Saturday 20 February 2021

অনির ডাইরি ফেব্রুয়ারি, ২০২১

 

অনির ডাইরি ২৫শে ফেব্রুয়ারি, ২০২১


রিক্সামামা আর রিক্সা চালায় না। প্রথম প্রথম যখন মেয়ে নিয়ে একা থাকতে শুরু করেছিলাম তখন এমনি অনেক সম্পর্ক গড়েছিলাম আমি আর তুত্তুরী। জানতে পারলে হুলো বেড়ালের মত এখুনি ঘ্যাঁও করে উঠবে শৌভিক, ‘একা কেন? আমি কি আসতাম না?’ আসত বৈকি। ব্লক সামলে সুযোগ পেলেই পালিয়ে আসত। যখন আসত মুটে মজুরের মত দোকান বাজার করে দিয়ে যেত। বাকি দিনগুলোয় আপনি অার কপনি ভরসা। 


তাতে যে খুব একটা অসুবিধে হত তেমন নয়,সমস্যা হত তুত্তুরী সর্দিজ্বর বাঁধালে। কেমন যেন ডিনায়ালে ভুগতাম আমি, হয়তো আজও ভুগি। ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে ভাবলেই নার্ভাস ব্রেকডাউন হত। এতো আর আমাদের হাওড়া নয় যে, গৌতম কাকুর চেম্বারে গিয়ে বলব ,‘কাকু মেয়েটা ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ করছে। দু পুরিয়া ওষুধ দিন তো। ’ ঠাকুমা থেকে তুত্তুরী, চার প্রজন্মের যাবতীয় ছোটবড় অসুখে ডাঃ গৌতম সিংহরায় ছিলেন সাক্ষাৎ  ধন্বন্তরী।  পেশায় ছিলেন হোমিওপ্যাথ ডাক্তার। বাড়ির গ্যারেজের ওপরে ওণার ছোট্ট ডিসপেনসারি, সবসময় গমগম করত রুগীদের ভিড়ে।  রোগ নির্ণয়ের কেমন যেন সহজাত প্রতিভা ছিল ভদ্রলোকের, এমনকি যেসব ব্যধির চিকিৎসা ওণার আয়ত্বের বাইরেও, তাও কেমন একপলকে নাড়ি টিপে ধরে ফেলতেন গৌতম কাকু। 


 রিক্সার ঝাঁকানিতে সম্বিত ফিরে পেয়ে কিঞ্চিৎ  লজ্জিত লাগল। বয়স বাড়ার প্রধান লক্ষণই বোধহয় এই স্মৃতিমেদুরতা। লকডাউনে রিক্সা বেচে জোগাড়ের কাজ নিয়েছে রিক্সামামা। তবে স্বীকার করে না। ফোন করলেই বলে ‘আচ্ছা বওদি। আমিই থাকব। ’ থাকেও। অন্য রিক্সায় তুলে দিয়ে আবার কাজে ফিরে যায়। এদিকে আজকাল ই-রিক্সাই বেশী। চাপলেই দৌড়য়, ভর দুপুরে মেয়ের ইস্কুলে যেতে জাস্ট কান্না পাচ্ছে। কিন্তু নিরুপায়। মেয়ের ইস্কুলের ফরমান ওপরওয়ালীর ফরমানের থেকেও ভয়ঙ্কর। কি সব অলিম্পিয়াডের সার্টিফিকেট এবং মেডেল দেবে নাকি। 


অমন অলিম্পিয়াডে ফি বছর বসে তুত্তুরী। কোনবারই বলার মত কিছু হয় না। না হলেই বেশী খুশি হই আমি। যেটাতে উত্তীর্ণ হয়, সেটার পরের ধাপের জন্য আবার নিয়ে যেতে হয় অন্য ইস্কুলে। যে মহা যাতনার। প্রতিটি পরীক্ষার জন্য মোটা ফি দিতে পাঁজর টনটন করে, কিন্তু না দিলেও নয়। কি যেন একটা পরীক্ষায় জেদ করে ফি দিইনি একবার, রবার্ট ব্রুস একজন সম্মানীয় ব্যক্তি বটে, তবে ওণার মত সপ্তবার্ষিকী ফেল করার পরিকল্পনা না করাই শ্রেয়। সেদিন অফিস থেকে ফেরার পর করুণ মুখে বলেছিল তুত্তুরী, ‘জানো মা, আজ আমি একা বসেছিলাম ক্লাশে। সবাই পরীক্ষা দিতে গিয়েছিল। ’ সেই থেকে নাক কান মুলেছি, যা বাবা ফেলই করে আয়। মনটা তো খুশি খুশি থাকুক।  


ইস্কুলে বিরাট লাইন। কিসের মেডেল কি বৃত্তান্ত কিছুই না জানা বাবামায়েরা রীতিমত ভোম্বল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অ্যাসেম্বলী হল থেকে কেউ বেরিয়ে এলেই ছেঁকে ধরছে তাকে, ‘মেডেল পেলে?’ যা বুঝলাম মেডেলের সংখ্যা সীমিত। ফলে উত্তর প্রত্যাশিত। ওদিকে বাড়িতে তুত্তুরী রূপার মেডেল পাবে ভেবে নেচেই চলেছে। রূপা নাকি সোনার থেকেও বেশী ঝলমলে। 


অবস্থা দেখে মায়াই লাগল, আহাঃ বড় আশা করেছিল গো। আজ অবধি একটাও মেডেল পায়নি মেয়েটা। বন্ধুরা অনেকেই পেয়েছে, প্রতিবার গল্প শোনায় মেয়েটা। ভাবতে ভাবতে মনে পড়ল , আরেঃ আমি তো জীবনে কোন মেডেল পাইনি। থুড়ি পেয়েছি প্রচুর, অর্জন করিনি একটাও। 


মেডেল কিছু পেত বটে আমার ছোটদা। কি ভালো যে আঁকত ছোটদা। যবে থেকে পেন্সিল ধরতে শিখেছে, কোন প্রতিযোগিতায় দ্বিতীয় হয়নি। এখনও আঁকে বটে, তবে আজকালকার ছবিগুলো বড় বেশী আঁতেল-আঁতেল মার্কা হয়,কিচ্ছু বুঝি না। ভিন্ন বছর হলেও, একই দিনে জন্ম তাই ছন্দ মিলিয়ে নাম-‘গুনু আর ঝুনু।’ শ্রীমাণ গুনু সত্যিই ভয়ানক গুণের আকর ছিলেন। ততোধিক নির্গুণ ছিলাম আমি। 

তবে ভাইফোঁটার দিনটা এলেই পাল্টে যেত সব হিসেব। সেদিন সম্বৎসরের মেডেল গুলো পরম যত্নে আমার হাতে তুলে দিত ছোটদা।  

ভাইফোঁটায় ছোটদার দেওয়া উপহারের জন্য মুখিয়ে বসে থাকতাম আমি। পুরানো পিচবোর্ডের বাক্সকে সুন্দর করে রঙ করে, রাংতা দিয়ে মুড়ে তার মধ্যে যত্ন করে রাখা মেডেলের পাশে থরে থরে সাজানো থাকত চকলেট। ক্যাডবেরীর যতরকম চকলেট পাওয়া যেত সব দুএকটা করে  সাজিয়ে বাকিটা আমুল,নেসলে আর কফি বাইট দিয়ে ঠাসা থাকত। উফঃ সেই সোনালী বাক্স খোলার উন্মাদনা জীবনে ভুলব? ভাবতে ভাবতেই মনে পড়ল, এত চকলেট কেনার পয়সা কোথা থেকে পেত ছোটদা? কি আশ্চর্য! এতদিন এই চিন্তাটা কেন মাথায় আসেনি? ছাপোষা মধ্যবিত্ত আরএমএসের কর্মী বড় মেসোমশাইয়ের টানাটানির সংসারে কেউ হাতখরচ পেত বলে কখনও শুনিনি। অনেক কষ্টে তিন পিতৃহীন শ্যালিকা আর চার পুত্রকে মানুষ করেছিলেন স্বর্গীয় বড় মেসোমশাই। পেরেছিলেন শুধু অদম্য জেদ আর অপরিসীম দুঃসাহসে। তাহলে? অত চকলেট কেনার টাকা তুমি পেতে কোথায় ছোটদা?


দুখানি পার্টিসিপেশন সার্টিফিকেট বগলে রিক্সায় উঠেই ফোন করলাম ছোটদাকে, ‘কি ভাবে দিতে ছোটদা?নিজের কি কি প্রয়োজন না মিটিয়ে জমাতে পয়সা? শুধু আমার জন্য?’ প্রশ্ন করতে গিয়ে চিকচিকিয়ে উঠল চোখের কোণা, এত ভালোবাসা দিয়ে গেছে জীবন, অথচ আমি বুঝিনি?ফোনের ওপাড়ে ছোটদার উদাত্ত হাসি, ‘যা যা বাড়ি যা। তুত্তুরীকে যেন ঠ্যাঙাস না। যা ঠ্যাঙাড়ে তুই।’ কি প্রশ্নের কি জবাব। মনে পড়ে গেল, এই কারণে, শুধু কারণেই উদোম হাতাহাতি হত এই ভদ্রলোকের সঙ্গে। সবসময় লুকোচুরি মাইরি। মহা বাজে লোক।

অনির ডাইরি ২১শে ফেব্রুয়ারি, ২০২১

#শুভভাষাদিবস

সাত সকালে চৈতালী বলল, ‘শোন অাজ ভাষা দিবস, জম্পেশ করে একটা লেখা নামিয়ে ফেল-’। রসাল আলাপচারিতার ফাঁকে এমন বিদঘুটে আব্দার শুনে শঙ্কর শেঠের কথা মনে পড়ে গেল। তাঁর আদরের নন্দন কোষ্ঠকাঠিন্যে ভুগত এবং শতানুরোধেও সক্কাল সক্কাল প্রাতকৃত্য করতে রাজি হত না, তাই শঙ্কর বাবু করেছিলেন কি, পরপর দিন সাত আটেক ভোরভোর শিশু পুত্রকে ঘুম থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে শৌচাগারে ভরে দিতেন এবং লাঠি নিয়ে দরজায় বসে থাকতেন। পাক্কা গব্বর ইস্টাইলে,‘ হয় ইয়ে কর, নয় লাঠি খা’। আরে লেখাপত্তর হল ইয়ে মার্কা ব্যাপার স্যাপার, অমন হুকুম দিলেই হয়? প্রসঙ্গতঃ দ্বিতীয় ইয়েটা কিন্তু প্রথম ইয়ে নয়। বুইলেন কি না- একটা সত্যিই ইয়ে আর দ্বিতীয়টা আঁতেল মার্কা আর কি- 


তো যা বলছিলাম, আমি মনে, প্রাণে এবং ধনে ঘোরতর বাঙালী। বঙ্গের রাণী দয়া করে বেতন দেন, তাই মোর সংসার চলে। তবে আমার থেকেও কড়া বাঙালী হল মোর বাপ। যার কাছে আমার বাঙালিয়ানার হাতে খড়ি। রাত নটা নাগাদ, টিভির সামনে বসে, আধ কি সিকিখানা হিন্দি সিনেমা দেখতে দেখতে, চামচে করে চাট্টি শুকনো মুড়ি আর কড়াইশুঁটি খেতে খেতে, মায়ের কাছে এক কাপ চায়ের উষ্ণ প্রেম প্রার্থনা করতে করতেও বাবা হিসেব করে যায়, ‘একটা ষোল আনা বাঙালী(রাণী মুখার্জী), একটা আট আনা বাঙালী (অভিষেক বচ্চন), একটা চার আনা বাঙালী (ঋত্বিক রোশন। ওণার পিতামহী বঙ্গনারী ছিলেন কিনা) আর একটা সাড়ে বারো পয়সার বাঙালী (করিনা কাপুর। তাঁর প্রপিতামহ কোন কালে কলকাতাবাসী ছিলেন-)।’ উফঃ কত্ত বাঙালী। 


নাঃ অধম এখনও ঐ স্তরীয় বাঙালী হয়ে উঠতে পারেনি, তবে ঐ পথেই এগোচ্ছি। দিনদিন আরো আরো বেশী করে বাঙালী হয়ে উঠছি। উল্টো দিকের লোকটা খুব বেশী ইংরেজিতে পটরপটর না করলে বাঙলাতেই কথা বলি। উল্টোদিকের ব্যক্তিটি যদি আমার মাতৃভাষা শুনে , ‘কেয়া’ বলে তো আমিও গোবেচারার মত হাত পা নেড়ে বোঝাই, ‘হিন্দি ভালো নেহি বুঝতা। বাংলায় বোলিয়ে নয়তো ইংরেজি ভি চলেগা।’  চিঠিপত্রে দস্তখৎ তো বাংলা হরফেই করি। ঊর্ধ্বতন কতৃপক্ষকে লিখতে কিঞ্চিৎ সঙ্কোচ নয়, কিন্তু নিম্নতন কর্মীবন্ধুদের যখন চিঠি করি, বাঙলা ভাষাতেই করি। নোটিশ দিলেও বাংলায় দেবার জন্য পীড়াপীড়ি করি, ফলতঃ দশ মিনিটের চিঠি লিখতে ঘন্টা আধেক দাঁত কিড়মিড় করতে হয় এবং নিজের চিঠি নিজেকেই টাইপ করতে হয়। সর্বোপরি নির্ভেজাল বাংলায় গালাগালি দিই। 


এতদসত্ত্বেও খুঁৎ তো থেকেই যায়। আমি হইচই দেখি না। তিলোত্তমা বা তসলিমা ছাড়া সাম্প্রতিক বাংলা সাহিত্য পড়ি না। গানও বেশীর ভাগ সময় অবাংলা ভাষাতেই শুনি।মাসটা ধরতে পারলেও বাংলা তারিখের হিসেব রাখি না। খাবারদাবারের বেলাতেও আমার বিজাতীয় ভিনদেশীয় খাবারে বড় লোভ-।  উপরিউক্ত সবকটি কারণের জন্যই আমি যৎপরনাস্তি লজ্জিত। একুশে ফেবুর ফেবুসমাজ কি আমায় মেনে নেবে Chaitali? 


শেষবিচারে আমি বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের এক অতি নগন্য কিন্তু অতি গর্বিত সদস্যা। দেশস্বাধীন- ভাষাও স্বাধীন। যা খুশি বলুন না মশাই, ভাষা তো শুধু মনের ভাব প্রকাশের মাধ্যম মাত্র। কানে বন্দুক ঠেকিয়ে আপনাকে না বাঙালি করা যাবে, না অবাঙালি। এতই যদি সহজ হত ব্যাপারটা, তাহলে দেশভাগের এত বছর পরেও পদ্মা পেরিয়ে আসা মানুষগুলো আজও সুযোগ পেলেই নিজেদের হারিয়ে যাওয়া পরগণার কথ্য ভাষায় বাক্যালাপ করত না। ভাষার প্রতি প্রেম থাকুক, তবে ভাষা নিয়ে একদিনের গুণ্ডামি না হয় নাই করলাম। ভাষা তো স্থবির নয়, ভয়ানক জঙ্গম। ভিন্ন ভাষা বা আঙ্গিকের দৌরাত্ম্যে থোড়াই হারিয়ে যেতে পারে এমন ভাষা? বিজ্ঞজন যাই ভবিষ্যৎ বাণী করুন না কেন, ভালো করে কান পেতে শুনুন কি কয় আপনার হৃদয়? 


