অনির সিমলিপালের ডাইরি ২৫শে মার্চ, ২০২২
(প্রথম পর্ব)
পরিকল্পনা তো ছিল ভোর রাতে বের হবার। তমলুক থেকে বাংড়িপোশি, বাংড়িপোশি থেকে যোশিপুর। যোশিপুরে পৌঁছে করাতে হবে জঙ্গলে প্রবেশের পারমিট। তুলতে হবে গাইড নিহার বাবুকে, অতঃপর শুরু হবে আমাদের দুদিনের বনবাস। যতদূর শুনেছি সিমলিপাল অরণ্যে প্রবেশের মূখ্য প্রবেশদ্বার দুটি, পিঠাবাটা (নাকি পিথাবাটা) গেট আর যোশীপুরের রামতীর্থ গেট। বারিপদার কাছে পিঠাবাটা গেটটিই অধিক জনপ্রিয়, তুলনায় কাছাকছিও। অধিকাংশ পর্যটক ও পথেই প্রবেশ এবং প্রস্থান করেন। আমাদের ট্যুর প্লানার ওরফে তমলুকের মহকুমা বিপর্যয় মোকাবিলা আধিকারিক আগেই নাকচ করে দিয়েছেন সেই প্ল্যান। আমরা বাংড়িপোশি হয়ে যোশিপুর দিয়ে ঢুকব এবং পিঠাবাটা দিয়ে বেরোব।
আমাদের ট্যুর প্ল্যানার প্রথমেই সচেতন করে দিয়েছেন, ‘দমবন্ধ-করা জঙ্গল দেখতে পাবেন, কিন্তু জন্তুজানোয়ার দেখতে পাবার কোন প্রতিশ্রুতি বা দাবী আমি করব না।’ বিভিন্ন ট্যুরিস্ট ব্লগেও দেখলাম অনেকেই বেশ ক্ষুব্ধ, নামেই টাইগার রিজার্ভ অথচ বাঘ দেখতে পাওয়া লটারি জেতার থেকেও দুষ্কর।স্মরণাতীত কালে কেউ দেখেছে বলেও দাবী করেনি। আমরা বাঘ দেখতে চাইছিও না, আমরা শুধু দুদণ্ড একটু প্রাণ ভরে শ্বাস নিতে চাইছি। পড়ে দেখলাম অধিকাংশ পর্যটকই ঝটিকা সফরে গেছেন, ভোর ভোর পিঠাবাটা দিয়ে প্রবেশ করে সারাদিন ঘুরে, সন্ধ্যা নামার মুখে বেরিয়ে এসেছেন।আমাদের ট্যুর প্ল্যানার জানালেন,‘ওভাবে সিমলিপালকে চিনতে বা অনুভব করতে পারবেন না স্যার। সিমলিপাল বড় লাজুক, জঙ্গলে না থাকলে,এ জঙ্গল আপনার সামনে স্বমহিমায় কখনই ধরা দেবে না।’
উদ্দীপিত হয়ে,এক নয় দুরাতের জন্য জঙ্গলে থাকবার মনোবাসনা নিয়ে চলেছি আমরা। জঙ্গলের বাইরে লুলুং নদীর ধারে গড়ে ওঠা শৌখিন তথা গলা কাটা প্রমোদ কুটির নয়, আমরা থাকব গভীর জঙ্গলের মধ্যে বন দপ্তরের নিজস্ব নেচার ক্যাম্পে। অনলাইন বুক করাতে গেলেই পাবেন সতর্কবাণী, জঙ্গলের মধ্যে তিনটি জিনিস থেকে আপনাকে থাকতে হবে সম্পূর্ণ বঞ্চিত- প্রথমতঃ ওখানে কোন ইলেকট্রিসিটি নেই। যা আলো বা পাখা চলবে সবই জ্বলবে সৌর বিদ্যুতে। ফলে বাতানুকূল যন্ত্রের আরাম মশাই ভুলেই যান।
দ্বিতীয়তঃ ওখানে নেই কোন টেলিফোনের টাওয়ার। ফলে অন্তর্জাল তো ছাড়ুন মামুলী ফোনও করতে পারবেন না। জঙ্গলে পা রাখার সাথে সাথেই আধুনিক সভ্যতা তথা নাগরিক জীবন থেকে সম্পূৰ্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবেন আপনি। মানসিক ভাবে প্রস্তুত হয়েই আসুন।
তৃতীয়তঃ ওখানে নেই কোন পিচ রাস্তা। গাড়ি যাবার জন্য লাল মোরামের রাস্তাই বরাদ্দ কেবল। তাতে গাড়ি নাচবেই, সেই নাচটুকু হজম করতেই হবে আপনার পিঠ এবং কোমরকে। বাড়ির গাড়ি নিয়ে আপনি যেতেই পারেন, তবে নীচু গাড়ি হলে কিন্তু মিলবেনি জঙ্গলে প্রবেশের ছাড়পত্র।মাটি থেকে অন্তত ১৮০ সেন্টিমিটার ক্লিয়ারেন্স লাগবে গাড়ির।
এসব জানা ইস্তক শৌভিক আমাকে ক্ষেপাচ্ছে, ‘কি করে থাকবি রে, তিন তিনটে দিন? কি হবে তোর ফেসবুক, হোয়াটস্অ্যাপ, ইন্স্টাগ্রাম আর নেটফ্লিক্সের? এসব ছেড়ে তুই বাঁচবি তো?’ সমস্যা সেটা নয়, সমস্যা হল আমাদের দু জোড়া বৃদ্ধ-বৃদ্ধা।আর সবার ওপরে আমার ৮৬ বছরের পিসি। পাক্কা আড়াই তিনদিন সমস্ত যোগাযোগ রহিত থাকাটা এনাদের কারোরই তেমন মনঃপূত হয়নি বেশ বুঝতে পারছিলাম।
যাই হোক, ভোর চারটে নাকি পাঁচটা করতে করতে শেষ পর্যন্ত আমরা বেরিয়েছি সাড়ে ছটায়। পূর্ব মেদিনীপুরের সীমানা ছাড়িয়ে ডেবরা হয়ে পশ্চিম মেদিনীপুরে ঢুকে, খড়্গপুর শহরকে সামান্য স্পর্শ করে চৌরঙ্গী দিয়ে গোল করে ঘুরে লোধাশুলি আর ক্ষেমাশুলির শালের জঙ্গলের পাশ কাটিয়ে, বহরাগোড়া হয়ে উড়িষ্যায় প্রবেশ করে যখন বাংড়িপোশিতে পৌঁছালাম তখন সময় পৌনে নয়। দু একটা ছোট অংশ বাদে মোটামুটি মখমলী হাইরোড। সাধারণতঃ পর্যটকেরা ফেরার পথে বাংড়িপোশি হয়ে ফেরেন, কিন্তু আমাদের ট্যুর প্লানার বলেছেন, বাংড়িপোশি থেকে যোশিপুরের রাস্তাটা নাকি বেশ চড়াই এবং ভয়ানক সুন্দর। পথের দৈর্ঘ্য গুগল দেখায় সোয়া দু ঘন্টা আর যোশিপুরে আমাদের জন্য প্রতীক্ষারত গাইড নীহার বাবু বলেন এক ঘন্টা। শেষ পর্যন্ত নীহার বাবুকেই যথার্থ প্রমাণ করে সাড়ে দশটার মধ্যেই যোশিপুর পৌঁছে যাই আমরা।
