Tuesday 20 April 2021

বই পড়ি-

বই পড়ি- ২০শে এপ্রিল, ২০২১


‘২২শে ফেব্রুয়ারি, সন ১৯৪১। কাবুল শহরে তখন বিকেল। আচমকা কাবুলের ইতালীয় দূতাবাসের পিছনের দরজায় কড়া নাড়ল এক স্থানীয় ব্যক্তি। পরিষ্কার করে দাড়িগোঁফ কামানো, ছোট্টখাট্ট চেহারার  আপাতঃ সাধারণ লোকটার মাথায় কারাকুলি আফগান টুপি, পরণে হাঁটু পর্যন্ত লম্বা কুর্তা আর ঢোলা পাজামা। ধূমপানের জন্য পিছনের দরজায় ভিড় জমানো দূতাবাসের আফগান কর্মচারীদের একবারও সন্দেহ হল না, লোকটি স্থানীয় বাসিন্দা নয়। 


সমস্ত রকম যুদ্ধ বিগ্রহ থেকে বহুদূর,আফগানিস্তান তখন নিরপেক্ষ দেশ।  ১৭ মাস আগে শুরু হওয়া মহাশক্তি সংগ্রাম তখনও পরিণত হয়নি মহাযুদ্ধে। ইউরোপে নাৎসীরা ক্রমেই দুর্দম হয়ে উঠছে, একলা বৃটেন কেবল চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে তার সাথে টক্কর দেবার। আপোসে পোল্যাণ্ডকে ভাগাভাগি করে, হিটলার এবং স্ট্যালিন তখনও পরষ্পরের পরম মিত্র। আমেরিকার সাথেও জাপানের সম্পর্ক সৌহার্দ্যপূর্ণ। ‘ আমাদের ছেলেরা কোন তৃতীয় দেশের যুদ্ধে লড়তে যাবে না’ এই মর্মে আমেরিকার মাতা- পিতাদের প্রতিশ্রুতি দিয়ে সদ্য সদ্য তৃতীয়বারের জন্য আমেরিকার রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়েছেন ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট।

 


লোকটির ইতালীয় রাষ্ট্রদূতের সাথে সাক্ষাৎ করা ভীষণ দরকার। কিন্তু এইভাবে এসে দেখা করতে চাইলেই তো আর দেখা হয় না। লোকটি রক্ষীদের জানাল, সে পেশায় পাচক, তাকে হুজুরের সাথে দেখা করতে বলা হয়েছে। 


রক্ষীর পিছুপিছু উঁচু শিলিংওয়ালা যে ঘরটিতে লোকটা প্রবেশ করল, তার দেওয়ালে টাঙানো ইতালীয় পতাকা আর বড় করে বাঁধানো ইতালীয় স্বৈরাচারী শাসক বেনিতো মুসোলিনির ছবি। মস্ত বড় ডেস্কের উল্টোদিকে বসে থাকা ইতালীয় রাষ্ট্রদূত মোটেই খুশি হলেন না লোকটাকে দেখে। কাবুলের বসবাসকারী অন্যান্য কূটনৈতিকদের মতই তিনিও অনাহূত স্থানীয় আগন্তকদের বেশ ভয় পেতেন। ব্যাটারা হয় সরকারী চর,নয়তো অন্যদেশের গুপ্তচর হয়। এই লোকটাও গুপ্তচর কি না তিনি ঠিক বুঝতে পারলেন না।  এমনকি লোকটি যখন জানাল যে ‘কাবুল সিমেন্সের হের থমাস আপনার কাছে পাঠিয়েছেন। ’ তখনও বিশেষ স্বস্তি বোধ করতে পারলেন না তিনি। 


“কেন পাঠিয়েছে’ খেঁকিয়ে উঠলেন তিনি। লোকটি অত্যন্ত ঋজু ভাবে বলল, ‘তা জানি না।  আমাকে বলা হয়েছে, এসে আপনার সাথে দেখা করতে। ’ লোকটির গলার স্বরে এমন কিছু ছিল, যাতে ইতালীর রাষ্ট্রদূতের বুঝতে বাকি রইল না, এ কোন সাধারণ আফগান হয়। কি মনে করে উনি ফোন করলেন থমাস সাহেবকে।  দুজনের মধ্যে জার্মান ভাষায় বেশ খানিকক্ষণ ফিসফিসিয়ে কথা হল। যার বিন্দুবিসর্গও বুঝলে না আগন্তুক। তবে এটুকু খেয়াল করল যে, বেশী কথা থমাস সাহেব ওপাশ থেকে বলে গেল, আর রাষ্ট্রদূত চুপচাপ শুনে গেল।  


ফোন নামিয়ে, ব্যক্তিগত আর্দালি এবং অন্যান্য কর্মচারীদের বাইরে যেতে ইশারা করলেন রাষ্ট্রদূত। ঘরের দরজা বন্ধ হতেই তিনি ইশারায় আগন্তুককে আসন গ্রহণ করতে বললেন, তারপর ভাঙা ইংরাজিতে বললেন, ‘আমি পিয়েত্রো কুয়ারোনি। আমি কাবুলে ইতালীয় রাষ্ট্রদূত। ’  


আগন্তুক তার পরিচয় দিল। নাম রহমত খাঁ। আফগান নয়, বরং জন্মসূত্রে ভারতীয়।  নামটা সঠিক না হলেও বাকি তথ্যে কোন ভ্রান্তি ছিল না। আগন্তুক জানাল পেশোয়ার থেকে কাবুল এই দীর্ঘ ২০০ মাইল দুর্গম পথ সে পদব্রজে পার হয়ে এসেছে দুর্ধর্ষ তথা দুর্দম উপজাতি অধ্যুষিত এলাকার মধ্যে দিয়ে যারা বৃটিশ ভারত এবং আফগানিস্তানের মধ্যে রচনা করে সীমানা। 


গত ২৭শে জানুয়ারী সে কাবুলে এসে পৌঁচেছে। তবে একা আসেনি, সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে ভারতীয় বিপ্লবী সুভাষ চন্দ্র বোসকেও। সুভাষের পথপ্রদর্শক  তথা দেহরক্ষী হিসেবেই খাঁয়ের কাবুলে আগমন। খাঁ আরো জানাল যে আপাততঃ কাবুলেই আত্মগোপন  করে আছে সুভাষ, কাবুল থেকে সীমান্ত টপকে রাশিয়া হয়ে বার্লিন যেতে চান সুভাষ, ভারতকে পরাধীনতার শিকল থেকে মুক্ত করার জন্য জার্মান সহায়তা চাইতে।  


কাবুলে এসেই তাঁরা জার্মান দূতাবাসের সাথে যোগাযোগ করেন, বেশ কয়েকবার মিটিং হয়, কিন্তু ফলপ্রসূ হয় না কিছুই।  এদিকে সম্পূর্ণ বেআইনি ভাবে কাবুলে এসেছেন সুভাষ আর রহমত খাঁ।  না আছে তাদের পাশপোর্ট বা অন্যান্য দরকারী কাগজপত্র, কোনমতে এক আফগান পুলিশ আপিসারকে ঘুষ দিয়ে গ্রেপ্তার এড়িয়ে আত্মগোপন করে আছেন তাঁরা।  যত দিন কাটছে, ততোই বাড়ছে তাদের বিপদ। এই ভাবে বেশীদিন গ্রেপ্তারী এড়ানো অসম্ভব।  আর আফগান পুলিশ একবার ধরতে পারলেই, সোজা তুলে দেবে বৃটিশ সরকারের হাতে। এমতবস্থায় কুয়ারনিই তাদের একমাত্র ভরসা।  


জার্মানদের মত ঝুলিয়ে রাখল না কুয়ারনি। পরবর্তী তিনটি সপ্তাহ আর কয়েকটি মিটিং এর পরই ইতালীয় কূটনৈতিক পাশপোর্ট সমেত সুভাষকে নিরাপদে পার করিয়ে দেওয়া হল আফগান সীমান্ত। তুলে দেওয়া হল মস্কোগামী ট্রেনে। তারপর বোসের কি হল, অথবা হল না আমরা সবাই জানি অথবা জানি না। কিন্তু যে সঙ্গীকে তিনি ছেড়ে গেলেন কাবুলে তাঁর গপ্পও বোসের থেকে কিছু কম চিত্তাকর্ষক নয়। ”

তবে সে গল্প আবার কাল, অথবা পরশু বা কখনই নয়। কে জানে- 


পুনশ্চঃ সবটুকুই মিহির বোসের দা ইন্ডিয়ান স্পাই থেকে।  পাতা- ১৩-১৫।


বই পড়ি- ২৩শে এপ্রিল, ২০২১


“সুভাষ বোস ইউরোপ রওণা দেবার অল্পদিনের মধ্যেই,  রহমত খাঁয়ের পদোন্নতি  ঘটল, নিছক দেহরক্ষী থেকে গুপ্তচর। কাবুলের ইতালীয় রাষ্ট্রদূত পিয়েত্র কুয়ারোনি বহুদিন থেকেই এমনি এক অস্ত্রের সন্ধানে ছিলেন, যার মাধ্যমে  ভারতে বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তির ওপর সরাসরি আঘাত হানা যায়। কুয়ারোনির বদ্ধমূল ধারণা ছিল, বৃটিশ সাম্রাজ্য নামক শিকলের সবথেকে দুর্বল, সবথেকে নড়বড়ে আংটা হল ভারত।  এখানে ঠিকঠাক আঘাত করলে শিকল ছিঁড়তে বাধ্য।  


যাবার সময়, বোস যখন ইতালীয়দের সাথে সহযোগীতা করার জন্য খাঁকে তাঁর এজেন্ট নিয়োগ করে গেলেন, কুয়ারোনি এই সুযোগ ছাড়লেন না। কয়েক মাসের মধ্যেই আরেক অক্ষশক্তি জার্মানিও খাঁকে তাদের চর হিসেবে নিযুক্ত করল। ইতালী এবং জার্মানি দুই ফ্যাসিস্ট দেশের হয়ে কাজ করলে বা পারিশ্রমিক নিলেও খাঁ কিন্তু আদতে ছিল গোঁড়া কম্যুনিস্ট। ফলে প্রথম থেকেই খাঁ দুই দেশকে ভুলভাল তথ্য সরবরাহ করে আসত। 


এই ভুল তথ্য পরিবেশন প্রথমদিকে স্বতঃপ্রণোদিত হলেও, ‘অপারেশন বার্বারোসা’র পর অর্থাৎ হিটলারের রাশিয়া আক্রমণের পর, খাঁ হাত মেলায় রাশিয়ার সাথে এবং রাশিয়ানদের সরবরাহ করা তথ্য নাৎসি বাহিনীর কাছে পৌঁছে তাদের ভুল পথে পরিচালনা করতে থাকে।  


দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষের দিকে  খাঁ ইংরেজদের হয়েও কাজ করতে থাকে। বৃটিশরাই তাঁর নাম দেয়, ‘সিলভার’। যাঁকে ব্যঙ্গ করে রহমত খাঁর নাম রাখা হয়েছিল সিলভার, সেই আসল মিঃ সিলভার ছিলেন এক ওপরতলার বৃটিশ অফিসার, যিনি ইংলণ্ডে বসে সমগ্র ভারতে যাবতীয় আণ্ডার কভার অপারেশনের তদারকি করতেন। 


জার্মানরা কোনদিন ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেনি যে সিলভার তাদের ইচ্ছাকৃত ভাবে ভুল তথ্য পরিবেশন করছে। তারা সিলভারকে এতটাই বিশ্বাস করত এবং তার কাজে এতটাই সন্তুষ্ট ছিল, যে সিলভারকে তৎকালীন জার্মানির সবথেকে বড় মিলিটারি পুরষ্কার, ‘ দা আয়রণ ক্রস’ প্রদান করা হয়। জার্মানরা সিলভারকে একটি ট্রান্সমিটারও দিয়েছিল,যার মাধ্যমে সিলভার সরাসরি বার্লিনে হিটলারের স্পেশাল সিক্রেট সার্ভিস, Abwehr এর সদর দপ্তরের সাথে কথা বলতে পারত। জার্মানরা এক মুহূর্তের জন্য সন্দেহ করেনি যে সিলভারের প্রদত্ত যাবতীয় মিলিটারি তথ্য আসলে বৃটিশ সিক্রেট সার্ভিসের বানানো গপ্প। যা ফাঁদা হত খোদ দিল্লীতে ভাইসরয়ের প্রাসাদে বসে। 


যুদ্ধ শেষের আগে সিলভার কিছুদিন জাপানের হয়েও গুপ্তচরবৃত্তি করেন। একসাথে পাঁচ পাঁচটা দেশের হয়ে গুপ্তচরবৃত্তির এহেন নজির দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাসে আর খুঁজে পাওয়া যায় না।” 

- Pg-16, The Indian Spy, The True Story of the Most Remarkable Secret Agent of World War II by Mihir Bose.


  বই পড়ি- ৩, ২৫শে এপ্রিল, ২০২১


"১৫ কোটি পাউণ্ড, ১১লক্ষ লোকলস্কর সহ প্রথম বিশ্বযুদ্ধে সর্বাত্মকভাবে বৃটেনের পাশে দাঁড়িয়েছিল ভারত। যার মধ্যে ১লক্ষ ৩৮ হাজার সেপাই লড়েছিল শুধু ইউরোপেরই নানা রণাঙ্গনে। মূলতঃ ভারতীয়দের জন্যই বৃটিশ সাম্রাজ্য প্রসারিত হয়েছিল রাশিয়ার দক্ষিণে ট্রান্স ক্যাস্পিয়ান আর ককেশিয়া এবং পারস্য ছাড়িয়ে সুদূর মেসোপটেমিয়া। ভারতীয়দের জন্যই ইরাক দখল করে বৃটেন, পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায় যে বেশ কিছুদিনের জন্য ভারতীয় টাকাই ছিল ইরাকের জাতীয় মুদ্রা।  এমনকি যে সৈন্যসামন্ত নিয়ে প্যালেস্টাইনের যুদ্ধে অ্যালেনবি তুরস্ককে পরাস্ত করেছিল তার পদাতিক বাহিনীর দুই তৃতীয়াংশ আর অশ্বারোহী সেনাদলের এক তৃতীয়াংশই ছিল ভারতীয়। যুদ্ধে বৃটেনের পাশে দাঁড়াতে ভারতীয়দের অনুপ্ররণা দেবার জন্য গান্ধীজী কাইজার- এ-হিন্দ এর শিরোপাও পান।  


 অগণিত লস্কর, নাবিক, জাহাজী ছাড়াও ষাট হাজারের বেশী ভারতীয় সৈন্য নিহত হয় এই যুদ্ধে। যুদ্ধ শেষে যে ইনফ্লুয়েঞ্জা অতিমারিতে(* স্প্যানিশ ফ্লু) আক্রান্ত হয় বিশ্ব, ভারতে তা তেমন ভাবে দেখা না গেলেও প্রায় বিনা চিকিৎসায় মারা যান ১কোটি ৭০ লক্ষ মানুষ, যা ছিল তৎকালীন মোট জনসংখ্যা ৫শতাংশ। এত চড়া হারে মৃত্যুর একটাই কারণ ছিল, দেশের অধিকাংশ ডাক্তার আর নার্সকে খেয়ে বসেছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। 


এতকিছুর পর, নূন্যতম ধন্যবাদের বদলে ভারতের কপালে জুটল বেত্রাঘাত। গান্ধীজী সমেত গোটা ভারতবর্ষই ভেবে বসেছিল, মহাযুদ্ধে এমন সর্বাত্মক সহায়তার পর, নিশ্চয় হোমরুলের দাবী মেনে নেবে বৃটেন। অন্যান্য সাদা উপনিবেশ গুলি যথা অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যাণ্ড, কানাডা বা সাউথ আফ্রিকা যেমন বহু আগে থেকে ভোগ করে আসছে স্বায়ত্তশাসন। এমনকি দীর্ঘ সশস্ত্র বিপ্লবের মধ্যে দিয়ে আয়ার্ল্যাণ্ডও স্বাধীনতা পেল, শিকে ছিঁড়ল না কেবল ভারতের ভাগ্যে।  


বদলে ভারতবাসী দেখল, আরো কঠোর, আরো নির্মম হয়ে উঠেছে বৃটিশ শাসন। যুদ্ধ শেষ হতে না হতেই, ডিফেন্স অব ইণ্ডিয়া অ্যাক্টের প্রতিক্রিয়াশীল ধারাগুলি আরো কঠোর ভাবে বলবৎ করল বৃটিশ সরকার। হৃত হল সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, মিটিং মিছিলের ওপর চেপে বসল নিষেধাজ্ঞা, চালু হল পরোয়ানা ছাড়াই গ্রেপ্তার, বিনা বিচারে একবছর অবধি হাজতবাস। যার মেয়াদ বাড়ানো একেবারেই কতৃপক্ষের ইচ্ছাধীন। এমনকি কারো কাছে দেশদ্রোহ মূলক কোন ইস্তেহার পাওয়া গেলে গ্রেপ্তার হবার পর স্বপক্ষে উকিল নিয়োগ করারও অধিকার কেড়ে নিল বৃটিশ সরকার।  লোকে বলত, ‘না দলিল, না ভকিল, না আপিল।’ বৃটিশদের প্রতি আনুগত্য ঝেড়ে ফেলে রাতারাতি বিদ্রোহী হয়ে উঠলেন গান্ধীজী।  ডাক দিলেন দেশ জোড়া গণ আন্দোলনের।  


আর এই গণবিক্ষোভকে কেন্দ্র করেই ১৩ই এপ্রিল ১৯১৯, সিলভারের গ্রাম গল্লা ঢেড় থেকে মাত্র ২৫০ মাইল দূরে অমৃতসর শহরে ঘটে গেল এক পাশবিক হত্যাকাণ্ড। বৃটিশদের প্রায় দুশো বছরের ঔপনিবেশিক শাসনে এত নৃশংস, এত ন্যক্কারজনক ঘটনা কখনও প্রত্যক্ষ করেনি এই উপমহাদেশবাসী।


নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও গণবিক্ষোভ চলছিলই, এমতবস্থায় পরিস্থিতি আয়ত্তে আনতে অমৃতসর শহরের আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব  তুলে দেওয়া হল আর্মির হাতে। জ্যুলাণ্ডার ব্রিগেডের কম্যাণ্ডার, ব্রিগেডিয়ার  জেনারেল রেজিন্যিল্ড ডায়ার অমৃৎসর শহরের দায়িত্ব নেবার সাথে সাথেই জারি করলেন মার্শাল ল। এমন সময়ে তাঁর কাছে খবর এল, তাঁর নির্দেশ অগ্রাহ্য করে জালিয়ানওয়ালা বাগে সমবেত হয়েছে এক বিশাল জনতা। জালিয়ানওয়ালা বাগ ছিল এক অতিকায় মুক্তাঙ্গন, কিন্তু প্রবেশ বা প্রস্থানের পথ কেবল একটি।  তাও অত্যন্ত সরু এক গলি বরাবর। খবর পাওয়া মাত্রই ডায়ার লোকলস্কর নিয়ে হাজির হলেন এই সরু রাস্তার মুখে। 


