Sunday 10 April 2022

অনির ডাইরি, ৩১শে মার্চ, ২০২২

 

পট্টনায়ক কাকুকে বললাম, ‘আপনাকে তো মিউজিয়ামে সংরক্ষণ করতে হয়।’ মহানগরের বুকের ওপর তখন নামছে বাসন্তী সন্ধ্যা। নিউটাউন যাবার রাস্তার ধারে, এক সস্তা চায়ের দোকানের সামনে পেতে রাখা জীর্ণ কাঠের বেঞ্চিতে বসে চা খাচ্ছি আমরা। পট্টনায়ক কাকু আর আমি। দুজনেই ভয়ানক ‘চাতাল’। চা’টা এই মুহূর্তে আমার কাছে শুধু চা নয়, খাদ্যও বটে। আপিস টাইমের ভাত খেয়ে, অর্ধেক আপিস করে বেরিয়েছি তমলুক ছেড়ে। দিন দুয়েক ধরে এটাই আমার নৈমিত্তিক রুটিন। আগের দিন টি জাংশানের কফি খেয়েছিলাম দুজনে, পছন্দ হয়নি পট্টনায়ক কাকুর, তাই আজ ওণার মনপসন্দ মাটির ভাঁড়ে জিভ পোড়ানো চা, সাথে দুটো কড়কড়ে সুজির বিস্কুট। সামনের ব্রিজ থেকে ঝুঁকে পড়া কি যেন এক অচেনা লতার পাতার ফাঁকে লুকোচুরি খেলা সূর্যের দিকে তাকিয়ে, তপ্ত মাটির ভাঁড়ে একটা লম্বা চুমুক মেরে ভ্রু কুঁচকে বাজখাঁই গলায় জানতে চাইলেন, পট্টনায়ক কাকু, ‘কেন?’ 


‘কেন’ আবার কি? এমন মানুষ আজকালকার দিনে খুঁজে পাওয়া যায় নাকি? ভদ্রলোক পেশায় ছিলেন ডিভিসির ইঞ্জিনিয়ার আর সম্পর্কে আমাদের প্রতিবেশী। একমাত্র সন্তান সাবলম্বী হয়ে যেতেই দুম করে একদিন চাকরিটা ছেড়ে দেন পট্টনায়ক কাকু। আজকাল মর্নিং ওয়াক করেন হনহনিয়ে, বাজারওয়ালার সাথে সামান্য দরাদরির পর জমিয়ে করেন খোশগল্প, বাজার নিয়ে ফেরার পথে চায়ের দোকানের ঠেকে আরেক প্রস্থ আড্ডা মেরে বাড়ি ফিরে কম্পুটার নিয়ে বসেন জনসেবায়। আবাসনে যত নিঃসহায় বৃদ্ধ-বৃদ্ধা আছেন, যাদের কৃতি সন্তানেরা কেউ বিদেশে কেউ বা ভিনরাজ্যের গর্বিত নিবাসী, তাঁদের যাবতীয় ট্যাক্স-ইলেকট্রিক বিল-ফোন-টাটাস্কাই রিচার্জ করে দেন। এমনকি ডিসকাউন্টে ওষুধপত্রও আনিয়ে দেন বিভিন্ন ওয়েবসাইট থেকে। সন্ধ্যে বেলা কাকিমার সঙ্গে বেরোন একদফা রোমান্টিক ওয়াকে। আবাসনের সামনের চায়ের দোকান থেকে মাটির ভাঁড়ে চা খেতে খেতে সারেন প্রেমালাপ, এটা অবশ্যি আমিই বলি কেবল। ওণারা বলেন, ওগুলো নাকি মধ্যবিত্তের তেল-নুন-লকড়ির গল্প। দিনের শেষে পট্টনায়ক কাকু ঢুঁ মারেন আমার শ্বশুর তথা ওণার ভটচায সাহেবের কাছে। বিভিন্ন বিষয়ে তাত্ত্বিক আলোচনা সেরে, এক কাপ চা বা ক্ষেত্র বিশেষে এক পেয়ালা ইয়েতে তুফান তুলে শুভরাত্রি। 


৭ই মার্চ কাক ভোরে যখন আচমকা নেতিয়ে পড়লেন শাশুড়ি মা, আমাদের ঘুম ভাঙানোর আগে, প্রথম ফোনটা শ্বশুরমশাই করেছিলেন পট্টনায়ককাকুকে। আমরা ছিলাম দুই নম্বরে। তমলুক থেকে যখন ছুটতে ছুটতে গিয়ে আমরা পৌঁছালাম,দেখি বৃদ্ধ শ্বশুরমশাইকে হাত ধরে হাসপাতাল থেকে বাইরে নিয়ে আসছেন পট্টনায়ক কাকু। শাশুড়িমাকে ততক্ষণে এমারজেন্সি থেকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে ICU। প্রিয়তমা স্ত্রীর আচমকা অসুস্থতায় যৎপরনাস্তি ঘাবড়ে গেছেন বৃদ্ধ। আমাদের অবর্তমানে তাঁকে সাহস তথা বুদ্ধি দিয়ে, হেল্থস্কিম, আধারকার্ড ইত্যাদি যাবতীয় কাগজপত্র গুছিয়ে, অ্যাম্বুলেন্স ডেকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলেন ঐ পট্টনায়ক কাকুই। এমন মানুষকে যদি না মিউজিয়ামে রাখা হয়, রাখা হবে কাকে?


গল্প তো এখানে শেষ না। শুরু বলতেই পারেন। বৃদ্ধার হিমোগ্লোবিন নেমেছিল ২.৯ এ। সে যাত্রা তাঁকে মোটামুটি সুস্থ করে বাড়ি এনে, ২৪ঘন্টার দেখাশোনার লোক রেখে, পরিস্থিতি কিছুটা সামলে দিন দশেক পর, আমরা গেলাম সিমলিপাল। একদিনের সিএল আর আরেকদিনের স্টেশন লিভের অনুমতি সম্বল করে। জঙ্গলে ঢোকার আগে উভয়ের এক জোড়া বৃদ্ধ-বৃদ্ধাকে পইপই করে বলে গেলাম আমরা, মাত্র ৪৮টি ঘন্টা পরিষেবা সীমার বাইরে থাকব আমরা। সবাই যেন খুব সাবধানে থাকে এই সময়টা। তারপর তো আমরা আসছিই। 

পথশ্রমের ক্লান্তি, জঙ্গুলে গা ছমছমে নির্জনতা, ক্যাম্পের বাইরে লেপার্ড আসার গল্প, সুস্বাদু দিশী মুরগির ঝোল কিছুতেই আমার ঘুমটা জমল না সিমলিপালে। প্রথম রাতে স্বপ্ন দেখলাম, খুব খারাপ অর্থনৈতিক অবস্থায় পড়েছি আমরা। বাবা অবসর নিয়েছে, মায়ের রিটায়ারমেন্ট সামনেই, সংসার চলবে না। আমায় একটা ৬০৩৬টাকার চাকরি জোগাড় করতেই হবে। সকালে স্বপন বৃত্তান্ত শুনে শৌভিকের সেকি হাসি। ৬০৩৬ই কেন? কারণ ওটাই যে ছিল আমার প্রথম বেতন। রাইটার্সে লোয়ার ডিভিশন ক্লার্ক হয়ে ঢুকে পাওয়া প্রথম মাইনে। কড়কড়ে নতুন টাকায়। 


দ্বিতীয় রাতে স্বপ্ন দেখলাম, পলেস্তারা খসে পড়ছে আমাদের বাড়ির, যত্রতত্র গজিয়ে ওঠা আগাছা গুলো রূপান্তরিত হয়েছে মহীরুহে। ইঁট বার করা সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠতে গিয়ে আটকে গেছে আমার পা। নীচে থেকে বেদম চিৎকার করছে বাবা,মা আর পিসি আমায় উঠতেই হবে দোতলায়। কিন্তু পারছি না। ঘুম ভেঙেও কাটছিল না আতঙ্ক। রবিবার মধ্যাহ্নে জঙ্গল ছেড়ে বেরিয়ে টাওয়ার পেতেই যে যার বাড়িতে ফোন লাগালাম আমরা। ফোন পেয়ে বাবার সে কি উল্লাস,‘হ্যালো! আমরা খুউব ভালো আছি-’। ফোন ছাড়াও দিব্যি শোনা যেত। মা যদিও মিনমিনে স্বরে বলল,‘আর যাস না।’ নিশ্চিন্ত হয়ে ফোন রেখে দেখি পাশে শুকনো মুখে বসে আছে শৌভিক। 


কি হল? জবাব এল শ্বশুরমশাইয়ের ফোন বন্ধ আর ল্যান্ড ফোন বেজে গেল। বৃদ্ধ আবার ফোন বন্ধ রেখেছে কেন? কি জ্বালা। চার্জে বসাতে ভুলে গেছে নির্ঘাত। দীর্ঘশ্বাস ফেলে শৌভিক বলল,‘একটু পরে দেখছি।’ আমার তর সইলে তো। আবার করলাম। আবারও। তিনবারের বার ল্যান্ডফোনটা তুললেন শাশুড়ি মা। শৌভিক কেড়েই নিল প্রায় ফোনটা, অতঃপর,‘বাবার ফোনটা বন্ধ কেন? সে কি গো, বাবা হাসপাতালে?’


শ্বাসকষ্ট জনিত কারণে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছে শ্বশুরমশাইকে। আর কে নিয়ে গেছেন বলুন তো? অবশ্যই পট্টনায়ক কাকু। অর্থবর্ষের শেষে আপিস ফেলে মহানগরে এসে থাকা অসম্ভব, তাই যাতায়াতই ভরসা। বড়সাহেবের অনুমতি নিয়ে দেড়টায় তমলুক ছেড়ে বেরিয়েছি আমি, ডাক্তার আসবে তিনটে নাগাদ। আগে আউটডোর পেশেন্ট দেখে তারপর কথা বলবেন ইনডোর পেশেন্টের বাড়ির লোকের সাথে। সাড়ে তিনটের মধ্যে পৌঁছালেই হল। আমাদের উত্তমকুমার যেভাবে গাড়ি চালায়, আরেকটু আগেই পৌঁছে যাব আমি। সে কথা ফোনে জানালামও পট্টনায়ক কাকুকে, উনি বললেন,‘ তাড়া কি? আস্তে সুস্থে এস। আমি তো যাবই।’ 


ডাক্তারের সাথে কথা হবার পরও বেশ খানিকক্ষণ বসতে হয়, ভিজিটং আওয়ারে বৃদ্ধকে দেখে, তাঁর অসুস্থ প্রিয়াকে তাঁর কুশল সংবাদ দিয়ে বাড়ি ফিরব। সেই ফাঁকেই আগের দিন কফি খেয়েছিলাম আমরা। আজ চায়ের পালা। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতেই খোশগল্প হচ্ছিল। পট্টনায়ক কাকুকে বললাম, ওণার মত মানুষকে মিউজিয়ামে সংরক্ষণ করা উচিত। উনি উল্টে আমায় বললেন, কেন?‘ এটাই কি স্বাভাবিক নয়?’ মানুষ তো মানুষেরই জন্য। প্রতিবেশী হয়ে প্রতিবেশীর দুর্দিনে এইটুকু করব না? মাথা নেড়ে বললাম,। ‘স্বাভাবিকই তো। ঘোরতর স্বাভাবিক। তবে ছিল। সেই শরৎচন্দ্রের ইন্দ্রনাথ বা লালুর জমানায়। আজ এমন একটা লোক আপনি আমায় খুঁজে দেখান তো মশাই? আপনাকে সত্যিই জাদুঘরে নিয়ে গিয়ে সংরক্ষণ করা উচিত।

Friday 8 April 2022

অনির সিমলিপালের ডাইরি ২৫-২ ৭শে মার্চ, ২০২২

 অনির সিমলিপালের ডাইরি ২৫শে মার্চ, ২০২২

(প্রথম পর্ব) 


পরিকল্পনা তো ছিল ভোর রাতে বের হবার। তমলুক থেকে বাংড়িপোশি, বাংড়িপোশি থেকে যোশিপুর। যোশিপুরে পৌঁছে করাতে হবে জঙ্গলে প্রবেশের পারমিট। তুলতে হবে গাইড নিহার বাবুকে, অতঃপর শুরু হবে আমাদের দুদিনের বনবাস। যতদূর শুনেছি সিমলিপাল অরণ্যে প্রবেশের মূখ্য প্রবেশদ্বার দুটি, পিঠাবাটা (নাকি পিথাবাটা) গেট আর যোশীপুরের রামতীর্থ গেট। বারিপদার কাছে পিঠাবাটা গেটটিই অধিক জনপ্রিয়, তুলনায় কাছাকছিও। অধিকাংশ পর্যটক ও পথেই প্রবেশ এবং প্রস্থান করেন। আমাদের ট্যুর প্লানার ওরফে তমলুকের মহকুমা বিপর্যয় মোকাবিলা আধিকারিক আগেই নাকচ করে দিয়েছেন সেই প্ল্যান। আমরা বাংড়িপোশি হয়ে যোশিপুর দিয়ে ঢুকব এবং পিঠাবাটা দিয়ে বেরোব। 


আমাদের ট্যুর প্ল্যানার প্রথমেই সচেতন করে দিয়েছেন, ‘দমবন্ধ-করা জঙ্গল দেখতে পাবেন, কিন্তু জন্তুজানোয়ার দেখতে পাবার কোন প্রতিশ্রুতি বা দাবী আমি করব না।’ বিভিন্ন ট্যুরিস্ট ব্লগেও দেখলাম অনেকেই বেশ ক্ষুব্ধ, নামেই টাইগার রিজার্ভ অথচ বাঘ দেখতে পাওয়া লটারি জেতার থেকেও দুষ্কর।স্মরণাতীত কালে কেউ দেখেছে বলেও দাবী করেনি। আমরা বাঘ দেখতে চাইছিও না, আমরা শুধু দুদণ্ড একটু প্রাণ ভরে শ্বাস নিতে চাইছি। পড়ে দেখলাম অধিকাংশ পর্যটকই ঝটিকা সফরে গেছেন, ভোর ভোর পিঠাবাটা দিয়ে প্রবেশ করে সারাদিন ঘুরে, সন্ধ্যা নামার মুখে বেরিয়ে এসেছেন।আমাদের ট্যুর প্ল্যানার জানালেন,‘ওভাবে সিমলিপালকে চিনতে বা অনুভব করতে পারবেন না স্যার। সিমলিপাল বড় লাজুক, জঙ্গলে না থাকলে,এ জঙ্গল আপনার সামনে স্বমহিমায় কখনই ধরা দেবে না।’ 


