নিমতৌড়ি চৌমাথা থেকে একটা রাস্তা ঢুকে এসেছে আমাদের আপিস তথা নব্য প্রশাসনিক ভবনের দিকে। বাঁহাতের রাস্তাটা চলে গেছে নন্দকুমার হয়ে দীঘার দিকে। ডান দিকের রাস্তাটা গেছে মেচেদা হয়ে কোলাঘাট টপকে সোজা মহানগর। আর মুখোমুখি উল্টো দিকের রাস্তাটা গেছে ময়নার দিকে। ময়নাই যাচ্ছি আমরা, আমি আর আমাদের উত্তমকুমার। গজগজ করতে করতে গাড়ি চালাচ্ছে উত্তমকুমার, বেশ খানিক বকুনি খেলাম আমিও, ময়না যেতে আগ্রহ প্রকাশের জন্য। যথারীতি আমার আগে কোন সাহেব, মেমসাহেব কোনদিন নাকি ময়নার ক্যাম্পে যায়নি। যাবেই বা কেন, ময়নার দুয়ারে সরকারের ক্যাম্প গুলো হয় ভীষণ ভিতরের দিকে, অধিকাংশ ক্যাম্পেই নাকি পৌঁছায় না মোটরচালিত চারচক্র যান। পৌঁছায় বটে টোটো আর বাইক।
মহানগরের তুলনায় তমলুক শহরটা বড়ই ছোট, কেমন যেন মুঠো খুললেই শেষ। একটু গেলেই নদী আর পঞ্চায়েত এলাকা। এ পথে যেন আরো ঝপ করে শেষ হয়ে গেল শহরটা। ফাঁকা চকচকে রাস্তা, দুধারে গাছ আর গাছের ওপারে ঘন সবুজ গালচের মত ধানজমি। ধান চাষের গল্প শোনায় উত্তম। কেমন করে ধান রুইতে হয়, কেমন করে ধান কাটতে হয়। ধান কাটার আগে পরে বৃষ্টি নামলে কি হয়। বিকাল বেলা কেমন মোলায়েম শীতল বাতাস ভেসে আসে ধান ক্ষেত থেকে, তখন নাকি আলের ওপর গিয়ে বসলে জুড়িয়ে যায় মন প্রাণ। শুনতে শুনতে মোহিত হয়ে জানলার কাঁচটা নামাতে গিয়ে আরেক চোট বকা খেলাম, ‘ধুলো ঢুকবেনি ম্যাডাম-’।
আমরা চলেছি ময়না ব্লকের পরমানন্দপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের উদ্দেশ্যে। পঞ্চায়েত লাগোয়া হাবেলি হরিদাসপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বসেছে দুয়ারে সরকারের ক্যাম্প। চলতে চলতে কখন যেন শেষ হয়ে যায় ধান জমি, দুধারে জেগে ওঠে টলটলে জলের দীঘি। এরা বলে ঝিল। মাছ চাষের জন্য বিখ্যাত ময়না। যদিও তমলুকের বাজারুরা ময়নার মাছকে মোটেই নেক নজরে দেখে না। কিসব যেন ভিটামিন মিনারেল খাওয়ানো হয় এখেনকার মাছগুলোকে, তাই একটু বেশিই হৃষ্টপুষ্ট হয় নাকি তারা। উত্তমকুমার স্বগতোক্তি করে, ‘জল দেখছেন ম্যাডাম? প্রায় রাস্তার লেভেল এ। কেন এখেনে বন্যা হবেনি বলুন দিকি?’ সত্যিই বন্যার জন্য বিখ্যাত ময়না। এই শুখা মরশুমেও টলটল করছে জল। কোথাও কোথাও আবার ঝিলকে ঘিরে উঠেছে বিশাল প্রাচীর, বসেছে সুউচ্চ দরওয়াজা। এক নজরে মনে হবে সারি সারি রির্জট বোধহয়। উত্তমকুমার বুঝিয়ে দেয়, ‘মাছের নিরাপত্তার জন্য এমনি বানাইছে ম্যাডাম। কোটি কোটি টাকার পোনা ছাড়া আছে এই সব ঝিলে। এক মুঠো লিয়ে লেওয়া মানেও কয়েক লাখটাকার মাছ চলে গেল। বুঝলেননি-’।