প্রায় হাজার বিশেক নিরস্ত্র শান্তিপূর্ণ জনতা জমায়েত হয়ে শুনছিল নেতাদের বক্তব্য। দিনটি ছিল বৈশাখী, সমগ্র উত্তরভারত জুড়েই ঐ দিনটি উৎসব হিসেবে পালিত হয়, তাই জমা হওয়া জনতার মধ্যে কতজন ঠিক রাজনৈতিক কারণে জমা হয়েছিল বলা দুষ্কর। ছিলেন শিশু সন্তান কোলে অগণিত মহিলা। সবথেকে বড় কথা, প্রত্যেকেই ছিল নিরস্ত্র। তাতে অবশ্য জেনারেল ডায়ারের কিছু যায় আসেনি।  


ডায়ার যখন দেখলেন এত সরু রাস্তায় তার সাজোয়া গাড়ি ঢুকবে না, তখন তিনি গাড়িগুলি রাস্তার মুখে দাঁড় করিয়ে, গুর্খা সেপাইদের নির্দেশ দিলেন রাস্তা আটকে, গুলি চালাতে।  কোন সচেতনবাণী ছাড়াই।


এম্যুনিশন শেষ না হওয়া পর্যন্ত থামেনি গুলিবর্ষণ। শুধু সরকারী হিসেবেই মারা গিয়েছিলেন ৩৩৭ জন পুরুষ, ৪১ জন মহিলা এবং একটি ৭ সপ্তাহের দুধের শিশু। আহত ১৫০০।  কংগ্রেসের মতে মৃতের সংখ্যা  ছিল হাজারের অনেক বেশী।


ডায়ারের কৃতকর্মের তালিকা বেশ লম্বা। নানা অজুহাতে এদেশীয়দের চাবুকপেটা করা ছাড়াও তিনি কুখ্যাত ছিলেন, ‘ক্রলিং অর্ডার’ এর জন্য। জনৈকা শ্বেতাঙ্গ রমণী আক্রান্ত হয়েছিলেন একদল এদেশীয়দের দ্বারা, যেখানে এই ঘটনাটি ঘটেছিল, ডায়ার নির্দেশ দেন, সেই পথে যাতায়াত করতে হলে ভারতীয় পুরুষদের যেতে হবে বুকে হেঁটে। অন্যথা হলেই জুটবে বেধড়ক মার এমনকি বেয়নেটের খোঁচাও। বৃটিশ লাইব্রেরিতে রাখা একটি ছবিতে দেখা যায়, এইভাবে সরীসৃপের মত বুকে হেঁটে চলা ভারতীয়দের বেয়নেটের খোঁচা মারছে ২৫ তম রেজিমেন্টের গোরা সেপাইরা। জনৈক প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ থেকে জানা যায়, ‘রাস্তাটা অনেকটাই লম্বা, এইভাবে উপুড় হয়ে শুয়ে, হাত আর কাঁধে ভর দিয়ে বুক ঘষটে সরীসৃপের মত চলতে থাকা বেশ দুরূহ এবং ভীষণ কষ্টকর। কারো পাছা মাটি থেকে সামান্য উঁচুতে উঠলেই লাথি মারছিল টহলদার গোরা সেপাইরা। ’ 


এতকিছুর পরেও ভারতবাসীর কাছে যেটা সবথেকে বেদনাদায়ক ছিল তা হল, যদিও ডায়ারকে আর্মি ছাড়তে হয়, কিন্তু তাছাড়া তার বিরুদ্ধে কোন শাস্তিমূূলক ব্যবস্থা নেওয়া হল না। তাকে সসম্মানে অবসর গ্রহণের সুযোগ দেওয়া হল, এমনকি অবসর নেবার পর তার পেনশন ইত্যাদিও চালু করা হল। 


যেটুকু সামান্য শাস্তি দেওয়া হয়েছিল তার জন্যও বৃটিশ পার্লামেন্টে ঝড় ওঠে। জালিয়ানওয়ালা বাগ নিয়ে আলেচনার প্রস্তাব বিপুল ভোটে খারিজ হয়ে যায় হাউস অব কমনস্ এমনকি হাউস অব লর্ডসেও। এই নিয়ে আলোচনার প্রস্তাব দেবার জন্য তীব্র সমালোচনার মুখে পড়ে সেদেশের সরকার। আসলে এদেশে বা ইংলণ্ডে বসবাসকারী গোরাদের চোখে ডায়ার ছিল নায়ক। তিনি যা করেছিলেন তা বৃটিশ রাজের মঙ্গলের জন্যই করেছিলেন এই মতবাদ আজও  খোলাখুলি ভাবে অনেক বৃটিশ লেখক পোষণ করে থাকেন। 


ডায়ারের মৃত্যুর পর রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়। তাঁর জন্য একটি বিশেষ তহবিল খোলা হয় যাতে বহু গণ্যমান্য ব্যক্তি অর্থপ্রদান করেন। যাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন লেখক রুডিয়ার্ড কিপলিং। কারণ শতিনেক নিরস্ত্র ভারতীয়কে হত্যা করার পিছনে তাঁরা কোন অনৈতিকতা, কোন অন্যায় খুঁজে পাননি। “ 


 Pg- 35-37, The Indian Spy, The True Story of the Most Remarkable Secret Agent of World War-II by Mihir Bose.

Tuesday 13 April 2021

অনির ডাইরি, ১৩ই এপ্রিল, ২০২১

 



বলেছিলাম, আগামী কাল নীল, একটা বেল এনো তো। তা এনেছেন বটে, তবে আমার সুবিধার কথা ভেবে বেলটিকে ফাটিয়ে এনেছেন।  তাই দিলাম ঠাকুরকে, 'প্রভু, তোমার যা অভিরুচি'। 


এই বাড়ির নিয়মকানুন কিছুই জানি না। শ্বশুরমশাই যেমন কড়া নাস্তিক, শাশুড়ীমা তেমনি প্রগতীশীলা। উপোসতিরেস প্রসঙ্গে প্রথমেই জানিয়ে দিয়েছিলেন, ‘তোমার যা প্রাণ চায়,কোরো-’। এমনিতে যে আমি খুব ধর্মপরায়ন লক্ষ্মীমন্ত মেয়ে তা নই, বরং সর্বার্থে লক্ষ্মীছাড়া, অলবড্ডে তথা হদ্দ কুঁড়ে ‘নারী বদ’ বলে অত্যন্ত শ্লাঘা বোধ করি, তবুও বছরে ছটা ষষ্ঠী অার দুটো অষ্টমী করেই ফেলি টুকটুক করে। সবটুকুই আমার বাপের বাড়ির নিয়ম মেনে।  কেন করি? এ প্রশ্ন বিগত এক যুগে আমার শ্বশুরমশাই তথা তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র অগণিত বার করেছেন- জবাবটা আমিও ঠিক জানি না। করি, কারণ মা করত, থুড়ি এখনও করে। আর করি, মেয়েটার শিকড়ে খানিক বাঙালীয়ানার মাটি জোগাতে। বড় বেশি ট্যাশ তৈরি হচ্ছে এরা, একটু তো বাঙালী হোক, বারো মাসে বাঙালির তেরো পার্বণের সাথে কিছুটা তো আলাপ জমুক। 


জৈষ্ঠ্যে আসে জামাইষষ্ঠী। ভাদ্রে চাপড়া ষষ্ঠী। দুর্গা ষষ্ঠীর ঠিক একমাস আগে। কি দারুণ মিষ্টি মিষ্টি মুগডালের বড়া বানাত ঠাকুমা, চাপড়া ষষ্ঠী এলেই। মিষ্টি দই মাখিয়ে সেই বড়ার আস্বাদ আজও কোথাও জেগে আছে স্বাদকোরকের কোন গহীন অংশে। রান্নাঘরের মস্ত শিলনোড়াখানি এই সময় রাতারাতি হয়ে যেত মা ষষ্ঠী। গোটা ফল দিয়ে পুজো হত তাঁর। কোলের বাছাদের স্নান করতে নিষেধ করত ঠাকুমা। সন্ধ্যা ঢললে, যখন পশ্চিমের নিম গাছের ফাঁক দিয়ে উঁকি মারত বুড়ি চাঁদ, উঠোনের লাগোয়া দখিন খোলা রোয়াকে আঁচল বিছিয়ে শুয়ে, চাপড়া ষষ্ঠীর গল্প শোনাত ঠাকুমা। কোলের কাছে বিড়ালছানার মত ঘেঁষে থাকতাম আমরা তিন খুড়তুতো জেঠতুতো ভাইবোন। সব কি আর মনে আছে, স্মৃতিপটে জমেছে বিস্তর ধূলিকণা। এই দিনে নাকি গঙ্গাস্নান করতে গিয়ে সন্তান হারায় কোন এয়োস্ত্রী। আচমকা আসা বান খালি করে যায় কোল। সন্তানহারা জননীর করুণ আর্তিতে আবির্ভূত হন ষষ্ঠীদেবী স্বয়ং। তারপর জানা যায়, আপন পাপেই সন্তান হারিয়েছে নারী। বাছার দুধের বাটিতে ঠোঁট ডোবানো বিড়ালছানাকে চ্যালাকাঠ পিটিয়ে হত্যা করারই মাসুল গুণছে রমণী। পরিত্রাণের উপায় আছে বটে, তবে তা ভয়ানক। ঘাটেই পড়ে থাকা আধপচা, পোকা কিলবিল করা মরা বেড়ালছানার দেহে মিষ্টি দই ঢেলে চাটতে হবে তাঁকে। ঠিক যেমন সোহাগ করে চেটে দিত ছানাটার মা বেড়াল। পুত্রশোকে মূহ্যমান নারী অক্ষরে অক্ষরে পালন করেন মা ষষ্ঠীর নিদান। পরিণতি, আবার আসে বান, মায়ের আঁচল ধরে ভেসে ওঠে ডুবে যাওয়া শিশু। 


আশ্বিনে দুর্গা ষষ্ঠী। মাঘে আসে শীতল বা শেতল ষষ্ঠী। সরস্বতী পুজোর ঠিক পরের দিন। এই একটিই ষষ্ঠী যেদিন ভাত খায় মায়েরা। গরম ভাত নয় অবশ্য, আগের রাতে করে রাখা, জল ঢালা ভাত, অথবা সকালে করেও জলে ভিজানো ভাত। সাথে আর যাই থাকুক না কেন গোটাসিদ্ধ আর মিষ্টি দই থাকবেই। 


পরপর দুটো ষষ্ঠী আসে চৈত্রে। বাসন্তী পুজোর ষষ্ঠী বা অশোক ষষ্ঠী। আগে থেকে তুলে রাখা, শুকনো ছখানি অশোকফুল, কাঁঠালি কলার খণ্ডিতাংশে চটকিয়ে কপ্ করে গিলে খেতে হয় সকালে। জল দিয়ে গিললে হবে না, আবার না গিলতে পেরে ওয়াক তুললেও হবে না।  সদ্য সদ্য মা হবার পর, প্রথম অশোক ষষ্ঠী পড়েছিল যখন, তখন আমি বিডিওর ঘরণী। খড়্গপুরের উপান্তে এক ছোট্ট গাঁয়ে মোদের ঘরসংসার। সারা গাঁ ঘুরে কোথাও জুটল না অশোকফুল। কি করি? পিসি নিদেন দিল, ছটা কাঁচা মুগকড়াই কলায় চটকে গিলে খেতে। তারপর থেকে অবশ্য কখনও সমস্যা হয়নি। আমাদের আবাসনেই আছে ঝাঁকড়া অশোকগাছ। ইস্কুল ফেরৎ রিক্সামামাকে দিয়ে পাড়িয়ে আনে তুত্তুরী।  


চৈত্র মাসে দ্বিতীয় তথা বছরের শেষ ষষ্ঠী আজ। শ্বশুরমশাই প্রত্যেকবার মাথা চুলকান, “তিথি গত ভাবে আজ তো ষষ্ঠী নয়। চৈত্রসংক্রান্তির আগের দিন নীল তথা শিবের উপাসনা হয় বটে, তাকে খামোখা তোমরা ষষ্ঠী বানাও কেন?” এ প্রশ্নের সদুত্তর কি ছাই আমার কাছে আছে? আমাদের মধ্যহাওড়ায় নীলের সাথে সাথে ষষ্ঠীরও উপাসনা যে হয় আজকের দিনে। পঞ্চানন তলার লালবর্ণ বুড়ো পঞ্চাননের পাশে ছেলে কোলে বসে থাকেন তন্বী ষষ্ঠীদেবী। 


আগে নিয়ম অনেক কঠোর ছিল, মধ্যাহ্ন অবধি জলগ্রহণ পর্যন্ত করতেন না জেনানাকুল। বেলা বারোটা বাজলে তবে শিবের মাথায় কাঁচাদুধ মেশানো গঙ্গাজল ঢেলে, ধুঁতরো ফুল, আকন্দ ফুলের মালা, সিদ্ধি পাতা, পাঁচরকম ফল আর পৈতে দিয়ে বুড়ো শিবের উপাসনা করে, চরণামৃত সহযোগে উপবাস ভঙ্গ করতেন তাঁরা। উপাচার একই আছে, তবে বেলা বারোটা অবধি অপেক্ষা করার নিয়ম বর্তমানে অনেক শিথিল। 


বরাবর নীলের দোসর আমার পিসি। পুজোর যাবতীয়  যোগাড় করে রাখে পিসি। আমার করণীয় বলতে শুধু ধরাচূড়া পড়ে নীলের সকালে পিসির হাত ধরে পিতলের কমণ্ডুল ভর্তি দুধ গঙ্গাজল আর সাদা রুমাল ঢাকা ফুলফলের টুকরি নিয়ে বুড়ো শিবের দুয়ারে হাজির হওয়া। এবারে অবশ্য হাওড়া যাওয়া বা মন্দিরে গিয়ে পুজো দেওয়ার বিলাসিতা আর হয়ে ওঠেনি। ঘরেই নমঃ নমঃ করে পুজো সারা। ধুতরো ফল, সিদ্ধি পাতা বা আকন্দ ফুলের মালা আনতে বলে আর বিব্রত করিনি নিজের বরকে। 


 পুজো শেষে বানাতে বসেছিলাম বেলের শরবৎ , নীল আর বেলের শরবৎ বা পানা কেমন যেন একে অপরের সম্পূরক।  বাড়ির গাছের বেল সন্তর্পনে ফাটিয়ে হাতে করে জলে গুলে, পরিষ্কার সাদা কাপড়ে ছেঁকে, পরিমাণ মত মিষ্টি, সামান্য নুন আর কয়েকফোঁটা লেবুর রস মিশিয়ে যে অমৃত তৈরী করত ঠাকুমা, অবিকল তেমন না হলেও কাছাকাছি তো এসেইছে ব্যাপারটা। সমস্যা একটাই, ব্যাপারখানা বেলের পানা না হয়ে, কেমনি যেন বেলের স্মুদি হয়ে গেছে। তা হোক, প্রতি চুমুকে না হয়, আরেকটু ঘন হয়ে আসুক হারিয়ে ফেলা শৈশব, আর হারিয়ে যাওয়া মানুষগুলো।

Sunday 11 April 2021

অনির ডাইরি ১০ই এপ্রিল, ২০২১

 


ভালো করে ঘুমই হয়নি কাল রাতে। একাকিনী হোটেলে রাত কাটানো অবশ্যি কালই প্রথম নয়। বিগতপাঁচ তারিখেও তো একাই ছিলাম হোটেলে। সৌজন্য নির্বাচন। নির্বাচনের আগের রাতে কোন সরকারী আস্তানা পাওয়া অসম্ভব, ভাগ্যে এই হোটেলখানা ছিল। ঠিক পাঁচ বছর আগের বিধানসভা নির্বাচনের সময় হুগলী তৎকালীন ওসি ইলেকশনের আপৎকালীন মাথা গোঁজার ঠাঁই ছিল বাসস্ট্যাণ্ডের ধারের এই হোটেলখানা। তিনি আবার সম্পর্কে তুত্তুরীর বাবা, তাঁর পরামর্শেই তড়িঘড়ি রমেশকে পাঠিয়ে বুক করেছিলাম ঘর। বাসস্ট্যান্ডের ধারের ছোট্ট হোটেল,একতলায় মালিকেরই মিষ্টির দোকান, দুই-তিন-চার তলায় থাকার ব্যবস্থা। আহামরি কিছুই না,মোটামুটি কাজ চালানোর মত। 


চারতলার ঘরগুলি তুলনামূলকভাবে এট্টু বড়, একটা ছোট্ট জানলাও আছে,যা দিয়ে দেখা যায় সামনের রাজপথ। বাথরুমে গিজার- হ্যাণ্ড শাওয়ার লাগানো। দেওয়ালে স্পিল্ট এসি, একটা কাঠের আলমারি, এলসিডি টিভিও ছিল। দোতলার ঘরটা তুলনায় বেশ ছোট, গিজার হ্যান্ড শাওয়ার কিছুই নেই। বালতি মগই ভরসা। বাথরুমটাই এত ছোট, নড়ানড়া করা দায়। ঘরে একখান দেওয়ালে লাগানো এসি আছে বটে, তবে তা থেকে নিখাদ হাওয়া বেরোয়। জানলাও আছে একটা, চেপে বন্ধ করে,তারওপরে জাল লাগানো। টিভিও আছে, সেই সাবেকী ছোট্ট পোর্টেবল টিভি। আর আছে একখান কাঁচের গ্লাস,  তারপাশে বড়বড় করে লেখা, ‘এখানে মদ্যপান নিষেধ’।  


ওপরের ঘরের দরজায় দুইখানি ছিটকিনি ছিল, এইঘরে একটি সম্বল। তুত্তুরী জোরে লাথি মারলেই ভেঙে পড়বে ছিটকিনি। কি আর করা। মালিক প্রভূত ক্ষমা চেয়েছেন, এইঘরটি দিয়েছেন বলে, কিন্তু উনি নিরুপায়। জেলা স্বাস্থ্য আধিকারিকের দলবল অনেক আগে থেকেই বুক করিয়ে রেখেছিল ভালো ঘরগুলি।  অবশ্য ওপরের ঘরে দুইটি ছিটকিনি থাকলেও লাগত কেবল একটি। বহু চেষ্টাচরিত্র করেও লাগাতে পারিনি তলার ছিটকিনিটা। ভেবেছিলাম গ্লাসটপ টেবিলটাকে ঠেলে দরজা আটকে শোব, তাঁকে সামান্য হিলাতেই তিনি যা ক্যাঁচোরম্যাচোর জুড়লেন, অগত্যা একখান নকল বেতের মোড়া ছিল, সেটাকেই দরজায় ঠেস দিয়ে, তার ওপর আমার পিট্টু ব্যাগটা চাপিয়ে ঘুমিয়েছিলাম সেরাতে। 