বাংড়িপোশি থেকে যোশিপুর যাবার পথটা সত্যিই নয়ন জুড়িয়ে দেয়। আচমকাই পথের বাঁকে মাথা তুলে দাঁড়ায় বেঁটে বেঁটে ক্ষয়িষ্ণু পাহাড়ের দল আর তাদের পাদদেশ বরাবর অগুনতি শিমূলে পলাশে যেন হোলি খেলেছে কেউ। প্রকৃতির থেকে বড় চিত্রকর বুঝি কেউ নেই, কত যে অগুনতি রঙ পথের দুধারে। গাইড সাহেব বললেন, শিমূল থেকেই নাকি সিমলিপাল নামটার উৎপত্তি। যদিও শীতেই সবথেকে বেশি পর্যটক আসে এদিকে, তবে শিমলিপালকে দেখা তথা অনুভব করার সেরা সময় নাকি বসন্তকাল বিশেষতঃ মার্চ-এপ্রিল। শীতে জঙ্গল কেবলি সবুজ, এখন তা না না বর্ণের সমাহার। হরেকরকম গাছ চেনাতে চেনাতে নিয়ে চললেন নীহার বাবু, কমলা পলাশ, লাল শিমুল, গোলাপী কাঞ্চন তো আগেই চিনতাম, টকটকে লাল কুসুম গাছ এই প্রথম দেখলাম। জানলার কাঁচ নামিয়ে দিতেই ছুটে আসছে জঙ্গলের গন্ধবাহী দামাল হাওয়া। কোথাও তা মহুয়া ফুলের গন্ধে মাতাল কোথাও বা বকুল বা ইউক্যালিপটাস বা নাম না জানা গাছের গন্ধে বন্ধ হয়ে আসে দম।
গাড়ি থামিয়ে পথ থেকে এক গোছা মহুয়া ফুল তুলে নিয়ে এলেন গাইড বাবু। জলে ধুয়ে বললেন, খেয়ে দেখেন না। তুত্তুরী একটা খেল, আমি দুটো। শৌভিক আর ড্রাইভার সাহেব তো ছুঁলেনই না। কি অসম্ভব মিষ্টি ফুল। খেতে অনেকটা কচি তালশাঁসের মত। হাল্কা একটা কষাটে ভাব আছে বটেক, তবে তা মুখে লাগে না। তুত্তুরী ফিসফিস করে জানতে চাইল,‘মা তোমার নেশা হয়েছে?’ সমস্বরে হেসে উঠলাম আমরা।
এই সামান্য দুটো ফুল চিবিয়ে কারো নেশা হয় না।পাকা মহুয়া ফল থেকে কিভাবে তৈয়ার হয় নেশার জিনিস বিশদে বোঝালেন গাইড দাদা। বললেন এছাড়াও মহুয়ার তেল হয়। আগে তা রান্নাতেও ব্যবহৃত হত। মহুয়া ফুল এবং ফল যদিও বেশ সুমিষ্ট, তেলটা কিন্তু বেশ তিতকুটে হয়। তবে গরম তেলে সামান্য নুন ফেলে দিলেই কেটে যায় তার তিক্ত ভাব। তবে আজকাল আর কেউ তেমন খায় না। মূলতঃ প্রদীপ জ্বালাতে আর নানা ওষুধ,প্রসাধনী ইত্যাদি প্রস্তুতিতেই যা লাগে। জানালেন আগে গরীর মানুষ এই ঝরে যাওয়া মহুয়া ফুল তুলে শুকিয়ে রেখে দিত। ঘোর বর্ষায় যখন মিলত না কোন খাবার, ঐ গুলিকে জলে ফুটিয়ে কাত্থ বানিয়ে তার সাথে পাকা তেঁতুলের কাত্থ মিশিয়ে ফুটিয়ে খেত।উনিও খেয়েছেন শৈশবের দিনগুলিতে, জানালেন সে নাকি পুরো অমৃত। আজকাল সরকারের হাজার একটা প্রকল্পের সৌজন্যে তেমন গরিব নাকি কেউ নেই। শুনেও সুখ।
সিমলিপালে যদি আসেন এবং থাকার মনস্থ করেন, সর্বাগ্রে মাথায় রাখবেন এটা গহীন জঙ্গল। মধ্যে মধ্যে জনবসতি বলতে কয়েকটা আদিবাসী গাঁ আছে বটে, তবে দোকানপাট কিছুই নেই। তাই ব্যাগ তথা গাড়ি ভর্তি করে নিয়ে আসবেন শুকনো খাবারদাবার আর জল।যে গেট দিয়েই প্রবেশ করুন না কেন, ঢোকার আগে অবশ্যই ভর্তি করে নেবেন গাড়ির তেলের ট্যাঙ্ক। গাইড সাহেব বললেন সিমলিপালের আয়তন প্রায় নয়শ বর্গকিলোমিটার। এর মধ্যে কিছুটা পর্যটনের জন্য নির্দিষ্ট থাকলেও বাকিটা শুধুই বন্যপ্রাণীদের চারণ ভূমি। সিমলিপালের সবটুকুই প্রাকৃতিক, এখানে কোন কৃত্রিম বা মনুষ্য নির্মিত ব্যাপার পাবেন না। সিমলিপাল হল রিজার্ভ ফরেস্ট, এখানকার কোন কিছুই অন্যত্র স্থানান্তর করা যায় না। বা অন্যস্থান থেকে কোন জীবজন্তু এনে এখানে ছাড়া হয় না। ওণার ভাষায়,‘যা সিমলিপালে জন্মাবে, তা এখানেই বড় হবে এবং এখানেই মারা যাবে।’ আন্দামান বা আমাদের সুন্দরবনের মত। এই জঙ্গলের সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র তথা নিজস্ব ইকো সিস্টেম আছে।
আমরা থাকব বড়েহিপানি নেচার ক্যাম্পে। যোশীপুর থেকে সেটা প্রায় ষাট কিলোমিটার। জঙ্গলে প্রবেশের সাথে সাথেই ঝুপ করে পড়ে গেল সব ফোনের সব টাওয়ার। গাইড দাদা বললেন, ‘ফ্লাইট মোডে করে লিন। জঙ্গল থিকে না বেরোতে পারলি, টাওয়ার আসবে না।’ জানতে চাইলাম, ফোনে চার্জ দেওয়া যাবে তো? হেসে জানালেন তা যাবে বটে। লাল মেঠো আঁকাবাঁকা পথ, একপাশে ঘন জঙ্গল আর পথের অন্য ধার দিয়ে বয়ে যাচ্ছে তিরতিরে খৈরি নদী। এই জঙ্গলের বুক চিরে নাকি বেরিয়েছে সাত-সাতটা নদী। খৈরি, বুড়িবালাম (এরা বলে বুঢ়াবলঙ্গ), ভণ্ডন, খড়কাই, দেও,সঞ্জু আর সালন্দী। এগুলো ছাড়াও আছে আরো সাত আটটা ছোট নদী। যার অন্যতম হল পলপলা বা লুলুং।
