Sunday 5 September 2021

অনির ডাইরি ১লা আগস্ট, ২০২১

 

মক্সো করেছিলাম বন্ধুদিবসে লিখব বলে, তারপর যা হয় আর কি, বিশ্বাসঘাতক সময় - । কোনদিনই খুব বেশী বন্ধুবান্ধব আমার ছিল না,আজও বন্ধু বলতে যাদের বদন মুদিত নয়নের সম্মুখে ভেসে ওঠে, তাদের সংখ্যা বেশ সীমিত। অন্তত জুকুদার ফেসবুক যে এগারোশ কত বন্ধু দেখাচ্ছে তার এক দশমাংশের থেকেও বেশ অনেকটাই কম। মোটামুটি সারাদিন যারা অনুপস্থিত থেকেও ঘিরে থাকে আমার দিনটাকে, তাদেরই বন্ধু বলে ধরি আর কি-। 


যাদের সকলকেই ব্যক্তিগত পর্যায়ে হাড়ে হাড়ে চিনি, কারো কপালে সহকর্মীর ছাপ্পা তো কারো গায়ে সহপাঠী বা ক্ষেত্রবিশেষে সহযাত্রীর  উল্কি। ভালোমত চেনা পরিচয় না হলে আবার মৈত্রী হয় নাকি? 


মুস্কিল হল,এই চেনাবৃত্ত-চেনাছকের বাইরেও বেশ কিছু মানুষ ধূমকেতুর মত আচমকা প্রবেশ করেই বেরিয়েগেছেন আমার জীবনের কক্ষপথ থেকে, আর রেখে গেছেন একরাশ সৌহার্দ্যের সুখস্মৃতি। 


তা প্রায় বছর দশেক হল, তুত্তুরী তখন সদ্য পূর্ণ করেছে এক বৎসর। শিশুকন্যার দোহাই দিয়ে মহানগর পোস্টিং পেয়েছি।  চার্চ লেনের পাঁচ তলায় আপিস। বড়সাহেব মহঃ আমানুল হক। আপিস তো নয়, হাওদাখানা, দুবার ফোন চুরি হয়েছে খাস বড়সাহেবেরই, সবাই প্রায় বগলদাবা করে ঘোরে নিজের মুঠোফোন আর আলমারির চাবি। আর আমি এমনি ট্যালা, যে টেবিলে মোবাইল ফেলে ফাইল বগলে ঢুকেছিলাম বড় সাহেবের ঘরে। শুভাকাঙ্ক্ষী বড় সাহেবের পিতৃসুলভ ধমক খেয়ে ছুটতে ছুটতে নিজের চেম্বারে ঢুকে দেখি দিব্যি ফাইলের ওপর শুয়ে আড়ামোড়া ভাঙছেন তিনি। বেশী না মাত্র দুটো মিস কল এসেছে আমার অনুপস্থিতিতে।কোন অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তি দুবার ফোন করেছেন। 


সাধারণতঃ অচেনা নম্বরে ঘুরিয়ে ফোন করি না। কিন্তু কেন জানি না, সেদিন করলাম। ওপার থেকে এক প্রৌঢ় কণ্ঠ বলে উঠল, ‘হ্যালো অনিন্দিতা? আমি প্রসেনিজিৎ দা বলছি-’। তৎকালে প্রসেনজিৎ নামক দুজন ব্যক্তিকে কেবল চিনতাম, প্রথমতঃ দি প্রসেনজিৎ, সুপারস্টার। তিনি থোড়াই অধমের মত তুচ্ছ ব্যক্তিকে ফোন করবেন?


আর দ্বিতীয়জন সার্ভিসতুতো সিনিয়র দাদা শ্রী প্রসেনজিৎ কুণ্ডু ওরফে পিকে দা। তিনি মাঝেমধ্যেই ফোন করেন থুড়ি করতেন নানা কাজে। নম্বরটা অচেনা যদিও, সে তো হতেই পারে।ব্যস্ত কেজো সুরে জানতে চাইলাম, ‘ হ্যাঁ প্রসেনজিৎ দা বলো? তোমার ক্লেমের ফাইল স্যারের ঘরে। ’ ওপারের গলাটা কিঞ্চিৎ  থতমত খেয়ে বলল, ‘আরেঃ আমি প্রসেনজিৎ দা বলছি ব্যাঙ্ক থেকে। ’ ও হরি। ভুলেই গিয়েছিলাম। আমি আরেক প্রসেনজিৎকেও চিনি। তবে তাঁকে কোনদিন দাদা বলে ডাকা বা ভাবার ধৃষ্টতা  দেখাইনি। 


প্রৌঢ় ভদ্রলোকের সাথে ব্যাঙ্কেই আলাপ।কিছুদিন আগেই আমি গিয়েছিলাম অ্যাকাউন্টে ঠিকানা বদল করতে, যাঁর টেবিলে পাঠানো হয়েছিল, সেই সৌম্য দর্শন অতি গৌর বর্ণ প্রৌঢ়, আদতে ছিলেন অত্যন্ত সদাশয় তথা অমায়িক  ব্যক্তি। পাশে বসিয়ে, চা খাইয়ে স্নেহশীল ভঙ্গিমায় অনেক খোশগল্প করেছিলেন। না বলতেই কে ওয়াই সি ঠিক করে দিয়েছিলেন, আর সব কি কি করে দিয়ে বলেছিলেন, ‘ আমার নম্বরটা নিয়ে যাও, কোন দরকার হলে ফোন করে দিও, কাজ হয়ে যাবে। কষ্ট করে আর আসতে হবে না। তবে যদি আসো, অবশ্যই এই বুড়োটার সাথে দেখা করে যেও।’


তাই করতামও। ফোন কখনও করিনি, তবে গেলে দেখা করতাম। বেশ কিছুদিন আর ব্যাঙ্কে যেতে হয়নি, তাই দেখাসাক্ষাৎও হয়নি। ভাবলাম তাই বোধহয় কুশল বিনিময় করতে ফোন করেছেন ভদ্রলোক। উৎফুল্ল স্বরে জানতে চাইলাম, ‘ও প্রসেনজিৎ বাবু আপনি? কেমন আছেন?’ ওপার থেকে ভেসে এল মৃদু ধমক, ‘কেমন আছি, পরে জানলেও চলবে। আগে বলো তোমার এটিএম কার্ডটা কোথায়?’ থতমত খেয়ে জানালাম, কার্ডটা যেখানে থাকার সেখানেই আছে, হাতব্যাগের ভিতর পয়সার থলের মধ্যে, ওণারই উপহার দেওয়া ব্যাঙ্কের নাম লেখা ‘ফ’ লেদারের পাউচের ভিতর। ওদিকের গলায় ফুটে উঠল, চাপা উত্তেজনা,‘ তাই নাকি? আমি ফোনটা ধরছি, তুমি খুঁজে দেখো তো। ’ 


হাতব্যাগ উপুড় করে টেবিলের ওপর ঢেলেও পেলাম না, এটিএম কার্ড। সবেধন নীলমণি একটিই অ্যাকাউন্ট,তার একমাত্র কার্ড। আমার সিন্দুকের চাবি। কি করি? রীতিমত আতঙ্কিত সুরে জানতে চাইলাম ফোন করে ব্লক করাব কি? করাতে হলেও বোধহয় কার্ড নম্বরটা লাগবে,যা আমার মুখস্থও নেই, কোথাও টোকাও নেই। 


ওদিক থেকে স্নেহময় বড়দার ধমক ভেসে এল, ‘কাল হাওড়া ময়দান থেকে টাকা তুলেছিলে?’ আলবাৎ তুলেছিলাম। বেশ মনে আছে টাকা তুললাম, টাকা গুণলাম,পয়সার থলে তে ঢোকালাম। থলেটা হাত ব্যাগে ঢোকালাম, তারপর মায়ের ভাষায় ধেইধেই করতে করতে বাড়ি গেলাম। উনি জানালেন, ওখানেই হয়েছে গড়বড়, টাকা গোণার সময়, ফ লেদারের পাউচে ভরা কার্ডটা রেখেছিলাম এটিএম কাউন্টারে। তারপর তাঁকে সেখানে রেখেই ধেইধেই- ।  


জনৈক ব্যক্তি পরে রাতে ঐ এটিএমে টাকা তুলতে গিয়ে কার্ড সমেত পাউচটা পান। উনি তৎক্ষণাৎ এটিএমের রক্ষীর কাছে সেটি জমা করতে উদ্যত হন, এই আশঙ্কায় যে,যার কার্ড সে হয়তো নিজের ভুল বুঝতে পেরে ছুটে আসবে। রক্ষী হাই তুলে দায়সারা ভাবে জানান,তিনি নিতে পারবেন না। হয় থানায় জমা করুন, নাহলে ওখানেই পড়ে থাকুক। যার কার্ড সে বুঝে নেবে। 


এত সহজে দায় ঝেড়ে ফেলতে পারেননি ভদ্রলোক, উনি তখন ফ লেদার পাউচটি ঘেঁটে দেখেন ভিতরে কোন ঠিকানা বা ফোন নম্বর আছে কি না। ছোট্ট চিরকৃটে প্রসেনজিৎ বাবুর স্বহস্তে লেখা ফোন নম্বরটি আমি ভাগ্যে ঐ পাউচটাতেই রেখেছিলাম, গতকাল রাত নটা নাগাদ ভদ্রলোক প্রসেনজিৎ বাবুকে ফোন করে সব জানান। কার্ডের নামটা শুনেই উনি চিনতে পারেন, কিন্তু আমার নম্বর না থাকায় আর ফোন করতে পারেননি। আজ আপিসে এসে, ডেটাবেস ঘেঁটে আমার নম্বর খুঁজে সকাল থেকে চেষ্টা করছেন যোগাযোগ করার। 


শুনে স্বস্তি পেলাম। সাথে সাথে ভদ্রলোকের নাম আর নম্বরটাও। প্রসেনজিৎ বাবু জানালেন, ভদ্রলোক কাল রাতেই ওণাকে জানিয়ে রেখেছেন আজ সারাদিন উনি কাজের জন্য হাওড়ার কোন প্রত্যন্ত গ্রামে থাকবেন, যেখানে টাওয়ার থাকবে না। ফলে রাত আটটা নটার আগে ওণাকে পাওয়া যাবে না। তখন ফোন করলে উনি জানাবেন কখন উনি কার্ডটা ফেরৎ  দিতে পারবেন। 


