পট্টনায়ক কাকুকে বললাম, ‘আপনাকে তো মিউজিয়ামে সংরক্ষণ করতে হয়।’ মহানগরের বুকের ওপর তখন নামছে বাসন্তী সন্ধ্যা। নিউটাউন যাবার রাস্তার ধারে, এক সস্তা চায়ের দোকানের সামনে পেতে রাখা জীর্ণ কাঠের বেঞ্চিতে বসে চা খাচ্ছি আমরা। পট্টনায়ক কাকু আর আমি। দুজনেই ভয়ানক ‘চাতাল’। চা’টা এই মুহূর্তে আমার কাছে শুধু চা নয়, খাদ্যও বটে। আপিস টাইমের ভাত খেয়ে, অর্ধেক আপিস করে বেরিয়েছি তমলুক ছেড়ে। দিন দুয়েক ধরে এটাই আমার নৈমিত্তিক রুটিন। আগের দিন টি জাংশানের কফি খেয়েছিলাম দুজনে, পছন্দ হয়নি পট্টনায়ক কাকুর, তাই আজ ওণার মনপসন্দ মাটির ভাঁড়ে জিভ পোড়ানো চা, সাথে দুটো কড়কড়ে সুজির বিস্কুট। সামনের ব্রিজ থেকে ঝুঁকে পড়া কি যেন এক অচেনা লতার পাতার ফাঁকে লুকোচুরি খেলা সূর্যের দিকে তাকিয়ে, তপ্ত মাটির ভাঁড়ে একটা লম্বা চুমুক মেরে ভ্রু কুঁচকে বাজখাঁই গলায় জানতে চাইলেন, পট্টনায়ক কাকু, ‘কেন?’
‘কেন’ আবার কি? এমন মানুষ আজকালকার দিনে খুঁজে পাওয়া যায় নাকি? ভদ্রলোক পেশায় ছিলেন ডিভিসির ইঞ্জিনিয়ার আর সম্পর্কে আমাদের প্রতিবেশী। একমাত্র সন্তান সাবলম্বী হয়ে যেতেই দুম করে একদিন চাকরিটা ছেড়ে দেন পট্টনায়ক কাকু। আজকাল মর্নিং ওয়াক করেন হনহনিয়ে, বাজারওয়ালার সাথে সামান্য দরাদরির পর জমিয়ে করেন খোশগল্প, বাজার নিয়ে ফেরার পথে চায়ের দোকানের ঠেকে আরেক প্রস্থ আড্ডা মেরে বাড়ি ফিরে কম্পুটার নিয়ে বসেন জনসেবায়। আবাসনে যত নিঃসহায় বৃদ্ধ-বৃদ্ধা আছেন, যাদের কৃতি সন্তানেরা কেউ বিদেশে কেউ বা ভিনরাজ্যের গর্বিত নিবাসী, তাঁদের যাবতীয় ট্যাক্স-ইলেকট্রিক বিল-ফোন-টাটাস্কাই রিচার্জ করে দেন। এমনকি ডিসকাউন্টে ওষুধপত্রও আনিয়ে দেন বিভিন্ন ওয়েবসাইট থেকে। সন্ধ্যে বেলা কাকিমার সঙ্গে বেরোন একদফা রোমান্টিক ওয়াকে। আবাসনের সামনের চায়ের দোকান থেকে মাটির ভাঁড়ে চা খেতে খেতে সারেন প্রেমালাপ, এটা অবশ্যি আমিই বলি কেবল। ওণারা বলেন, ওগুলো নাকি মধ্যবিত্তের তেল-নুন-লকড়ির গল্প। দিনের শেষে পট্টনায়ক কাকু ঢুঁ মারেন আমার শ্বশুর তথা ওণার ভটচায সাহেবের কাছে। বিভিন্ন বিষয়ে তাত্ত্বিক আলোচনা সেরে, এক কাপ চা বা ক্ষেত্র বিশেষে এক পেয়ালা ইয়েতে তুফান তুলে শুভরাত্রি।