উদ্দীপিত হয়ে,এক নয় দুরাতের জন্য জঙ্গলে থাকবার মনোবাসনা নিয়ে চলেছি আমরা। জঙ্গলের বাইরে লুলুং নদীর ধারে গড়ে ওঠা শৌখিন তথা গলা কাটা প্রমোদ কুটির নয়, আমরা থাকব গভীর জঙ্গলের মধ্যে বন দপ্তরের নিজস্ব নেচার ক্যাম্পে। অনলাইন বুক করাতে গেলেই পাবেন সতর্কবাণী, জঙ্গলের মধ্যে তিনটি জিনিস থেকে আপনাকে থাকতে হবে সম্পূর্ণ বঞ্চিত- প্রথমতঃ ওখানে কোন ইলেকট্রিসিটি নেই। যা আলো বা পাখা চলবে সবই জ্বলবে সৌর বিদ্যুতে। ফলে বাতানুকূল যন্ত্রের আরাম মশাই ভুলেই যান। 


দ্বিতীয়তঃ ওখানে নেই কোন টেলিফোনের টাওয়ার। ফলে অন্তর্জাল তো ছাড়ুন মামুলী ফোনও করতে পারবেন না। জঙ্গলে পা রাখার সাথে সাথেই আধুনিক সভ্যতা তথা নাগরিক জীবন থেকে সম্পূৰ্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবেন আপনি। মানসিক ভাবে প্রস্তুত হয়েই আসুন।


তৃতীয়তঃ ওখানে নেই কোন পিচ রাস্তা। গাড়ি যাবার জন্য লাল মোরামের রাস্তাই বরাদ্দ কেবল। তাতে গাড়ি নাচবেই, সেই নাচটুকু হজম করতেই হবে আপনার পিঠ এবং কোমরকে। বাড়ির গাড়ি নিয়ে আপনি যেতেই পারেন, তবে নীচু গাড়ি হলে কিন্তু মিলবেনি জঙ্গলে প্রবেশের ছাড়পত্র।মাটি থেকে অন্তত ১৮০ সেন্টিমিটার ক্লিয়ারেন্স লাগবে গাড়ির। 


এসব জানা ইস্তক শৌভিক আমাকে ক্ষেপাচ্ছে, ‘কি করে থাকবি রে, তিন তিনটে দিন? কি হবে তোর ফেসবুক, হোয়াটস্অ্যাপ, ইন্স্টাগ্রাম আর নেটফ্লিক্সের? এসব ছেড়ে তুই বাঁচবি তো?’ সমস্যা সেটা নয়, সমস্যা হল আমাদের দু জোড়া বৃদ্ধ-বৃদ্ধা।আর সবার ওপরে আমার ৮৬ বছরের পিসি। পাক্কা আড়াই তিনদিন সমস্ত যোগাযোগ রহিত থাকাটা এনাদের কারোরই তেমন মনঃপূত হয়নি বেশ বুঝতে পারছিলাম। 

যাই হোক, ভোর চারটে নাকি পাঁচটা করতে করতে শেষ পর্যন্ত আমরা বেরিয়েছি সাড়ে ছটায়। পূর্ব মেদিনীপুরের সীমানা ছাড়িয়ে ডেবরা হয়ে পশ্চিম মেদিনীপুরে ঢুকে, খড়্গপুর শহরকে সামান্য স্পর্শ করে চৌরঙ্গী দিয়ে গোল করে ঘুরে লোধাশুলি আর ক্ষেমাশুলির শালের জঙ্গলের পাশ কাটিয়ে, বহরাগোড়া হয়ে উড়িষ্যায় প্রবেশ করে যখন বাংড়িপোশিতে পৌঁছালাম তখন সময় পৌনে নয়। দু একটা ছোট অংশ বাদে মোটামুটি মখমলী হাইরোড। সাধারণতঃ পর্যটকেরা ফেরার পথে বাংড়িপোশি হয়ে ফেরেন, কিন্তু আমাদের ট্যুর প্লানার বলেছেন, বাংড়িপোশি থেকে যোশিপুরের রাস্তাটা নাকি বেশ চড়াই এবং ভয়ানক সুন্দর। পথের দৈর্ঘ্য গুগল দেখায় সোয়া দু ঘন্টা আর যোশিপুরে আমাদের জন্য প্রতীক্ষারত গাইড নীহার বাবু বলেন এক ঘন্টা। শেষ পর্যন্ত নীহার বাবুকেই যথার্থ প্রমাণ করে সাড়ে দশটার মধ্যেই যোশিপুর পৌঁছে যাই আমরা। 


বাংড়িপোশি থেকে যোশিপুর যাবার পথটা সত্যিই নয়ন জুড়িয়ে দেয়। আচমকাই পথের বাঁকে মাথা তুলে দাঁড়ায় বেঁটে বেঁটে ক্ষয়িষ্ণু পাহাড়ের দল আর তাদের পাদদেশ বরাবর অগুনতি শিমূলে পলাশে যেন হোলি খেলেছে কেউ। প্রকৃতির থেকে বড় চিত্রকর বুঝি কেউ নেই, কত যে অগুনতি রঙ পথের দুধারে। গাইড সাহেব বললেন, শিমূল থেকেই নাকি সিমলিপাল নামটার উৎপত্তি। যদিও শীতেই সবথেকে বেশি পর্যটক আসে এদিকে, তবে শিমলিপালকে দেখা তথা অনুভব করার সেরা সময় নাকি বসন্তকাল বিশেষতঃ মার্চ-এপ্রিল। শীতে জঙ্গল কেবলি সবুজ, এখন তা না না বর্ণের সমাহার। হরেকরকম গাছ চেনাতে চেনাতে নিয়ে চললেন নীহার বাবু, কমলা পলাশ, লাল শিমুল, গোলাপী কাঞ্চন তো আগেই চিনতাম, টকটকে লাল কুসুম গাছ এই প্রথম দেখলাম। জানলার কাঁচ নামিয়ে দিতেই ছুটে আসছে জঙ্গলের গন্ধবাহী দামাল হাওয়া। কোথাও তা মহুয়া ফুলের গন্ধে মাতাল কোথাও বা বকুল বা ইউক্যালিপটাস বা নাম না জানা গাছের গন্ধে বন্ধ হয়ে আসে দম। 


গাড়ি থামিয়ে পথ থেকে এক গোছা মহুয়া ফুল তুলে নিয়ে এলেন গাইড বাবু। জলে ধুয়ে বললেন, খেয়ে দেখেন না। তুত্তুরী একটা খেল, আমি দুটো। শৌভিক আর ড্রাইভার সাহেব তো ছুঁলেনই না। কি অসম্ভব মিষ্টি ফুল। খেতে অনেকটা কচি তালশাঁসের মত। হাল্কা একটা কষাটে ভাব আছে বটেক, তবে তা মুখে লাগে না। তুত্তুরী ফিসফিস করে জানতে চাইল,‘মা তোমার নেশা হয়েছে?’ সমস্বরে হেসে উঠলাম আমরা। 


এই সামান্য দুটো ফুল চিবিয়ে কারো নেশা হয় না।পাকা মহুয়া ফল থেকে কিভাবে তৈয়ার হয় নেশার জিনিস বিশদে বোঝালেন গাইড দাদা। বললেন এছাড়াও মহুয়ার তেল হয়। আগে তা রান্নাতেও ব্যবহৃত হত। মহুয়া ফুল এবং ফল যদিও বেশ সুমিষ্ট, তেলটা কিন্তু বেশ তিতকুটে হয়। তবে গরম তেলে সামান্য নুন ফেলে দিলেই কেটে যায় তার তিক্ত ভাব। তবে আজকাল আর কেউ তেমন খায় না। মূলতঃ প্রদীপ জ্বালাতে আর নানা ওষুধ,প্রসাধনী ইত্যাদি প্রস্তুতিতেই যা লাগে। জানালেন আগে গরীর মানুষ এই ঝরে যাওয়া মহুয়া ফুল তুলে শুকিয়ে রেখে দিত। ঘোর বর্ষায় যখন মিলত না কোন খাবার, ঐ গুলিকে জলে ফুটিয়ে কাত্থ বানিয়ে তার সাথে পাকা তেঁতুলের কাত্থ মিশিয়ে ফুটিয়ে খেত।উনিও খেয়েছেন শৈশবের দিনগুলিতে, জানালেন সে নাকি পুরো অমৃত। আজকাল সরকারের হাজার একটা প্রকল্পের সৌজন্যে তেমন গরিব নাকি কেউ নেই। শুনেও সুখ।





সিমলিপালে যদি আসেন এবং থাকার মনস্থ করেন, সর্বাগ্রে মাথায় রাখবেন এটা গহীন জঙ্গল। মধ্যে মধ্যে জনবসতি বলতে কয়েকটা আদিবাসী গাঁ আছে বটে, তবে দোকানপাট কিছুই নেই। তাই ব্যাগ তথা গাড়ি ভর্তি করে নিয়ে আসবেন শুকনো খাবারদাবার আর জল।যে গেট দিয়েই প্রবেশ করুন না কেন, ঢোকার আগে অবশ্যই ভর্তি করে নেবেন গাড়ির তেলের ট্যাঙ্ক। গাইড সাহেব বললেন সিমলিপালের আয়তন প্রায় নয়শ বর্গকিলোমিটার। এর মধ্যে কিছুটা পর্যটনের জন্য নির্দিষ্ট থাকলেও বাকিটা শুধুই বন্যপ্রাণীদের চারণ ভূমি। সিমলিপালের সবটুকুই প্রাকৃতিক, এখানে কোন কৃত্রিম বা মনুষ্য নির্মিত ব্যাপার পাবেন না। সিমলিপাল হল রিজার্ভ ফরেস্ট, এখানকার কোন কিছুই অন্যত্র স্থানান্তর করা যায় না। বা অন্যস্থান থেকে কোন জীবজন্তু এনে এখানে ছাড়া হয় না। ওণার ভাষায়,‘যা সিমলিপালে জন্মাবে, তা এখানেই বড় হবে এবং এখানেই মারা যাবে।’ আন্দামান বা আমাদের সুন্দরবনের মত। এই জঙ্গলের সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র তথা নিজস্ব ইকো সিস্টেম আছে। 

আমরা থাকব বড়েহিপানি নেচার ক্যাম্পে। যোশীপুর থেকে সেটা প্রায় ষাট কিলোমিটার। জঙ্গলে প্রবেশের সাথে সাথেই ঝুপ করে পড়ে গেল সব ফোনের সব টাওয়ার। গাইড দাদা বললেন, ‘ফ্লাইট মোডে করে লিন। জঙ্গল থিকে না বেরোতে পারলি, টাওয়ার আসবে না।’ জানতে চাইলাম, ফোনে চার্জ দেওয়া যাবে তো? হেসে জানালেন তা যাবে বটে। লাল মেঠো আঁকাবাঁকা পথ, একপাশে ঘন জঙ্গল আর পথের অন্য ধার দিয়ে বয়ে যাচ্ছে তিরতিরে খৈরি নদী। এই জঙ্গলের বুক চিরে নাকি বেরিয়েছে সাত-সাতটা নদী। খৈরি, বুড়িবালাম (এরা বলে বুঢ়াবলঙ্গ), ভণ্ডন, খড়কাই, দেও,সঞ্জু আর সালন্দী। এগুলো ছাড়াও আছে আরো সাত আটটা ছোট নদী। যার অন্যতম হল পলপলা বা লুলুং। 

এত অপরিসর খৈরি নদীর খাত, মধ্যে মধ্যে পড়ে আছে বড় বড় পাথর। বর্ষা নামলেই নির্ঘাত দুকুল ছাপিয়ে যায় নদী? শুনলাম তা যায় বটে, তবে তার স্থায়িত্ব বড়ই স্বল্প। অচীরেই নেমে যায় জল, তবে আজ সিমলিপালে জল বাড়লে পরশু ভাসে বালেশ্বর বা কটক। নদীর ডানদিকে গভীর জঙ্গল, তথা কোর এরিয়া। বাঘের সাকিন। ওখানে সাধারণ মানুষের পদার্পণ কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ। এতদসত্ত্বেও যদি কেউ যায় বা গবাদি পশুকে চরতে পাঠায় এবং বাঘের পেটে যায় তাহলে সরকার দেয় না কোন ক্ষতিপূরণ। জানতে চাইলাম বাঘ কি সত্যিই আছে? উত্তর পেলাম আছে তো বটেই। সদ্য শেষ জানুয়ারীতে হয়েছে বাঘসুমারি। আমাদের গাইডদাদাও নাকি তখন তাতে অংশগ্রহণ করেছিল। খুঁজে খুঁজে বস্তাবন্দী করে পাঠাতে হয়েছিল বাঘের পুরিষ। ফলাফল এখনও জানায়নি বনদপ্তর, তবে বড় ছোট মিলিয়ে প্রায় শতখানেক বাঘ আছে বলেই ওণার ধারণা। আসার আগে পড়েছিলাম ৯৯টা বাঘ ছিল আগের সুমারিতে। তাহলে তেমন বাড়েনি বাঘের সংখ্যা? 

গাইড দাদা হতাশ সুরে জানালেন,বাড়ছে বটে আবার মারাও পড়ছে। বাঘের দাঁত, বাঘের চামড়ার লোভে মাঝেমাঝেই চোরাগোপ্তা হামলা হয় দক্ষিণ রায়ের তুতো বংশধরদের ওপর। কিছুদিন আগেই নাকি দুটো বাঘকে মেরে কারা যেন ছাল ছাড়িয়ে তাদের মাংস রান্না করে খেয়েছে। ধরা পড়ার পর, তা জাতীয় খবর হয়। আজব লাগে শুনে, এতদিন জানতাম বাঘ মানুষের মাংস খায়,মানুষও যে বাঘ খেতে পারে তা কল্পনাতীত হলেও সত্যি। শুধু কি তাই, জঙ্গলে আগুনও লাগায় মানুষ। পথে যেতে যেতে আমরা নিজের চোখে দেখলাম দূরের পাহাড়ের মাথা থেকে পাকিয়ে পাকিয়ে উঠছে ধোঁয়া। শৌভিক জানতে চাইল কারা লাগায় এ আগুন? কেনই বা লাগায়?শুনলাম ফাজলামি করতেই আগুন লাগায় মানুষ। এত বড় জঙ্গল, জঙ্গল ভর্তি শুকনো পাতা।কে কোথায় একটা জ্বলন্ত বিড়ি ছুঁড়ে ফেলল, কি একটা দেশলাই কাঠি ছুঁড়ে মারল তার হদিশ পেতে পেতেই পুড়ে যায় অনেকটা জঙ্গল। আগুন নেভানোর জন্য আইন সংশোধন করে কঠোর শাস্তির বিধান এনেছে বনদপ্তর, গড়েছে অগুনতি অগ্নি নির্বাপক টিম, যাদের কেউ খাস সরকারি কর্মচারী, কেউ বা নিছক কন্ট্রাক্টে কাজ করে। খবর পেলেই তারা দৌড়ায় অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র নিয়ে। তবে আশার কথা একটাই যে এই সব আগুনে বড় গাছের কোন ক্ষতি হয় না। বড়জোর এক দেড় ফুটের গাছ অবধি ক্ষতির শিকার হয়। তবে তাই বা কেন হবে? 

