অনির ডাইরি ২৫শে ফেব্রুয়ারি, ২০২১
রিক্সামামা আর রিক্সা চালায় না। প্রথম প্রথম যখন মেয়ে নিয়ে একা থাকতে শুরু করেছিলাম তখন এমনি অনেক সম্পর্ক গড়েছিলাম আমি আর তুত্তুরী। জানতে পারলে হুলো বেড়ালের মত এখুনি ঘ্যাঁও করে উঠবে শৌভিক, ‘একা কেন? আমি কি আসতাম না?’ আসত বৈকি। ব্লক সামলে সুযোগ পেলেই পালিয়ে আসত। যখন আসত মুটে মজুরের মত দোকান বাজার করে দিয়ে যেত। বাকি দিনগুলোয় আপনি অার কপনি ভরসা।
তাতে যে খুব একটা অসুবিধে হত তেমন নয়,সমস্যা হত তুত্তুরী সর্দিজ্বর বাঁধালে। কেমন যেন ডিনায়ালে ভুগতাম আমি, হয়তো আজও ভুগি। ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে ভাবলেই নার্ভাস ব্রেকডাউন হত। এতো আর আমাদের হাওড়া নয় যে, গৌতম কাকুর চেম্বারে গিয়ে বলব ,‘কাকু মেয়েটা ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ করছে। দু পুরিয়া ওষুধ দিন তো। ’ ঠাকুমা থেকে তুত্তুরী, চার প্রজন্মের যাবতীয় ছোটবড় অসুখে ডাঃ গৌতম সিংহরায় ছিলেন সাক্ষাৎ ধন্বন্তরী। পেশায় ছিলেন হোমিওপ্যাথ ডাক্তার। বাড়ির গ্যারেজের ওপরে ওণার ছোট্ট ডিসপেনসারি, সবসময় গমগম করত রুগীদের ভিড়ে। রোগ নির্ণয়ের কেমন যেন সহজাত প্রতিভা ছিল ভদ্রলোকের, এমনকি যেসব ব্যধির চিকিৎসা ওণার আয়ত্বের বাইরেও, তাও কেমন একপলকে নাড়ি টিপে ধরে ফেলতেন গৌতম কাকু।
রিক্সার ঝাঁকানিতে সম্বিত ফিরে পেয়ে কিঞ্চিৎ লজ্জিত লাগল। বয়স বাড়ার প্রধান লক্ষণই বোধহয় এই স্মৃতিমেদুরতা। লকডাউনে রিক্সা বেচে জোগাড়ের কাজ নিয়েছে রিক্সামামা। তবে স্বীকার করে না। ফোন করলেই বলে ‘আচ্ছা বওদি। আমিই থাকব। ’ থাকেও। অন্য রিক্সায় তুলে দিয়ে আবার কাজে ফিরে যায়। এদিকে আজকাল ই-রিক্সাই বেশী। চাপলেই দৌড়য়, ভর দুপুরে মেয়ের ইস্কুলে যেতে জাস্ট কান্না পাচ্ছে। কিন্তু নিরুপায়। মেয়ের ইস্কুলের ফরমান ওপরওয়ালীর ফরমানের থেকেও ভয়ঙ্কর। কি সব অলিম্পিয়াডের সার্টিফিকেট এবং মেডেল দেবে নাকি।
অমন অলিম্পিয়াডে ফি বছর বসে তুত্তুরী। কোনবারই বলার মত কিছু হয় না। না হলেই বেশী খুশি হই আমি। যেটাতে উত্তীর্ণ হয়, সেটার পরের ধাপের জন্য আবার নিয়ে যেতে হয় অন্য ইস্কুলে। যে মহা যাতনার। প্রতিটি পরীক্ষার জন্য মোটা ফি দিতে পাঁজর টনটন করে, কিন্তু না দিলেও নয়। কি যেন একটা পরীক্ষায় জেদ করে ফি দিইনি একবার, রবার্ট ব্রুস একজন সম্মানীয় ব্যক্তি বটে, তবে ওণার মত সপ্তবার্ষিকী ফেল করার পরিকল্পনা না করাই শ্রেয়। সেদিন অফিস থেকে ফেরার পর করুণ মুখে বলেছিল তুত্তুরী, ‘জানো মা, আজ আমি একা বসেছিলাম ক্লাশে। সবাই পরীক্ষা দিতে গিয়েছিল। ’ সেই থেকে নাক কান মুলেছি, যা বাবা ফেলই করে আয়। মনটা তো খুশি খুশি থাকুক।
ইস্কুলে বিরাট লাইন। কিসের মেডেল কি বৃত্তান্ত কিছুই না জানা বাবামায়েরা রীতিমত ভোম্বল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অ্যাসেম্বলী হল থেকে কেউ বেরিয়ে এলেই ছেঁকে ধরছে তাকে, ‘মেডেল পেলে?’ যা বুঝলাম মেডেলের সংখ্যা সীমিত। ফলে উত্তর প্রত্যাশিত। ওদিকে বাড়িতে তুত্তুরী রূপার মেডেল পাবে ভেবে নেচেই চলেছে। রূপা নাকি সোনার থেকেও বেশী ঝলমলে।
