Sunday 23 January 2022

অনির ডাইরি ২৩শে জানুয়ারী ২০১৯

 

 বিগত মধ্যরাত্রি থেকে যাঁরা ফেসবুক- হোয়াটস্অ্যাপ- এসএমএস আর মেসেঞ্জারে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন, যাঁরা শুধুমাত্র অন্তর্জালে আবদ্ধ না থেকে ফোনটা করেই ফেলেছেন, তাদের সকলকে অসংখ্য ধন্যবাদ। বড় ব্যস্ত এ জীবন আর বড়ই মূল্যবান এ সময়,তবুও তার মধ্যে থেকে কয়েক মুহূর্ত চুরি করতে পারা বড় কম কথা নয়। বিশেষতঃ অনিন্দিতা এবং চৈতালী এই মুহূর্তে যে চরম মানসিক শূণ্যতায় ভুগছে, তার মধ্যেও তাদের পাঠানো শুভেচ্ছায় আমি এক্কেবারে অভিভূত  তথা বিগলিত। 


এমনিতে আমি নিজেকে হাওড়ার মেয়ে বলে দাবী করলেও আমার জন্ম সেই সুদূর মুর্শিদাবাদের শক্তিপুর প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। সে বছর বড় জব্বর শীত পড়েছিল, বাবা তো বলে সেটা নাকি বিগত শত বছরের শীতলতম দিন।ফুলহাতা হলুদ পুলওভারের ওপর জেঠুর কাছ থেকে ধার করা ওভারকোট চাপিয়ে, বাবা যখন পলাশী স্টেশনে নেমেছিল তখন ২১শে জানুয়ারি এর গভীর রাত। ডাক্তারের নির্ধারিত দিনলিপি অনুসারে আমার জন্মানোর কথা ছিল ২১শে জানুয়ারীই। ছুটি আর টাকা জুটিয়ে পৌঁছতে পৌঁছতে একটু দেরীই হয়ে গিয়েছিল বাবার, তাও প্রতিশ্রুতি মত টাকাপয়সা যোগাড় হয়নি। মন খারাপ আর উত্তেজনার যুগলবন্দি নিয়ে, বড় পাঁচ সেলের টর্চের ভরসায় অন্ধকার পাকা রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে গঙ্গার ধার। শেষ পারানির নৌকায় নদী পেরিয়ে,এবার কাঁচা মাটির রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে দেড় কিলোমিটার পথ পেরিয়ে দিদার বাড়ি পৌঁছে দেখে মা দিব্যি হেঁটে চলে বেড়াচ্ছে, দুপুরে ভারি মশারি কেচেছে,মায়ের মনোবল তুঙ্গে। আর আমি? দূর দূর ডাক্তারবাবু বললেই হল নাকি? আমার বাবা না এলে আমি ভূমিষ্ঠ হব থোড়াই? ২১তো দূরের কথা-২২টপকে সেই ২৩শে ভোরে জন্মেছিলাম আমি। জন্ম থেকেই বাবার প্রাণ। এখনও প্রতি বছর ২২তারিখ রাতে বাবা আরেক বার শোনায়,ঠিক কি হয়েছিল সেবছর ২১-২২-২৩শে জানুয়ারী। 

বিয়ের পরও প্রতিবছর এই দিনটা নিয়ম করে হাওড়ায় কাটাই। না হলে বড় বেশী দুঃখ পায় আমার বৃদ্ধ বাবা। মেয়েটা তাহলে পরই হয়ে গেল। চ্যাটার্জী থেকে ভট্টাচার্যই হয়ে গেলে শেষে? 

এবছর আর যেতে পারিনি। কারণ মেয়ের স্কুল এবং আসন্ন পরীক্ষা। গতকাল মধ্যরাত্রে তাই আমিই ফোন করলাম আমার বৃদ্ধ-বৃদ্ধাকে। শৌভিক যদিও চিমটি কাটছিল,“ওরে ওদের ঘুমোতে দে। ” কিন্তু আমি তো চিনি,বড় বেশী করে চিনি আমার জন্মদাতা এবং দাত্রীকে। জানতাম শ্রোতা হিসেবে আমি নেই তো কি, দালানের ডাইনিং টেবলে বসে নিঃসঙ্গ  বুড়োবুড়ি নিজেরাই স্মৃতিচারণ করছে সেই দিনটার। ফোন পেয়ে খুশির সীমা রইল না। যাক মেয়েটা বদলে যায়নি। আরো জানালাম বাপের বাড়ি যাচ্ছি না বলে,শ্বশুরমশাই খেতে নিয়ে যাবেন বলেছেন, আমার প্রিয় রেস্টুরেন্টএ। এরপর তো আর হাওড়া না যাওয়া নিয়ে কোন অভিযোগই থাকতে পারে না। 

ভোর থেকে স্বামী এবং কন্যা পর্যায়ক্রমে চপেটাঘাত  করেই চলেছে,“তুমি তো ছোট্ট বেবি। ছোট্ট বেবিদের জন্মের পর মেরে কাঁদাতে হয়।” জন্মের শোধ তুলে নিল বোধহয় দোঁহে। 

বেলা বারোটার সময় তৈরি হয়ে নেমে দেখি,গাড়িতে শাশুড়ি মাও বসে।  হাঁটু এবং ব্যালান্সের সমস্যার জন্য উনি পারতপক্ষে বাড়ি থেকে নড়তে চান না। তিনি নিজে চলেছেন,স্বেচ্ছায় আমার জন্মদিন পালন করতে পার্কস্ট্রীট এর থেকে আনন্দের আর কি হতে পারে? তুত্তুরী মহানন্দে গিয়ে বসল ঠাকুমা-ঠাকুরদার কোলে। 