সত্যিই ওণাকে পাওয়া গেল না রাত নটা অবধি। টেনশনে কত সহস্রবার যে ডায়াল করলাম ওণার নম্বর। রাত নটার পর বাজল ফোনের রিং, ওপাশ থেকে ভেসে এল এক ক্লান্ত পুরুষকণ্ঠ। পরিচয় দিতেই , চিনতে পারলেন। মার্জনা চাইলেন এতক্ষণ ফোনে না পাওয়ার জন্য। জানালেন পেশায় ছোটখাট কন্ট্রাক্টর। কাজের ধান্ধায় প্রায়ই এমন দূরদূরান্তে যেতে হয়। আগামী কালও যেতে হবে। যদি আমি সকাল সকাল একটু হাওড়া ময়দানের ঐ এটিএমে আসি, তো উনি কার্ডটা আমায় দিয়ে যেতে পারেন। 


কৃতজ্ঞতায় বুঝে আসছিল গলা। কে বলে আমরা কলি যুগে বাস করি? এখনও কত যে সৎ মানুষ ছড়িয়ে আছেন, এই সমাজে। তাই না এতকিছুর পরও জিতে যায় মানুষ। নিশ্বাস চেপে কোন মতে কাটল রাত, ভোর ভোর পৌঁছালাম এটিএমে। ফোন করতেই এক সৌম্য দর্শন বছর ত্রিশের ব্যক্তি এগিয়ে এলেন, নমস্কার বিনিময়ের পর আমার কার্ডটা আমার হাতে দিয়ে ওণার শান্তি হল। তাড়া ছিল ওণার, তবুও দুদণ্ড কথা বললেন আমার সাথে। ভুল বললাম, আমিই বলে গেলাম একতরফা। জানালাম অকুণ্ঠ কৃতজ্ঞতা। জানালাম কি চাকরী করি আমি এবং শৌভিক, জানালাম এছাড়াও আছে বেশ কিছু বন্ধুবান্ধব, যে কোন প্রয়োজনে উনি যেন নিঃসঙ্কোচে জানান আমাদের। এই উপকারের কোন প্রতিদান তো হয় না, তবুও চেষ্টা করব পাশে থাকার। উনিও কথা দিলেন, অবশ্যই জানাবেন। পরে বাড়ি ফিরে একই কথা জানিয়েছিলাম প্রসেনজিৎ বাবুকেও। মজার কথা হল না উনি কখনও কোন সাহায্য চেয়েছিলেন না প্রসেনজিৎ বাবু। দ্বিতীয় ব্যক্তির সাথে এরপরও বেশ কিছুদিন যোগাযোগ ছিল, প্রথমজনের সাথে আর কখনও যোগাযোগই হয়নি। 


নাই হোক দেখাসাক্ষাৎ, নাই থাকুক যোগাযোগ, ওই যে স্বর্গীয় চাণক্য বলে গেছেন না, বন্ধুত্বের প্রথম শর্তই হল বিপদে পাশে থাকা, এনারা যদি বন্ধু না হন, তাহলে আর বন্ধু কে? প্রতিটি বন্ধুদিবসে তাই একটি বার অন্তত স্মরণ করি এইসব মানুষকে, আর ইথার তরঙ্গে পাঠিয়ে দিই, একরাশ শুভকামনা। যেখানেই থাকুন, ভালো থাকুন। আপনাদের মত ভালো মানুষদের বড় দরকার এই পোড়া সমাজে।

Saturday 21 August 2021

তুত্তুরী উবাচ ২১শে আগস্ট, ২০২১

 


👧🏻-মা, এই যে তুমি বললে না, পার হেড দুটো করে চিকেন বল, এখানে যদি রাবণ থাকত, তাহলে কি হত? দশটা হেডের জন্য দুটো করে, একাই কুড়িটা বল খেয়ে নিত।  

👨🏻- রাবণ খেতো তো একটাই মাথা দিয়ে। 

👩🏻-(পাশ থেকে কৌতুকের সুরে) আর বাকি মাথা গুলো কি করত? তারা খেতে চাইত না বুঝি?

👧🏻-(উভয় পক্ষকে শান্ত করার ভঙ্গিতে) আরেঃ রাবণ এক-একটা গাল এক-একটা মাথায় খেত। 

👨🏻-(নিজের খাবারে মনঃনিবেশ পূর্বক, বিড়বিড় করে) ঐ জন্যই রাবণ এখানে নেই। থাকলে সবারটা একাই সাবড়ে দিত। 

👧🏻-(কিছুক্ষণ নীরবে খেয়ে) জানো তো বাবা, ঠাম্মাদাদু(পিতামহ) সেদিন বলছিল,‘ তুমি একদম তোমার বাবার মত কাঁটা-চামচ দিয়ে খাও। ’ তো আমি বললাম, ‘সে তো হবেই, আমি তো বাবার থেকেই শিখেছি। ’ তখন ঠাম্মাদাদু বলল, ‘তোমার বাবাকে কিন্তু কেউ শেখায়নি। তোমার বাবা সিনেমা দেখে শিখেছিল। ’ তখন আমি বললাম, ‘কিন্তু দাদু আমি তো অত সিনেমা দেখি না। ’ 

👩🏻-(পাশ থেকে ব্যঙ্গের সুরে) তারপর ঠাম্মাদাদু কি বলল, আর পড়াশোনা করতে হবে না, দিনরাত টিভি আর মোবাইল নিয়ে বসে থাকো। তাই তো?

👧🏻-না মানে, ঠাম্মা দাদু বলল, ‘তুমিও দেখো। যত দেখবে ততো শিখবে। ’ (কিঞ্চিৎ  প্রগলভ হয়ে) জানো তো বাবা,আমি ঠাম্মাদাদুকে বলেছি,‘আমি বাবার থেকে আর একটা জিনিসও শিখেছি, কি করে ওয়াইন গ্লাস ধরতে হয়। ’

👩🏻-(মা হতাশ গলায়) হয়ে গেল। তোর থেকে ও মোদো মাতাল হতে শিখেছে। 

👧🏻-(বিরক্ত হয়ে) আঃ উজ্জ্বয়িনীর হোটেলে ঐ গ্লাসে জল খেয়েছিলাম। মদ আমি খাই না। আর ঠাম্মাদাদুও বলল,‘ধরতে শিখেছ, কিন্তু খেতে শিখো না। ’

Friday 20 August 2021

অনির ডাইরি ১৩ই আগস্ট, ২০২১

 


নামটা শুনেছিলাম বিয়ের আগেই। সে অনেককাল আগের কথা। এক যুগ তো বটেই, তারও বেশী। আইনানুগ বিবাহ হয়ে যাবার পর থেকেই শ্বশুরমশাইয়ের নির্দেশ ছিল, সপ্তাহান্তে একটি বেলা যেন আমি হবু শ্বশুরবাড়িতে কাটাই। গোঁড়া রক্ষণশীল পরিবার আমাদের, এসব সাহেবীয়ানায় ঘোর আপত্তি মায়ের। কিন্তু সদ্য কর্কটরোগাক্রান্ত শ্বশুরমশাইকে না বলার সাধ্য কার? 


অগত্যা প্রতি শনিবার, সামান্য বেলায় ঘুম ভেঙে মায়ের হাতের এককাপ চা খেয়েই উঠে বসতাম তেঘরিয়া মিনিতে। প্রাতঃরাশ না করে বসে থাকত বৃদ্ধ আর তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র। তারপর হবু বরের হাতে সেঁকা কড়কড়ে টোস্টে জবজবে করে মাখানো মাখন দিয়ে প্রাতঃরাশ সারতাম তিনজনে। শাশুড়ী মা যথারীতি কিছুই খেতেন না। তবে আমাদের সাথে বসে গল্প করতেন অনেক। তেমনি একদিন শুনেছিলাম তাঁর কথা।  ‘কাল তোমার কাকিমারা সব এসেছিলেন- কেকা, স্বপ্না, সন্ধ্যা। ’ শুনলাম বটে, চিনলাম না কাউকে। পাশ থেকে হবু বর জানালো, 'এনাদের মধ্যে কেকা অর্থাৎ মণি কাকিমা হল তোমার বড় সাহেবের বউ।'


 বড় সাহেব অর্থাৎ মণিকাকা অর্থাৎ তৎকালীন অ্যাডিশনাল কমিশনার শ্রী অরুণকান্তি ভট্টাচার্য মহাশয়। বসের,বসেরও  বস।আমাদের সার্ভিসের সিনিয়রতম সদস্য। দূর থেকেই দেখেছি কেবল মিটিংএ। ডায়াসের ওপর রাখা মস্তচেয়ারে গম্ভীর মুখে বসে থাকতে। যিনি মুখ খুললে তো বটেই, গলা খাকরি দিলেও স্তব্ধ হয়ে যেত যাবতীয় গুঞ্জন। এহেন বড় সাহেবের ভ্রাতুষ্পুত্রের আমি ঘরণী হতে চলেছি- 


যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই সন্ধ্যে হয়, কয়েক সপ্তাহ পরের এক শনিবার। দ্বিপ্রাহরিক মধ্যাহ্নভোজের মধ্যেই মণিকাকার ফোন, কোথায় যেন বেরিয়েছিলেন সস্ত্রীক, পথে একবার ঢুঁ মেরে যাবেন তাঁর আদরের ছোটদার বাড়ি। শুনে তো এঁটো হাতেই বাড়ির বাস ধরি আমি, কান ধরে বসালেন শ্বশুরমশাই, ‘আরেঃ এত ভয়ের কি আছে? অফিসের চৌহদ্দির মধ্যে উনি তোমার বস্। বাড়িতে তো নয়। এখানে শুধুই মণিকাকা। ’ 