এত অপরিসর খৈরি নদীর খাত, মধ্যে মধ্যে পড়ে আছে বড় বড় পাথর। বর্ষা নামলেই নির্ঘাত দুকুল ছাপিয়ে যায় নদী? শুনলাম তা যায় বটে, তবে তার স্থায়িত্ব বড়ই স্বল্প। অচীরেই নেমে যায় জল, তবে আজ সিমলিপালে জল বাড়লে পরশু ভাসে বালেশ্বর বা কটক। নদীর ডানদিকে গভীর জঙ্গল, তথা কোর এরিয়া। বাঘের সাকিন। ওখানে সাধারণ মানুষের পদার্পণ কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ। এতদসত্ত্বেও যদি কেউ যায় বা গবাদি পশুকে চরতে পাঠায় এবং বাঘের পেটে যায় তাহলে সরকার দেয় না কোন ক্ষতিপূরণ। জানতে চাইলাম বাঘ কি সত্যিই আছে? উত্তর পেলাম আছে তো বটেই। সদ্য শেষ জানুয়ারীতে হয়েছে বাঘসুমারি। আমাদের গাইডদাদাও নাকি তখন তাতে অংশগ্রহণ করেছিল। খুঁজে খুঁজে বস্তাবন্দী করে পাঠাতে হয়েছিল বাঘের পুরিষ। ফলাফল এখনও জানায়নি বনদপ্তর, তবে বড় ছোট মিলিয়ে প্রায় শতখানেক বাঘ আছে বলেই ওণার ধারণা। আসার আগে পড়েছিলাম ৯৯টা বাঘ ছিল আগের সুমারিতে। তাহলে তেমন বাড়েনি বাঘের সংখ্যা?
গাইড দাদা হতাশ সুরে জানালেন,বাড়ছে বটে আবার মারাও পড়ছে। বাঘের দাঁত, বাঘের চামড়ার লোভে মাঝেমাঝেই চোরাগোপ্তা হামলা হয় দক্ষিণ রায়ের তুতো বংশধরদের ওপর। কিছুদিন আগেই নাকি দুটো বাঘকে মেরে কারা যেন ছাল ছাড়িয়ে তাদের মাংস রান্না করে খেয়েছে। ধরা পড়ার পর, তা জাতীয় খবর হয়। আজব লাগে শুনে, এতদিন জানতাম বাঘ মানুষের মাংস খায়,মানুষও যে বাঘ খেতে পারে তা কল্পনাতীত হলেও সত্যি। শুধু কি তাই, জঙ্গলে আগুনও লাগায় মানুষ। পথে যেতে যেতে আমরা নিজের চোখে দেখলাম দূরের পাহাড়ের মাথা থেকে পাকিয়ে পাকিয়ে উঠছে ধোঁয়া। শৌভিক জানতে চাইল কারা লাগায় এ আগুন? কেনই বা লাগায়?শুনলাম ফাজলামি করতেই আগুন লাগায় মানুষ। এত বড় জঙ্গল, জঙ্গল ভর্তি শুকনো পাতা।কে কোথায় একটা জ্বলন্ত বিড়ি ছুঁড়ে ফেলল, কি একটা দেশলাই কাঠি ছুঁড়ে মারল তার হদিশ পেতে পেতেই পুড়ে যায় অনেকটা জঙ্গল। আগুন নেভানোর জন্য আইন সংশোধন করে কঠোর শাস্তির বিধান এনেছে বনদপ্তর, গড়েছে অগুনতি অগ্নি নির্বাপক টিম, যাদের কেউ খাস সরকারি কর্মচারী, কেউ বা নিছক কন্ট্রাক্টে কাজ করে। খবর পেলেই তারা দৌড়ায় অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র নিয়ে। তবে আশার কথা একটাই যে এই সব আগুনে বড় গাছের কোন ক্ষতি হয় না। বড়জোর এক দেড় ফুটের গাছ অবধি ক্ষতির শিকার হয়। তবে তাই বা কেন হবে?
পথে পড়া প্রথম চেক পোস্টে আগুন লাগার খবর জানিয়ে, আমরা চললাম 'মহাবৃক্ষ শাল' এর সাথে আলাপিত হতে। যদিও গোটা সিমলিপাল জুড়েই শালের আধিক্য, তবে তাদের মধ্যে সবথেকে কুলীন তথা খ্যাত হলেন মহাবৃক্ষ শাল। তাঁর কাণ্ডের বেড়ই ১৬ ফুটের বেশি, উচ্চতাতেও তেমনি,বয়স হয়েছে সাড়ে তিনশ বছরেরও বেশি। ব্রিটিশ ভারতে রেল লাইন পাতার সৌজন্যে যখন শহীদ হচ্ছে একের পর এক শাল গাছ, দিন ঘনিয়ে এল মহাবৃক্ষেরও। সে তো তখন ছিল এক মামুলি উঠতি শাল গাছ। জনা দুয়েক কুলি এসে চালাল কুঠার।জনশ্রুতি হল চালানোর সাথে সাথেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে একজন আর অপরজন পাগলের মত ছুটে পালায় কুলি বস্তিতে। কিন্তু বাঁচে না সেও। রাত পোহানোর আগেই শেষ নিঃশ্বাস ফেলে সে। তারপর থেকে আর কেউ স্পর্শ করার সাহস পায়নি এই শাল গাছটিকে। গোটা সিমলিপালের সবথেকে বুড়া গাছ হয়ে আজও মেঘেদের সাথে লুকোচুরি খেলেন তিনি। স্থানীয় লোকজন এসে দিয়ে যায় শ্রদ্ধার্ঘ্য।
বড়েইপানি নেচারক্যাম্প যাবার আগে আমরা গুড়গুড়িয়ার পাইন জঙ্গল আর অর্কিডারিয়াম ঘুরে এলাম। গুড়গুড়িয়াতেও একটা নেচার ক্যাম্প আছে। আগে এখানে হাতির সওয়ারি হত, কিন্তু ২০১৯সাল নাগাদ সাতকোশিয়ায় একটা দুর্ঘটনা ঘটে, যেখানে পোষা হাতি খেপে গিয়ে তার মাহুতকেই তুলে আছাড় মারে, তারপর থেকে বনদপ্তর হাতির সওয়ারি বন্ধ রেখেছে। সিমলিপাল প্রায় শতেক রকমের অর্কিডের নিবাস। মার্চ-এপ্রিলই হল ফুলের মরশুম। এখনও ফুল আসেনি বটে আর কিছুদিনের মধ্যেই অর্কিডে ভরে যাবে গুড়গুড়িয়ার জঙ্গল। একবার ফুল ফুটলে নাকি মাস খানেক থাকে সেই ফুল।