পথে পড়া প্রথম চেক পোস্টে আগুন লাগার খবর জানিয়ে, আমরা চললাম 'মহাবৃক্ষ শাল' এর সাথে আলাপিত হতে। যদিও গোটা সিমলিপাল জুড়েই শালের আধিক্য, তবে তাদের মধ্যে সবথেকে কুলীন তথা খ্যাত হলেন মহাবৃক্ষ শাল। তাঁর কাণ্ডের বেড়ই ১৬ ফুটের বেশি, উচ্চতাতেও তেমনি,বয়স হয়েছে সাড়ে তিনশ বছরেরও বেশি। ব্রিটিশ ভারতে রেল লাইন পাতার সৌজন্যে যখন শহীদ হচ্ছে একের পর এক শাল গাছ, দিন ঘনিয়ে এল মহাবৃক্ষেরও। সে তো তখন ছিল এক মামুলি উঠতি শাল গাছ। জনা দুয়েক কুলি এসে চালাল কুঠার।জনশ্রুতি হল চালানোর সাথে সাথেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে একজন আর অপরজন পাগলের মত ছুটে পালায় কুলি বস্তিতে। কিন্তু বাঁচে না সেও। রাত পোহানোর আগেই শেষ নিঃশ্বাস ফেলে সে। তারপর থেকে আর কেউ স্পর্শ করার সাহস পায়নি এই শাল গাছটিকে। গোটা সিমলিপালের সবথেকে বুড়া গাছ হয়ে আজও মেঘেদের সাথে লুকোচুরি খেলেন তিনি। স্থানীয় লোকজন এসে দিয়ে যায় শ্রদ্ধার্ঘ্য।




বড়েইপানি নেচারক্যাম্প যাবার আগে আমরা গুড়গুড়িয়ার পাইন জঙ্গল আর অর্কিডারিয়াম ঘুরে এলাম। গুড়গুড়িয়াতেও একটা নেচার ক্যাম্প আছে। আগে এখানে হাতির সওয়ারি হত, কিন্তু ২০১৯সাল নাগাদ সাতকোশিয়ায় একটা দুর্ঘটনা ঘটে, যেখানে পোষা হাতি খেপে গিয়ে তার মাহুতকেই তুলে আছাড় মারে, তারপর থেকে বনদপ্তর হাতির সওয়ারি বন্ধ রেখেছে। সিমলিপাল প্রায় শতেক রকমের অর্কিডের নিবাস। মার্চ-এপ্রিলই হল ফুলের মরশুম। এখনও ফুল আসেনি বটে আর কিছুদিনের মধ্যেই অর্কিডে ভরে যাবে গুড়গুড়িয়ার জঙ্গল। একবার ফুল ফুটলে নাকি মাস খানেক থাকে সেই ফুল। 

গুড়গুড়িয়া থেকে বেরিয়ে আমরা যখন বড়িয়াপানি নেচার ক্যাম্পে পৌঁছালাম তখন বাজে বেলা দুটো প্রায়। চা-ব্রেকফাস্ট-লাঞ্চ-বিকালের চা-তেলেভাজা-রাতের ডিনার সবকিছুই ধরা আছে ক্যাম্প বুকিং এর সাথে। যাঁরা ডে ট্রিপে আসেন তাদের অবশ্য প্রবেশের সময় লাঞ্চের কথা জানিয়ে আসতে হয় চেক পোস্টে। ওয়াকিটকি বা রেডিওয় খবর এলে রান্না করে রাখে এরা। তবে ডে ট্রিপারদের জন্য খাবার ব্যবস্থা মূল প্রাঙ্গনের বাইরে।

বিশাল এলাকা জুড়ে নেচার ক্যাম্প। লাল মোরামের রাস্তার দুধারে শাল আর কুসুম গাছের জঙ্গল। আছে আম- কাঁঠালও। এই মরসুমে কুসুমগাছের পাতার রঙ সিঁদুরে লাল। উঁচু গাছগুলোর মাথা জুড়ে এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত চলে গেছে ঝুলন্ত ব্রিজ। ছোট ছোট লাল রঙের কটেজ। বাতানুকূল নয় বটে তাও কটেজের ভিতর গুলো প্রচণ্ড ঠাণ্ডা। ওরা বলল, রাতে নাকি আরো ঠাণ্ডা পড়ে। কম্বল গায়ে দিতে হয়। 

আগে এই বড়েইপানি নেচারক্যাম্পটা ছিল একেবারে বড়েইপানি ঝর্ণার সামনাসামনি। কিন্তু এখন পিছিয়ে এসেছে প্রায় তিন কিলোমিটার। আদিবাসী গ্রামের মধ্যে গড়ে উঠেছে নতুন নেচারক্যাম্প। সৌজন্য মাওবাদী হামলা। বড়েইপানিতে কটেজে আগুন লাগানো হয়েছিল, আর চাহালাতে তো রাতে হামলা করে চরম লুটপাট চালিয়ে পর্যটকদের বিবস্ত্র করে রেখে গিয়েছিলেন তেনারা। তারপর দীর্ঘদিন বন্ধ ছিল যাবতীয় নেচারক্যাম্প। পরে উড়িষ্যা সরকার তথা বনদপ্তর সিদ্ধান্ত নেয় যে নতুন নেচারক্যাম্প গুলো গড়া হবে গাঁ তথা জনবসতির মধ্যে। 

এই সুবিশাল জঙ্গল নাকি আদতে ছিল ময়ূরভঞ্জের রাজাদের শিকারভূমি। বৃটিশ আমলে যখন শুরু হল রেললাইন পাতা, সাথে সাথে কাটা পড়তে লাগল সিমলিপালের শালের জঙ্গলও। লাইনের কাঠের স্লিপারের জন্য শালের থেকে মজবুত গাছ আর কিই বা হতে পারে। তখন শাল গাছ কাটা, চেরা, লোড করা তথা রাজার সাথে শিকারে যাওয়া এবং অন্যান্য বিলাসব্যসনের জন্য বেশ কিছু প্রজাকে এখানে বাস করার সুযোগ করে দেওয়া হয়। রাজার থেকে পাট্টা পেয়েই এণারা এখানে বসবাস করেন। তবে বর্তমানে নাকি বন দপ্তর অফার দিয়েছে, যাঁরা জঙ্গল ছেড়ে যেতে রাজি হবে, তাদের প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনার বাড়ি আর পরিবারের পুরুষ সদস্যকে দশ লক্ষটাকা এককালীন ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে। সাথে অন্যান্য সরকারী প্রকল্পের সুযোগসুবিধার ক্ষেত্রেও মিলবে অগ্রাধিকার। আজই নাকি ১৭টি এমন পরিবার ছেড়ে যাচ্ছে সিমলিপাল অরণ্য ভূমি। 

মুখ হাত ধুয়ে বেশ খানিক পায়ে হেঁটে খাবার ঘরে গিয়ে বসলাম। খাবার বলতে সাদা প্লাস্টিকের খোপ কাটা থালায় এল মোটা চালের ভাত, গুঁড়ো বড়ি ভাজা, পেঁয়াজ লঙ্কা দিয়ে বেগুন পোড়া মাখা, মোটা মোটা করে আলুভাজা, দই-বেগুন যা অনেকটা রায়তার মত খেতে,ডুমো ডুমো করে কাটা পেঁয়াজ, প্রচণ্ড মিষ্টি গাজর আর পাকা কিন্তু সরস শশার স্যালাড, পনির-সোয়াবিন-আলু-পটল-বেগুন দিয়ে একটা পাঁচমিশেলি তরকারি, ডিমের ঝোল আর ডাল। খিদের মুখে সবই যেন অমৃত। তবে রান্না বড়ই তেল মশলা বিবর্জিত এমনকি নুনও বেশ কম। তাও অতুলনীয়। খেয়ে উঠে রেস্ট। গাইড দাদা বললেন, পাঁচটা নাগাদ বেরাব। চাহালা যাব। চাহালা হল কোর এরিয়া। যেখানে জন্তুজানোয়ার দেখতে পাবার সম্ভবনা প্রবল। তবে সন্ধ্যা ছটার পর আর ঢুকতে দেয় না। এখান থেকে বড় জোর আধঘন্টা। আমরা সাড়ে পাঁচটা নাগাদ বেরোলেই আরামসে পৌঁছে যাব। ততোক্ষণ অন্ধকার শীতল ঘরে পরম সুখের ভাত ঘুমই সই।

সিমলিপাল অরণ্য পর্যটনের অন্যতম তথা সেরা আকর্ষণ হল সন্ধ্যার চাহালা। চাহালা হল জঙ্গলের কোর এরিয়া। সামান্য ভুল লিখলাম, সিমলিপালে অনেকগুলি কোর এরিয়া আছে বটে, তার মধ্যে পর্যটকদের প্রবেশ কেবল চাহালা অবধিই সীমাবদ্ধ। বড়েয়াপানি নেচার ক্যাম্প থেকে চাহালা পৌঁছাতে লাগে চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ মিনিট। প্রথম চোটে পড়বে আদিবাসী গাঁ, দূরে ঢেউ খেলানো পাহাড়ের পটভূমিকায় নিকানো তকতকে আদিবাসী গৃহকোণ,গবাদি পশু যেমন গরু, ছাগল, ভেড়া, মুর্গি ইত্যাদি আর ঝকঝকে রমণী আর হাসিখুশি শিশুর দল, যারা গাড়ি দেখলেই হাত নাড়ায় আর ছুটে আসে। 

গরুর লোভে নাকি এখানে প্রায়ই হামলা করে লেপার্ড। কয়েকমাসের মধ্যেই নাকি আট দশটা গরু মেরেছে, এরা বলে ছোট বাঘ। দিন কয়েক আগে নাকি রাতের বেলা নেচার ক্যাম্পের পিছনেও চলে এসেছিল ছোট বাঘ। এরা অবশ্য অকুতোভয়। বলল, ‘ছোটা বাঘ তো মানুষ মারলি না। দুটো ছোটখাটো জীবজন্তু একলা পেলি মারে। তাই আজকাল সাত আটটা গরুকে একসাথে চরতে পাঠায় স্থানীয় আদিবাসীরা। 'এমন বদমাশ ছোট বাঘ গুলা যে গরু মারলি, কিন্তু গরু খাইলি না। মেরে ফেলি রেখে চলে যায়।’

আদিবাসী গাঁ ছাড়িয়ে ক্রমেই গাঢ় হয় জঙ্গল, কমতে থাকে সূর্যের দীপ্তি। দুধারে শালের ঘন জঙ্গল, তাতেই টর্চ মারতে থাকে গাইড দাদা, বলেন, সন্ধ্যা না নামলে বেরোয় না জন্তুর দল। ড্রাইভারকে বলেন খুব আস্তে চালাও, দশ কি বিশের বেশি স্পিড তুলো না। প্রথমেই চোখে পড়ল একদল কালো মুখো হনুমান। লাল মুখো পুঁচকে ফিচেল বাঁদর অনেক দেখেছি, এই প্রথম কালো মুখ হনুমান চোখে পড়ল। তবে সে গুলো মোটেই আমাদের দেখে ভয় পেল না বা পালিয়ে গেল না। কেবল পুঁচকে গুলোকে কোলে নিয়ে মা গুলোই যা 'দৌড়ে পালাইলি'। আরো এগোতেই একপাল লাজুক হরিণ, শিং তথা পেশিওয়ালা দলনেতার অনুগামী। দলনেতা যাও বা খানিক বুক ফুলিয়ে উঁকি ঝুঁকি মারল, তাঁর অনুগামীরা তো গিয়ে লুকালো গাছের আড়ালে। একটু এগোতেই রাস্তা পেরোচ্ছিল গোটা দুয়েক নীল বন মোরগ, আমাদের গাড়ি দেখে, সে কি 'পড়ি কি মরি' করে দৌড়। 




ক্রমেই কমে আসছে দিনের আলো। একটা জায়গায় এসে গাড়িটা দাঁড়িয়ে পড়ল। লেখা আছে বৃন্দাবন গেট। সামনেই একটা চেকপোস্ট, গাইড দাদা বললেন ওটা কোর এরিয়া ছেড়ে বারিপদার দিকে বেরোনোর পথ। আমাদের ডানদিকে বাঁকতে হবে। আর বললেন,' দুমিনিট দাঁড়িয়ে যান, হাতির পটি পড়ে আছে। মনে হচ্ছে কাছাকাছি হাতি এসেছে।' গাইড আর ড্রাইভার নেমে বৃন্দাবন চেকপোস্টের গার্ডের সাথে কথা বলতে গেল। গার্ড বলতে একটা পুঁচকে ছেলে তাও আমাদের মেদিনীপুরের।একগাল হেসে এগিয়ে এসে আলাপ করল ছেলেটি। বয়স সদ্য বিশের কোটায়। কি কম ও হতে পারে। দাঁতনে বাড়ি। বলল, হাতি তো এসেছে। ভোর পাঁচটার সময় বৃন্দাবনগেটে এসেছিল। ওর ধারণা রাতে আবার আসবে। বৃন্দাবনে একটা পুঁচকে জলাশয় আছে, যার মাটিতে নুন ছড়িয়ে রাখে বনদপ্তর। সেই নুনের লোভেই আসে হাতি বা অন্য বন্য জন্তু। বাইসনও আসে, তবে বেশ অনেকটা রাত করে, যখন সব গাড়ি বেরিয়ে গিয়ে নিঝুম হয়ে আসে জঙ্গল। হাতি এলে ওয়াকিটকিতে খবর দেবার অনুরোধ জানিয়ে চাহালার পথ ধরলাম আমরা। 

চাহালাতেও একটা ক্ষুদ্র জলাশয় আছে, বিশাল মাঠের মাঝে, জঙ্গলের ধার ঘেঁষে। তার মাটিতেও ছড়ানো হয় নুন। মাঠের এক কোণে রাজার বাংলো, যেখানে স্মরণাতীত কালে শিকার করতে আসতের রাজামশাই। এখন অবশ্য বনদপ্তরের উচ্চপদস্থ আধিকারিক বা সরকারের গণ্যমান্য অতিথি ভিন্ন কেউ থাকতে পারে না। মাঠের একদিক কাঁটা তার দিয়ে ঘেরা, সেখান থেকেই পশুপাখি পর্যবেক্ষণ করেন পর্যটকরা। একটা তেতলা লোহার ওয়াচটাওয়ারও আছে। 