 বেঁচে থাক মোদের ভাষা শতায়ু- সহস্রায়ু হয়ে- বাহুল্যর খোলস ঝেড়ে ফেলে- আবেগে ভালোবাসায় পুষ্ট হোক দিনে দিনে। চলুন, শুভ ভাষাদিবস। ভালো থাকুন, ভালোবাসুন আর প্রাণের ভাষায় কথা বলুন। মাতৃভাষা জিন্দাবাদ, আমরাও, আপনারও, সবার ভাষা জিন্দাবাদ।

অনির ডাইরি ১৯শে ফেব্রুয়ারি, ২০২১



‘আজ পারলে একটু তাড়াতাড়ি ফিরো মা-’। গ্রীলের ওপাশে কন্যার করুণ মুখ ঘোরতর ব্যস্ত আপিসটাইমকেও থামিয়ে দেয় এক লহমায়। পলকে পিছিয়ে নিয়ে যায় কোন সে সাদাকালো দশকে। সময়ের দর্পণে যেখানে ফুটে ওঠে তুত্তুরীর সমবয়সী চেনাঅচেনা কোন বালিকার সিপিয়া প্রতিবিম্ব। দেড়শো বছরের পলেস্তারা খসে পড়া বুড়ো বাড়িটার দক্ষিণ পশ্চিমের বারন্দা থেকে এমনি করেই কাতর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকত, যে। বিশাল বার্মাটিকের সদর দরজা ঠেলে অাপিস বেরিযে যাওয়া লোকটার দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলত, ‘একটু তাড়াতাড়ি ফিরো বাবা। এখনও বাকি কত্ত কাজ-’। সোচ্চারে বলতে ভয় পেত, পিছু ডাকতে ভয় পেত সে। 


দুই যুগের দুই কন্যার যাবতীয় উদ্বেগ তথা উৎকণ্ঠার মধ্যমণি একজনই, সপ্তাহের গাড়ি বাঁক নিলেই যে এসে পড়বেন তিনি। এমন অগোছালো ধূলিমাখা আবহে কি ভাবে বরণ করা হবে তাঁকে? শুধুই তাঁর জন্য যুদ্ধকালীন ব্যস্ততায় গোছাতে হবে, সাফাই করতে হবে ঘরদুয়ার। কিনে আনতে হবে ষোড়শ উপাচার, তারপর সাজাতে হবে মনের মত করে। পাততে হবে মঙ্গলঘট, আঁকতে হবে স্বস্তিকা, দুয়ারে বসাতে হবে কলাগাছ আর সবশেষে কাঁপা কাঁপা হাতে বাইরের দরজার সামনে আঁকতে হবে তাঁর পদচিহ্ন, ঠিক যে ভাবে মা লক্ষ্মীর পদচিহ্ন আঁকত ঠাকুমা, ঢুকবে কিন্তু বের হবে না। অদূরে মিলনী মাঠে বসন্তবিলাপী সুর ধরতেন আরতি মুখোপাধ্যায় ‘ধরেছি আর তোমায় ছাড়ব না-’।  


ঘরসাফাই দিয়ে শুরু হয় বাগদেবীর আগমন পর্ব। মা নিষেধ করা সত্ত্বেও নিঝুম দুপুরে স্কচব্রাইট আর বাসনমাজা সাবান দিয়ে দেওয়াল ঘষে তুত্তুরী। মুছে ফেলার চেষ্টা করে দেওয়াল জোড়া অগুনতি ছবি, হাতের ছাপ, ‘মাসি খুব বাজে’ বা ‘আই লাভু মা’ মার্কা ছুটকো বার্তা। কোথাও কোথাও ভুলভাল অঙ্কও কষে রেখেছে তুত্তুরী, দেখতে পেলেই কান ধরে ওঠবোস করায় বাবা, দেওয়াল নষ্ট করার জন্য নয় যোগ/ বিয়োগ বা গুণে ভুল করার জন্য।  


কন্যার ঘর সাফাই করার মরিয়া প্রচেষ্টা দেখেও রাগতে পারে না তুত্তুরীর মা। মনে পড়ে যায় পলেস্তারা খসা, সাবেকী ঠাকুরঘরের কথা। ভিটের মূল কাঠামোর বাইরে টালির চালের ঠাকুরঘরটা বিশেষ রূপে বানানো হয়েছিল প্রপিতামহের জননী স্বর্গীয়া গোলাপসুন্দরী দেবীর জন্য। ঘরের লাগোয়া চকচকে কালো রোয়াকটা ছিল তাঁর গোঁসা ঘর বুঝি। গোঁসা হলেই আঁচল বিছিয়ে শয্যা নিতেন তিনি। কলকাতা তখনও ভারতের রাজধানী। অনুশীলন সমিতির উৎপাতে বঙ্গভঙ্গের চিন্তা সদ্য ঢুকছে গোরাদের গোবরভরা মস্তিষ্কে। 


ঠাকুরঘরের লাগোয়া আমগাছটি অবশ্য নবীন। পাঁচ সাত রকম আমের আঁঠি থেকে গজানো একগুচ্ছ চারা মিলে তৈরী করা মহীরুহের এক একটা আমের সোয়াদ ছিল এক একরকম। সবই চিনি গোলা যদিও। গ্রীষ্মকালে টুপটাপ ঝরে পড়া আমে ফি বছর ভাঙত টালি। আম- কাঁঠাল আর পেয়ারার লোভে হামলা চালানো হনুমানের দলও ভাঙত কিছু টালি। বর্ষাকালে চুঁইয়ে নামত সজলধারা। দেওয়ালগুলোও ছিল ড্যাম্প ধরা। আয়নার মত চকচকে কৃষ্ণবর্ণ মেঝের মুখে শতেক বলিরেখা।


 এহেন ঠাকুরঘরকেও কেমন যেন রাজপ্রাসাদ বানিয়ে ফেলত বাবা রাতারাতি। মায়ের বাতিল ঝলমলে ব্যাঙ্গালোর সিল্ক দিয়ে রচিত হত পিছনের চালচিত্র। অমনি কোন শাড়ি দিয়েই মাথায় টাঙানো হত চাঁদোয়া। দীর্ঘ দুই তিন মাস ধরে জমানো সিগারেটের খোলের পাহাড় থেকে রাংতা বার করতে বসতাম আমরা তিন খুড়তুতো জেঠতুতো ভাইবোন। আপিস ফেরতা ক্লান্ত হাতে নিটোল ফুল কাটত বাবা। টিভি সিরিয়াল দেখার ফাঁকেফোকরে অ্যালুমিনিয়ামের বাটিতে ময়দা গুলে স্টোভে ফুটিয়ে আঠা বানিয়ে দিত জ্যাঠাইমা। অতঃপর ঠাকুর ঘর জুড়ে টুপটাপ ফুটে উঠত সোনালী রূপালী ফুলের দল। বিরাট উঠোনের কোণায় কোণায় ঝুলত লাল-নীল-সবুজ শিকলি। 


ফেলে আসা সময়টাকে আঁকড়ে ধরতে আপিস ফেরতা পাঁচরঙা মার্বেল পেপার কিনে আনে তুত্তুরীর মা। রান্নাঘরের ভোঁতা ছুরি দিয়ে কাগজ কেটে ফেভিস্টিক দিয়ে মেয়েকে শিকলি বানানো শেখানোর সময়, কেন জানি না গলার কাছটা ব্যথা ব্যথা করে তুত্তুরীর মায়ের। কাগজের খসখস শব্দের আবডালে ফিসফিসিয়ে কাকে যেন বলে তুত্তুরীর মা, 'দেখো বাবা, আমি আজ তোমার ভূমিকায়-'। 


নামভূমিকায় অভিনয় হয়তো করা যায়, কিন্তু আসলকে বোধহয় কোনদিনই ছুঁতে পারে না নকলনবীশের দল। গাঁদাফুলের মালা, আম্রপল্লব, পঞ্চগুঁড়ি, পঞ্চশস্য, পঞ্চরত্ন, চাঁদমালা কিনতে গিয়ে তাই বোধহয় হাত বাড়িয়ে সেই চেনা, চির নির্ভরশীল হাতটাই খোঁজে তুত্তুরীর মা। জ্বলে যাওয়া ফর্সা রঙা হাতটায় বারো মাস থাকে সস্তা সিগারেটের গন্ধ।  কত বছর পেরিয়ে যায় এই গন্ধ আর এই স্মৃতি গুলো কেন যে যুগান্তরেও থেকে যায় অবিকৃত?


পাঁচালি খুলে ভুলভাল উচ্চারণে মন্ত্র উচ্চারণে, দেবনাগরী অলিগলিতে হোঁচট খেতে খেতে, করজোড়ে বসে থাকা ভক্তিমতী কন্যার বিনম্র আঁখিপল্লবে, সন্ধ্যাপ্রদীপের কম্পমান শিখায় কি যে খোঁজে তুত্তুরীর মা। চোখ বন্ধ করে বসে থাকা ভক্তিমতী তুত্তুরীর মধ্যে হয়তো সেই সিপিয়া রঙা মেয়েটা আর সাদাকালো সময়টাকেই খোঁজার চেষ্টা করে তুত্তরীর মা। সময় বড় নির্মম, পট ঠিক রাখলেও কেমন বদলে বদলে যায় কুশীলবরা। আজ বাবার জুতোয় পা রেখেছি আমি, কাল হয়তো  অন্য কেউ থাকবে আমার ভূমিকায়। পড়ে থাকবে শুধু একমুঠো স্মৃতিমেদুরতা।


অনির ডাইরি১১ই ফেব্রুয়ারি ২০২১

অতসী দেবী জিন্দাবাদ- 


ভদ্রমহিলা আপাততঃ বেশ ভালো আছেন। অবশ্যি থাকারই কথা, প্রাকবিবাহ যুগ থেকে শুনে আসছি ওণার অতিমানবিক শক্তি তথা কর্মদক্ষতার উপাখ্যান। বয়স কালে ভদ্রমহিলা শুধু যে অসীম শক্তিশালিনী ছিলেন তাই নয়, যে কোন গৃহকর্মে ওণার পারিপাট্য তথা নৈপুণ্য প্রবাদপ্রতিম। এ হেন ভদ্রমহিলা খোদ যখন আমায় বধূ হিসেবে বরণ করে এনেছিলেন তখনই আমার গর্ভধারিণী বলেছিলেন, ‘আমার মেয়েটা ন্যাদোশ। ঢ্যাঁড়শ এবং হদ্দ কুঁড়ে। সবথেকে বড় কথা ভয়ানক নিদ্রাকাতর।’ অর্থাৎ বহির্রঙ্গ দেখে বিমোহিত হবেন না। জবাবে উনি বলেছিলেন, ‘আমার ছেলেটা আবার ভয়ানক কর্মঠ। একজন যদি গৃহকর্মে ব্যাপৃত থাকে, আরেকজনকেও তখন উঠতেই হবে। আর অপ্রয়োজনে ওঠার দরকারটাই বা কি?’ 


ভদ্রমহিলা ওমনি। চেনা শাশুড়ির ছকে ফেলা বেশ মুস্কিল।আর পাঁচটা পুত্রবধূর মতোই আমি আর উমা বেশ সমীহ করে চলি আমাদের শাশুড়ি মাতাকে। সমীহ ছাড়ুন, পাতি বাংলায় বেশ ভয় পাই এণাকে। শ্বশুরমশাই অবসর প্রাপ্ত জাঁদরেল আমলা হলেও তাঁর সঙ্গে তর্ক করা যায়, ভুলো স্বভাব নিয়ে খিল্লি করা যায়, ফোকটে দেওয়া যায় খানিক জ্ঞানও,এমনকি ক্ষেত্র বিশেষে ধমকানোও যায়। কিন্তু এই ভদ্রমহিলার ভয়ে রীতিমত কম্পমান আমরা। 


যাই হোক ফিরে যাই ভদ্রমহিলার ভালো থাকার গপ্পে, গত পরশুই ওণার উদরে তিনখানি ফুটো করেছেন ডাক্তারবাবু, জনৈক সুপার স্পেশিয়ালিটি হাসপাতালের লবিতে একাকী সেদিন বসে বসে ভাবছিলাম, প্রতিদিন কত মানুষই না অসুস্থ হন। ঘোরতর কর্মব্যস্ত দিনেও কি মারাত্মক ভিড়ের দৌরাত্ম্য। পৌনে একঘন্টারর মধ্যেই জনা সতেরো বয়ঃজ্যেষ্ঠ ব্যক্তি এবং বেতো মহিলাকে আসন ছাড়লাম। আপদ করোণার জন্য চেয়ারের সংখ্যা অসম্ভব সীমিত। এদের নিয়ম রুগী পিছু মাত্র একজন সঙ্গী কেবল হাসপাতালে ঢুকতে পারে। আর ডাক্তারের কাছে বা বিলিং সেকশনে অনুমোদন পায় কেবল একজন। একটু আগেই জনৈক বৃদ্ধ চিৎকার করছিলেন, ‘এখানে কত রুগীর সঙ্গে চারজন করে লোক ঢুকছে দেখতে পারছেন না আপনারা?’ বৃদ্ধকে তাঁর বৃ্দ্ধার থেকে আলাদা করার চেষ্টা করছিল মহিলা নিরাপত্তা রক্ষী। তাই এই ক্ষোভ। পাশ থেকে উমা ফিসফিস করে বলল, “কাল এই  নিয়ে এই এক বৃদ্ধ দম্পতি কি ঝগড়া করছিল দিদিভাই। বৃদ্ধ বলছিল ‘আমি যাব’ আর বৃদ্ধা বলছিল, ‘তুমি ঢ্যাঁড়শ। কিচ্ছু মনে করে বলতে পারো না। আমি যাব।’“ অন্য সময় হলে হয়তো হাসতাম, কিন্তু সেদিন তো বেআইনি কাজ করেছি আমরা দুজনেও। একজন ঢুকেছে শাশুড়ি মায়ের সাথে আর আমি বলেছি, আমিও রুগী, আমারও পেটে ব্যথা। 


পেটে ব্যথা অবশ্য কারোর নয়। শাশুড়ী মায়ের পেটে পাথর জমেছে বটে, তবে ব্যথা বেদনা কিচ্ছু নেই। ওণার বমি করার অভ্যাস বরাবরের। বারো বছর ধরে দেখছি, মাঝে মাঝেই অমন গা কাঁপিয়ে বমি হয়, উনি একবেলা নিঝুম হয়ে পড়ে থাকেন, বারো ঘন্টা কাটতে না কাটতেই আবির্ভূত হন পুনর্বিক্রমে। আবাসনের দত্ত ডাক্তার বলতেন এর নাম ভার্টিগো। আমরাও জানতাম, মাঝে মাঝে ওণার ভার্টিগোর অ্যাটাক হয়। 


হঠাৎ করে বছর দুয়েক আগে জানা গেল ওণার পাথুরী হয়েছে। ফিরিঙ্গি ভাষায় গল ব্লাডারে জমেছে পাথর কুচি। কে জানে হয়তো সেই কারণেই এত বমির দমক। গল ব্লাডারে অপারেশন তো মামুলী ব্যাপার। পেটে তিনটে ফুটো,ব্যাস-। জনৈক সার্ভিসতুতো দাদার মুখে শুনেছিলাম, তেনার অপারেশনের সময় পাশাপাশি পর্দা দেওয়া বেডে শোওয়ানো হয়েছিল আরো অনেকজন রুগীকে। অতঃপর ঘচাঘচ ফুটো করা, আর টপাটপ পাথর পড়া। ভদ্রলোক মহা ফাজিল, মস্করা করেছিলেন কি না জানি না, তবে আমার মায়ের ক্ষেত্রে দেখেছিলাম সাকুল্যে আধাঘন্টার ব্যাপার। আধঘন্টা কেটে গেছে অনেকক্ষণ হল। খিদে পাচ্ছে। সেই কোন সকালে দুটো বাসি রুটি খেয়ে বেরিয়ে এসেছি উমা আর আমি। শাশুড়ী মাতা তো তাও খাননি। শুধু জল আর ওষুধ। বেচারা বৃদ্ধ শ্বশুরমশাই পত্নীগত প্রাণ,আসতে চেয়েছিলেন হাসপাতালে। আসতে চেয়েছিল দুই পুত্রও। বেজায় ধমকে তাদের নিরস্ত করা গেছে। শ্বশুরমশাই ফুসফুসের সমস্যায় ভোগেন নিত্য। রাস্তায় বেরোন এমনি নিষেধ তাঁর। শৌভিকের আছে ইলেকশন আর অভীক থুড়ি টুকলুর আছে কলেজের ইন্টারনাল এক্সজাম। ফলে আমরা দুই পুত্রবধূই আপাততঃ শাশুড়ি মায়ের একমাত্র সঙ্গী। তাই নিয়ে শুরুর দিকে ভদ্রমহিলার গর্বের অন্ত ছিল না, তিনবার বললেনও সে কথা। 

উনি অবশ্য অমন কথা প্রায়ই বলেন। উমা এবং আমি উভয়ই মনে করি এমন আলোকপ্রাপ্ত মহিলা খুব কম আছে। নারী স্বাধীনতার সংজ্ঞা হয়তো পড়েননি তবে এত বেশী নারীবাদী মহিলা, বিশেষতঃ ঐ বয়সে আমরা আজ অবধি দেখিনি। যেখানে সব শাশুড়িরা বিয়ে হতে না হতেই নাতিনাতনীর মুখ দেখার আব্দার করে, আমাদের শাশুড়ী জরায়ুর ওপর মেয়েদের অধিকার দাবী করেন। বিশ্বাস করেন এবং আমাদের বলেনও যে সন্তান আসবে কি আসবে না, সেই সিদ্ধান্ত নেবার অধিকার শুধু মায়েদের থাকা উচিত। উনি ঘোরতর নারীবাদী বলেই হয়তো ছেলেদের শিখিয়েছেন খাবার টেবিলে বউদের জন্য অপেক্ষা করতে। শিখিয়েছেন প্রয়োজনে বউদের খাবার বেড়ে দিতে। শিখিয়েছেন ঘরের কোন কাজ নিছক মেয়েলি নয়, সব কাজই সবার শেখা এবং করা উচিত। তা রান্না করাই হোক বা বাসন মাজা, বা জামাকাপড় কাচা বা হোক না নিছক শৌচাগার সাফাই। কখনও মাছের পেটি বা বড় পিসটা আলাদা করে ছেলেদের পাতে তুলে দেননি। রান্না করে সাজিয়ে দিয়েছেন টেবিলে,এবার যার ভাগ্যে যা ওঠে। যখনই বলেছি কোন কাজ ঠিক জানি না বা ভালো পারি না, ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়েছেন ভদ্রমহিলা, ‘অত জানার দরকারটাই বা কি?নিজের মত চালিয়ে নিও’। 