গুড়গুড়িয়া থেকে বেরিয়ে আমরা যখন বড়িয়াপানি নেচার ক্যাম্পে পৌঁছালাম তখন বাজে বেলা দুটো প্রায়। চা-ব্রেকফাস্ট-লাঞ্চ-বিকালের চা-তেলেভাজা-রাতের ডিনার সবকিছুই ধরা আছে ক্যাম্প বুকিং এর সাথে। যাঁরা ডে ট্রিপে আসেন তাদের অবশ্য প্রবেশের সময় লাঞ্চের কথা জানিয়ে আসতে হয় চেক পোস্টে। ওয়াকিটকি বা রেডিওয় খবর এলে রান্না করে রাখে এরা। তবে ডে ট্রিপারদের জন্য খাবার ব্যবস্থা মূল প্রাঙ্গনের বাইরে।
বিশাল এলাকা জুড়ে নেচার ক্যাম্প। লাল মোরামের রাস্তার দুধারে শাল আর কুসুম গাছের জঙ্গল। আছে আম- কাঁঠালও। এই মরসুমে কুসুমগাছের পাতার রঙ সিঁদুরে লাল। উঁচু গাছগুলোর মাথা জুড়ে এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত চলে গেছে ঝুলন্ত ব্রিজ। ছোট ছোট লাল রঙের কটেজ। বাতানুকূল নয় বটে তাও কটেজের ভিতর গুলো প্রচণ্ড ঠাণ্ডা। ওরা বলল, রাতে নাকি আরো ঠাণ্ডা পড়ে। কম্বল গায়ে দিতে হয়।
আগে এই বড়েইপানি নেচারক্যাম্পটা ছিল একেবারে বড়েইপানি ঝর্ণার সামনাসামনি। কিন্তু এখন পিছিয়ে এসেছে প্রায় তিন কিলোমিটার। আদিবাসী গ্রামের মধ্যে গড়ে উঠেছে নতুন নেচারক্যাম্প। সৌজন্য মাওবাদী হামলা। বড়েইপানিতে কটেজে আগুন লাগানো হয়েছিল, আর চাহালাতে তো রাতে হামলা করে চরম লুটপাট চালিয়ে পর্যটকদের বিবস্ত্র করে রেখে গিয়েছিলেন তেনারা। তারপর দীর্ঘদিন বন্ধ ছিল যাবতীয় নেচারক্যাম্প। পরে উড়িষ্যা সরকার তথা বনদপ্তর সিদ্ধান্ত নেয় যে নতুন নেচারক্যাম্প গুলো গড়া হবে গাঁ তথা জনবসতির মধ্যে।
এই সুবিশাল জঙ্গল নাকি আদতে ছিল ময়ূরভঞ্জের রাজাদের শিকারভূমি। বৃটিশ আমলে যখন শুরু হল রেললাইন পাতা, সাথে সাথে কাটা পড়তে লাগল সিমলিপালের শালের জঙ্গলও। লাইনের কাঠের স্লিপারের জন্য শালের থেকে মজবুত গাছ আর কিই বা হতে পারে। তখন শাল গাছ কাটা, চেরা, লোড করা তথা রাজার সাথে শিকারে যাওয়া এবং অন্যান্য বিলাসব্যসনের জন্য বেশ কিছু প্রজাকে এখানে বাস করার সুযোগ করে দেওয়া হয়। রাজার থেকে পাট্টা পেয়েই এণারা এখানে বসবাস করেন। তবে বর্তমানে নাকি বন দপ্তর অফার দিয়েছে, যাঁরা জঙ্গল ছেড়ে যেতে রাজি হবে, তাদের প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনার বাড়ি আর পরিবারের পুরুষ সদস্যকে দশ লক্ষটাকা এককালীন ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে। সাথে অন্যান্য সরকারী প্রকল্পের সুযোগসুবিধার ক্ষেত্রেও মিলবে অগ্রাধিকার। আজই নাকি ১৭টি এমন পরিবার ছেড়ে যাচ্ছে সিমলিপাল অরণ্য ভূমি।
মুখ হাত ধুয়ে বেশ খানিক পায়ে হেঁটে খাবার ঘরে গিয়ে বসলাম। খাবার বলতে সাদা প্লাস্টিকের খোপ কাটা থালায় এল মোটা চালের ভাত, গুঁড়ো বড়ি ভাজা, পেঁয়াজ লঙ্কা দিয়ে বেগুন পোড়া মাখা, মোটা মোটা করে আলুভাজা, দই-বেগুন যা অনেকটা রায়তার মত খেতে,ডুমো ডুমো করে কাটা পেঁয়াজ, প্রচণ্ড মিষ্টি গাজর আর পাকা কিন্তু সরস শশার স্যালাড, পনির-সোয়াবিন-আলু-পটল-বেগুন দিয়ে একটা পাঁচমিশেলি তরকারি, ডিমের ঝোল আর ডাল। খিদের মুখে সবই যেন অমৃত। তবে রান্না বড়ই তেল মশলা বিবর্জিত এমনকি নুনও বেশ কম। তাও অতুলনীয়। খেয়ে উঠে রেস্ট। গাইড দাদা বললেন, পাঁচটা নাগাদ বেরাব। চাহালা যাব। চাহালা হল কোর এরিয়া। যেখানে জন্তুজানোয়ার দেখতে পাবার সম্ভবনা প্রবল। তবে সন্ধ্যা ছটার পর আর ঢুকতে দেয় না। এখান থেকে বড় জোর আধঘন্টা। আমরা সাড়ে পাঁচটা নাগাদ বেরোলেই আরামসে পৌঁছে যাব। ততোক্ষণ অন্ধকার শীতল ঘরে পরম সুখের ভাত ঘুমই সই।
সিমলিপাল অরণ্য পর্যটনের অন্যতম তথা সেরা আকর্ষণ হল সন্ধ্যার চাহালা। চাহালা হল জঙ্গলের কোর এরিয়া। সামান্য ভুল লিখলাম, সিমলিপালে অনেকগুলি কোর এরিয়া আছে বটে, তার মধ্যে পর্যটকদের প্রবেশ কেবল চাহালা অবধিই সীমাবদ্ধ। বড়েয়াপানি নেচার ক্যাম্প থেকে চাহালা পৌঁছাতে লাগে চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ মিনিট। প্রথম চোটে পড়বে আদিবাসী গাঁ, দূরে ঢেউ খেলানো পাহাড়ের পটভূমিকায় নিকানো তকতকে আদিবাসী গৃহকোণ,গবাদি পশু যেমন গরু, ছাগল, ভেড়া, মুর্গি ইত্যাদি আর ঝকঝকে রমণী আর হাসিখুশি শিশুর দল, যারা গাড়ি দেখলেই হাত নাড়ায় আর ছুটে আসে।
