ে খেতে। 


উমা অত্যুৎসাহে বলল,‘ সেটা তো দেয়নি। চেয়ে নেব তাহলে।’ হেসে বললাম, এত তাড়াতাড়ি দেবে না বাপু। একটু সবুর কর। একটু বড় হোক, তবে না। নেস্টাম রাইস আর ভিল্যাক হুইট। তুত্তুরীকে দিয়েছিল ওর ডাক্তার দিদিমণি। এককালে ওটাই ছিল ওর ভাত আর রুটি। উমারাণী খুশিতে ডগমগ হয়ে উঠল,‘ আহাঃ কবে দেব গো? আমাদের জন্যও তাহলে আর রান্না করাব না তখন।’ হাসি চেপে কইলাম, বাপু হে নেস্টাম রাইসটা কিন্তু চিনি ছাড়া চটকানো দুধভাতের মত খেতে। হুঁ হুঁ বাবা আমি সব খেয়ে দেখেছি। এমনকি সেরেল্যাকও । মিষ্টি বটে তবে এমনকিছু আহামরি খেতে না। কেমন যেন সুগন্ধী দুধে চটকানো বাসি রুটির মত সোয়াদ। 


উমারাণী সন্দিগ্ধ স্বরে বলল, ‘সোনাই(তুত্তুরী) জানে তুমি ওর সব খাবার সাবাড় করতে?’ হেসে বললাম, ‘সে তো আজও। নিজে টেস্ট না করে আজ অবধি কিছু খেতে দিই না মেয়েকে। বা মেয়ের বাপকে।’ রহস্যময় সুরে বলল উমা,“ তাহলে তোমাকে বলা যায়, জানো তো আমি না ওষুধ গুলোও টেস্ট করে দেখি আগে।" শুনে কি যে নির্মল আনন্দ হল, আহা আমার মত তাহলে আরো কেউ আছে। মুখে অবশ্য বললাম,‘বেশ করিস। তোর ছানা। তুই চাইলে বাচ্ছার ইয়েও টেস্ট করে দেখতেই পারিস।’ উমা আবার বলল, ওয়াক থুঃ। ভালো কথা, থুড়ি ভালো মানুষের জমানাই নেই মাইরি।

অনির ডাইরি ৩১শে আগস্ট, ২০২২


 


লিখতে সামান্য ভয় লাগে আজকাল। যা লেখার জন্য নিসপিস্ করে হাত, ছটফট করে প্রাণ তা সবই তো সীমিত শব্দভাণ্ডারের মাধ্যমে বর্ণিত আমার ছাপোষা জীবনের তুচ্ছাতিতুচ্ছ কোন ঘটনা। যেমন ধরুন শ্রীমতী তুত্তুরীর স্কুলের পেরেন্টস্-টিচার মিটিং। দূরভাষ মারফৎ উক্ত মিটিং এর সন্দেশ যে রাতে এসে পৌঁছাল, শ্রীমতী তুত্তুরী নৈর্ব্যক্তিক ভাবে বললেন,‘ঐ মিটিং এ গিয়ে আর কি শুনবে? অমুক স্যার বলবেন এই, তমুক ম্যাম বলবেন ওই। আর সবাই সম্মিলিত ভাবে বলবে পুরোযার হাতের লেখা কি খারাপ!’ বললে অবশ্য খুব ভুল কিছু বলবেন না। দীর্ঘদিন পর অফলাইন পরীক্ষা দিতে গিয়ে তড়িঘড়ি লিখতে বসে শ্রীমতী তুত্তুরী যা লিখেছিলেন তা এক নজরে দেখলে মনে হবে খাতায় কালো বা নীল পিঁপড়ে ধরেছে। 


শ্রীমতী তুত্তুরীর বাক্যালাপ শুনে আমাদের ধারণা হল, এই পেরেন্টস্-টিচার মিটিং ব্যাপারটা তিনি মোটেই ভালো চোখে দেখছেন না। আমরাও যে দেখছি তা নয়। কারণ মহকুমা শাসক মহোদয় থোড়াই ঘোর আপিস টাইমে মেয়ের স্কুলে গিয়ে হাজিরা দেবে, ফলে যেতে হবে আমাকে। তুত্তুরীর স্কুলে আমি রোজ এমনিই একবার করে যাই, তাঁকে স্কুল থেকে আনতে। ব্যস্ততার কারণে অন্য কাউকে পাঠালে ভয়ানক অখুশি তথা দুখী হন তিনি। 


মুস্কিল হচ্ছে তুত্তুরীর ছুটির সময় বা সামান্য আগে পরে যদি এই মিটিং ডাকা হত, আমার যেতে কোন আপত্তি থাকত না। মিটিং ডাকা হয়েছে ছুটির পাক্কা এক ঘন্টা আগে। এত ক্ষণ ধরে কি কথা বলব আমি তুত্তুরীর টিচারদের সঙ্গে? আমার মেয়ে কেমন তৈরি হচ্ছে সে তো আমি এমনিই বুঝতে পারছি তাকে পড়াতে বসিয়ে। সকালে এক প্রস্থ ধুন্ধুমার হয় এবাড়িতে, বিকালে এক প্রস্থ। কাজেই শৌভিক আর আমি সমস্বরে বললাম, ‘তোর যখন এত আপত্তি তাহলে নাহয় আমরা যাব না ঐ মিটিং এ।’ আপিস ফেলে বারবার এমন যাওয়াটাও তো শোভন না। 