যাই হোক বছর দুয়েক আগে আবিষ্কার তো হল যে ওণার উদরে জমছে পাথর, যা সরাতে লাগার কথা মাত্র ঘন্টা আধেক,  কিন্তু সেই আধাঘন্টার ব্যাপার সামলাতে যে কত ঘাটের জল খেতে হল, কি আর বলি। সবাই মিলে ছুটতে হল এই হাসপাতাল থেকে ঐ হাসপাতাল। নামকাওয়াস্তে গল স্টোন তার জন্য বারবার একে অপরের কোর্টে বল ঠেললেন কত যে বিশেষজ্ঞ। প্রত্যেকেরই দাবী ঝুড়ি ঝুড়ি পরীক্ষা। যত রকম পরীক্ষা, ততো রকম জটিলতা। যত রকম জটিলতা ততো নতুন রকম বিশেষজ্ঞ। 


এদিকে শাশুড়ী মায়ের ঐ বমি ছাড়া যে অন্য কোন উপসর্গ ছিল তাও না। বয়স সুলভ হাঁটুর ব্যথা, সামান্য উচ্চ রক্তচাপ আর বেতো হাঁটু। সর্বশেষ বিশেষজ্ঞ বললেন বৃদ্ধার ফুসফুস বেশ ভালোই জখম। যদিও সাদা চোখে ধরা পড়ে না। শ্বাসকষ্টও  তেমন হয় না। অথবা হয়, উনি বুঝতেও পারেন না। দু দুবার ক্যান্সারকে নক আউট করে যাবতীয় মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু শ্বশুরমশাই একাই। শাশুড়ি মাতাকে নিয়ে তেমন ভাবিত থাকি না আমরা। উনি তো অ্যাটলাস, ঝিম মেরে সোফায় বসে, বেতো হাঁটুতে হাত বোলাতে বোলাতে কেবল্ টিভিতে বাংলা সিনেমার চ্যানেল সার্ফ করতে করতেও ধরে রাখেন পুরো বাড়ির ভার। হেঁপো রুগী তো শ্বশুরমশাই। গান্ধারীর মত শাশুড়ি মা যে কবে আপন করে নিয়েছেন বরের ব্যামো, তা জানতেও পারিনি আমরা। জানলাম তখন, যখন ডাক্তার বললেন, অপারেশন করালে নাও ফিরতে পারে জ্ঞান- 


মুলতুবি হয়ে যাওয়া অপারেশন আর পেট ভর্তি পাথর নিয়ে দিব্যি ঘুরতে লাগলেন শাশুড়ি মা। ধাড়সার আহমেদ ডাক্তারের হোমিওপ্যাথি ওষুধ খেয়ে খানিক গলিয়েও ফেললেন পাথর, করোণার মাঝেও রিপোর্টে বেশ কম কম এল সবকিছু। নতুন বছর পড়তেই রাতারাতি গেল বেড়ে সবকিছু। অতঃপর আমার আদরের ছোট দেওর ওরফে অধ্যাপক ডাঃ টুকলুর প্রবল ধমকচমকের পর ভদ্রমহিলা রাজি হলেন অপারেশন করাতে। 

আধাঘন্টার অপারেশনের সময়সীমা কখন যে বেড়ে গেল ঘন্টা সাড়ে তিন কে জানে। নিষেধ সত্ত্বেও গুটি গুটি এসে হাজির হল টুকলু বাবু। উমা বিরক্ত হয়ে বলেই ফেলল, ‘আমাদের ওপর এদের কোন ভরসাই নেই দিদিভাই। দেখছ তো?’ দেখছিলাম তো। দেখছিলাম এমন জাঁদরেল গুরুগম্ভীর অধ্যাপক টুকলুরও মুখটা কেমন শুকনো। দেখছিলাম বাইরের জটিল কঠিন আবরণের ভিতর একটা বছর সাত আটেকের ভীতু ছানা, যার সমস্ত সত্ত্বা জুড়ে রয়েছেন ছবির ভদ্রমহিলা।


অপারেশন শেষ হতে বেরোল প্রায় সাতখানা জব্বর পাথর। একনজরে দেখলে মনে হবে বুঝি ডুমো ডুমো করে কাটা সুপারি বা চৌকো করে কাটা পেস্তা। এত পাথর নিয়ে ভদ্রমহিলা এতদিন টিকে ছিলেন কি করে ভগবান জানেন। ডাক্তার জানালেন, সমস্ত জটিলতার মুখে ছাই দিয়ে দিব্যি আছেন ভদ্রমহিলা। জানালেন কালকেই ছুটি-। 


উমার সাথে খোদ শ্বশুরমশাই গিয়েছিলেন প্রিয়তমা স্ত্রীকে বাড়ি আনতে। ছবিতে যতই গোবেচারা নির্বিরোধী মনে হোক না কেন, বাড়ি আসার সাথে সাথেই নিজ মূর্তি ধরেছেন ইনি। উড়িয়ে দিয়েছেন আয়া মাসি রাখার প্রস্তাব। কাজের দিদিকে কটা দিন একটু বেশী থাকতে বলে বেজায় ধমক খেয়েছেন শ্বশুরমশাই। দুদিন তাও একটু জবুথবু ছিলেন, আজ সকাল থেকে পূর্ণোদ্যমে যাবতীয় সাংসারিক কাজে ব্যাপৃত হয়েছেন ভদ্রমহিলা। হতাশ শ্বশুরমশাই অসহায় ভাবে  বিড়বিড় করে বললেন, ‘কি করি বলো তো?’ কিচ্ছু করার নেই, সবই অতসী দেবীর মহিমা। মোদ্দা কথা শাশুড়িমা জিন্দাবাদ। এমন ভাবেই চলুক না জীবন ছন্দবিহীন ছন্দবদ্ধ হয়ে- কখনও টক আর অনেকটা মিষ্টি নিয়ে।

Friday 29 January 2021

মেলার ডাইরি ২০২১

 মেলার ডাইরি, ১৫ই জানুয়ারী, ২০২১

পর্ব ৯ক


জনৈকা আত্মীয়া একবার বলেছিলেন,‘তোর চাকরীটা বেশ ভালো। খালি সাজুগুজু আর ছবি তোলা“।  


১২ই জানুয়ারী বেলা দুটো- স্যারকে মেসেজ করতে গিয়েও বুঝতে পারলাম না কি লিখি। এমন জটিল পরিস্থিতিতে বাপের জন্মে পড়িনি। প্রতিবছরই মেলার আগের দিন গোলমাল বাঁধে। গত বছর যেমন গেটের সামনে লাগানো শোলার হাতি নিয়ে চূড়ান্ত রাজনৈতিক নোংরামো করেছিল এক স্থানীয় ব্যক্তি। একটা মাতাল আর পলকে জমে যাওয়া ভিড়ের সামনে ভয়ে জড়সড় আমার টিমের ছবি দীর্ঘদিন দুঃস্বপ্ন দেখেছি আমি। পেঁচো মস্তানের সাথে মস্তানি করে তাকে পুলিশের জিপে তোলাটা আজ অবধি নিজের বিশের বছরের অন্যতম কৃতিত্ব বলে মনে করি। তবে সেটা তো বিগত বছরের কথা। এ বারের সমস্যা যে তার থেকে শতগুণ জটিল। 


১২ই জানুয়ারী বেলা ২টো দশ-স্যারের ফোনটা বেজে গেল। ওণার অনুমতি ছাড়াই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। যুযুধান দুপক্ষের একজনকে পত্রপাঠ বাড়ি পাঠাব বলে ঠিক করলাম। আমরা যতই নিজেদের অপরিহার্য বলে মনে করি না কেন- আদতে সবাইকে ছাড়াই সব হতে পারে। যেমন আমার অন্যতম নির্ভরশীল ইন্সপেক্টর নির্মলকে ছাড়াই এবছর মেলা করার দিকে এগোচ্ছি আমরা। নিরূপায়। সদ্য প্রিয়জন হারানো নির্মল আপাততঃ কাছা পরেই অসুস্থ মাকে নিয়ে বসে আছে কলকাতার এক নামী হাসপাতালে।


বেলা তিনটে- সমস্যাটা কোন মতে মেটানো গেল। আমি কঠোর পদক্ষেপ নেবারই পক্ষপাতী ছিলাম। বর্মন সাহেব মিটমাট করার পক্ষে। শেষ পর্যন্ত রণং দেহির ওপর বিজয় প্রাপ্ত হলেন শান্তিরূপিনী। এখনও বাকি প্রচুর কাজ। সবাই ফিরে এসো মেলা মোডে। 

শ্যামল মুড়ি কই? 


বেলা সাড়ে তিনটে- এখনও অর্ধসমাপ্ত স্টেজ। মাঠে টানা হয়নি ছাউনি। লাগেনি কোন আলো। সমীর দৌড়ে এল, মাঠের বাইরে পোস্টার মেরেছে ওরা। মুড়ি খাওয়া হাতেই রাস্তায় গিয়ে দাঁড়ালাম সবাই। মাঠের উল্টো দিকের বাড়ির দেওয়ালে হাতে লেখা মেলা তথা সরকার বিরোধী না না শ্লোগান। যার কিছুকিছু বেশ আক্রমণাত্মক। শুধু তাই নয়, মাঠের সামনের রাজপথ বরাবর যতদূর নজর যায়- দুপাশের ল্যাম্পপোস্টে কারা যেন রাতারাতি লাগিয়ে গেছে বিশেষ রাজনৈতিক দলের ঝাণ্ডা। গণ্ডগোলের পূর্বাভাষ ছিলই। এসপি থেকে জেলা প্রশাসন হয়ে থানা সবজায়গায় চিঠি করে যথোপযুক্ত  ফোর্স পাঠানোর অনুরোধ করেই রেখেছি। গোপন সূত্র থেকে মুহূর্তে মুহূর্তে খবর আসছে, আজ ওণাদের মিটিং চলছে। আমাদের চন্দ্রাকেও ডেকেছিল ঐ মিটিং এ। মেলা থেকে বিশ মিনিট দূরত্বে জমায়েত হবে ওণাদের। সেখান থেকে ট্যাবলো এবং মিছিল নিয়ে এসে হাজির হবে আমাদের মেলায়। ইতিপূর্বে যথেষ্ট দুর্ঘটনা ঘটে গেছে অন্যান্য জেলায়। প্রচারিত হয়েছে কুৎসামূলক খবর। আর সর্বক্ষেত্রে আসামীর কাঠগোড়ায় দাঁড় করানো হয়েছে বেচারা আধিকারিককে। 


বেলা চারটে- নির্মলই সাধারণতঃ থানার সাথে কথা বলে, সে এখনও এসে পৌঁছায়নি কলকাতা থেকে।  নির্মল এলে সাথে চঞ্চল বা কৌশিককে থানায় পাঠানো হবে। আপাততঃ আরেকবার ঝালিয়েনি নিজেদের প্ল্যান। সামনের গেটে থাকবে দুজন জাঁদরেল মহিলা। বলাগড়ের প্রীতি শীল আর বাঁশবেড়িয়ার মহুয়া নাথ। শ্যামল আপত্তি করে, ‘মেয়েরা শুধু পারবে না। আমরা কজনও থাকি। ’ একসাথে মুখ ঝামটা দি আমরা। আমরাই পারি। ইন্সপেক্টর মৃণালের রিশেপসন টিম থাকবে প্রীতি দি আর মহুয়াদির পিছনে। দূরদূরান্ত থেকে আমাদের যে এসএলও বা কালেক্টিং এজেন্টরা লোক নিয়ে আসবেন, তাঁদের গেটের পাশে দাঁড় করিয়ে, এক একজন করে স্যানিটাইজার গেটের ভিতর দিয়ে ভিতরে ঢুকবে। মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক। মাস্ক পরে না এলে মাস্ক সরবরাহ করব আমরাই। সার্জিক্যাল মাস্কের বাণ্ডিল রাখা থাকবে মহুয়াদির কাছে। স্লোগান হবে, ‘মাস্ক পরুন, মেলা দেখুন’। 


আর যদি স্থানীয় মানুষ মেলা দেখতে আসেন। তাঁরা অবশ্যই স্বাগত। তাদের ছাড়পত্র দেবে বাঁশবেরিয়ার মহুয়াদি। অচেনা কেউ না। আর হ্যাঁ একবার ঢুকে পড়লে, উদ্বোধন শেষ না হওয়া পর্যন্ত বেরোতে দেওয়া হবে না। বাহির গেটে ডিউটি দেবে বাঁশবেড়িয়ারই নূপুরদি আর তরুণী মধুমিতা। 


যদি এদের চোখে ধুলো দিয়ে কোন বিক্ষোভকারী ঢুকেও পড়েন, তাঁকে সামলাবে মাঠ কমিটি। মাঠ কমিটির মাথায় থাকবে আমাদের ইন্সরেক্টর দর্প। আর তার সাথে থাকবে প্রদীপ, সমীর, প্রিয়াঙ্কা, শান্তনু আর আশিস। দূরত্ববিধি মেনে পাতা চেয়ারগুলির ফাঁক দিয়ে সমানে পায়চারি করবে এরা। যদি দেখা যায় কেউ ব্যাগ থেকে কোন ফেস্টুন বার করছে, তাকে বুঝিয়ে শান্ত করার দায়িত্ব এদের। 

এত উৎসাহী এই ছেলেমেয়েগুলো যে এদের সামলানো বেশ চাপ। বিশেষতঃ প্রিয়াঙ্কা তো একাই লড়তে চায় বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে। এ মেয়েকে সামলাতে আরও গুটি কতক মেয়েকে বলা হল, ওকে সামলে রেখো বাপ।   


বিকেল পাঁচটা- নির্মল এসে পৌঁছালো। ওর মাকে কালই ভর্তি করতে হবে  হাসপাতালে। এবারে আর নির্মল মেলা হবে না আমাদের। থাকতে পারবে না মেলার মূখ্য উদ্যোক্তা শ্রী নির্মল কুমার শেঠ। বাকি দুই ইন্সপেক্টর চঞ্চল আর কৌশিক আশ্বাস দিল, ‘আমরা সামলে নেবো ম্যাডাম’। বেশ। 


রাত পৌনে আটটা- থানা থেকে ফোন করল চঞ্চল। 'দুটো মেল আইডি পাঠাচ্ছি ম্যাডাম। বড় বাবু বলছেন একটা চিঠি করতে হবে। তবে ফোর্স চাইবেন ওণারা।’ সে আবার কি? এত রাতে আমি গাড়ি থেকে কি করে চিঠি করব? মেমো নম্বর পাব কোথা থেকে? আর এত যে চিঠি করলাম? সেগুলো কি অর্থহীন? অসহায় গলায় জবাব এল, 'সেই সব চিঠি এখনও ওণাদের কাছে নামেনি।'

অনির মেলার ডাইরি ১৫ই জানুয়ারী, ২০২১

পর্ব-৯ খ

https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=10222728040936852&id=1449214651  এর পর 


১২ই জানুয়ারী রাত আটটা- স্যারকে ফোন করলাম। মিটিং সেরে ফুলের লোক আর ফুল গাড়িতে তুলে মাঠে যাচ্ছেন স্যার। উনি আসছেন বলেই বাড়ির দিকে রওণা দিয়েছি আমি। ঠিক বাড়ি নয়। মেলার আগের রাতে হেয়ার স্পা করানোটা আমার বার্ষিক রিচুয়্যাল বলতে পারেন। একটা তুক থাকে না সকলেরই। 

স্যার আশ্বস্ত করলেন, ‘তুমি যাও। দরকার হলে মাঠে পৌঁছে হাতে চিঠি করে দেবো আমি। ’ এত চিঠি, ধাপে ধাপে ধাপে চিঠি করার পরও কেন চিঠি করব আমরা? ফোন করলাম অতিরিক্ত জেলা শাসক, সাধারণ মহাশয়কে। উনি স্বয়ং ফরোয়ার্ডিং চিঠি সমেত আমার চিঠিটি পাঠিয়েছিলেন পুলিশের কাছে। তার আর পর থাকতে পারে নাকি? 