রাতই বা কোথায়? কয়েকটা তো ঘন্টা। স্নানাদি সেরে,তৈরিটৈরি হয়ে ব্যাগব্যাগেজ গুছিয়ে পাঁচটার মধ্যে ঢুকতে হয় কন্ট্রোল রুম। তার আগে ফোন করে ঘুম ভাঙাতে হয় ড্রাইভারের। তিনি দেরী করলেই মারা পড়ব যে। এমনিতেই একা শুতে বেশ গাছমছম করে,রোজই তাই টিউব জ্বালিয়ে শুই আমি, গতরাতে আবার তারই মধ্যে দরজায় ঠকঠক্। রাত এগারোটার সময় কে আবার দরজা পিটোয়। আবার দরজায় কোন পিপ হোলও নেই যে দেখব। অবশ্যি আমি চিরদিনই ডাকাবুকো, আর এরা সবাই ভালোমতই চেনে আমায়। তাই দিলাম দরজা খুলে। দরজার ওপারে সংকুচিত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে হোটেলের কর্মচারী, তাকে ঘিরে গোটা পাঁচেক কেন্দ্রীয় পুলিশের অস্ত্রধারী। উল্টোদিকের ঘরের অতিথির সাথে বাক্যালাপ রত। লোকটি হাত কচলে জানাল,পুলিশের রেড পড়েছে, ওণারা কিছু প্রশ্ন করেই চলে যাবেন, তারপর আর কেউ জ্বালাবে না আমায়। উর্দিধারীদের মাথা যদিও টুপি খুলে,সবিনয়ে ‘কোই নেহি জী। আপ শো যাইয়ে’ বলে আশ্বস্ত করে গেলেন, ঘুম আর এল না। 

এও ছিল কপালে, রাতবিরেতে হোটেলের ঘরে দরজা ধাক্কাবে পুলিশে। শৌভিকের কাছে সবটুকুই কৌতুকের ব্যাপার। আমার অনুযোগের প্রত্যুত্তরে আমোদে মাখোমাখো সুরে জানাল, ‘ভোটের আগের রাতে অমন হয়। ওখানে অনেক সময় পলিটিক্যাল পার্টির লোকজনও থাকে তো। আমার সময় অমুকের দলবল সারারাত এমন খোল করতাল পিটিয়েছিল যে রাতে ঘুমোতেই পারেনি। ’ 


ভোর চারটের অ্যালার্ম যখন বাজল, শিরায় উপশিরায় অসীম ক্লান্তি। এত সকালে তালা খোলে না হোটেলের সদর দরজার। অন্ধকার সিঁড়ি দিয়ে মালপত্র সহ হাতড়ে নেমে, করিডরে ঘুমিয়ে থাকা কর্মচারীকে ডেকে তুলে খোলাতে হয় দরজা। দরজার সামনেই গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন আমাদের সুবীর বাবু। আমায় নামিয়ে দিয়েই আবার বাড়ি চলে যান উনি। গিয়ে খানিক ঘুমিয়ে নটা নাগাদ আবার আসেন টিফিন তুলতে। আমার টিফিনটা রোজ উনিই পৌঁছিয়ে আসেন কন্ট্রোল রুমে। 


নতুন কালেক্টরেটের তিনতলার গতিধারা হলটাই আপাততঃ জেলা কন্ট্রোল রুম। দেওয়াল জুড়ে লাগানো গোটা বিশেক অতিকায় টিভি। যার মধ্যে আমাদের ভাগ্যে পড়ে নয় থেকে এগারোটা। প্রতিটি বিধানসভা ক্ষেত্রের জন্য বরাদ্দ একটি করে টিভি।  ইলেকশন কমিশনের নির্দেশ মোতাবেক দেড় থেকে দুই হাজার সংবেদনশীল বুথে লাগানো হয়েছে ক্যামেরা। পোল ডের আগের দিন সকাল থেকেই, ক্যামেরা গুলির লাইভ ফিড চলতে থাকে টিভিতে। 


আমাদের ডান পাশের টিভি গুলিতে চলতে থাকে নানা সংবাদ চ্যানেলগুলি। আর বাঁ পাশের টিভিতে পর্যবেক্ষণ করা হয় সেক্টর অফিসারদের গতিবিধি। ক্যামেরা লাগানোর কাজ শেষ হয়েছিল আগেই, গতরাতে অনেকক্ষণ থেকে, দেখে  গেছি আমরা, সব বুথ থেকে লাইভ ফিড আসছে কি না। একসাথে অবশ্য কখনই অনলাইন থাকে না সব ক্যামেরা। তবুও অফলাইনের অনুপাত যত কমানো যায় ততোই মঙ্গল। 


কাক না ডাকা ভোর থেকে বিএলটিপিদের ফোন করতে থাকি আমরা, ‘কি ব্যাপার তোমার অমুক বুথ কেন অফলাইন?’ কখনও বা ফোনে ধরা হয় প্রিসাইডিং অফিসারকে, ‘শুনুন না, আপনাদের ক্যামেরার ওপর থেকে কাপড়টা সরিয়ে দিন। ’ এই সমস্যা কেবল মহিলাবুথগুলির জন্যই নির্দিষ্ট। যেহেতু বুথেই রাত্রিবাস করেন ওণারা, তাই ক্যামেরার ওপর চাপা দিয়ে দেন কোন কাপড়। তাতে কিছু না,শুধু ভোর সাড়ে পাঁচটার মকপোলের আগে সরিয়ে দিলেই হল। সরাতে গিয়ে অনেক সময় বেঁকে যায় ক্যামেরা, উপড়ে যায় দেওয়াল থেকে। আবার ধরতে হয় টেকনিক্যাল পার্সনকে। তাকে না পেলে এজেন্সির সুপারভাইজার।  প্লিজ একটু দেখুন-। এই ফিড দেখতে পায় কলকাতর সিইও অফিস। দেখতে পায় দিল্লীর কমিশন। 


পুরুষ বুথে অবশ্য সে সমস্যা নেই। ঊর্ধাঙ্গ অনাবৃত করে রীতিমত স্ট্যালোন হয়ে ঘোরে লোকজন। ক্যামেরা সামনে দড়ি টাঙিয়ে শুকায় গামছা। পাশাপাশি ঘুমোয় পোলিং পার্সোনেল আর কেন্দ্রীয় বাহিনী। ভোট চলাকালীনও শুকায় গামছা আর লুঙ্গি। আহাঃ একটা দিনের তো ব্যাপার।  


গতিধারা হলের ডিজিট্যাল ঘড়িতে বাজে সকাল সাতটা। স্বস্তির নিঃশ্বাস বয় কন্ট্রোল রুম জুড়ে ভোট শুরু হয়ে গেছে। ক্যামেরার ফিড বলে দরজার বাইরে বিশাল লাইন এই সাতসকালেই। কেজো ফোনের পাশাপাশি ফোন করি আমার বুড়োকে, ‘ভোট দিতে যাবে না বাবা?’ দীর্ঘশ্বাস ফেলে জানায় বাবা, ‘ আর্যবালিকা স্কুল অবধি গিয়ে কি আর হেঁটে ফিরতে পারব? এবার ভাবছি দেবো না। ’ করোনার আবহে ভোট দিতে না যাওয়াই মঙ্গল, তবুও বড় মনখারাপ হয়ে যায়। জানি বৃদ্ধের ভোট দেবার কি তীব্র ইচ্ছে, ভোটের ফলাফল নিয়ে প্রতিনিয়ত কাটাছেঁড়া করে চলেছে যে মানুষটা, সে বয়ঃজনিত শারিরীক  অসমর্থতার কারণে ভোট দিতে পারবে না, ভাবতেই ব্যাথাতুর হয়ে ওঠে মন। 


কাপের ফেনার সাথে দুঃখ গিলে আবার ঘোরাতে হয় ফোন, করতে হয় মাতব্বরী। আপনার বুথে এত লোক ঢুকেছে কেন? লাইনটা প্লিজ বাইরে দেওয়ান। বা আপনার বুথের ইভিএম স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে যে, কম্পার্টমেন্টটা ঘুরিয়ে দিন একটু। বা একি আপনার এভিএমের পিছনের জানলা/দরজাটা খোলা নাকি? বন্ধ করুন শীঘ্র। প্রিসাইডিং অফিসারকে ফোনে না পেলে প্রথম পোলিং অফিসারকে। কখনও ধরেন, কখনও বা বেজে যায় ফোন, কখনও বা ঘুম চোখে ফোন ধরেন তাঁর স্ত্রী, ‘এই ফোনটা তো বাড়িতে রেখে গেছে- । ’ 


একান্তই কাউকে না পাওয়া গেলে তখন ধরতে হয় সেক্টর অফিসারকে। সেক্টর অফিসারদের তালিকা খুব মনযোগ দিয়ে দেখি আমি। আইএমডব্ল্যু দেখলে অদ্ভূত আপনভাবে ভরে ওঠে মন। এই তো আমার নিজের লোক।  ‘শুভঙ্কর ক্যামেরার সামনে গামছা শুকোচ্ছে বাবা। একটু সরিয়ে দিতে বলো প্লিজ।’ বেচারা শুভঙ্কর একবার ছেড়ে তিনবার ফোন করে, ‘সবকটা বুথ থেকেই গামছা সরিয়ে দিয়েছি ম্যাম। এবার দেখুন তো। ’ 


কখনও বা বলা হয়, ও মশাই বুথ ছেড়ে সবাই গেলেন কোথায়? ক্যামেরার সামনে ফোন হাতে এসে দাঁড়ান প্রিসাইডিং অফিসার, ‘আছি ম্যাডাম। আমি আছি। বাকিরা খেতে গেছে। ’ বেলা ঢলে বিকালের দিকে। লোক কমতে থাকে বুথে। অশক্ত বৃদ্ধ বাবা বা মাকে ধরে ধরে ভোট দিতে নিয়ে আসে পুত্র তথা পরিজন বর্গ। আসেন দৃষ্টিহীন ভোটার। এঁণাদের ভোট দেবার আগ্রহ দেখে ভরে ওঠে মন। এই না হলে আমার দেশ, বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র। এক ফাঁকে মেসেজ করে বাবা, ‘ভোট দিয়ে এলাম।’





Thursday 8 April 2021

ইতি বুজুর মা।

 ইতি বুজুর মা- ৮ই এপ্রিল, ২০২১


আজ খুব ইচ্ছে করছে, তোমাকে একটা চিঠি লিখি। কেন ইচ্ছে করছে জানি নে বাপু। তুমিই শিখিয়েছিলে, ‘ইচ্ছে হল এক ধরণের গঙ্গা ফড়িং, অনিচ্ছেতেও লাফায় খালি তিড়িংবিড়িং। 


 চিঠি লেখার নিয়মে প্রথমেই বোধহয় একটা সম্বোধন দিতে হয়। যেমন গুরুজন হলে পরম পূজনীয় বা শ্রীচরণকমলেষু ইত্যাদি। আর তোমার কন্যার ভাষায় ল্যাঘুজন হলে প্রিয়বরেষু বা প্রিয়তমেষু এই ধরণের কিছু বোধহয়। তবে এতবছর বাদে তোমায় প্রিয়তমেষু বলে সম্বোধন করলে, তুমি নির্ঘাত হোঃ হোঃ হোঃ করে অট্টহাস্য করবে। যেমন করো, তুমি আর তোমার বিশ্বপাকা মেয়েটা। আমার সবকিছুতেই কেন যে তোমরা এত খুঁত খুঁজে পাও, মানছি আমি হদ্দ কুঁড়ে,অলস, অলবড্ডে এবং তোমাদের তুলনায় বেশ খানিকটা নির্বোধ এমনকি হয়তো কিছুটা অগোছালো, অপরিষ্কারও। নাহয় তোমার মায়ের মত গৃহকর্মনিপুনা নই, তাই বলে বুঝি আমি এতই ফেলনা? 


শুধু ‘প্রিয় অমুক’ অবশ্যি লেখাই যায়, কিন্তু মুস্কিল হচ্ছে তোমার পোশাকী নামটা ধরে তো কোনদিনই তেমন ভাবে তোমায় ডাকিনি, তাই ঐ প্রিয় অমুক লিখতে গেলে শেষে বাবু জুড়ে বসব নির্ঘাত, জানোই তো আমি কতটা সেকেলে। আমি যে তোমার অচল পয়সা।  ব্যাপারখানা কেমন যেন পরপুরুষকে চিঠি লেখার মত হয়ে যাবে। তাতে পূব-পশ্চিম রাগ- অনুরাগ থাকতে পারে বটে, কিন্তু তোমার-আমার এই সুখী দাম্পত্য, আমাদের খুচরো অভাব, তুচ্ছ হীনমণ্যতা, আমাদের সামান্য মনখারাপ, আমাদের সামান্য পিছিয়ে পড়া, ছাপোষা লড়াই, আমাদের তেল নুন লকড়ির গল্প তো করা যাবে না।


আর আমি তোমার সাথে গল্পই তো করতে চাই। হোয়াটস্অ্যাপে লাইভ লোকেশন পাঠিয়ে, ‘বাড়ি ফিরছি’ নয়, আমি তোমার সাথে বলতে চাই অনেক অনেক কথা। চিৎপুর মার্কা ভালোবাসায় জবজবে সেই সমস্ত কথায় থাকব শুধু তুমি আর আমি। জানাতে চাই, ঠিক কখন, কখন, ঠিক কতবার অনুভব করেছি, তোমার মত  আর কেউ নেই। তোমর থেকে ভলো আর কেউ হতে পারে না।  শুধু একটাই অনুরোধ, অনুভূতিটা অনুভব করো, দয়া করে বানান ভুল ধরতে বসো না। তোমর কখনও মনে হয়েছে কিনা জানি না, আমার প্রায়ই মনে হয় বড় বেশী বাবা-মা হয়ে পড়ছি আমরা, সব সময়েই আমাদের মধ্যে বিরাজ করে তৃতীয়া কোন ব্যক্তি। সব শেষে জীবনের রঙ্গমঞ্চে প্রবেশ করেও সবথেকে বেশী গুরুত্ব পায় সে। হ্যাঁগা তুমি তাকে আমার থেকে বেশী ভালোবাসো না তো? মাঝে মাঝে তাকে বকাঝকা বা ঠ্যাঙানোর পর যেভাবে কালো হয়ে থাকে তোমার মুখ,দেখে রীতিমত কেঁপে উঠি আমি। মা হিসেবে সন্তানকে সুশিক্ষা দেবার দায়িত্ব যে মুখপোড়া সমাজ চাপিয়েছে আমার কাঁধে, খারাপ হলেই বলবে আমার মেয়ে, আর ভালো হলেই, তোমার আর তোমাদের বাড়ির মেয়ে  কিনা। 


আমি তোমায় সোহাগ করে যে নামে ডাকি, সেই নামে অবশ্যি সম্বোধন করতেই পারি, কিন্তু সেই নামটা যে আমার সমস্ত কিছুর পাসওয়ার্ড। চিঠি বেহাত হলেই যে বিপদগ্রস্ত হব।  অবশ্যি তুমি সবই জানো, আমার সমস্ত পাসওয়ার্ড, যাবতীয় পিন, আমার তুচ্ছ উপার্জন ইত্যাদি প্রভৃতি- কোনকিছুই তোমার অজ্ঞাত নয়। তোমার ডেবিট আর ক্রেডিট কার্ডের পিন ছাড়া বাকি কোন কিছু অবশ্য লুকিয়ে রাখো না তুমিও। চুপি চুপি তোমায় বলি,ঠিকই করো।  আমার খরচপাতির হিসেবটা তো তুমি জানো না মশাই। তুমি আমায় যতই চোখবন্ধ করে বিশ্বাস করো না কেন, আজ স্বীকার করছি, অনেককিছু বেমালুম চেপে যাই আমি। মানে টুকটাক কেনাকাটার গপ্প। ভয় পাই, জানতে পারলে যদি কুরুক্ষেত্র করো তুমি, সামনাসামনি স্বীকার না করলেও বড় ভয় পাই তোমায়। ধরা পড়লেও তুমি অবশ্য কিছুই বলো না, বড়জোর বলো, ‘বড় বাজে খরচা করো/করিস। মনমর্জি মোতাবেক কখনও তুমি কখনও তুই বলো তুমি। আমিও তাই বলি।  পরিস্থিতির  তাপমাত্রা অনুযায়ী নির্ধারিত হয় আমাদের সম্বোধন। 


বড় বাজে বকছি।পশ্চিমের মরা চাঁদ এবার বুঝি হেলে পড়বে পূবে। ঘুমোতে যেতে হবে এবার, কাল আবার একখান কর্মব্যস্ত দিন। বলার ছিল কতই কথা, বলতে পারলাম কই? বলতে চেয়েছিলাম যা তা মৌখিক ভাবেও হয়তো বলেছি অনেকবার। বলছি কি না, তুমি ভালো থেকো গো। তুমি ভালো থাকলেই ভালো থাকব আমি আর ঐ ছোট্ট লোকটা।।  দেখো আবার তার কথা তুললাম। বলেছিলাম না বড় বেশী বাবা-মা হয়ে গেছি আমরা। 


ইতি

বুজুর মা। 

পুনশ্চঃ-ধ্যাৎ তেরি।

Monday 5 April 2021

ইতি তোমার মা-

 ইতি তোমার মা- ৫ই এপ্রিল, ২০২১


প্রিয় বুকু,

কি করছ? আজ ভীষণ ইচ্ছে করছে তোমায় একটা চিঠি লিখি। আমরা যত মেসেজে দড় হচ্ছি, ততোই ভূলে যাচ্ছি চিঠি লিখতে। আমরা কথা বলছি, সারাদিন কথা বলছি, তবুও ঠিক সম্পূর্ণ হচ্ছে না ভাবের আদানপ্রদান। অনেকদিন অভ্যেস নেই তো, জানি না কেমন লিখব, ভূলত্রুটি হলে মার্জনা করো। 


আজ তোমার জন্য একটু বেশীই মন খারাপ করছে কি না, তাই ভাবলাম তোমায় একটা চিঠিই লিখি। যেমন লিখে,সেঁটে রেখে যেতাম ফ্রিজের গায়ে। তুমি তখন আরও অনেক অনেকটা ছোট। সকালের স্কুলে পড়ো। ভোর ভোর তোমায় ঘুম থেকে তুলে, একরাশ মনোবেদনা সহ ছেড়ে আসতাম স্কুলের গেটে। ভারি ব্যাগটা পিঠে নিয়ে প্রবল অনিচ্ছা আর অপরিসীম ক্লান্তি নিয়ে এগিয়ে যেতে যেতে একবার পিছন ফিরে তাকাতে তুমি, আমি হাত নেড়ে ইশারায় বলতাম এগিয়ে যাও। মাথা নীচু করে, মাটিতে পা ঘষতে, ঘষতে এগিয়ে যেতে তুমি। এরপর তোমার সাথে দেখা হতে-হতে সন্ধ্যা ঢলে পড়ত রাতের পথে।  