মুখের কথা শেষ হল না আমাদের, ভেসে এল শ্রীমতী তুত্তুরীর অভিমানী কণ্ঠস্বর, ‘এ আবার কেমন কথা! তোমাদের এত ব্যস্ততা যে তোমরা আমার পেরেন্টস্ টিচার মিটিং এ যেতে পারবে না?’ সাময়িক ভাবে গুলিয়ে গেল মাথা, এটা কে, আমার কন্যা না আমার শাশুড়ী মাতা। পাশ থেকে ভুল ধরিয়ে দিল শৌভিক, ‘তোর নয়, আমার শাশুড়ীর মত কথা বলছে ও।’ সত্যিই তো, ‘এত কিসের ব্যস্ততা যে মেয়েকে সময় দিতে পারবি না?’ মার্কা সেন্টু দেওয়া কথা তো এই পৃথিবীতে একজনই শোনান আমাদের। তিনি আমার গর্ভধারিণী বটে। 


মিটিং এর দিন বেলা দশটা নাগাদ অচেনা নম্বর থেকে ফোন। স্নানাহার সেরে আপিস যাবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছি দোঁহে, অন্যদিন এই সময় কোন ফোন এলে সাধারণতঃ ধরি না। চেনা নম্বর হলেও না। তড়িঘড়ির মধ্যে বিস্তারিত কথাবার্তা বলতে বসলে বড় দেরী হয়ে যায়। সেদিন কি মনে হল ধরেই ফেললাম ফোনটা। ফোনের ওপাশ থেকে শ্রীমতী তুত্তুরীর নার্ভাস কণ্ঠস্বর,‘হ্যালো মা!’ ধক্ করে উঠল বুকের ভিতরটা। তিনি তো ঘন্টা খানেক আগেই রওণা দিয়েছেন স্কুলের পথে। তাহলে? হঠাৎ ফোন করছে কেন? কি হল? শরীর-টরীর- আমাকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে ঠেট ইংরেজিতে বলে চলে তুত্তুরী, ‘আমি স্কুল থেকে বলছি। ম্যাম পাশেই দাঁড়িয়ে আছেন। চিন্তা কোর না। যা বলছি শোন, তুমি আমার ঘরে যাও, ড্রয়ারটা খোল দেখবে এক বাক্স রঙ  পেন্সিল আছে। ওটা একটু দিয়ে যাবে প্লিজ। খুব আরজেন্ট দরকার। আমি আনতে ভুলে গেছি। আর হ্যাঁ শোন, এনে কিন্তু স্কুল অথরিটিকেই দিও।’ 


শৌভিকের আপিস থেকে তুত্তুরীর স্কুলটা কাছে, তাকে অনুরোধ করলাম, তিনি যথারীতি উড়িয়েই দিলেন। ‘ফুঃ। ছাড় তো! খুব দরকার, তা সময় থাকতে ব্যাগে ঢোকায়নি কেন? কিচ্ছু করতে হবে না। যেমন গোভূতের মত গেছে, ওকে ভুগতে দে। লাগলে পাশের বন্ধুর থেকে চেয়ে নেবে। আমরাও তো তাই করেছি।’ বাবারা অমন বলে, বাবারা অমন বলতেই পারে, তাই বোধহয় বাবাকে চোখে হারালেও আজ আর বাবাকে ফোন করেনি তুত্তুরী। 


শৌভিকের অমৃতবাণী উপেক্ষা করে, ড্রয়ার খুলে রঙ পেন্সিলের বাক্স নিয়ে যখন পৌঁছলাম, বসে গেছে স্কুল। সিকিউরিটি ছেলেটাকে সনির্বন্ধ অনুরোধ করে ভিতরে ঢুকে, আপিস ঘরে বসে থাকা প্রৌঢ়ের হাতে রঙ পেন্সিলের বাক্স তুলে দিয়ে তবে শান্তি। আসার সময় তড়িঘড়ি তুত্তুরীর নাম আর ক্লাশ লিখেই দিয়েছিলাম বাক্সের গায়ে, বৃদ্ধ দেখলাম তা সত্ত্বেও বাক্সটাকে একটা সাদা খামে ভরল। ওপরে যত্ন  করে লিখল নাম, ক্লাশ, সেকশন। অতঃপর সসম্ভ্রমে আমায় বলল, ‘আপনি যেতে পারেন। আমরা দিয়ে দেব।’ বৃদ্ধের কণ্ঠস্বর শুনে ভরসা হল, এণাকে বোধহয় আবোলতাবোল  প্রশ্ন করা যায়। বেশ খানিকক্ষণ কান চুলকে জানতে চাইলাম,‘দাদা বলছি কি না, ঐ পেরন্টস্ মিটিং এ কি পাক্কা এক ঘন্টা থাকতে হবে?’ উনি অল্প হেসে বললেন,‘ আসেন না। যেমন আপনার সুবিধা। আড়াইটে-পৌনে তিনটে- আপনার ব্যাপার।’ 


তিনটে নাগাদ গিয়ে হাজির হলাম মেয়ের স্কুলে। বিরাট হল ঘরে জমায়েত হয়েছে গুটি কয়েক পিতামাতা। দেখে আশ্বস্ত হলাম আমার মত দায়িত্বজ্ঞানহীন পেরেন্টস্ আরোও কিছু আছে তা হলে। আমি যখন পৌঁছেছি, ভাইস প্রিন্সিপাল স্যার বক্তব্য রাখছিলেন, উনি বেশ বেদনার্ত স্বরেই বললেন,‘ আপনাদের এই অনপস্থিতির হার আমাদের কাছে বেশ বেদনাদায়ক। এই মুহূর্তে সবার অলক্ষে এক ভিন্ন ধরণের যুদ্ধ লড়ছি আমরা। দীর্ঘ দুই বৎসর প্রথাসিদ্ধ শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে দূরে থাকাটা যে আমাদের ছেলেমেয়েদের জন্য কতটা ক্ষতিকর, প্রতি মুহূর্তে তা অনুধাবন করে চলেছি আমরা। দীর্ঘ দুই বছর অফলাইন ক্লাশ না করাতে পেরে আমরাও কিছুটা অনভ্যস্ত, আউট অফ প্রাকটিশ হয়ে পড়েছি। সিস্টেমটাতেও লেগেছে জং। তবুও আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। যাচ্ছি শুধু আমাদের ছেলেমেয়েগুলোর মুখের দিকে তাকিয়ে। এমতবস্থায় আপনাদের সাহচর্য এবং সহযোগিতা যে আমাদের বড় প্রয়োজন।’