গরুর লোভে নাকি এখানে প্রায়ই হামলা করে লেপার্ড। কয়েকমাসের মধ্যেই নাকি আট দশটা গরু মেরেছে, এরা বলে ছোট বাঘ। দিন কয়েক আগে নাকি রাতের বেলা নেচার ক্যাম্পের পিছনেও চলে এসেছিল ছোট বাঘ। এরা অবশ্য অকুতোভয়। বলল, ‘ছোটা বাঘ তো মানুষ মারলি না। দুটো ছোটখাটো জীবজন্তু একলা পেলি মারে। তাই আজকাল সাত আটটা গরুকে একসাথে চরতে পাঠায় স্থানীয় আদিবাসীরা। 'এমন বদমাশ ছোট বাঘ গুলা যে গরু মারলি, কিন্তু গরু খাইলি না। মেরে ফেলি রেখে চলে যায়।’
আদিবাসী গাঁ ছাড়িয়ে ক্রমেই গাঢ় হয় জঙ্গল, কমতে থাকে সূর্যের দীপ্তি। দুধারে শালের ঘন জঙ্গল, তাতেই টর্চ মারতে থাকে গাইড দাদা, বলেন, সন্ধ্যা না নামলে বেরোয় না জন্তুর দল। ড্রাইভারকে বলেন খুব আস্তে চালাও, দশ কি বিশের বেশি স্পিড তুলো না। প্রথমেই চোখে পড়ল একদল কালো মুখো হনুমান। লাল মুখো পুঁচকে ফিচেল বাঁদর অনেক দেখেছি, এই প্রথম কালো মুখ হনুমান চোখে পড়ল। তবে সে গুলো মোটেই আমাদের দেখে ভয় পেল না বা পালিয়ে গেল না। কেবল পুঁচকে গুলোকে কোলে নিয়ে মা গুলোই যা 'দৌড়ে পালাইলি'। আরো এগোতেই একপাল লাজুক হরিণ, শিং তথা পেশিওয়ালা দলনেতার অনুগামী। দলনেতা যাও বা খানিক বুক ফুলিয়ে উঁকি ঝুঁকি মারল, তাঁর অনুগামীরা তো গিয়ে লুকালো গাছের আড়ালে। একটু এগোতেই রাস্তা পেরোচ্ছিল গোটা দুয়েক নীল বন মোরগ, আমাদের গাড়ি দেখে, সে কি 'পড়ি কি মরি' করে দৌড়।
ক্রমেই কমে আসছে দিনের আলো। একটা জায়গায় এসে গাড়িটা দাঁড়িয়ে পড়ল। লেখা আছে বৃন্দাবন গেট। সামনেই একটা চেকপোস্ট, গাইড দাদা বললেন ওটা কোর এরিয়া ছেড়ে বারিপদার দিকে বেরোনোর পথ। আমাদের ডানদিকে বাঁকতে হবে। আর বললেন,' দুমিনিট দাঁড়িয়ে যান, হাতির পটি পড়ে আছে। মনে হচ্ছে কাছাকাছি হাতি এসেছে।' গাইড আর ড্রাইভার নেমে বৃন্দাবন চেকপোস্টের গার্ডের সাথে কথা বলতে গেল। গার্ড বলতে একটা পুঁচকে ছেলে তাও আমাদের মেদিনীপুরের।একগাল হেসে এগিয়ে এসে আলাপ করল ছেলেটি। বয়স সদ্য বিশের কোটায়। কি কম ও হতে পারে। দাঁতনে বাড়ি। বলল, হাতি তো এসেছে। ভোর পাঁচটার সময় বৃন্দাবনগেটে এসেছিল। ওর ধারণা রাতে আবার আসবে। বৃন্দাবনে একটা পুঁচকে জলাশয় আছে, যার মাটিতে নুন ছড়িয়ে রাখে বনদপ্তর। সেই নুনের লোভেই আসে হাতি বা অন্য বন্য জন্তু। বাইসনও আসে, তবে বেশ অনেকটা রাত করে, যখন সব গাড়ি বেরিয়ে গিয়ে নিঝুম হয়ে আসে জঙ্গল। হাতি এলে ওয়াকিটকিতে খবর দেবার অনুরোধ জানিয়ে চাহালার পথ ধরলাম আমরা।
চাহালাতেও একটা ক্ষুদ্র জলাশয় আছে, বিশাল মাঠের মাঝে, জঙ্গলের ধার ঘেঁষে। তার মাটিতেও ছড়ানো হয় নুন। মাঠের এক কোণে রাজার বাংলো, যেখানে স্মরণাতীত কালে শিকার করতে আসতের রাজামশাই। এখন অবশ্য বনদপ্তরের উচ্চপদস্থ আধিকারিক বা সরকারের গণ্যমান্য অতিথি ভিন্ন কেউ থাকতে পারে না। মাঠের একদিক কাঁটা তার দিয়ে ঘেরা, সেখান থেকেই পশুপাখি পর্যবেক্ষণ করেন পর্যটকরা। একটা তেতলা লোহার ওয়াচটাওয়ারও আছে।
কাঁটাতারের এপাশ থেকে টর্চ মারল গাইড দাদা, ওপারে জলাশয়কে ঘিরে থিকথিক করছে হরিণের পাল। অন্ধকারে আলো পড়লে জোনাকির মত জ্বলে তাদের চোখ। বেশ খানিকক্ষণ থেকে অন্ধকার আর টর্চের আলোয় ছবি তোলার বৃথা চেষ্টা করে বোর হয়ে গেলাম আমরা। একে একে বিদায় নিল অন্য পর্যটকরাও, রয়ে গেলাম শুধু আমরা। শৌভিক তাড়া দিল, ‘চলুন ফিরে যাই’। গাইড দাদা অত্যন্ত লজ্জা লজ্জা করে বললেন, 'একটু অপেক্ষা করে যান দাদা। রাত যত গাঢ় হবে, জঙ্গল যত শুনশান হবে, ততো বেরিয়ে আসবে জংলি জানোয়ারের দল। অন্য গাড়ি গুলাকে চলে যেতে দিন না।'
বনদপ্তরের জনৈক কর্মচারীকে পটিয়ে, চিনি, বিটনুন, মরিচ গুঁড়ো, আর লেবুর রস দিয়ে দুর্ধর্ষ কালো চা বানিয়ে খাওয়ালেন গাইড দাদা। ওই গা ছমছম অন্ধকারে, বাঁধানো কাঁঠাল গাছের তলায় বসে জংলি জন্তুর অপেক্ষা করতে লাগলাম আমরা। মাঝে মাঝে টর্চ জ্বালাই আর বিরক্ত হয়ে মাথা তুলে তাকায় হরিণের পাল। রাত সাড়ে সাতটা নাগাদ দৌড়ে এলেন গাইড দাদা, ওনার অনুরোধ মোতাবেক ওয়াকিটকিতে খবর পাঠিয়েছে বৃন্দাবন গেট, ' হাতি এসেছে। একটা নয়, দুটো নয়, চার চারটে। সাথে একটা বাচ্ছা(হাতি) ও আছে।'