অবস্থা দেখে মায়াই লাগল, আহাঃ বড় আশা করেছিল গো। আজ অবধি একটাও মেডেল পায়নি মেয়েটা। বন্ধুরা অনেকেই পেয়েছে, প্রতিবার গল্প শোনায় মেয়েটা। ভাবতে ভাবতে মনে পড়ল , আরেঃ আমি তো জীবনে কোন মেডেল পাইনি। থুড়ি পেয়েছি প্রচুর, অর্জন করিনি একটাও।
মেডেল কিছু পেত বটে আমার ছোটদা। কি ভালো যে আঁকত ছোটদা। যবে থেকে পেন্সিল ধরতে শিখেছে, কোন প্রতিযোগিতায় দ্বিতীয় হয়নি। এখনও আঁকে বটে, তবে আজকালকার ছবিগুলো বড় বেশী আঁতেল-আঁতেল মার্কা হয়,কিচ্ছু বুঝি না। ভিন্ন বছর হলেও, একই দিনে জন্ম তাই ছন্দ মিলিয়ে নাম-‘গুনু আর ঝুনু।’ শ্রীমাণ গুনু সত্যিই ভয়ানক গুণের আকর ছিলেন। ততোধিক নির্গুণ ছিলাম আমি।
তবে ভাইফোঁটার দিনটা এলেই পাল্টে যেত সব হিসেব। সেদিন সম্বৎসরের মেডেল গুলো পরম যত্নে আমার হাতে তুলে দিত ছোটদা।
ভাইফোঁটায় ছোটদার দেওয়া উপহারের জন্য মুখিয়ে বসে থাকতাম আমি। পুরানো পিচবোর্ডের বাক্সকে সুন্দর করে রঙ করে, রাংতা দিয়ে মুড়ে তার মধ্যে যত্ন করে রাখা মেডেলের পাশে থরে থরে সাজানো থাকত চকলেট। ক্যাডবেরীর যতরকম চকলেট পাওয়া যেত সব দুএকটা করে সাজিয়ে বাকিটা আমুল,নেসলে আর কফি বাইট দিয়ে ঠাসা থাকত। উফঃ সেই সোনালী বাক্স খোলার উন্মাদনা জীবনে ভুলব? ভাবতে ভাবতেই মনে পড়ল, এত চকলেট কেনার পয়সা কোথা থেকে পেত ছোটদা? কি আশ্চর্য! এতদিন এই চিন্তাটা কেন মাথায় আসেনি? ছাপোষা মধ্যবিত্ত আরএমএসের কর্মী বড় মেসোমশাইয়ের টানাটানির সংসারে কেউ হাতখরচ পেত বলে কখনও শুনিনি। অনেক কষ্টে তিন পিতৃহীন শ্যালিকা আর চার পুত্রকে মানুষ করেছিলেন স্বর্গীয় বড় মেসোমশাই। পেরেছিলেন শুধু অদম্য জেদ আর অপরিসীম দুঃসাহসে। তাহলে? অত চকলেট কেনার টাকা তুমি পেতে কোথায় ছোটদা?
দুখানি পার্টিসিপেশন সার্টিফিকেট বগলে রিক্সায় উঠেই ফোন করলাম ছোটদাকে, ‘কি ভাবে দিতে ছোটদা?নিজের কি কি প্রয়োজন না মিটিয়ে জমাতে পয়সা? শুধু আমার জন্য?’ প্রশ্ন করতে গিয়ে চিকচিকিয়ে উঠল চোখের কোণা, এত ভালোবাসা দিয়ে গেছে জীবন, অথচ আমি বুঝিনি?ফোনের ওপাড়ে ছোটদার উদাত্ত হাসি, ‘যা যা বাড়ি যা। তুত্তুরীকে যেন ঠ্যাঙাস না। যা ঠ্যাঙাড়ে তুই।’ কি প্রশ্নের কি জবাব। মনে পড়ে গেল, এই কারণে, শুধু কারণেই উদোম হাতাহাতি হত এই ভদ্রলোকের সঙ্গে। সবসময় লুকোচুরি মাইরি। মহা বাজে লোক।
অনির ডাইরি ২১শে ফেব্রুয়ারি, ২০২১
#শুভভাষাদিবস
সাত সকালে চৈতালী বলল, ‘শোন অাজ ভাষা দিবস, জম্পেশ করে একটা লেখা নামিয়ে ফেল-’। রসাল আলাপচারিতার ফাঁকে এমন বিদঘুটে আব্দার শুনে শঙ্কর শেঠের কথা মনে পড়ে গেল। তাঁর আদরের নন্দন কোষ্ঠকাঠিন্যে ভুগত এবং শতানুরোধেও সক্কাল সক্কাল প্রাতকৃত্য করতে রাজি হত না, তাই শঙ্কর বাবু করেছিলেন কি, পরপর দিন সাত আটেক ভোরভোর শিশু পুত্রকে ঘুম থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে শৌচাগারে ভরে দিতেন এবং লাঠি নিয়ে দরজায় বসে থাকতেন। পাক্কা গব্বর ইস্টাইলে,‘ হয় ইয়ে কর, নয় লাঠি খা’। আরে লেখাপত্তর হল ইয়ে মার্কা ব্যাপার স্যাপার, অমন হুকুম দিলেই হয়? প্রসঙ্গতঃ দ্বিতীয় ইয়েটা কিন্তু প্রথম ইয়ে নয়। বুইলেন কি না- একটা সত্যিই ইয়ে আর দ্বিতীয়টা আঁতেল মার্কা আর কি-