আজ পর্যন্ত কম পেরেন্টস্ মিটিং তো অ্যাটেন্ড করিনি, এত দরদ দিয়ে কথা বলতে কাউকে শিখিনি। বিশেষতঃ প্রিন্সিপাল গোত্রীয় কাউকে। প্রথমে ইংরেজিতে বলতে শুরু করলেও কখন যে নির্ভেজাল বাংলায় কথা বলতে শুরু করেছেন ভদ্রলোক কেউই খেয়াল করিনি। ওণার বক্তব্যের শেষে উনি উপস্থিত অপ্রতুল সংখ্যক পিতা/মাতাকে অনুরোধ করলেন যদি কারো কিছু বলার থাকে। 


জানলার বাইরে ঝেঁপে নামল বৃষ্টি। ঘড়িতে সাড়ে তিন। আর মিনিট দশ পরেই বাজবে ছুটির ঘন্টা। তারপর নাকি একে একে এসে হাজির হবেন শিক্ষক শিক্ষিকাদের দল। প্রায় সকলেই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন তাঁদের জন্য।  আসল কথাবার্তা, প্রশ্নাবলী, অভাব- অনুযোগ তাদের জন্যই জমিয়ে এনেছে শুনলাম সবাই। এখন চলছে নেহাৎ আলগা হাল্কা চালের কথা বার্তা, যেমন- বাংলাটা একদম পারছে না। হিন্দির উত্তর গুলো একটু লিখে দিলে ভালো হয় ইত্যাদি, প্রভৃতি।  ভাইস প্রিন্সিপ্যাল স্যার তখনও বলেই চলেছেন,‘ আর কেউ কিছু বলবেন? আপনি যে ভাষায় স্বচ্ছন্দ সেই ভাষাতেই বলুন, কিন্তু যদি কিছু বলার থাকে প্লিজ বলুন।’ আমার পাশের ভদ্রমহিলা দীর্ঘক্ষণ ধরেই উসখুস করছিলেন। এবার সাহস করে উঠেই পড়লেন, ‘স্যার মে আই-’।  উপস্থিত মায়েদের মধ্যে আমি ছাড়া কেবল ইনিই শাড়ি পরে এসেছেন। চোখের চশমা থেকে আলগা খোঁপা, গলার সরু সোনার চেন, পরণের সাদা হলুদ ছাপোষা তাঁতের শাড়ি এমনকি পায়ের চটি সবকিছুতেই  রুচি এবং পারিপাট্যের ছাপ। 


চড়া আলোর নীচে, মাইক্রোফোনর সামনে পৌঁছে কিঞ্চিৎ  থতমত খেলেন ভদ্রমহিলা। সবাইকে নমস্কার জানিয়ে একটু দম নিয়ে বললেন,‘ আমি বাংলাতেই বলি কেমন।’ জানালেন ওণার একটিই সন্তান, পুত্র। ওণার সমস্যা হল, ছেলেটি কিছুতেই স্কুলে আসতে চাইছে না। দুশ্চিন্তায় আদ্র মমতা মাখানো কণ্ঠে উনি বলে চলেন,‘ ছেলেটা স্কুলে আসতে ভীষণ ভালোবাসত জানেন। তবে সে সব লক ডাউনের আগের কথা। আজকাল স্কুল যেতে হবে বললেই ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে। পায়ে পড়ে যায়। আমি যে কি করি। আমি নিজে একজন শিক্ষিকা, অনেক বুঝিয়েছি ওকে, কিন্তু কোন লাভ হচ্ছে না। আজ এসেছে, আজ যেহেতু গিটার ক্লাশ আছে, তাই আজ মহানন্দে গিটার কাঁধে স্কুলে এসেছে। কিন্তু কাল যে কি হবে-।


 কেন আসতে চায় না জানতে চাইলে উদ্ভট যুক্তি দেয়। প্রথমে বলত, যাদের পাশে বসতে হয় তাদের সাথে বনছে না। আমি ক্লাশ টিচারকে বলে ওর সিট পাল্টে দিয়েছি, কিন্তু তাও-। আজকাল বলে স্কুলে বড্ড গরম। গায়ে হাওয়া লাগে না। যত বলি, গরম ঠিক আছে, কিন্তু এতগুলো বাচ্ছাও তো ঐ গরমেই পড়ছে, ওর মাথাতই ঢোকে না। ওর মাথায় কেবল ঢোকে মোবাইল আর গেমিং। আমি বেরিয়ে গেলে সারাদিন ঐ সব নিয়ে বসে থাকে। কাল স্কুলে আসেনি বলে রাগ করে আমি সব মোবাইল,ল্যাপটপ আলমারিতে ঢুকিয়ে চাবি দিয়ে গিয়েছিলাম। বাড়ি ফিরে কাজের মাসির কাছে শুনলাম, ও নাকি পাগলের মত সারাদিন চাবি খুঁজেছে। আলমারির দরজা ধরে টানাটানিও করে দেখেছে অসংখ্য বার। যদি খুলে যায়। এছেলে নিয়ে আমি কি করব, একটু হেল্প করুন না প্লিজ। আমি আর পারছি না।’ 