দরজার বেল বাজল। স্টাডিরুমে সিঁটিয়ে  আছি আমি, কিছুতেই যাব না, এত বড়,মস্ত বড় সাহেবের সামনে। বসার ঘর থেকে ভেসে এল কার যেন রিনিরিনি কণ্ঠস্বর, ‘ওমা ভয় পাচ্ছিস কেন? আয় আয় দেখি।’  চৌকাঠের অপর পারে এক অপরূপা মধ্যবয়সী ভদ্রমহিলা। মাথায় অবশ্য আমারই মত ছোট্টখাট্ট, ধপধপে গায়ের রঙ। চোখে সরু ফ্রেমের চশমা। পরণে গুজরাতি কাজ করা সুতির শাড়ি আর ঠোঁটে মোহন হাসি। সেই দণ্ড থেকে মণিকাকা স্যার রয়ে গেলেন বটে, ম্যাডাম হয়ে গেলেন মণি কাকিমা। 


অগ্নিসাক্ষী করে বিয়ের পরদিন আয়লা মাথায় নিয়ে প্রবেশ করলাম শ্বশুরবাড়ি। সর্বত্র এক হাঁটু জল। ঝড়ের দাপটে ছিঁড়েছে ইলেক্ট্রিকের তার, আছড়ে পড়ছে গাছের পর গাছ। পথে আটকে পড়েছে বাকি আত্মীয়স্বজনেরা। বধূবরণ করবে কে? পূর্ববঙ্গীয় নিয়মনীতি কিছুই তেমন জানেন না শাশুড়ী মা, ভয়েই অস্থির। উপস্থিত শুধু মণিকাকা আর কাকিমা। আজ মধ্যরাতে, নিকষ আঁধারে ঘেরা এই বাংলোর বারন্দায় বসে বারবার মনে পড়ছে সেইদিনটার কথা, আমায় বরণ করে ঘরে তুলেছিল মণিকাকিমা। 


ঝড়ে কাঁপছে কলকাতা, সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মনখারাপের বোঝা। ফুঁপিয়ে-ফুঁপিয়ে, ডুগরে-ডুগরে কাঁদছি শুধু আমার মায়ের জন্য। চিরকালই বাবার মেয়ে আমি। মা যেন বড় বেশী নিঃসঙ্গ, হয়তো অবহেলিতও।  প্রতিটা পলে মনে পড়ছে, কবে কি দুর্ব্যবহার করেছি মায়ের সাথে,শুনিয়েছি কি কটু কথা আর সরু ব্লেড দিয়ে যেন কেউ চিরে দিচ্ছে হৃদপিণ্ডটাকে। বড় আদরের পুত্রবধূ আমি, আমার কান্না সহ্য হয় নাকি বৃদ্ধ শ্বশুরের। অসহায় শ্বশুরমশাই গিয়ে ধরলেন মনিকাকিমাকে,‘কেকা মেয়েটাকে থামাও। ’ হাত ধরে ঘরের বাইরে টেনে আনল মনিকাকিমা,‘ তুই খামোকা কাঁদছিস কেন আমায় বল? আমরা কি এতই খারাপ লোক?’ 


না মণি কাকিমা, মোটেই খারাপ নও, বরং ভীষণ ভীষণ ভালো তোমরা। আমরা অর্থাৎ আমি এবং উমা অনেক ভাগ্য করে পেয়েছিলাম তোমাদের সবাইকে। বিয়ের জন্মলগ্ন থেকে শ্বশুরবাড়ি সুলভ কোন অনুভূতি কখনও জাগতে দাওনি তোমরা। কখনও ভিন্ন চোখে দেখোনি এবাড়ির মেয়েদের আর বউদের। পুঁচি, বুজান, দুষ্টু,সোনাইয়ের থেকে যে আলাদা অনিন্দিতা আর উমা, তা কখনও মনে হয়নি আমাদের। আজও হয় না। ভুলেই যাই আমরা ভট্টাচার্য বাড়ির মেয়ে নই, বধূ।  


এইভাবে, এত জলদি তোমার চলে যাওয়াটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না মণিকাকিমা। কল্পনাও করতে পারছি না মণিকাকার মানসিক অবস্থা। বাইরে থেকে বড় রুঠা মণিকাকা, একদম তোমার উল্টো। স্থিতধী।  কিন্তু ভিতরটা যে বড় নরম, নইলে ঠিক চারদিন আগে, লিখত না মণিকাকা যে, ‘সামান্য বেপরোয়া হলেই যিনি আমাকে শাসন করতেন, তিনি এখন অর্দ্ধ-চেতন। অসহ্য এ-স্বাধীনতা।’ সেদিন সর্বান্তঃকরণে প্রার্থনা করেছিলাম, সুস্থ হয়ে ওঠো তুমি। সেজেগুজে মিষ্টি হেসে আবার এসে দাঁড়াও সবার মাঝে, আমার মতই বরণ করে নাও আমার উত্তরসূরীদের। সব প্রার্থনা কেন যে সত্যি হয় না।

অনির ডাইরি ১৫ই আগস্ট, ২০২১

 


‘এই খানেই গুলি খেয়ে লুটিয়ে পড়েছিলেন না শহীদ মাতঙ্গিনী হাজরা?’ প্রশ্ন করল শৌভিক। শ্যাওলা ধরা এক বাঁধানো পুকুরের ধারে সবে দাঁড়িয়েছে শৌভিকের গাড়ি। পুকুরের একধারে সাদা রঙের দোল মঞ্চ বা নহবৎ খানার মত একখান ইমারত, যার বুক এফোঁড়-ওফোঁড়  করে চলে গেছে পিচের রাস্তা। ঐ রাস্তা ধরেই হেঁটে যেতে হবে আমাদের। এটাই আজ আমদের তিন নম্বর গন্তব্যস্থল।  সেই সকাল সোয়া আটটা থেকে শুরু হয়েছে পতাকা উত্তোলন পর্ব। 


সবার আগে শৌভিকের নিজের দপ্তরে। শুনেছি জেলা যখন যখন অবিভক্ত মেদিনীপুর ছিল তখনও এখানেই বসতেন তমলুকের মহকুমা শাসক। পিছনে লাগানো বোর্ড অনুসারে আমার বর তমলুকের ৮০তম মহকুমা শাসক। জেলা যখন ভাগ হল, তখন তড়িঘড়ি এই অফিসের ওপর তোলা হল নতুন মঞ্জিল। আর মহকুমা শাসকের দপ্তর রাতারাতি ভোল বদলে হয়ে গেল জেলা শাসকের করণ। এই তো সেদিন পর্যন্ত এই আপিসেই বসতেন জেলা শাসক। নিমতৌড়ির ঝাঁ চকচকে নতুন কালেক্টরেট তো জীবন পেয়েছে গত বছরের ডিসেম্বর মাস থেকে। আর পুরাতন মহকুমা শাসকের দপ্তর হয়েছে পুনর্মুষিক ভবঃ।  


নিমতৌড়ির কালেক্টরেটে ঠিক নটার সময় পতাকা তুলবেন মাননীয় জেলা শাসক মহোদয়, সেখানে হাজিরা দিয়ে তমলুক জেল। গাল ভরা নাম, তমলুক সাব-কারেকশনাল হোম। দণ্ডাজ্ঞা  প্রাপ্ত আসামী নয়, কেবলমাত্র বিচারাধীন বন্দীরাই এই হোমের বাসিন্দা। পদাধিকার বলে তমলুকের মহকুমা শাসক আবার এই জেলের সুপারও বটে। জেলের প্রতি আমাদের বংশানুক্রমিক দুর্বলতা। রীতিমত দাগী পরিবার বলতে পারেন। স্বর্গীয় পিতামহ তো জেল খেটেছেন খাস মান্দালয়ে, তস্য ভ্রাতা জেল খেটেছেন, 'ইয়ে আজাদী ঝুটা হ্যায়' আন্দোলন করতে গিয়ে। জেঠু জেল এড়িয়ে যেতে পারলেও, পারেনি বাবা এবং ছোটকাকু। নকশাল পিরিয়ডে হাজতবাসের কথা বলতে বলতে আজও কেমন যেন স্মৃতিমেদুর হয়ে ওঠে বাবা। 


শৌভিক জেলে পতাকা তুলবে, শুনেই অনুরোধ করেছিলাম, যদি সঙ্গী হিসেবে গণ্য করে এ অধমে। জবাবে শুনেছি, জেলের নিয়ম ভীষণ কড়া। প্রবেশাধিকার অত্যন্ত দুর্লভ। এমনকি সুপার হওয়া সত্ত্বেও, সশস্ত্র দেহরক্ষীকে বাইরে রেখে ঢুকতে হয় আমার বরকেও। তবুও মেয়ে- বউয়ের আব্দার বলে কথা, সসঙ্কোচে জেলার সাহেবকে অনুরোধ করেছিল শৌভিক, যদি আর কি- 


জেলের বাইরেই সাজানো ছিল শহীদ বেদী। গেরুয়া- সাদা-সবজে আবিরে আঁকা এবং লেখা, '৭৫ তম স্বাধীনতা দিবস।' প্রতীক্ষায় ছিলেন জেল কর্মীরা। সুপার পৌঁছাতেই শুরু হল, অভিবাদন। তারপর পতাকা তোলা, জাতীয় সঙ্গীত গাওন। তারপর হাজিরা খাতায় সই করে, ভিতরে ঢোকা।


 তেরঙা বেলুন দিয়ে সাজানো হয়েছে জেল। বানানো হয়েছে মস্ত শহীদ বেদী। তাকে সাজানো হয়েছে ফুল আর আবির দিয়ে। শহীদ বেদীকে ঘিরে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে পুরুষ কয়েদিরা। পুষ্পস্তবক, ব্যাজ নিয়ে আমাদের স্বাগত জানাতে এগিয়ে এলেন মহিলা বন্দিনীদের দল। সংখ্যায় বেশ কম। তাদের মধ্যে কয়েকজনকে দেখে অবাঙালি মনে হয়, চপচপে করে তেল দিয়ে বাঁধা খোঁপা, সিঁথিতে ডগডগে লাল বা মেটে সিঁদুর। হিজাব পরা রমণীও আছেন। আর আছে কয়েকটি তরুণী কন্যা। যে মেয়েটি ফুলের তোড়া দিল বা ব্যাজ আটকাল,  জেলের প্রটোকলের ভয়ে তার নাম ছাড়া আর কিছুই জানতে পারলাম না। শুনলাম ২০১৮ সাল থেকে বিচারের প্রতীক্ষায় জেলে আছে মেয়েটি। কি অপরাধে কে জানে? আর এক মহিলা জানালেন ওনার হাজতবাসের মেয়াদ শুরু সেই ২০১৬ থেকে। কে জানে মুক্তি কবে, আর কি সংবাদ বয়ে আনবে সেই মুক্তির বাতাস। 