উত্তমকুমারের আশঙ্কা সত্যি করে পরমানন্দপুর হাবেলি হরিদাসপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের রাস্তাটা দেখা যায় ভয়ানক সরু। গজগজ করতে করতে ময়নার ভারপ্রাপ্ত ইন্সপেক্টর রাজীবের মুণ্ডপাত করে উত্তম। ‘রাজীব স্যারকে বননু, এমন ভেনু ম্যাডামকে বলবেননি, যেখেনে গাড়ি যাবেনি-। ঠিক তেমনিই বললেন।এবার কাউরে পাঠান দিকি। ’ ফোনের ওপার থেকে আমার মুখচোরা ভালোমানুষ ইন্সপেক্টর আরো সংকুচিত হয়ে বলতে থাকে,‘ ম্যাডাম এটায় তাও কিছুটা গাড়ি আসবে, অন্যগুলোয় তো অনেকটা হাঁটতে হবে-’। আমার তো মজাই লাগছে। দুধারে ধান ক্ষেত, মাঝে সরু ঢালাই রোড, তার ওপর দিয়ে কোন মতে গড়াতে লাগল আমাদের গাড়ি,ইন্সপেক্টর সাহেবের নির্দেশে স্কুটি নিয়ে আমাদের আনতে এল SLO ছেলেটি, তার পিছে গাড়ি সবে গড়িয়েছে এমন সময় বাঁকের মুখে ভেসে উঠল একটা- দুটো- তিনটে টোটো আর গোটা দুয়েক বাইক। কোন মতে পিছু হঠে,টেড়ে বেঁকে খানিকটা এগিয়ে একটা বাঁশঝাড়ের তলায় এসে উত্তম বলল,‘ম্যাডাম রাগ করবেননি, কিন্তু আর গাড়ি যাবেনি।’ রাগের কি আছে, এতক্ষণ বসে থেকে পা ব্যথা করছিল বরং। SLO ছেলেটাকে ইশারায় বললাম, তুমি এগোও, আমি আসছি। আরো অনেকেই চলেছেন, পুকুরপাড় দিয়ে, বাঁশঝাড়ের তলা দিয়ে, গেরস্থের নিকানো আঙিনা আর গোয়ালঘরের পাশ দিয়ে, চতুর্দিকে যেন মেলা বসে গেছে।
জনৈক মাসিমা, যেচেই বললেন, ‘কোথা যাবে মা?’ জানালাম ক্যাম্পে যাব, দুয়ারে সরকারে। মাসিমা বললেন,‘আমিও যাতেছি তো। তুমি আমার সঙ্গে এসো।’ প্রায় এক কিলোমিটার রাস্তা গপ্প করতে করতে গেলাম, মাসিমা প্রায় পুলিশের মত জেরা করে জানলেন আমার বিয়ে কবে হয়েছে, বর কি করে, ছেলেমেয়ে কটি, কত বড়, আমি কি 'কাস সাটিফিকেট'এর জন্য যাতেছি নাকি লক্ষ্মীর ভাণ্ডার করব ইত্যাদি প্রভৃতি। বরের পরিচয় ব্যতিরেকে সব সত্যি কথাই বললাম বটে। স্কুলের গেটেই দাঁড়িয়ে ছিল রাজীব, গেলাম, কাজ দেখলাম, গুটি কয়েক সার্টিফিকেট পাশবই বিতরণ করে ছবি তুলে, প্রধান সাহেবের সঙ্গে কিঞ্চিৎ কুশল বিনিময় করে বেরিয়ে আসছি, কে যেন বলল, ‘চণ্ডী মন্দিরটা দেখে যাবেননি ম্যাডাম। খুব জাগ্রত। কত্ত বিয়ে হয় জানেননি। খুব সোন্দর মন্দির। দুদিকে ঝিল, মাঝে মন্দির।’
আবার এককিলোমিটার হেঁটে এসে গাড়িতে উঠলাম, এবার অবশ্য রাজীব, দুই SLO সুপ্রিয়া এবং সেই ছেলেটিও এল গল্প করতে করতে। গাড়িতে উঠে উত্তমকুমারকে চণ্ডী মন্দিরের কথা বলে আরেক চোট বকা খেলাম, ‘বেশি পাকা সব। আমি তো লিয়ে যেতামই। এ রাস্তায় আসবেন আর চণ্ডীমায়ের মন্দির যাবেননি?কত বিয়ে হয় দেখবেন চলুন। বর্গভীমা মন্দিরে যত বিয়ে হয়, এখেনে অত হয়নি, তবে এখেনে বিয়ের খর্চা বেশ কম।’ সত্যিই দুদিকে জলাভূমি মাঝে একটা ছোট মন্দির। ভিতরে বড় পট আছে বটে, কোন বিগ্রহ নাই। শুনলাম বিসর্জন হয়ে গেছে। আসছে বৈশাখ না শ্রাবণে মস্ত মেলা বসবে হেথায়। দেখলাম বিয়ে হচ্ছে একদলের, আরেকদল অপেক্ষমান। আরো একদল সাজুগুজুতে ব্যস্ত। বাইরে অনেকটা খোলা চত্বর, দাঁড়িয়ে আছে সারি সারি গাড়ি। সুন্দর সাজানো গোছানো ঝিলের পাড়, প্রখর মধ্যাহ্নেও ভেসে আসছে ঠাণ্ডা বাতাস। সত্যিই দুদণ্ড জিরোবার আদর্শ স্থান বটে। বড় ভালো লাগল। ময়না এলে আসতে ভুলবেননি কিন্তু।
No comments:
Post a Comment