চালাও পানসি মার্কোপোলো। মার্কোপোলোর গোল্ডেন ক্রাম্ব ভেটকি আর মোহিতো দিয়ে যাত্রা শুরু করে- চেলো কাবাব হয়ে হট ব্রাউনি উইথ ভ্যানিলা আইসক্রীম দিয়ে ভুরিভোজ সমাপ্ত হল। পিটারক্যাটের সাথে চেলোকাবাব সমার্থক যাঁরা মনে করেন অনুগ্রহ করে একবার মার্কোপোলোয় খেয়ে দেখবেন। আর ফিশ এণ্ড চিপস্ টাইপ মাছ ভাজা ওদের অতুলনীয়। এত ভালো ভেটকি খুব কম রেস্টুরেন্টেই পাওয়া যায়। শৌভিক নির্দ্বিধায়,হাসিমুখে  বিল মেটাবার পর প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হলাম, আগামী একবছর বরকে কোন বাজে কথা বলব না।ঝগড়া করব না।  সেটা যদিও তুল্যমূল্য  বিচার করতে করতে আপাততঃ আগামী এক পক্ষে এসে দাঁড়িয়েছে।  


ফেরার পথে ২ নং বাবা বললেন,“চলো একটু ঘুরে যাই। ছোট্ট করে লং ড্রাইভ আরকি।” ফলতঃ বাড়ির পথ না ধরে, গাড়ি ছুটল বিদ্যাসাগর সেতুর পথে। কোনা এক্সপ্রেস ওয়েতে বেশ খানিকটা ঘুরপাক খেয়ে, নিবেদিতা সেতুতে ৪৫টাকার টোল দিয়ে গঙ্গার হাওয়া খেয়ে অবশেষে বাড়ি ফিরলাম। 

আরেকবার অসংখ্য ধন্যবাদ জানাই আপনাদের সকলকে, খুব ভালো থাকুন সকলে। সময় বড় নির্মম, যে হারে গুরুজনদের ছাওয়া সরে যাচ্ছে মাথার ওপর থেকে-- আজকে শুধু আজকের দিনে আঁকড়ে ধরতে চাই আমার প্রতিটা প্রিয়জনকে, আর বলতে চাই-- যাই হোক না কেন আমায় ছেড়ে যেও না। সময় যতজোরেই দৌড়ক না কেন, আমি বদলাইনি।  তোমরাও বদলে যেও না।

Thursday 20 January 2022

আয় তবে সহচরী, ২০শে জানুয়ারী, ২০২২

 

👩🏻-এই তোমরা love like pity hate kiss miss marriage খেলতে?

👩🏻‍🎤- সেটা আবার কি? আরে হ্যাঁ ফ্লেমস্। F for friends, l for love এই সব। এখন কি তুত্তুরীরা খেলে?  

👩🏻- আরে না। ঐ যে দুটো লোকের নামের কমন লেটার গুলো কেটে কুটে যেগুলো পড়ে থাকে, সেই সংখ্যাটা দিয়ে দেখা। 1 হলে love, 2 হলে like এইভাবে। 7 হলে marriage। 8 হলে আবার লাভ। যেমন ধর Shyam আর Mita। এদের নাম নিয়ে খেললে, শুধু A আর M কাটবে। পরে থাকবে 5টা লেটার। অর্থাৎ ওদের সম্পর্ক হবে kiss😂😂😂


👩🏻‍🎤- (পরদিন সন্ধ্যা বেলা) আমার বরের নামের সাথে খেললাম, পিটি এল😔। কে যে কাকে দয়া করে কে জানে। 

👩🏻- দুঃখের কথা কি আর বলি, আমি সেই শচীন তেণ্ডুলকর থেকে শুরু করেছিলাম।  আমার কোন ক্রাশের সঙ্গে আমার লাভ কিস ম্যারেজ আসে না😣😫😩


👩🏻‍🎤- ঐ ভয়েই শালা আমি নিজেরটা আর করছি না। কিন্তু কি নেশা মাইরি। একটা পুরানো খাতা যোগাড় করে খেলেই যাচ্ছি। কার সাথে কারটা দেখব বলো?


👩🏻-👩🏻‍🎓 সাথে 👨🏻‍🎓 কি আসে দেখ দিকি?  


👩🏻‍🎤-(কাটাকুটি অন্তে) এই 👩🏻‍🎓, তোমাদের কিন্তু লাভ বেরোল। এই দ্যাখ। 😆😆😆


👩🏻‍🎓- (প্রবল ক্রোধান্বিত হয়ে) কত সাধ যায় রে চিতে

মলের আগায় চুটকি দিতে!!


👩🏻‍🎤-(সবজান্তা ভঙ্গিতে)এটা কি মারাত্মক এফেক্টিভ। 


👩🏻-(বোকার মত) কিন্তু এর মানে কি?মল মানে তো ইয়ে,পটি? পটির ওপর ডিজাইন করতে বলছে নাকি?


👩🏻‍🎤- ডিজাইন করতে কোথায় বলল? সেটা কি করে সম্ভব? বলছে তো ইয়ের আগায় চুটকি দিতে। তার মানে সঠিক সময় হাতটা পিছনে ঘুরিয়ে চুটকি বাজাতে ইচ্ছে হচ্ছে নির্ঘাত।(কিঞ্চিৎ চিন্তাভাবনা অন্তে) তবে ব্যাপারটা বড্ড messy হয়ে যাবে না? আর ইয়ে বড্ড দুর্গন্ধ ও।


👩🏻‍🎓-উফঃ ভগবান। মল মানে নূপুর। এরা কি  বাঙালি?