বৃন্দাবন গেটে আমরা যখন পৌছালি, রাত তখন আটটা। মনে হচ্ছে যেন নিশুতি মধ্য রাত্রি। যাবার পথে গাইড দাদা বুঝিয়ে দিলেন, পথে যদি কোন হাতি পড়ে, আলো নেভাবেন না, স্টার্ট বন্ধ করবেন না, হর্ন দেবেন না এবং কথা বলবেন না। একদম চুপচাপ থাকবেন, হাতি চলে যাবে। নড়েছেন কি, বিপদ। পথে যাই হোক তেনাদের সাথে মোলাকাত না হলেও বৃন্দাবন গেটে হল। আলো নিভিয়ে কোন মতে অন্ধকারে চোখ সইয়ে আমরা দূতলা ওয়াচ টাওয়ারে যখন উঠলাম এবং গার্ড ছেলেটি তার পরিপক্ক হাতে টর্চ জ্বালালো, সমানেই কাঁটাতারের ওপারে, ক্ষুদ্র জলাশয়ের ধারে একপাল হাতি।
আলো জ্বলে, নিভে, ফাঁকে ফাঁকে ছেলেটি গপ্প শোনায়, নুন চাটতে এসেছে হাতির পাল। বাচ্ছা হাতিটা লেপ্টে আছে মায়ের পেটের কাছে। আমরা দেখলাম প্রথম চোটে দাঁত দিয়ে লবনাক্ত মাটির চোকলা তুলল দাঁতাল দলপতি। তারপর সবাই মিলে পা দিয়ে তাকে থেঁতলে গুঁড়া করল, তারপর শুঁড়ে করে সেই ঝুরঝুরে মাটি মুখে পুরল হাতির দল। সে এক অনবদ্য দৃশ্য।
আরো কি দেখতাম জানি না, এমন সময় এসে উদয় হলেন আরো একদল পর্যটক, সঙ্গে গুটি কয়েক বাচ্ছা। ' এলিফ্যান্ট' দেখে তাদের কি পুলক।তা সোচ্চারে জানানোও হল, গার্ড ছেলেটির নিষেধ সত্ত্বেও বার বার আলো জ্বালানো হল ছবি তোলার উদ্দেশ্যে, পরিণাম এই হল যে সচেতন হয়ে গেল হাতির পাল। প্রথম চোটে আমাদের ভয় দেখাতে করা হল, পায়ের ধুপধাপ আওয়াজ, তারপর ফোঁস ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলা, তারপর বৃংহন, সবশেষে মড়মড়িয়ে শাল গাছের ডাল ভাঙা। হল্লাবাজ পর্যটকের দল তো ভয়ে পগার পর, নিকষ আধারে অপেক্ষারত আমাদের গাইড দাদা বললেন,' এবার চলে চলুন, ওরা লুকিয়ে পড়বে এখুনি। সঙ্গে বাচ্ছা আছে না। বেশি দূর যেতে পারলি না। পথেও মিলতে পারে দেখা।'
গোটা পথ আমরা অন্ধকার জঙ্গলে টর্চের আলো ফেলতে ফেলতে এলাম। যদি মেলে কোন বন্য জীবের দেখা। মিলল বটে, এক পাল হরিণ, হাতি আর মিলল না। কোর এরিয়া ছেড়ে আমরা যখন বেরিয়ে আসছি, পথে পড়ল গোটা তিনেক গরু।এত রাতে গরু দেখে বিকট খুশি হয়ে গেল তুত্তুরী, গাইড দাদা আবার বলতে লাগল, ‘এখানে বাঘে খেলে কোন ক্ষতিপূরণ পাবে না গ্রামবাসীরা। তবে এগুলা তো ষাঁড় বটে, ইত্যাদি প্রভৃতি।’ এমন সময় চিৎকার করে উঠল শৌভিক, 'ওটা কি, ওটা কি? বড়সড় কুকুরের থেকে একটু বড় একটা জীব, প্রায় বাঘের মত মোটা লেজ-'। ভালো করে ঠাওর করার আগেই হাওয়া। গাইড দাদা গম্ভীর ভাবে বললেন, 'ছোট বাঘ আজ্ঞে।। গরুর লোভে এইয়েছিল মনে হচ্ছে।'
নিষুতি রাতের নিকষ জঙ্গলকে পিছনকে ফেলে আমরা যখন বড়েইপানিতে ফিরে এলাম, ঘড়ি বলছে সবে রাত সাড়ে আটটা। আজ আমরা ছাড়া এত বড় নেচারক্যাম্পে রয়েছে কেবল একটাই পরিবার। সৌর বিদ্যুতে জ্বলা মিটমিটে আলোয় গোটা নেচারক্যাম্পটা যেমন যেন ভুতুড়ে রূপ নিয়েছে। এরা ভীষণ অতিথি বৎসল,এত রাতে আমরা আশা না করলেও, ওরা ঠিক দিয়ে গেল তিনকাপ জিভ পোড়ানো সর ফেলা মোটা দুধের চা আর তিন প্লেট পেঁয়াজের পকোড়া। ডিনারে গরম গরম হাতে গড়া রুটি, ফুটন্ত দিশি মোরগের ঝোল আর মোটামোটা আলু ভাজা।
যাত্রার ধকল, রাতের জঙ্গলের কুহকিনী উত্তেজনা আর উদর ভরা সুখাদ্যে মেখে হিমেল জঙ্গুলে রাতটা যে কখন ঝুপ করে কেটে গেল। দরজার কড়া নাড়ার শব্দে যখন অতি কষ্টে খুললাম চোখের ভারি পাতা, ঘড়ি বলল সবে সকাল সাড়ে ছয়। মোটা দুধের চা আর বিস্কুট দিতে আসা ছেলেটা লাজুক আদিবাসী সুরে জানতে চাইল, ‘ব্রেকফাস্ট মে কেয়া খায়েঙ্গে-’। আমাদের 'যা খুশি'র জবাবে, সকাল নটা নাগাদ পাতে এসে পড়ল খড়মড়ে করে ভাজা বিশাল বিশাল আটার তেকোনা পরোটা, চার কুচি আলু, ষোলটা মটর আর এক বাটি জল দিয়ে বানানো জিভে জল আসা ঘুঘনি, আচার, অমলেট আর উপমা। উপমাটা বড় উত্তম বানায় এরা। সুজির সাথে নানা সব্জি আর সিমাই মিশিয়ে বেশ নোনতা-মিষ্টি একটা রগরগে ব্যাপার। পেট ভরলেও মন ভরে না।