সব শুনে জানালেন, ‘তুমি সিম্পলি আমার চিঠিটার একটা হার্ড কপি থানায় পাঠিয়ে কি ফিড ব্যাক পাও আমায় জানাও।’


রাত সাড়ে আটটা-  মাঠে প্রিন্টার কোথায়? চিঠিটা থানার মেলে আর নির্মলকে হোয়াটস্অ্যাপে পাঠালাম। সামাজিক মুক্তি কার্ড আর পিপিও প্রিন্ট ল্যামিনেট করাতে গেছে রমেশ। তাকেই বলা হল, ওটার একটা প্রিন্ট এনে দে বাবা। শুনলাম সময় লাগবে। সব প্রিন্ট নিয়ে চুঁচুড়া থেকে বাঁশবেড়িয়া আসতেও লাগবে অন্তত আধঘন্টা। রাস্তা ভয়ানক খারাপ। আচ্ছা সামলে আয়। 


রাত সাড়ে নটা- রমেশের ফোন বন্ধ। বুঝলাম চার্জ শেষ। গোপন সূত্রে কিছু খবর পেলাম। সংবাদ প্রদানকারী আশ্বাস দিলেন, ‘মেলা বয়কট করবেন বটে,বানচাল করবেন না ওণারা। বিক্ষোভ দেখাবেনই। ’ বললাম দেখুন বিক্ষোভ দেখানো আপনাদের অধিকার। তাতে হস্তক্ষেপ করতে চাই না। তবে চার বছর এই জেলায় কাটিয়ে দেওয়ার পরও যদি ‘শ্রমিকবিহীন শ্রমিকমেলায় চলছে বিরিয়ানি উৎসব’ বা ‘সরকারী মেলায় চলছে চটুল অশ্লীল নাচগান’ মার্কা খবর পড়তে হয়, তার থেকে বেদনাদায়ক কিছু হতে পারে না। 


রাত দশটা- থানা থেকে ফোন করল চঞ্চল,‘ম্যাডাম আপনাকে খবরটা কে দিয়েছে? এণাদের কাছে কিন্তু খবর আছে বিরাট গণ্ডগোল হবে। সারাদিনের উত্তেজনা আর ক্লান্তি ঘুম হয়ে নেমে আসে ফোনের এপ্রান্তে। সোর্স কেউ জানায়? আমার যা করার আমি করেছি। এরপর যদি কিছু হয়, হবে। তুমি ফিরে এসো। কাল ভোর থেকে প্রচুর চাপ।  


রাত এগারোটা- মাঠ থেকে ফোন করল ডেকরেটর। ম্যাডাম গুটি তিন চ্যাঙড়া ছেলে এসে হুমকি দিচ্ছে কাল সব ভাঙচুর করবে। ক্লান্তি জড়ানো গলায় জানালাম, করুক। যার যা প্রাণ চায় করুক। শুধু যখন ভাঙচুর করতে আসবে, আপনি আপনার মূল্যবান জিনিসগুলি সরিয়ে রাখবেন। 


১৩ই জানুয়ারী ভোর ছটা- অ্যালার্মটাকে ঘুম জড়ানো হাতে বন্ধ করে জড়িয়ে ধরলাম ঘুমন্ত বরকে। আমি বেশ যাব না আজ। যার যা খুশি মারামারি  করে নিক। আধঘুমন্ত আলিঙ্গন সহ, ফিসফিস করে ভেসে এল সোহাগী বাণী,‘ সেই ভালো যাস না। বড় সাহেব আছেন তো। আর বর্মনও আছে।’


সকাল পৌনে আটটা- সাড়ে সাতটায় বেরোব ভেবেও দেরী হয়ে গেল। বের হবার আগে শৌভিককে দিয়ে একটা ছবি তোলানোটাও তুক বলে মনে করি আমি। কাজের সময় এমন বেয়াড়া আব্দারে ভয়ানক বিরক্ত হয় শৌভিক। তাকে পটাতে গিয়েই দেরী আর কি। 

 জলদি চালান সুবীরবাবু। এইসব দিনগুলোতে ভীষণ মৃত্যুচিন্তা নিয়ে খেলা করতে মন চায় আমার। কি হয়,যদি আজ রাস্তায় উল্টে যায় গাড়ি? ওরা অপেক্ষা করবে আমার জন্য। ফোন করবে বারে বারে। তারপর সামলে নেবে ধীরে ধীরে। টেনশন চেপেও চালিয়ে যাবে নিজ- নিজ দায়িত্ব। ঐ যে শেক্সপিয়র সাহেব বলে গেছেন না, কুশীলব বদলে গেলেও-‘দা শো মাস্ট গো অন’। দেখা যাক আজ কি শো থাকে কপালে- 

(চলবে)

অনির ডাইরি জানুয়ারী, ২০২১

 অনির ডাইরি ২৭শে জানুয়ারী, ২০২১


ঘোরতর আপিস টাইমে ফোন করেন তিনি,‘মা আমি একটা অপাট করেছি’। বিগত দশ বছরের অভিজ্ঞতা যাবতীয় অপাট সম্পর্কে মোরে করেছে অনেকটাই সহিষ্ণু। আজকাল আর আঁতকে উঠি না। কেজো গলায় জানতে চাই, কি ঘটিয়েছেন শ্রীমতী অঘটনঘটনপটিয়সী? উত্তর আসে, বাড়িতে পরার হাওয়াই চপ্পলখানি দেহ রেখেছেন। এতদিন কেন যে রাখেননি, তা পরমেশ্বরই জানেন। সারাদিন মোটামুটি খালি পায়েই তো ঘোরে তুত্তুরী। পায়ের তলায় মাখা থাকে দুনিয়ার কালিঝুলি। আর চপ্পল জোড়া বিমর্ষ হৃদয়ে পড়ে থাকে কখনও খাটের কোণায় তো কখনও খাবার টেবিলের নীচে। 


আজ তাঁরা দেহ রাখায় বড়ই বিমর্ষ কন্যা আমার, বারংবার আশ্বস্ত করে, ‘একটা ফেভিকুইক কিনে এনো তো। জোড়া যাবে মনে হয়। ’ দাঁত থাকতে যেমন বোঝা যায় না দাঁতের মর্ম, তেমনি হয়তো চপ্পল থাকতেও কেউ কেউ বোঝেন না-। তাঁরা মারা গেলে হঠাৎ বড় দীন, বড় শীতকাতুরে হয়ে ওঠেন কেউ কেউ। আপন মনে করুণ সুরে বিড়বিড় করে তুত্তুরী, ‘দাদু(মাতামহ) থাকলে ঠিক জুড়ে দিত।’ হয়তো দিতো। এসব ব্যাপারে দাদু সাক্ষাৎ বিশ্বকর্মা। যুগটাই যে অমন ছিল। প্রাচুর্য শব্দটাই বোধহয় ছিল সবথেকে দুষ্প্রাপ্য।   


তুত্তুরী জন্মের পর শ্বশুরমশাই একবার বলেছিলেন, ‘যা চাইবে সঙ্গে সঙ্গে দিও না। অভাববোধ যেন তৈরী হয়। ’ যিনি এই অমূল্য জ্ঞান দিয়েছিলেন, তুত্তুরী তাঁর প্রাণ। তিনি নিজে এই জ্ঞান ভুলে গেছেন কবেই। তবে তিনি না মানতে পারলেও, আমি থুড়ি আমরা দোঁহে মেনে চলি। থাক না একটু অভাব। তৈরী হোক না সামান্যতম মূল্যবোধ। 


 বাবামায়ের পেশাদারী ব্যস্ততার ফাঁকে মায়ের চপ্পল জোড়াই দখল করে তুত্তুরী। মাত্র কয়েক মুহূর্তের জন্য, তারপরই ফেরৎ দিয়ে যায়, আহাঃ মায়ের পায়ে ঠাণ্ডা লাগবে কি না। ছেঁড়া চপ্পল পরেই বাড়িময় ঘুরতে থাকেন তিনি, কর্মব্যস্ত মাকে অফিস বেরোনোর সময় আশ্বস্ত করেন তিনি,‘ মা এটা তো দিব্যি পরা যাচ্ছে। তোমায় চিন্তা করতে হবে না।’ কড়া আধিকারিক, বিস্তর (অ)জ্ঞানবতী মায়ের চোখের কোণা কেন যে ভিজে ওঠে অকারণে- 


শ্রীরামপুর শ্রমিকমেলার দপ্তরী দায়িত্ব সেরে, তড়িঘড়ি চপ্পলের দোকান খোঁজে মা। বাড়ি ফিরলেই প্রশ্ন করেন তিনি, ‘কি এনেছো মা?’ কোন মিটিং এর ঠাণ্ডা টিফিন প্যাকেটই হোক বা কোন উৎসবের শুঁটকে মার্কা স্টিক বুকে বা ছাপোষা আপদ উত্তরীয়, যেগুলি না পারা যায় বয়ে আনতে না পারি ফেরৎ দিতে, সব ঝেঁটিয়ে বাড়ি আনি আমি। তিনি খুশি হন যে।  আজ অবশ্য যথারীতি ফেলে এসেছি শ্রীরামপুর শ্রমিকমেলার উত্তরীয়টা। বৈদ্যবাটির ইন্সপেক্টর দেবারতির ইন্সপেক্টরগিরির হাতেখড়ি আমাদের চুঁচুড়ায়। আজ আর তার ওপর আমাদের কোন দপ্তরী অধিকার নেই বটে, তবে দপ্তরীয় সম্পর্কের বাইরেও রয়ে গেছে বেশ খানিকটা উষ্ণতা। শ্রীরামপুরের কোন অনুষ্ঠানে গেলেই আমি দেবারতিকে খুঁজি, আর ও আমায়। দেবারতিই পরিয়ে দিয়েছিল সাধ করে। দিব্যি গলায় পরে বসেও ছিলাম, শান্তশিষ্ট নক্ষ্মী অতিথি হিসেবে। তারপর যা হয় আর কি। কখন যে পাট করে পাশে রেখেছি আর মনে নেই।  


যথারীতি, মায়ের জলদি বাড়ি ফেরা তথা নতুন চপ্পল জোড়া উপহার পাওয়ার পরও তাঁর দুঃখ হল ফেলে আসা নীল সাদা উত্তরীয় খানার জন্য। অন্তত একটা নীলসাদা ওড়ণাও যদি মায়ের থাকত, গলায় পরে মান্যগণ্য অতিথি হয়ে ঘুরতেন তিনি। ধুত্তেরি! 

অতিথিবরণের ঝকমকে সোনালী জরি দেওয়া ব্যাজটা অবশ্য দিব্য পছন্দ হল তাঁর। যতো ঝকমকে ততো বেশী পছন্দ, বেশ বুঝলাম রাতে ঘুমাতে যাবার আগে ঐ ব্যাজটি খুলছেন না মাননীয় অতিথি। ব্যাজ পরিয়ে, হাতে পিটুনিয়ার টব ধরিয়ে বরণ করার পর মাননীয় অতিথির সাথে তুলতে হল খানকতক ছবিও। এবার মাননীয় অতিথির ভাষণ দেবার পালা- তবে সে তো অবশ্যি অন্য গল্প। এইভাবেই গড়াক না জীবন, অলসছন্দ প্রতি মুহূর্তে তৈরী করুক না নতুন নতুন গপ্প। ছড়িয়ে পড়ুক ভালোলাগা আর ভালোবাসার রঙ জীবনের প্রতিটি পল থেকে অনুপলে। দর্পনে নিজের প্রতিচ্ছবির মুখোমুখি হয়ে যাতে বলতে পারি,‘ এই বেশ ভালো আছি।’

অনির ডাইরি ২১শে জানুয়ারী, ২০২১


বেলা এগারোটার অ্যালার্ম বাজার সাথে সাথেই দিতে হয় হাজিরা। এগারোটা দশে আসবে লিঙ্ক। সেই লিঙ্ক পাঠাতে হবে অন্য একটা নম্বরে। বাড়িতে ল্যাপটপ খুলে বসে থাকবে একজন। তার নিজের তো ফোন নেই। মাসির ফোনে যায় লিঙ্ক। সেই লিঙ্ক দেখে নিজেই খোলে গুগল মিট। বসায় কোড। তারপর বসে ক্লাস করতে। এই ভাবেই গড়ায় দিন। 

প্রতিটা দিনই নিজের সাথে বয়ে আনে নানা জটিলতা। কোনদিন আচমকা কিবোর্ডে হাত পড়ে গিয়ে উড়ে যায় দরকারী ফাইলপত্র। পাগলের মত তলাশ করে সে। মায়ের আপিসের ল্যাপটপ। মায়ের দরকারী ফাইলপত্র। হারিয়ে গেলে কি হবে? মা যে পড়ে যাবে ভয়ানক বিপদে। হাউহাউ করে কাঁদতে কাঁদতে ফোন করে সে। মা ব্যস্ত জরুরী মিটিং এ। কেজো সুরে ‘পরে করছি’ বলে রাখতে রাখতে হাত কাঁপে মায়ের। গুগল ক্রোমটাও বোধহয় খুঁজে পাচ্ছে না সে। ক্লাশ করবে কি করে। চটজলদি মেটেও না আপদ মিটিংগুলি। 


মিটিং শেষে মা যখন ফোন করে, সে বলে, ‘তুমি চিন্তা করো না মা। আমি ক্রোম খুঁজে বার করেছি। শুধু তোমার ফাইলগুলো খুঁজে পাচ্ছি না।’ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে মা শেখায়, যা হবার তা হবেই। সমস্যায় পড়লে মোকাবিলা করবে। অবলার মত কাঁদতে বসবে না। তবেই না শক্তপোক্ত হবে। 


কখনও বা হ্যাং হয়ে যায় বুড়ো কম্পুটার। কখনও অকারণে নিতেই থাকে আপডেট। আজকাল আর কাঁদে না কেউ। শুধু নার্ভাস গলায় ফোন করে জানতে চায়, ‘ক্লাস যে শুরু হয়ে গেল মা। সবে ৩৫ শতাংশ-’। ঠিক তখনিই দরজা ফাঁক করে মুখ গলায় কোন পরিচিত মুখ, তাড়া তাড়া বিল এসে জমে টেবিলের ওপর। পারে না মা সমস্যা মেটাতে। অসহায় অবলার মত বলে, একটু অপেক্ষা কর। আর ঠাকুর ডাক। সারাদিন এত যে ‘মুণ্ডমালা শোভিনী ভয়ংকরী ত্রিনয়নী’ গেয়ে বেড়াস। বিপদে পড়লে তাকে ডাকিস না কেন? বলতে বলতে বাড়তে থাকে মায়ের হীনমন্যতার মাত্রা। দপ্তরী কাজ করতে করতে মোবাইলের স্ক্রীনের দিকেই তাকিয়ে থাকে মা- কত শতাংশ হল?কিছু বলে না কেন? টুং করে নেচে ওঠে মুঠোফোন- কোন ভারিক্কি দপ্তরী গ্রুপে ভেসে উঠতে থাকে কাজের খতিয়ান। তারই ফাঁকে আসে প্রাণের বাণী, ‘৮৫ শতাংশ মা। তুমি চিন্তা করো না। এই তো খুলে গেল। ওয়াইফাইও লাগিয়ে নিলাম। এবার ক্লাশ করি। ’ কন্যার ক্ষুদ্রতম জয়েও ঝরে পড়তে চায় কড়া আধিকারিকের আনন্দাশ্রু। ঘর ফাঁকা হলে কাঁপা কাঁপা হাতে মেসেজ করে মা, ‘তোমার পাশে না থাকতে পারার বেদনা আমায় কুড়ে কুড়ে খায়। বড় ভালোবাসি যে তোমায়। বাবার থেকেও বেশী। ’ ক্লাস থামিয়ে ধমকে ওঠে মেয়ে, ‘কাজে মন দাও মা। আমি তো রইলামই।’  তাজ্জব মায়ের হৃদয় ভরে ওঠে কানায় কানায়, এমন গতিতে কি আদৌ ছোটার কথা ছিল জীবনের? এত উত্তেজনা- সাফল্য, এত উষ্ণতা, বিষণ্ণতা, হঠাৎ ব্যর্থতা, এত নির্ভরশীলতা,এত ভালোবাসা কি সত্যিই প্রাপ্য ছিল? প্রাপ্য ছিল চূড়ান্ত ঋণাত্মক পরিস্থিতির মধ্যেও এত আনন্দ? কিছুই তো পারতাম না আমি। আজও পারি না। পারি শুধু ভালবাসতে, ভাগ্যিস জীবন সমুদ্রসম, যত ভালোবাসি, ফিরে ফিরে আসে শতগুণ হয়ে।





Saturday 16 January 2021

তুত্তুরী উবাচ, ২০২১


তুত্তুরী উবাচ ৩০শে এপ্রিল, ২০২১


(মাসির সাথে দাবাখেলা নিয়ে সক্কাল সক্কাল তুমুল বিবাদ, বেশ কিছুক্ষণ বাক্যালাপ বন্ধ এবং অবশেষে মায়ের পীড়নে ক্ষমা চেয়ে মিটমাট করার পর)  


👩🏻-দেখছ তো, ক্ষমা চাইলে আর শাস্তি পেতে হয় না। 

👧🏻-(হাসি চেপে) তাই বলে খুন করে ক্ষমা চাইলে কি আর মার্জনা করা হয়?

👩🏻-(জ্ঞান দেবার সুরে) নাঃ তা হ-য়-না। তবে ফাঁসিও হয় না। যাবজ্জীবন  কারাদণ্ড হয় হয়তো, অথবা সাত আট বছরের জেল।  

👧🏻-(খানিক চিন্তা করে) আচ্ছা মা কেউ যদি আমার ছুরির ওপর পেট নিয়ে আসে, তাহলেও কি আমার শাস্তি হবে?

👩🏻-(প্রবল হাসির দমকে, কাশতে কাশতে) এ আবার কেমন প্রশ্ন। কেউ খামোকা তোর ছুরির ওপর পেট নিয়ে আসতে যাবে কেন? 