অধিকাংশ রাতেই তোমাতে পড়তে বসানো নিয়ে বাঁধত অশান্তি। দুচার ঘা উত্তমমধ্যম খেয়েই যেতে তুমি। সকাল হলে তোমায় স্কুলের গেটে ছেড়ে আসার সাথে-সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকত মনস্তাপ। প্রতিটি সকালে আমি নতুন নতুন করে উপলব্ধি করতাম,কতটা, ঠিক কতটা বদলে দিয়েছ তুমি আমায়। বদলে দিয়েছ জীবন তথা সম্পর্কের যাবতীয় সংজ্ঞা। বেশি শক্ত হয়ে গেল বুঝি, সহজ করে বলতে গেলে, বুঝতে পারতাম আমার জীবনের কতটা জুড়ে একচ্ছত্র রাজত্ব করো তুমি। অথচ রাতে ফিরে তোমায় পড়াতে বসালেই কিভাবে যেন কর্পূরের মত উবে যেত সারাদিন ধরে লালন করা যাবতীয় সুকুমার অনুভূতিগুলো। তাই আঁধার নামার আগেই লিখে রাখতাম চিঠিগুলো। 


মনে মনে ভাবতাম অনেককিছুই, লিখতে পারতাম থোড়াই। আর লিখে ফেললেই বা কি হত? না তুমি ভালো করে পড়তে পারতে বাংলা, না ইংরেজি। মনে আছে, বাবা তোমাকে ক্ষেপাতে বলত, ‘তুই অশিক্ষিত, তাই তোর আধারকার্ড হবে না। ’ একেবারে অশিক্ষিত না হলেও সদ্যস্বাক্ষর তো ছিলেই তুমি। তাই দুচারখানা মনের কথা লিখেই আঁকতে বসতাম ছবি। পড়তে না পারলেও ছবির ভাষা তুমি দিব্যি বুঝতে। হয়তো সব শিশুই বোঝে। ভালো তো আঁকতে পারি না,তবুও একটা যে কোন পশুর ছবি এঁকে, তার চোখ থেকে টপটপ করে ঝরে পড়া জলকণার ছবি আঁকলেই তুমি বুঝতে পারতে মায়ের মনে ঘনিয়েছে ঘোর কৃষ্ণ মেঘের ঘনঘটা। আপিস থেকে ফিরে হতভম্ব হয়ে দেখতাম, পাশে কচি কচি হাতে আঁকা ঐ পশুটিরই একটি শাবক। তারও মনে জমেছে মেঘ, তারও উছলে উঠেছে ছলোছলো আঁখি। মমির মন খারাপ, তাই বেবিটারও মন খারাপ বোঝাতে চাইতে তুমি। 


কখনও বা একটা বড় ফুল/পাখি বা বিড়ালের পাশে আরেকটা ছোট্ট ফুল/পাখি/বিড়াল এঁকে উভয়ের মাঝে একটা পুঁচকে পানপাতা এঁকে রেখে যেতাম। তুমি উভয়ের আসেপাশে এঁকে রাখতে আরো অনেক অনেক পানপাতা। বেবিটাও যে মাকে ভীষণ ভালোবাসে। কখনও কখনও তুমি খাতার পাতার কোণা ছিঁড়ে এঁকে রাখতে তিনটে বিভিন্ন মাপের পুঁচকে হাসিখুশি মুখ। তারপর উপহার দিতে আমাদের। উপহার পছন্দ হয়েছে কিনা জানার জন্য লোভাতুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে আমাদের মুখের পানে।


জানিনা তোমার মনে আছে কিনা, কিন্তু এমন প্রতিটা চিরকূট, প্রতিটি চিঠি যত্ন করে গুছিয়ে রাখতে বলতাম আমি। কারণ এই সমস্ত চিঠির আঁকিবুকি, সমস্ত ছবির বাঁকে লুকিয়ে আছে তোমার অমূল্য শৈশব। পুতগন্ধময় e-জগতের বাইরে তোমার একেবারে নিজস্ব মোমরঙের দুনিয়া। 


এই দেখো লিখতে বসেছিলাম আমার কথা, আমার বর্তমান পরিস্থিতি, আমার ভালো লাগা না লাগার কথা, অথচ লিখে চলেছি তোমার,শুধু তোমার কথা। মা হবার এটাই সবথেকে বড় যাতনা। জীবনটাই যে আবর্তিত হয় তোমাকে ঘিরে। তুমি হলে আমার সূর্য, আর আমি তোমার বুড়ো পৃথিবী। 


ইতি

তোমার মা।

Saturday 6 March 2021

অনির ডাইরি মার্চ, ২০২১


অনির ডাইরি ৩০শে মার্চ, ২০২১


পাঁচশ বছরেরও বেশী পুরাণ শহরটায় যখন ঢুকলাম, তন্বী সন্ধ্যা ততোক্ষণে পা বাড়িয়েছে গভীর রাতের পানে। কাঁধে মাথা রেখে গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন তুত্তুরী। দোলে ফিরে আসছি নিজের শহরে, প্রতিবারই শহরে প্রবেশের সাথে সাথে উদ্দাম আনন্দের পাশাপাশি এক অজানা আশঙ্কায় মৃদু কেঁপে ওঠে হৃদয়, কতদিন, আর ঠিক কতদিন বাঁধা থাকবে এই গাঁটছড়া? এমনি সজীব থাকবে সম্পর্কের শেকড়বাকড় গুলো? প্রতিটি পল অনুপলে কেমন যেন একটু একটু করে বুড়িয়ে যাচ্ছে, চেনা মানুষগুলো। একটু একটু করে মুছে যাচ্ছে সোনালী অতীত, আলগা হয়ে আসছে আশৈশব লালিত বাঁধন। 


কোণা এক্সপ্রেস ওয়ে বরাবর ছুটে আসা গাড়িটা আচমকা বেলেপোল থেকে ধরে নিল বাঁদিকের সরণি। তু্ত্তুরীর মুখ আর মাথা আবৃত পুরু আবিরে। গাড়ি ছোটে, পেরিয়ে যায় ৫২র চৌরাস্তা,পেরিয়ে যায় পুরাণ ইছাপুর রোড, ইছাপুর জলট্যাঙ্কের কাছে ক্ষুদিরামের মূর্তিকে ডানহাতে রেখে কদমতলা বাজারের দিকে বেঁকে যাই আমরা। পথে গমগমে ভিড় কিছুক্ষণ রেস্তোরাঁয়, এই অঞ্চলে কত যে রেস্তোরাঁ  খুলল আর বন্ধ হল, কিছুক্ষণের জনপ্রিয়তায় ভাঁটা পড়েনি তিলমাত্র। খাবার যে অনবদ্য তা নয়, তবে সুস্বাদু এবং বেশ সস্তা। কতবার যে আমি,চৈ, সঞ্চিতা আর দেবারতি এখানে নৈশাহার সেরে, রাত এগারোটা নাগাদ হাঁটতে হাঁটতে বাড়ি ফিরেছি। কি নিরাপদ ছিল আমাদের জনপদটা, হয়তো এখনও তাই আছে, তবে আমরা একটু বেশীই বেপরোয়া ছিলামও বটে। অন্তত মায়ের তাই অভিমত, হোটেলওয়ালারা, এবার ওঠ মামণি, তালা মারব মার্কা কিছু বলে ঠেলে না তুললে আমরা  উঠতাম থোড়াই? বকেই যেতাম, কি যে এত কথা জমে থাকত আমাদের। তবে মাঝেমধ্যেই এসে ঢুঁ মারতেন রবি ঠাকুর। দেবা থাকবে আর দাড়ি বুড়ো থাকবে না? 


পাওয়ার হাউসের মোড় থেকে ডানদিকে বেঁকে বাবাকে ফোন করলাম, একটু আসতে পারবে কি। টুকটুক করে জমেছে অনেকগুলো প্যাকেট। মাত্র চারবেলার জন্য পিত্রালয়ে আসাটাও যে কি ঝঞ্ঝাট, ব্যাগ ভর্তি করার আগে খালি করতে হয় ঠাণ্ডা আলমারি। এই করতে গিয়ে আবিষ্কৃত হয়, তিন টুকরো মাছ,বেশ খানিকটা ফুলকপি, শুঁটকো মটরশুঁটি, গুচ্ছ খানেক পটল, আধখানা ঢেপসা বেগুন, গুটি কয় উচ্ছে, একছড়া নিমপাতা, এক প্যাকেট বিনস্, গুটি চারেক পাতিলেবু, গাদাগাদা টমেটো আর শশা। এতকিছু থাকা সত্ত্বেও প্রতি সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে দেখি মাসির চিন্তান্বিত বদন, ‘রাতে যে কি তরকারি করি? সব্জি তো কিছুই নেই।’ গোটা সব্জিপাতি শাশুড়ী মাকে গছিয়ে, আধকাটা  ফুলকপি আর শুঁটকো মটরশুঁটি দিয়ে খিচুড়ি আর পটলের বড়া করে খেয়ে এবং খাইয়ে তথা টিফিন দিয়ে বেরিয়েছি। আর এককৌটো ভর্তি খিচুড়ি ঠাণ্ডা আলমারিতে না তুলে ডাইনিং টেবিলে ফেলে রেখেই চলে এসেছি। অতখানি গোবিন্দভোগ চাল আর সোনামুগের ডালের খিচুড়ি, তারওপর ছড়ানো হয়েছে অপরিমিত গব্য ঘৃত, কেন যে তুলে এলাম না? গৃহকর্তা বাড়ি ফিরবেন রাত দশটা নাগাদ, এই পচা গরমে ততোক্ষণে কি আর তা অবশিষ্ট থাকবে? যত বলছি, বাড়ি ফিরে ফেলে দিও, শৌভিক ততোবারই ভয় দেখাচ্ছে, ওটাই খাবে। তবে আজ রাতে নয়, ইতিমধ্যেই দুবার খিচুড়ি খাওয়া হয়ে গেছে। ওটা কাল সকালে খেয়ে আপিস যাবেন বাবু। সাধে কি তুত্তুরী মাঝেমাঝেই, “ঠাম্মার ছেলে বাবা” বলে আদর করে? শৌভিক যথার্থই অতসী দেবীর পুত্র। না শাশুড়ি মা একদানা খাদ্য নষ্ট করেন, না তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র।  


গলির মুখে এসে থামল গাড়ি। দুহাতে চারটে ব্যাগ নিয়ে আমরা দাঁড়িয়ে আছি, বাবার জন্য। বৃদ্ধ বলেছে, ‘বুড়ো হয়ে গেছি কিনা, অত তাড়াতাড়ি তো আর হাঁটতে পারি না, তোমরা কিন্তু দাঁড়াবে। চলে আসবে না। ’ আমার হাতে আর তুত্তুরীর পিঠের ব্যাগ ছাড়াও রয়েছে গোটা চারেক প্লাস্টিকের ব্যাগ। কাগজের ঠোঙার বদলে যখন সদ্য আসতে শুরু করল এই ব্যাগগুলো, আমরা বলতাম চিকচিকে। আজকাল আর কেউ বলে না বোধহয়। স্বকীয়তা ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে শহরটার। আসল জেল্লা খুইয়ে, কেমনি যেন গিল্টিকরা ফ্যাশনদুরস্ত হয়ে উঠছে আমার শহর। 


বৃদ্ধের হাঁটুর যা অবস্থা, পাঁপড় ভাজার মত মচমচ করে, জোর কমেছে ফুসফুসেরও। আজকাল দু কিলো মালও বইতে পারে না বাবা। রিক্সায় বসে থেকে রিক্সাওয়ালাকে পাঠায় মাল সমেত বাড়ি, হয়তো কমেছে ক্ষয়েছে অনেককিছুই, তবে তিলমাত্র টসকায়নি মনের জোর আর বিক্রম। বুড়ো হলেও রীতিমত রয়াল বেঙ্গল হয়ে ঘুরে বেড়ায় বাবা। গলার শির ফুলিয়ে ঝগড়া করে মায়ের সাথে, সেই জন্যই ডেকে আনা, তুত্তুরীর যা অবস্থা, এইমেয়েকে শ্যাম্পু করাতেই হবে, আর এতরাতে মেয়েকে স্নান তথা শ্যাম্পু করাতে হবে বললেই পত্রপাঠ বিদায় করে দিতে পারে মা। ভুল বললাম, তুত্তুরীকে কেড়ে নিয়ে আমায় বিতাড়নই করবে মা। এই বৃদ্ধের সক্রিয় সমর্থন তাই আমার বড় প্রয়োজন। এত তাড়াতাড়ি তাড়িয়ে দিলে হবে? এখনও তো বাকি কতকিছু, দোলের আগের রাতে পোড়াতে হবে ন্যাড়া, রাত বারোটায় করতে হবে ফিস্টি, দোলের দিনের উদ্দাম রঙ খেলা আর রাতে আমাদের ভাঙ পার্টি। উৎসব থেকে উৎসবেই তো বেঁচে থাকি আমি, যতটা না ভালো থাকি আর তারথেকেও ভালো রাখি আসেপাশের মানুষগুলোকে। এবারেও হবে, সব হবে, আগে তো বৃদ্ধার প্রকোপ থেকে বাঁচি।



অনির ডাইরি ২৯শে মার্চ, ২০২১


মায়ের রান্নাঘরের জানলার বাইরে পূর্ণ মহিমায় বিকশিত দোল পূর্ণিমার চাঁদ। কি যেন বলেছিল চৈতালী, সবথেকে বড়,সবথেকে মাদক মাখানো চাঁদ ওঠে এই বসন্তপূর্ণিমার রাতে। সিদ্ধির নেশায় হাল্কা আচ্ছন্ন তখন আমাদের মন আর মাথা। নিঝুম বসন্তপূর্ণিমার রাতে চৈতালীদের বাড়ির গলি বেয়ে রাজপথের দিকে হাঁটছিলাম আমরা তিনজনা, চৈ, অন্তু আর আমি। গলির প্রতিটি বাঁকে ধাক্কা খাচ্ছিলাম পূর্ণ চন্দ্রের সাথে, পাল্লা দিয়ে চড়ছিল ঝিমঝিমানি। প্রতিটি পদক্ষেপে, মনে হচ্ছিল, কি অসম্ভব সুখী আমরা, এই পুতিগন্ধময় অবহেলার কুলি টাউনেও প্রকৃতি উজাড় করে দিয়েছে তার রূপের ডালি, শুধু, শুধু আমাদেরই জন্য। শিরায় শিরায় ছড়িয়ে পড়ছিল অসীম,অপরিসীম সুখ- 


এই তো গত পরশুই এসে হাজির হয়েছিলাম অর্ধ সহস্রাব্দী পেরোনো বুড়ো শহরটায়। প্রগাঢ় সন্ধ্যা তখন পা বাড়িয়েছে পূর্ণ রাতের দিকে।  নামানো কাঁচের বাইরে থেকে ছুটে আসা দামাল বাসন্তী হাওয়ায় মাখামাখি ফাগের সুবাস। কোথা থেকে যেন ভেসে আসছে মৃদু কাঁসরঘন্টার ধ্বনি। কাঁধে মাথা রেখে অকাতরে ঘুমাচ্ছে তুত্তুরী। বড় পরিশ্রান্ত বেচারী,সেই কোন সকালে আপিস টাইমে দুটো নাকেমুখে গুঁজে আপিসে ছুটেছিল মেয়েটা। আপিসটা অবশ্য আমার, তবুও-। 


কি ভূতভূতে করে রঙ মেখেছে মেয়েটা। মাথা,গাল, গলা গাঢ় লাল গোলাপী বেগুনী আবিরে মাখামাখি। অবশ্য যত না মেখেছে, মাখিয়েছে তার পাঁচ গুণ। বলাগড়ের শ্যামলের কালো চুল আর সাদা পাঞ্জাবি লাল-সবুজ মাখামাখি, সৌজন্য আমার, ঝুমার এবং মাম্পির দুহিতা। আমাদের থেকে ঢের সকালে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল ছেলেটা, দুধসাদা পাঞ্জাবি পরে, সাথে ব্যাগ ভর্তি করে এনেছিল ঘরে ভাজা মুড়ি, বাগানের নারকেল, ঝুরি ভাজা, চিনে বাদাম এমনকি একটা ছোট্ট প্লাস্টিকে মুড়ে খানিক ঘানি ভাঙা সর্ষের তেল। আপিসে এসে মুড়ি মাখবে বলে। এমনি করে ছেলেটা, শ্যামল আসা মানেই জম্পেশ করে মুড়ি মাখা। শুধু মুড়ি মাখার জন্যই একটা বড় স্টিলের গামলা কিনে আপিসে রেখে গেছে শ্যামল। পথে কোন দোকান থেকে কিনে এনেছিল রসগোল্লা আর পান্তুয়া। আর এনেছিল ফুল। পলাশের বায়না জুড়েছিল মেয়েরা। পলাশ পায়নি বলে, রাজ্যের হলুদ, লাল ফুল ব্যাগ ভর্তি করে এনেছিল ছেলেটা। যার মধ্যে খানিক হলুদ ফুল আর একখান শুঁটকো গোলাপ তুত্তুরীর মাথায় আটকে দিয়েছিল প্রিয়াঙ্কা। দশ কেজি লাল আবির আনবে বলেও ভয় দেখাচ্ছিল শ্যামল কয়েকদিন ধরে, সেটা যা হোক বলে কয়ে নিরস্ত করা গেছে।


 আমার সাতটা শ্রমিক কল্যাণ কেন্দ্রের প্রতিটি থেকে আসা এজেন্ট আর এসএলওদের বলা হয়েছিল একটা আলাদা রঙের আবির আনতে। যার যা মন চায়, নিয়ে আসুক সেই রঙ। বলাগড় বেছেছিল লাল, সেই হেতু লাল আবির। 


শুধু শ্যামল নয়, সবাইকেই কমবেশী রঙ মাখিয়েছে তুত্তুরী, মায়ের আপিস বলে,একটু বেশীই গুণ্ডামি করে মেয়েটা। আমার অসাক্ষাতে মৃদু শাসনও করে টুকটাক লোকজনকে। এবারের বসন্তোৎসবের জন্য রীতিমত দিন গুণছিল মেয়েটা।  এত আগ্রহের দুটি কারণ, প্রথমতঃ মায়ের নতুন ম্যাডামকে দেখবে আর দ্বিতীয় সিকনি আর লস্যি খাবে। নতুন ম্যাডামকে মা কেন যে, ‘দিদি,তুমি’ বলে সম্বোধন করে এটা নিয়ে অসীম কৌতুহল তুত্তুরীর। আগের উপরওয়ালাদের তুত্তুরী মামা এবং তুমি বললেও, মা তো,‘স্যার, আপনি’ বলেই সম্বোধন করত বরাবর। প্রশ্ন করলে মা বলে, ম্যাডামের সাথে পরিচিতি তো আজ নয়, প্রায় একযুগ আগে। উনিই বলেছেন, রাতারাতি সম্বোধন বদল করার কোন প্রয়োজন নেই।  