কাঁটাতারের এপাশ থেকে টর্চ মারল গাইড দাদা, ওপারে জলাশয়কে ঘিরে থিকথিক করছে হরিণের পাল। অন্ধকারে আলো পড়লে জোনাকির মত জ্বলে তাদের চোখ। বেশ খানিকক্ষণ থেকে অন্ধকার আর টর্চের আলোয় ছবি তোলার বৃথা চেষ্টা করে বোর হয়ে গেলাম আমরা। একে একে বিদায় নিল অন্য পর্যটকরাও, রয়ে গেলাম শুধু আমরা। শৌভিক তাড়া দিল, ‘চলুন ফিরে যাই’। গাইড দাদা অত্যন্ত লজ্জা লজ্জা করে বললেন, 'একটু অপেক্ষা করে যান দাদা। রাত যত গাঢ় হবে, জঙ্গল যত শুনশান হবে, ততো বেরিয়ে আসবে জংলি জানোয়ারের দল। অন্য গাড়ি গুলাকে চলে যেতে দিন না।'

বনদপ্তরের জনৈক কর্মচারীকে পটিয়ে, চিনি, বিটনুন, মরিচ গুঁড়ো, আর লেবুর রস দিয়ে দুর্ধর্ষ কালো চা বানিয়ে খাওয়ালেন গাইড দাদা। ওই গা ছমছম অন্ধকারে, বাঁধানো কাঁঠাল গাছের তলায় বসে জংলি জন্তুর অপেক্ষা করতে লাগলাম আমরা। মাঝে মাঝে টর্চ জ্বালাই আর বিরক্ত হয়ে মাথা তুলে তাকায় হরিণের পাল। রাত সাড়ে সাতটা নাগাদ দৌড়ে এলেন গাইড দাদা, ওনার অনুরোধ মোতাবেক ওয়াকিটকিতে খবর পাঠিয়েছে বৃন্দাবন গেট, ' হাতি এসেছে। একটা নয়, দুটো নয়, চার চারটে। সাথে একটা বাচ্ছা(হাতি) ও আছে।'

বৃন্দাবন গেটে আমরা যখন পৌছালি, রাত তখন আটটা। মনে হচ্ছে যেন নিশুতি মধ্য রাত্রি। যাবার পথে গাইড দাদা বুঝিয়ে দিলেন, পথে যদি কোন হাতি পড়ে, আলো নেভাবেন না, স্টার্ট বন্ধ করবেন না, হর্ন দেবেন না এবং কথা বলবেন না। একদম চুপচাপ থাকবেন, হাতি চলে যাবে। নড়েছেন কি, বিপদ। পথে যাই হোক তেনাদের সাথে মোলাকাত না হলেও বৃন্দাবন গেটে হল। আলো নিভিয়ে কোন মতে অন্ধকারে চোখ সইয়ে আমরা দূতলা ওয়াচ টাওয়ারে যখন উঠলাম এবং গার্ড ছেলেটি তার পরিপক্ক হাতে টর্চ জ্বালালো, সমানেই কাঁটাতারের ওপারে, ক্ষুদ্র জলাশয়ের ধারে একপাল হাতি। 

আলো জ্বলে, নিভে, ফাঁকে ফাঁকে ছেলেটি গপ্প শোনায়, নুন চাটতে এসেছে হাতির পাল। বাচ্ছা হাতিটা লেপ্টে আছে মায়ের পেটের কাছে। আমরা দেখলাম প্রথম চোটে দাঁত দিয়ে লবনাক্ত মাটির চোকলা তুলল দাঁতাল দলপতি। তারপর সবাই মিলে পা দিয়ে তাকে থেঁতলে গুঁড়া করল, তারপর শুঁড়ে করে সেই ঝুরঝুরে মাটি মুখে পুরল হাতির দল। সে এক অনবদ্য দৃশ্য।

আরো কি দেখতাম জানি না, এমন সময় এসে উদয় হলেন আরো একদল পর্যটক, সঙ্গে গুটি কয়েক বাচ্ছা। ' এলিফ্যান্ট' দেখে তাদের কি পুলক।তা সোচ্চারে জানানোও হল, গার্ড ছেলেটির নিষেধ সত্ত্বেও বার বার আলো জ্বালানো হল ছবি তোলার উদ্দেশ্যে, পরিণাম এই হল যে সচেতন হয়ে গেল হাতির পাল। প্রথম চোটে আমাদের ভয় দেখাতে করা হল, পায়ের ধুপধাপ আওয়াজ, তারপর ফোঁস ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলা, তারপর বৃংহন, সবশেষে মড়মড়িয়ে শাল গাছের ডাল ভাঙা। হল্লাবাজ পর্যটকের দল তো ভয়ে পগার পর, নিকষ আধারে অপেক্ষারত আমাদের গাইড দাদা বললেন,' এবার চলে চলুন, ওরা লুকিয়ে পড়বে এখুনি। সঙ্গে বাচ্ছা আছে না। বেশি দূর যেতে পারলি না। পথেও মিলতে পারে দেখা।' 

গোটা পথ আমরা অন্ধকার জঙ্গলে টর্চের আলো ফেলতে ফেলতে এলাম। যদি মেলে কোন বন্য জীবের দেখা। মিলল বটে, এক পাল হরিণ, হাতি আর মিলল না। কোর এরিয়া ছেড়ে আমরা যখন বেরিয়ে আসছি, পথে পড়ল গোটা তিনেক গরু।এত রাতে গরু দেখে বিকট খুশি হয়ে গেল তুত্তুরী, গাইড দাদা আবার বলতে লাগল, ‘এখানে বাঘে খেলে কোন ক্ষতিপূরণ পাবে না গ্রামবাসীরা। তবে এগুলা তো ষাঁড় বটে, ইত্যাদি প্রভৃতি।’ এমন সময় চিৎকার করে উঠল শৌভিক, 'ওটা কি, ওটা কি? বড়সড় কুকুরের থেকে একটু বড় একটা জীব, প্রায় বাঘের মত মোটা লেজ-'। ভালো করে ঠাওর করার আগেই হাওয়া। গাইড দাদা গম্ভীর ভাবে বললেন, 'ছোট বাঘ আজ্ঞে।। গরুর লোভে এইয়েছিল মনে হচ্ছে।'




নিষুতি রাতের নিকষ জঙ্গলকে পিছনকে ফেলে আমরা যখন বড়েইপানিতে ফিরে এলাম, ঘড়ি বলছে সবে রাত সাড়ে আটটা। আজ আমরা ছাড়া এত বড় নেচারক্যাম্পে রয়েছে কেবল একটাই পরিবার। সৌর বিদ্যুতে জ্বলা মিটমিটে আলোয় গোটা নেচারক্যাম্পটা যেমন যেন ভুতুড়ে রূপ নিয়েছে। এরা ভীষণ অতিথি বৎসল,এত রাতে আমরা আশা না করলেও, ওরা ঠিক দিয়ে গেল তিনকাপ জিভ পোড়ানো সর ফেলা মোটা দুধের চা আর তিন প্লেট পেঁয়াজের পকোড়া। ডিনারে গরম গরম হাতে গড়া রুটি, ফুটন্ত দিশি মোরগের ঝোল আর মোটামোটা আলু ভাজা। 


যাত্রার ধকল, রাতের জঙ্গলের কুহকিনী উত্তেজনা আর উদর ভরা সুখাদ্যে মেখে হিমেল জঙ্গুলে রাতটা যে কখন ঝুপ করে কেটে গেল। দরজার কড়া নাড়ার শব্দে যখন অতি কষ্টে খুললাম চোখের ভারি পাতা, ঘড়ি বলল সবে সকাল সাড়ে ছয়। মোটা দুধের চা আর বিস্কুট দিতে আসা ছেলেটা লাজুক আদিবাসী সুরে জানতে চাইল, ‘ব্রেকফাস্ট মে কেয়া খায়েঙ্গে-’। আমাদের 'যা খুশি'র জবাবে, সকাল নটা নাগাদ পাতে এসে পড়ল খড়মড়ে করে ভাজা বিশাল বিশাল আটার তেকোনা পরোটা, চার কুচি আলু, ষোলটা মটর আর এক বাটি জল দিয়ে বানানো জিভে জল আসা ঘুঘনি, আচার, অমলেট আর উপমা। উপমাটা বড় উত্তম বানায় এরা। সুজির সাথে নানা সব্জি আর সিমাই মিশিয়ে বেশ নোনতা-মিষ্টি একটা রগরগে ব্যাপার। পেট ভরলেও মন ভরে না। 


সাড়ে নটা নাগাদ আবার জঙ্গলে বেরোলাম আমরা। সিমলিপালের মূখ্য ট্যুরিষ্ট আকর্ষণ হল তার তিনটি ঝর্ণা- উচ্চতা অনুসারে উস্কি, জোরান্ডা আর বড়েইপানি। তিনটেতেই জল থাকে বছর ভর। এদের মধ্যে সবচেয়ে পুঁচকে হচ্ছে উস্কি। জলপ্রপাতের খুব কাছ পর্যন্ত গাড়ি যায়, গাড়ি থেকে নেমে স্বল্প দূরত্ব সরু পাহাড়ি পথে হেঁটে গেলেই আপনি উস্কির সামনে এসে পৌঁছাবেন। চাইলে আপনি স্নানও করতে পারেন। উস্কির জল গিয়ে মিশেছে ভণ্ডন নদীতে। 


সিমলিপালের সবথেকে উঁচু জলপ্রপাতটির নাম বড়েইপানি। বুড়া বলঙ্গ নদীর এই জলপ্রপাতটির জল দুধাপে নেমেছে। সব মিলিয়ে মোট উচ্চতা ১৩০৯ ফুট বা ৩৯৯মিটার। এটি ভারতের দ্বিতীয় উচ্চতম আর উড়িষ্যার উচ্চতম জলপ্রপাত, গভীর জঙ্গলের মধ্যে অবস্থিত বড়েইপানি জলপ্রপাতকে আপনাকে দূরের পাহাড়ের মাথা থেকেই দেখতে হবে, তাও কোর এরিয়ার মধ্যে তিন কিলোমিটার ঢুকে এসে। আগে এখানে থাকার অনুমতি ছিল পর্যটকদের, তবে মাওবাদী হামলার পর, সব বন্ধ। ফাঁকা, পুড়িয়ে দেওয়া কটেজগুলিতে বাঁদর আর হনুমানের বাস। 


সারা দিন জঙ্গলের মধ্যে উদ্দেশ্যহীন ভাবে কখনও পায়ে হেঁটে, কখনও বা সাইকেল চালিয়ে ঘুরে বেড়িয়ে, নেচারক্যাম্পের ঝুলন্ত ব্রিজ আর দড়ির সেতুতে বেশ কয়েকবার পারাপার করে, ক্লান্ত হয়ে ভরপেট দ্বিপ্রাহরিক আহার এবং হাল্কা বিশ্রাম সেরে আমরা আবার যখন চাহলার জন্য বেরোলাম তখন ঘড়িতে বাজে সাড়ে পাঁচ। কমতে থাকা দিনের আলো, বাড়তে থাকা রহস্যময়তা, গাছের ডালে ডালে ফিসফিস করা ভয়ানক মিষ্টি, রঙচঙে রাক্ষুসে কাঠবিড়ালী (জায়েন্ট স্কুইরেল), চিন্তিত হনুমান আর ফিচেল বাঁদরের দল। ল্যাজ গুটিয়ে ছুট্টে পালানো বনমুরগি, কান খাড়া চেনা হরিণের দল সবই ভীষণ পরিচিত। নতুন আলাপ বলতে রাস্তা পেরিয়ে যাওয়া বার্কিং ডিয়ার, এরা বলে বনছাগল। মোটেই ক্যামেরা ফ্রেন্ডলি নয় ব্যাটারা। 


সন্ধ্যে সাড়ে ছটার পর টর্চের আলোয় দেখা হরিণের দল। রাতের বেলা জোনাকির মত জ্বলে ওদের চোখ। আলো ফেললেও কেমন যেন ভেবলে গিয়ে খানিক তাকিয়ে থাকে, তারপর আবার মন দেয় নুন চাটতে। রাত বাড়তে আসে হাতির দল। তারা অবশ্য চোখে টর্চ মারলে মোটেই খুশি হয় না। বরং বেশ বিরক্ত হয়। হুঙ্কার ছাড়ে। গাইড দাদা বলে, ‘বেশি বিরক্ত করলি ওরা কিন্তু গাছ তুলে ছুঁড়ে দেবে।‘ যাদের উদ্দেশ্য বলা তাঁরা কর্ণপাতও করে না। প্রায় ১৭/১৮ জন মধ্য ৩০থেকে ৫০ এর মহিলার দল, ওয়াকিটকিতে ছড়িয়ে পড়া হাতির খবর শুনে তাদের গাইড তাদের চাহালায় নিয়ে এসেছেন। তাদের উল্লাস দেখে কে!