👧🏻-(বোঝানোর ঢঙে) নাঃ ধর, আমি রাস্তা দিয়ে ছুরি নিয়ে যাচ্ছি, কেউ পেট নিয়ে আমার ছুরির ওপর পড়ল-

👩🏻- (হাসতে হাসতে) তুই খামোকা রাস্তা দিয়ে ছুরি নিয়ে যাবিই বা কেন? আর যদি যাস ও তাহলে এমন ভাবে মুড়ে নিয়ে যাবি,যাতে হোঃ হোঃ হোঃ কেউ তোর ছুরির ওপর পেট না নিয়ে আসতে পারে।  

👧🏻-(খানিক ভাবনা চিন্তা, খানিক পায়চারি যাকে ঠাম্মা বলে ‘হুমহাম’ করে পুনরায় রান্নাঘরের দরজায় আবির্ভূত  হয়ে) আচ্ছা মা, তুমি দৌড় বোম্বাই আম খেয়েছ?

👩🏻-(তাজ্জব হয়ে) অ্যাঁ? সে আবার কি? 

👧🏻-(বোঝানোর ঢঙে) হ্যাঁ গো মা। এক ধরণের আম আছে, যার নাম দৌড় বোম্বাই আম। মাম্মাম (দিদা)  মাঝেমাঝে কিনে আনত, অফিস ফেরত। দাদু বলেছে সেই আম এত টক যে বাঘের পিছনে দিলে বাঘ দৌড়ে পালাবে। 

👩🏻-(হাসতে হাসতে বিষম খেয়ে) কি শুরু করেছিস তোরা বলতো? খামোখা বাঘের পিছনে আম দিতে যাবি কেন?



 তুত্তুরী উবাচ, ৬ই এপ্রিল, ২০২১


👧🏻-(খেতে বসে উত্তেজিত হয়ে) মাসি তুমি আবার শুক্তোতে উচ্ছে দিয়েছ? 

👩🏽‍🍳-(তাজ্জব হয়ে) শুক্তো তো উচ্ছে করলা দিয়েই হয়। উচ্ছে না দিলে আবার শুক্তো হয় নাকি? 

👧🏻-(যুক্তি মেনে খানিক ভাত খেয়ে, পুলকিত স্বরে) মাসি জানো তো আমার মাথায় না সবসময় উল্টোপাল্টা চিন্তা ঘোরে। যেমন ধরো, রসগোল্লার শুক্তো আর উচ্ছের পায়েস রাঁধলে কেমন খেতে হবে? তুমি একদিন রাঁধবে?


(বিশেষ পাত্তা না খেয়ে খানিকবাদে দাদুকে ফোন করে) 


হ্যালো দাদু, জানো তো অামার মাথায় সবসময় নানা উদ্ভট চিন্তা আসে। আচ্ছা তুমি বলো তো, কলাগাছের চারা থেকেই তো কলা হয়, আবার সেই কলার বীজ থেকেই তো গাছ হয়, তাহলে প্রথম কলাগাছের চারাটা এসেছিল কোথা থেকে?


তুত্তুরী উবাচ ২রা এপ্রিল, ২০২১


👧🏻-(ঘুম চোখে, দুধের কাপে চুমুক দিয়ে) হ্যালো দাদু, একটা গল্প বলো না। 

👴🏻-  (প্রাতকালীন চিনি ছাড়া চায়ে চুমুক দিয়ে, ক্লান্ত সুরে) সকাল সকাল কি গল্প শোনাই বলো তো। বুড়ো হয়েছি, মাথা কি আর অত চলে। তুমিই বরং একটা গল্প শোনাও। 

👧🏻-(খুশি হয়ে,তরল গলায়) আচ্ছা দাদু, শ্রীকৃষ্ণের যে ১৬১০৮টা বউ ছিল তুমি জানতে?

👴🏻- বেশ।  শুনলাম। অত জন একসাথে থাকত?

👧🏻- আরে নাঃ। অষ্ট ভার্যার আটটা মহল ছিল-

👴🏻- অষ্ট ভার্যা?

👧🏻- হ্যাঁ, রুক্ষ্মিণী, জাম্ববতী, সত্যভামা, কালিন্দী,মিত্রাবিন্দা,নাগনাজীতি, ভদ্রা আর লক্ষ্মণা। 

👴🏻- (ক্লান্তি চেপে)অ। আর বাকি ১৬১০০?

👧🏻- তারা? তাদের গল্প আলাদা। তুমি শুনবে?

👴🏻-(আঁতকে উঠে) না। না। এতজনের কথা বলতে গিয়ে তোমার আমার চার-পাঁচদিন কেটে যাবে। 

👵🏼-(দিদা থুড়ি মামমাম পাশ থেকে মিনতির সুরে) সকাল থেকে কেন এসব কেষ্টবিষ্টু নিয়ে পড়েছ মা। একটু পড়তে বসো না মায়ের কাছে। 

👧🏻-(ঠক্ করে দুধের কাপ নামিয়ে ঝাঁঝালো সুরে) কারো ঠাকুমা-দিদিমা যে তাদের ঘুম থেকে উঠেই পড়তে বসতে বলে, এ আমি জীবনেও শুনিনি।  (অতঃপর কিঞ্চিৎ শান্ত হয়ে দাদুর উদ্দেশ্যে) শোননা, এক অসুর ছিল, তার নাম ছিল নকাসুর। 

👴🏻-( মধ্যস্থতার সুরে) নকাসুর! কি অদ্ভূত নাম। শুনে খুউব ভালো লাগল। 

👧🏻-(তুরীয় মেজাজে) নকাসুর ১৬১০০জন সুন্দরী মেয়েকে ধরে এনেছিল। সবাই অভিজাত বাড়ির মেয়ে। তাদের বাড়ির লোকেরা শ্রীকৃষ্ণের কাছে নালিশ করল, শুনে শ্রীকৃষ্ণ তো গেল ক্ষেপে,বলল, ‘এই নকা, আজ তোর একদিন কি আমার একদিন।’ তারপর যুদ্ধ হল আর শ্রীকৃষ্ণ নকাসুরকে বধ করল। তারপর হল কি, শ্রীকৃষ্ণ ঐ ১৬১০০জন কন্যাকে তাদের বাবামায়ের কাছে ফেরৎ দিতে গেল-‘একে কি আপনারা নেবেন? তারা বলল,‘ না নেবো না। ’

👴🏻- (দুঃখী স্বরে) কি অবিচার!

👧🏻- হ্যাঁ তো। তখন  শ্রীকৃষ্ণ কোন উপায় খুঁজে না পেয়ে তাদের বিয়েই করে নিল। 

👴🏻-(হতভম্ব স্বরে) একসাথে?

👧🏻-(মাথা চুলকে) হ্যাঁ তাই বোধহয়। একটা একটা করে বিয়ে করতে তো পাঁচ ছয় বছর কেটে যেত- 

👴🏻-(দুষ্টুমির সুরে) তাহলে একটা কাপড়ে এতগুলো গাঁটছড়া বাঁধা হল কি করে? শ্রীকৃষ্ণ কি মালায় ঢেকে গিয়েছিল? একদিনে এতজনকে মালাই বা পরাল কি করে? 

👧🏻-(চিন্তিত সুরে) তা জানি না। (বিজ্ঞ ভাবে) কিন্তু বিয়ের পর শ্রীকৃষ্ণ কখনও তাদের সাথে থাকেনি। বা কথা বলেনি,বা সম্পর্কও রাখেনি। 

👴🏻-তারা কোথায় থাকত?

👧🏻- দ্বারকামহলেই হবে।

👴🏻-অ।  অষ্ট ভার্যা ছাড়া তাহলে আর কারো সাথেই সম্পর্ক রাখেনি শ্রীকৃষ্ণ?

👧🏻- নাঃ। (আহ্লাদী সুরে) তোমার কেমন লাগল গল্পটা দাদু। 

👴🏻-(ক্ষ্যামা চাওয়ার সুরে) খুউব ভালো লেগেছে। সকাল সকাল এত বিয়ের গল্প শুনে তো আমারই আর একটা বিয়ে করতে ইচ্ছে করছে।

তুত্তুরী উবাচ ১৯শে মার্চ, ২০২১


👧🏻-(সকাল সকাল দুধের কাপ হাতে গম্ভীর গলায়) হ্যালো, ইলেকশন কমিশন থেকে বলছি। সরমা চ্যাটার্জী বলছেন?

👴🏻-(হাসি চেপে)হ্যাঁ বলছি। 

👧🏻-(আরো গম্ভীর গলায়,ধমকের সুরে) না বলছেন না। তিনি তো মহিলা। 

👴🏻-(কৌতুকের সুরে) উনি আমার বউ। বেবিকটে শুয়ে শুয়ে এখন কাঁদছেন। 

👧🏻- (উত্তেজিত হয়ে) অ্যাঁ? ওণার এত বড় সাহস? উনি আবার জন্মেছেন? ওণার ভোটে নাম কেটে গেছে দ্বিতীয়বার জন্মানোর অপরাধে। (কিঞ্চিৎ ধাতস্থ হয়ে) আচ্ছা সরমা চ্যাটার্জিকে দিন। 

👵🏼-( স্নেহাদ্র কণ্ঠে) হ্যাঁ সন্তু বলো। (প্রসঙ্গতঃ তুত্তুরীকে তার দিদা আদর করে সন্তু বলেও ডাকেন। )

👧🏻-(পুনরায় ধমকে) কে সন্তু? আমি ইলেকশন কমিশন থেকে বলছি। ধ্যারঃ, আপনি দ্বিতীয়বার জন্মেছেন কোন সাহসে? এই অপরাধে ভোট থেকে আপনার নাম কেটে গেছে জানেন?

👵🏼-(আদর মাখা কণ্ঠে) ও আচ্ছা। এবার কি হবে?

👧🏻-(হাসি গোপন করে, উত্তেজক কণ্ঠে) কি আর হবে? আবার নাম তুলতে হবে। আপনি শীঘ্রই আপনার পাখি কার্ড, প্যান কার্ড, আধার কার্ড বানিয়ে নিয়ে আসুন। 

👵🏼- ও আচ্ছা। তা পাখিটাকেও কি ভোট দিতে নিয়ে যাব?

👧🏻-হ্যাঁ। আপনার পাড়ার সব লোককে বলুন, তাদের পোষা পশুপাখি নিয়ে যেন ভোট দিতে আসে। আপনারা ভোট দেবেন আর আমরা ওদের গায়ে দাগ কেটে দেব। 

👵🏼-(ক্ষ্যামা দেওয়া সুরে) আ-চ-ছা। 

👧🏻-(মজার সুরে) তা আপনি তো একটা ছোট বাচ্ছা,বেবি কটে শুয়ে কাঁদছেন, আপনার দুধ টুধ কম পড়েনি তো? 

👵🏼-না না কিচ্ছু কম পড়েনি। তুমি বরং এবার আমার পাকা চুলো বুড়ো বরটার সাথে কথা বলো।  

👴🏻-(দাদুর গলা পেয়ে, পুনরায় ধমকে) এই যে, আপনার বউ দ্বিতীয়বার জন্মেছে, এই অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত স্বরূপ আপনাকে একখানা কুকুর পুষতে হবে। 

👴🏻-কেন? আমাকে কি এবার কুকুরটাকেও বিয়ে করতে হবে?

👧🏻-(হেসে কুটোপুটি হয়ে) উফঃ আমি আর পারছি না। ইলেকশন কমিশন সেজে নতুন ডায়লগ বানানো আর সম্ভব নয়। দাদু আমি আবার তোমার সোনার তুত্তুরী হয়ে গেছি। একটা গল্প বলো-

তুত্তুরী উবাচ, ১৫ই মার্চ ২০২১


👧🏻-আচ্ছা বাবা, ইনস্যাশিয়েবল সেক্সুয়াল অ্যাপেটাইট মানে কি? ( অফিস টাইমের ভাত খেতে বসেছে শৌভিক, পাশেই বসে ইংলিশ লিটারেচর পরীক্ষা দিচ্ছে তুত্তুরী। এক পলক আমার দিকে অসহায ভাবে তাকিয়ে পুনরায় ভাত খাওয়ায় মন দিল। অগত্যা-)

👩🏻- (ভালো মানুষের মত মুখ করে) পরীক্ষায় এসেছে? কোন চ্যাপ্টার থেকে বল তো?

👧🏻- (লেখা থামিয়ে, চোখ তুলে) নাঃ পরীক্ষায় আসেনি। একজনের সম্বন্ধে পড়লাম। তাই জানতে চাইছি- 

👩🏻-পড়লি? আচ্ছা কোথায় পড়লি? কনটেক্সটটা একটু  বল, তবে না মানে বলতে পারব- 

👧🏻- দ্রৌপদীর সম্বন্ধে পড়লাম। গুগল বলল। আগের জন্মে দ্রৌপদী একজন ঋষির বউ ছিল। গুগল বলছে ইনস্যাশিয়েবল সেক্সুয়াল অ্যাপেটাইটের জন্য তার বর তাকে অভিশাপ দিয়েছিল, পরের জন্মে তোমার একটা নয়, দুটো নয়, পাঁচ পাঁচটা বর হবে। সবটা বুঝতে পারলাম, শুধু ঐটুকু বুঝিনি। তাই বাবার কাছে জানতে চাইছি-

👩🏻-(বেচারী বাবার করুণ মুখ দেখে হাসি গোপন করে) তার মানে হল একটা বরে সে সন্তুষ্ট ছিল না। 

👧🏻-মানে? বরের ওপর অসন্তুষ্ট কেন ছিল?

👩🏻- তার আরও চাহিদা ছিল (বলেই প্রমাদ গুণলাম)

👧🏻- কিসের চাহিদা ছিল মা? আরোও গয়নার- 

👩🏻-(স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে) হ্যাঁ আরো ভালো ভালো শাড়ি,  আরোও গয়না, খাওয়া, বেড়াতে যাওয়া এইসব আর কি।  

👧🏻-আচ্ছা। (তরল স্বরে) জান তো মা, দ্রৌপদীর ছেলেদের নামগুলো কি শক্ত, আমি তো উচ্চারণ করতেই পারলাম না। বেচারী দ্রৌপদী, দ্রৌপদী শুধু অর্জুনকেই ভালোবাসত। ( বিজ্ঞ স্বরে) অর্জুন কিন্তু দ্রৌপদীকে ভালোবাসত না। অর্জুন শুধু সুভদ্রা আর চিত্রাঙ্গদাকেই ভালোবাসত। 

👨🏻-(গম্ভীর মুখে)কথা হয়েছে? 

👧🏻-(থতমত খেয়ে) কার সাথে অর্জুনের সাথে? (হাসিতে ফেটে পড়ে) নাঃ অর্জুন পিসের সাথেও হয়নি। তবে গুগল কাকার সাথে হয়েছে।

তুত্তুরী উবাচ ১১ই মার্চ ২০২১

-আরেঃ।  কি করছিস? এই অন্ধকারে ছবি তুলছিস কেন? 

-(দৃঢ় স্বরে) আমি এই মশাটার ভিডিও তুলে ভাইরাল করে দেবো। তখন থেকে পোঁ পোঁ করে জ্বালাচ্ছে। মা

-(হাসি চেপে) মশার ভিডিও ভাইরাল করলে কি হবে?

-(দাঁতে দাঁত চেপে) তখন ওকে সবাই চিনে যাবে, আর পুলিশে ধরে নিয়ে গিয়ে জেলে পুরে দেবে। 

-কাকে?

-(তিক্ত স্বরে) মশাটাকে। আবার কাকে? (অতঃপর তরল স্বরে) মা জানো তো মশাদের জেল কেমন হয়? আমাদের জেলের মত হয় না। তাতে ছোট ছোট ফুটো থাকে। যাতে মশারা না পালাতে পারে। (আচমকা তেড়ে ফুঁড়ে উঠে) এই মশা জেলে যাবি? 


তুত্তুরী উবাচ ৮ই ফেব্রুয়ারি ২০২১

👧🏻-(বাড়ি ঢোকার সাথে সাথে অত্যুৎসাহী হয়ে) মা, আমি আজ মিসকে বলেছি, বাবা তো ইলেকশন নিয়ে ভীষন ব্যস্ত, আর মায়েরও খুব চাপ। সকালে আমায় একটু খানি পড়িয়েই মা অফিস বেরিয়ে যায়-

👩🏻-(ক্লান্ত স্বরে) মোদ্দা কথাটা বল। 

👧🏻- তাই বললাম আর কি, যদি আমি আর আমার মাসি যাই প্রজেক্ট জমা করতে? মিস বলল সরি চাইল্ড। আই কান্ট অ্যালাও। প্লিজ টক টু ইয়োর পেরেন্টস্। 

👩🏻-ঠিকই তো বলেছে। তোকে এত কথা বলতে কে বলেছে? প্রজেক্টটা ডেকরেট করতে হবে কি না শুধু এইটুকু জানতে বলেছিলাম। 

👧🏻-হ্যাঁ করতে হবে তো। ম্যাম বললেন ইয়েস চাইল্ড। ডেকরেট ইট উইথ স্টোন স্টিকারস্। 

👩🏻-(ভ্যেংচি কেটে)ডেকরেট উইথ স্টোন স্টিকার্স! যেই বড়মামা কিনে দিল, অমনি মিস বলল, ঐটা দিয়েই ডেকরেট করতে হবে?