মঠ ফুটকড়াইয়ের পাশাপাশি সিকনি অর্থাৎ সিন্নির প্রস্তাবটা ছিল আদতে আমারই, পরে লস্যিটা জুড়েছে ঝুমার আব্দারে। বর্মন সাহেব খানিক ঘেঁটে গিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন, ‘সিন্নি হবে মানে? আপিসে সত্যনারায়ণ করবেন?’ না না, পুজো আচ্ছা নয়, শুধু সিকনি থুড়ি সিন্নি মাখা। কে মাখবে সিকনি, ইয়ে মানে সিন্নি? কেন মগরার প্রিয়াঙ্কা আছে না। সবেতেই ঝাঁপিয়ে পড়ে প্রিয়াঙ্কা। রমেশ আর প্রিয়াঙ্কাকে নিয়ে মোটামুটি যুদ্ধ জেতা যায়, এদের অপরিসীম উৎসাহ আর উদ্দীপনা মাঝে মাঝে আমাকেও লজ্জায় ফেলে। শেষ পর্যন্ত অবশ্য লস্যি বানিয়েই ক্ষান্ত হল প্রিয়াঙ্কা। সিন্নি মাখা মোটেই সেদিনের ছুকরির কাম না। তারজন্য দরকার পাকা গৃহিণী। 


লস্যিটা অবশ্য বড় দরদ দিয়ে বানিয়েছিল মেয়েটা। বাড়ি থেকে বয়ে আনা স্টিলের হাঁড়িতে কোন খাটাল থেকে কিনে আনা মোষের দুধের দইয়ের সাথে মাদার ডেয়ারির দই মিশিয়ে সামান্য চিনি আর নুন দিয়ে ডাল ঘুটনি দিয়ে অনেকক্ষণ ধরে ঘটঘট করে যে বস্তটি তৈরী হল,সেটা এক্কেরে অমৃত। প্রিয়াঙ্কা অবশ্য তাতে লেবুর রস, বিট লবণ আর জলজিরা মেশাবে বলে উঠে পড়ে লেগেছিল, শেষ পর্যন্ত বড় ম্যাডামের হস্তক্ষেপে তাকে নিরস্ত করা গেল। 


সিকনি থুড়ি সিন্নি মাখল আমাদের বাঁশবেড়িয়ায় এজেন্ট নূপুরদি। পেশায় নূপুরদি অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী।   আরও দুই অঙ্গওয়াড়ি দিদি, আমাদের পোলবার দেবী দি আর মিঠুদির সক্রিয় সহযোগিতায় সিন্নিটা দাঁড়ালো পুরো অমৃত। ওপর থেকে পাকা গৃহিণীরা আলতো হাতে ছড়িয়ে দিল কুচানো আপেল, বেদানার দানা আর ভাঙা কাজু। কাগজের বাটিতে ঘন ক্ষীরের মত সিন্নি মাখা, হাতে তুলে দেবার সময়, মিঠুদি লাজুক হেসে বললেন, ‘আপনি আমাদের মনে রেখেছেন ম্যাডাম, এতেই আমরা খুশি। ’ 


 আবিরে মাখামাখি আমারও মুখ আর মাখা। হাল্কা ঝেড়েছি বটে, তবুও টুপটাপ করে ঝরে পড়ছে রঙীন ফাগ, রাঙিয়ে দিয়ে যাচ্ছে সাধের কাঁচা হলুদ রঙা তাঁত। ওণার বিগলিত মিষ্টি হাসিটা দেখতে দেখতে সামান্য ব্যথা করে উঠল গলার কাছটা, চুঁচুড়ায় এটা আমার এবং তুত্তুরীর শেষ বসন্তোৎসব। পেশাগত ভাবে পরিযায়ী পাখি আমরা, কবেই ঘোষিত হয়েছে বদলীর হুকুমনামা। কার্যকর হয়নি শুধুমাত্র নির্বাচনী নির্ঘন্ট হেতু। সময় হয়ে আসছে, অনেকদিন তো হল এবার গুটাতে হবে পাততাড়ি। না হয় চলেই যাব, রেখে যাব অগুনতি সুখস্মৃতি আর নিয়ে যাব অনেক অনেকটা ভালোবাসা।


অনির ডাইরি ১৪ই মার্চ,২০২১


অচেনা কলরবে চমকে উঠলাম আমরা। সচকিত হয়ে তাকিয়ে দেখি গটগট করে হেঁটে যাচ্ছেন এক প্রৌঢ়, পরণে গোলাপী টি শার্ট আর নীল ট্রাউজার। পিছন পিছন রীতিমত ভিখারিনীর মত দৌড়াচ্ছেন প্রৌঢ়া, কণ্ঠে কাতর কাকুতি মিনতি, ‘ওগো যেও না। ওগো যেও না। ওগো একটু দাঁড়াও-’। হতভম্বের মত তাকিয়ে ছিলাম শ্বশুরমশাই আর আমি। সময় সকাল নটা। আজকের আবহাওয়াটা বেশ মনোরম, নরম সোনালী আদুরে একটা রোদ ক্রমেই ছায়া মেলছে ধুলিমলিন মহানগরের ওপর। গরম তেমন নেই, বরং একটা বেশ মনোরম ঠাণ্ডা হাওয়ার ঘুর্ণি মাঝে মাঝেই পাক দিয়ে উঠছে শহরটার বুক জুড়ে। ‘এমন বসন্ত দিনে, বাড়ি ফিরি মাংস কিনে’ না করে লং ড্রাইভে যেতে পারলে সবথেকে ভালো হত। ড্রাইভেই অবশ্য বেরিয়েছি আমরা, গন্তব্য শহরের এক প্রসিদ্ধ নার্সিংহোম।  


কি যেন একটা স্ক্যান করতে বলেছে ডাক্তার। তাতে সময় লাগবে ঘন্টা পাঁচেক। ভোর ভোরই বেরিয়ে এসেছি আমরা, রাস্তা পেরিয়ে কোণাকুণি দুচার পা হাঁটলেই হাসপাতাল থুড়ি নার্সিংহোম, কিন্তু ঐ টুকু পথও হেঁটে অতিক্রম করা দুঃসাধ্য শ্বশুরমশাইয়ের পক্ষে। বিগত কয়েকদিনের ঘুষঘুষে জ্বর,শ্বাসকষ্ট আর হাই ডোজের অ্যান্টিবায়োটিকের সম্মিলিত দৌরাত্ম্যে বেশ কাহিল বৃদ্ধ। গাড়ি থেকে নেমে, হাসপাতালের সামনের কেয়ারি করা বাঁধানো বাগানে বসে আছি দুজনে। শ্বশুরমশাইয়ের হাতে ফ্রুট জুসের বোতল, তাতে মেশানো আছে ওষুধ। একঘন্টা ধরে ঢুকঢুক করে খেতে হবে সবটা। তারপরও বসে থাকতে হবে পাক্কা একটি ঘন্টা, তারপর নিয়ে যাওয়া হবে স্ক্যান করতে। হাতকাটা সোয়েটার,মাথায় উলের টুপি পরে এসেছিলেন বাবা, এখন আবার গায়ে জড়িয়েছেন একটা খাদির মোটা চাদর। বাগান থেকে উঠে আসা বাসন্তী হাওয়ায় কিঞ্চিৎ  নাজেহাল বৃদ্ধ, আমি খুলে বসেছি একখান বই, সবকিছুই চলছিল বেশ জম্পেশ আচমকা এই হট্টোগোল। 


গোলাপী টি শার্ট এখন মুখের মাস্ক খুলে প্রবল চিৎকার করছেন প্রৌঢ়ার ওপর। রাস্তার ফুটপাতে দাঁড়িয়ে জমে উঠেছে রীতিমত নাটক। ফুটপাথের লাগোয়া স্বল্প উঁচু পাঁচিলের এপাশে, সুদৃশ্য বাগানে বসে বই বন্ধ করে হাঁ করে তাকিয়ে আছি আমি। কি ব্যাপার জানি না, তবে বাজে লাগছে খুব। এমন কি ব্যাপার হল যে এইভাবে নিজের স্ত্রীকে জনসমক্ষে অপমান করছে লোকটা। পাশ থেকে শ্বশুরমশাইও বললেন, ‘ছিঃ। কি সব মানুষ। ’ ভিড় জমে গেছে দম্পতিকে ঘিরে। ফুটপাথ বরাবর একটু এগিয়ে দৃষ্টির আড়ালে চলে গেছেন ওণারা,কিন্তু কানে এখনও আসছে উত্তপ্ত বাদানুবাদ। আর কতক্ষণ ঝগড়া করবে এরা? একটা লোকের মাথা ঠাণ্ডা হতে কত সময় লাগে? 

ভদ্রমহিলার জন্য মনের মধ্যে পাক খেয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে এক অদ্ভূত খারাপ লাগা। কেমন ভিখারিনীর মত কাকুতি-মিনতি করছিলেন উনি। হয়তো ডাক্তার দেখাতে এনেছিলেন স্বামীকে, এই হাসপাতালটা এমনি মন্দ না, তবে মাঝেমাঝে বড় ঝোলায়। শৌভিকের মত ঠাণ্ডা মাথার ছেলে বা উমার মত শান্ত মেয়েও একাধিকবার রেগে গেছে এদের ওপর। বাড়ির কাছে আর সবরকম টেস্ট হয় এই যা সুবিধা। 


হট্টোগোল ক্রমশঃ বাড়ছে। যারা ভিড় জমিয়েছিল দম্পতিকে ঘিরে, বুঝলাম সবাই একই পরিবারের সদস্য। এখন এক প্রৌঢ়া প্রচুর চিৎকার করছেন, বাগানের গেটের সামনে এসে। এক সিকিওরিটি আর একমহিলা গ্রুপ ডি স্টাফকে হাতপা নেড়ে ভয় দেখাচ্ছেন, ‘তোমাদের আমি দেখে নেবো। দেখ আমি কি করি-’। ট্রেনড স্টাফ এদের,রোজই চারটে লোক অমন ভয় দেখায়, তাই বোধহয় ভাবলেশহীন মুখে নিজের কাজ করে যাচ্ছে দুজনে। খুব ইচ্ছে করছে মহিলা স্টাফটাকে জিজ্ঞাসা করি, ‘ব্যাপারখানা কি?’ পারছি না শুধু পাশে বসে থাকা চাদর জড়ানো বৃদ্ধের জন্য। এমনিতে থিরথির করে কাঁপছেন, তবুও যা বিক্রম, যদি ধমকে দেন-


শৌচাগারে যেতে নিষেধ করছিল ওরা, শরীরে ফ্লুইডটা থাকলে নাকি রিডিং ভালো আসে। হেসে ফেললাম, সত্তরোর্ধ্বো কোন পুরুষকে এতটা জল খাইয়ে ওমন চেপে বসে থাকতে বলছে- এদের বুকের পাটা আছে বলতে হবে। অবশেষে রাজি হয়েছে ওরা, ‘একবার যাবেন কেমন-’। একবারই গেছেন শ্বশুরমশাই, শৌচাগার অদূরেই। দৃষ্টির অগোচর হতেই মহিলা স্টাফটাকে পাকড়াও করলাম, জানতে চাইলাম কেসটা কি? গোলাপী টিশার্টকে দেখা যাচ্ছে না বটে, তবে উত্তেজিত কথা বার্তা এখনও চলছে। বেশ অস্থির লাগছে এদের ঝগড়াঝাটির চোটে। এমন দিনে এত কলহ কেউ করে? 

আচমকা আবার বিরাট হট্টগোল লেগে গেল। উত্তর না দিয়েই দৌড়ল মহিলা স্টাফটি। হাসপাতালের মূল গেট থেকেও ছুটে গেল অনেকে। টেনে অানল চাকা লাগানো বিছানা। কি ব্যাপার হল, ব্যাগপত্র সামলে উঁকিঝুঁকি মারতে পাঁচিলের কাছে গিয়ে দেখি কাকুতি-মিনতি করা প্রৌঢ়া অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছেন ফুটপাথে। আজব ব্যাপার হাতদুটো তখনও খাড়া হয়ে উঠে আছে ওপরে- ।  


‘কোলাপস্ করে গেছে-’ অসহায় কিঞ্চিৎ  ভীত কণ্ঠে এইকথা গুলো শুনে দেখি কখন পিছনে এসে দাঁড়িয়েছেন বাবা। মুখেচোখে অপরিচিতার প্রতি টলটলে সহানুভূতি। প্রৌঢ়ার আত্মীয়স্বজন যা ঝগড়ুটে, কি আবার বলে বসে, তাই মুখ ঘুরিয়ে জানতে চাইলাম, ‘আপনার হয়েছে?’ জবাব পেলাম টয়লেটটাই খুঁজে পাননি বৃদ্ধ। 


সিকিউরিটি এক কথায় নিয়ে যেতে রাজি হল, তার সাথে শৌচাগারে যেতে যেতে বাবা বললেন ,‘এদের ব্যাপারখানা কি? কিছু জানতে পারলে-’। আর কোন চিন্তা নেই। পুরাণ মেয়েটিও আবার ফিরে এসেছে তার স্টেশনে, তাকে পাকড়াও করলাম, ব্যাপারখানা কি? মেয়েটি কেজো বিরক্তি উগরে বলল, ‘আরে ঐ যে ভদ্রমহিলা সেন্সলেস হয়ে পড়লেন না, ওণার স্বামীর একটা অপারেশন হয়েছে আজ সকালে। অপারেশনের পর বেডেও দেওয়া হয়েছে। দুজনকে দেখতে যেতে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। তাতেই এদের রাগ। এরা  সবাই দেখতে যাবে-। নিষেধ করা হয়েছে বলে এত কাণ্ড। ঐ যে মহিলা আমাকে শাসাচ্ছিল ওটা পিসি। অর্থাৎ ঐ বউটার ননদ। কি লাভ হল বলুন তো? একজন এমনিতেই অসুস্থ ছিল, এখন আরেকজনও বেঁহুশ- ’ 


তাজ্জব হয়ে গেলাম শুনে। এত সামান্য ব্যাপার নিয়ে এত অসভ্যতা? আরে কেউ হাসপাতালে ভর্তি হলে দল বেঁধে দেখতে যাওয়াটা চাটুজ্জে আর ঘোষ বাড়ি অর্থাৎ আমার বাপের বাড়ি আর দিদার বাড়ির ট্রাডিশন। তুত্তুরী জন্মের সময় হাসপাতালের ওয়েটিং রুমে শৌভিক ছাড়াও উপস্থিত ছিল আরো এগারোজন। শ্বশুরবাড়ির দিকেও যখনই শ্বশুরমশাইয়ের কোন অপারেশন হয়েছে ছুটে এসেছেন সেজো জেঠু,মণিকাকা, ছোট পিসেমশাই এমনকি নীচের ফ্ল্যাটের পট্টনায়ক কাকুও। আজই তো বাবা বলছিলেন, ‘ছুটির দিন। তুমি বাড়ি থাকো। আমি বরং পট্টনায়ককে নিয়ে চলে যাব-’।  মোদ্দা কথা, এতজন জমায়েত হন বটে, তবে হাসপাতালের নিয়ম তো কেউ ভাঙেন না। আর ও কেন দেখতে গেল, আমি কেন সুযোগ পেলাম না এই নিয়ে এমন অসভ্যতাও কাউকে কোনদিন করতে দেখিনি। এই কোভিডের বাজারে সর্বত্র ১জন করে ভিজিটর অ্যালাও করে, এরা তো তাও দুজন করেছে। 


বেলা বাড়ছে, শ্বশুরমশাইকে ভিতরে নিয়ে গেল ওরা। দরজার কাছ থেকে সোয়েটার, টুপি আর চশমাটা নিয়ে আবার বাগানে ফিরে এসেছি আমি। অজ্ঞান হয়ে পড়া মহিলার বাড়ির ঝগড়ুটে লোকজন এখন এসে জমায়েত হয়েছে বাইরের বাগানে। পিসি এখনও চেঁচিয়ে যাচ্ছে। ফোনে কাকে যেন পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে লাগাচ্ছে সব। পাশের অল্প বয়সী মেয়েটি বলতে গেল ‘একটু আস্তে’। তাকে কুৎসিত ভাবে ধমকালেন-।  


কানে হেড ফোন গুঁজলাম, স্টারট্রেকই বাঁচাতে পারে এই তিক্ত পারিবারিক দ্বৈরথ থেকে। কপাল মন্দ, স্কান ঘরের পুরুষ নার্সটি বেরিয়ে এসে জানতে চাইল, ২০১৪ সালে বাবার যে কোলনে অপারেশন হয়েছিল তার কাগজপত্র কিছু এনেছি কিনা। দস্তাবেজ তো সব বৃদ্ধ গুছিয়ে এনেছেন, কি কি আনতে হয় ভালো জানিও না। উমাই এগুলো ভালো পারে,  ভালো জানে। তবুও সব ঘেঁটে দেখতে লাগলাম। যদি এনে থাকা হয়- । কানের গোড়ায় এবার হল্লা জুড়েছে সকালের গোলাপী টি শার্ট পরা লোকটি। যার পিছনে ভিখারীর মত দৌড়েছিলেন সেন্স হারানো মহিলা। লোকটি পাকড়াও করেছে অজ্ঞান হয়ে পড়া মহিলার মেয়েকে, তারস্বরে প্রশ্ন করছেন, ‘আমার কি আসার কথা ছিল? না না আগে বলো আমার কি আসার কথা ছিল? তবুও আমি এসেছি-’। এমন দাক্ষিণ্য করার ঢঙে বললেন যে মনে হচ্ছিল উঠে ঘুরে দুটো জবাব দিই, এসে তো ধন্য করে দিয়েছেন মশাই। আপনি এসেছেন বলেই ভদ্রমহিলা এখন হাসপাতালে শুয়ে ধুঁকছেন। সবকথা তো আর বলা যায় না। আর এণার যা বিক্রম-।  


নার্স ভাইকে জানালাম, অপারেশনের কাগজপত্তর কিছু আনা হয়নি। কি হবে এখন? লোকটি দেখছি বলে উধাও হয়ে গেল-। পাশের নাটক এখন পুরোদমে চলছে, জনৈক চামচামত লোক গোলাপী টিশার্টকে তৈলমর্দন করে বলছে, ‘ঠিকই তো। তোমার তো আসার কথাই না। আমি তো অবাক হয়ে গেছি।’ অজ্ঞান মহিলার ভোম্বলমার্কা ছেলেটি কিছু বলতে গেল সবিনয়ে, গোলাপী টি শার্ট তাকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিল,তারপর মেয়েটিকে বলল, ‘শুনে রাখো, তোমার মা আর তোমার এই ভাই তোমার বাবাকে মৃত্যুর শেষ সীমায় নিয়ে চলে এসেছে-’। মেয়েটি হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে করজোড়ে কিছু বলল,ছেলেটি গিয়ে লোকটির পায়ে পড়ল, ‘ অন্যায় হয়ে গেলে মাপ করে দাও। কিন্তু তুমি যেও না। বিশ্বাস করো আমি মাকেও দেখতে নিয়ে যাইনি। জানতাম মা বাবাকে ঐ অবস্থায় দেখলেই কাঁদবে-’। বাঘের মত ঝাঁপিয়ে পড়ল গোলাপী টি শার্ট, তাহলে ঐ লোকটা দেখতে গেল কি করে? আমি দেখতে পেলাম না, ও গেল কেন-’। জবাবে কি বলল ছেলেটি জানি না, দেহবিভঙ্গে বুঝতেই পারলাম বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করছে-। মেয়েটি কাঁদছে, যাদের বাবা মা দুজনেই আপাততঃ হাসপাতালে ভর্তি তাদের সাথে চরম খারাপ ব্যবহার করেও গোলাপী টিশার্টের মধ্যে ছিটেফোঁটা অনুতাপের চিহ্ন নেই।ক্ষ্যামা দিয়ে পুনরায় স্টারট্রেকে ডুব দিলাম।  এত অসভ্যতা বরদাস্ত হয় নাকি? ছেলেমেয়ে দুটি কাকুতি-মিনতি করে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে বেশ বুঝলাম। এই নাটকের শীঘ্রই যবনিকা পাত হবে হয়তো। তবে আর দেখার ইচ্ছা আমার নেই।  মনে মনে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানালাম, বাপরেঃ ভাগ্যিস এমন আত্মীয়স্বজন আমাদের কেউ নেই। ঐ যে রাষ্ট্রভাষায় বলে না, এমন বন্ধু থাকলে আর শত্রুর কি প্রয়োজন-।