বক্তৃতা দিতে উঠে এটাই বলল শৌভিক, ' আজ স্বাধীনতা দিবস, আর স্বাধীনতার অর্থ সেই জানে, এক লহমার জন্য হলেও ক্ষুণ্ন হয়েছে যার স্বাধীনতা। আজকের দিনটির তাৎপর্য তাই আপনাদের থেকে বেশি কেউ বুঝবে না।' 


জেলের অধিবাসী এবং বাসিনীদের সঙ্গে সামান্য সময় কাটিয়ে, একরাশ শুভেচ্ছা আর শুভকামনা বিলিয়ে আমরা চলেছি তৃতীয় গন্তব্যের অভিমুখে। জনৈক স্থানীয় সমাজ সেবী খোদ নিমন্ত্রণ করেছেন শৌভিককে। 


 ধুতি আর খদ্দরের পাঞ্জাবি আর মুখে ডবল মাস্ক পরে ভদ্রলোক সটান হাজির হয়েছিলেন শৌভিকের চেম্বারে। দোতলায় উঠে হাঁফাতে হাঁফাতে বলেছিলেন, 'আমার বয়স ৮২ বছর, আমি অমুক শিশু নিকেতনের সাথে জড়িত। একটু যদি স্বাধীনতা দিবসের দিন দয়া করে আমাদের হোমে পদধূলি দেন।' ওনার বয়স শুনেই এককথায় রাজি হয়ে গিয়েছিল আমার বর। 


শিশুনিকেতন থেকে বেশ খানিক দূরে শ্যাওলা ধরা পুকুর পাড়ে গাড়ি রেখে পায়ে হেঁটে যেতে হয়। বগলে শান্তিনিকেতনী ব্যাগ ঝুলিয়ে, খদ্দর পরা বৃদ্ধ নিজে অপেক্ষা করছিলেন আমাদের জন্য, সঙ্গে এক অপেক্ষাকৃত বৃদ্ধতর ব্যক্তি। শৌভিককে সপরিবারে পেয়ে কি যে অসীম খুশি দুই বুড়োতে। নিজেরাই কোথা থেকে বয়ে আনলেন প্লাস্টিকের চেয়ার, নিষেধ করার আগেই তাদের দিলেন স্যানিটাইজার দিয়ে স্নান করিয়ে। তারপর পীড়াপীড়ি করতে লাগলেন, ' একটু বসুন আজ্ঞে।' বিশাল হোমটা আপাততঃ খাঁ খাঁ করছে। করোনার জন্য বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে শিশুদের। তবুও কি উৎসাহ দুই বৃদ্ধের। তিনতলা তুলবেন, পাশের ফাঁকা জমিতে তুলবেন নতুন বিল্ডিং। জেলাশাসককে ধরে পাশ করিয়েছেন প্ল্যান।পেয়েছেন স্যাংশনও। টাকাও ঢুকে যাবে কিছুদিনের মধ্যে। বেলা এগারোটার পিঠ পোড়ানো রোদে, ঘুঘু পাখির ডাক শুনতে শুনতে, কড়া মিষ্টি দেওয়া দুধ চায়ে চুমুক দিতে দিতে শোনালেন কত যে গল্প,শোনালেন এক দামাল ছেলের গল্প।  পাশেই হ্যামিল্টন স্কুলে পড়ত সে ছেলে। তখন এই অঞ্চল ঢাকা ঘন জঙ্গলে। পড়ত থোড়াই, কেবল দস্যিবৃত্তি করে বেড়াত। গাছের মগডাল থেকে পেড়ে আনত ফলের গোছা, ঝপাং করে ঝাঁপ দিত পুকুরে। মাছ ধরে, ঘুড়ি উড়িয়ে দিব্যি কাটছিল দিন,তারপর কি যে হল- হঠাৎ একদিন বদলে গেল ছেলেটা। ঘুড়িলাটাই ফেলে তুলে নিল পিস্তল। তারপর কি যে হল, আর বয়স বাড়ল না ছেলেটার। ইতিহাস তাকে আজও চেনে শহীদ ক্ষুদিরাম বলে। 


 ইতিহাসই তো, তমলুক শহরের অলিতে গলিতে ছড়ানো শুধুই ইতিহাস। নাঃ ওই পুকুর পাড়ে গুলি খেয়ে লুটিয়ে পড়েননি বটে শহীদ মাতঙ্গিনী হাজরা। পড়েছিলেন আর একটু দূরে। সেদিন ওনার সাথে তমলুক শহরের বিভিন্ন রাস্তায়, মোড়ে গুলি বিদ্ধ হন আরো ১১জন মানুষ। আর পাশের মহিষাদলে আরো ১৩ জন। এই টুকু ছোট্ট শহরে সেদিন যথার্থই বয়েছিল রক্তগঙ্গা, সে গল্প শুধু জানে সময়, আর জানে চারণ কবিরা।তবে তারাই বা আজ কোথায়? 


 চলে আসার সময়, দুই বৃদ্ধ বারবার অনুরোধ করলেন, ‘আবার আসবেন, আর যদি পারেন দুটো কাজের লোক খুঁজে দেন আজ্ঞে। আমাদের যা বয়স হয়েছে, এই বুড়ো হাড়ে আর পারি না গো আমরা। কোন দিন সেরিব্রাল হয়ে মরে যাব দেখবেন আজ্ঞে।কত জনকে বললাম, একটু দায়িত্ব নে বাবারা, তা এরা তো কেউ ঘাড়ই পাততে চায় না স্যার।’

অনির ডাইরি ২০শে আগস্ট, ২০২১

 


বাড়ির বিয়ের আনন্দই আলাদা।  বিশেষ করে আমাদের মত অভাগাদের জন্য, যাদের জীবনের শেষ বিয়েবাড়িটা বোধহয় ২০১৯ এ পড়েছিল। নাকি ২০১৮? তা কি আর মনে আছে বাপু।  


প্রায় এক বচ্ছর আগে থেকে চলছে পরিকল্পনা, পাল্টা পরিকল্পনা। কি পরব, কবে পরব। কি আছে, কি কিনতে হবে ইত্যাদি। কেন জানি না, প্রতিটা বিয়ে বাড়ির আগেই আমার মনে হয়, না তো পরার মত ভালো শাড়ি আছে, না মানানসই গয়না। বললেই চশমার ওপারে গোলগোল হয়ে যায় শৌভিকের চোখ। আলমারি ভর্তি, ওগুলো কি তাহলে? বরের কথা বাদ দিন। বরেরা অমনি বলে। 


পাড়ার হাবিব এর অমিতের একটা মেকআপ চ্যানেল আছে, তাতে অমিত নিজেই মেকআপ করে আপলোড করে সুন্দর সুন্দর ছবি আর ভিডিও। দেখে মেয়েরা পাগল হয়ে যায়, আর অচেনা পুরুষ সিংহের দল গাল দেয় ‘ছক্কা’ বলে। আমি অবশ্য অমিতের গ্রাহক নই, আমার মাথায় অমিতকে হাতও দিতে দেয় না সুরজিৎ, তবুও গেলেই ফাঁকফোকর খুঁজে গল্প করে অমিত। দেখায় ওর করা মেকআপের ছবি। আর বলে, ‘তুমি এসো, তোমায় আমি ডিসকাউন্টে করে দেবো। তোমার রেফারেন্সে কেউ এলেও-’। 


পিসতুতো দেওরের বিয়ে ঠিক হতেই তাই অমিতকে বলে রাখি, আগামী আগস্টে আমার বিয়ে বাড়ি। দেওর-ননদদের আর মাত্র জনা কয়েকেরই আইবুড়ো নাম খণ্ডানো বাকি। তাই ভালো করে সাজতে গুজতে তো হবেই। সম্পর্কে পিসি শাশুড়ী হলেও,বিয়ের জন্মলগ্ন থেকেই মণিকে নিজের পিসির মতই পেয়েছি  আমরা দুই বউ অর্থাৎ উমা আর আমি। যেহেতু উমার থেকে বেশ কিছুটা বড় আমি, এসেছিও বেশ কিছু বছর আগে, তাই আমার সাথে পিসিমণির সম্পর্কটা কিছুটা বন্ধুত্বপূর্ণও বটে। আর পিসেমশাই থুড়ি ছোটে কাকা তো আমাদের ডার্লিং। শ্বশুরবাড়িতে এসে থেকে এত ভালোবাসা পেয়েছি এই ভদ্রলোকের কাছ থেকে লিখতে গেলে আদ্র হয়ে ওঠে হৃদয়। আমাদের দুই বউয়ের বিয়েই হোক বা শ্রীমতী তুত্তুরীর অন্নপ্রাশন বা ভট্টাচার্য বাড়ির কোন শুভকাজই হয় না এই দম্পতি বিনা। তাদের জীবনের সবথেকে বড় শুভকাজ, এতে অনুপস্থিত  থাকলে গর্দান থাকবে নাকি? 