তো যা বলছিলাম, আমি মনে, প্রাণে এবং ধনে ঘোরতর বাঙালী। বঙ্গের রাণী দয়া করে বেতন দেন, তাই মোর সংসার চলে। তবে আমার থেকেও কড়া বাঙালী হল মোর বাপ। যার কাছে আমার বাঙালিয়ানার হাতে খড়ি। রাত নটা নাগাদ, টিভির সামনে বসে, আধ কি সিকিখানা হিন্দি সিনেমা দেখতে দেখতে, চামচে করে চাট্টি শুকনো মুড়ি আর কড়াইশুঁটি খেতে খেতে, মায়ের কাছে এক কাপ চায়ের উষ্ণ প্রেম প্রার্থনা করতে করতেও বাবা হিসেব করে যায়, ‘একটা ষোল আনা বাঙালী(রাণী মুখার্জী), একটা আট আনা বাঙালী (অভিষেক বচ্চন), একটা চার আনা বাঙালী (ঋত্বিক রোশন। ওণার পিতামহী বঙ্গনারী ছিলেন কিনা) আর একটা সাড়ে বারো পয়সার বাঙালী (করিনা কাপুর। তাঁর প্রপিতামহ কোন কালে কলকাতাবাসী ছিলেন-)।’ উফঃ কত্ত বাঙালী।
নাঃ অধম এখনও ঐ স্তরীয় বাঙালী হয়ে উঠতে পারেনি, তবে ঐ পথেই এগোচ্ছি। দিনদিন আরো আরো বেশী করে বাঙালী হয়ে উঠছি। উল্টো দিকের লোকটা খুব বেশী ইংরেজিতে পটরপটর না করলে বাঙলাতেই কথা বলি। উল্টোদিকের ব্যক্তিটি যদি আমার মাতৃভাষা শুনে , ‘কেয়া’ বলে তো আমিও গোবেচারার মত হাত পা নেড়ে বোঝাই, ‘হিন্দি ভালো নেহি বুঝতা। বাংলায় বোলিয়ে নয়তো ইংরেজি ভি চলেগা।’ চিঠিপত্রে দস্তখৎ তো বাংলা হরফেই করি। ঊর্ধ্বতন কতৃপক্ষকে লিখতে কিঞ্চিৎ সঙ্কোচ নয়, কিন্তু নিম্নতন কর্মীবন্ধুদের যখন চিঠি করি, বাঙলা ভাষাতেই করি। নোটিশ দিলেও বাংলায় দেবার জন্য পীড়াপীড়ি করি, ফলতঃ দশ মিনিটের চিঠি লিখতে ঘন্টা আধেক দাঁত কিড়মিড় করতে হয় এবং নিজের চিঠি নিজেকেই টাইপ করতে হয়। সর্বোপরি নির্ভেজাল বাংলায় গালাগালি দিই।
এতদসত্ত্বেও খুঁৎ তো থেকেই যায়। আমি হইচই দেখি না। তিলোত্তমা বা তসলিমা ছাড়া সাম্প্রতিক বাংলা সাহিত্য পড়ি না। গানও বেশীর ভাগ সময় অবাংলা ভাষাতেই শুনি।মাসটা ধরতে পারলেও বাংলা তারিখের হিসেব রাখি না। খাবারদাবারের বেলাতেও আমার বিজাতীয় ভিনদেশীয় খাবারে বড় লোভ-। উপরিউক্ত সবকটি কারণের জন্যই আমি যৎপরনাস্তি লজ্জিত। একুশে ফেবুর ফেবুসমাজ কি আমায় মেনে নেবে Chaitali?
শেষবিচারে আমি বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের এক অতি নগন্য কিন্তু অতি গর্বিত সদস্যা। দেশস্বাধীন- ভাষাও স্বাধীন। যা খুশি বলুন না মশাই, ভাষা তো শুধু মনের ভাব প্রকাশের মাধ্যম মাত্র। কানে বন্দুক ঠেকিয়ে আপনাকে না বাঙালি করা যাবে, না অবাঙালি। এতই যদি সহজ হত ব্যাপারটা, তাহলে দেশভাগের এত বছর পরেও পদ্মা পেরিয়ে আসা মানুষগুলো আজও সুযোগ পেলেই নিজেদের হারিয়ে যাওয়া পরগণার কথ্য ভাষায় বাক্যালাপ করত না। ভাষার প্রতি প্রেম থাকুক, তবে ভাষা নিয়ে একদিনের গুণ্ডামি না হয় নাই করলাম। ভাষা তো স্থবির নয়, ভয়ানক জঙ্গম। ভিন্ন ভাষা বা আঙ্গিকের দৌরাত্ম্যে থোড়াই হারিয়ে যেতে পারে এমন ভাষা? বিজ্ঞজন যাই ভবিষ্যৎ বাণী করুন না কেন, ভালো করে কান পেতে শুনুন কি কয় আপনার হৃদয়?