 

অনির ডাইরি ৯ই মার্চ, ২০২১


সিনেমা দেখার ভয়ানক নেশা ছিল পিসির। দোসর ছিল জ্যাঠাইমা। জ্যাঠাইমার বাপের বাড়িও যেহেতু একই মহল্লায়, পাড়ার ছেলেদের দিয়ে গোপনে খবর আনাত জ্যাঠাইমা, কোথায় কি সিনেমা এল। নবরূপমে কি এলো? আর শ্রীরূপায়? শ্যামাশ্রীতে বুঝি বাংলা বই চলছে, পার্বতীতে বাবা তারকনাথ। পুষ্পশ্রী সিনেমা হলের পাশেই গোরস্তান, নাইট শোয় নাকি আম দর্শকের পাশে বসে সিনেমা দেখেন তাঁরাও। বঙ্গবাসীতে আবার অবাঙালী লোকজন বেশী যায়, 'ভদ্দর ঘর কি লেড়কি'রা গেলে আর আস্ত রাখবে ঠাকুমা? তবুও যেত জ্যাঠাইমা আর পিসি। অনিল ধাওয়ানের কি ভয়ানক ভক্ত ছিল দুজনে। ছোট থেকে শুনে আসছি অনিল ধাওয়ান আর রাধা সালুজার সিনেমা মানেই নীল না হলেও আকাশী তো বটেই। আর জুলি? ছিঃ ছিঃ ওসব সিনেমা নিয়ে আমাদের সামনে কথাও বলা যায় না। আমার জন্মের পর, দেখাশোনার দায়িত্ব যখন স্বেচ্ছায় ঘাড় পেতে নিলো ঠাকুমা আর পিসি, সিনেমা দেখতে যাওয়ার ওপর লাগল প্রতিবন্ধ। 


সীমিত সামর্থেও মাসি রাখতে চেয়েছিল মা। রেখেও ছিল কাকে যেন। ঘুমন্ত আমায় ফেলে সে পাঁচিল ধার গিয়ে পাড়ার মাঠে ছেলেদের বল পেটানো দেখছিল নাকি। পরিণতি সহজেই অনুমেয়। মায়ের আপিসে নিয়ে যাবার চেষ্টাও করেছিল মা, ঠাকুমা তখন ঘুরিয়ে দিয়েছিল , তাঁর শাশুড়ীর ডায়লগ,‘সারাদিন বাচ্ছা আপিসে পড়ে থাকবে? বাচ্ছা কি বাপের বাড়ি থেকে এনেছো? ও বাচ্ছা আমার-’। আজও ঠাকুমার সম্বন্ধে বলতে গিয়ে কপালে হাত ঠেকায় মা। ঐ ভাবে বলেছিল হয়তো, তবে ক্ষণিকের তরেও কোনদিন দায়িত্ব এড়িয়ে যায়নি ঠাকুমা। 


ঠাকুমার নির্দেশ মত, প্রায় বুকে করে মানুষ করেছে পিসি। যৌথ সংসারের যাবতীয় দায়িত্ব,রান্না ইত্যাদি সামলেও খেয়াল রেখেছে আমার। আমার জন্য বেশ কিছুদিন বন্ধ হয়ে যায় পিসির সিনেমা দেখা। তারপর যখন হাঁটতে শিখলাম, ঠাকুমার অসাক্ষাতে আমাকে ট্যাঁকে নিয়েই নবরূপমে সিনেমা দেখতে গিয়েছিল পিসি। একটা পুঁটলিতে সামান্য ন্যাকড়া চোপড়া আর খিদে পেলে খাবার জন্য কাঁচের বোতলে দুধ এই নিয়ে পিসি গেল সিনেমা দেখতে। গিয়ে দেখে সুপার ফ্লপ সিনেমা। দুপুরের শো পুরো ফাঁকা। একা পিসি আর দোসর আমি আর অদূরে হলের ঝাড়ুদারনি। তাই সই, কোল থেকে নামিয়ে দিল পিসি- হাতে ধরিয়ে দিল দুধের বোতল আর গোটা সিনেমাটা নাকি আমি অন্ধকারে প্রতিটা সিটে হাত বুলিয়েই কাটিয়ে দিলাম। সমস্যা হল ক্লাইম্যাক্সে, হিরো যেই ঘুঁষি চালাল ঢিস্যুম,অমনি আমি ঘুমিয়ে কাদা।ঈশ্বরের দয়ায় চিরকালই হৃষ্টপুষ্ট, পুঁটলি সমেত, ঘুমন্ত ভারী আমাকে কি ভাবে যে পিসি সেদিন বাড়ি এনেছিল এ গল্প প্রতিবার গিয়েই শুনতে হয়। যেমন শুনতে হয়, সরগম দেখতে গিয়ে সোনার দুল হারিয়ে এসেছিল পিসি। সৌজন্য সেদিনের আমি। শুনতে হয় কি যেন এ মার্কা হিন্দি সিনেমা দেখতে গিয়ে, দিদিভাই থাকায় জ্যাঠাইমা আর পিসিকে আটকে দিয়েছিল পুলিশ। দিদিভাইয়ের বয়স তখন তুত্তুরীর বয়সী, ছিলও তুত্তুরীর মত বোকচন্দর। পুলিশকে বলেছিল,‘না গো পুলিশ কাকু, আমার অনেক বয়স-১৭/১৮/১৯/২০ বছর।’ জবাবে পুলিশ  কাকু বলেছিল নাকি, ‘চুপ কর ডেঁপো মেয়ে-’। ডেঁপো মেয়েটার অবশ্যি তাতে কিচ্ছু যেতো আসত না, তিন চার বছর বয়স থেকে বাবা আর ছোটকাকুর সাথে নকশালদের মিটিংএ গিয়ে বসত দিদিভাই। মিটিং শেষে, উঠোনে জমায়েত বাড়ির লোকেদের অবিকল বয়ঃজ্যেষ্ঠ বক্তাদের নকল করে শোনাত মিটিং এর গল্প- ‘তারপর সন্তোষ দা বলল----। জবাবে বনবেহারী দা বলল----। তখন মেজোকাকু বলল----’। সন্তোষ দা আর বনবেহারী দা ছিলেন ডাকসাইটে নকশাল নেতা আর মেজোকাকু আমার বাবা। বাড়িতে যেবার পুলিশের রেড হল, খালি গায়ে একটা চাড্ডি পরে, বাঁশের কঞ্চির ডগায় একটা লাল জাঙিয়া টাঙিয়ে পুলিশের নাকের ডগায় ঘুরছিল দিদিভাই- তবে সে তো অন্য গল্প। 


বয়স বাড়ার প্রধান লক্ষণই বোধহয় স্মৃতিমেদুরতা। কোথা থেকে কোথায় চলে যায় মানসিক তরঙ্গ। বয়স বাড়ে, সময় টপকে নামে এক প্রজন্ম থেকে অন্যে। বদলে যায় কতকিছুই, সমাজ, দেশ, পরিপ্রেক্ষিত, মানসিকতা- বদলায় না শুধু ভালোবাসা। বয়স আর ওজন যতই বাড়ুক, পিসির ভালোবাসা আজও অবিকৃত, নির্ভেজাল,১০০শতাংশ খাঁটি এবং ভয়ানক ভয়ানক দুর্লভ।


অনির ডাইরি ৪ঠা মার্চ, ২০২১

'আমি তোমার কথা বলব কাকে'-


এটা তিলীদের বাড়ি, ওটা সদগোপদের, কড়ুরীদের বাড়ি, সোনার বেনেদের বাড়ি, গয়লাদের বাড়ি, এটা গোপালে বস্তি আর ঐটা বনমালী বস্তি- এই ভাবেই পরিচিত ছিল বাড়িগুলো। পুরোনো পাড়া আমাদের, সববাড়িই নিদেন পক্ষে শতেক বছরের বুড়ো। পাড়া জুড়ে ঘুরে বেড়াত নরম গরম হাওয়া। নকী পিসির বাবা, লাঠি ঠুকঠুক করে হেঁটে বেড়ানো বুড়ো বনমালী ঢ্যাংকে বলা হত বস্তির রাজা। আমরা জানতাম সোনার বেনেদের বাড়ির মেয়েরা অপরূপ সুন্দর হয়, কাঁচা হলুদ রঙা ত্বক, মা দুর্গার মত মুখশ্রী আর গোলগাল গড়ন। ওদের বাড়িতে সোনা নাকি কিলো দরে থাকে- আমরা অবশ্য বাড়ি গুলোকে চিনতাম অন্য নামে, এটা রক্ষেদার বাড়ি, ওটা মৌরি আর তন্দ্রাদিদের। কড়ুরীদের ছিল যমজ বাড়ি, জোড়া বাড়ির উঠোনে ঘুরে বেড়াত বিশাল হোঁৎকা ডোবারম্যান। হাল্কা বিস্কুট রঙা কুকুরটা দৈর্ঘ্যে প্রস্থে ছিল একখানা বাছুরের সমান, শুধু ল্যাজের জায়গায় ছিল ছোট্ট একটা কুণ্ডুলী। বিশাল গেটের ফাঁক দিয়ে নাকটা গলিয়ে যমদূতের মত রাস্তা দেখত সে, পাড়ার নেড়িরা দল বেঁধে যেত ঝাড়ি মারতে। এতজন তপ্ত অনুরাগিনীর রঙ ঢঙ নখরায় বিন্দুমাত্র প্রভাবিত হত বলে মনে হয় না। কেমন যেন তাচ্ছিল্য ভরা উদাস চোখে তাকিয়ে তাকত - 


সেসব দিনকাল ছিল সন্ধ্যে নামলেই আমতেল দিয়ে মুড়িমাখার, দিনকাল হলুদ বাল্বের আলো আর সাদাকালো টেলেরামা টিভির। বুধবারে চিত্রহার আর বৃহস্পতিবারে চিত্রমালার। দিনকাল ছিল জ্যাঠাইমার উনুনের ধোঁয়া আর ভোর ভোর আকাশবাণীর অমৃত সুরের। দিনকাল ছিল গরম কালে কালবোশেখী আর তার ছিঁড়ে যাবার-। সদ্যস্বাক্ষর আমায় পড়াতে এলেন তিলিদের বাড়ির বউ, আমার দিদিমণি। বনেদী বাড়ির বউ, শুনেছি ওণার শ্বশুরমশাইয়ের ছিল বিশাল মুদিখানার দোকান। শ্বশুরের উপার্জন দেখেই বিয়ে দেওয়া হয়েছিল দিদিমণির। ব্যাঁটরা পাবলিক লাইব্রেরির গণ্ডি ছাড়িয়ে, একরাশ বন্ধু হারিয়ে, কান্নাকাটি করে জ্বর বাঁধিয়ে সদ্য ভর্তি হয়েছি তারাসুন্দরী বালিকা বিদ্যাভবনে।  এতদিন মা’ই পড়াত। আপিস ফেরৎ উত্তমমধ্যম সহকারে খানিক পড়ানোর পর মিলত ছুটি। তখন সামান্য সময়ের জন্য অনুমতি মিলত মাকে পড়ানোর। সেই যে সেদিন, ঈশ্বরচন্দ্রের চিত্রখচিত চটি বর্ণপরিচয়ের উ শেষ করিয়েছে মা। এবার মায়ের পালা ঊ পড়ার। মা পড়ল, ‘ভ য়ে ঊ ত, ভূত’। বাবা গো! সটান মায়ের কোলে আমি। পশ্চিমের জানালার ওপারে অন্ধকার ঝাঁকড়া পেয়ারাগাছে পা দুলিয়ে ছিলিম টানা বেহ্মদত্যির সে কি হাসি- 


দিদিমণি কোনদিন গায়ে হাত তোলেননি। অথচ তখন ছাত্র ঠ্যাঙানো ছিল শিক্ষক শিক্ষিকাদের গণতান্ত্রিক অধিকার। বাবামায়েরাই বলত, ‘বেশটি করে ঠ্যাঙাবেন তো মাস্টারমশাই/দিদিমণি। জলবিছুটি দিয়ে দেবেন এক্কেবারে।’ দিদিমণির ওসব ছিল না, বকতেন প্রচুর, পড়াতে পড়াতে মায়ের সাথে জুড়ে দিতেন সুখদুঃখের গল্প। বাল্বের আলো ঠিকরে আসত ওণার হাতের তুবড়ে যাওয়া সোনার আংটি থেকে, যার ওপরে মিনাকারিতে লেখা ছিল ,‘পুষ্পরাণী’। হাজার অভাবেও গয়না বেচেননি দিদিমণি। এটাই নাকি তিলী বাড়ির বৈশিষ্ঠ্য। অভুক্ত থাকলেও বাস্তু আর সোনা বেচেন না ওণারা। এতো বুঝতাম না,তবে প্রত্যেক সপ্তাহে একবার জানতে চাইতাম কি কি গয়না আছে ওণার- 


শরৎচন্দ্রের লেখার অসম্ভব অনুরক্ত ছিলেন। ওণার মুখে শুনে শুনে অর্ধেক গল্প, চরিত্রের নাম মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল ক্লাশ থ্রি ফোরেই। মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল সাদাকালো যুগের অগণিত বাংলা সিনেমার ডায়লগ আর ঘটনাবলী। সে সব ছবির বোধহয় আর প্রিন্টও অবশিষ্ট নেই আজ। 


বয়স বাড়ার প্রধান লক্ষণই বোধহয় স্মৃতিমেদুরতা। বর্তমান চরম সুখে জবজবে থাকলেও মন ঘুড়ি হয়ে যায় অতীতের চিলেকোঠার জানলা গলে, উড়ে যায় ‘চৈত্রের রৌদ্রের উদ্দাম উল্লাসে’। মেয়েকে দেখাতে বসা ঝাপসা যমালয়ে জীবন্ত মানুষের ডিজিটাল প্রিন্টের আড়াল থেকে বকে যায় কবেই মুছে যাওয়া জীবনের সাদাকালো কোন অধ্যায়। চন্দনগন্ধী ধূপের সুবাসে গুলে যায় কয়েকদশক আগে সদ্য বনেদী বাড়ির চৌকাঠ ডিঙানো এক অভাবী অথচ আত্মাভিমানী গৃহবধূর কাতর অনুরোধ, ওণার বর ধূপকাঠি বাঁধতেন, যদি দু এক প্যাকেট কেনে কেউ।  ধুতি পাঞ্জাবি পরিহিত ঈষৎ নুব্জ দাদামণি স্বয়ং আসতেন ধূপের গোছা নিয়ে- একটু বেশী করে জ্বালানো ধূপের সুবাসে ম ম করত বাড়িটা সকাল- বিকেল।


নাঃ তুত্তুরীর এখনও কোন দিদিমণি নেই, এখনও মায়ের কোলে বসে ‘ভ য়ে ঊ ত’ পড়ার স্তরেই আছে তুত্তুরী। অগোছালো আপিস- সংসার, কিছুই ঠিকমত সামলে উঠতে পারি না, পারি না ভালো পড়াতে, তবে ভালো লাগে ভীষণ। মেয়ের সাথে নতুন করে শিখতে- নতুন করে পা ফেলতে- কবে শিখেছিলাম সব, মনে হয় যেন বিগতজন্মের কথা। নাম বদলে ফেললেও দিব্যি চিনতে পারি, সেই মান্ধাতার যুগে শেখা লসাগু আর গসাগু। নতুন করে শিখি বায়ুতে তিনভাগ নাইট্রোজেন আর একভাগ অক্সিজেন। সেই যে সেবার বড়দার সঙ্গে হাতেকলমে পরীক্ষা করতে গিয়ে ফাটিয়ে ছিলাম মায়ের কাঁচের গ্লাস। আবার ভাঙি নতুন করে, সঙ্গে এবার নতুন দোসর। মা হবার এটাই তো সুবিধে- নতুন করে ফিরে পাওয়া যায় ফেলে আসা সাদাকালো জীবনটাকে। প্রিয় অতীত, তোমায় আমি হারাইনি, আমার ভবিষ্যেতর মধ্যেই লুকিয়ে থাকো তুমি, ফিরে ফিরে আসো প্রতিটা বাঁকে, আরোও অনেক অনেক ভালোবাসা নিয়ে-  জুগিয়ে যাও বেঁচে থাকার রশদ।

Saturday 20 February 2021

অনির ডাইরি ফেব্রুয়ারি, ২০২১

 

অনির ডাইরি ২৫শে ফেব্রুয়ারি, ২০২১


রিক্সামামা আর রিক্সা চালায় না। প্রথম প্রথম যখন মেয়ে নিয়ে একা থাকতে শুরু করেছিলাম তখন এমনি অনেক সম্পর্ক গড়েছিলাম আমি আর তুত্তুরী। জানতে পারলে হুলো বেড়ালের মত এখুনি ঘ্যাঁও করে উঠবে শৌভিক, ‘একা কেন? আমি কি আসতাম না?’ আসত বৈকি। ব্লক সামলে সুযোগ পেলেই পালিয়ে আসত। যখন আসত মুটে মজুরের মত দোকান বাজার করে দিয়ে যেত। বাকি দিনগুলোয় আপনি অার কপনি ভরসা। 


তাতে যে খুব একটা অসুবিধে হত তেমন নয়,সমস্যা হত তুত্তুরী সর্দিজ্বর বাঁধালে। কেমন যেন ডিনায়ালে ভুগতাম আমি, হয়তো আজও ভুগি। ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে ভাবলেই নার্ভাস ব্রেকডাউন হত। এতো আর আমাদের হাওড়া নয় যে, গৌতম কাকুর চেম্বারে গিয়ে বলব ,‘কাকু মেয়েটা ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ করছে। দু পুরিয়া ওষুধ দিন তো। ’ ঠাকুমা থেকে তুত্তুরী, চার প্রজন্মের যাবতীয় ছোটবড় অসুখে ডাঃ গৌতম সিংহরায় ছিলেন সাক্ষাৎ  ধন্বন্তরী।  পেশায় ছিলেন হোমিওপ্যাথ ডাক্তার। বাড়ির গ্যারেজের ওপরে ওণার ছোট্ট ডিসপেনসারি, সবসময় গমগম করত রুগীদের ভিড়ে।  রোগ নির্ণয়ের কেমন যেন সহজাত প্রতিভা ছিল ভদ্রলোকের, এমনকি যেসব ব্যধির চিকিৎসা ওণার আয়ত্বের বাইরেও, তাও কেমন একপলকে নাড়ি টিপে ধরে ফেলতেন গৌতম কাকু। 