ভদ্রমহিলার অসহায় কণ্ঠস্বর ধাক্কা খাচ্ছে হলঘরের এ দেওয়াল থেকে ও দেওয়াল, দেওয়াল জোড়া বিশাল কালো বোর্ডে, যেখানে উজ্জ্বল সাদা রঙে লেখা বিগত কয়েক বছরে দশম এবং এবং দ্বাদশ শ্রেণীর সেরা পড়ুয়াদের নাম। ছুটির ঘন্টা পড়ে গেল, ধীরে ধীরে উঠে গেলেন কয়েকজন পিতা/মাতা। কয়েকজন আবার বাচ্ছার হাত ধরে ফিরেও এলেন। সকলেই ভদ্রমহিলাকে আশ্বস্ত করতে লাগলেন একযোগে। স্কুলে সদ্য নিযুক্ত কাউন্সেলরের সাথে কথা বলতে বললেন, কেউ বা মনোরোগ বিশেষজ্ঞের সাথে কথা বলার পরামর্শ দিলেন। উপস্থিত অন্য বাবা/মারাও সকলেই সহমর্মী হয়ে নানা পরামর্শ দিতে লাগলেন। 


দেরী হয়ে যাচ্ছে বলে উঠে পড়লাম আমি। শ্রীমতী তুত্তুরীর বেরোনোর সময় হয়ে গেছে। স্কুলের ফটক থেকে বেরিয়েই আমাকে দেখতে পেলে তাঁর মুখে যে অনাবিল হাসি ফুটে ওঠে তার দাম মিলিয়ন ডলারের থেকেও অনেক অনেক বেশী আমার কাছে। আজও তিনি হাসলেন, তারপর ভ্রু কুঁচকে জানতে চাইলেন মিটিংএ ছিলাম কি না। আমার ওপর আমার কন্যা এবং তাঁর পিতার যে কি অপরিসীম অনাস্থা তা প্রতি পদে অনুভব করি। মানুষ বলেই গণ্য করে না ব্যাটারা আমায়। তবুও হজম করে যাই। কারণ ঐ যে মা হওয়া কি মুখের কথা। 


তাই দেঁতো হেসে জানালাম, জী মহারাণী। অ্যাটেন্ড করেছি আপনার মিটিং। তবে মিটিং এখনও শেষ হয়নি। বরং বলা যায় সবে শুরু। ক্লাশ টিচাররা তো সদ্য এসে বসলেন। এখন চাইলেই কথা বলা যায় তাঁদের সাথে। এবার তুত্তুরী বলুক কি করব? কথা বলব কি? বারো বছরের কচি মাথায় কি সব হিসেব নিকেশ চলে বুঝি না, অতঃপর তিনি কিঞ্চিৎ  ঘাবড়ে যাওয়া গলায় জানতে চান,‘তুমি কি চাও?’ তুই কি চাস/তুমি কি চাও এর চাপানউতোর অন্তে মহানন্দে বাড়ি এবং অফিসের পথে পা বাড়াই আমরা। কারণ আমার মেয়ে কেমন তৈরি হয়েছে বা তার প্রাবল্য কোথায় আর দুর্বলতাই বা কোথায় বিশ্বাস করুন তা আমার থেকে ভালো কেউ বোঝে না। এটা তুত্তুরীও মেনে নিল। 


গাড়ির দরজা বন্ধ করে বললাম, চল হে উত্তমকুমার এটাকে নামিয়ে আপিস যাই। আর শ্রীমতী তুত্তুরী চোখ পাকিয়ে বললেন, ‘ মা, তোমাকে বলেছিলাম কালার পেন্সিল দিতে, তুমি ক্রেয়ন্স গুলো পাঠিয়েছ কেন?জানো আমার বন্ধুরা কত হাসছিল। এঃ হেঃ হেঃ তোর মা কিচ্ছু জানে না বলে-।  পরের বার হয়তো আই কার্ড দিতে বলব, তুমি পাঠাবে টাই।’ সত্যি বাপু, মা হওয়া মোটেই মুখের কথা না যা দেখছি।

তুত্তুরী উবাচ ২৯শে আগস্ট, ২০২২

 


👧🏻-(সকাল বেলা দুধের কাপ হাতে)বাবা

👨🏻-(মোবাইলে কাগজ পড়তে পড়তে অন্যমনস্ক ভাবে) উঁ। 

👧🏻-(ঢোঁক গিলে) আমাকে একটা গরু কিনে দাও। 

👨🏻-(প্রায় বিষম খেয়ে) অ্যাঁ? কিঃ?

👧🏻-হ্যাঁ বাবা, তুমি আমাকে একটা গরুই কিনে দাও। আমি আর লেখাপড়া করব না। গরু চরাব।

(আশানুরূপ প্রতিক্রিয়া না পেয়ে, কিঞ্চিৎ  বিমর্ষ ভাবে) জানো তো বাবা, আমি ভেবেছিলাম এই স্কুলটা খুব ভালো। কিন্তু-

👨🏻-খামোখা ভালো ভাবতে গেলি কেন?