বেঁচে থাক মোদের ভাষা শতায়ু- সহস্রায়ু হয়ে- বাহুল্যর খোলস ঝেড়ে ফেলে- আবেগে ভালোবাসায় পুষ্ট হোক দিনে দিনে। চলুন, শুভ ভাষাদিবস। ভালো থাকুন, ভালোবাসুন আর প্রাণের ভাষায় কথা বলুন। মাতৃভাষা জিন্দাবাদ, আমরাও, আপনারও, সবার ভাষা জিন্দাবাদ।
অনির ডাইরি ১৯শে ফেব্রুয়ারি, ২০২১
‘আজ পারলে একটু তাড়াতাড়ি ফিরো মা-’। গ্রীলের ওপাশে কন্যার করুণ মুখ ঘোরতর ব্যস্ত আপিসটাইমকেও থামিয়ে দেয় এক লহমায়। পলকে পিছিয়ে নিয়ে যায় কোন সে সাদাকালো দশকে। সময়ের দর্পণে যেখানে ফুটে ওঠে তুত্তুরীর সমবয়সী চেনাঅচেনা কোন বালিকার সিপিয়া প্রতিবিম্ব। দেড়শো বছরের পলেস্তারা খসে পড়া বুড়ো বাড়িটার দক্ষিণ পশ্চিমের বারন্দা থেকে এমনি করেই কাতর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকত, যে। বিশাল বার্মাটিকের সদর দরজা ঠেলে অাপিস বেরিযে যাওয়া লোকটার দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলত, ‘একটু তাড়াতাড়ি ফিরো বাবা। এখনও বাকি কত্ত কাজ-’। সোচ্চারে বলতে ভয় পেত, পিছু ডাকতে ভয় পেত সে।
দুই যুগের দুই কন্যার যাবতীয় উদ্বেগ তথা উৎকণ্ঠার মধ্যমণি একজনই, সপ্তাহের গাড়ি বাঁক নিলেই যে এসে পড়বেন তিনি। এমন অগোছালো ধূলিমাখা আবহে কি ভাবে বরণ করা হবে তাঁকে? শুধুই তাঁর জন্য যুদ্ধকালীন ব্যস্ততায় গোছাতে হবে, সাফাই করতে হবে ঘরদুয়ার। কিনে আনতে হবে ষোড়শ উপাচার, তারপর সাজাতে হবে মনের মত করে। পাততে হবে মঙ্গলঘট, আঁকতে হবে স্বস্তিকা, দুয়ারে বসাতে হবে কলাগাছ আর সবশেষে কাঁপা কাঁপা হাতে বাইরের দরজার সামনে আঁকতে হবে তাঁর পদচিহ্ন, ঠিক যে ভাবে মা লক্ষ্মীর পদচিহ্ন আঁকত ঠাকুমা, ঢুকবে কিন্তু বের হবে না। অদূরে মিলনী মাঠে বসন্তবিলাপী সুর ধরতেন আরতি মুখোপাধ্যায় ‘ধরেছি আর তোমায় ছাড়ব না-’।
ঘরসাফাই দিয়ে শুরু হয় বাগদেবীর আগমন পর্ব। মা নিষেধ করা সত্ত্বেও নিঝুম দুপুরে স্কচব্রাইট আর বাসনমাজা সাবান দিয়ে দেওয়াল ঘষে তুত্তুরী। মুছে ফেলার চেষ্টা করে দেওয়াল জোড়া অগুনতি ছবি, হাতের ছাপ, ‘মাসি খুব বাজে’ বা ‘আই লাভু মা’ মার্কা ছুটকো বার্তা। কোথাও কোথাও ভুলভাল অঙ্কও কষে রেখেছে তুত্তুরী, দেখতে পেলেই কান ধরে ওঠবোস করায় বাবা, দেওয়াল নষ্ট করার জন্য নয় যোগ/ বিয়োগ বা গুণে ভুল করার জন্য।