রীতিমত প্যাড পেন্সিল নিয়ে বসে হিসেব করি উমা আর আমি, কবে কি রঙ পরব। দুজনের আলমারির শাড়ি মিলিয়ে চলে হিসেব নিকেশ, আমারটা তুই পরিস,তোরটা আমি- তাহলে কি হবে? আর গয়না? অমিত বুদ্ধি দেয়, ওসব সোনারূপা ছাড়ো, বাগড়ি মার্কেট থেকে গয়না কিনে আনো। যেমন ফিনিশ তেমনি সস্তা। প্লানও বানাই আমরা দুই অসমবয়সী বধূ, ৪৬ নম্বর বাসে করে গিয়ে, বকুলতলা বা রাইটার্সের কাছে নেমে, পায়ে হেঁটে বাগড়ি মার্কেট যাব আমরা। আর দর করব কোমর বেঁধে। 


তার পরপরই ঘটে যায় কত্ত কি-। বেরিয়ে যায় শৌভিকের মহকুমা শাসকের অর্ডার, হাসপাতালে ভর্তি হয় মা, আর কলেজে নতুন সেশনের অ্যাডমিশনের দায়িত্বটা পুরোই চাপে টুকলু অর্থাৎ আমার আদরের দেওরের কাঁধে। বরের সঙ্গে দুর্গাপুর রওণা দেয় উমা। ঘেঁটে যায় যাবতীয় পরিকল্পনা, মাথায় ওঠে বাগড়ি মার্কেট, তুমি আমায় ডোবালে আর তুই আমায় ডোবালির দ্বন্দ্বে কে যে কাকে মির্জাফর বলব ভেবে পাই না আমরা। 


এরই ফাঁকফোকর গলে, এক ফোঁটা সময় বার করে, এক বর্ষণ মুখর দুপুরে পিসিমণির বাড়ি হামলা করি দুই বউয়ে। যাবার পথে উমাকে নিয়ে যাই ছুঁচ ফুটিয়ে, মহা বদ ব্যাটা, ভ্যাকসিন না নিয়ে বসে থাকা! চেনে না তো আমায়। গাড়িতে গোটা রাস্তা ভয় দেখাতে দেখাতে নিয়ে যায় উমা, ‘দিদিভাই, আমার কিন্তু মাথা ঘুরছে। জ্বর আসছে, কাশি আসছে-’। সত্যি সত্যি ভয় পেলেই হেসে গড়িয়ে পড়ছে, কি জ্বালা।  


পিসিমণির দ্বিপ্রাহরিক নিদ্রার তেরোটা বাজিয়ে ঘেঁটে দেখি আমরা নতুন বউয়ের নতুন নতুন শাড়ি,কুর্তি, গয়না, আশির্বাদী হার আর ফুলশয্যার আংটি। প্ল্যাটিনামের ওপর জ্বলজ্বলে এক কুচি হীরে দেখে মোহিত হয়ে বাড়ি ফিরি আমরা। কোভিড বিধি মেনে বিয়ে, বিয়ের রাতের প্রথম পঞ্চাশের মধ্যে নেই আমরা, থাকবই বা কেন, প্রথম পঞ্চাশের অর্ধেক তো কনের বাড়ির লোকজনই থাকবেন আর বাকি অর্ধেকে অগ্রগণ্য বয়োজ্যেষ্ঠরা। তাতে কি? বাড়ির বিয়ে বলে কথা- বিয়ের দিন সকালটা তো আমাদের, আছে বধূবরণের দিন সকালটাও আর বৌভাতের রাত। বৌভাতের সকালে বউয়ের হাতের ঘি ভাত বা পায়েসের ওপর অধিকার বাড়ির বয়োজ্যেষ্ঠদের। রাতটা অবশ্য আমাদের কুচোকাঁচাদের। আমাকে কুচোকাঁচাদের মধ্যে ধরার জন্য বিগলিত হয়ে যাই মাইরি। 

প্রতি মুহূর্তে বদলায় কবে ‘কি পরব তালিকা“। গায়ে হলুদে হলুদ পরাই রীতি, কিন্তু মায়ের সাদা গোলিপী মুগা যে বড় নজর কাড়ে। শুনে একটা অফ হোয়াইট শাড়ি বার করে বসে উমাও। শুনেই আঁতকে ওঠে পিসিমণি,পাগল নাকি, কে কোথায় হলুদ লাগিয়ে দেবে শাড়িতে, ও দাগ আর জম্মে উঠবে। ধ্যাৎ তেরি।  শেষ পর্যন্ত কমলা একখান শাড়ি মনোমত হয় বটে, শেষ পরেছিলাম কোন একবছর মেলায় যেন। ঠিক কমলা না পেলেও একটা চুনেহলুদে রঙ খুঁজে বার করে উমা। 


সব হিসেব করে গুছিয়ে তমলুকের উদ্দেশ্যে রওণা দিই আমি। হতাশ পিসিমণি আর উমাকে আশ্বস্ত করি বারবার, বিয়ের দিন সকালে ঠিক হাজির হব নটার মধ্যে, সে আমি যেখানেই থাকি না কেন। মাঝপথে কোথায় যে হারিয়ে ফেলি নথটা, শুনে উল্লসিত হয়ে ওঠে উমারাণী, ‘বেশ হয়েছে দিদিভাই।  আমি সাতসকালে ন্যূনতম সেজে যাবারও সুযোগ পাব না, আর তুমি পরবে নথ-’। আরেঃ সে সাজিয়ে দেব খন আমি,যা যা লাগবে বুঝিয়ে বলে দিই আনতে। 


সময়মতো পেয়েই যাই নথটা খুঁজে,বিয়ের দিন পৌনে ছটায় উঠে, ঘুমন্ত মেয়েকে টেনে তুলে স্নানিয়ে সাজিয়ে সাড়ে সাতটায় বেরিয়ে পড়ি, শুধু এক কাপ চা খেয়েই। আঃ বাড়ির বিয়ে বলে কথা। নটা দশের মধ্যে পৌঁছে খুঁজি উমাকে। কোথায় গেল মেয়েটা? সময়মতো ঢুকতেও পারে না? আজব অপদার্থ মাইরি। আমি তমলুক থেকে বালি এলাম, আর মহারাণী কলকাতা থেকে আসতে পারে না। বেলা বাড়ে, গায়ে হলুদের তেলের পাত্র আর হলুদের বাটি ধরানো হয় আমায় আর তুত্তুরীকে। পইপই করে বুঝিয়ে দেন পিসিমণির ননদ, মুন্নি পিসি,‘অনিন্দিতা ঠিক সে সমঝো, পহলে গণেশ জী নামবেন। তারপর তেলের ঘটি, তারপর পানপাতা দিয়ে সাজানো, হলুদ আর মেহেন্দির পাত্র।’ তাকে ঘিরে রাখা সবুজ কাঁচের চুড়ি হাতে পরবে নববধূ। দীর্ঘদিন বঙ্গদেশের অধিবাসী, বাঙালী রমণীর পতি তবুও আদতে তো উত্তরপ্রদেশের বাসিন্দা পিসেমশাইয়ের পূর্বপুরুষ। কাশীর কাছে ওণাদের ‘পুস্তেইনি হাভেলী’ আজো বর্তমান আভিজাত্যের চিহ্ন কাঁধে। ছবি দেখিয়েছিল ছোটেকাকা থুড়ি পিসেমশাই। যদিও কাজের দরকারে গোবলয়ে গেলে লোকে ওণাকে বাঙালী বলেই মনে করে। বিয়ের পর থেকে ছোটেকাকা পিসিমণির হাতের উচ্ছে চচ্চড়ি আর কুমড়োর ঘ্যাঁটই খেয়ে আসছেন, ইস্টবেঙ্গলকে সাপোর্ট করেন এবং সুযোগ পেলেই আমাকে ঘটি বলে খ্যাপান। তুমুল রেগে গেলে বলেন, ‘আমি কি বাঙালী রে?আমার কাছে তোরাও যা, ওরাও তাই। ’ মহা সুবিধাবাদী ভদ্রলোক মাইরি।  


ঝমঝমে বৃষ্টি মাথায় গাড়িতে উঠি মা আর মেয়ে। ছোটে কাকা নালিশ করে যায়, ‘উমারা বেলুড় চলে গেছে-’। যেন উমার অভিভাবক আমি। গাড়ি আর ছাড়ে না, অন্যান্য গাড়িগুলিতে তত্ত্ব তোলা হতেই থাকে, সাড়ে নটা নাকি চল্লিশ, দরজা খুলে মুখ বাড়ায় ভীতু ভীতু এক জোড়া চোখ। ‘দিদিভাই!’ শুনেই রাগ ধরে যায়। ভাগো ইঁয়াসে। এই গাড়িতে জায়গা হবে না। 'আচ্ছা' বলে ভয়ে ভয়ে অন্য গাড়িতে জায়গা খুঁজতে যায় উমা। বাঃ দারুণ মেয়ে তো। একবার না বলে দিলেই চলে যায়? জানে না আমার রাগের স্থায়িত্ব আড়াই মিনিট। আবার হাঁক পাড়ি আমি,‘থাক। আর অন্য গাড়িতে উঠতে হবে না। এটাতেই চেপে আমায় ধন্য করো। ’ চোরের মত গাড়িতে ওঠে উমা। পৌনে দশটা বাজে, এখনও ছাড়ে না গাড়ি, পাশ থেকে করুণ স্বরে প্রশ্ন করে তুত্তুরী, ‘মা তোমায় বকেছে, তাই তুমি আর আমার সাথে কথা বলবে না, না কাকিমা?’ আমাকে টপকে আদরও করতে পারে না উমা তার সোনাইকে। কোন মতে বলে, ‘না না। বলব তো।  আগে দিদিভাইয়ের মাথাটা একটু ঠাণ্ডা হোক। ’ 


মাথা ঠাণ্ডা তো তখন হবে, যখন জানা যাবে দেরীটা হল কেন? নির্ঘাত টুকলুই কিছু করেছে। তৈরী হতে সময় লাগিয়েছে,অথবা দেরী করেছে ঘুম থেকে উঠতে। হাঁহাঁ করে ওঠে উমা,’না দিদিভাই,ওর কোন দোষ নেই। তুমি তো শুনলেই না কি হয়েছিল।’ উফঃ এত পতিগত প্রাণা এই ভদ্রমহিলা। অতঃপর শুনতেই হয় দেরী পুরাণ। সামাণ্য ভুলে নির্ধারিত গলি ছাড়িয়ে চলে যাওয়া এবং ঘুরে আসার পথে গাড়ি খারাপ হয়ে যাবার গল্প শুনে মন খারাপ হয়ে যায় আমার। ইশ! কিছু  না জেনেই বকেছি গো মেয়েটাকে। প্রশ্রয় পেয়ে গলার জোর বাড়ে উমার,‘হ্যাঁ গো দিদিভাই, সে কি ধোঁয়া। আমরা তো ভাবলাম গাড়িতে আগুনই লেগে গেল। ড্রাইভার খালি বলে, আভি হো জায়েগা। শেষে মিনিট দশ পনেরো পর, ঐ বৃষ্টিতেই নেমে পড়লাম আমরা। ওকে বলা হল, তুই বাবা গাড়ি নিয়ে গ্যারাজে যা। সারিয়ে নিয়ে আয়। আর আমরা কোন মতে রাস্তা পেরিয়ে একটা টোটো ধরে ছুটতে ছুটতে আসছি। ’