👧🏻-(নিষ্পাপ মুখে) তা আমি কি জানি? জানো তো মা, সেদিন বড়মামা আমাকে আর দাদাকে নিয়ে কদমতলা বাজার গেল না, ওই যে গো স্টোন স্টিকার কিনতে, ফেরার পথে একটা বাজারওলার কাছ থেকে কি যেন একটা কিনল। বেশী না পাঁচশ গ্রাম মাত্র। কেনার সময় বড় মামা আমায় প্রশ্ন করল, ‘এটা কি বলতো?’ আমি বললাম বরবটি। শুনে বড় মামার কি হাসি। বলল,‘তুই নাকি তোর বাবার সাথে রোজ বাজার যাস? এই তুই বাজার চিনিস?’ তারপর দাদাকে প্রশ্ন করল, ‘তুই বলতো দেখি?’ দাদা বলল, ‘ঢ্যাঁড়শ’। ওটা আসলে কি ছিল জানো? ডাঁটা। 

বড়মামা তাই হাসতে হাসতে  কি বলল জানো? বলল,‘এরা সব এক গোয়ালের গরু।  একটা বোকা গরু আর একটা চালাক গরু। ’ 

👩🏻- (হাসি চেপে) বোকা গরুটা কে? 

👧🏻-( দুষ্টু  দুষ্টু মুখে) দাদা।


তুত্তুরী উবাচ ৩রা ফেব্রুয়ারি, ২০২১


👧🏻-হ্যালো এষা পিসি! (আদুরে গলায়) কি করছ?

👩🏻‍🎓-এই তো সবে বাড়ি ঢুকলাম। তুই কি করছিস?

👧🏻- তেমন কিছু না। এবার মাছেদের খেতে দেবো। 

👩🏻‍🎓- হ্যাঁ আমিও দেবো।

👧🏻- তোমাদের অ্যাকোরিয়ামে কটা মাছ আছে?

👩🏻‍🎓- আপাততঃ একটা। বাকি গুলো মরে গেছে। 

👧🏻-এ বাবা। মাত্র একটা? আরোও কয়েকটা কেনো না শিগ্গির। 

👩🏻‍🎓-(নালিশের সুরে) তোর পিসেকে বল। যখনই বলি, একই কথা-‘ওটা আগে মরুক। তখন কিনব’। 

👧🏻-(হতভম্ব হয়ে) ওটা কি চাল নাকি, যে শেষ হলে তবে কিনে আনবে?

তুত্তুরী উবাচ ১৬ই জানুয়ারী, ২০২১


👧🏻-(দরজা খোলার সাথে সাথে) মা জানো আজ কত বড় বিপদ হচ্ছিল? আমি তো ঠাম্মা দাদুর কাছে যাচ্ছি, পথে বড় মাঠটার কাছে দেখি কয়েকটা তুলোর বলের মত কুকুর ছানা গড়াগড়ি খাচ্ছে। আমি দাঁড়িয়ে খানিকক্ষণ ওদের খেলা দেখলাম। তারপর দেখি ওরা কোথায় যেন চলে গেল। আর ওদের মা’টা এতক্ষণ দূর থেকে আমায় দেখছিল, সে এসে আমায় শুঁকতে লাগল। তারপর আমার গায়ে দুধের গন্ধ পেয়ে সটান আমার বুকে পা তুলে দাঁড়িয়ে পড়েছিল। 

👩🏻-সে কি রে বাবু। কি সর্বনাশ। তারপর?

👧🏻- তারপর আর কি? আমি তো প্রবল চিৎকার করতে লাগলাম, বাঁচান! বাঁচান! একটা লোক দৌড়ে এল, ‘কি হয়েছে?’ আমি বললাম, ‘এই যে কৌটোটা দেখছেন এতে গুড়ের পায়েস আছে। আমার মা দিয়েছে ঠাম্মা-দাদুর জন্য। এই পায়েসের লোভে কুতুয়াটা আমায় আক্রমণ করছে-। ঐ সামনেই তো দাদুর ফ্ল্যাট। আমাকে একটু ঐ বিল্ডিং অবধি এগিয়ে দিন না প্লিজ’। 

👩🏻-বাপরেঃ। তুই তো বীরাঙ্গনা রে। কি সুন্দর বিপদে থেকে নিজেকে উদ্ধার করেছিস। প্রাউড অব ইউ। 

👧🏻- হ্যাঁ জানো তো, দাদু বলল, ‘আমি তোমাকে আর একা ফিরতে দিচ্ছি না।’ শেষে কাকিমা সাইকেলে চাপিয়ে পৌঁছে দিল। 

👩🏻-বাঃ। খুব ভালো। 

👧🏻- জানো তো মা, লোকটা ঠাম্মা দাদুর বাড়ি অবধি এগিয়ে দিয়ে বলল,‘তুমি রোজ ফ্লাওয়ার শো দেখতে আসো না? ডালিয়ার কুঁড়িটা কি তুমি ছিঁড়েছ?’ আরেঃ আমি ছিঁড়ব কেন? তুই ব্যাটা অপদার্থ। অামাদের ডালিয়া গাছে কুঁড়ি এসে গেল আর তোদের এল না?  

👩🏻- আচ্ছা এবার থাম। আর বড়দের অপদার্থ বলতে নেই । বিশেষতঃ উপকারীকে তো নয়ই। 

👧🏻-বড়রা ছোটোদের বলতে পারে?

👩🏻-হ্যাঁ। 

👧🏻- আজব নিয়ম তো? (মা নিরুত্তর দেখে, ফাজিল সুরে) মা হাতিদের টুথপিক লাগে?

👩🏻-(বিরক্ত সুরে) আমি জানি না। যত উৎকট কথাবার্তা। 

👧🏻-(আরো খানিকবাদে,রহস্যের সুরে) মা বলোতো কোন ভারতীয় মহিলা প্রথম বিদেশে গিয়েছিলেন?

👩🏻-(চিন্তার সুরে) মাদাম কামা? না না দাঁড়া। সম্রাট অশোকের কন্যা সংঘমিত্রা। 

👧🏻-(ফাজিল সুরে) হল না। প্রথম বিদেশ যাওয়া ভারতীয় মহিলা  হলেন সীতা। শ্রীলঙ্কায় গিয়েছিল না? অার তার পিছন পিছন গিয়েছিল রাম। 

👩🏻-(তিক্ত সুরে) কোথা থেকে শিখিস এই পচাপাতকো জোকস্? হানিবানি থেকে?

👧🏻-(বিজ্ঞের সুরে)না না। আমি ইয়ে মানে ভেবে ভেবে বার করেছি। (খানিকপরে, আহ্লাদী সুরে) কি করছ বাবা? এপিক জেনারেট করছ? দাও না আমিও একটু করি?

👨🏻-(বিরক্ত সুরে) আর বাজে বকিস না তো। তুই করলে আমার চাকরী থাকবে?

👧🏻-(অবাক সুরে) আরে? এপিক জেনারেট হলেই তো হলো নাকি? শৌভিক ভট্টাচার্য করল না পুরোযা ভট্টাচার্য তাতে ওদের কি? 

(কিছুক্ষণ অন্যমনস্ক থেকে) আচ্ছা বাবা,কেউ যদি কানের ফুটোতে বন্দুকের নল ঢুকিয়ে চালায়, তাহলে কি সে খুব জোর আওয়াজ শুনবে?

👨🏻-(কম্পুটার চালাতে চালাতে প্রায় বিষম খেয়ে) সে কোন অাওয়াজই আর শুনতে পাবে না।

তুত্তুরী উবাচ ২৮শে জানুয়ারী, ২০২১


👧🏻-হ্যালো মামমাম। (আদুরে সুরে) হ্যাঁ মামমাম, চটি পরেছি। হ্যাঁ মা'ই তো এনে দিয়েছে কালকে। চটিটায় না কালকে দেখছিলাম সুগন্ধী তেল মাখানো ছিল। পরলেই পা হড়কে যাচ্ছিল। আজ ঠিক হয়ে গেছে মামমাম। কি নরম চটিটা। তুমি সেদিন বলছিলে না, তোমার ঐ আকুপ্রেশারওয়ালা চটিটা পরলে পায়ে লাগে, মাকে বলব তোমায়ও একটা কিনে দিতে। এই চটিটা পরলে পায়ের সব ময়লা উঠে যায়- পাটা ঝকঝক করে।

👩🏻-( পাশ থেকে ভেংচি কেটে) হ্যাঁ। কারণ পায়ের সব কালিঝুলি গিয়ে চটিতে লাগে। একদিনেই চটিটার হাল করেছে দেখো। 

👧🏻-উফ্। বড় বিরক্ত করো মা তুমি।(পুনরায় আবদারের সুরে) তোমার মেয়ে বড্ড জ্বালাতন করে মামমাম। সারাদিন শুধু (ভেঙিয়ে) 'পড়-পড়' করে পিছনেই পড়ে থাকে।(মায়ের থেকে একটু সরে গিয়ে,অভিমানী সুরে) জানো তো মামমাম, বাবাও আজ আমায় বকেছে। 

👵🏽- বাবা তো বকে না মা। কেন বকেছে? 

👧🏻- কেন আবার? আমি আঙুল চাটছিলাম তাই। 

👵🏽- খামোকা আঙুল চাটছিলে কেন? 

👧🏻- আরেঃ আমি মাছের ঝোলের সাথে লেবু মেখে ভাত খেয়েছিলাম। তারপর দই দিয়ে ভাত খাবার আগে ভাবলাম, লেবুর রসে যদি দুধ কেটে যায়, তাহলে দইটাও তো কেটে যাবে। তাই ভালো করে হাত চাটছিলাম। বাবা ধমকে বলল, ‘দুধ কেটেই তো দই হয়। দই খামোকা কাটতে যাবে কেন?’

(প্রসঙ্গ বদলে) দাদু আবার কবে রেশন আনতে যাবে? আমিও যাব তাহলে-। সেদিন খুব মজা হয়েছিল। দাদু তো আমায় রিক্সায় বসিয়ে আর কুড়িটাকার নোটটা দিয়ে রেশন তুলতে গেছে, বলে গেছে ,‘তুমি রিক্সাটাকে ধরে রেখো তুত্তুরী। ’ আমি তো রিক্সাটাকে চেপে ধরে বসেই আছি, বসেই আছি। রিক্সাওয়ালাটা বলে কিনা, ‘ বাবু একবার নামো তো।’ আমি ভাবলাম,পিছনের কাপড়টা ঠিক করবে বুঝি। যেই নামলাম, ওমনি অন্য একটা বুড়োকে বসিয়ে পোঁপাঁ দৌড়। আমি বোকার মত খানিক দাঁড়িয়ে রইলাম। তারপর গুটি গুটি দাদুর কাছে গিয়ে হাজির হলাম। দাদু তো হতবাক। ‘তোকে রিক্সাটাকে ধরে রাখতে বললাম যে-।’ ভাগ্যিস টাকাটা দিয়ে দিইনি।  তারপর রেশন নিয়ে রাস্তায় এসে আবার অন্য একটা রিক্সা ধরলাম আমরা। রিক্সায় ওঠার সময় দাদু বলল ,‘তুত্তুরী তুমি ঐ দিকটায় বসো। আমি একদিকে বসব। এদিকে রোদ আসছে,।  আমি রোদ পোহাতে পোহাতে যাব। ’শুনে তো আমি হেসে বাঁচি না। দাদু কি কুমীর নাকি? যে রোদ পোহাবে? 

যাই বলো। খুব মজা হয়েছিল সেদিন। জানো তো মামমাম, রেশন দোকানে প্যাকেটের মাল পাওয়া যায় না। সব গোটা গোটা। সব বিনা পয়সায় পাওয়া যায় রেশনে। 

👴🏼-(দাদু পাশ থেকে গলা তুলে) বিনা পয়সায়? ওটা কি আমার শ্বশুরমশাইয়ের দোকান নাকি রে?

Sunday 3 January 2021

অনির ডাইরি, ৩১শে ডিসেম্বর, ২০২০

 

“ঝটক কে গেঁসু যাঁহা চলে,তো সাথ মেঁ আশমাঁ চলে-”

সকাল আটটা। কিশোর কুমারের মধু ঢালা কণ্ঠ থামিয়ে বেজে ওঠা ফোনটা যখন ধরলাম, সিক্ত কেশ গুচ্ছ দিয়ে টপাটপ ঝরে পড়ছে মুক্তোকণা। গানটাকে গত রাতে কিছুতেই খুঁজে পাইনি। আজ সকালে অনুধাবন করলাম, “কেয়া সুরৎ হ্যায়” বলে অন্বেষণ করলে, “জরুরৎ হ্যায়”কে খুঁজে পাওয়া যায় না। 


ফোনের ওপারে জনৈক মস্ত বড় সাহেবের পিএ। ঘুম জড়ানো অসহায় কণ্ঠে জানান, অনিবার্য কারণ বশতঃ আজকের বৈঠক বাতিল। বসের নির্দেশ সবাইকে জানাতে হবে, অথচ ওণার গৃহে বা মোবাইলে কারো নম্বর নেই। লাজুক কণ্ঠে সবিনয় অনুরোধ, যদি বাকি আধিকারিকদের এট্টু জানিয়ে দিই- অত্যন্ত আনন্দের সাথে রাজি হয়ে যাই।  বর্ষবরণের প্রাক্কালে বৈঠক বাতিলের সংবাদ বহন অতীব পূণ্যকর্ম। 


আজ বছরের শেষ দিন। কোন এককালে এমন দিনে আপিস যেতে ডাক ছেড়ে কান্না পেত। উৎসব মুখর শহর আর খুশি খুশি নাগরিক বৃন্দ জাগাত ভয়ানক হীনমন্যতা।  জমানাই ছিল ভিন্ন, আর শৌভিকের ভাষায় আপিসটাও ছিল ‘জঘন্যের কাকাবাবু’।


এ হেন বালখিল্যচিত ছিঁচকাঁদুনে দুঃখবিলাস অবশ্যি আজকাল আর অনুভূত হয় না। জেলাটা ভালো, আপিসটা ভালো, লোকজন ভালো আর সবার ওপরে আপাততঃ মোদের শিরে সংক্রান্তি। 


আরে মশাই, বারো দিন বাদে আমাদের মেলা বুইলেন। সময় কম, লোক বল তলানিতে আর অর্থ বল? বাজেট কাটতেছাঁটতে যাকে বলে জেরবার আমরা। নির্দয় হাতে ছাঁটা হচ্ছে মেলার যাবতীয় সৌন্দর্যায়ন।  প্রতিপদে কেটারার আর ডেকরেটরের সাথে দরদাম করে চলেছে আমার অবশিষ্ট খঞ্জভঙ্গ টিম। শেষে গতকাল উনি হতাশ হয়ে বললেন, “বাজারদর সম্পর্কে আপনাদের কোন ধারণা আছে ম্যাডাম? আলু-পেঁয়াজের দাম জানেন? গ্যাসের দাম জানেন?” আলু-পেঁয়াজের সঠিক দাম না জানলেও, জানি বাজারে লেগেছে আগুন। আর সদ্য অনলাইন গ্যাসের বিল দিলাম, তাই এমাসে গ্যাসের দামটা ঠোঁটস্থ। উনি আমাদের সম্মিলিত অত্যাচারে এই ঠাণ্ডাতেও ঘেমে উঠেছিলেন। কপালের ঘাম মুছে হেসে বললেন, “ওটা তো ডোমেস্টিক ম্যাডাম। কমার্শিয়াল সিলিণ্ডার আরও অনেক বেশী মূল্যবান।” সে হোক। আমরা নিরূপায়। আপনার যা প্রাণ চায় করুন। যা খুশি বিল দিন। আমার এইটুকুই  সম্বল- 


সকাল নটা। গুড় নিয়ে ফিরল তুত্তুরী। গিয়েছিল আখের গুড় আনতে। কিনে এনেছে ভেলিগুড়। একখানা জাম্বো নারকেল দিয়েছে মা। বেহারী নারকেল। দেশ থেকে এনে দিয়েছে পৌরসভার ঝাড়ুদার। রোজ ময়লা নিতে এসে খোশগল্প করে বাবা আর মায়ের সাথে। যত এদের নিষেধ করি, অপরিচিত অর্ধপরিচিত মানুষের সাথে এত খোশ গপ্প করো না। জমানা খারাপ। তা শুনলে তো? কদিন আগে বোধহয় মা বলেছিল আমার জামাই আর নাতনী নারকেল নাড়ু খেতে বড় ভালোবাসে। বাজার গিয়ে বাবার পক্ষে নারকেল কিনে আনা প্রায় অসম্ভব। স্থানীয় যারা বাজার নিয়ে বসে তারা তো আর নারকেল বিক্রি করে না।  