অনির ডাইরি ২০শে জানুয়ারি, ২০২২

 


‘হ্যাঁ কে, অনিন্দিতা? তুমি কি অফিসে?’ অচেনা  নম্বর, অপিরচিত কণ্ঠ। বৃহস্পতিবার বেলা দেড়টায় আর কোথায় থাকব? তাই জবাব দিলাম। ফোনের ওপাড়ের ভদ্রলোক বললেন, ‘ কি আমাকে চিনতে পারছ?’ অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে জানালাম, নাঃ, মাত্র দুটো বাক্য বিনিময় হয়েছে,এবং তার দ্বারা কণ্ঠের মালিককে চিনতে আমি সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছি। তিনি মৃদু হেসে বললেন, ‘এর মধ্যেই ভুলে গেলে? আমি রসুল সাহেব।’ 

ফোন ধরা অবস্থাতেই সটান চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম, ‘স্যার।’ রসুল সাহেব অর্থাৎ শ্রী আজিজ রসুল ছিলেন লেবার সার্ভিসের অন্যতম উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক। যে সব সিনিয়র অফিসারদের দেখে তথা যাঁদের থেকে আমরা অর্থাৎ অফিসার হবার তালিম পেয়েছি রসুল সাহেব হলেন তাঁদের অগ্রগণ্য। বর্তমানে অবসর প্রাপ্ত, তাতে কি? শিক্ষক তো শিক্ষকই থাকেন। স্যার বলেছিলেন বটে মাঝে মধ্যে এদিকে আসেন, তখন অনুরোধ করেছিলাম, যদি একবার অনুগ্রহ করে অধমের আপিসে পায়ের ধুলো দেন। 


স্যারকে আজ আবার বললাম সেই একই কথা। যদি আসেন, একটু কষ্ট করে। শিক্ষক সুলভ গাম্ভীর্যের সাথে স্বল্প হেসে স্যার বললেন, ‘আরে আসব বলেই তো জানতে চাইছি, তোমার আপিসটা কোথায়?’ বললাম আপনি যেখানে আছেন দাঁড়ান, আমি নিজে যাচ্ছি আপনাকে আনতে। এবার বকেই দিলেন স্যার, ‘আরেঃ বাবা, তুমি কেন আসবে? তোমার গাড়িটা একটু পাঠাও।আমার ড্রাইভার খেতে গেছে। ’ কথা শুনে বুঝলাম পাশের, পাশের বিল্ডিং এই আছেন স্যার। গাড়ি তো পাঠালামই, সাথে জসূয়াকেও পাঠালাম। জসূয়া আমার ইন্সপেক্টর। এই মুহূর্তে এই আপিসে আমার পরেই সবথেকে সিনিয়র ব্যক্তি। আমি না যাই, নং ২ তো অন্তত যাক। 


সেই ফাঁকে শুভাশিস আর আমাতে ব্রেন স্টর্মিং করতে লাগলাম, স্যারকে কি দিয়ে আপ্যায়ন করা যায়। স্যার তো রীতিমত মিতাহারী, খোঁজখবর নিয়ে দেখা গেল ক্যান্টিনে আজ শুধু স্যান্ডউইচ আর মিষ্টি পাওয়া যাবে আর মর্তমান কলা। কফি বললে করে দেবে বটে, তবে ওদের কফি বড় পাতলা লাগে আমার। 


স্যার এলেন, গোটা আপিস ঘুরে দেখলেন, খাবার যাবতীয় প্রস্তাব উড়িয়ে দিয়ে শুধুমাত্র চা খাবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে আমার চেম্বারে বসলেন। বারবার অনুরোধ করলাম, স্যার আমার চেয়ারে বসুন। ওটাই এ ঘরের সবথেকে উঁচু চেয়ার। শুনলেনই না। টেবিলের উল্টোদিকের বিবর্ণ ভিজিটর চেয়ারে বসলেন। একটা তোয়ালে পাততেও দিলেন না। স্যারের উল্টোদিকে উঁচু চেয়ারে বসতে ভয়ানক অস্বস্তি লাগছিল, আবার বললাম, ‘স্যার প্লিজ বড় চেয়ারটায় বসুন।’ স্যার হেসেই উড়িয়ে দিলেন,‘এখন তো আমি অবসর প্রাপ্ত, ইন সার্ভিস থাকলেও বসতাম না। তোমার চেয়ারটা তোমারই। নির্দ্বিধায় বসো।’ সাধে এই লোকগুলোকে এত ভক্তিশ্রদ্ধা করতাম আমরা। উঁচু চেয়ারে বসেও যে মাটির কাছে থাকা যায়, এগুলো এণাদের থেকেই শেখা। সাধে কি বলি, বস্ এরা আমাদের বস্ হতে শেখায়। ভালো থাকবেন স্যার। সময় পেলে আবার আসবেন। আরেকবার ঝালিয়ে নেব পুরাণ অনুশীলনী যত। 


Wednesday 19 January 2022

অনির ডাইরি ১৯ই জানুয়ারি, ২০২২

 


#তাম্রলিপ্তকড়চা


পরশু সন্ধ্যা ৭টা১০- আপিস থেকে বাড়ি ফিরে তুত্তুরীকে পড়াতে বসেছি, লোকটার মেল ঢুকল।  নাঃ লোকটাকে আমি ব্যক্তিগত ভাবে চিনি না, নিখাদ কেজো ইমেল। 