সাড়ে নটা নাগাদ আবার জঙ্গলে বেরোলাম আমরা। সিমলিপালের মূখ্য ট্যুরিষ্ট আকর্ষণ হল তার তিনটি ঝর্ণা- উচ্চতা অনুসারে উস্কি, জোরান্ডা আর বড়েইপানি। তিনটেতেই জল থাকে বছর ভর। এদের মধ্যে সবচেয়ে পুঁচকে হচ্ছে উস্কি। জলপ্রপাতের খুব কাছ পর্যন্ত গাড়ি যায়, গাড়ি থেকে নেমে স্বল্প দূরত্ব সরু পাহাড়ি পথে হেঁটে গেলেই আপনি উস্কির সামনে এসে পৌঁছাবেন। চাইলে আপনি স্নানও করতে পারেন। উস্কির জল গিয়ে মিশেছে ভণ্ডন নদীতে।
সিমলিপালের সবথেকে উঁচু জলপ্রপাতটির নাম বড়েইপানি। বুড়া বলঙ্গ নদীর এই জলপ্রপাতটির জল দুধাপে নেমেছে। সব মিলিয়ে মোট উচ্চতা ১৩০৯ ফুট বা ৩৯৯মিটার। এটি ভারতের দ্বিতীয় উচ্চতম আর উড়িষ্যার উচ্চতম জলপ্রপাত, গভীর জঙ্গলের মধ্যে অবস্থিত বড়েইপানি জলপ্রপাতকে আপনাকে দূরের পাহাড়ের মাথা থেকেই দেখতে হবে, তাও কোর এরিয়ার মধ্যে তিন কিলোমিটার ঢুকে এসে। আগে এখানে থাকার অনুমতি ছিল পর্যটকদের, তবে মাওবাদী হামলার পর, সব বন্ধ। ফাঁকা, পুড়িয়ে দেওয়া কটেজগুলিতে বাঁদর আর হনুমানের বাস।
সারা দিন জঙ্গলের মধ্যে উদ্দেশ্যহীন ভাবে কখনও পায়ে হেঁটে, কখনও বা সাইকেল চালিয়ে ঘুরে বেড়িয়ে, নেচারক্যাম্পের ঝুলন্ত ব্রিজ আর দড়ির সেতুতে বেশ কয়েকবার পারাপার করে, ক্লান্ত হয়ে ভরপেট দ্বিপ্রাহরিক আহার এবং হাল্কা বিশ্রাম সেরে আমরা আবার যখন চাহলার জন্য বেরোলাম তখন ঘড়িতে বাজে সাড়ে পাঁচ। কমতে থাকা দিনের আলো, বাড়তে থাকা রহস্যময়তা, গাছের ডালে ডালে ফিসফিস করা ভয়ানক মিষ্টি, রঙচঙে রাক্ষুসে কাঠবিড়ালী (জায়েন্ট স্কুইরেল), চিন্তিত হনুমান আর ফিচেল বাঁদরের দল। ল্যাজ গুটিয়ে ছুট্টে পালানো বনমুরগি, কান খাড়া চেনা হরিণের দল সবই ভীষণ পরিচিত। নতুন আলাপ বলতে রাস্তা পেরিয়ে যাওয়া বার্কিং ডিয়ার, এরা বলে বনছাগল। মোটেই ক্যামেরা ফ্রেন্ডলি নয় ব্যাটারা।
সন্ধ্যে সাড়ে ছটার পর টর্চের আলোয় দেখা হরিণের দল। রাতের বেলা জোনাকির মত জ্বলে ওদের চোখ। আলো ফেললেও কেমন যেন ভেবলে গিয়ে খানিক তাকিয়ে থাকে, তারপর আবার মন দেয় নুন চাটতে। রাত বাড়তে আসে হাতির দল। তারা অবশ্য চোখে টর্চ মারলে মোটেই খুশি হয় না। বরং বেশ বিরক্ত হয়। হুঙ্কার ছাড়ে। গাইড দাদা বলে, ‘বেশি বিরক্ত করলি ওরা কিন্তু গাছ তুলে ছুঁড়ে দেবে।‘ যাদের উদ্দেশ্য বলা তাঁরা কর্ণপাতও করে না। প্রায় ১৭/১৮ জন মধ্য ৩০থেকে ৫০ এর মহিলার দল, ওয়াকিটকিতে ছড়িয়ে পড়া হাতির খবর শুনে তাদের গাইড তাদের চাহালায় নিয়ে এসেছেন। তাদের উল্লাস দেখে কে!
আধো অন্ধকারে ওয়াচটাওয়ার ছেড়ে বেশ খানিকটা পিছিয়ে এসে একটা মস্ত কাঁঠাল গাছের তলায় বসলাম আমরা। গাইড দাদা ফরেস্টেরই এক কর্মচারীকে ধরে চা বানালেন, জিভ পোড়ানো কালো চা, তাতে প্রচুর মরিচ গুঁড়ো আর সামান্য বিটনুনের তড়কায় পুরো অমৃত। দিদিমণিদের হর্ষ চায়ের উত্তাপে কিছুটা জুড়াল বটে, তার ওপর ছিল হাতি সংক্রান্ত নানা গল্প। যেমন হাতির স্মৃতিশক্তি নাকি ভয়ানক প্রখর। হাতি নাকি দারুণ গন্ধ পায়। কোন রাস্তা দিয়ে একবার গেলে, হাতি সে রাস্তা ভোলে না। কোন মানুষ হাতির ক্ষতি করলে,হাতি নাকি ঠিক তাকে খুঁজে বার করে শাস্তি দেয়। শাস্তি বলতে শুঁড়ে করে গাছ তুলে ছুঁড়ে মারা। গাছ যদি খুব শক্ত হয়, মাটি ছাড়তে না চায়, হাতিরা করে কি নিকটবর্তী জলাশয় থেকে শুঁড়ে করে জল এনে মাটি ভিজিয়ে চেষ্টা করে গাছটাকে ওপড়াতে। নুন খাবার ভয়ানক লোভ হাতির। নুন খাবার তাড়নায় মাটিতে গর্ত করে ফেলে। আর হাতি ভালোবাসে মহুয়া খেতে। আদিবাসী গাঁয়ে কোথাও যদি মহুয়া তৈরি হয়, গন্ধে গন্ধে পৌঁছে যায় হ্যাংলা হাতির দল আর দেওয়াল ফুটো করে, শুঁড় ডুবিয়ে শুষে নেয় মহুয়া। তারপর মাতাল হয়ে টহল দিয়ে বেরায় বনে বনে।
গাইড দাদা বলল, মাতাল হলেও তাল জ্ঞান নষ্ট হয় না হাতির। কিছুদিন আগে এমনি এক মাতাল হাতি বেশ কিছু শস্য নষ্ট করছিল, তখন হাতি তাড়াতে জনা কয়েক স্থানীয় যুবক বিভিন্ন গাছের ওপর উঠে তীর চালাতে থাকে। তার মধ্যে একটা তীর সত্যিই হাতির লেগে যায়, সামান্য রক্তপাতও হয়। ব্যাস, কিভাবে যে হাতিটা বোঝে কার তীরে আহত হয়েছে সে, কে জানে। কিন্তু পাগলের মত দৌড়ে যায় সেই গাছটার দিকে, তারপর ধাক্কা মারতে থাকে বারবার। বিশাল মহীরুহ ছিল বলে ঐ ধাক্কাও সয়ে যায়। তখন হাতি করে কি দাঁত দিয়ে গাছটাকে এফোঁড়-ওফোঁড় করতে থাকে। ছেলেটা তো ভয়েই আধমরা, সবাই দূর থেকে বলে, ‘হাতি যা পারে করুক, তুই নামিস না। নামলে ও তোকে জিন্দা ছাড়লি না।‘ তারপর সন্ধ্যা নামতে নামতে হাতির মাথা বোধহয় ঠান্ডা হল বা নেশা কাটল, তখন সে আবার জঙ্গলে ঢুকে গেল।