👧🏻-(বাবার সাড়া পেয়ে প্রবল উৎসাহিত হয়ে)হ্যাঁ সেটাই তো ভুল হয়েছে। মোটেই ভালো নয় বাবা। রোজ ক্লাস টেস্ট নেয়। পরীক্ষার আগে একদিনও স্টাডি লিভ দেয় না। শুধু কি তাই, সেদিন কি দেখলাম জানো (গলা নামিয়ে ষড়যন্ত্রের সুরে) একটা ক্লাশ এইটের দিদি লাইব্রেরিতে গিয়ে এদিকওদিক তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল, ‘কোয়েশ্চন পেপার দেখব।’ আমরা তো তাজ্জব। লাইব্রেরি ম্যাম একবার আমাদের দিকে তাকালেন, তারপর চোখের ইশারা করলেন একটা তাকের দিকে। দিদিটা চুপচাপ ফাইলটা নিল, প্রশ্নগুলো দেখল,তারপর ফাইলটা রেখে দিয়ে চলে গেল। 

👨🏻👩🏻-(যুগলে অট্টহাস্য করতে করতে) ওরে ওগুলো পুরাণ পরীক্ষার প্রশ্ন।

অনির ডাইরি ১৯ শে আগস্ট, ২০২২

 

#তুত্তুরী_আর_ফুলঝুরির_গপ্প - ৩

আমাদের বাড়ির ছিরি কেষ্ট (অন্য কারো মুখ কল্পনাপটে ভেসে উঠলে, লেখিকা দায়ী নহে)। কারাগারে অবশ্য জন্মাননি, নগর কলিকাতার সবথেকে মূল্যবান হাসপাতালেই ভূমিষ্ঠ হয়েছিলেন শ্রীমতী ফুলঝুরি। আজ্ঞে হ্যাঁ, উনি শ্রীমান নন, শ্রীমতী বটেক। তাতে কি?  শ্রীকৃষ্ণ তো অখণ্ড প্রেমের আধার, ইনিও তাই। হোক না মেয়ে, শ্রীরাধিকার মত পরপুরুষে মন মজিয়ে, বিরহানলে দগ্ধে মরার থেকে পার্থসারথি শ্রীকৃষ্ণ হওয়া ঢের ভালো। অসি আর বাঁশি দুইয়েতেই সমান পারদর্শী হোক।  রাজা হয়ে সিংহাসনে বসার দরকার কি, রাজা হলে মুকুট পরার যাতনাটাও যে ভুগতে হবে, তার থেকে ওর অঙ্গুলিহেলনে তৈরি হউক রাজা। 


তো, আমাদের কেষ্ট বাবু ভূমিষ্ঠ হবার দিন দুয়েক আগেও শ্রীমতী উমারাণী হুমকি দিয়েছিল, ‘হলে তোমাদের দিয়ে দেব। তুমি আর দাদা মানুষ করবে।’ বেজায় হেসেছিলাম মেসেজ খানা পড়ে, যেন সত্যিই প্রাণে ধরে দিয়ে দিতে পারবে! আমার আশঙ্কা সত্যি প্রমাণ করে, শ্রীমতী উমারাণী আজকাল দিনরাত মেয়ের মুখের দিকেই তাকিয়ে থাকে। ফুলঝুরি কি রকম করে তাকাচ্ছে, ফুলঝুরি কিসে বিব্রত হচ্ছে, কি নিয়ে ফুলঝরি তীব্র আপত্তি জানাচ্ছে ইত্যাদি প্রভৃতি।  রোজ ঘুরে ফিরে মেসেজ করে উমা, ‘দিদিভাই, এমন সুন্দর সময়ের মধ্যে যাচ্ছি ওকে নিয়ে যে মনে হচ্ছে সময় বড় দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে, বড় হয়ে যাচ্ছে আমার ছোট্ট মেয়েটা দেখতে দেখতে। মাঝে মাঝে মনে হয় এরকম ছোট্টটি থাকলে বেশ হত।’


পড়ি আর হাসি, হাসি নিজের নির্বুদ্ধিতার কথা ভেবে। ঠিক এমন চিন্তা আসত আমারও মাথায়। শ্রীমতী তুত্তুরী যখন মাত্র চার মাস বয়স, ওকে আমার মায়ের জিম্মায় রেখে যোগ দিতে হয়েছিল চাকরীতে। অফিস সেই খড়্গপুর। আবাস বলতে মাদপুর নামক অজ গাঁয়ের বিডিও কোয়ার্টর।ইচ্ছে থাকলেও শ্রীমতী তুত্তরীকে নিয়ে যাওয়ার উপায় ছিল না। আমাদের আপিস টাইমে মেয়েকে সামলাবে এমন বিশ্বস্ত তথা পরিচ্ছন্ন লোক পেলাম কোথায়। সবথেকে বড় কথা কেয়ার্টারটা ছিল চতুর্দিকে ধান জমি আর জলা জমি দিয়ে ঘেরা। আমরা যে নেহাৎ ভাড়াটে তা প্রতিপদে বুঝিয়ে দিত বাড়ির মালিক ওরফে টিকটিকি, আরশোলা, গুচ্ছ গুচ্ছ পোকা আর ধেড়ে ইঁদুরের দল। তাই সাহস করে মেয়েকে আর আনতে পারিনি।  বদলির আবেদন করে একাকি ফিরে গেলাম খড়্গপুর। কখনও যাতায়াত করে নিতাম, কখনও থাকতে বাধ্য হতাম। যাই করি না কেন প্রতি রাতে শৌভিকের বুকে মাথা রেখে ডাক ছেড়ে কাঁদতাম,আর বলতাম, ‘কি তাড়াতাড়ি বড় হয়ে যাচ্ছে ও, এইভাবে দেখতে দেখতে ওর ৩০বছর বয়স হয়ে যাবে, বিয়ে করে শ্বশুরবাড়ি চলে যাবে। আমার মেয়েকে আমি আর কাছে পাব না।’ 