কন্যার ঘর সাফাই করার মরিয়া প্রচেষ্টা দেখেও রাগতে পারে না তুত্তুরীর মা। মনে পড়ে যায় পলেস্তারা খসা, সাবেকী ঠাকুরঘরের কথা। ভিটের মূল কাঠামোর বাইরে টালির চালের ঠাকুরঘরটা বিশেষ রূপে বানানো হয়েছিল প্রপিতামহের জননী স্বর্গীয়া গোলাপসুন্দরী দেবীর জন্য। ঘরের লাগোয়া চকচকে কালো রোয়াকটা ছিল তাঁর গোঁসা ঘর বুঝি। গোঁসা হলেই আঁচল বিছিয়ে শয্যা নিতেন তিনি। কলকাতা তখনও ভারতের রাজধানী। অনুশীলন সমিতির উৎপাতে বঙ্গভঙ্গের চিন্তা সদ্য ঢুকছে গোরাদের গোবরভরা মস্তিষ্কে।
ঠাকুরঘরের লাগোয়া আমগাছটি অবশ্য নবীন। পাঁচ সাত রকম আমের আঁঠি থেকে গজানো একগুচ্ছ চারা মিলে তৈরী করা মহীরুহের এক একটা আমের সোয়াদ ছিল এক একরকম। সবই চিনি গোলা যদিও। গ্রীষ্মকালে টুপটাপ ঝরে পড়া আমে ফি বছর ভাঙত টালি। আম- কাঁঠাল আর পেয়ারার লোভে হামলা চালানো হনুমানের দলও ভাঙত কিছু টালি। বর্ষাকালে চুঁইয়ে নামত সজলধারা। দেওয়ালগুলোও ছিল ড্যাম্প ধরা। আয়নার মত চকচকে কৃষ্ণবর্ণ মেঝের মুখে শতেক বলিরেখা।
এহেন ঠাকুরঘরকেও কেমন যেন রাজপ্রাসাদ বানিয়ে ফেলত বাবা রাতারাতি। মায়ের বাতিল ঝলমলে ব্যাঙ্গালোর সিল্ক দিয়ে রচিত হত পিছনের চালচিত্র। অমনি কোন শাড়ি দিয়েই মাথায় টাঙানো হত চাঁদোয়া। দীর্ঘ দুই তিন মাস ধরে জমানো সিগারেটের খোলের পাহাড় থেকে রাংতা বার করতে বসতাম আমরা তিন খুড়তুতো জেঠতুতো ভাইবোন। আপিস ফেরতা ক্লান্ত হাতে নিটোল ফুল কাটত বাবা। টিভি সিরিয়াল দেখার ফাঁকেফোকরে অ্যালুমিনিয়ামের বাটিতে ময়দা গুলে স্টোভে ফুটিয়ে আঠা বানিয়ে দিত জ্যাঠাইমা। অতঃপর ঠাকুর ঘর জুড়ে টুপটাপ ফুটে উঠত সোনালী রূপালী ফুলের দল। বিরাট উঠোনের কোণায় কোণায় ঝুলত লাল-নীল-সবুজ শিকলি।
ফেলে আসা সময়টাকে আঁকড়ে ধরতে আপিস ফেরতা পাঁচরঙা মার্বেল পেপার কিনে আনে তুত্তুরীর মা। রান্নাঘরের ভোঁতা ছুরি দিয়ে কাগজ কেটে ফেভিস্টিক দিয়ে মেয়েকে শিকলি বানানো শেখানোর সময়, কেন জানি না গলার কাছটা ব্যথা ব্যথা করে তুত্তুরীর মায়ের। কাগজের খসখস শব্দের আবডালে ফিসফিসিয়ে কাকে যেন বলে তুত্তুরীর মা, 'দেখো বাবা, আমি আজ তোমার ভূমিকায়-'।
নামভূমিকায় অভিনয় হয়তো করা যায়, কিন্তু আসলকে বোধহয় কোনদিনই ছুঁতে পারে না নকলনবীশের দল। গাঁদাফুলের মালা, আম্রপল্লব, পঞ্চগুঁড়ি, পঞ্চশস্য, পঞ্চরত্ন, চাঁদমালা কিনতে গিয়ে তাই বোধহয় হাত বাড়িয়ে সেই চেনা, চির নির্ভরশীল হাতটাই খোঁজে তুত্তুরীর মা। জ্বলে যাওয়া ফর্সা রঙা হাতটায় বারো মাস থাকে সস্তা সিগারেটের গন্ধ। কত বছর পেরিয়ে যায় এই গন্ধ আর এই স্মৃতি গুলো কেন যে যুগান্তরেও থেকে যায় অবিকৃত?