৭ই মার্চ কাক ভোরে যখন আচমকা নেতিয়ে পড়লেন শাশুড়ি মা, আমাদের ঘুম ভাঙানোর আগে, প্রথম ফোনটা শ্বশুরমশাই করেছিলেন পট্টনায়ককাকুকে। আমরা ছিলাম দুই নম্বরে। তমলুক থেকে যখন ছুটতে ছুটতে গিয়ে আমরা পৌঁছালাম,দেখি বৃদ্ধ শ্বশুরমশাইকে হাত ধরে হাসপাতাল থেকে বাইরে নিয়ে আসছেন পট্টনায়ক কাকু। শাশুড়িমাকে ততক্ষণে এমারজেন্সি থেকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে ICU। প্রিয়তমা স্ত্রীর আচমকা অসুস্থতায় যৎপরনাস্তি ঘাবড়ে গেছেন বৃদ্ধ। আমাদের অবর্তমানে তাঁকে সাহস তথা বুদ্ধি দিয়ে, হেল্থস্কিম, আধারকার্ড ইত্যাদি যাবতীয় কাগজপত্র গুছিয়ে, অ্যাম্বুলেন্স ডেকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলেন ঐ পট্টনায়ক কাকুই। এমন মানুষকে যদি না মিউজিয়ামে রাখা হয়, রাখা হবে কাকে?
গল্প তো এখানে শেষ না। শুরু বলতেই পারেন। বৃদ্ধার হিমোগ্লোবিন নেমেছিল ২.৯ এ। সে যাত্রা তাঁকে মোটামুটি সুস্থ করে বাড়ি এনে, ২৪ঘন্টার দেখাশোনার লোক রেখে, পরিস্থিতি কিছুটা সামলে দিন দশেক পর, আমরা গেলাম সিমলিপাল। একদিনের সিএল আর আরেকদিনের স্টেশন লিভের অনুমতি সম্বল করে। জঙ্গলে ঢোকার আগে উভয়ের এক জোড়া বৃদ্ধ-বৃদ্ধাকে পইপই করে বলে গেলাম আমরা, মাত্র ৪৮টি ঘন্টা পরিষেবা সীমার বাইরে থাকব আমরা। সবাই যেন খুব সাবধানে থাকে এই সময়টা। তারপর তো আমরা আসছিই।
পথশ্রমের ক্লান্তি, জঙ্গুলে গা ছমছমে নির্জনতা, ক্যাম্পের বাইরে লেপার্ড আসার গল্প, সুস্বাদু দিশী মুরগির ঝোল কিছুতেই আমার ঘুমটা জমল না সিমলিপালে। প্রথম রাতে স্বপ্ন দেখলাম, খুব খারাপ অর্থনৈতিক অবস্থায় পড়েছি আমরা। বাবা অবসর নিয়েছে, মায়ের রিটায়ারমেন্ট সামনেই, সংসার চলবে না। আমায় একটা ৬০৩৬টাকার চাকরি জোগাড় করতেই হবে। সকালে স্বপন বৃত্তান্ত শুনে শৌভিকের সেকি হাসি। ৬০৩৬ই কেন? কারণ ওটাই যে ছিল আমার প্রথম বেতন। রাইটার্সে লোয়ার ডিভিশন ক্লার্ক হয়ে ঢুকে পাওয়া প্রথম মাইনে। কড়কড়ে নতুন টাকায়।
দ্বিতীয় রাতে স্বপ্ন দেখলাম, পলেস্তারা খসে পড়ছে আমাদের বাড়ির, যত্রতত্র গজিয়ে ওঠা আগাছা গুলো রূপান্তরিত হয়েছে মহীরুহে। ইঁট বার করা সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠতে গিয়ে আটকে গেছে আমার পা। নীচে থেকে বেদম চিৎকার করছে বাবা,মা আর পিসি আমায় উঠতেই হবে দোতলায়। কিন্তু পারছি না। ঘুম ভেঙেও কাটছিল না আতঙ্ক। রবিবার মধ্যাহ্নে জঙ্গল ছেড়ে বেরিয়ে টাওয়ার পেতেই যে যার বাড়িতে ফোন লাগালাম আমরা। ফোন পেয়ে বাবার সে কি উল্লাস,‘হ্যালো! আমরা খুউব ভালো আছি-’। ফোন ছাড়াও দিব্যি শোনা যেত। মা যদিও মিনমিনে স্বরে বলল,‘আর যাস না।’ নিশ্চিন্ত হয়ে ফোন রেখে দেখি পাশে শুকনো মুখে বসে আছে শৌভিক।