সেটা ২০১১সাল, রাজনৈতিক পালাবদলের সময়, বিডিওদের ওপর উত্তাল চাপ, তারই মধ্যে আমার কান্নাকাটি গুলো ছিল আমার বরের একমাত্র বিনোদন। আমার আজগুবি কথাবার্তা আর হুহু করে কান্না দেখে হেসে অস্থির হত শৌভিক। বাবাদের যে ভেঙে পড়লে চলে না। 


একই পথের পথিক বলেই উমারাণীর মনের অবস্থা তাই আমার থেকে ভালো কে বোঝে! অতীত খুলে বসলেই উমারাণী বলে, ‘বিয়েই দেব না দুটোর। আমাদের কাছে থাকবে। ও দিদিভাই এদের বিয়ে হয়ে চলে গেলে আমরা বাঁচব কি নিয়ে গো?’ ওর ইনিংস সবে শুরু, এসব চিন্তা আসা খুব সাধারণ। এই পথে বেশ খানিকটা হেঁটে এসে আজ আমি জানি কি নিয়ে বাঁচব, বাঁচব এইসব অমূল্য মুহূর্তের স্মৃতিগুলো নিয়ে, বাঁচব ওদের গরবে গরবিনী হয়ে, ওদের প্রেমে আকণ্ঠ নিমজ্জিত হয়ে, ওদের সাথে পড়ে, ওদের সাথে উঠে, ওদের গায়ের গন্ধ মেখে। ঠিক যেমন ভাবে শত সহস্র বছর আগে বেঁচেছিল দেবকী আর যশোদা মা, মায়েদের যে বেঁচে থাকতেই হয়।

শুভ জন্মাষ্টমী 🙏🏼🙏🏼


অনির ডাইরি ১২ই আগস্ট, ২০২২

 



#তাম্রলিপ্তকড়চা 


'ম্যাডাম যাবেননি?' তাগাদা দেয় উত্তমকুমার। এমন দিনে আপিস ছেড়ে যেতে একটুও ইচ্ছে করছে না। কিন্তু যেতেই হবে। লাটসাহেবকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছি যে। লাটসহেব নামটা আমারই দেওয়া।  প্রতিদিন সবার শেষে হাঁপাতে হাঁপাতে আপিস ঢোকেন লাটসাহেব। এবং যতক্ষণ না তিনি এসে পৌঁছান, হাজিরা খাতাটি এসে পৌঁছায় না আমার কাছে। পাছে ছোকরাকে লাল দাগ দিই, কোন না কোন অছিলায় খাতাটা লুকিয়ে রাখেন আমাদের হক বাবু। 


অবশ্য একথা অনস্বীকার্য যে ছেলেটা লেট লতিফ হলেও ফাঁকিবাজ নয়। বরং কাজের ক্ষেত্রে এক্কেবারে যাকে বলে রত্ন বিশেষ। কাজে কোন আপত্তি নেই ছেলেটার, উৎসাহ এবং উদ্দীপনাও প্রচুর।  প্রয়োজনে গভীর রাত পর্যন্ত জেগেও কাজD তুলে দেয়। লাটসাহেব বলেন তাতেই নাকি তাঁর সুবিধা।  কম্পুটার, প্রোগ্রামিং ইত্যাদি নিয়ে গভীর জ্ঞান ছেলেটার। আঞ্চলিক শ্রম দপ্তর তাম্রলিপ্তর জন্য  একখানা নিজস্ব ওয়েবসাইটই বানিয়ে ফেলেছে ছেলেটা। আমাদের লাটসাহেবের কল্যাণে আপিসের প্রয়োজনীয় তথ্যাদি, হিসেবনিকেশের ফর্মূলা কেবল একটা মাউস ক্লিকের দূরত্বে। 


 এহেন লাটসাহেবকে আমি একদিন প্রশ্ন করেছিলাম, রোজ এত দেরী কেন করিস বাবা? জবাবে জানতে পারি, সকাল সকাল কোন কোচিংR সেন্টারে পড়াতে যায় ছেলেটা। সেখান থেকে ফিরে চটজলদি স্নানাহার সেরে আপিস ঢুকতে একটু বিলম্ব হয় আর কি। ওদের ক্যাডারের বেতনের যা হাল, আর মূল্যবৃদ্ধি যে হারে উর্দ্ধগামী , আমার আপিসের কাজ গুছিয়ে কেউ যদি আপিসটাইমের আগে পরে দুটি ছাত্র পড়ায়, আমার তাতে কোন আপত্তি নেই। 


 ছেলেটির মুখে বিশদে শুনেছিলাম ওদের কোচিং সেন্টারের গল্প। মূলতঃ কম্পিউটার পড়ায় এবং শেখায় ওরা। নবম থেকে দ্বাদশের ছাত্রছাত্রীই বেশি। কিছু অষ্টম শ্রেণীর পুঁচকেও অবশ্য আছে। যেমন আছে কিছু কলেজের ছাত্রছাত্রী। পড়ানোটা যে ছেলেটার কাছে নিছক জীবিকা-নির্বাহ নয়, তা ওর কথা শুনেই বোঝা যায়। পড়াতে ভালোবাসেK ছেলেটা, শেখাতেও।  এমনকি মাঝে মধ্যেই সুযোগ পেলে উপযাচক হয়ে আমাকে নানা জ্ঞান দেয় লাটসহেব । নেহাৎ আমি ছাত্রী হিসেবে একেবারেই অগাকান্ত অকর্মণ্য।  