আধো অন্ধকারে ওয়াচটাওয়ার ছেড়ে বেশ খানিকটা পিছিয়ে এসে একটা মস্ত কাঁঠাল গাছের তলায় বসলাম আমরা। গাইড দাদা ফরেস্টেরই এক কর্মচারীকে ধরে চা বানালেন, জিভ পোড়ানো কালো চা, তাতে প্রচুর মরিচ গুঁড়ো আর সামান্য বিটনুনের তড়কায় পুরো অমৃত। দিদিমণিদের হর্ষ চায়ের উত্তাপে কিছুটা জুড়াল বটে, তার ওপর ছিল হাতি সংক্রান্ত নানা গল্প। যেমন হাতির স্মৃতিশক্তি নাকি ভয়ানক প্রখর। হাতি নাকি দারুণ গন্ধ পায়। কোন রাস্তা দিয়ে একবার গেলে, হাতি সে রাস্তা ভোলে না। কোন মানুষ হাতির ক্ষতি করলে,হাতি নাকি ঠিক তাকে খুঁজে বার করে শাস্তি দেয়। শাস্তি বলতে শুঁড়ে করে গাছ তুলে ছুঁড়ে মারা। গাছ যদি খুব শক্ত হয়, মাটি ছাড়তে না চায়, হাতিরা করে কি নিকটবর্তী জলাশয় থেকে শুঁড়ে করে জল এনে মাটি ভিজিয়ে চেষ্টা করে গাছটাকে ওপড়াতে। নুন খাবার ভয়ানক লোভ হাতির। নুন খাবার তাড়নায় মাটিতে গর্ত করে ফেলে। আর হাতি ভালোবাসে মহুয়া খেতে। আদিবাসী গাঁয়ে কোথাও যদি মহুয়া তৈরি হয়, গন্ধে গন্ধে পৌঁছে যায় হ্যাংলা হাতির দল আর দেওয়াল ফুটো করে, শুঁড় ডুবিয়ে শুষে নেয় মহুয়া। তারপর মাতাল হয়ে টহল দিয়ে বেরায় বনে বনে। 


গাইড দাদা বলল, মাতাল হলেও তাল জ্ঞান নষ্ট হয় না হাতির। কিছুদিন আগে এমনি এক মাতাল হাতি বেশ কিছু শস্য নষ্ট করছিল, তখন হাতি তাড়াতে জনা কয়েক স্থানীয় যুবক বিভিন্ন গাছের ওপর উঠে তীর চালাতে থাকে। তার মধ্যে একটা তীর সত্যিই হাতির লেগে যায়, সামান্য রক্তপাতও হয়। ব্যাস, কিভাবে যে হাতিটা বোঝে কার তীরে আহত হয়েছে সে, কে জানে। কিন্তু পাগলের মত দৌড়ে যায় সেই গাছটার দিকে, তারপর ধাক্কা মারতে থাকে বারবার। বিশাল মহীরুহ ছিল বলে ঐ ধাক্কাও সয়ে যায়। তখন হাতি করে কি দাঁত দিয়ে গাছটাকে এফোঁড়-ওফোঁড় করতে থাকে। ছেলেটা তো ভয়েই আধমরা, সবাই দূর থেকে বলে, ‘হাতি যা পারে করুক, তুই নামিস না। নামলে ও তোকে জিন্দা ছাড়লি না।‘ তারপর সন্ধ্যা নামতে নামতে হাতির মাথা বোধহয় ঠান্ডা হল বা নেশা কাটল, তখন সে আবার জঙ্গলে ঢুকে গেল। 


হাতির গল্প শুনে, হাতি দেখে, রাতের জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে পাগলের মত টর্চ মেরে লেপার্ড খুঁজতে গুঁজতে আমরা যখন বড়েইপানি নেচার ক্যাম্পে পৌঁছালাম তখন রাত নটা। আজ মেঘলা ছিল বলে সোলার ব্যাটারি বসে গেছে। কটেজ গুলো ছাড়া বাকি সবকিছু ঘুট্ঘুটে অন্ধকারে নিমজ্জিত। অনেকরাতে উঠল মরা চাঁদ, জেনারেটরের আলোয় কোন মতে ডিনার সেরে ফাঁকা চত্বরে যখন পায়চারি করছি,মনে হল আজই শেষ রাত। কাল থেকে আবার আমাদের ঘিরে থাকবে ইঁট আর কনক্রিটের জঙ্গল। কাল অপরাহ্নের মধ্যেই আবার সভ্যতায় ফিরে যাব আমরা। এসে পড়বে ফোনের টাওয়ার। ঢুকবে গুচ্ছের নোটিফিকেশন, মেসেজ আর মেল। সেটা একই সাথে কাম্য আবার অকাম্যও বটে।





নিয়ম মত, ঠিক সকাল সাড়ে ছটায় জিভ কড়া নেড়ে এসে হাজির হল জিভ পুড়ানো সর সমেত মোটা দুধের চা। অত সকলেও ঝকঝকে রোদে ভেসে যাচ্ছে চরাচর। হরেক রকম গাছের, হরেক রঙা পাতায় লুকোচুরি খেলা রোদ তৈরি করছে বিচিত্র রামধনু। আগের দিনের মতই,স্নানাদি সেরে, ঠিক নটায় আটার পরোটা, জলজলে ঘুঘনি, গরম অমলেট আর মিষ্টি উপমা দিয়ে প্রাতরাশ সেরে আমরা বেরিয়ে পড়লাম বড়েইপানি নেচার ক্যাম্প থেকে। আজ বিকালে আর ফিরে আসব না আমরা। 


 গন্তব্য বাড়ি, পথে পড়বে জোরাণ্ডা জলপ্রপাত। জোরাণ্ডা দেখে আমরা বারিপদা হয়ে ফিরে আসব তাম্রলিপ্ত নগরী। যদিও বড়েইপানি থেকে বারিপদা যাবার পথেই পড়ে জোরাণ্ডা, তবে বেশ অনেকটা ভিতরে। পৌঁছানোর পথ যথারীতি নয়নাভিরাম, কোথাও ঘন জঙ্গল, কোথাও বা ফাঁকা উপত্যকা। উপত্যকা ঘিরে ছোট ছোট আদিবাসী গাঁ। ছোট আশ্রম। কোথাও স্কুল ইউনিফর্ম পরে স্কুল যাচ্ছে কচিকাচার দল। উদ্দাম হাত নাড়াচ্ছে চলন্ত গাড়ির উদ্দেশ্যে, কোথাও বা সাইকেলে মস্ত একটা গাছের গুঁড়ি চাপিয়ে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে চার পাঁচ জন পুঁচকে ছানা সিমলিপাল মোটেই একঘেঁয়ে নয় যাই বলুন। 


জোরাণ্ডা সিমলিপালের সবথেকে জনপ্রিয় ট্যুরিস্ট স্পট। যেহেতু বারিপদা বা লুলুং থেকে মাত্র দু আড়াইঘন্টা তাই প্রচুর ডে ট্যুরিস্ট আসেন। তারওপর আমাদের মত লোকজন তো আছেই, যাঁরা জঙ্গলেই রাত্রিবাস করেছেন। তাই জোরাণ্ডায় একটু সকাল সকাল যাওয়াই মঙ্গল। মোটামুটি এগারোটার মধ্যেই জোরাণ্ডা পৌঁছালাম আমরা। তখনও বেশ ফাঁকা। উঁচু পাহাড়ের ওপর থেকে সিঙ্গল ড্রপ ওয়াটার ফল, অনেকটা মেঘালয়ের নওকালিকাই এর মত। তবে নওকালিকাই জলপ্রপাতের নীচের পুলটা যেমন টলটলে নীল, এটা তেমন নয়। সাদা বা ঘোলাটে মনে হবে। জোরাণ্ডা জলপ্রপাতকে ঘিরে গহীন জঙ্গল, আগে এখানেও একটা নেচার ক্যাম্প ছিল, মাওবাদী হামলার পর বন্ধ হয়ে যায়। 


জোরাণ্ডা থেকে পিথাবাটা গেট আসতে সময় লাগে আরো ঘন্টা দু আড়াই। এদিকে জঙ্গল যেন আরো ঘন, পাহাড় ও অনেক বেশি খাড়া। জন্তুজানোয়ার তেমন না মিললেও ময়ূর মেলে ভুরিভুরি। যত ঢলে পড়ে সূর্যি মামা, ততো বাড়ে ময়ূরদের আনাগোনা। আর কত যে বিচিত্র ফুল ফুটে থাকে এই পথে, খোলা জানলা দিয়ে হুড়মুড় করে ফুলেল সুবাস বয়ে আনে দুষ্টু বাতাস। 


পিথাবাটা গেট দিয়ে বেরিয়ে আসার পর গাইড দাদা বললেন,‘ দাদা লুলুং দেখবেন নাকি?’ পিথাবাটা থেকে আনুমানিক তিন কিলোমিটার। লুলুং নদীর ধারে গড়ে উঠেছে গোটা দুই বিলাসবহুল রিজর্ট। জঙ্গল দেখে বেরোলে বড় আলুনি লাগে সবকিছু। তবুও গেলাম আমরা,সরু পাথুরে খাত ওয়ালা প্রায় শুকিয়ে আসা নদী। একটুও ভালো লাগল না। গাইডদাদা হেসে বললেন,‘ভালো লাগলি না তো? আমি জানতাম। তবে অনেকে এসে এখেনেই থাকে কি না। আপনি সিমলিপাল দেখে যখন কলকাতায় যাবেন, লোকজন বলবে, লুলুং দেখোনি? তাহলে তো কিছুই দেখোনি। লুলুংটাই তো আসল। আমি বাঙালিদের জানি, তাই বললি, একবার দেখে লিন দাদা।’




(শেষ)

Friday 1 April 2022

তুত্তুরী উবাচ ১লা এপ্রিল, ২০২২

 


👧🏻- মা জানো তো,আমি আজ গুগল অ্যাসিস্টান্টকে জিজ্ঞেস করেছিলাম,‘তোর সিক্রেট কি রে?’ ও বলল,' আমি কক্ষনো স্নান করি না। তোর মতই দুর্গন্ধ কালু।’( প্রসঙ্গতঃ যারা জানেন না, তাদের অবগতির জন্য জানাই, দুর্গন্ধ কালু 🐕হল, কি যেন একটা কার্টুনের অন্যতম চরিত্র। যাঁর গা দিয়ে ভয়ানক বোঁটকা গন্ধ বেরোয়, এবং তিনি প্রায় শুধু বগল তুলেই, প্রতিদ্বন্দ্বীদের ঘায়েল করে দেন।)


👩🏻-ভাগ!


👧🏻- হ্যাঁ গো মা, সত্যি। আমি প্রশ্ন করলাম।,‘হোয়াটস্ ইয়োর ডার্ক সিক্রেট।’ ও বলল,‘মেনি। ফর এক্সামপল্ আই ডু নট বেদ্।’


👩🏻- (কেজো সুরে) ও চান করুক বা না করুক, তোমায় যে করতেই হবে মা। 


👧🏻-(বেজার মুখে চানঘরের দরজা অবধি পৌঁছে, আচমকা ঘুরে গিয়ে, উৎসাহী সুরে) মা তুমি সেদিন বলছিলে না, ব্যাঙ্কের পাসওয়ার্ড ভুলে গেছ, আমি একটা ভালো পাসওয়ার্ড ভেবেছি তোমার জন্য, যেটা তুমি ভুলতেই পারবে না। কি বলো তো? পাসওয়ার্ড দাও,‘মিঠুনদা, নাচুন না।’🕺🏻🕺🏻

Sunday 20 March 2022

অনির দোলের ডাইরি ২০২২

 

অনির দোলের ডাইরি ১৬ই মার্চ, ২০২২ 

#তাম্রলিপ্তকড়চা 

সত্যি কথা বলতে কি,বিগত সোম এমনকি মঙ্গলবার সকালেও জানতাম না, আমাদের দোল কেমন কাটবে। শাশুড়িমাতা তখনও হাসপাতাল বন্দী। বিগত শুক্র-শনিবারই ছেড়ে দেবার কথা ছিল, কিন্তু বয়সজনিত নানা জটিলতার জন্য আরো কিছু টেস্ট লিখে বসলেন যে ডাক্তারবাবু। জানালেন নিশ্চিন্ত হয়ে তবেই ছাড়বেন ভদ্রমহিলাকে। সত্যিই তো, বাড়ি নিয়ে যাবার পর যদি দেখা দেয় নতুন কোন উপসর্গ, তাহলে তা সামাল দেওয়া হয়ে দাঁড়াবে কঠিন চাপের ব্যাপার। 


সোমবার দিন একখান মহাযন্ত্রণাদায়ক পরীক্ষা অন্তে হাসপাতাল কতৃপক্ষ জানালেন, তাঁদের মতে সম্পূর্ণ সুস্থ বৃদ্ধা। কারণ অপুষ্টি ছাড়া তেমন কিছুই মেলেনি। এবার প্রয়োজন দিন কয়েকের ভরপুর বিশ্রাম আর অনেক অনেক পুষ্টিকর খানা। এটা খাব না, ওটা খাব না, সবার শেষে হাঁড়ি চেঁচে খাব, চিকেন খাব না, দুধ খাব না, ডিম খাব না মার্কা বায়নাক্কা আর চলবেনি। খেতে হবে জম্পেশ করে তাহলেই চাঙ্গা হয়ে উঠবেন পূর্বের মত। ফিরে পাবেন হারানো বিক্রম। 


শাশুড়ী মাতার গৃহপ্রবেশের পর মিটিং এ ডাকলাম সবকটাকে, বক্তব্য একটাই, তোমরা কি আদৌ বসন্তোৎসবে আগ্রহী? চুঁচুড়া হলে এ প্রশ্ন ছিল নিছক বাতুলতা মাত্র, করতেই হত না, ওরা নিজেরাই হল্লা করে সবকিছু ঠিক করে এসে আমায় শুধু জানিয়ে দিত। 


এদের সঙ্গে প্রথম দোল, না এরা আমায় ভালো চেনে, না আমি এখনও তল খুঁজে পেয়েছি। তাছাড়াও এদের এ প্রশ্ন করার অন্য কতগুলি কারণ  আছে, একে তো এই আপিসে রঙ-আবির সুদূর অতীতে কখনও এসেছে বলে কেউ দাবী করে না, তদুপরি কিছুদিন আগেই আমরা সাধ্যমত সমারোহে বিদায় জানিয়েছি আমাদের তিন প্রিয় ইন্সপেক্টর সাহেবকে।  তার পক্ষকালের মধ্যে এমন আয়োজন, তাও এতজনকে নিয়ে,মোটেই মুখের কথা নয়। 


সিকেসিও শান্তনু তো একগাল হেসে বলল,‘ হ্যাঁ হবে ম্যাডাম।’ ইন্সপেক্টর সৌরভ বলল,‘ম্যাডাম, আমরা আপনার বাড়ির কথা ভেবে ভয় পাচ্ছি একটু।’ আশ্বস্ত করলাম, বাড়ির কথা ভেবে চাপ নেবার দরকার আপাততঃ নেই, শাশুড়ীমায়ের পুরানো জোর ফিরে পেতে সময় লাগবে বটে, তবে তিনি তো ঠিকই আছেন। শৌভিক আর আমার পাঁচ বুড়োবুড়ির সংসার, উভয়ের মা-বাবা তো আছেনই,সর্বোপরি আছে আমার পিসি, কিছু না কিছু তো আমাদের নিত্যসঙ্গী। তাই আমরা দুজনেই কালকের চিন্তা না করে কেবল আজকের ওপর বাঁচি। 


ফিরে যাই টিম তাম্রলিপ্তর বসন্তোৎসবে, ঠিক হল প্রতিটা ব্লক/মিউনিসিপ্যালিটির জন্য বরাদ্দ হবে একটা বিশেষ রঙের আবির। বললাম, এক প্যাকেট করেই আনতে বলো, গতবছর বলাগড়ের শ্যামল দশ কেজি লাল আবির আর দশকেজি পলাশ ফুল আনবে বলে আমাদের হেবি চাপে ফেলে দিয়েছিল। কে কোন রঙ আনবে এটা টিম চুঁচুঁড়ার লোকজন নিজেরাই ঠিক করে নিত। প্রিয়াঙ্কার ওপর দায়িত্ব থাকত, এক রঙ যেন দুটো LWFC থেকে না আসে তার ওপর নজর রাখা। প্রিয়াঙ্কা সত্যিই বাঘ থুড়ি বাঘিনীর মত নজর রাখত। এখানে তো আর রমেশ, শ্যামল বা প্রিয়াঙ্কা নেই, তাই কোন সাব টিম কি রঙ আনবে তা নির্ধারণের দায়িত্ব সৌরভ আর জসুয়া নিজেদের ঘাড়ে তুলে নিল। 'আমরাই বলে দিই এ বছর ম্যাডাম। পরের বার দেখা যাবে।'