কি হল? জবাব এল শ্বশুরমশাইয়ের ফোন বন্ধ আর ল্যান্ড ফোন বেজে গেল। বৃদ্ধ আবার ফোন বন্ধ রেখেছে কেন? কি জ্বালা। চার্জে বসাতে ভুলে গেছে নির্ঘাত। দীর্ঘশ্বাস ফেলে শৌভিক বলল,‘একটু পরে দেখছি।’ আমার তর সইলে তো। আবার করলাম। আবারও। তিনবারের বার ল্যান্ডফোনটা তুললেন শাশুড়ি মা। শৌভিক কেড়েই নিল প্রায় ফোনটা, অতঃপর,‘বাবার ফোনটা বন্ধ কেন? সে কি গো, বাবা হাসপাতালে?’
শ্বাসকষ্ট জনিত কারণে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছে শ্বশুরমশাইকে। আর কে নিয়ে গেছেন বলুন তো? অবশ্যই পট্টনায়ক কাকু। অর্থবর্ষের শেষে আপিস ফেলে মহানগরে এসে থাকা অসম্ভব, তাই যাতায়াতই ভরসা। বড়সাহেবের অনুমতি নিয়ে দেড়টায় তমলুক ছেড়ে বেরিয়েছি আমি, ডাক্তার আসবে তিনটে নাগাদ। আগে আউটডোর পেশেন্ট দেখে তারপর কথা বলবেন ইনডোর পেশেন্টের বাড়ির লোকের সাথে। সাড়ে তিনটের মধ্যে পৌঁছালেই হল। আমাদের উত্তমকুমার যেভাবে গাড়ি চালায়, আরেকটু আগেই পৌঁছে যাব আমি। সে কথা ফোনে জানালামও পট্টনায়ক কাকুকে, উনি বললেন,‘ তাড়া কি? আস্তে সুস্থে এস। আমি তো যাবই।’
ডাক্তারের সাথে কথা হবার পরও বেশ খানিকক্ষণ বসতে হয়, ভিজিটং আওয়ারে বৃদ্ধকে দেখে, তাঁর অসুস্থ প্রিয়াকে তাঁর কুশল সংবাদ দিয়ে বাড়ি ফিরব। সেই ফাঁকেই আগের দিন কফি খেয়েছিলাম আমরা। আজ চায়ের পালা। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতেই খোশগল্প হচ্ছিল। পট্টনায়ক কাকুকে বললাম, ওণার মত মানুষকে মিউজিয়ামে সংরক্ষণ করা উচিত। উনি উল্টে আমায় বললেন, কেন?‘ এটাই কি স্বাভাবিক নয়?’ মানুষ তো মানুষেরই জন্য। প্রতিবেশী হয়ে প্রতিবেশীর দুর্দিনে এইটুকু করব না? মাথা নেড়ে বললাম,। ‘স্বাভাবিকই তো। ঘোরতর স্বাভাবিক। তবে ছিল। সেই শরৎচন্দ্রের ইন্দ্রনাথ বা লালুর জমানায়। আজ এমন একটা লোক আপনি আমায় খুঁজে দেখান তো মশাই? আপনাকে সত্যিই জাদুঘরে নিয়ে গিয়ে সংরক্ষণ করা উচিত।
No comments:
Post a Comment