মায়ের দুঃখে গলে গিয়ে, চারদিন কাজে ডুব মেরে, চার খানা খোক্ষস মার্কা নারকেল এনে দিয়েছে ঝাড়ুদার। দরাদরি অন্তে নগদ ৩৫০টাকায় কেনা চারখানা নারকেল, যার দুখানি নাড়ু রূপে আর একখানি গোটাগুটি এসে হাজির হয়েছেন আমার গৃহে। নারকেল তো পেলাম,ফাটাই কি দিয়ে? ছোট নারকেল হলে বাটনা বাটার নোড়া মেরে ঘায়েল করে লতা দি। এটা যা জাঁদরেল। 


রমেশকে বলেছিলাম একটা কাটারি কিনে দিবি বাবা? অত্যুৎসাহী জনগণ যত। নিজের বাড়ির ভারি কাটারিটাই গছিয়েছে দিন কয়েকের জন্য। তিনি এসেছেন তো এসেইছেন। কাজে আর লাগানো হচ্ছে না তাঁকে। মায়ের হাতের নাড়ু শেষ হলে তবে না নতুন নাড়ু পাকাব। 


গতকালই লতাদিকে বললাম,যা হয় হোক, এবার কাটারিটা ফেরৎ দিতে হবে। ভেবেছিলাম বছর শেষে আপিস ফেরতা চিনির নাড়ু পাকাব। বাপ-মেয়ের না পসন্দ। সাতসকালে তাই কৌটো নিয়ে দৌড়েছিল তুত্তুরী পাঁচশ আখের গুড় আনতে। মেয়েকে দোকানে পাঠাতে খুব একটা স্বচ্ছন্দ বোধ করে না শৌভিক। ভয় পায়। যা ট্যালা মেয়ে। তাই টাকাপয়সা ছাড়াই দোকান যায় তুত্তুরী। দোকানদার হোয়াটস্ অ্যাপে পাঠিয়ে দেয় বিল।  


আজ তিনি অনুপস্থিত। দোকানের পুঁচকে কর্মচারী আখের গুড় বোঝেনি। পাঁচশ ভেলি গুড় গছিয়েছে। তাই নিয়েই নাচতে নাচতে বাড়ি ফিরেছে আমার কন্যা। 


আখের গুড়ের পরিবর্তে ভেলি গুড় এনেছে বটে, তবে পথে কোন বুড়ো রিক্সাওয়ালা নাকি মামণি বলে ডেকে বিনামূল্যে বাড়ি পৌঁছে দিতে চেয়েছে, তাকে দিব্য মায়ের ভয় দেখিয়ে পাশ কাটিয়ে ফিরে এসেছে ট্যালা মেয়েটা। বর্ষ শেষে এটাই কম পাওনা কি? রোমে টিকতে হলে রোমান হতে হয়, আর জঙ্গলে বাস করতে হলে- 


বেলা দশটা- “আজ কোথাও যাচ্ছ তোমরা?” ফোনের ওপার থেকে সংকুচিত ভাবে জানতে চাইল উমা।  তুত্তুরীর প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও ভেলিগুড় বিদায় করে, ধার করা কাটারি বগলে আপিস বেরোতে একটু দেরীই হয়ে গেছে। হাসি চেপে জানালাম, যাচ্ছিই তো। যে যার আপিস। “তাহলে সোনাইকে নিয়ে একটু বেরোব?” আবার জানতে চায় উমা। উমা অর্থাৎ কাকিমা আর তার সোনাই অর্থাৎ তুত্তুরীর মধ্যে সাধারণত ঢুকি না আমি। যতক্ষণ  না দুটোতে ঝটাপটি করছে, যা খুশি কর না বাপু তোরা।   


বেলা এগারোটা- আপিসে ঢুকতেই সঞ্চিতা বলল, “ওরা কিন্তু আসবে ম্যাডাম। দল বেঁধে।” ওরা আসবেই, জানি। গতকাল মেলার সমস্ত দপ্তরী দায়িত্ব থেকে ওদের অব্যাহতি দিয়েছি যে। তারপর থেকেই উত্যক্ত করছে ওরা। 


বড় সাহেবই বলেছিলেন, ‘তোমার ছেলেমেয়েগুলো ভালো, তুমি বললে ওরা ফেলতে পারবে না। কিন্তু সাংগঠনিক ভাবে যদি ওরা মেলা বয়কটের সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে আমাদের চাপ দেওয়া অনুচিত। দেখো কি করবে-।’  আমার ছেলেমেয়ে গুলো সত্যিই ভালো, মেলা নিয়ে আমাদের থেকে ওদের উত্তেজনা বেশী। শ্যামল তো রোজই লিখে চলেছে, ‘দূরদূরান্ত থেকে মানুষ আসবে আমাদের মেলা দেখতে। কত লোক চাই ম্যাডাম। আমি আনব।’ ধরে বেঁধে থামাতে হয় এদের। বাপঃ করোণা এখনও আছে কিন্তু। 


তবুও ভেসে আসে নানা অপ্রীতিকর বার্তা। অন্য মহকুমার লোকজনের তিক্ত ঝাঁঝালো উক্তি। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের জন্য ফোন করে অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে কৌশিক। “জানেন না আমাদের কি অবস্থা?”  অবস্থা আমাদের থেকে ভালো কে জানে? তুচ্ছ ফিল্ড আপিসের ওপর গোঁসা হতেই পারে, কিন্তু ফিল্ড আপিসের অসহায়তা বুঝবি না তোরা? তাহলে কে বুঝবে? ক্ষোভ অভিমান তো আমাদেরও হয়- তাই লিখেছিলাম,  মেলা তো তোমাদেরই, অবশ্যই মেলায় এস, মেলার কাজে অংশগ্রহণ করো, কিন্তু স্বেচ্ছায়। এবার অফিশিয়ালি যাবতীয় দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হল সকলকে। ‘আপনি আর কপনি’ নিয়েই লড়ে যাব আমরা। 


বেলা একটা- তুত্তুরীর ফোন আর থামেই না। দারুণ কাটছে আজকের দিনটা। পিছনের কেরিয়ারে সোনাইকে বসিয়ে সারা আবাসন সাইকেলে চক্কর মেরেছে কাকিমা। জীবনে কখনও সাইকেলের কেরিয়ারে বসেনি তুত্তুরী। তারপর পাড়ার ছোট্ট পার্কে ঢুকে এক অবাঙালি শিশুর থেকে ধার করা ফুটবল নিয়ে হুল্লোড়বাজি, দোলনায় চড়া, ঢেঁকিতে চড়া আর তারপর মাঠে রোদ পোয়াতে আসা জনৈক দাদুর আদরের থলথলে ল্যাব্রাডর কুতুয়াকে ধার নিয়ে আশ মিটিয়ে চটকেছে দোঁহে। আদরের দাপটে নাজেহাল কুতুয়া মাঝে একবার পালিয়ে গিয়ে পাশের গাছে পা তুলে কিভাবে ইয়ে করেছে সেই গল্পও শোনায় তুত্তুরী। সারা বেলা টইটই করে ঘুরে, হাফ প্যাডেল শেখা তথা শেখানোর ব্যর্থ প্রচেষ্টান্তে বাড়ি ফিরেছে দুজনে। উফঃ এমন দিন কেন যে রোজ আসে না, একসাথে চিৎকার করে দুটোতে, সাধে এদের মধ্যে ঢুকি না।  


বেলা তিনটে-কালো হয়ে আসা মুখগুলিতে মাখামাখি আব্দার আর আর্তি।  “ও ম্যাডাম, রাগ করবেন না।” “দুঃখ পাবেন না। মেলা থেকে প্লিজ আমাদের সরিয়ে দেবেন না। আমরা আসব হ্যাঁ।” ওদের মেলা থেকে ওদের বাদ দেবার ক্ষমতা কি আমার আছে? কত বড় শক্তিধর আমি? আর রাগ? রাগ হলেও তার স্থায়িত্ব কতক্ষণ এরা ভালোমতই জানে। মন কষাকষি, মান অভিমান, রাগ-অনুরাগ মিটতে মেটাতে গড়িয়ে যায় বেলা। বর্মন সাহেব গলা ঝেড়ে, হাত কচলে, জানান দেন, সব তো হল, এবার একটু কিছু খাওয়া দাওয়া হবে না? আজ যে বছর শেষ। বুঝতে বাকি থাকে না, বাইরে থেকে শিখিয়ে পড়িয়ে পাঠিয়েছে সবাই মিলে। ছদ্ম গাম্ভীর্যের প্রসাধনের আড়ালে ফিক করে হেসে ওঠে হৃদয়,‘ এমনি ভাবেই কাটুক না বছর গুলো, কিছু নরমে, কিছু গরমে। কিছুটা লোহায় আর বাকিটা নিখাদ সোনায়।’

Sunday 27 December 2020

অনির ডাইরি ২৫শে ডিসেম্বর, ২০২০



সাতসকালে ঢুলঢুলে মেয়েটার ঘুম ভাঙিয়ে, কোনমতে দুটো মেরি বিস্কুট খাইয়ে, হাওড়ায় রেখে অফিস যাওয়াটা তুত্তুরী এবং আমার কাছে যেন রূপকথা। সারাদিন ধরে একছত্র রাজত্ব চালায় তুত্তুরী। ঝিম মেরে থাকা দেড়শ বছরের বুড়ো বাড়িটা যেন জেগে ওঠে মন্ত্রবলে। আজব যত আব্দার করে তুত্তুরী। সাজতে বড় ভালোবাসে মেয়েটা। আর বড় মামি ভালোবাসে সাজাতে। কখনও লক্ষ্মীঠাকুর সাজে তুত্তুরী, তো কখনও সাজে পরী।  হাতের কাজ সেরে সাজাতে বসে চৈতি। আগামী কাল বড়দিন কি না, তাই বোধহয় নিজের সাদা সালোয়ার আর পাথর বসানো গয়নায় পরী সাজায় তুত্তুরীকে। তুত্তুরীর শহর জুড়ে নামে বুঝি রূপকথার মরশুম- 


দেবানন্দপুরের চাটুজ্জেদের বাড়ির আনাচেকানাচে নেচে বেড়ায় ফরিদপুরের ভট্টচার্য বাড়ির পরী। আজ তার সাতখুন মাপ। আজ যে আমি দিনান্তে ফিরব নিজের শহরে। শহরটা অবশ্যি বদলে গেছে অনেকটাই। বহিঃরঙ্গে লেগেছে প্রসাধনের প্রলেপ। দিদিমণি যেদিন থেকে গঙ্গা পেরিয়ে বাসা গড়েছেন এইপাড়ে, ল্যাদ খাওয়া চেনাছন্দ ভুলে, রীতিমত তন্বী হয়ে উঠছে পাঁচশ বছরের বুড়ি শহরটা। রাজপথ যেন আজকাল অনেক বেশী তকতকে। নিয়ন আলোয় উদ্ভাসিত। পাইকারি হারে স্যাঁৎসেতে ড্যাম্পধরা সাবেকী বাড়ি ধুলিসাৎ করে মাথা চাড়া দিচ্ছে ফ্যান্সি বহুতলের সারি। পথেঘাটে বাড়ছে অবাংলা ভাষীদের ভিড়। কে জানে হয়তো নিজ ভূমে ক্রমেই সংখ্যালঘু হয়ে পড়ছি আমরা মুষ্টিমেয় আঞ্চলিক বাঙালী। 


 গলির ভেতর অবশ্য একই আছে শহরটা। ওঠে একই রকম শীতের আদুরে পশমী রোদ। আছে ড্রেন, আছে খানাখন্দ, আছে উপচে পড়া ভ্যাট,গোছা গোছা ফেতি কুতুয়া, আছে পাড়ার  মাঠে একই রকম ভাবে বল পেটানো ছন্নছাড়া ছেলেছোকরার দল। আছে চায়ের ঠেক, আছে জগতের ভবিষ্যৎ চিন্তায় উদ্বিগ্ন  জটলা পাকানো বয়ঃজ্যেষ্ঠদের দল। সব মিলিয়ে সময় যেন আজও থমকে আছে সহস্রাব্দের ওপারে- 


যেখানে আজও সারা দুপুর জেগে নারকেল কুরিয়ে রাখে মা। ঝোলা ভরে বুম্বার দোকান থেকে আখের গুড় নিয়ে আসে বুল্লুবাবু। পরীর সাজ খুলে, মস্ত স্টিলের গামলায় হাপুসহুপুস করে কুরানো নারকেল আর গুড় চটকায় তুত্তুরী। হাত লাগাতে গেলে ধমকে ওঠে মা, আঃ ও করতে চাইছে, ওকে বাধা দেওয়া কেন বাপু? সাধে শৌভিক বলে, “ওকে জিজ্ঞেস করে দেখ সাপের কটা পা। ও বলবে পাঁচটা। ” 


 কড়ায় অল্প ঘি মাখিয়ে নারকেল আর গুড়ের মিশ্রণ ঢেলে, গ্যাস কমিয়ে চায়ের গ্লাস হাতে সিরিয়াল দেখতে বসে মা। দাদার সাথে খেলতে চলে যায় তুত্তুরী। চায়ের কাপে ঠোঁট চুবিয়ে উদ্বিগ্ন দৃষ্টিতে কড়ার দিকে তাকিয়ে থাকে বাবা। যদি ধরে যায়। তাড়ু না মারলে আবার নাড়ু হয় গা? তাড়ু মানে খুন্তি চালানো। খুন্তি চালানোর পারিশ্রমিক হল অঢেল অর্ধপক্ক গুড়-নারকেল। একটু সামলে খেতে হয় এই যা, নইলে যুগপৎ হাত এবং জিভ পুড়ে কাঠকয়লা।  



“এঁটো করে খাস না যেন-” টিভি দেখতে দেখতে অন্যমনস্ক সুরে হাঁকে মা। ভুলে গিয়েছিলাম, এবাড়িতে এঁটোকাটার বাছবিচার বড় কঠিন। আমাদের মধ্য হাওড়ায় ভাতের এঁটোকে এককালে বলা হত 'সকড়ি'- এখনও বলে কি, কে জানে? 


বড়দিনের সকাল মানেই ঘরে তৈরি কেক। অন্তত আমার মেয়ের কাছে।  আবাসনের রাজা ঘরে তৈরি কেক বিক্রি করে, বড় দাম কিন্তু অসম্ভব ভালো খেতে।  এই পরবের সময় কয়েক দিনই বানায় ওরা। যা বানায় অর্ধেক স্বামীস্ত্রী নিজেরাই খেয়ে নেয়। বাকি অর্ধেক পড়তে পায় না। ঐ কেক কিনে আনলেই ল্যাটা চুকে যেত- তা না।  


বৃদ্ধ দাদুর ঘাড়ে চেপে গুচ্ছ খানেক কাজু, কিশমিস, ড্রাই ফ্রুট আর কুমড়ো মেঠাই কিনিয়ে আনে তুত্তুরী। ওগুলোকে একরাত রামে ভিজিয়ে রাখলে নাকি দুর্ধর্ষ স্বাদ হয়। কিন্তু তাঁকে কোথা পাই? মা যে রাম-লক্ষ্মণ- হনুমান জাতীয় যাবতীয় পানীয় ভজনার ঘোরতর বিরোধী। তাছাড়া রাম দিয়ে কেক বানালে তো সেটা তুত্তুরীর ভাষায় “অ্যাডাল্ট কেক” হয়ে যাবে না?