এরপর আসে খাবার, তহবিলের যা সাংঘাতিক অবস্থা, মেন্যু তাই একেবারে পকেট তথা চাঁদা ফ্রেণ্ডলি। মঠ-ফুটকড়াই-লস্যি আর সিন্নি। গত বছরও এই মেন্যুই হয়েছিল টিম চুঁচুড়ার বসন্তোৎসবে। সিন্নি মাখা, ফল কোচানো, লস্যি বানানো সব করেছিল আমাদের পোলবার মিঠুদি-দেবী দি আর বাঁশবেড়িয়ার মহুয়াদিরা।প্রিয়াঙ্কা,ঝুমা, চন্দ্রা, পূজারা তো ছিলই, সর্ব ঘটে কাঁঠালি হয়ে, সর্বত্র বিরাজমান। বাড়ি থেকেই সব বাসনকোসন এনেছিল আমার পুরানো টিমের মেয়েরা। এখানে মেয়ে কোথায়? মেয়ের সংখ্যা ভয়ানক সীমিত তার থেকেও সীমিত তাদের উৎসাহ।


শুভদীপ্তর বাড়ি সবথেকে কাছে,থালা বাসন আনার দায় পড়ল শুভদীপ্তর ওপর। আর সিন্নি মাখবে কে? সৌম্যজিৎকে ধরা হল,‘ তুই মাখ না ভাই। তুমি এই আপিসের সবথেকে পরিচ্ছন্ন ব্যক্তি, কনুই থেকে সাবান না দিয়ে কিছু খাও না। তুমিই পারবে।’ প্রথম চোটে সৌম্যর ঘোর আপত্তি ছিল অবশ্য, সত্যনারায়ণ পুজো ভিন্ন সিন্নি মাখায়। চুঁচুড়ার বিগত চার পাঁচ বছরের দোলের গল্প শুনিয়ে, ছবি দেখিয়ে আশ্বস্ত করলাম, পুজো ছাড়াও দিব্যি সিন্নি মাখা হয়েছে, খাওয়া হয়েছে, তাও ঈশ্বরের কৃপায় সবাই ঠিকই আছি। 


সৌম্যর লিস্টি মোতাবেক সিন্নির উপকরণ কেনাকাটার দায়িত্ব ভাগ করে নিল সকলে। মুস্কিল হল আমার মঠ-ফুটকড়াই বোঝাতে। আমি-সৌরভ আর জসুয়া হাওড়ার লোক,আমরা ব্যতীত কেউ বুঝতেই পারে না যে মঠ কারে কয় আর ফুটকড়াইটাই বা কি। শেষে আমাদের রবিবাবুর ঘাড়ে দায়িত্ব পড়ল, বাগনান থেকে মঠ-ফুটকড়াই কিনে আনার। ওগুলো ছাড়া আবার বাঙালীর দোল হয় নাকি। মঙ্গলবার রাত আটটায় রবিবাবুর ফোন,‘ম্যাডাম বুঝতে পেরিছি। তাহলে কি এখনই কিনে নেব?’ না না পাগল নাকি, বুধবার রাতের আগে কিনবেন না, পিঁপড়ে ধরে যায় যদি।


বুধবার সন্ধ্যায় আবার ফোন করে যখন রবি বাবু জানতে চাইছেন 'কতটা নেব ম্যাডাম', তখনই অন্য ফোনে শুভদীপ্ত জানাচ্ছে, কাল ডেপুটেশন দিতে যাবে সব CKCOরা। ফলে আমাদের বসন্তোৎসবে থাকতে পারবে না কেউই। তবুও বললাম, যদি পারো, কাজ মিটিয়ে জলদি ফিরো অন্তত চেষ্টা করো। অফিস টাইমের পরও নাহয় খানিক অপেক্ষা করব আমরা। আমার CKCO দের ছাড়া, আমার বসন্তোৎসব ভালো লাগবে কি একটুও? ঠিক তখনই ইন্সপেক্টর সঞ্জয় বলছে, 'ম্যাডাম কাল হয়তো আমিও থাকতে পারব না।' রঞ্জিত বলল, 'ম্যাডাম আমি তো ময়না যাব, জানি না সময় মত ঢুকতে পারব কি না!' ইত্যাদি প্রভৃতি। একবার ভাবলাম দিই সব বাতিল করে। তারপর মনে হল, থাক। দেখাই যাক না। কি নিয়ে আসে আগামী কালের সকাল।

অনির দোলের ডাইরি, ১৭ই মার্চ, ২০২২

#তাম্রলিপ্তকড়চা 

প্রতি বছর দোলে একটা করে হলুদ শাড়ি নষ্ট হয় আমার। আপিস থেকে রঙ আবির মেখে এমনি ভূত হয়ে বাড়ি ফিরি যে বাবা হাজারবার কেচে, ভ্যানিশ দিয়ে ধুয়েও মুছতে পারে না, গায়েব করতে পারে না শতরঙ্গী দাগছোপ গুলো। এবারে অবশ্যি কি হবে জানি না। সিকেসিওরা তো বলেই দিয়েছে থাকতে পারবে না। সংগঠনের ডাকে, ছুটি নিয়ে দল বেঁধে নবান্ন অভিযানে যাবে সব। দুজন ইন্সপেক্টর সাহেব বলেছেন, তাঁরা ব্লকের কাজ মিটিয়ে হাজিরা দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করবেন। এসএলও/সিএদের তরফ থেকেও মেলেনি তেমন সাড়া। এদিকে আমাদের রবি বাবু যে বাগনান থিকে এক না দেড় কেজি ফুট কড়াই আর পাঁচশ মঠ কিনে আনতেছেন। তার কি হবে? কে খাবে? কে জানে?


বেলা এগারোটা, অন্য দিনের থেকে আজ যেন একটু বেশিই ফাঁকা আঞ্চলিক শ্রমদপ্তর তাম্রলিপ্ত। ঢুকতেই বাঁদিকে গম্ভীর মুখে কাজ করছেন হক বাবু, গুনগুন করে কীর্তন ধরেছেন জহর বাবু। জহর বাবু অবশ্যি গুনগুন করে গাইতে পারেন না, উদাত্ত স্বরেই গান,তবে আমায় দেখলেই শুনেছি কমে যায় গানের ভল্যুম। দুয়ারে সরকারের সময়, আমার অনুপস্থিতিতে ফাঁকা অফিসে ওনার গানের বহর শুনে নাকি ছুটে আসত আশেপাশের দপ্তরের লোকজন। সেদিন ক্যাম্প থেকে বেখাপ্পা সময়ে আপিসে ফিরে দেখলাম কারা যেন রেকর্ড করছিল জহর বাবুর টপ্পা। 


ইন্সপেক্টর বলতে আজ কেবল জসুয়া আর সৌরভ। বদলির পর্ব মিটে অবশিষ্টই তো আছে চারজন, তার মধ্যেও সঞ্জয় আর রঞ্জিত ভুগছে দোলাচলে। এ ব্যাটারা দেখি আনন্দ করতেই জানে না।  বিলের পাহাড় পড়ে আছে বলে রয়ে গেছে শুভাশিস, আর আছে অরূপ আর রবিবাবু। এমনকি চঞ্চলও আজ ছুটি নিয়ে মায়াপুর গেছে।আর আছি, সৌম্যজিৎ আর আমি।


বেলা একটা নাগাদ সৌম্য একবার মুখ গলিয়ে প্রশ্ন করল,' ভেবে দেখ দিদি,সিন্নি কি সত্যিই মাখা হবে? তোমার লোক কোথায়?' সত্যিই লোক কোথায়? সৌরভ যদিও আশ্বস্ত করল, সঞ্জয় বলেছে আসবে। আর ময়নার কাজ মিটিয়ে রওনা দিয়েছে রঞ্জিত। তাহলেও দেড় কেজি ফুটকড়াই আর পাঁচশ মঠ, একটু কেন, অনেকটা বেশি হয়ে যাবে নি? 


বেলা দুটো নাগাদ ক্যান্টিন থেকে ফরমায়েশ মোতাবেক এককেজি আটা, পাঁচশ দুধ, আর একছড়া কলা দিয়ে গেল। সৌম্যজিতের ফরমায়েশ মোতাবেক দু একটা আপেল, একটা বেদানা, অল্প একটু আঙুর, কাজু আর কিশমিশ ভাগ করে কিনে এনেছেন হক বাবু আর শুভাশিস। 


 লস্যিটা ক্যান্টিনকেই করতে বলা হয়েছে। ওরা প্রস্তাব দিয়েছিল আমূল লস্যির প্যাকেট কিনে সরবরাহ করবে। এক কথায় উড়ে গেছে সে প্রস্তাব। একে তো দাম অনেক বেশী পড়বে, আর দ্বিতীয়তঃ ডাল ঘোঁটা আর টক দই দিয়ে বানানো বরফ ভাসা লস্যির কোন তুলনাই হয় না। 


বেলা তিনটে, পাঁশকুড়া থেকে চলে এল বৈদ্যনাথ। যাক তবু তো একটা লোক বাড়ল। বাকি সিকেসিওদের খবর কি? ওরা নাকি এখনও ফিরতি বাসেই চাপেনি। 


বেলা সাড়ে তিনটে, চণ্ডীপুর থেকে সাত জন এসএলও এল, আর পাঁশকুড়া থেকে ছায়া। তাও হলুদ শাড়ি পরে।  আমার আনন্দ দেখে কে?  যাক্ আরও একটা অন্তত মেয়ে পাওয়া গেল। পাঁশকুড়া আর ময়না থেকে কাজ মিটিয়ে এসে হাজির হল দুই ইন্সপেক্টর সাহেব ও। অরূপের আনা মস্ত পিতলের পরাতে ঢালা হতে লাগল একের পর রঙ। এবার তাহলে সিন্নি মাখা হোক।


মাখবে কে? যাঁর ঘাড়ে সিন্নি মাখার গুরু দায়িত্ব তিনিই তো নিরুদ্দেশ। ধুত্তোরি বলে হক বাবু আর শুভাশিস সুতো কাটার ছুরি দিয়ে আপেল কুচাতে নেমে পড়ল। ক্রমেই ভিড় বাড়ছে, এসএলও সিএদের মধ্যে যে এমন সাড়া পড়েছে তা ছাতা আমরা সকাল থেকে টেরই পায়নি।  রঙের থালার কাছে ঘুরঘুর করা কটা ছেলেকে জোর করে পাঠালাম শুভাশিস আর হকবাবুকে হেল্প করতে। ওরে সৌম্য, এবার এসো ভাই, এদের যে আর সামলে রাখা যায় না। ব্যাটারা না হলে সিন্নি মাখার আগেই সব রঙ মেখে ভূত হয়ে যাবে। 


বিকেল চারটে, অরূপের আনা মস্ত পিতলের গামলায় এক কেজি আটা ঢেলে স্ট্যাচুর মত দাঁড়িয়ে আছে সৌম্য, কি রে ভাই, মাখ? ক্ষুব্ধ স্বর ভেসে আসে, 'এক কেজি আটা আর পাঁচশ দুধ? আরও অন্তত দেড় লিটার দুধ লাগবে দিদি।' আশিস আর রবি বাবু দৌড়লেন দুধ আনতে। দোলের ছুটির আগের দিন বিকালের অফিস পাড়া, দুধ কোথায় মিলবে কে জানে? গুড়ের ও আব্দার ছিল বটে, বদলে পাওয়া গেছে এক প্যাকেট গুড়ের বাতাসা। সে সমস্যা না হয় জহর বাবুর চায়ের চিনি মেটালো, দুধটার যে কি হবে? 


টেনশনে গুটি কয়েক ভাঙা কাজুই খেয়ে নিলাম আমি। কটা আঙুরও খাবার ইচ্ছে ছিল, ঊপস্থিত জনগণের সমালোচক দৃষ্টি অনুভব করে গুটিয়ে নিলাম হাত। 


 সিকেসিও গুলোই বা কতদূর পৌঁছালো? কেউ ফোনই তোলে না ব্যাটা। তাঁদের মধ্যে আবার শুভদীপ্ত, সৌমেন,নন্দন আর শান্তনু এই চারজন নাকি আসছেন বাসে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আর ট্রেনে আসছে সুরজিৎ। যাতে পারিস আয় বাবা, এসে আমাদের ধন্য কর।


 দুধ এসে পৌঁছায়, সাথে আসে এক টিন কনডেন্সড মিল্কও। উফঃ কি বুদ্ধি মাইরি। যা জমবে না আজকের সিন্নিটা। জমেই উঠেছিল সবকিছু, মাঝখান থেকে যদি কনডেন্সড মিল্কের ক্যানে হাতটা না কাটত সৌম্য। শুভাশিস নিষেধ ও করল, 'স্যার ছেড়ে দিন, যতটা পড়তেছে পড়ুক, বাকিটা সামান্য জল দিয়ে গুলে নিলেই হবে।' কিন্তু ততক্ষণে ক্যানে হাত ঢুকিয়ে চাঁচতে শুরু করে দিয়েছে যে সৌম্য। 


উফঃ সে কি রক্ত। ধুয়ে আসা হল, চিনি দিয়ে চেপে ধরা হল, ব্যান্ডেড দেওয়া হল, রক্ত আর বন্ধ হয়ই না। সেলাই করতে হবে নাকি?বাইরে বিদায় নিচ্ছে দোলের আগের বিকাল, এখুনি নামবে সন্ধ্যা। এই ভুষুণ্ডির মাঠে ডাক্তার পাব কোথায় আমরা? ওই অবস্থাতেই হাতটা চেপে ধরে আশিস দৌড়ল,ওদের স্যারকে নিয়ে কাছের ওষুধের দোকানে, মাসির আপিস পোঁছা ন্যাতা দিয়ে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত মুছতে মুছতে লিফট্ অবধি গেল দুজন এসএলও। কি যে হবে, হয়ে গেল আমাদের দোল। 


বাকিদের অবশ্য উৎসাহের ঘাটতি নেই, বহু দূর দূর থেকে এসেছে সবাই,এখনও আসছে। সঙ্গে এনেছে এবং আনছে পছন্দের রঙ, এসে গেছে লস্যি, রেডি হয়ে গেছে সিন্নিও। কোলাঘাটের দীপালি দিও এসে গেছেন হলুদ শাড়িতে সেজে গুজে, কোমর বেঁধে আমাদের মেয়েরা বাটিতে বাটিতে তুলছে সিন্নি। গ্লাসে গ্লাসে ঢালছে লস্যি। বেশ একচোট রঙও মেখে ফেলল জনগণ। যে যার ইন্সপেক্টর সাহেবের মাথায় আর গালে ভালো করে রঙ মাখাচ্ছে, রঙের থালা নিয়ে এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত ঘুরে বেড়াচ্ছেন জহর বাবু। গান গাইছেন, এ আমার গুরুদক্ষিণা। জিজ্ঞাসা করতে গেলাম, আজকের দিনে এমন গান কেন, উল্টে আমায় বললেন, ‘ম্যাডাম রঙ মাখবেন নি?’ 