হাতির গল্প শুনে, হাতি দেখে, রাতের জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে পাগলের মত টর্চ মেরে লেপার্ড খুঁজতে গুঁজতে আমরা যখন বড়েইপানি নেচার ক্যাম্পে পৌঁছালাম তখন রাত নটা। আজ মেঘলা ছিল বলে সোলার ব্যাটারি বসে গেছে। কটেজ গুলো ছাড়া বাকি সবকিছু ঘুট্ঘুটে অন্ধকারে নিমজ্জিত। অনেকরাতে উঠল মরা চাঁদ, জেনারেটরের আলোয় কোন মতে ডিনার সেরে ফাঁকা চত্বরে যখন পায়চারি করছি,মনে হল আজই শেষ রাত। কাল থেকে আবার আমাদের ঘিরে থাকবে ইঁট আর কনক্রিটের জঙ্গল। কাল অপরাহ্নের মধ্যেই আবার সভ্যতায় ফিরে যাব আমরা। এসে পড়বে ফোনের টাওয়ার। ঢুকবে গুচ্ছের নোটিফিকেশন, মেসেজ আর মেল। সেটা একই সাথে কাম্য আবার অকাম্যও বটে।
নিয়ম মত, ঠিক সকাল সাড়ে ছটায় জিভ কড়া নেড়ে এসে হাজির হল জিভ পুড়ানো সর সমেত মোটা দুধের চা। অত সকলেও ঝকঝকে রোদে ভেসে যাচ্ছে চরাচর। হরেক রকম গাছের, হরেক রঙা পাতায় লুকোচুরি খেলা রোদ তৈরি করছে বিচিত্র রামধনু। আগের দিনের মতই,স্নানাদি সেরে, ঠিক নটায় আটার পরোটা, জলজলে ঘুঘনি, গরম অমলেট আর মিষ্টি উপমা দিয়ে প্রাতরাশ সেরে আমরা বেরিয়ে পড়লাম বড়েইপানি নেচার ক্যাম্প থেকে। আজ বিকালে আর ফিরে আসব না আমরা।
গন্তব্য বাড়ি, পথে পড়বে জোরাণ্ডা জলপ্রপাত। জোরাণ্ডা দেখে আমরা বারিপদা হয়ে ফিরে আসব তাম্রলিপ্ত নগরী। যদিও বড়েইপানি থেকে বারিপদা যাবার পথেই পড়ে জোরাণ্ডা, তবে বেশ অনেকটা ভিতরে। পৌঁছানোর পথ যথারীতি নয়নাভিরাম, কোথাও ঘন জঙ্গল, কোথাও বা ফাঁকা উপত্যকা। উপত্যকা ঘিরে ছোট ছোট আদিবাসী গাঁ। ছোট আশ্রম। কোথাও স্কুল ইউনিফর্ম পরে স্কুল যাচ্ছে কচিকাচার দল। উদ্দাম হাত নাড়াচ্ছে চলন্ত গাড়ির উদ্দেশ্যে, কোথাও বা সাইকেলে মস্ত একটা গাছের গুঁড়ি চাপিয়ে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে চার পাঁচ জন পুঁচকে ছানা সিমলিপাল মোটেই একঘেঁয়ে নয় যাই বলুন।
জোরাণ্ডা সিমলিপালের সবথেকে জনপ্রিয় ট্যুরিস্ট স্পট। যেহেতু বারিপদা বা লুলুং থেকে মাত্র দু আড়াইঘন্টা তাই প্রচুর ডে ট্যুরিস্ট আসেন। তারওপর আমাদের মত লোকজন তো আছেই, যাঁরা জঙ্গলেই রাত্রিবাস করেছেন। তাই জোরাণ্ডায় একটু সকাল সকাল যাওয়াই মঙ্গল। মোটামুটি এগারোটার মধ্যেই জোরাণ্ডা পৌঁছালাম আমরা। তখনও বেশ ফাঁকা। উঁচু পাহাড়ের ওপর থেকে সিঙ্গল ড্রপ ওয়াটার ফল, অনেকটা মেঘালয়ের নওকালিকাই এর মত। তবে নওকালিকাই জলপ্রপাতের নীচের পুলটা যেমন টলটলে নীল, এটা তেমন নয়। সাদা বা ঘোলাটে মনে হবে। জোরাণ্ডা জলপ্রপাতকে ঘিরে গহীন জঙ্গল, আগে এখানেও একটা নেচার ক্যাম্প ছিল, মাওবাদী হামলার পর বন্ধ হয়ে যায়।
জোরাণ্ডা থেকে পিথাবাটা গেট আসতে সময় লাগে আরো ঘন্টা দু আড়াই। এদিকে জঙ্গল যেন আরো ঘন, পাহাড় ও অনেক বেশি খাড়া। জন্তুজানোয়ার তেমন না মিললেও ময়ূর মেলে ভুরিভুরি। যত ঢলে পড়ে সূর্যি মামা, ততো বাড়ে ময়ূরদের আনাগোনা। আর কত যে বিচিত্র ফুল ফুটে থাকে এই পথে, খোলা জানলা দিয়ে হুড়মুড় করে ফুলেল সুবাস বয়ে আনে দুষ্টু বাতাস।
পিথাবাটা গেট দিয়ে বেরিয়ে আসার পর গাইড দাদা বললেন,‘ দাদা লুলুং দেখবেন নাকি?’ পিথাবাটা থেকে আনুমানিক তিন কিলোমিটার। লুলুং নদীর ধারে গড়ে উঠেছে গোটা দুই বিলাসবহুল রিজর্ট। জঙ্গল দেখে বেরোলে বড় আলুনি লাগে সবকিছু। তবুও গেলাম আমরা,সরু পাথুরে খাত ওয়ালা প্রায় শুকিয়ে আসা নদী। একটুও ভালো লাগল না। গাইডদাদা হেসে বললেন,‘ভালো লাগলি না তো? আমি জানতাম। তবে অনেকে এসে এখেনেই থাকে কি না। আপনি সিমলিপাল দেখে যখন কলকাতায় যাবেন, লোকজন বলবে, লুলুং দেখোনি? তাহলে তো কিছুই দেখোনি। লুলুংটাই তো আসল। আমি বাঙালিদের জানি, তাই বললি, একবার দেখে লিন দাদা।’
(শেষ)
No comments:
Post a Comment