পাঁচালি খুলে ভুলভাল উচ্চারণে মন্ত্র উচ্চারণে, দেবনাগরী অলিগলিতে হোঁচট খেতে খেতে, করজোড়ে বসে থাকা ভক্তিমতী কন্যার বিনম্র আঁখিপল্লবে, সন্ধ্যাপ্রদীপের কম্পমান শিখায় কি যে খোঁজে তুত্তুরীর মা। চোখ বন্ধ করে বসে থাকা ভক্তিমতী তুত্তুরীর মধ্যে হয়তো সেই সিপিয়া রঙা মেয়েটা আর সাদাকালো সময়টাকেই খোঁজার চেষ্টা করে তুত্তরীর মা। সময় বড় নির্মম, পট ঠিক রাখলেও কেমন বদলে বদলে যায় কুশীলবরা। আজ বাবার জুতোয় পা রেখেছি আমি, কাল হয়তো অন্য কেউ থাকবে আমার ভূমিকায়। পড়ে থাকবে শুধু একমুঠো স্মৃতিমেদুরতা।
অনির ডাইরি১১ই ফেব্রুয়ারি ২০২১
অতসী দেবী জিন্দাবাদ-
ভদ্রমহিলা আপাততঃ বেশ ভালো আছেন। অবশ্যি থাকারই কথা, প্রাকবিবাহ যুগ থেকে শুনে আসছি ওণার অতিমানবিক শক্তি তথা কর্মদক্ষতার উপাখ্যান। বয়স কালে ভদ্রমহিলা শুধু যে অসীম শক্তিশালিনী ছিলেন তাই নয়, যে কোন গৃহকর্মে ওণার পারিপাট্য তথা নৈপুণ্য প্রবাদপ্রতিম। এ হেন ভদ্রমহিলা খোদ যখন আমায় বধূ হিসেবে বরণ করে এনেছিলেন তখনই আমার গর্ভধারিণী বলেছিলেন, ‘আমার মেয়েটা ন্যাদোশ। ঢ্যাঁড়শ এবং হদ্দ কুঁড়ে। সবথেকে বড় কথা ভয়ানক নিদ্রাকাতর।’ অর্থাৎ বহির্রঙ্গ দেখে বিমোহিত হবেন না। জবাবে উনি বলেছিলেন, ‘আমার ছেলেটা আবার ভয়ানক কর্মঠ। একজন যদি গৃহকর্মে ব্যাপৃত থাকে, আরেকজনকেও তখন উঠতেই হবে। আর অপ্রয়োজনে ওঠার দরকারটাই বা কি?’
ভদ্রমহিলা ওমনি। চেনা শাশুড়ির ছকে ফেলা বেশ মুস্কিল।আর পাঁচটা পুত্রবধূর মতোই আমি আর উমা বেশ সমীহ করে চলি আমাদের শাশুড়ি মাতাকে। সমীহ ছাড়ুন, পাতি বাংলায় বেশ ভয় পাই এণাকে। শ্বশুরমশাই অবসর প্রাপ্ত জাঁদরেল আমলা হলেও তাঁর সঙ্গে তর্ক করা যায়, ভুলো স্বভাব নিয়ে খিল্লি করা যায়, ফোকটে দেওয়া যায় খানিক জ্ঞানও,এমনকি ক্ষেত্র বিশেষে ধমকানোও যায়। কিন্তু এই ভদ্রমহিলার ভয়ে রীতিমত কম্পমান আমরা।
যাই হোক ফিরে যাই ভদ্রমহিলার ভালো থাকার গপ্পে, গত পরশুই ওণার উদরে তিনখানি ফুটো করেছেন ডাক্তারবাবু, জনৈক সুপার স্পেশিয়ালিটি হাসপাতালের লবিতে একাকী সেদিন বসে বসে ভাবছিলাম, প্রতিদিন কত মানুষই না অসুস্থ হন। ঘোরতর কর্মব্যস্ত দিনেও কি মারাত্মক ভিড়ের দৌরাত্ম্য। পৌনে একঘন্টারর মধ্যেই জনা সতেরো বয়ঃজ্যেষ্ঠ ব্যক্তি এবং বেতো মহিলাকে আসন ছাড়লাম। আপদ করোণার জন্য চেয়ারের সংখ্যা অসম্ভব সীমিত। এদের নিয়ম রুগী পিছু মাত্র একজন সঙ্গী কেবল হাসপাতালে ঢুকতে পারে। আর ডাক্তারের কাছে বা বিলিং সেকশনে অনুমোদন পায় কেবল একজন। একটু আগেই জনৈক বৃদ্ধ চিৎকার করছিলেন, ‘এখানে কত রুগীর সঙ্গে চারজন করে লোক ঢুকছে দেখতে পারছেন না আপনারা?’ বৃদ্ধকে তাঁর বৃ্দ্ধার থেকে আলাদা করার চেষ্টা করছিল মহিলা নিরাপত্তা রক্ষী। তাই এই ক্ষোভ। পাশ থেকে উমা ফিসফিস করে বলল, “কাল এই নিয়ে এই এক বৃদ্ধ দম্পতি কি ঝগড়া করছিল দিদিভাই। বৃদ্ধ বলছিল ‘আমি যাব’ আর বৃদ্ধা বলছিল, ‘তুমি ঢ্যাঁড়শ। কিচ্ছু মনে করে বলতে পারো না। আমি যাব।’“ অন্য সময় হলে হয়তো হাসতাম, কিন্তু সেদিন তো বেআইনি কাজ করেছি আমরা দুজনেও। একজন ঢুকেছে শাশুড়ি মায়ের সাথে আর আমি বলেছি, আমিও রুগী, আমারও পেটে ব্যথা।