মাখব তো। সৌম্যর হাতটা কি হয় আগে দেখি। যে ছেলেটা সাধ করে সিন্নি মাখল, তাকে বাদ দিয়ে কি করে মাখি বা খাই। আর শুভদীপ্ত-নন্দনরাই বা কখন আসবে? ফোনও ধরে না কেন আপদগুলো। অতিকষ্টে নন্দনকে পাওয়া গেল, ‘ম্যাডাম আমরা নিমতৌড়ি বাসস্টাণ্ডে নেমেছি।’ সন্ধ্যা প্রায় ছটা। আনন্দ আর উত্তেজনা চেপে জানতে চাই, আপিস আসছ তো? নাকি সারাদিনের ধকল শেষে বাড়ির পথ ধরছ সবাই? পাশ থেকে শুভদীপ্ত বলে,‘না ম্যাডাম। এতটা পথ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এলাম, আপিস যাব বলেই কি না।’ 


অতঃপর হাত সেলাই না করে, ভালো করে ব্যাণ্ডেজ বেঁধে ফিরে আসে সৌম্য আর আশিস। ক্যামেরা নিয়ে রেডি থাকে অরূপ। চার মক্কেল আপিসের চৌহদ্দিতে  পা রাখতেই-‘হোলি হ্যায়।’ যতই বলি, ওরে বাপ, এটা দোল। হোলি নয়কো। কে শোনে কার কথা।

Monday 14 March 2022

অনির ডাইরি ২০শে ফেব্রুয়ারি, ২০২২ #তাম্রলিপ্তকড়চা


 


নিমতৌড়ি চৌমাথা থেকে একটা রাস্তা ঢুকে এসেছে আমাদের আপিস তথা নব্য প্রশাসনিক ভবনের দিকে। বাঁহাতের রাস্তাটা চলে গেছে নন্দকুমার হয়ে দীঘার দিকে। ডান দিকের রাস্তাটা গেছে মেচেদা হয়ে কোলাঘাট টপকে সোজা মহানগর। আর মুখোমুখি উল্টো দিকের রাস্তাটা গেছে ময়নার দিকে। ময়নাই যাচ্ছি আমরা, আমি আর আমাদের উত্তমকুমার। গজগজ করতে করতে গাড়ি চালাচ্ছে উত্তমকুমার, বেশ খানিক বকুনি খেলাম আমিও, ময়না যেতে আগ্রহ প্রকাশের জন্য। যথারীতি আমার আগে কোন সাহেব, মেমসাহেব কোনদিন নাকি ময়নার ক্যাম্পে যায়নি। যাবেই বা কেন, ময়নার দুয়ারে সরকারের ক্যাম্প গুলো হয় ভীষণ ভিতরের দিকে, অধিকাংশ ক্যাম্পেই নাকি পৌঁছায় না মোটরচালিত চারচক্র যান। পৌঁছায় বটে টোটো আর বাইক। 


মহানগরের তুলনায় তমলুক শহরটা বড়ই ছোট, কেমন যেন মুঠো খুললেই শেষ। একটু গেলেই নদী আর পঞ্চায়েত এলাকা। এ পথে যেন আরো ঝপ করে শেষ হয়ে গেল শহরটা। ফাঁকা চকচকে রাস্তা, দুধারে গাছ আর গাছের ওপারে ঘন সবুজ গালচের মত ধানজমি। ধান চাষের গল্প শোনায় উত্তম। কেমন করে ধান রুইতে হয়, কেমন করে ধান কাটতে হয়। ধান কাটার আগে পরে বৃষ্টি নামলে কি হয়।  বিকাল বেলা কেমন মোলায়েম শীতল বাতাস ভেসে আসে ধান ক্ষেত থেকে, তখন নাকি আলের ওপর গিয়ে বসলে জুড়িয়ে যায় মন প্রাণ। শুনতে শুনতে মোহিত হয়ে জানলার কাঁচটা নামাতে গিয়ে আরেক চোট বকা খেলাম, ‘ধুলো ঢুকবেনি ম্যাডাম-’। 


আমরা চলেছি ময়না ব্লকের পরমানন্দপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের উদ্দেশ্যে। পঞ্চায়েত লাগোয়া হাবেলি হরিদাসপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বসেছে দুয়ারে সরকারের ক্যাম্প। চলতে চলতে কখন যেন শেষ হয়ে যায় ধান জমি, দুধারে জেগে ওঠে টলটলে জলের দীঘি। এরা বলে ঝিল। মাছ চাষের জন্য বিখ্যাত ময়না। যদিও তমলুকের বাজারুরা ময়নার মাছকে মোটেই নেক নজরে দেখে না। কিসব যেন ভিটামিন মিনারেল খাওয়ানো হয় এখেনকার মাছগুলোকে, তাই একটু বেশিই হৃষ্টপুষ্ট হয় নাকি তারা। উত্তমকুমার স্বগতোক্তি  করে, ‘জল দেখছেন ম্যাডাম? প্রায় রাস্তার লেভেল এ। কেন এখেনে বন্যা হবেনি বলুন দিকি?’ সত্যিই বন্যার জন্য বিখ্যাত ময়না। এই শুখা মরশুমেও টলটল করছে জল। কোথাও কোথাও আবার ঝিলকে ঘিরে উঠেছে বিশাল প্রাচীর, বসেছে সুউচ্চ দরওয়াজা। এক নজরে মনে হবে সারি সারি রির্জট বোধহয়। উত্তমকুমার বুঝিয়ে দেয়, ‘মাছের নিরাপত্তার জন্য এমনি বানাইছে ম্যাডাম। কোটি কোটি টাকার পোনা ছাড়া আছে এই সব ঝিলে। এক মুঠো লিয়ে লেওয়া মানেও কয়েক লাখটাকার মাছ চলে গেল। বুঝলেননি-’। 


উত্তমকুমারের আশঙ্কা সত্যি করে পরমানন্দপুর হাবেলি হরিদাসপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের রাস্তাটা দেখা যায় ভয়ানক সরু। গজগজ করতে করতে ময়নার ভারপ্রাপ্ত ইন্সপেক্টর রাজীবের মুণ্ডপাত করে উত্তম। ‘রাজীব স্যারকে বননু, এমন ভেনু ম্যাডামকে বলবেননি, যেখেনে গাড়ি যাবেনি-। ঠিক তেমনিই বললেন।এবার কাউরে পাঠান দিকি। ’ ফোনের ওপার থেকে আমার মুখচোরা ভালোমানুষ ইন্সপেক্টর আরো সংকুচিত হয়ে বলতে থাকে,‘ ম্যাডাম এটায় তাও কিছুটা গাড়ি আসবে, অন্যগুলোয় তো অনেকটা হাঁটতে হবে-’। আমার তো মজাই লাগছে। দুধারে ধান ক্ষেত, মাঝে সরু ঢালাই রোড, তার ওপর দিয়ে কোন মতে গড়াতে লাগল আমাদের গাড়ি,ইন্সপেক্টর সাহেবের নির্দেশে স্কুটি নিয়ে আমাদের আনতে এল SLO ছেলেটি, তার পিছে গাড়ি সবে গড়িয়েছে এমন সময় বাঁকের মুখে ভেসে উঠল একটা- দুটো- তিনটে টোটো আর গোটা দুয়েক বাইক। কোন মতে পিছু হঠে,টেড়ে বেঁকে খানিকটা এগিয়ে একটা বাঁশঝাড়ের তলায় এসে উত্তম বলল,‘ম্যাডাম রাগ করবেননি, কিন্তু আর গাড়ি যাবেনি।’ রাগের কি আছে, এতক্ষণ বসে থেকে পা ব্যথা করছিল বরং। SLO ছেলেটাকে ইশারায় বললাম, তুমি এগোও, আমি আসছি। আরো অনেকেই চলেছেন, পুকুরপাড় দিয়ে, বাঁশঝাড়ের তলা দিয়ে, গেরস্থের নিকানো আঙিনা আর গোয়ালঘরের পাশ দিয়ে, চতুর্দিকে যেন মেলা বসে গেছে। 


জনৈক মাসিমা, যেচেই বললেন, ‘কোথা যাবে মা?’ জানালাম ক্যাম্পে যাব, দুয়ারে সরকারে। মাসিমা বললেন,‘আমিও যাতেছি তো। তুমি আমার সঙ্গে এসো।’ প্রায় এক কিলোমিটার রাস্তা গপ্প করতে করতে গেলাম, মাসিমা প্রায় পুলিশের মত জেরা করে জানলেন আমার বিয়ে কবে হয়েছে, বর কি করে, ছেলেমেয়ে কটি, কত বড়, আমি কি 'কাস সাটিফিকেট'এর জন্য যাতেছি নাকি লক্ষ্মীর ভাণ্ডার করব ইত্যাদি প্রভৃতি। বরের পরিচয় ব্যতিরেকে সব সত্যি কথাই বললাম বটে। স্কুলের গেটেই দাঁড়িয়ে ছিল রাজীব, গেলাম, কাজ দেখলাম, গুটি কয়েক সার্টিফিকেট পাশবই বিতরণ করে ছবি তুলে, প্রধান সাহেবের সঙ্গে কিঞ্চিৎ কুশল বিনিময় করে বেরিয়ে আসছি, কে যেন বলল, ‘চণ্ডী মন্দিরটা দেখে যাবেননি ম্যাডাম। খুব জাগ্রত। কত্ত বিয়ে হয় জানেননি। খুব সোন্দর মন্দির। দুদিকে ঝিল, মাঝে মন্দির।’ 


আবার এককিলোমিটার হেঁটে এসে গাড়িতে উঠলাম, এবার অবশ্য রাজীব, দুই SLO  সুপ্রিয়া এবং সেই ছেলেটিও এল গল্প করতে করতে। গাড়িতে উঠে উত্তমকুমারকে চণ্ডী মন্দিরের কথা বলে আরেক চোট বকা খেলাম, ‘বেশি পাকা সব। আমি তো লিয়ে যেতামই। এ রাস্তায় আসবেন আর চণ্ডীমায়ের মন্দির যাবেননি?কত বিয়ে হয় দেখবেন চলুন। বর্গভীমা মন্দিরে যত বিয়ে হয়, এখেনে অত হয়নি, তবে এখেনে বিয়ের খর্চা বেশ কম।’ সত্যিই দুদিকে জলাভূমি মাঝে একটা ছোট মন্দির। ভিতরে বড় পট আছে বটে, কোন বিগ্রহ নাই। শুনলাম বিসর্জন হয়ে গেছে। আসছে বৈশাখ না শ্রাবণে মস্ত মেলা বসবে হেথায়। দেখলাম বিয়ে হচ্ছে একদলের, আরেকদল অপেক্ষমান। আরো একদল সাজুগুজুতে ব্যস্ত। বাইরে অনেকটা খোলা চত্বর, দাঁড়িয়ে আছে সারি সারি গাড়ি।  সুন্দর সাজানো গোছানো ঝিলের পাড়, প্রখর মধ্যাহ্নেও ভেসে আসছে ঠাণ্ডা বাতাস। সত্যিই দুদণ্ড জিরোবার আদর্শ স্থান বটে। বড় ভালো লাগল। ময়না এলে আসতে ভুলবেননি কিন্তু।

Thursday 10 March 2022

অনির ডাইরি ১০ই মার্চ, ২০২২

 


‘এই মা, একটা বিরাট গড়বড় হয়ে গেছে!' তাম্রলিপ্ত নগরী ছেড়ে চলেছি মহানগরের উদ্দেশ্যে,কিছুক্ষণ আগে সদ্য টপকেছি রূপনারায়ণ নদ তথা কোলাঘাট ব্রীজ, এমন সময় তুত্তুরীর আর্ত চিৎকার। ঘচাং করে ব্রেক কষল আমাদের উত্তমকুমার, সামনের সিট থেকে হায় হায় করে উঠল তুত্তুরীর মাসিও,‘ কি হয়েছে সোনা মা?’ 