বাংলা বই খুলল তুত্তুরী। সুর করে ‘কাজলা দিদি’ মুখস্থ করছে, আমি মন দিলাম লোকটার চিঠিতে।  লোকটা লিখেছে, ‘মাননীয়/মাননীয়া মহোদয়, পত্রের প্রথমেই আমার পরিচয় জানাই।  আমি হলুম ধরুন গিয়ে শ্রী আজিজুল। মোর বাপের নাম ধরেন গিয়া এজাদ। মোর গাঁয়ের নাম, পূব বাহালা।১০ই মার্চ ১৯৫৯ সালে মোর জন্ম। পেশায় ছিলুম নির্মাণকর্মী। আপনাদের দপ্তর আমাকে নির্মাণকর্মী হিসেবে মান্যতাও দিয়েছিল বৈ কি। পেয়েছিলুম নির্মাণকর্মীর কার্ড। এখন বুড়া হৈছি। আর খাটতে পারিনে কো। তাই পেনশন দেয় আপনাদের দপ্তর। 

কিন্তু বিগত কয়েকমাস পেনশন ঢোকেনি কো। স্ট্রোক হয়ে বিছানায় পড়ে আছি, শরীরের একটা অংশে বিশেষতঃ বাঁ হাত আর পায়ে তেমন সাড় পাই না আজকাল। পঙ্গুত্ব গ্রাস করিছে। ওষুধপত্রের ও যা অগ্নিমূল্য। পেনশনের টাকা কটা বড় দরকার, একটু দেখেন না। গরীবের বড় উপকার হয়।’ 


মোদ্দা কথা এই, এর সাথে আরো কিছু আনুষঙ্গিক কথাবার্তা, যা যে কোন সরকারী দপ্তর সম্পর্কে লোকে বলে আর কি। আমি বেশ কবার গেছি ব্লক আপিসে, ওরা বলেছে আপনার আপিসে পাঠিয়ে দিয়েছে বা বেশ কয়েকবার আপনাদের ল্যান্ড লাইনে ফোন করেছি, পাইনি ইত্যাদি। পাবার কথাও নয়। সদ্য স্থানান্তর হয়েছে আপিসটা। বলে কয়ে টেলিফোন লাইনটা এখানে আনানো হয়েছে বটে, তবে এখনও তেমন শক্তপোক্ত নন তিনি। মাঝেমধ্যেই অক্ষিপটল উল্টে বসে থাকেন । আর সুস্থ হতেও সময় নেন বেজায়।  


পরশু রাত ৮টা ৯- অবশেষে ফিরে ফোন করল শান্তনু।  অচেনা পঙ্গু বৃদ্ধের মেলটা পড়ে মনটা বেশ খারাপ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু মেলেতে দেওয়া তথ্য থেকে বৃদ্ধকে খুঁজে বার করা আমার পক্ষে অসম্ভব। তাই শান্তনুকে ফোন করেছিলাম। শান্তনু পেশায় তাম্রলিপ্ত আপিসের সিকেসিও হলেও, গোটা অফিসটা থাকে ওর আঙুলের ডগায়। সমস্ত তথ্য সুন্দর করে সাজিয়ে রাখে আপিসের নিজস্ব ওয়েবসাইটে। শান্তনুকে গুছিয়ে বলার মিনিট তিনেকের মধ্যেই আমার মোবাইলে পৌঁছে গেল বৃদ্ধের নাম, পিপিও নম্বর, লাইফ সার্টিফিকেট কবে জমা পড়েছে, কবে কলকাতা গেছে তার বিশদ তথ্য। 


দেখে আশ্বস্ত হলাম যে বৃদ্ধের তথ্য আমরা কুক্ষিগত  করে রাখিনি। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই তা পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে মহানগরে ঊর্ধ্বতন কতৃপক্ষের কাছে। ভাবলাম কাল এইটুকু তথ্যই মেল করে জানিয়ে দেব বৃদ্ধকে। 


পরশু রাত সাড়ে ৮টা- প্রবল বিরক্তি নিয়ে সোশ্যাল স্টাডিজের বই খুলল তুত্তুরী। আজকের পাঠ্য ডেজার্ট আর ফরেস্ট। বাংলা মাধ্যম থেকে পাশ করা আমি, নিরক্ষীয় চিরহরিৎ অরণ্য মুখস্থ করতেই কাঁদতে হয়েছে এতদিন এখন আবার ঐ একই জিনিস ইংরেজিতে বোঝাতে হচ্ছে মেয়েকে। এর থেকে বড় অত্যাচার আর কিছু হতে পারে? অতিকষ্টে ইকোয়াটোরিয়াল ময়েস্ট এভারগ্রিন থেকে ট্রপিকাল ড্রাই ডেসিডুয়াস ফরেস্টে পৌঁছতে বেরিয়ে গেল জিভ। ঢের হয়েছে বাপ।  আজ এইটুকুই থাক।  অকালেই ছুটি পেয়ে আনন্দে মত্ত নৃত্যরত তুত্তুরীর অসাক্ষাতে এসে সাহস করে ফোনটা করেই ফেললাম কলকাতার সুমিত বাবুকে। পেনশনগুলো মূলতঃ উনিই ছাড়েন। ভুল লিখলাম পেনশন অবশ্যই ছাড়েন বোর্ডের মাননীয় সিইও সাহেব। তবে যায় তো সুমিত বাবুরই হাত ঘুরে।মোটামুটি ওণার নখদর্পনে থাকে অনেকটাই তথ্য। যদিও এই ভাবে পূব বাহালা গাঁয়ের স্বর্গীয়(তাই হবেন নির্ঘাত) এজাদ বাবুর পুত্র আজিজুল বাবুর পেনশন কেন ঢোকেনি বা কবে ঢুকবে বললে উনি বলতে পারবেন না, তবুও যদি কিছু জানা যায়। যদি সামান্য ত্বরান্বিত হয় বৃদ্ধের কটা টাকা। 