পেটে ব্যথা অবশ্য কারোর নয়। শাশুড়ী মায়ের পেটে পাথর জমেছে বটে, তবে ব্যথা বেদনা কিচ্ছু নেই। ওণার বমি করার অভ্যাস বরাবরের। বারো বছর ধরে দেখছি, মাঝে মাঝেই অমন গা কাঁপিয়ে বমি হয়, উনি একবেলা নিঝুম হয়ে পড়ে থাকেন, বারো ঘন্টা কাটতে না কাটতেই আবির্ভূত হন পুনর্বিক্রমে। আবাসনের দত্ত ডাক্তার বলতেন এর নাম ভার্টিগো। আমরাও জানতাম, মাঝে মাঝে ওণার ভার্টিগোর অ্যাটাক হয়।
হঠাৎ করে বছর দুয়েক আগে জানা গেল ওণার পাথুরী হয়েছে। ফিরিঙ্গি ভাষায় গল ব্লাডারে জমেছে পাথর কুচি। কে জানে হয়তো সেই কারণেই এত বমির দমক। গল ব্লাডারে অপারেশন তো মামুলী ব্যাপার। পেটে তিনটে ফুটো,ব্যাস-। জনৈক সার্ভিসতুতো দাদার মুখে শুনেছিলাম, তেনার অপারেশনের সময় পাশাপাশি পর্দা দেওয়া বেডে শোওয়ানো হয়েছিল আরো অনেকজন রুগীকে। অতঃপর ঘচাঘচ ফুটো করা, আর টপাটপ পাথর পড়া। ভদ্রলোক মহা ফাজিল, মস্করা করেছিলেন কি না জানি না, তবে আমার মায়ের ক্ষেত্রে দেখেছিলাম সাকুল্যে আধাঘন্টার ব্যাপার। আধঘন্টা কেটে গেছে অনেকক্ষণ হল। খিদে পাচ্ছে। সেই কোন সকালে দুটো বাসি রুটি খেয়ে বেরিয়ে এসেছি উমা আর আমি। শাশুড়ী মাতা তো তাও খাননি। শুধু জল আর ওষুধ। বেচারা বৃদ্ধ শ্বশুরমশাই পত্নীগত প্রাণ,আসতে চেয়েছিলেন হাসপাতালে। আসতে চেয়েছিল দুই পুত্রও। বেজায় ধমকে তাদের নিরস্ত করা গেছে। শ্বশুরমশাই ফুসফুসের সমস্যায় ভোগেন নিত্য। রাস্তায় বেরোন এমনি নিষেধ তাঁর। শৌভিকের আছে ইলেকশন আর অভীক থুড়ি টুকলুর আছে কলেজের ইন্টারনাল এক্সজাম। ফলে আমরা দুই পুত্রবধূই আপাততঃ শাশুড়ি মায়ের একমাত্র সঙ্গী। তাই নিয়ে শুরুর দিকে ভদ্রমহিলার গর্বের অন্ত ছিল না, তিনবার বললেনও সে কথা।
উনি অবশ্য অমন কথা প্রায়ই বলেন। উমা এবং আমি উভয়ই মনে করি এমন আলোকপ্রাপ্ত মহিলা খুব কম আছে। নারী স্বাধীনতার সংজ্ঞা হয়তো পড়েননি তবে এত বেশী নারীবাদী মহিলা, বিশেষতঃ ঐ বয়সে আমরা আজ অবধি দেখিনি। যেখানে সব শাশুড়িরা বিয়ে হতে না হতেই নাতিনাতনীর মুখ দেখার আব্দার করে, আমাদের শাশুড়ী জরায়ুর ওপর মেয়েদের অধিকার দাবী করেন। বিশ্বাস করেন এবং আমাদের বলেনও যে সন্তান আসবে কি আসবে না, সেই সিদ্ধান্ত নেবার অধিকার শুধু মায়েদের থাকা উচিত। উনি ঘোরতর নারীবাদী বলেই হয়তো ছেলেদের শিখিয়েছেন খাবার টেবিলে বউদের জন্য অপেক্ষা করতে। শিখিয়েছেন প্রয়োজনে বউদের খাবার বেড়ে দিতে। শিখিয়েছেন ঘরের কোন কাজ নিছক মেয়েলি নয়, সব কাজই সবার শেখা এবং করা উচিত। তা রান্না করাই হোক বা বাসন মাজা, বা জামাকাপড় কাচা বা হোক না নিছক শৌচাগার সাফাই। কখনও মাছের পেটি বা বড় পিসটা আলাদা করে ছেলেদের পাতে তুলে দেননি। রান্না করে সাজিয়ে দিয়েছেন টেবিলে,এবার যার ভাগ্যে যা ওঠে। যখনই বলেছি কোন কাজ ঠিক জানি না বা ভালো পারি না, ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়েছেন ভদ্রমহিলা, ‘অত জানার দরকারটাই বা কি?নিজের মত চালিয়ে নিও’।
যাই হোক বছর দুয়েক আগে আবিষ্কার তো হল যে ওণার উদরে জমছে পাথর, যা সরাতে লাগার কথা মাত্র ঘন্টা আধেক, কিন্তু সেই আধাঘন্টার ব্যাপার সামলাতে যে কত ঘাটের জল খেতে হল, কি আর বলি। সবাই মিলে ছুটতে হল এই হাসপাতাল থেকে ঐ হাসপাতাল। নামকাওয়াস্তে গল স্টোন তার জন্য বারবার একে অপরের কোর্টে বল ঠেললেন কত যে বিশেষজ্ঞ। প্রত্যেকেরই দাবী ঝুড়ি ঝুড়ি পরীক্ষা। যত রকম পরীক্ষা, ততো রকম জটিলতা। যত রকম জটিলতা ততো নতুন রকম বিশেষজ্ঞ।