 রিক্সার ঝাঁকানিতে সম্বিত ফিরে পেয়ে কিঞ্চিৎ  লজ্জিত লাগল। বয়স বাড়ার প্রধান লক্ষণই বোধহয় এই স্মৃতিমেদুরতা। লকডাউনে রিক্সা বেচে জোগাড়ের কাজ নিয়েছে রিক্সামামা। তবে স্বীকার করে না। ফোন করলেই বলে ‘আচ্ছা বওদি। আমিই থাকব। ’ থাকেও। অন্য রিক্সায় তুলে দিয়ে আবার কাজে ফিরে যায়। এদিকে আজকাল ই-রিক্সাই বেশী। চাপলেই দৌড়য়, ভর দুপুরে মেয়ের ইস্কুলে যেতে জাস্ট কান্না পাচ্ছে। কিন্তু নিরুপায়। মেয়ের ইস্কুলের ফরমান ওপরওয়ালীর ফরমানের থেকেও ভয়ঙ্কর। কি সব অলিম্পিয়াডের সার্টিফিকেট এবং মেডেল দেবে নাকি। 


অমন অলিম্পিয়াডে ফি বছর বসে তুত্তুরী। কোনবারই বলার মত কিছু হয় না। না হলেই বেশী খুশি হই আমি। যেটাতে উত্তীর্ণ হয়, সেটার পরের ধাপের জন্য আবার নিয়ে যেতে হয় অন্য ইস্কুলে। যে মহা যাতনার। প্রতিটি পরীক্ষার জন্য মোটা ফি দিতে পাঁজর টনটন করে, কিন্তু না দিলেও নয়। কি যেন একটা পরীক্ষায় জেদ করে ফি দিইনি একবার, রবার্ট ব্রুস একজন সম্মানীয় ব্যক্তি বটে, তবে ওণার মত সপ্তবার্ষিকী ফেল করার পরিকল্পনা না করাই শ্রেয়। সেদিন অফিস থেকে ফেরার পর করুণ মুখে বলেছিল তুত্তুরী, ‘জানো মা, আজ আমি একা বসেছিলাম ক্লাশে। সবাই পরীক্ষা দিতে গিয়েছিল। ’ সেই থেকে নাক কান মুলেছি, যা বাবা ফেলই করে আয়। মনটা তো খুশি খুশি থাকুক।  


ইস্কুলে বিরাট লাইন। কিসের মেডেল কি বৃত্তান্ত কিছুই না জানা বাবামায়েরা রীতিমত ভোম্বল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অ্যাসেম্বলী হল থেকে কেউ বেরিয়ে এলেই ছেঁকে ধরছে তাকে, ‘মেডেল পেলে?’ যা বুঝলাম মেডেলের সংখ্যা সীমিত। ফলে উত্তর প্রত্যাশিত। ওদিকে বাড়িতে তুত্তুরী রূপার মেডেল পাবে ভেবে নেচেই চলেছে। রূপা নাকি সোনার থেকেও বেশী ঝলমলে। 


অবস্থা দেখে মায়াই লাগল, আহাঃ বড় আশা করেছিল গো। আজ অবধি একটাও মেডেল পায়নি মেয়েটা। বন্ধুরা অনেকেই পেয়েছে, প্রতিবার গল্প শোনায় মেয়েটা। ভাবতে ভাবতে মনে পড়ল , আরেঃ আমি তো জীবনে কোন মেডেল পাইনি। থুড়ি পেয়েছি প্রচুর, অর্জন করিনি একটাও। 


মেডেল কিছু পেত বটে আমার ছোটদা। কি ভালো যে আঁকত ছোটদা। যবে থেকে পেন্সিল ধরতে শিখেছে, কোন প্রতিযোগিতায় দ্বিতীয় হয়নি। এখনও আঁকে বটে, তবে আজকালকার ছবিগুলো বড় বেশী আঁতেল-আঁতেল মার্কা হয়,কিচ্ছু বুঝি না। ভিন্ন বছর হলেও, একই দিনে জন্ম তাই ছন্দ মিলিয়ে নাম-‘গুনু আর ঝুনু।’ শ্রীমাণ গুনু সত্যিই ভয়ানক গুণের আকর ছিলেন। ততোধিক নির্গুণ ছিলাম আমি। 

তবে ভাইফোঁটার দিনটা এলেই পাল্টে যেত সব হিসেব। সেদিন সম্বৎসরের মেডেল গুলো পরম যত্নে আমার হাতে তুলে দিত ছোটদা।  

ভাইফোঁটায় ছোটদার দেওয়া উপহারের জন্য মুখিয়ে বসে থাকতাম আমি। পুরানো পিচবোর্ডের বাক্সকে সুন্দর করে রঙ করে, রাংতা দিয়ে মুড়ে তার মধ্যে যত্ন করে রাখা মেডেলের পাশে থরে থরে সাজানো থাকত চকলেট। ক্যাডবেরীর যতরকম চকলেট পাওয়া যেত সব দুএকটা করে  সাজিয়ে বাকিটা আমুল,নেসলে আর কফি বাইট দিয়ে ঠাসা থাকত। উফঃ সেই সোনালী বাক্স খোলার উন্মাদনা জীবনে ভুলব? ভাবতে ভাবতেই মনে পড়ল, এত চকলেট কেনার পয়সা কোথা থেকে পেত ছোটদা? কি আশ্চর্য! এতদিন এই চিন্তাটা কেন মাথায় আসেনি? ছাপোষা মধ্যবিত্ত আরএমএসের কর্মী বড় মেসোমশাইয়ের টানাটানির সংসারে কেউ হাতখরচ পেত বলে কখনও শুনিনি। অনেক কষ্টে তিন পিতৃহীন শ্যালিকা আর চার পুত্রকে মানুষ করেছিলেন স্বর্গীয় বড় মেসোমশাই। পেরেছিলেন শুধু অদম্য জেদ আর অপরিসীম দুঃসাহসে। তাহলে? অত চকলেট কেনার টাকা তুমি পেতে কোথায় ছোটদা?


দুখানি পার্টিসিপেশন সার্টিফিকেট বগলে রিক্সায় উঠেই ফোন করলাম ছোটদাকে, ‘কি ভাবে দিতে ছোটদা?নিজের কি কি প্রয়োজন না মিটিয়ে জমাতে পয়সা? শুধু আমার জন্য?’ প্রশ্ন করতে গিয়ে চিকচিকিয়ে উঠল চোখের কোণা, এত ভালোবাসা দিয়ে গেছে জীবন, অথচ আমি বুঝিনি?ফোনের ওপাড়ে ছোটদার উদাত্ত হাসি, ‘যা যা বাড়ি যা। তুত্তুরীকে যেন ঠ্যাঙাস না। যা ঠ্যাঙাড়ে তুই।’ কি প্রশ্নের কি জবাব। মনে পড়ে গেল, এই কারণে, শুধু কারণেই উদোম হাতাহাতি হত এই ভদ্রলোকের সঙ্গে। সবসময় লুকোচুরি মাইরি। মহা বাজে লোক।

অনির ডাইরি ২১শে ফেব্রুয়ারি, ২০২১

#শুভভাষাদিবস

সাত সকালে চৈতালী বলল, ‘শোন অাজ ভাষা দিবস, জম্পেশ করে একটা লেখা নামিয়ে ফেল-’। রসাল আলাপচারিতার ফাঁকে এমন বিদঘুটে আব্দার শুনে শঙ্কর শেঠের কথা মনে পড়ে গেল। তাঁর আদরের নন্দন কোষ্ঠকাঠিন্যে ভুগত এবং শতানুরোধেও সক্কাল সক্কাল প্রাতকৃত্য করতে রাজি হত না, তাই শঙ্কর বাবু করেছিলেন কি, পরপর দিন সাত আটেক ভোরভোর শিশু পুত্রকে ঘুম থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে শৌচাগারে ভরে দিতেন এবং লাঠি নিয়ে দরজায় বসে থাকতেন। পাক্কা গব্বর ইস্টাইলে,‘ হয় ইয়ে কর, নয় লাঠি খা’। আরে লেখাপত্তর হল ইয়ে মার্কা ব্যাপার স্যাপার, অমন হুকুম দিলেই হয়? প্রসঙ্গতঃ দ্বিতীয় ইয়েটা কিন্তু প্রথম ইয়ে নয়। বুইলেন কি না- একটা সত্যিই ইয়ে আর দ্বিতীয়টা আঁতেল মার্কা আর কি- 


তো যা বলছিলাম, আমি মনে, প্রাণে এবং ধনে ঘোরতর বাঙালী। বঙ্গের রাণী দয়া করে বেতন দেন, তাই মোর সংসার চলে। তবে আমার থেকেও কড়া বাঙালী হল মোর বাপ। যার কাছে আমার বাঙালিয়ানার হাতে খড়ি। রাত নটা নাগাদ, টিভির সামনে বসে, আধ কি সিকিখানা হিন্দি সিনেমা দেখতে দেখতে, চামচে করে চাট্টি শুকনো মুড়ি আর কড়াইশুঁটি খেতে খেতে, মায়ের কাছে এক কাপ চায়ের উষ্ণ প্রেম প্রার্থনা করতে করতেও বাবা হিসেব করে যায়, ‘একটা ষোল আনা বাঙালী(রাণী মুখার্জী), একটা আট আনা বাঙালী (অভিষেক বচ্চন), একটা চার আনা বাঙালী (ঋত্বিক রোশন। ওণার পিতামহী বঙ্গনারী ছিলেন কিনা) আর একটা সাড়ে বারো পয়সার বাঙালী (করিনা কাপুর। তাঁর প্রপিতামহ কোন কালে কলকাতাবাসী ছিলেন-)।’ উফঃ কত্ত বাঙালী। 


নাঃ অধম এখনও ঐ স্তরীয় বাঙালী হয়ে উঠতে পারেনি, তবে ঐ পথেই এগোচ্ছি। দিনদিন আরো আরো বেশী করে বাঙালী হয়ে উঠছি। উল্টো দিকের লোকটা খুব বেশী ইংরেজিতে পটরপটর না করলে বাঙলাতেই কথা বলি। উল্টোদিকের ব্যক্তিটি যদি আমার মাতৃভাষা শুনে , ‘কেয়া’ বলে তো আমিও গোবেচারার মত হাত পা নেড়ে বোঝাই, ‘হিন্দি ভালো নেহি বুঝতা। বাংলায় বোলিয়ে নয়তো ইংরেজি ভি চলেগা।’  চিঠিপত্রে দস্তখৎ তো বাংলা হরফেই করি। ঊর্ধ্বতন কতৃপক্ষকে লিখতে কিঞ্চিৎ সঙ্কোচ নয়, কিন্তু নিম্নতন কর্মীবন্ধুদের যখন চিঠি করি, বাঙলা ভাষাতেই করি। নোটিশ দিলেও বাংলায় দেবার জন্য পীড়াপীড়ি করি, ফলতঃ দশ মিনিটের চিঠি লিখতে ঘন্টা আধেক দাঁত কিড়মিড় করতে হয় এবং নিজের চিঠি নিজেকেই টাইপ করতে হয়। সর্বোপরি নির্ভেজাল বাংলায় গালাগালি দিই। 


এতদসত্ত্বেও খুঁৎ তো থেকেই যায়। আমি হইচই দেখি না। তিলোত্তমা বা তসলিমা ছাড়া সাম্প্রতিক বাংলা সাহিত্য পড়ি না। গানও বেশীর ভাগ সময় অবাংলা ভাষাতেই শুনি।মাসটা ধরতে পারলেও বাংলা তারিখের হিসেব রাখি না। খাবারদাবারের বেলাতেও আমার বিজাতীয় ভিনদেশীয় খাবারে বড় লোভ-।  উপরিউক্ত সবকটি কারণের জন্যই আমি যৎপরনাস্তি লজ্জিত। একুশে ফেবুর ফেবুসমাজ কি আমায় মেনে নেবে Chaitali? 


শেষবিচারে আমি বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের এক অতি নগন্য কিন্তু অতি গর্বিত সদস্যা। দেশস্বাধীন- ভাষাও স্বাধীন। যা খুশি বলুন না মশাই, ভাষা তো শুধু মনের ভাব প্রকাশের মাধ্যম মাত্র। কানে বন্দুক ঠেকিয়ে আপনাকে না বাঙালি করা যাবে, না অবাঙালি। এতই যদি সহজ হত ব্যাপারটা, তাহলে দেশভাগের এত বছর পরেও পদ্মা পেরিয়ে আসা মানুষগুলো আজও সুযোগ পেলেই নিজেদের হারিয়ে যাওয়া পরগণার কথ্য ভাষায় বাক্যালাপ করত না। ভাষার প্রতি প্রেম থাকুক, তবে ভাষা নিয়ে একদিনের গুণ্ডামি না হয় নাই করলাম। ভাষা তো স্থবির নয়, ভয়ানক জঙ্গম। ভিন্ন ভাষা বা আঙ্গিকের দৌরাত্ম্যে থোড়াই হারিয়ে যেতে পারে এমন ভাষা? বিজ্ঞজন যাই ভবিষ্যৎ বাণী করুন না কেন, ভালো করে কান পেতে শুনুন কি কয় আপনার হৃদয়? 


 বেঁচে থাক মোদের ভাষা শতায়ু- সহস্রায়ু হয়ে- বাহুল্যর খোলস ঝেড়ে ফেলে- আবেগে ভালোবাসায় পুষ্ট হোক দিনে দিনে। চলুন, শুভ ভাষাদিবস। ভালো থাকুন, ভালোবাসুন আর প্রাণের ভাষায় কথা বলুন। মাতৃভাষা জিন্দাবাদ, আমরাও, আপনারও, সবার ভাষা জিন্দাবাদ।

অনির ডাইরি ১৯শে ফেব্রুয়ারি, ২০২১



‘আজ পারলে একটু তাড়াতাড়ি ফিরো মা-’। গ্রীলের ওপাশে কন্যার করুণ মুখ ঘোরতর ব্যস্ত আপিসটাইমকেও থামিয়ে দেয় এক লহমায়। পলকে পিছিয়ে নিয়ে যায় কোন সে সাদাকালো দশকে। সময়ের দর্পণে যেখানে ফুটে ওঠে তুত্তুরীর সমবয়সী চেনাঅচেনা কোন বালিকার সিপিয়া প্রতিবিম্ব। দেড়শো বছরের পলেস্তারা খসে পড়া বুড়ো বাড়িটার দক্ষিণ পশ্চিমের বারন্দা থেকে এমনি করেই কাতর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকত, যে। বিশাল বার্মাটিকের সদর দরজা ঠেলে অাপিস বেরিযে যাওয়া লোকটার দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলত, ‘একটু তাড়াতাড়ি ফিরো বাবা। এখনও বাকি কত্ত কাজ-’। সোচ্চারে বলতে ভয় পেত, পিছু ডাকতে ভয় পেত সে। 


দুই যুগের দুই কন্যার যাবতীয় উদ্বেগ তথা উৎকণ্ঠার মধ্যমণি একজনই, সপ্তাহের গাড়ি বাঁক নিলেই যে এসে পড়বেন তিনি। এমন অগোছালো ধূলিমাখা আবহে কি ভাবে বরণ করা হবে তাঁকে? শুধুই তাঁর জন্য যুদ্ধকালীন ব্যস্ততায় গোছাতে হবে, সাফাই করতে হবে ঘরদুয়ার। কিনে আনতে হবে ষোড়শ উপাচার, তারপর সাজাতে হবে মনের মত করে। পাততে হবে মঙ্গলঘট, আঁকতে হবে স্বস্তিকা, দুয়ারে বসাতে হবে কলাগাছ আর সবশেষে কাঁপা কাঁপা হাতে বাইরের দরজার সামনে আঁকতে হবে তাঁর পদচিহ্ন, ঠিক যে ভাবে মা লক্ষ্মীর পদচিহ্ন আঁকত ঠাকুমা, ঢুকবে কিন্তু বের হবে না। অদূরে মিলনী মাঠে বসন্তবিলাপী সুর ধরতেন আরতি মুখোপাধ্যায় ‘ধরেছি আর তোমায় ছাড়ব না-’।  


ঘরসাফাই দিয়ে শুরু হয় বাগদেবীর আগমন পর্ব। মা নিষেধ করা সত্ত্বেও নিঝুম দুপুরে স্কচব্রাইট আর বাসনমাজা সাবান দিয়ে দেওয়াল ঘষে তুত্তুরী। মুছে ফেলার চেষ্টা করে দেওয়াল জোড়া অগুনতি ছবি, হাতের ছাপ, ‘মাসি খুব বাজে’ বা ‘আই লাভু মা’ মার্কা ছুটকো বার্তা। কোথাও কোথাও ভুলভাল অঙ্কও কষে রেখেছে তুত্তুরী, দেখতে পেলেই কান ধরে ওঠবোস করায় বাবা, দেওয়াল নষ্ট করার জন্য নয় যোগ/ বিয়োগ বা গুণে ভুল করার জন্য।  


কন্যার ঘর সাফাই করার মরিয়া প্রচেষ্টা দেখেও রাগতে পারে না তুত্তুরীর মা। মনে পড়ে যায় পলেস্তারা খসা, সাবেকী ঠাকুরঘরের কথা। ভিটের মূল কাঠামোর বাইরে টালির চালের ঠাকুরঘরটা বিশেষ রূপে বানানো হয়েছিল প্রপিতামহের জননী স্বর্গীয়া গোলাপসুন্দরী দেবীর জন্য। ঘরের লাগোয়া চকচকে কালো রোয়াকটা ছিল তাঁর গোঁসা ঘর বুঝি। গোঁসা হলেই আঁচল বিছিয়ে শয্যা নিতেন তিনি। কলকাতা তখনও ভারতের রাজধানী। অনুশীলন সমিতির উৎপাতে বঙ্গভঙ্গের চিন্তা সদ্য ঢুকছে গোরাদের গোবরভরা মস্তিষ্কে। 


ঠাকুরঘরের লাগোয়া আমগাছটি অবশ্য নবীন। পাঁচ সাত রকম আমের আঁঠি থেকে গজানো একগুচ্ছ চারা মিলে তৈরী করা মহীরুহের এক একটা আমের সোয়াদ ছিল এক একরকম। সবই চিনি গোলা যদিও। গ্রীষ্মকালে টুপটাপ ঝরে পড়া আমে ফি বছর ভাঙত টালি। আম- কাঁঠাল আর পেয়ারার লোভে হামলা চালানো হনুমানের দলও ভাঙত কিছু টালি। বর্ষাকালে চুঁইয়ে নামত সজলধারা। দেওয়ালগুলোও ছিল ড্যাম্প ধরা। আয়নার মত চকচকে কৃষ্ণবর্ণ মেঝের মুখে শতেক বলিরেখা।