সোনামা ওরফে তুত্তুরীর মুখ চুন, কাচুমাচু হয়ে জানাল মহানগরে ফেরৎ আসার উন্মাদনায় অন্তিম মুহূর্তে জুতো না বদলে, বাড়িতে পরার হাওয়াই চপ্পলটাই পায়ে গলিয়ে চলে এসেছেন তিনি।  গাড়ির সামনের সিটে বসে কপাল চাপড়ায় মাসি, উৎকণ্ঠিত স্বরে জানতে চায়, ‘গাড়িটা কি একবার ঘোরাবে?’ স্টিয়ারিং উল্টোদিকে ঘোরাতে প্রস্তুতও হয়ে যায় অামাদের উত্তমকুমার, প্রয়োজন বলতে শুধু আমার অনুমতিটুকু। অনুমতি কে দেবে, আমি তো হেসেই খুন। কি ভোম্বল বাবু তুই। এবার থাক হাওয়াই চটি পরে,গাড়ি ঘোরানোর সময় কি আমার আছে? সময় মত পৌঁছাতে হবে মহানগর, প্রথমে জমা করতে হবে তুত্তুরীর পরীক্ষার খাতা, তারপর গিয়ে কথা বলতে হবে হাসপাতালের ডাক্তারবাবুর সঙ্গে, তারপর ভিজিটিং  আওয়ারে গিয়ে মোলাকাৎ হবে শ্রশ্রুমাতার সঙ্গে। গত সোমবার থেকে যিনি হাসপাতালবাসিনী। এত ব্যস্ত শিডিউলের মধ্যে তুত্তুরীর হাওয়াইচটির জন্য ব্যয় করার মত সময় বিলাসিতা আমার সত্যিই নেই।  


কিসের উন্মাদনায় তিনি হাওয়াই চটি পরেই চার চক্র যানে সওয়ার হয়েছেন তা টের পেলাম অচীরেই। বিমানবন্দরের এক নম্বর গেট গলে গাড়ি দৌড়তে শুরু করেছে মসৃণ ভিআইপি রোড ধরে, বাইরে চোখ ধাঁধানো রোদে ঝলসে যাচ্ছে চোখ, এমন সময় তুত্তুরীর প্রাণের বান্ধবীর জননী, যিনি আবার সম্পর্কে আমার অন্যতম ঘনিষ্ঠ বান্ধবী,তাঁর ফোন। বক্তব্য অত্যন্ত সরল, শ্রীমতী তুত্তুরী ওরফে পুরোযা এবং শ্রীমতী ঈশাণী উভয়ে মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, আজ তাঁরা মিলিত হবেনই। মায়েরা সঙ্গে থাকতে পারলে ভালো, নতুবা আবাসনের দুর্গা পুজোর মাঠেই সমবেত হবেন দোঁহে। এতদিন দেখা হয়নি, আর কি দেখা না করে থাকা যায়, বিশেষতঃ যাদের বার্ষিক পরীক্ষার পাঠ বিগতকালই চুকেছে। 


বেচারা মায়েরা আর কত কাবাবের হাড় তথা কন্যাদের চক্ষুশূল হবে। অগত্যা জানালাম, ঠিকই আছে, দেখা তো করতেই হবে,সন্ধ্যা ছটার পর বাড়ির সবথেকে কাছের রেঁস্তোরায়। 


 মাসি সমেত শ্রীমতী তুত্তুরীকে বাড়ি পৌঁছে, টুকটাক দোকানবাজার সেরে গেলাম তাঁর স্কুলে। আর এই স্কুলে আর পড়বে না তুত্তুরী, ভাবতেই ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে হৃদয়। এই তো সেদিন ছেড়ে গিয়েছিলাম আমার পুঁচকে দুধের বাচ্ছাটাকে, এই স্কুলের মস্ত গেটে। গিয়েছিলাম আর কোথায়, দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে ভিড়ের নজর এড়িয়ে অঝোরে কাঁদছিলাম আমি, ভাবছিলাম যা ন্যাদোশ, ভোম্বল বাচ্ছা আমার, নিজের ক্লাশরুমটা কি  খুঁজে পাবে? আর দরজার এপারে দাঁড়িয়ে আমার জন্য কেঁদে ভাসিয়েছিল তুত্তুরী। শেষ পর্যন্ত অবশ্য কি ভাবে যেন কার হাত ধরে নির্ধারিত ক্লাসে পৌঁছেও গিয়েছিল। ছুটির ঘন্টা পড়ার পর, প্রি নার্সারির ক্লাশে গিয়ে আর খুঁজে পাই না মেয়েকে, কোথায় গেল!তারপর দেখি, কাঁদতে কাঁদতে সামনের বেঞ্চে মাথা রেখে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছে মেয়েটা আমার। প্রথম দর্শনেই এত ভালোবেসে ফেলেছিল, ক্লাশ টিচার, যে বকা তো দূরস্থান, ঘুমটুকুও ভাঙ্গায়নি মেয়েটার। আট বছর সেই স্কুলে কাটিয়ে, প্রিয় মিস, প্রিয় স্যার, প্রিয়তম বন্ধুবান্ধবদের সবাইকে ছেড়ে আজ অন্য স্কুলে ভর্তি হবে আমার তুত্তুরী।


ডাক্তার বাবু বললেন, আরো দুই ইউনিট রক্ত লাগবে। বড় আশা নিয়ে এসেছিলাম আজ, ভেবেছিলাম হয়তো ছেড়ে দেবার কথা বলবেন ডাক্তার বাবু। তেমনিই আভাষ দিয়েছিলেন গতকাল শৌভিককে। তাই না আজ ও তমলুক গেছে আর আমি এসেছি হাসপাতাল। শাশুড়ি মায়ের হিমোগ্লোবিন নেমে গিয়েছিল তিনেরও নীচে। চার পাউচ রক্ত ইতিমধ্যেই দেওয়া হয়েছে তাঁকে, রক্ত দিতে গিয়েছিলাম আমরাও, আমার হিমোগ্লোবিন সাড়ে এগারোরও বেশি, তাও নেয়নি ব্লাড ব্যাঙ্কের দিদি। ১২বা সাড়ে ১২র নীচে হলে নেবে না। রক্তের রিকুইজিশন নিয়ে এবাড়ি সেবাড়ি দৌড়চ্ছি, ডোনার ছাড়া দিতে চাইছেন না ওণারা। রাগও করতে পারছি না,সত্যিই তো, ওণারাই বা পাবেন কোথা থেকে, টাকা দিয়ে তো আর রক্ত কেনা যায় না। তমলুক থেকে ফোন করে শৌভিক, আর একজন ডোনার মিলেছে। ওরই সহকর্মী। কিন্তু আজ তো আর আসতে পারবে না, কাল দুপুরের আগে সম্ভব নয়। তাই বলে, রাজি করিয়ে, বিল মিটিয়ে, দু পাউচ রক্ত নিয়ে দেখা করতে গেলাম শাশুড়ী মাতার সঙ্গে। 


অকাতরে ঘুমোচ্ছিলেন তিনি। নার্স দিদি ঠেলে তুলে দিলেন, ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। জানতে চাইলাম, আমায় চিনতে পারছ? বাধ্য বালিকার মত ঘাড় নাড়লেন তিনি, জিজ্ঞাসা করলাম,‘ আমি কে বলো তো?’ জবাব এল, ‘তুমি তো নার্স।’ পাশ থেকে আসল নার্স বলল, ‘অনেকটা রক্ত ঢুকেছে তো দিদি, একটু ভুল বকবেই। আমাদের যা বকাঝকা করছেন, বাপরে বাপ-। তবে বাড়ির লোককে খুব মিস করছেন। বার বার ওণার স্বামীকে খুঁজছেন।’ যাঁকে নিয়ে এত আলোচনা, তিনি শিশুর মত ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাচ্ছেন এদিক, ওদিক। বোধহয় খুঁজছেন শ্বশুরমশাইকেই। জানতে চাইলাম, ‘কেমন আছ? কি খেয়েছ? এবং তোমার বাড়ির লোক এসেছিল?’ সরল স্বরে সব প্রশ্নের উত্তর দিল, শুধু বাড়ির লোকের প্রসঙ্গে দরজার দিকে তাকিয়ে বলল,‘নাঃ কেউ আসেনি। আমি সকাল থেকে এদের বলছি, আমার বাড়িতে ফোন করো, এরা আমার একটা কথা শুনছে না।’ স্যানিটাইজ করা দু হাতে ওণার সূঁচ ফোটানো হাতটা ধরে বললাম,‘ কেন আমি তো এসেছি!’ দুষ্টু মেয়ের মত হেসে বললেন,‘ধ্যাৎ।’ তারপর ভালো করে তাকিয়ে আধ হাত জিভ কাটলেন। ‘হায় গো, অনিন্দিতা তোমায় চিনতে পারিনি।’


অনুমতি নিয়ে বৃদ্ধ-বৃদ্ধাকে সংযুক্ত করলাম ভিডিও কলে। কি ভাগ্যি আমার ব্যাগে সব সময় হেড ফোনটা থাকে। আট মিনিট পর নার্স দিদির তাড়ায় যখন কাটতে বাধ্য হলাম ফোনটা, শাশুড়ি মাতার দুগালে লেগেছে হাল্কা গোলাপী ছোঁয়া। হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে শ্বশুরমশাইকে বিশদ রিপোর্ট করে, বাপবেটিতে একসাথে এক কাপ চা খেয়ে, মেয়ে বগলে রওণা দিলাম তার বন্ধু সকাশে। কতদিন বাদে যে দেখা হল মেয়েগুলোর- কত যে বদলে গেছে মেয়েগুলো- হ্যাংলা মা দুটো শুধু হাঁ করে দেখেই গেল। আর ভেবেই গেল, এমনিই থাক তোরা, সরল, সাধাসিধে,নিষ্পাপ, বেশ খানিকটা ন্যাদোশ আর অনেক অনেকটা ভোম্বল। বাকিটা ঠিক হয়েই যাবে।

অনির ডাইরি ৮ই মার্চ,২০২২


#HappyWomensDay2022 #তাম্রলিপ্তকড়চা 

আজ যা হল, তা আমার এত বছরের সরকারী কর্মজীবনে কখনও হয়নি। বেলা তখন কত, একটা, খুব জোর দেড়টা হবে। কি যেন কাজ করছিলাম, কারা যেন দেখা করতে এসেছিল- হঠাৎ করে অতিরিক্ত জেলা শাসক ম্যাডামের ফোন,‘ আপনি কি অফিসে? সেমিনার হলে মিটিং চলছে, একবার আসতে পারবেন?’ খাতাপত্র গুছিয়ে, চোখে চশমা এঁটে রওণা দিলাম, যাবার আগে আমার টিমকে বলে গেলাম, দাঁড়াও আমার ভাগের বকাটা খেয়ে আসি,তারপর খুব বকব সবকটাকে। 


মস্ত সেমিনার হল, জমিয়ে চলছে মাসিক উন্নয়নের মিটিং। জেলার প্রতিটি প্রান্ত থেকে বিডিও সাহেবেরা এসেছেন, এসেছেন জেলার হোমরাচোমরা অফিসার কুল। উঁচু মঞ্চে বসে আছেন ডিএম সাহেব, পাশাপাশি এডিএম স্যার এবং ম্যাডামেরা, আছেন তিনজন মহকুমা শাসকও। অনুপস্থিত কেবল আমার ব্যক্তিগত মহকুমা শাসকটাই। সম্প্রতি ঘটে যাওয়া এক পারিবারিক বিপর্যয়ের জন্য আপাততঃ ভাগ করে অফিস করছি আমরা। আজ যেমন আমি তমলুক, আর শৌভিক মহানগর। 


দুয়ারে সরকারের ফলাফল নিয়ে গম্ভীর ভাবে কি যেন বলছেন ডিএম সাহেব। হোয়াটস্অ্যাপ গ্রুপে পোস্টানো আজকের মিটিং এর অর্ডারটা আবার ভালো করে পড়লাম, নাঃ লেবার তো নেই আজ। তাহলে? যাই হোক, কর্তার ইচ্ছেয় কর্ম, মুস্কিল হল আমার নিজের মহকুমার রিপোর্টটুকু আমার ঠোঁটস্থ, জেলার রিপোর্ট তো নয়। হে ঠাকুর দয়া করে পোর্টালটা খুলিয়ে দাও। 


কি ভাগ্যি আমার বড় সাহেবের আইডি পাসওয়ার্ডটা কি কারণে যেন দিয়েছিলেন স্যার কিছুদিন আগে, তাই দিয়ে ঢুকে ডাউনলোড করতে দিলাম রিপোর্ট। একটা নয় দু- দুই খান এক্সেল, তাও এই ঘোর কর্মব্যস্ত সময়ে। একি আর আজ নামবে? হে মা বর্গভীমা, হে বাবা ব্যবত্তার ভীম, হে মা নাচিন্দা নামিয়ে দাও মা। আরও কারো নাম কি দেখেছি কোন রিক্সা বা টোটোর গায়ে, মনে করতে পারলাম না। যাই হোক, এই সব দেবদেবীদের ত্র্যহস্পর্শে অবশেষে নামল রিপোর্ট। টুকেও নিলাম খাতায়। ভালো করে মুখস্থও করে নিলাম। ডিএম সাহেব প্রশ্ন করলেই এমন ধ্যাড়াই আমি। এত তোতলাতে থাকি,যে ওণার নির্ঘাত মনে হয়, ব্যাটা এক নম্বরের ফাঁকিবাজ। 


সব তথ্য জলের মত মুখস্থ করে, শতকরা কষে, গ্রাফ এঁকে যখন রেডি করেছি, একগাদা ফুল আর ব্যাগে করে কি সব যেন এসে ঢুকল মিটিং হলে। এই রে, কলকাতা থেকে নির্ঘাত কোন বড় সাহেব এসেছেন। রাজ্যের রিপোর্টটাও নির্ঘাত লাগবে। মেল খুলে তড়িঘড়ি সেটা খুঁজতেই যাচ্ছিলাম এমন সময় বোমা ফাটালেন ডিএম সাহেব, ‘আজ বিশ্ব নারী দিবস, আসুন আমরা সম্মান জানাই আমাদের লেডি অফিসারদের।’ সম্মানই বটে, ফুল-চকলেট তো ছিলই, তার সাথে ছিল, ‘মন কি বাত।’ ধুর আকাশবাণীর মন কি বাত নয়,আমাদের ঘরোয়া মনের কথা। 


ডিএম সাহেব শুনলেন প্রতিটি মহিলা অফিসারদের অনুভব এবং অভিজ্ঞতা। শুধু মেয়েরাই নয়, পুরুষ অফিসাররাও ভাগ করে নিলেন তাঁদের মনোভাব। কি ভাবেন তাঁরা নারী তথা নারী দিবস নিয়ে। ঘড়ির কাঁটা ঘুরছিল এক মহিলা অফিসার থেকে আরেক মহিলা অফিসার, জানতাম আমার পালা আসবেই, কি বলি! সবই তো বলে দিয়েছেন আমার পূর্বসুরীরা,  ছুঁয়ে গেছেন কন্যা ভ্রুণ হত্যা থেকে শিশু নির্যাতন, লিঙ্গ বৈষম্য থেকে যৌন হয়রানি হয়ে পণপ্রথা। আর বাকি রইল কি? 


সেটাই বললাম, আর বললাম যে অনেক শিক্ষা দিয়েছি আমরা আমাদের মেয়েদের, এবার একটু ছেলেগুলোকে মানুষ করার সময়। ছোট স্কার্ট পরাটা সমস্যা নয়, সমস্যা স্কার্টটাকে ছোট করে দেখাটা। আর এই শিক্ষা কে দিতে পারে বলুন তো, দিতে পারে কেবল একজন নারী। উঁহু যে সে নারী নয়, সেই নারী, যিনি শেখান শিশুকে তার প্রথম পাঠ, যাঁকে আমরা মা বলে এক ডাকে চিনি। মায়েরা যত শিক্ষিত হবে, ততো শিক্ষিত হবে আমাদের ছেলেরা।  মায়েরা যত সবলা হবে, ততো সবল হবে আমাদের সমাজ। তারপর আবার এমন ভাবে একদিন সমবেত হব আমরা, ‘লিঙ্গ নিরপেক্ষ দিবস’ পালনে। 


বাড়ি ফিরে আজকে পাওয়া সমস্ত উপহার তুলে দিলাম শ্রীমতী তুত্তুরীর হাতে। আর জনৈক রাজনৈতিক নেতার মন্তব্য কোট করে বললাম, ‘জগৎটা তোমাদের, জগৎটা আমাদেরও। কিন্তু তোমরা হলে সকাল বেলা আটটা নটার সূর্য।’ আমি যতই বলি, খবরদার লক্ষ্মী মেয়ে হোস না বাবু, লক্ষ্মী  বাঈরা কোনদিন লক্ষ্মী মেয়ে হয় না।