ফোনের প্রথমেই বিস্তর মার্জনা চাইলাম, আপিস টাইমের আগে বা পরে বা ছুটির দিনে কেজো কারণে কাউকে ফোন করলেই মার্জনা চাই আমি। তারপর শোনালাম বৃদ্ধের করুণ মেলের কথা।  উনি অত্যন্ত সহৃদয় ভাবে জানালেন, বৃদ্ধের পিপিও নম্বরটা দিলেই উনি কাল আপিসে গিয়ে জানিয়ে দিতে পারবেন, পেনশনের কি অবস্থা। ফোনটা রেখেই পাঠিয়ে দিলাম শান্তনুর দেওয়া পিপিও নম্বরখানা।  


গতকাল বেলা ১২টা ২৭- সুমিত বাবু বার্তা পাঠালেন, বৃদ্ধের লাইফ সার্টিফিকেট সিস্টেমে উঠে গেছে। এই মাসের মধ্যেই ঢুকে যাবে পেনশন। 


গতকাল বেলা ১টা ৬- প্রথমে ভেবেছিলাম বৃদ্ধকে ফোন করেই জানাই। বারংবার অনুযোগ করেছেন ওণার ফোন ধরেনি কেউ। তবে অফিসের ফোনটা আবার মৃত। ব্যক্তিগত ফোন থেকে জানালে যদি ভাবেন মস্করা করছে কেউ-। সাত পাঁচ ভেবে শেষমেষ ইমেলই করলাম। লিখলাম- 

‘প্রিয় আজিজুল বাবু,


আপনার ইমেল আমরা পেয়েছি। এতদ্বারা আপনাকে জানানো হচ্ছে যে আমাদের অফিস রেকর্ড অনুযায়ী, আপনার লাইফ সার্টিফিকেট কলকাতায় পাঠানো হয়েছে এবং কলকাতা অফিস তা পেয়েও গেছে। কলকাতা অফিসের সাথে আপনার কেসটা নিয়ে আমরা কথা বলেছি,  এবং ওনারা আশ্বস্ত করেছেন যে খুব শীঘ্রই, সম্ভবতঃ এই মাসের মধ্যেই আপনার পেনশন ঢুকে যাবে। ভালো থাকবেন এবং আসছে নভেম্বরে অবশ্যই মনে করে আপনার লাইফ সার্টিফিকেটটা জমা করবেন। 


ধন্যবাদান্তে


আঞ্চলিক শ্রম দপ্তর তাম্রলিপ্ত।’


গতকাল রাত ৭টা৫৭- তুত্তুরীর পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে ঠিক করলাম পাটিসাপটা বানাব। বেশ খানিকটা নারকেলের ছাঁই রয়ে গেছে। গৃহকর্তার বড় প্রিয় পিঠে ঐটা। কড়ায় পাতলা ঘোল ঢেলে গ্যাস কমিয়ে একবার আপিসের ইমেলটা দেখতে গেলাম। এটাই আমার নিত্য রুটিন। দেখতে গিয়ে দেখি মেল করেছেন আজিজুল বাবু। জানিয়েছেন, এই বৃদ্ধের জন্য আপনাদের তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ গ্রহণে আমি ধন্য। আমার আন্তরিক কৃতজ্ঞতা নেবেন। ভালো থাকবেন।  


ভিতরে গুড় নারকেলের পুর ভরে আলগা করে পাটাসাপটা খানি মুড়তে মুড়তে ভাবলাম, একখানা ইমেল আর দুটো ফোন করা ছাড়া আমি আর করলাম কি? সদ্য চাকরিতে ঢোকার পর, তৎকালীন অফিসার সংগঠনের জনৈক বড় দাদা বলেছিলেন, ‘সরকারি আপিস সম্পর্কে সাধারণ মানুষের সব থেকে বড় নালিশ কি জানিস? কেউ কথা শোনে না। একটু শুনিস। কাজ হওয়া, না হওয়া পরের কথা, মানুষের কথাটা তো শোন।’ তারপর কেটে গেছে কত বছর, ভাগ্যে সেদিন সেই ভদ্রলোকের এই কথাটা কান করে শুনেছিলাম।

Monday 17 January 2022

আয় তবে সহচরী ১৭ই জানুয়ারি, ২০২২

 


👩🏻-আজ রাতে পরোটা হয়েছে।সাদা ময়দার মুচমুচে মন খুশি, উর্বশী পরোটা- 

👩🏻‍🎤-বাঃ।  আর সঙ্গে কি?

👩🏻-নতুন আলুর দম। না মানে ঠিক দম নয়, মটরশুঁটি আর ধনেপাতা দিয়ে একটু ঝোলঝোল তরকারি। 

👩🏻‍🎤-বাঃ।  আর?

👩🏻- আবার কি? শেষ পাতে নলেন গুড়। ছোটদা দিয়েছে। বিশ্ব বাংলার টিউবে ভরা।  কি ভালো খেতে। 

👩🏻‍🎤- বাঃ। আর?