এদিকে শাশুড়ী মায়ের ঐ বমি ছাড়া যে অন্য কোন উপসর্গ ছিল তাও না। বয়স সুলভ হাঁটুর ব্যথা, সামান্য উচ্চ রক্তচাপ আর বেতো হাঁটু। সর্বশেষ বিশেষজ্ঞ বললেন বৃদ্ধার ফুসফুস বেশ ভালোই জখম। যদিও সাদা চোখে ধরা পড়ে না। শ্বাসকষ্টও তেমন হয় না। অথবা হয়, উনি বুঝতেও পারেন না। দু দুবার ক্যান্সারকে নক আউট করে যাবতীয় মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু শ্বশুরমশাই একাই। শাশুড়ি মাতাকে নিয়ে তেমন ভাবিত থাকি না আমরা। উনি তো অ্যাটলাস, ঝিম মেরে সোফায় বসে, বেতো হাঁটুতে হাত বোলাতে বোলাতে কেবল্ টিভিতে বাংলা সিনেমার চ্যানেল সার্ফ করতে করতেও ধরে রাখেন পুরো বাড়ির ভার। হেঁপো রুগী তো শ্বশুরমশাই। গান্ধারীর মত শাশুড়ি মা যে কবে আপন করে নিয়েছেন বরের ব্যামো, তা জানতেও পারিনি আমরা। জানলাম তখন, যখন ডাক্তার বললেন, অপারেশন করালে নাও ফিরতে পারে জ্ঞান-
মুলতুবি হয়ে যাওয়া অপারেশন আর পেট ভর্তি পাথর নিয়ে দিব্যি ঘুরতে লাগলেন শাশুড়ি মা। ধাড়সার আহমেদ ডাক্তারের হোমিওপ্যাথি ওষুধ খেয়ে খানিক গলিয়েও ফেললেন পাথর, করোণার মাঝেও রিপোর্টে বেশ কম কম এল সবকিছু। নতুন বছর পড়তেই রাতারাতি গেল বেড়ে সবকিছু। অতঃপর আমার আদরের ছোট দেওর ওরফে অধ্যাপক ডাঃ টুকলুর প্রবল ধমকচমকের পর ভদ্রমহিলা রাজি হলেন অপারেশন করাতে।
আধাঘন্টার অপারেশনের সময়সীমা কখন যে বেড়ে গেল ঘন্টা সাড়ে তিন কে জানে। নিষেধ সত্ত্বেও গুটি গুটি এসে হাজির হল টুকলু বাবু। উমা বিরক্ত হয়ে বলেই ফেলল, ‘আমাদের ওপর এদের কোন ভরসাই নেই দিদিভাই। দেখছ তো?’ দেখছিলাম তো। দেখছিলাম এমন জাঁদরেল গুরুগম্ভীর অধ্যাপক টুকলুরও মুখটা কেমন শুকনো। দেখছিলাম বাইরের জটিল কঠিন আবরণের ভিতর একটা বছর সাত আটেকের ভীতু ছানা, যার সমস্ত সত্ত্বা জুড়ে রয়েছেন ছবির ভদ্রমহিলা।
অপারেশন শেষ হতে বেরোল প্রায় সাতখানা জব্বর পাথর। একনজরে দেখলে মনে হবে বুঝি ডুমো ডুমো করে কাটা সুপারি বা চৌকো করে কাটা পেস্তা। এত পাথর নিয়ে ভদ্রমহিলা এতদিন টিকে ছিলেন কি করে ভগবান জানেন। ডাক্তার জানালেন, সমস্ত জটিলতার মুখে ছাই দিয়ে দিব্যি আছেন ভদ্রমহিলা। জানালেন কালকেই ছুটি-।
উমার সাথে খোদ শ্বশুরমশাই গিয়েছিলেন প্রিয়তমা স্ত্রীকে বাড়ি আনতে। ছবিতে যতই গোবেচারা নির্বিরোধী মনে হোক না কেন, বাড়ি আসার সাথে সাথেই নিজ মূর্তি ধরেছেন ইনি। উড়িয়ে দিয়েছেন আয়া মাসি রাখার প্রস্তাব। কাজের দিদিকে কটা দিন একটু বেশী থাকতে বলে বেজায় ধমক খেয়েছেন শ্বশুরমশাই। দুদিন তাও একটু জবুথবু ছিলেন, আজ সকাল থেকে পূর্ণোদ্যমে যাবতীয় সাংসারিক কাজে ব্যাপৃত হয়েছেন ভদ্রমহিলা। হতাশ শ্বশুরমশাই অসহায় ভাবে বিড়বিড় করে বললেন, ‘কি করি বলো তো?’ কিচ্ছু করার নেই, সবই অতসী দেবীর মহিমা। মোদ্দা কথা শাশুড়িমা জিন্দাবাদ। এমন ভাবেই চলুক না জীবন ছন্দবিহীন ছন্দবদ্ধ হয়ে- কখনও টক আর অনেকটা মিষ্টি নিয়ে।
No comments:
Post a Comment