অতঃপর আমার সাড়ে ৫২বার ক্ষমা চাওয়া আর পুরষ্কার স্বরূপ তত্ত্বের দই এর হাঁড়িখানা উমার কোলে চাপিয়ে দেয় ছোটে কাকা। বাপরেঃ কি ভারী গো, বললে ছোটেকাকা বোধহয় শুনতেই পায় না, এক গাল হেসে বলে, ‘দেখছিস কি সুন্দর হাঁড়িটা দেখতে। খাস অর্ডার দিয়ে আনানো বুঝলি। ওপরে কেমন গোপাল আছে দেখ,দেখ। ননী চোরা বালগোপাল। ’ মাথা নাড়ে উমা। বালগোপাল গোটা রাস্তা লক্ষ্মী হয়ে হাঁড়ির মাথায় বসলে বাঁচি, লাফিয়ে পালিয়ে গেলেই চিত্তির। আর আমার শাড়িতে যদি দই লাগে, তো হাঁড়িওয়ালিকে রাস্তাতেই নামিয়ে দেব কিন্তু হাঁড়ি সমেত। সাথে তার সোনাইকেও- হাসিমস্করায় ছাড়ে গাড়ি। আরো বারো বার সরি বলি আমি,আর ওরা দুটোতে বলে, ‘এবার অন্য কথা বললে হয় না। সরি সরি করে মাথা ধরিয়ে দিল মাইরি। ’ আঃ বাড়ির বিয়ে বলে কথা-

Saturday 7 August 2021

তুত্তুরী উবাচ ৭ই আগস্ট, ২০২১

 মধ্যরাতে নীলচে রাতবাতির আলোয় মা মেয়ের কথোপকথন অন্তে-

👧🏻- ব্যাস? হয়ে গেল? মানে শেষ পর্যন্ত কি জানা গেল, অবনী বাড়ি আছে না নেই?

👩🏻- সেটাই তো। তোর শুনে কি মনে হল? 

👧🏻-(বিজ্ঞ স্বরে) আমার মনে হচ্ছে অবনী বাড়ি নেই। নইলে অত কড়া নাড়লে তো যে কোন লোকের ঘুম ভেঙে যায়। 

👩🏻-থাক বাবু, তোকে আর কাব্য সমালোচনা করতে হবে না। আয় ঘুমাই।


তুত্তুরী উবাচ ৭ই আগস্ট, ২০২১

👧🏻-(বিড়বিড় করে শ্লোগান দিতে দিতে) আমাদের নেতা জিতেছে! (মাকে দেখে গলার জোর বেশ খানিকটা উঠিয়ে, মাকে প্রদক্ষিণ করতে করতে) আমাদের নেতা জিতেছে!দুর্গন্ধ কালু জিতেছে। 

👩🏻- (অন্যমনস্কভাবে) অ্যাঁ কে জিতেছে? অলিম্পিকে নতুন কেউ পদক পেল নাকি। 

👧🏻-(হিহি করতে করতে) না না। একটা কার্টুনের কথা বলছি। তাতে একটা লোক শ্লোগান দিচ্ছিল, ‘আমাদের নেতা জিতেছে। দুর্গন্ধ কালু জিতেছে-। 

👩🏻-(হেসে ফেলে) কি নাম রে! দুর্গন্ধ কালু! উফঃ

👧🏻-(প্রশ্রয় পেয়ে) হ্যাঁ গো মা। ওর আসল নাম কালু মণ্ডল। হিন্দিতে বলে কালু সিং। কিন্তু বাকিরা ওকে বলে দুর্গন্ধ কালু। আর হিন্দিতে বলে বদবু কালু। 

👩🏻-বাবা গো! তুই বাংলা আর হিন্দি দুটোই দেখিস। 

👧🏻-(সরল ভাবে) হ্যাঁ। ইংরিজিতে হয় কিনা তাও খুঁজে দেখেছি। ইংরেজিতে দুর্গন্ধ কালুকে কি বলে জানতে। 

👩🏻- কি আর বলবে, স্টিঙ্কি কালু বলে হয়তো  তা কালুর নাম দুর্গন্ধ কালু কেন?

👧🏻-(সোৎসাহে) ওর গায়ে যে ভীষণ দুর্গন্ধ। ওর বগলে, মুখে,পেছনে সর্বত্র ভয়ানক দুর্গন্ধ। তারওপর ঢেউ ঢেউ করে ঠেঁকুর তোলে।  কোন খেলায় নামতে হলে বা মারামারি করতে হলে বিপরীত পক্ষকে ভয় দেখায়, ‘কি রে আমার বগলের গন্ধ শোঁকাব নাকি তোকে-(সটান বগল তুলে)’। আর মাঝেমধ্যে ইয়েও করে, তখন ওর পিছন দিয়ে সবুজ ধোঁয়া বেরোয়। 

👩🏻- আচ্ছা মা, এবার থামো। আমি আর দুর্গন্ধ কালুর দুর্গন্ধপুরাণ শুনতে চাই না। দয়া কর। 🙏🏼

Thursday 5 August 2021

অনির ডাইরি, ২৬শে জুলাই, ২০২১


জন্মদিন নিয়ে এমনিতে খুব একটা কিছু প্রত্যাশা থাকে না তুত্তুরীর, একটু মায়ের হাতের পায়েস, একটা কেক আর মধ্যাহ্ন ভোজনে পাঁচরকম সাজিয়ে দেওয়া পদ। জন্মদিনের সকালে খেতে বসে বাটি গোনে তুত্তুরী, আর নির্ভেজাল মুখস্থ বলে যায় কোন বছরের জন্মদিনে কটা বাটি সাজিয়ে দিয়েছিলাম আমি। ভিতরের রান্না যতই ছাপোষা ঢ্যাঁড়স সিদ্ধ বা আলু পোস্তই দিই না কেন, শেষ বিচারে বাটির সংখ্যাই নির্ধারণ করে জন্মদিন তথা আমার সেই বছরের মাতৃত্বের সাফল্য। বিগত বছরের জন্মদিন বরবাদ করে অতিমারিতে আক্রান্ত হয়েছিলাম আমরা মা আর মেয়ে দোঁহে। তাই এবছরের জন্মদিন ঘিরে একটু বেশিই উৎসাহী ছিল কন্যা আমার।


কিন্তু জীবন থোড়াই এগোয় পরিকল্পনা মাফিক। জন্মদিনের ঠিক দু সপ্তাহ আগে ‘বিনা মেঘে বজ্রপাত’। ইনটেনসিভ কেয়ারে ভর্তি করতে হল মাকে। সাড়ে তিন বছর অবধি বুকে করে তুত্তুরীকে মানুষ করেছে মা। তুত্তুরীর বিরহে তলিয়ে গেছে গভীর মানসিক অবসাদে। আজ এই একাদশ বর্ষ অন্তেও মায়ের প্রাণ ভোমরার নাম শ্রীমতী তুত্তুরী। 


 একদিকে ইনটেনসিভ কেয়ারে লড়াই করছে মা, অপরদিকে বাক্সপ্যাঁটরা গুছিয়ে বাড়ি ছাড়ছে শৌভিক। জেনেশুনেই তো এই চাকরীতে ঢুকেছি আমরা, ভোগ করেছি যাবতীয় গৌরব, সুবিধা এবং ক্ষমতা। আজ পারিবারিক বিপর্যয়ের অজুহাতে তাকে আটকাই কোন মুখে। 


ফ্ল্যাট জোড়া শূণ্যতা আর চরম অসহায়তা মেখে পড়ে থাকি আমি আর আমার তুত্তুরী। মায়ের জন্য ছুটি নিই, ছুটির নাম, ‘চাইল্ড কেয়ার লিভ। ’  হাওড়া-কলকাতা, হাসপাতাল-ঘর, বৃদ্ধ অসহায়তর ভোম্বল বাবা আর জীবনের সাথে লড়াই করা মা সামলে, ক্লান্ত দেহে বাড়ি ফিরি রাত আটটা/নটা বা সাড়ে নটা। বৃষ্টি নামলে আগেভাগে ফোন করে সাবধান করে দেয় তুত্তুরী। ‘ওলাতে এসো না কিন্তু।’ 


গভীর রাতে, রাতপ্রদীপের নীলচে আলোয় হাত ধরাধারি করে গল্প করে ক্লান্ত মা, আর মেয়ে। লুকিয়ে চুরিয়ে ওঠে জন্মদিনের কথা। চোখের জল চেপে বলি, ‘বাবা যদি ছুটি না পায়। আর মামমাম যদি হাসপাতাল থেকে না ফেরে-। ’ পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে মায়ের মা হয়ে, মাকেই সামলাতে বসে তুত্তুরী। ‘কোন ব্যাপার নয় মা। তুমি একটু পায়েস করে দিও শুধু। তাও যদি সময় না পাও, কাকিমা করে দেবে।’ সমঝদার মেয়েকে বুকে আঁকড়ে কখন যে ঘুমিয়ে পড়ি কে জানে- 


জন্মদিনের ঠিক পাঁচদিন আগে ছাড়া পায় মা। সেই মুহূর্তেই ঠিক করেছিলাম, শৌভিক যদি নাও ছুটি পায় তবুও অন্তত গোটা দশেক বাটি সাজিয়ে দেবোই এবার মেয়েকে। দোকান বাজারের অভ্যাসটা এখনও তেমন রপ্ত হয়নি, তা নাই হোক। শেষ পর্যন্ত অবশ্য জন্মদিনের আগের সকালেই বাড়ি ফেরে শৌভিক। কাঁধ থেকে ব্যাগ নামাতেই হাতে ধরাই ফর্দ। টুকটাক জিনিসপত্র কিনেছি বটে, মাছ বিশেষতঃ মাংসটা ওকেই আনতে হবে বাপু। চোখের সামনে মুরগি বা ছাগল কাটলে ওখানেই অক্কা পাব আমি। 