👩🏻- আবার কি? এখানেই শেষ। 

👩🏻‍🎤-ধুর ব্যাটা। আর মদ?

👩🏻-রামঃ। 

👩🏻‍🎤- ওরে পরোটা খেলে মদ খেতে হয়।  আমার গুরুর নির্দেশ। 

👩🏻- কি নির্দেশ? যেদিন বাড়িতে পরোটা হবে, সেদিন মদ খেতে হবে?

👩🏻‍🎤- হুঁ। 

👩🏻- আর পরোটা যেদিন হবে না?

👩🏻‍🎤- সেদিন তো অবশ্যই খেতে হবে। 

👩🏻-এটাও গুরুর নির্দেশ?

👩🏻‍🎤-হুঁ। আবার কি? 

👩🏻- এমন গুরু কোথা থেকে পেলি ভাই?

Saturday 15 January 2022

অনির ডাইরি ১৫ই জানুয়ারি, ২০২২

 


পৌষ পার্বণ এলেই ঠাকুমার কথা খুব মনে পড়ে। আর মনে পড়ে যায় আমাদের সাবেকী রান্নাঘরটার কথা। এককালে এবেলা ওবেলা পঞ্চাশ-ষাট জনের পাত পড়ত এ বাড়িতে, সেই অনুপাতেই রান্নাঘরখানা বানিয়েছিলেন প্রপিতামহ। দুখানা দরজা, চারখানা জানলা, দুখানা কুলুঙ্গি ওয়ালা বিশাল ঘরটার আসল রঙ কি ছিল কে জানে। পৌনে শতক ধরে জ্বালানো উনুনের ধোঁয়ায় ঘোর কৃষ্ণ বর্ণ ধারণ করেছিল ছাতের কড়িবরগা সমেত গোটা ঘরটাই। একটা ষাট ওয়াটের হলুদ বাল্বের আলোয়, কয়লা,ঘুঁটে আর গুলের উনুনে পিঠে বানাত ঠাকুমা। 


উনুন ধরানোটাও ছিল একটা আর্ট। ধরানোর আগে সাজানো হত উনুনটাকে। তলায় পাতা হত কয়েটা ঘুঁটে। ওই বয়সে আমার মনে হত ঘুঁটে দেওয়াটাও একটা আর্ট বটে। আমাদের পূব দিকের দেওয়ালে ঘুঁটে দিত পদ্মদি। আর আমরা তিন খুড়তুতো জেঠতুতো ভাইবোন পাঁচিলের ওপর থেকে হাঁ করে দেখতাম আর খোশ গল্প করতাম পদ্মদির সাথে। পদ্মদির ঘুঁটের ওপর থরে থরে রাখা হত কয়লা অথবা গুল। আশির সোনালী দশক, তখন সববাড়িতেই একটা করে হাতুড়ি থাকত কয়লা ভাঙার জন্য। কয়লার থেকে অনেক সস্তায় মিলত ঘেঁষ বা কয়লার গুঁড়ো। ধুলোর মত সেই ঘেঁষকে মাখা হত ভাতের ফ্যান আর পুকুরের পাঁক দিয়ে। পাঁক বিক্রি করত নকী পিসি। দুপুর বেলা যখন পাড়ার সব সমর্থ পুরুষেরা কাজে বেরিয়ে যেত, ভিজে শাড়ি পরে দুহাতে পাঁকের বালতি নিয়ে বাড়ি বাড়ি পাঁক বিক্রি করতে যেত নকী পিসি। সেই ঘেঁষ আর পাঁক/ফ্যান মিশিয়ে গোল গোল বড়ার মত গুল দিত মায়াদি আর দেবীদি। ওরা যে আদতে গৃহ পরিচারিকা বা গৃহ শ্রমিক এই তত্ত্ব যখন আদতে আমাদের মাথায় ঢুকেছিল, ততোদিনে মায়াদি ইহলোকের মায়া ত্যাগ করেছেন আর দেবীদি বিবাহ করে বসতি গেড়েছে সুদূর খানাকুলের কোন গাঁয়ে।  


উনুনের আঁচে বসানো চাটুতে কাঁটা বেগুনের বোঁটা দিয়ে তেল মাখিয়ে ঘরের শিলে বাটা চালগুড়ির মিশ্রন ঢালত ঠাকুমা, তারওপর উল্টে দিত মাটির সরা। ছ্যাঁক করে আওয়াজ হওয়া মাত্রই লাগোয়া রোয়াকে বসে নারকেল দড়িতে গিঁট ফেলতাম আমরা তিন খুড়তুতো জেঠতুতো ভাইবোন। ঠাকুমার মুখে শোনা সেই উমনো-ঝুমনোর গল্পের বাবাটার মত। 