তো এহেন লাটসাহেব কিছুদিন আগে ভীতু ভীতু স্বরে অনুরোধ করে ,‘ম্যাডাম আমাদের কোচিং সেন্টারে বাৎসরিক রাখিবন্ধন অনুষ্ঠান হবে। আপনি যাবেন?’ লাটসাহেব তো আর সত্যি সত্যি অনুরোধ করেন না, আব্দার করেন। তা তিনি যে দিন এবং যে ক্ষণের উল্লেখ করেছিলেন, আপিসের ডাইরি অনুযায়ী তখনও পর্যন্ত তা ঢাকা পড়েনি কোন মিটিংমিছিলে। ফলতঃ মৌখিক সম্মতি দিয়েছিলাম। শুধু যে লাটসাহেব আমন্ত্রণ জানিয়েছিল তা নয়, উক্ত কোচিং সেন্টারের মুখ্য আহ্বায়ক স্বয়ং এসে জানিয়ে গিয়েছিলেন, অন্যান্য মান্যগণ্য  অতিথি সমাবেশের মাঝে মুখ্য অতিথি হিসেবে ওণারা আমাকেই যাচ্ঞা করেন। 


 আহ্বায়ক মহোদয় পরে আবার একবার এসেছিলেন, এবার একাকী নয় একঝাঁক “নূতন যৌবনের দূত” এবং দূতীসহ। ‘ওরা আপনাকে নিমন্ত্রণ জানাতে এসেছে ম্যাডাম।’ লাজুক অথচ গর্বিত স্বরে জানিয়ে ছিল লাটসাহেব। এই তো সেদিনের কথা, সবাই মিলে কার্ড দিয়ে গেল, ছবি তুলে গেল। এত কিছুর পর যাওয়াটাই তো শিষ্টাচার। বাধ্যতামূলক ও বটে।  


মুস্কিল হল প্রতিশ্রুতি দেবার সময় খেয়াল করিনি, দিনটা যে স্বাধীনতা দিবসের আগের শেষ কর্মদিবস। স্বাধীন ভারতের জন্মদিন উপলক্ষে এখানে কিছু হবে না? আপিস সাজাব না আমরা? তৎকালীন চুঁচুড়া আপিসটার তো ভোলই পাল্টে যেত এইদিনগুলোতে।  তেরঙা বেলুন আর কাগজের ত্রিকোণ তেরঙা পতাকায় মুড়ে দেওয়া হত বুড়ো কালেক্টরেটের ছোট্ট লেবার অফিস আর তার সামনের বারন্দাটাকে। চন্দননগরের বড়সাহেব থেকে শুরু করে এসএলওরা পর্যন্ত সকলের বুকে আটকানো হত তেরঙা ব্যাজ।  সম্মিলিত ভাবে গাওয়া হত জাতীয় সঙ্গীত। উদাত্ত গলায় দেশাত্মবোধক গান ধরত ধনিয়াখালির ইন্সপেক্টর চঞ্চল। গলা মেলাত আরএলও ইন্সপেক্টর কৌশিক। সবার শেষে গান ধরত ধনিয়াখালির SLO অমৃতা। মুহূর্তগুলো হারিয়ে গেছে বটে, রয়ে গেছে স্মৃতিগুলো। কে যেন সেদিন কটূক্তি করেছে শুনলাম, ’আগের চুঁচুড়া আপিসটা নাকি কেবল ছবি তোলার আপিস ছিল’ বলে। ভাগ্যে তাই ছিল, তাই না ফেসবুক জুড়ে জ্বলজ্বল করে সেইসব সোনালী মুহূর্ত গুলো। 


কেবল মাত্র জহরবাবু ছাড়া এখানে গানবাজনায় কারো তেমন উৎসাহ না থাকলেও, আপিস সাজানোয় দেখলাম সবার তীব্র উৎসাহ। পুরসভার ইন্সপেক্টর বেদজ্যোতি তো অত্যুৎসাহী হয়ে তেরঙা বেলুনের গেট বানানোর আব্দার জুড়ে ছিল। অতি কষ্টে নিরস্ত করা হল তাকে। 


 আমার ফরমাইশ মত বেলুন আর পতাকা কিনে আনল অরূপ। জসুয়ার ফরমাইশ মত তাদের সাথে যুক্ত হল তেরঙা রিবন। 


শুক্রবার দিন আপিসে বিভিন্ন ট্রেড ইউনিয়নের প্রতিনিধি আর পরিবহন শ্রমিকদের ভিড় লেগে থাকে। আরএলও ইন্সপেক্টর সৌরভ আর শহীদ মাতঙ্গিনী ব্লকের সিকেসিও নন্দন অন্যদিন দম ফেলার ফুরসৎ পায় না। আজও ওদের ব্যস্ততা চরম, তারই মাঝে আজ অপরাহ্নে শুরু হয়েছে বেলুন ফোলানো,পতাকা টাঙানোর কাজ। কাজ মিটে গেলেও ফিরে যাচ্ছে না আগত  অতিথিদের দল। সবাই সমবেত হয়ে বেলুন ফোলানো, পতাকা ঝোলানো, রিবন লাগানো দেখছেন। বিশেষজ্ঞ মতামত দিচ্ছেন। 


এমন দিনে, এমন আপিস ছেড়ে যেতে কার মন চায়? পাছে আমি আপিস ছেড়ে না নড়ি, তাই শুধু উত্তমকুমারের ভরসায় না থেকে ফোন করে নিজেই তাগাদা দেয় লাটসাহেব, ‘বেশীক্ষণ আটকাবনি ম্যাডাম। আপনি আসবেন, ছেলেমেয়েগুলোকে উৎসাহব্যঞ্জক দু-চারটে কথা বলবেন, ব্যাস।’ উৎসাহের মোড়কে জ্ঞান দিতে অবশ্যি আমার বরাবরই দারুণ লাগে। 