 জন্মদিন যদিও সোমবার, তবুও রবিবার সকাল থেকেই শুরু তোড়জোড়। চাটনি, পায়েস আমি বরাবরই আগের রাতে করে রাখি। অনেকটা সময় বাঁচে। বেটে রাখি মশলা। থোড়-মোচার ঝামেলা থাকলে কুটে রাখি তাও। আর চেষ্টা করি ম্যারিনেট তো বটেই পারলে কষে রাখতে মাংসটাকে। আগের রাতে কষা মাংসের সোয়াদ কেন জানি না ডবল হয় পরদিন। হয়তো ঝাল মশলাগুলো একটু বেশীই গভীরে প্রবিষ্ট হয়।  


আমি নিজে চিকেন রাঁধতে এবং খেতে ভালোবাসি। কিন্তু কন্যার আব্দার জন্মদিনে মায়ের হাতের তুলতুলে মাটন। কিন্তু মা তো জীবনে মাটন রাঁধেইনি। অন্য বছর হলে ভাগিয়ে দিতাম, এবছর এত পাশে থেকেছে মেয়েটা আমার, মায়ের হাসপাতালবাসের মধ্যেই পরীক্ষা পড়েছিল মেয়েটার, ছিটেফোঁটাও দেখার অবকাশ ছিল না আমার। একাকী পড়াশোনা করে পরীক্ষা দিয়েছে মেয়ে। এমনকি হিন্দিও। যার প্রশ্নপত্রই পড়তে পারছিল না প্রথমে। তাই ঠিক করেছিলাম, শৌভিক যদি নাও আসতে পারে, মাটন তো আসবেই। শ্বশুরমশাই আশ্বস্ত করেছিলেন, চোখের সামনে ছাগল কাটা দেখতে হবে না আমায়।  কারণ, ‘ম্যায় হুঁ না। ’ 


রবিবার সকালে অবশ্য শৌভিকই নিয়ে আসে মাংসটা।  আর আমি তাতে বেশটি করে সর্ষের তেল, বেশ অনেকটা নুন, হলুদ গুঁড়ো, লঙ্কা গুঁড়ো আর বেশ খানিকটা মধু মাখিয়ে জরতে দিই । মধু মাখালে কেন জানি না, মাংসের স্বাদটাই যায় বদলে। ম্যারিনেট করা মাংস ঢাকা দিয়ে ফ্রিজে তোলার পর মনে পড়ে, একবার পার্লার গেলে মন্দ হয় না। কদিনের ঘোরাঘুরিতে রোদে পুড়ে, ঘামে ভিজে মুখচোখের যা চেহারা হয়েছে- দেখে আঁতকে না ওঠে পার্লারের দিদি, এটাই যা ভয়। 


পার্লার থেকে ফিরে, দ্বিপ্রাহরিক মাছের ঝোল ভাত খেয়ে,বহুদিন বাদে সপরিবারে ছোটখাট দিবানিদ্রা দিয়ে, সূয্যি মামা পাটে বসলে, চাটনি চাপাই আগুনে। প্রথমে ভেবেছিলাম আমের অম্বল করব। কিন্তু কি বাজে মাইরি, এখনকার কাঁচা আমগুলোর সোয়াদ। একেবারে আলুর মত-। তার থেকে সাবেকী টমেটো-খেজুর- আমসত্ত্বের চাটনিই ভালো। 


টমেটো গুলো চার টুকরো করে অল্প নুন ছিটিয়ে ঢাকা দিয়ে সিদ্ধ করতে বসাই, পাশ থেকে চিন্তিত স্বরে তুত্তুরীর মাসি বলে, ‘প্রেশারে দিতে পারতে। এখনকার টমেটো গুলো যা-’। 


অতঃপর ‘হে ঠাকুর টমেটো গুলো সিদ্ধ করে দাও প্রভু’।  প্রার্থনা না নির্মম ভাবে আধসিদ্ধ টমেটো গুলোকে থেঁতলানো কার দয়ায় জানি না, মাসিকে ভুল প্রমাণ করে অচীরেই গলে যায় টমেটোর দল। চিনির কৌটো উল্টে দিই, একফোঁটাও টক খেতে পারে না যে আমার গৃহকর্তা। ছড়াই খেজুর আর অল্প কিশমিস। খেজুর গুলো সামান্য গলে না গেলে কিছুতেই আসে না ঐ অমৃতের স্বাদ আর গন্ধ।  ঠিক উল্টো কথা প্রযোজ্য অবশ্য আমসত্ত্বের ক্ষেত্রে। যাতে গলে না যায়, নামানোর ঠিক আগে মেশাই কেটে রাখা আমসত্ত্বের টুকরো। রান্নাঘরের জানলার বাইরে ঘনায় সন্ধ্যে। দীর্ঘদিন বাদে ঘরে ফেরা  বাবার সাথে দাবা খেলতে খেলতে টেরিয়ে তাকায় তুত্তুরী, ওই চাটনি নামল বুঝি। 


চাটনি শেষে পায়েসের পালা। দুটো পাত্রে দুধ ফোটাতে বসাতে হয়। 'ছোটা সনসার হামার', তেমন বড় পাত্র কোথা পাই। তাই মিটমিটে আঁচে বিটবিট করে ফোটে ভাগের দুধ। লাল লাল চাপচাপ পায়েস ভালোবাসে এরা দাদু থেকে বাপ আর মেয়ে। আর ভালোবাসে কাকিমা। তবে জনা দশেকের জন্য পায়েস বানালে অত ঘন তো করা যাবে না, তারপর যদি কারো ভাগে কম পড়ে। ফ্রিজে রাখলে কিঞ্চিৎ বসে যাবে এটাই যা সান্ত্বনার-। শেষ পর্যন্ত অবশ্যি বেশ জমিয়েই বসেছিলেন তিনি। 


পায়েসের ভাগের দুধ ঘন হয়ে এককাট্টা হয়, অন্য গ্যাসে রাতের রান্না বসায় মাসি। বউয়ের ব্যস্ততা দেখে শৌভিক প্রস্তাব দেয়, রাতের খানা না হয় বাইরে থেকে হোক আনা-। সটান নাকচ করে দেয় মাসি। পাঁচ দিন বয়স থেকে মানুষ করেছে তুত্তুরীকে, মায়ের শাসন থেকে আগলে রেখেছে পাখির মত। তুত্তুরীর পাকযন্ত্র মাসির থেকে ভালো কে বোঝে। কাল যদি ঐ সব চর্ব্য চোষ্য খেতে হয়, আজ রাতে নিছক ডাল-ভাত-আলুসিদ্ধ-ডিম সিদ্ধ খাবে বাড়ি শুদ্ধ সব্বাই।  


রাত সাড়ে নটায়, গ্যাস ফাঁকা পেয়ে অবশেষে চাপে মাংস। সাবেকী পদ্ধতিতে কড়ায় সর্ষের তেল গরম করে, তাতে গুটি চারেক শুকনো লঙ্কা, অল্প গোটা গরম মশলা, তেজপাতা, আর জিরে দিয়ে ভাজতে দিই আগে কুচিয়ে রাখা সরু সরু করে কুচানো পিঁয়াজ। ভাজা হতে থাকা কুচানো পেঁয়াজে মেশে নুন, হলুদ গুঁড়ো, লাল লঙ্কা আর কাশ্মীরী লঙ্কা গুঁড়ো। হলুদ আর লঙ্কা গুঁড়া দিয়ে ভাজলে দারুণ সুন্দর লালচে রঙ আসে মাংসে। এটা আমি আবিষ্কার করেছি ইউটিউব ঘেঁটে। আর যা যা আবিষ্কার করেছিলাম সবই প্রায় ভুল প্রমাণ হলেও, এই টোটকাটা দারুণ কাজে আসে। অল্প তেল মশলায়ও কি লাল গরগরে ঝোল হয় মাইরি। 


কুচানো পেঁয়াজ কাদা হয়ে এলে, তাতে পরপর মেশে রসুন বাটা, আদা বাটা। পড়ে জিরে আর ধনে গুঁড়ো। গ্যাস কমিয়ে মেশাই ফেটানো টক দই। ইয়ে এটাও ইউটিউবের দৌলতে শেখা।  আগে যতবার দিতাম, জল কেটে পুরো ম্যাচাকার হয়ে যেত সব।  আজকাল গ্যাস কমিয়ে বা সময় থাকলে নিভিয়ে মেশাই টকদই।  ভালো করে একবার মিশিয়ে নিন, তারপর বাড়ান না গ্যাস যত চান। কে আটকাচ্ছে আপনাকে। 


তেল ছাড়া কষা মশলায় সবার শেষে মেশে সকাল থেকে ম্যারিনেট করে রাখা মাটন। আর কিচ্ছু করব না। মাঝে মাঝে  হাল্কা নেড়ে দেওয়া ছাড়া। অল্প আঁচে, ঢাকা কড়ায় পাক হতে থাকে তুত্তুরীর মায়ের মাটন। রাত পৌনে বারোটা নাগাদ যখন গ্যাস অফ করি, দু আঙুলে ছিঁড়ে আসে মাটন।


ঘড়ির কাঁটা যখন মধ্যরাতি ছোঁয়, মটকা মেরে পড়ে থাকা মেয়ের ঘাড়ে পড়ে তাকে জন্মদিনের হাজার চুমু দিতে দিতেও একই চিন্তা ঘোরে মাথায়। সবে তিনটি বাটি হল। এখনও বানাতে হবে আরো সাতটা বাটির খানা। ‘কালিয়া- কোর্মা-পোলাও’ না, এমন কিছু, যা হবে, ‘সস্তায় পুষ্টিকর’। 


তুত্তুরীর প্রিয় পেঁয়াজ, পাঁচ ফোড়ন আর শুকনো লঙ্কা ফোড়ন দিয়ে মুসুর ডাল না হয় ভরল চার নম্বর বাটি। পাঁচ নম্বর বাটির জন্য পেঁয়াজ দিয়ে ঝিঙে আলু পোস্ত বানাতে গিয়ে দেখি, ঝিঙেটাই আনেনি শৌভিক বাজার থেকে। বলতে গেলে চোখ রাঙায়। এখন ঝিঙে নাকি এমন পাকা, যে কেউ খায় না।  বদলে চিচিঙে এনেছে আমার বর। তাই সই, পঞ্চম বাটি সাজুক চিচিঙে আলু পোস্তয়।  ষষ্ঠ বাটিতে থাকবে আমার প্রিয় পনীর ভুনা মশলা। ভট্টচার্য বাড়ির কোন ছেলেমেয়ে পনীর ভালোবাসে না। তবে আমরা বউরা তো বাসি। না হয় আলোকিত করবে তুত্তুরীর জন্মদিনের থালা, কিন্তু এটা না হয় বানাব শুধু আমাদেরই জন্য।  