কেন জানি না আজও মনে হয় ঠাকুমার মত আস্কে পিঠে আর কেউ বানাতে পারে না। আমার বড় মাসির মত পিঠেই বা কে বানাতে পারে? কি অমানুষিক খাটতে পারত বড়মাসি। অ্যালুমিনিয়ামের মস্ত গামলা ভর্তি ভর্তি পিঠে বানাত একা হাতে। দুই মাসি, মেসোমশাই, চার দাদা, তাদের অগণিত বন্ধুবান্ধব সবাইকে পেট পুরে খাইয়েও ঝোলা ভরে পাঠিয়ে দিত আমাদের জন্য।  দুধ পুলিই বলুন বা সিদ্ধ পুলি, ভাজা পিঠেই হোক বা পাটি সাপটা সবকিছুই দুধরণের বানাত বড়মাসি, এক ধরণের ভিতরে থাকত নারকেলের পুর আর এক ধরণের পিঠের ভিতর হরিণঘাটার দুধকে ঘন করে প্রায় শুকিয়ে ফেলা ক্ষীরের পুর । সকাল থেকে একা হাতে আপিস টাইমের রান্না বাড়া করে সবাইকে খাইয়ে আপিস-ইস্কুল-কলেজে পাঠিয়ে, জামাকাপড় কেচে, শুকিয়ে, রেডিওতে অনুরোধের আসর শুনে, দুপুরে হাল্কা গড়িয়ে নিয়ে বিকেলে কাচা কাপড় পরে পিঠে বানাতে বসত বড়মাসি আর রাতারাতি হয়ে যেত পিঠে বানানোর মেসিন। খুব খুব মিস করি সেই দিনগুলোকে। শুধু পিঠে বানিয়েই ক্ষান্ত হত না বড়মাসি, দাদাদের হাত দিয়ে গরম গরম আমাদের বাড়ি পাঠিয়ে তবে শান্তি। দাদাদের সময় না হলে, ধুত্তোর বলে নিজেই বাড়ির শাড়ি পাল্টে, ঘোমটা টেনে, ঝোলা হাতে রওণা দিত আমাদের বাড়ির দিকে। শুধু একদিন নয়, পরপর তিনদিন। 


পৌষ পার্বন এলে জ্যাঠাইমার কথাও খুব মনে পড়ে। কি ঝটপট পিঠে বানিয়ে ফেলত জ্যাঠাইমা। মালপোই বলুন বা ভাজাপিঠে বা রসবড়া সবকিছুই আধঘন্টার মধ্যে রেডি করে ফেলত জ্যাঠাইমা। কোন উৎসব বা পার্বণ নয়, জ্যাঠাইমা পিঠে বানাত শুধু আমার জন্য। যখনই খেতে চাইতাম, যাই খেতে চাইতাম। জ্যাঠাইমার কাছেই পায়েস বানাতে শেখা আমার। পৌষ পার্বণে আর কিছু বানাই বা না বানাই, ঘণ লাল চাপ-চাপ গুড়ের পায়েস অবশ্যই বানাই।


এই বছর অবশ্য পিঠে পায়েস বানানোটা ছিল বেশ চাপের ব্যাপার। সদ্য নতুন জেলায় আস্তানা বানিয়েছি আমরা। কাছাকাছি দোকানবাজার কোথায় কি কিছুই আজ অবধি শিখে উঠতে পারিনি। সবকিছুর জন্যই নির্ভর করতে হয় সহযোগীদের ওপর। শৌভিকের আগের বেশ অনেকজন মহকুমা শাসকই একলা থাকতেন হেথায়, আমার মত পাগল আর কে আছে, যে মেয়ের মহানাগরিক পড়াশোনা, ইস্কুল জলাঞ্জলি দিয়ে শুধুমাত্র একসাথে থাকা, একসাথে বাঁচার মোহে বদলী নিয়ে আসবে গোবিন্দপুর। তো সেই কারণেই হয়তো সহযোগীগণ অভ্যস্ত একলা মানুষের দোকানহাট করাতে। আমরা যে সদলবলে থাকব এবং যাবতীয় উৎসব পাব্বন ঢাকঢোল পিটিয়ে করব তা আর বেচারা জানবে কি করে।


 বলেছিলাম পলাশ ‘একটু ভালো গুড়’ এনে দিও তো। পলাশ এনে দিয়েছে বৈকি। ভয়ানক 'ভালো' প্রায় সাড়ে তিনশ টাকার গুড় এবং যথার্থই 'একটু' অর্থাৎ মাত্র পাঁচশ গ্রাম। আর এনে দিয়েছে দুখানা নিটোল নারকেল। ও দুটো অবশ্যি কেনা নয়, উপহার। আমার পিঠে বানানোটা যে পলাশের ঘোরতর না পসন্দ, তা পলাশ খোলাখুলিই জানিয়েছে আমায়। 'ম্যাডাম, আপনি করবেন কেন? ম্যাডামরা আবার ওসব  করে নাকি? তাদের অত সময় কুথা? আমার বউ বানিয়ে দিবে খন।' সত্যিই পলাশের বউ বানিয়ে দেয়, অনেক কিছুই, যেমন ধরুন বাড়ির পুকুরের গেঁড়ির ঝাল, নারকেল নাড়ু, সিদ্ধ পুলি, আরো কত কি। ভীষণ সুস্বাদু হরেক রকম খাবার। তাই বলে পৌষ পাব্বনের দিন এরকম বেয়াড়া আব্দার কেউ করে? না হে পলাশ, আমি নিজেই বানাব।  


নারকেল তো পেলাম, কাটারি আর কুরুনি নেই যে। 

শেষে রান্নার দিদিকেই ধরলাম। এই জেলার মেয়েরা ভয়ানক কর্মঠ। আমাকে একটা অন্তত নারকেল যদি একটু বাড়ি থেকে কুরে এনে দেয়। ভগবান মঙ্গল করুন তাঁর, অফিস থেকে ফিরে এসে দেখি, একটা নয়, দুটোই কুরে এনে দিয়েছেন তিনি। যে চায় চিনি, যোগান চিন্তামনির মত, মাত্র একশ একটাকা দিয়ে এক কিলো দুর্ধর্ষ ঝোলা গুড়ও এনে দিল আমার আপিসের শুভদীপ্ত। ব্যাস আর কি? বাকিটা তো চেনা সিলেবাস।  