 নির্দিষ্ট সময়ের মিনিট পনেরো পরে পৌঁছে দেখি ব্যস্ত রাজপথের এক প্রান্তে ছোট্ট ম্যারাপ বেঁধে সাজানো হয়েছে মঞ্চ। পাতা হয়েছে আসন। গলায় মোটা পুষ্পহার নিয়ে পাশাপাশি বসেছেন রবীন্দ্র-নজরুল। পাশে বিনম্র ভাবে দাঁড়িয়ে টলটলে তেল ভর্তি লম্বা পিতলের পঞ্চপ্রদীপ। শতরঙী প্রজাপতির মত উড়ে বেড়াচ্ছে শাড়ি পরা পুঁচকি সুন্দরীদের দল। পুরসভার ভাইস চেয়ারম্যান ম্যাডাম এসে গেছেন আমার আগেই। এসে গেছেন স্থানীয় মহাবিদ্যালয়ের মহাধ্যক্ষ  মহোদয়, স্থানীয় কাউন্সিলর, এসপি সাহেবের প্রতিনিধি। পুরসভার চেয়ারম্যান সাহেব এসে পৌছাবেন যে কোন মুহূর্তে। 


অতঃপর এত সাড়ম্বর রাখি উৎসবে যা হয় আর কি,  'মাত্র পনেরো মিনিটে ছেড়ে দুব ম্যাডাম' বলে জনে জনে প্রতিশ্রুতি দিলেও ছাড় পেতে পেতে প্রায় ঘন্টার কাঁটা গড়িয়ে যায়। 


কপালে চন্দনের টপ্পা, হাতে ভারী ফুলের রাখি, গলায় উত্তরীয় নিয়ে যখন উত্তমকুমারের গাড়িতে উঠলাম, বেলা গড়িয়ে গেছে। দূরের লোকজনের ঘরে ফেরার সময় সমাগত। সামনে তিনদিনের লম্বা সপ্তাহান্ত। একে তো ফুরফুরে ছুটির মেজাজ তার ওপর আমি নেই, আর থোড়াই কেউ আপিসে বসে থাকবে আজ। অবশ্য যাবার আগে বলে যায় সবকটা। মুঠোফোন খুলে দেখি বাস্তবিকই দুটি মিসড্ কল। প্রথমজনকে ফোন করতেই, লাজুক আব্দার, ‘বাড়ি যাব ম্যাডাম?’ বেপোট গরম পরেছে আজ, ঘন্টাখানেকের রাখি উৎসবে প্রায় তিন লিটার ঘেমে ক্লান্ত হয়ে নিজেরই বাড়ি ফেরার ইচ্ছা দুর্দম, আমি আবার অন্যকে আটকাব! বললাম জলদি পালাও। আমিও ভাবছি আর আপিসে ঢুকব না। গাড়ি চালাতে চালাতে উত্তমকুমার বলে,‘হায় ম্যাডাম, অফিসে ঢুকবেননি? ওরা যে এত কষ্ট করে অফিস সাজালো গো?’ 


বলতে না বলতেই সঞ্জয়ের ফোন,সঞ্জয় আপাততঃ  আমার সবথেক সিনিয়র ইন্সপেক্টর। আগেও একবার করেছিল দেখলাম সঞ্জয়,  ‘ম্যাডাম, আমাদের অফিস সাজানো তো কমপ্লিট। আপনি কতদূর?’ ঘড়ি বলছে আপিসের সময় প্রায় শেষ। বলতে গেলাম, বাড়ি যাও, স্বাধীনতা দিবসের আগাম শুভেচ্ছা, উল্টে সঞ্জয় বলল,‘আমরা বসে আছি। ছবি টবি তোলা হবে তো নাকি?’ এরপর আর বাড়ি ফিরি কি করে? উত্তমকুমারকে বললাম,‘চালাও পানসি’। ঘাড় ঘুরিয়ে উত্তমকুমার বলল,‘ আজ্ঞে!’ বললাম, আরেঃ আপিসে চল রে ভাই লোকজন বসে আছে। 


আপিসে ঢুকে দেখি, সৌরভ-সন্দীপ আর নন্দন তখনও পেনশনের কেসের গোছা নিয়ে লড়ে গেলেও বাকি সবাই মুখ-টুক মুছে,চুল-টুল আঁচড়ে প্রস্তুত। জহর বাবু তিনছড়া তেরঙা রিবনের হার পরে বসে আছেন ছবি তোলা হবে বলে। অরূপ, আশিস, জসুয়া, সৌমেন, চঞ্চল বাদানুবাদে মত্ত কোথায় তুললে বেশী বেলুন চোখে পড়বে, কোথায় আলো বেশী। কি ভাবে তোলা হবে,সবাই দাঁড়িয়ে নাকি কিছু দাঁড়িয়ে কিছু বসে, তাহলে কারা দাঁড়াবে, কারাই বা বসবে ইত্যাদি প্রভৃতি। ঘামে ভেজা, তেলতেলে পাঁপড় ভাজার মত মুখের ওপর আঁচল ঘষতে ঘষতে  বিড়বিড় করে বললাম, তোমাদের কপালেও বদনাম নাচছে বাপু। আমায় যেতে দাও, ঠিক কেউ না কেউ বলবে, 'এটা তো ছবি তোলার আপিস ছিল।' সে বলুক, আপাততঃ আমরা ছবিগুলো তো তুলি। ভাগ্যে মুঠো ফোন এসেছিল, ছবি তোলা এত সুলভ হয়েছিল। নাহলে এমন কত মুহূর্ত যে নিছক হারিয়েই যেত সময়ের অভিঘাতে, স্মৃতির যাদুঘরে-