ভুনা মশলা বানাতে হলে আগে ভুনা অর্থাৎ ভেজে নিতে হয় কাঁচা উপকরণ গুলি। যথা কুচানো পেঁয়াজ, গোটা আদা এবং রসুনের কোয়া।  এরপর তাদের বাটতে হয় মিক্সিতে। এইটুকুই যা কাজ।  বাকি ভীষণ সহজ। 


কড়ায় অল্প তেলে একখান বড় এলাচ, অল্প জিরে আর তেজপাতা ফোড়ন দিয়ে ভুনা মশলাটা সামান্য নাড়াচাড়া করে, তাতে মেশাতে হয় টমেটোর কাত্থ, আর আমাদের চিরকালীন হলুদ- লঙ্কা-জিরে-ধনে গুঁড়ো। আর স্বাদমত সামান্য চিনি। সবার শেষে গ্যাস অফ করে টক দই। টমেটো আর টকদই দুটোই পড়ে তাই একটু সাবধানে করতে হয়, না হলে একে তো টক হয়ে যায় বেশী আর দ্বিতীয়ত জল বেরোয় এক কলসী। এরপর আর কি, কষে তেল বেরোলে, পরিমাণ মত জল দিয়ে ফুটতে থাকলেই মিশিয়ে দিতে হয় আগে থেকে কেটে রাখা পনীরের টুকরো। পনীর গুলো ভাজা হয় না বলে, অসম্ভব নরম আর ক্রিমই হয় বস্তুটা। শেষে গ্যাস অফ করে হাফ চামচ ঘি আর গুটি কয় গোটা চেরা কাঁচা লঙ্কা দিয়ে ঢাকা দিয়ে রাখতে হয়। করে দেখবেন, যেমন ভালো পোলাও এর সাথে চলে,তেমনিই ভালো চলে তন্দুরী, নান বা হাতে গড়া রুটির সাথে।  


সপ্তম বাটিতে বরং থাকুক তুত্তুরীর প্রিয় মিষ্টি মিষ্টি চিংড়ি পোস্ত। মালাইকারি বানাবারই ইচ্ছে ছিল, কিন্তু নারকেল আর কোথায় পাই। এখন নারকেল আনতে বললে, ভস্মই করে দেবেন হয়তো গৃহকর্তা।  তাই পোস্তর সাথে মেশাই চার মগজ বাটা। 


বাকি অতি পরিচিত রেসিপি, চাপড়া চিংড়ির খোসা ছাড়িয়ে, সামান্য নুন হলুদ জলে ভাপিয়ে নিয়ে, সর্ষের তেলে অল্প নেড়েই তুলে নিই আমি। মা বলত নাহলে সিঁটে হয়ে যায়। এটা হাওড়া না মুর্শিদাবাদের ভাষা জানি না, সোজা কথায় একটু বেশি ভাজলেই ছিবড়ে হয়ে যায় মাছগুলো। 


মাছ তুলে নেবার পর পড়ে থাকা তেলে, পাঁচ ফোড়ন  পড়ে। অতঃপর ভাজা হয় সামান্য কুচানো পেঁয়াজ। পেঁয়াজের রঙ সোনালী হলে তাতে মেশে হলুদ গুঁড়ো, চারমগজ বাটা আর কাঁচা পোস্ত বাটা। মেশে দই আর চিনি। মশলা কষে জল ঢালার পর আগে থেকে ভেজে রাখা মাছগুলো মিশিয়ে দিই আমি। চিংড়ি- পোস্ত-মগজদানায় মাখো মাখো হয়ে এলে, হাল্কা লালচে তেল ছাড়লে তবে নিভবে গ্যাস। 


 বাড়ছে বেলা। বেদম হচ্ছে পা আর হাঁটু। অষ্টম আর নবম বাটিতে থাকুক ঝালঝাল ঝাঁঝালো ডিম সর্ষে আর মিষ্টি-মিষ্টি দই কাতলা। দুটো রান্নার মালমশলা প্রায় একই।  একদিকের কড়ায় গরম সর্ষের তেলে পড়ে পাঁচফোড়ন আর একটা ছিঁড়ে দেওয়া শুকনো লঙ্কা। ভাজা লঙ্কার সৌরভে রান্নাঘর মথিত হলে তাতে মেশে, বাটা সর্ষে আর কাঁচা লঙ্কার অমৃত মিশ্রণ।  বেশী ঝাঁঝালো হলে নাকের জলে, চোখের জলে হবে কন্যা আমার।  তাই মেশাই সামান্য বাটা পোস্ত। মশলা ভাজা হয়ে এলে মেসে অল্প টক দই আর গোটা লঙ্কা।  কষতে কষতে তেল বেরিয়ে এলে সামান্য জল আছড়া দিয়ে তারওপর জাস্ট রেখে দিই আগে থেকে সিদ্ধ করা শক্ত ডিমটা। বাটিতে ঢালার আগে ভালো করে ওলটপালট করে নিলেই হবে। চুপিচুপি বলি পিসিশাশুড়ীর থেকে শেখা রেসিপিটা তুত্তুরীর থেকেও আমার বেশী প্রিয়। 


পাশের গ্যাসে ভাজা হন কাতলা দেবী। দইকাতলা একেকজন একেক রকম ভাবে রাঁধেন, সবথেকে সহজ আর চটজলদি রেসিপিটাই অনুসরণ করি আমি। নুন-হলুদ মাখিয়ে ভাজা মাছের তেলেই দিই জিরে, শুকনো লঙ্কা আর তেজপাতা, গোটা গরমমশলা ফোড়ন। মাছে পেঁয়াজ দিলে খুব অখুশি হন শাশুড়ি মা। তবে দইকাতলায় একটু পেঁয়াজবাটা না দিলে তেমন স্বাদ আসে না আর গ্রেভিটা ঘনও হয় না।  তাই দিই একটা ছোট্ট বাটা পেঁয়াজ। ভাজা হয়ে এলে মেশাই অল্প আদা বাটা আর মগজদানা বাটা। মেশাই ছিটেফোঁটা হলুদ আর লঙ্কা গুঁড়ো, ঐ অনবদ্য রঙটার জন্য।  কষা হয়ে এলে জল ঢেলে ভাজা মাছগুলো ফুটিয়ে নিলেই রেডি।  


 দশম বাটি নিয়ে চাপ নেই। ওটা তো মিষ্টি আর চকলেটেই ভরে উঠবে। যার চুলচেরা ভাগ হবে পরে। এত কষ্ট করে রান্না করছি কার জন্য? আর সে চকলেটের ভাগ দেবে না, আমায়? 


 দশম বাটিটা এককালে ছিল তুত্তুরীর ভাত খাবার রূপার থালা। অন্নপ্রাশনে উপহার দিয়েছিল দাদু আর মামমাম। এতটুকু থালাতে এই সেদিনও জন্মদিনের ভাত খেতে বসত তুত্তুরী। এবছর সেই দাদুরই নির্দেশে বার করতে হয়েছে আমার বিয়ের দানের কাঁসার বাসনপত্তর। যার মধ্যে দুটো বাটি আমি বাতিল করেছি সাইজ দেখে। বাপস্ পাক্কা দৈত্যের বাটি দিয়েছিল বাবা।  পান নেই যদিও, তবুও সাজিয়ে দিই নর্তকীর মুখের মত দেখতে পানের ডাবরটাও।


শুধু শুভ বিবাহ লেখা পালিশ করা দানের থালাটা সরিয়ে রেখে, বার করেছি আমার মুখে ভাতের কাঁসার থালাটা। সুদূর মুর্শিদাবাদের এক প্রত্যন্ত গাঁ রামনগর থেকে পাঠিয়েছিল আমার দিদা। খাস খাগড়ার কাঁসা। পিছনে কালো ছোপ। এতো নিছক থালা নয়। এতে মাখানো আছে আমার দিদার ঘ্রাণ। সবই তো ভাগ করেনি মেয়ের সাথে, আজ ভাগ করে নেবো আমার দিদার স্মৃতি আর আশির্বাদ। 


ভাতের সাথে নাকি পাঁচ রকম ভাজা দেবার নিয়ম, অত আর পারব না বাপু।  ব্যথায় টনটন করছে পায়ের প্রতিটা পেশী আর কোমর। আর তেমনি বেপোট গরম মাইরি। আরেকবার স্নান না করলে গলেই যাব মনে হয়।  এ বছরের মত গোল গোল বেগুনী,  পাঁপড় আর সপ্তাহের বাটা মাছ ভাজা দিয়েই জন্মদিন হোক। পাঁচ আর তিনে কি আর তফাৎ বাপু।  আর তেমন কিছুই নেই ভাজার মত। আলু ছাড়া। যা ভাজতে আমি মোটেই আগ্রহী নই।  ধীরে ধীরে গরম হচ্ছে মটকা। সমাধান বাতলে দেন শ্রীমতী তুত্তুরী স্বয়ং। 'কাকরোল আর করলা ভেজে দাও না মা'। কাকরোল আর করলা? কি অসাধারণ কম্বো মাইরি। এই নাহলে শ্রীমান শৌভিকের আত্মজা।  


রেঁধে বেড়ে সাজিয়ে গুছিয়ে, ছবি তুলিয়ে তো দিলাম, শ্রীমতী তুত্তুরী খেলেন কেবল পায়েস, চাটনি, পাঁপড় ভাজা, ডাল, ভাত আর চিংড়ি মাছ। আহাঃ এই না হলে আমার মেয়ে। বাকি রান্না থাক তোলা। আর রান্নাঘরে ঢুকছি না আপাততঃ দিন তিনেক। অনেক হয়েছে মা। ভাগ্যে জন্মদিন বছরে একবার আসে-