বাসনকোসনের ভয়ানক অভাব সত্ত্বেও টুকটুক করে অনেক রকমই হল, পায়েস, দু রকম সিদ্ধ পুলি( নোনতা আর মিষ্টি), দুধ পুলি, ভাজা পিঠে, রস বড়া, সরু চাকলি। নতুন থালা বাটি কিনে, সাজিয়ে ঘরের ঠাকুরের সামনে যখন তুলে ধরলাম, ঘড়িতে রাত পৌনে দশটা। এত উঁচু গ্যাসের টেবিল, যে বড় কড়া বসিয়ে লেঙচে লেঙচে পিঠে বানাতে গিয়ে যন্ত্রনায় বেঁকে যাচ্ছে পিঠ আর হাঁটু। 


শৌভিক তুত্তুরীকে বেড়ে দিয়ে নিজের হাতের পিঠে নিজে খেতে বসে হঠাৎ ভীষণ মনটা খারাপ হয়ে গেল। এক প্রস্থ খারাপ হল তাদের জন্য যাদের কাছে পিঠেপুলির জন্য হ্যাংলামি করতাম আমি আর দ্বিতীয় দফায় খারাপ হল তাদের জন্য প্রতি বছর আমার হাতের পিঠে খাবে বলে হ্যাংলার মত বসে থাকে যারা। যাঁদের কেউ গুরুজন আবার কেউ লঘু।এত দূরে সরে আসার জন্য খাওয়াতে পারলাম না যাঁদের কাউকেই।  প্লিজ এমনি থেকো তোমরা, বদলে যেও না, আর সবথেকে বড় কথা হারিয়ে যেও না।

অনির ডাইরি ১৪ ই জানুয়ারি, ২০২২

 



কোন গুলো তুত্তুরীর বানানো বলুন দিকি? খুব সাবধান কিন্তু, ভালো করে দেখে বলুন আর ইয়ে মোটেই সত্যি কথাটা বলবেননি কিন্তু। বললেই গোঁসা ঘরে খিল দেবেন শ্রীমতী তুত্তুরী। এই অধম ভুক্তভোগী আজ্ঞে। 


আজ আমাদের পৌষ পার্বন কিনা, পর্যায়ক্রমে গুড়ের পায়েস, নোনতা পুলি, সিদ্ধ পুলি, দুধ পুলি, রস বড়া, ভাজা পিঠে, সরু চাকলির গন্ধে সুরভিত মোদের ক্ষুদ্র গৃহ কোণ। দৌড়ে দৌড়ে সব কিছুতে হাত লাগাচ্ছিলেন শ্রীমতী তুত্তুরী। শুধু পড়তে বসতে বললেই, ছলছলিয়ে উঠছিল আঁখি দ্বয়। তাঁর নাকি 'পচন্ড' I repeat 'পচন্ড' মাথা ব্যথা করছে। 


তা সেই মাথা ব্যথা নিয়েও তিনি গেলেন মাসির সাথে নোনতা পুলি গড়তে, নোনতা পুলি বোধহয় হাওড়া জেলারই বৈশিষ্ট্য। সিদ্ধ পুলির মধ্যে মিষ্টি নারকেলের পুরের পরিবর্তে আলু ফুলকপি/বাঁধাকপি মটরশুঁটির শুকনো ঝাল তরকারির পুর ভরা হয়। এক নাগাড়ে মিষ্টি খেয়ে মুখ বিস্বাদ হয়ে আসে যখন ঝাল পুলি তখন মঞ্চে নামে এবং বাকিটা যাকে বলে, 'veni vidi vici'। 


মাসির অপরিসীম ধৈর্য্য, মাসি দেখিয়ে দিল, বুঝিয়ে দিল। একটা হাতে ধরে বানিয়েও দিল। তারপরও যখন শ্রীমতী তুত্তুরী পুলির পরিবর্তে একখানা মণ্ড নির্মাণ করলেন, তখন মাসি কিঞ্চিৎ উত্যক্ত হয়েই বললেন, 'তোকে আর করতে হবে না। তুই যা তো।' ওমনি আর কি, গোঁসা ঘরে পড়ল খিল। কেবল বাবা ছাড়া আর কারো অনুমতি ছিল না সেই ঘরে প্রবেশ করার। নেহাত মা'টা কোন নিয়ম মানে না, তাই না ধরে আনল আদরে সোহাগে। একবার মাসি বলে দিল তুই পারবি না, ওমনি তুইও বিশ্বাস করে নিলি যে তোর দ্বারা হবে না?মাসি না হয় তোর ভালোবাসায় অন্ধ, সারা জীবন এমন বহু মানুষের সংস্পর্শ এ আসবি, যারা আরো খারাপ ভাবে, বলবে। বলবে তুই পারবি না। বলবে তোর দ্বারা হবে না। তখন কি করবি? পালিয়ে আসবি? আরে চেষ্টা তো কর। করে তো দেখ? হলে হবে, না হলে না হবে। মহাভারত তো অশুদ্ধ হবে না। আর ইয়ে তোকে পড়তেও বসানো হবে না। 


অতঃপর আবার পূর্ণ উদ্যমে পুলি বানাতে হাত লাগলেন শ্রীমতী তুত্তুরী। ভালো গুলো ওরই বানানো বুঝলেন তো,  ইয়ে খারাপ গুলো, ধরে নিন আমিই বানিয়েছি না হয়। মা কালি, আমি মিথ্যে কথা বলি না-