 এহেন ঠাকুরঘরকেও কেমন যেন রাজপ্রাসাদ বানিয়ে ফেলত বাবা রাতারাতি। মায়ের বাতিল ঝলমলে ব্যাঙ্গালোর সিল্ক দিয়ে রচিত হত পিছনের চালচিত্র। অমনি কোন শাড়ি দিয়েই মাথায় টাঙানো হত চাঁদোয়া। দীর্ঘ দুই তিন মাস ধরে জমানো সিগারেটের খোলের পাহাড় থেকে রাংতা বার করতে বসতাম আমরা তিন খুড়তুতো জেঠতুতো ভাইবোন। আপিস ফেরতা ক্লান্ত হাতে নিটোল ফুল কাটত বাবা। টিভি সিরিয়াল দেখার ফাঁকেফোকরে অ্যালুমিনিয়ামের বাটিতে ময়দা গুলে স্টোভে ফুটিয়ে আঠা বানিয়ে দিত জ্যাঠাইমা। অতঃপর ঠাকুর ঘর জুড়ে টুপটাপ ফুটে উঠত সোনালী রূপালী ফুলের দল। বিরাট উঠোনের কোণায় কোণায় ঝুলত লাল-নীল-সবুজ শিকলি। 


ফেলে আসা সময়টাকে আঁকড়ে ধরতে আপিস ফেরতা পাঁচরঙা মার্বেল পেপার কিনে আনে তুত্তুরীর মা। রান্নাঘরের ভোঁতা ছুরি দিয়ে কাগজ কেটে ফেভিস্টিক দিয়ে মেয়েকে শিকলি বানানো শেখানোর সময়, কেন জানি না গলার কাছটা ব্যথা ব্যথা করে তুত্তুরীর মায়ের। কাগজের খসখস শব্দের আবডালে ফিসফিসিয়ে কাকে যেন বলে তুত্তুরীর মা, 'দেখো বাবা, আমি আজ তোমার ভূমিকায়-'। 


নামভূমিকায় অভিনয় হয়তো করা যায়, কিন্তু আসলকে বোধহয় কোনদিনই ছুঁতে পারে না নকলনবীশের দল। গাঁদাফুলের মালা, আম্রপল্লব, পঞ্চগুঁড়ি, পঞ্চশস্য, পঞ্চরত্ন, চাঁদমালা কিনতে গিয়ে তাই বোধহয় হাত বাড়িয়ে সেই চেনা, চির নির্ভরশীল হাতটাই খোঁজে তুত্তুরীর মা। জ্বলে যাওয়া ফর্সা রঙা হাতটায় বারো মাস থাকে সস্তা সিগারেটের গন্ধ।  কত বছর পেরিয়ে যায় এই গন্ধ আর এই স্মৃতি গুলো কেন যে যুগান্তরেও থেকে যায় অবিকৃত?


পাঁচালি খুলে ভুলভাল উচ্চারণে মন্ত্র উচ্চারণে, দেবনাগরী অলিগলিতে হোঁচট খেতে খেতে, করজোড়ে বসে থাকা ভক্তিমতী কন্যার বিনম্র আঁখিপল্লবে, সন্ধ্যাপ্রদীপের কম্পমান শিখায় কি যে খোঁজে তুত্তুরীর মা। চোখ বন্ধ করে বসে থাকা ভক্তিমতী তুত্তুরীর মধ্যে হয়তো সেই সিপিয়া রঙা মেয়েটা আর সাদাকালো সময়টাকেই খোঁজার চেষ্টা করে তুত্তরীর মা। সময় বড় নির্মম, পট ঠিক রাখলেও কেমন বদলে বদলে যায় কুশীলবরা। আজ বাবার জুতোয় পা রেখেছি আমি, কাল হয়তো  অন্য কেউ থাকবে আমার ভূমিকায়। পড়ে থাকবে শুধু একমুঠো স্মৃতিমেদুরতা।


অনির ডাইরি১১ই ফেব্রুয়ারি ২০২১

অতসী দেবী জিন্দাবাদ- 


ভদ্রমহিলা আপাততঃ বেশ ভালো আছেন। অবশ্যি থাকারই কথা, প্রাকবিবাহ যুগ থেকে শুনে আসছি ওণার অতিমানবিক শক্তি তথা কর্মদক্ষতার উপাখ্যান। বয়স কালে ভদ্রমহিলা শুধু যে অসীম শক্তিশালিনী ছিলেন তাই নয়, যে কোন গৃহকর্মে ওণার পারিপাট্য তথা নৈপুণ্য প্রবাদপ্রতিম। এ হেন ভদ্রমহিলা খোদ যখন আমায় বধূ হিসেবে বরণ করে এনেছিলেন তখনই আমার গর্ভধারিণী বলেছিলেন, ‘আমার মেয়েটা ন্যাদোশ। ঢ্যাঁড়শ এবং হদ্দ কুঁড়ে। সবথেকে বড় কথা ভয়ানক নিদ্রাকাতর।’ অর্থাৎ বহির্রঙ্গ দেখে বিমোহিত হবেন না। জবাবে উনি বলেছিলেন, ‘আমার ছেলেটা আবার ভয়ানক কর্মঠ। একজন যদি গৃহকর্মে ব্যাপৃত থাকে, আরেকজনকেও তখন উঠতেই হবে। আর অপ্রয়োজনে ওঠার দরকারটাই বা কি?’ 


ভদ্রমহিলা ওমনি। চেনা শাশুড়ির ছকে ফেলা বেশ মুস্কিল।আর পাঁচটা পুত্রবধূর মতোই আমি আর উমা বেশ সমীহ করে চলি আমাদের শাশুড়ি মাতাকে। সমীহ ছাড়ুন, পাতি বাংলায় বেশ ভয় পাই এণাকে। শ্বশুরমশাই অবসর প্রাপ্ত জাঁদরেল আমলা হলেও তাঁর সঙ্গে তর্ক করা যায়, ভুলো স্বভাব নিয়ে খিল্লি করা যায়, ফোকটে দেওয়া যায় খানিক জ্ঞানও,এমনকি ক্ষেত্র বিশেষে ধমকানোও যায়। কিন্তু এই ভদ্রমহিলার ভয়ে রীতিমত কম্পমান আমরা। 


যাই হোক ফিরে যাই ভদ্রমহিলার ভালো থাকার গপ্পে, গত পরশুই ওণার উদরে তিনখানি ফুটো করেছেন ডাক্তারবাবু, জনৈক সুপার স্পেশিয়ালিটি হাসপাতালের লবিতে একাকী সেদিন বসে বসে ভাবছিলাম, প্রতিদিন কত মানুষই না অসুস্থ হন। ঘোরতর কর্মব্যস্ত দিনেও কি মারাত্মক ভিড়ের দৌরাত্ম্য। পৌনে একঘন্টারর মধ্যেই জনা সতেরো বয়ঃজ্যেষ্ঠ ব্যক্তি এবং বেতো মহিলাকে আসন ছাড়লাম। আপদ করোণার জন্য চেয়ারের সংখ্যা অসম্ভব সীমিত। এদের নিয়ম রুগী পিছু মাত্র একজন সঙ্গী কেবল হাসপাতালে ঢুকতে পারে। আর ডাক্তারের কাছে বা বিলিং সেকশনে অনুমোদন পায় কেবল একজন। একটু আগেই জনৈক বৃদ্ধ চিৎকার করছিলেন, ‘এখানে কত রুগীর সঙ্গে চারজন করে লোক ঢুকছে দেখতে পারছেন না আপনারা?’ বৃদ্ধকে তাঁর বৃ্দ্ধার থেকে আলাদা করার চেষ্টা করছিল মহিলা নিরাপত্তা রক্ষী। তাই এই ক্ষোভ। পাশ থেকে উমা ফিসফিস করে বলল, “কাল এই  নিয়ে এই এক বৃদ্ধ দম্পতি কি ঝগড়া করছিল দিদিভাই। বৃদ্ধ বলছিল ‘আমি যাব’ আর বৃদ্ধা বলছিল, ‘তুমি ঢ্যাঁড়শ। কিচ্ছু মনে করে বলতে পারো না। আমি যাব।’“ অন্য সময় হলে হয়তো হাসতাম, কিন্তু সেদিন তো বেআইনি কাজ করেছি আমরা দুজনেও। একজন ঢুকেছে শাশুড়ি মায়ের সাথে আর আমি বলেছি, আমিও রুগী, আমারও পেটে ব্যথা। 


পেটে ব্যথা অবশ্য কারোর নয়। শাশুড়ী মায়ের পেটে পাথর জমেছে বটে, তবে ব্যথা বেদনা কিচ্ছু নেই। ওণার বমি করার অভ্যাস বরাবরের। বারো বছর ধরে দেখছি, মাঝে মাঝেই অমন গা কাঁপিয়ে বমি হয়, উনি একবেলা নিঝুম হয়ে পড়ে থাকেন, বারো ঘন্টা কাটতে না কাটতেই আবির্ভূত হন পুনর্বিক্রমে। আবাসনের দত্ত ডাক্তার বলতেন এর নাম ভার্টিগো। আমরাও জানতাম, মাঝে মাঝে ওণার ভার্টিগোর অ্যাটাক হয়। 


হঠাৎ করে বছর দুয়েক আগে জানা গেল ওণার পাথুরী হয়েছে। ফিরিঙ্গি ভাষায় গল ব্লাডারে জমেছে পাথর কুচি। কে জানে হয়তো সেই কারণেই এত বমির দমক। গল ব্লাডারে অপারেশন তো মামুলী ব্যাপার। পেটে তিনটে ফুটো,ব্যাস-। জনৈক সার্ভিসতুতো দাদার মুখে শুনেছিলাম, তেনার অপারেশনের সময় পাশাপাশি পর্দা দেওয়া বেডে শোওয়ানো হয়েছিল আরো অনেকজন রুগীকে। অতঃপর ঘচাঘচ ফুটো করা, আর টপাটপ পাথর পড়া। ভদ্রলোক মহা ফাজিল, মস্করা করেছিলেন কি না জানি না, তবে আমার মায়ের ক্ষেত্রে দেখেছিলাম সাকুল্যে আধাঘন্টার ব্যাপার। আধঘন্টা কেটে গেছে অনেকক্ষণ হল। খিদে পাচ্ছে। সেই কোন সকালে দুটো বাসি রুটি খেয়ে বেরিয়ে এসেছি উমা আর আমি। শাশুড়ী মাতা তো তাও খাননি। শুধু জল আর ওষুধ। বেচারা বৃদ্ধ শ্বশুরমশাই পত্নীগত প্রাণ,আসতে চেয়েছিলেন হাসপাতালে। আসতে চেয়েছিল দুই পুত্রও। বেজায় ধমকে তাদের নিরস্ত করা গেছে। শ্বশুরমশাই ফুসফুসের সমস্যায় ভোগেন নিত্য। রাস্তায় বেরোন এমনি নিষেধ তাঁর। শৌভিকের আছে ইলেকশন আর অভীক থুড়ি টুকলুর আছে কলেজের ইন্টারনাল এক্সজাম। ফলে আমরা দুই পুত্রবধূই আপাততঃ শাশুড়ি মায়ের একমাত্র সঙ্গী। তাই নিয়ে শুরুর দিকে ভদ্রমহিলার গর্বের অন্ত ছিল না, তিনবার বললেনও সে কথা। 

উনি অবশ্য অমন কথা প্রায়ই বলেন। উমা এবং আমি উভয়ই মনে করি এমন আলোকপ্রাপ্ত মহিলা খুব কম আছে। নারী স্বাধীনতার সংজ্ঞা হয়তো পড়েননি তবে এত বেশী নারীবাদী মহিলা, বিশেষতঃ ঐ বয়সে আমরা আজ অবধি দেখিনি। যেখানে সব শাশুড়িরা বিয়ে হতে না হতেই নাতিনাতনীর মুখ দেখার আব্দার করে, আমাদের শাশুড়ী জরায়ুর ওপর মেয়েদের অধিকার দাবী করেন। বিশ্বাস করেন এবং আমাদের বলেনও যে সন্তান আসবে কি আসবে না, সেই সিদ্ধান্ত নেবার অধিকার শুধু মায়েদের থাকা উচিত। উনি ঘোরতর নারীবাদী বলেই হয়তো ছেলেদের শিখিয়েছেন খাবার টেবিলে বউদের জন্য অপেক্ষা করতে। শিখিয়েছেন প্রয়োজনে বউদের খাবার বেড়ে দিতে। শিখিয়েছেন ঘরের কোন কাজ নিছক মেয়েলি নয়, সব কাজই সবার শেখা এবং করা উচিত। তা রান্না করাই হোক বা বাসন মাজা, বা জামাকাপড় কাচা বা হোক না নিছক শৌচাগার সাফাই। কখনও মাছের পেটি বা বড় পিসটা আলাদা করে ছেলেদের পাতে তুলে দেননি। রান্না করে সাজিয়ে দিয়েছেন টেবিলে,এবার যার ভাগ্যে যা ওঠে। যখনই বলেছি কোন কাজ ঠিক জানি না বা ভালো পারি না, ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়েছেন ভদ্রমহিলা, ‘অত জানার দরকারটাই বা কি?নিজের মত চালিয়ে নিও’। 


যাই হোক বছর দুয়েক আগে আবিষ্কার তো হল যে ওণার উদরে জমছে পাথর, যা সরাতে লাগার কথা মাত্র ঘন্টা আধেক,  কিন্তু সেই আধাঘন্টার ব্যাপার সামলাতে যে কত ঘাটের জল খেতে হল, কি আর বলি। সবাই মিলে ছুটতে হল এই হাসপাতাল থেকে ঐ হাসপাতাল। নামকাওয়াস্তে গল স্টোন তার জন্য বারবার একে অপরের কোর্টে বল ঠেললেন কত যে বিশেষজ্ঞ। প্রত্যেকেরই দাবী ঝুড়ি ঝুড়ি পরীক্ষা। যত রকম পরীক্ষা, ততো রকম জটিলতা। যত রকম জটিলতা ততো নতুন রকম বিশেষজ্ঞ। 


এদিকে শাশুড়ী মায়ের ঐ বমি ছাড়া যে অন্য কোন উপসর্গ ছিল তাও না। বয়স সুলভ হাঁটুর ব্যথা, সামান্য উচ্চ রক্তচাপ আর বেতো হাঁটু। সর্বশেষ বিশেষজ্ঞ বললেন বৃদ্ধার ফুসফুস বেশ ভালোই জখম। যদিও সাদা চোখে ধরা পড়ে না। শ্বাসকষ্টও  তেমন হয় না। অথবা হয়, উনি বুঝতেও পারেন না। দু দুবার ক্যান্সারকে নক আউট করে যাবতীয় মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু শ্বশুরমশাই একাই। শাশুড়ি মাতাকে নিয়ে তেমন ভাবিত থাকি না আমরা। উনি তো অ্যাটলাস, ঝিম মেরে সোফায় বসে, বেতো হাঁটুতে হাত বোলাতে বোলাতে কেবল্ টিভিতে বাংলা সিনেমার চ্যানেল সার্ফ করতে করতেও ধরে রাখেন পুরো বাড়ির ভার। হেঁপো রুগী তো শ্বশুরমশাই। গান্ধারীর মত শাশুড়ি মা যে কবে আপন করে নিয়েছেন বরের ব্যামো, তা জানতেও পারিনি আমরা। জানলাম তখন, যখন ডাক্তার বললেন, অপারেশন করালে নাও ফিরতে পারে জ্ঞান- 


মুলতুবি হয়ে যাওয়া অপারেশন আর পেট ভর্তি পাথর নিয়ে দিব্যি ঘুরতে লাগলেন শাশুড়ি মা। ধাড়সার আহমেদ ডাক্তারের হোমিওপ্যাথি ওষুধ খেয়ে খানিক গলিয়েও ফেললেন পাথর, করোণার মাঝেও রিপোর্টে বেশ কম কম এল সবকিছু। নতুন বছর পড়তেই রাতারাতি গেল বেড়ে সবকিছু। অতঃপর আমার আদরের ছোট দেওর ওরফে অধ্যাপক ডাঃ টুকলুর প্রবল ধমকচমকের পর ভদ্রমহিলা রাজি হলেন অপারেশন করাতে। 

আধাঘন্টার অপারেশনের সময়সীমা কখন যে বেড়ে গেল ঘন্টা সাড়ে তিন কে জানে। নিষেধ সত্ত্বেও গুটি গুটি এসে হাজির হল টুকলু বাবু। উমা বিরক্ত হয়ে বলেই ফেলল, ‘আমাদের ওপর এদের কোন ভরসাই নেই দিদিভাই। দেখছ তো?’ দেখছিলাম তো। দেখছিলাম এমন জাঁদরেল গুরুগম্ভীর অধ্যাপক টুকলুরও মুখটা কেমন শুকনো। দেখছিলাম বাইরের জটিল কঠিন আবরণের ভিতর একটা বছর সাত আটেকের ভীতু ছানা, যার সমস্ত সত্ত্বা জুড়ে রয়েছেন ছবির ভদ্রমহিলা।


অপারেশন শেষ হতে বেরোল প্রায় সাতখানা জব্বর পাথর। একনজরে দেখলে মনে হবে বুঝি ডুমো ডুমো করে কাটা সুপারি বা চৌকো করে কাটা পেস্তা। এত পাথর নিয়ে ভদ্রমহিলা এতদিন টিকে ছিলেন কি করে ভগবান জানেন। ডাক্তার জানালেন, সমস্ত জটিলতার মুখে ছাই দিয়ে দিব্যি আছেন ভদ্রমহিলা। জানালেন কালকেই ছুটি-। 


উমার সাথে খোদ শ্বশুরমশাই গিয়েছিলেন প্রিয়তমা স্ত্রীকে বাড়ি আনতে। ছবিতে যতই গোবেচারা নির্বিরোধী মনে হোক না কেন, বাড়ি আসার সাথে সাথেই নিজ মূর্তি ধরেছেন ইনি। উড়িয়ে দিয়েছেন আয়া মাসি রাখার প্রস্তাব। কাজের দিদিকে কটা দিন একটু বেশী থাকতে বলে বেজায় ধমক খেয়েছেন শ্বশুরমশাই। দুদিন তাও একটু জবুথবু ছিলেন, আজ সকাল থেকে পূর্ণোদ্যমে যাবতীয় সাংসারিক কাজে ব্যাপৃত হয়েছেন ভদ্রমহিলা। হতাশ শ্বশুরমশাই অসহায় ভাবে  বিড়বিড় করে বললেন, ‘কি করি বলো তো?’ কিচ্ছু করার নেই, সবই অতসী দেবীর মহিমা। মোদ্দা কথা শাশুড়িমা জিন্দাবাদ। এমন ভাবেই চলুক না জীবন ছন্দবিহীন ছন্দবদ্ধ হয়ে- কখনও টক আর অনেকটা মিষ্টি নিয়ে।