 ওভেন নেই। মস্তবড় প্রেশার কুকার বার করে দেয় মা। কুকারের তলায় নুন ছড়িয়ে, তারওপর বসাতে হবে সেপারেটর এর বাটি। বাটিতে ঢালতে হবে কেকের মিশ্রণ। ব্রাউন পেপার নেই, কুছ পরোয়া নেই, বাটির গায়ে হাল্কা করে মাখন মাখিয়ে, পাতা হয় বাবার মস্ত প্যাডের চারখানা পাতা। পাতা ছিঁড়তে ছিঁড়তে অভিযোগের সুরে নতুন প্যাডের ফরমাইশ করে বাবা। 


চিনি গুঁড়ো করে মেশাতে হয় ডিম আর ভ্যানিলা এসেন্সের সাথে। অর্জুন পিসের নিষেধ আছে, ফ্রিজের শীতল ডিম দেওয়া যাবে না। কেক তাহলে খুব নরম হয় না। ডিমকে কি করে গরম করা হবে,সেই নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে তুত্তুরী আর তুত্তুুরীর দাদু। তবে কি গরম জলে কয়েক মিনিট ভিজিয়ে রাখা হবে ডিমগুলোকে? বা হালকা করে একটু ফুটিয়ে নিলে- 



কেক বানাতে বানাতে গড়ায় বেলা। জন্মদিনের খাওয়াটা বাকি আছে বাবার। মাটন বিরিয়ানি খেতে বড় ভালোবাসে বৃদ্ধ এবং তাঁর স্ত্রীও। বেহরুজে কিলোদরে বিক্রি হয় বোনলেস মাটন বিরিয়ানি। সাথে পুদিনা গন্ধী রায়তা আর ঘিগন্ধী ক্ষীরের পান্তুয়া থুড়ি গুলাবজাম ফ্রি। মায়ের মত যারা শুকনো বিরিয়ানি খেতে নারে, তাদের জন্য খুব অল্প টাকায় দারুণ মির্চি কা সালান বানায় ওরা। 


ধনেপাতা ছড়ানো বাসমতী চাল আর বোনলেস মাটনে বিমোহিত হয়ে যাই তুত্তুরী আর আমি। পেট ভরে,মন জুড়ায় কই? "মন্দ কি" বলতে বলতে নিরাসক্ত হয়ে কাঠের চামচে দিয়ে আলু খোঁজে বাবা। বিরিয়ানিতে আলু নেই? হতভম্ব হয়ে পড়ে মা।  ডিমও নেই? নেই সুবাসী আতর? তাহলে এই মাংসের ঝোল মাখা ভাতের এত দাম কেন? বিষম খেয়ে অওধী বিরিয়ানি আর হায়দ্রাবাদী বিরিয়ানির তফাৎ বোঝাই। ভাতের আবডালে লুকোচুরি খেলা বেরেস্তা খুঁজে এনে আত্মপক্ষ সমর্থন করার বৃথা চেষ্টা করি। “কেক বানালে আর বিরিয়ানি বানানো যায় না বুঝি?” গম্ভীর মুখে জানতে চায় মা? “তোর বানানো বিরিয়ানিটাই সবথেকে ভালো লাগে আমাদের-”। সমালোচনার আড়ালে লুকিয়ে থাকা ভালোবাসায় দ্রবীভূত হয়ে যাই আমি। সত্যি এ শহরের সবটুকু জুড়ে আজ রূপকথার মরশুম- 


“মামমাম তোমার লিপস্টিক আছে, মা আনতে ভুলে গেছে?” চিৎকার করে ওঠে তুত্তুরী। হেসে উঠি, ভদ্রমহিলা জীবনে ওসব রঙ মাখেননি আর এখন তো-। হাসি দেখে রেগে যায় মা। তারপর বেতো হাঁটু নিয়ে, বাক্সপ্যাঁটরা ঘেঁটে বার করে আনে, এল এইট্টিনের কবেকার লালচে রঙা লিপস্টিক। শুকিয়ে গেছে ভিতরের জোজবা অয়েল। ভেঙে গেছে মাঝখান থেকে। তবুও বাকরহিত হয়ে পড়ি আমি। এতো আমার আইবুড়ো বেলায় কেনা ৬০/৮০টাকার লিপস্টিক। এত বছর ধরে এত যত্নে তুলে রেখেছে মা? বললে রেগে যায় মা। “কে বলেছে তোর? এটা আমি আনিয়েছিলাম তোর বাবাকে দিয়ে।” কথা বাড়াই না। সত্যিই তো বাবাকে দিয়ে কাশি মামুর দোকান থেকে কিনে আনিয়ে দিয়েছিল মা, কোন সে রূপকথার যুগে। যখন বুঝি আকাশে উড়ত পক্ষীরাজ আর গপ্প শোনাত ব্যঙ্গমা-ব্যঙ্গমী। নাঃ এ শহর জুড়ে আজ শুধুই গোলাপী রূপকথা- 


আজ বাড়ি ফেরার দিন। সকাল সকাল জলখাবারে লাল আটার গোলগোল পরোটা বানায় মা। সাথে খোসা সমেত আলুর তরকারী। “তোমরা কত ভালোমন্দ জায়গায় খেয়ে বেড়াও- গরীবের লাল আটার পরোটা কি আর তোমাদের মুখে রোচে?” অভিমানী সুরে শোনায় বাবা। প্রতিবার চলে আসার সময় এমন অভিমান করে বাবা। ফোলায় ঠোঁট। মান ভাঙাতে বেশী ক্ষণ লাগে না আমাদের। যাব বটে, আবার তো ফিরে আসব। আবার। আবার।বারে-বারে--। এ শহর ছেড়ে যাই কোথা? এ শহরের যে মজ্জায় মজ্জায় রূপকথা।


খুশি হয়ে অভিমান ভুলে সাদা আলুর তরকারীর রেসিপি শেখায় বাবা। খোসা সমেত আলুকে কেটে নুন জলে সিদ্ধ করে, বড় হাতায় পরিমাণ মত তেল, জিরে, অল্প হিং আর শুকনো লঙ্কা ফোড়ন দিয়ে ফুটিয়ে  সিদ্ধ আলুর ঝোলে মিশিয়ে দিতে হবে। হলুদ দিতে নেই। হলুদে নষ্ট করে দেয় খোসা সমেত সিদ্ধ আলুর সুবাস। উপর থেকে ধনেপাতা কুচি ছড়িয়ে দিলে তো পুরো অমৃত। যুগপৎ হাঁটুর ব্যথা অার ঠাণ্ডায় কাবু হয়েও অমৃতই তো বানায় মা। 


বেলা বাড়ে, ব্যাগ গোছাই আমি। তুত্তুরীকে বগলদাবা করে রেশন দোকান যায় বাবা। যেমনি যেতাম আমি। মস্ত বড় দাঁড়িপাল্লায় খালি তেলের টিনে মস্ত বড় হাতায় করে চাল, গম বা চিনি ঢেলে ওজন করা দেখে হতভম্ব হয়ে যায় তুত্তুরী। যেমনি যেতাম  আমি। গমকলে গিয়ে তাজা গমভাঙা গন্ধে নির্বাক হয়ে পড়ে তুত্তুরী। যেমনি যেতাম আমি। বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করে, “হ্যাঁ গো তোমাদের দোকানে প্যাকেট করা মাল পাওয়া যায় না?”  বৃদ্ধ মালিকের পুত্র কিণ্ডারগার্টেনে আমার সহপাঠী ছিল, তাঁর গৃহেও বিরাজমান এমন একখানি নমুনা, তাই বুঝি হেসে ওঠেন তিনি। সবিনয়ে জানান, “না মা। এটা যে রেশন দোকান।”


বাড়ি ফিরে সহর্ষে রেশন দোকান আর গমকলের গল্প শোনায় তুত্তুরী। দোতলার দালানে সার সার ফেঞ্চ উয়িন্ডো দিয়ে চুঁইয়ে আসা সোনালী পশমী রোদ বাদামী রঙা মেঝেতে কাটে অচেনা আঁকিবুকি। সুযোগ বুঝে রান্নাঘরের জানলা গলে মুখ গলায় বুল্লুর আদরের বেড়ালিনী কালি- পেয়ারা গাছে উড়ে এসে বসে অচেনা এক জোড়া পাখি। খাঁচায় বসে ঢোলে মায়ের আদরের ককটেল- শহরটার রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়ে গোলাপি রূপকথা।

Friday 25 December 2020

অনির মধ্যপ্রদেশের ডাইরি,১৪ই নভেম্বর, ২০২০

 


মাঝে মাঝে মনে হয় হাতটা বেঁকিয়ে নিজের নিজের পিঠটা চাপড়ে দি খানিক। বাপরেঃ জীবন যে এত ঘোল খাওয়াবে কোনদিন স্বপ্নে ভেবেছিলাম? সাতসকালে উঠে, স্নান আহ্নিক সেরে, ঝক্কাস সাজুগুজু করে, সুপ্তোত্থিত কন্যাকে বগল দাবা করে সোজা হাওড়া- বাবা-মায়ের ঘাড়ে মেয়ে চাপিয়ে সোজা চুঁচুড়া। সারাদিন ঝঞ্ঝাটের মিটিং সেরে, রঙ্গোলি আর প্রদীপ হাতে ছবি, গ্রুপ ছবি তুলে রাত আটটায় আবার হাওড়া। বাড়ি ঢুকে চা- জলখাবার খেয়ে আবার স্নান সেরে লক্ষ্মী ঠাকুর পাতা। পাততে পাততে মনে হচ্ছিল ঢুলেই পড়ে যাব বোধহয়। যদিও ঘুমোতে ঘুমোতে রাত বারোটা, আহাঃ পুজো শেষে জমজমাট পারিবারিক আড্ডাটাকে তো মিস্ করতে পারি না। 

পরদিন পুনরায় ঢুলঢুলে মেয়েকে টেনে হিঁচড়ে তুলে, ওলা ধরে বেলা দশটার মধ্যে বাড়ি। আজ কালিপুজো। কাল সকাল দশটা পঞ্চাশে আমাদের ফ্লাইট। ভেবেছিলাম, মানে শৌভিকের সাথে কথা হয়েছিল যে দিনের বেলা হাটারি থেকে খাবার আনিয়ে নেওয়া হবে, আহাঃ কতদিন ওদের ড্রামস্ অব হেভেন আর রাইজ নুডলস্ খাইনি। খাবার আনিয়ে নিলে আর রাঁধতে হয় না। গোছগাছ  তো সবই বাকি। 


ভাবি এক আর হয় এক। আটদিন থাকব না, ফ্রিজে যা জমে আছে শেষ তো করতে হবে রে বাবা। খাবার নষ্ট তো আর করতে পারি না। সত্যিই ঐ রোগেই বাঙালী মরেছে। শৌভিকের গতকালের অভুক্ত ভাতকে মাখন,পেঁয়াজ, টমেটো আর কাঁচা লঙ্কা দিয়ে টমেটো রাইজ বানিয়ে জলখাবার সারলাম আমরা মা মেয়েতে, তারপরও দেখি বাস্কেটের ভিতর থেকে করুণ চোখে তাকিয়ে আছে বেশ কিছু সব্জি। অগত্যা- থাকুক হাটারি এবেলা।  


পথশ্রমের ক্লান্তিতেই বোধহয় অথবা বাবামাকে নিভৃত দাম্পত্যালাপের সুযোগ করে দিতে কালিপুজোর দিন মাঝ সকালে নাক ডাকাতে লাগল তুত্তুরী। একটু বেলা করে রান্না বসালেও তো চলবে আজ- জমে আছে কত যে কথা- 


বেলা একটা নাগাদ রান্না করতে করতে হঠাৎ মনে হল, ফোনটা চার্জে বসানো দরকার এবং সেটা করতে গিয়ে দেখি চার্জার খানা রয়ে গেছে হাওড়াতেই। বাঃ! সাধে কি বললাম, কব্জি বেঁকিয়ে চাপড়াতে ইচ্ছে করে নিজেরই পিঠ। আপনারা কি ভাবলেন? এমন আপদ ফোন, যাতে লাগে না অন্যান্য ফোনের চার্জার। কি হবে এখন? কাছাকাছি ফোনের দোকান বলতে হাঁটা পথে মিনিট বিশেক। তার নম্বরও নেই আমার কাছে। একটু আগে দেখলেও নির্ঘাত এনে দিত শৌভিক। কিন্তু সদ্য একগাদা বিস্কুট আর কিছু ওষুধপত্র কিনে এনে স্নানে ঢুকেছেন তিনি। এখন বললে নির্ঘাত গালমন্দ-  


নাঃ আমার বর কখনই বকে না। কখনই রেগে যায় না। হয়তো এককালে যেত, দীর্ঘ একযুগ ধরে গিন্নীর ন্যাদশপনা সহ্য করতে করতে আজকাল আর কিছুই বলে না। বরং পাশে থাকার চেষ্টা করে। সহমর্মিতা  দেখায়। যেমন আজ এগিয়ে দিল ফোনের দোকানের কার্ডটা। ঘড়িতে বেলা দুটো। তিনবার ফোন করেছি,ধরছে না লোকটা। ধর বাপ!প্লিজ ধর। আট-নদিন ফোন ছাড়া থাকা? উফঃ ভগবান।  


আড়াইটে নাগাদ ফোন ধরল লোকটা। জানাল চার্জার পাওয়া যাবে বটে তবে দোকান বন্ধ হয়ে যাবে তিনটের সময়। শৌভিক জামা গলাতে গলাতে বলল, “আমি এখুনি যাচ্ছি। কিন্তু তার আগে খেতে তো দে।”ওঃ হরি, রান্নাই তো শেষ হয়নি এখনও। সাধে কি বলি নিজের পিঠ চাপড়াতে ইচ্ছে করে। 


আবার ফোন করলাম লোকটাকে ভয়ে ভয়ে,  দাদা ওবেলা কি দোকান খুলবেন? জানতাম জবাব কি আসবে। আরেঃ আজ কালিপুজো। আজ কখনও কেউ সন্ধ্যেবেলা দোকান খোলে। ওপাশ থেকে হাসি ভেসে এল,“অবশ্যই খুলব। সন্ধ্যে ছটা থেকে দোকান খোলা। আরেঃ আমাদের বয়সে আবার কালিপুজো কি?” কাছাকাছি থাকলে নির্ঘাত হামি খেতাম লোকটাকে। 


দুপুরের খাওয়া মিটতে মিটতে বেলা তিনটে গড়িয়ে গেল। গড়িয়ে পড়ল শৌভিকও। ছোট্ট করে দিবানিদ্রা আর কি। গড়াবার তাল করছিল তুত্তুরীও। মামদো বাজি আর কি? সেই চুঁচুড়া থেকে কিনে এনেছি রঙ্গোলী বানানোর হরেক রঙ। কিনে এনেছি টিলাইট ক্যাণ্ডেল, মাটির প্রদীপ,ফ্লোটিং ক্যান্ডেল। বানাবে কে আর সাজাবে কে? 


মেয়ের সাথে খুনসুটি করতে করতে রঙ্গোলী যখন সেজে উঠল সন্ধ্যা নামছে কলকাতার বুকে। জ্বলে উঠেছে আবাসনের লাল-নীল-হলদে-সবুজ আলোর মালা। কফি বানিয়ে মুখের কাছে ধরল শৌভিক, এমন বর না থাকলে আমার যে কি হত? 


রঙ্গোলী প্রস্তুত। বাতি, প্রদীপ, সলতে,তৈল সাজানো শেষ,এবার সাজুগুজু করার পালা। তুত্তুরীর লাল কোল্ড শোল্ডার ড্রেস আর আমার টিয়াপাখি সবুজ খোলের কাঞ্জিভরম। যার লাল পেটা জরির পাড়ে ঝিলিক মারে আলো। একযুগ পূর্বে ফুল শয্যার তত্ত্বে সেজে এবাড়িতে এসেছিল শাড়িটা। সেই থেকে পরাই হয়নি। আজ পরবই। বাজার যাবার ফ্যাকাশে গেঞ্জি গলিয়ে চার্জার আনতে যাওয়া শৌভিক, হতবাক হয়ে প্রশ্ন করে, “কেন? কে দেখবে”। কেন তুমি দেখবা না? আহাঃ না হয় আমি পুরানো বউ, তাই বলে সাদা কালো নাকি। তোমায় অত ভাবতে হবে না,তুমি এগোও। আমার টিকলিটা কোথায় যে গেল- 


সন্ধ্যে সাড়ে সাতটা। আতসবাজি বিহীন দীপাবলী। খসখসে শাড়ি সামলে বাতি জ্বালাতে গিয়ে গোলাপ গাছের কাঁটায় হাত ছড়ে গেল। পোড়েনি তাও ভালো। চার্জার নিয়ে শৌভিক ফিরে আসার পর খেয়াল হয়েছে, “হ্যাঁ গো, মাছ গুলোকে ওবাড়ি দিয়ে আইলে না?” মাছ আইজ্ঞা। তুত্তুরীর আদরের পপি আর টফি? তেনাদের তো এই সপ্তাহে ঠাম্মা আর দাদুর কাছে থাকার কথা। তবে যে তারা দিব্যি টিভির সামনের টেবিলে খেলে বেড়াচ্ছে? 


বিনা বাক্যে মাছ নিয়ে দৌড়ল শৌভিক, যাবার আগে হিমশীতল কণ্ঠে শুধু বলে গেল, প্যাকিংটা কিন্তু এবার করতে হবে। প্যাকিং? ও হ্যাঁ প্যাকিং। তাই তো। কাল যে সকাল পৌনে এগারোটায় ছাড়বে আমাদের বিমান। এখনও গোছগাছ হয়নি কিছুই। মাগোঃ সাধে কি চাপড়াতে ইচ্ছে করে নিজের পিঠ। 


রাত নটার মধ্যে ঝড়ের গতিতে সারা প্যাকিং। আটদিনের জন্য, প্রতি দুদিন পিছু একটা করে জামা ধরে চারটে সেট। শুধু তুত্তুরীর জন্য দুটো অতিরিক্ত, তেনার আবার গাড়িতে উঠলে ইয়ে করার অভ্যেস আছে না। যাঃ ভুল হয়ে গেছে কটা প্লাস্টিকের প্যাকেট নিতে হবে মনে করে। এতকিছু কি আর এই গোল মাথায় থাকে। যা গম্ভীর মুখে ম্যাগি বানাচ্ছে শৌভিক, চুপচাপ খেয়ে আজ রাতের মত ঘুমিয়ে পড়াই বোধহয় ভালো। কাল নটার মধ্যে বেরোতে হবে। সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হল কাল সকালে শ্যাম্পু করতে হবে। ঐটা করতে আমার আবার বড় সময় লাগে কিনা। আগে সালফেট ফ্রি শ্যাম্পু দিয়ে দুবার মাথা ধুয়ে, তারপর হেয়ারপ্যাক লাগিয়ে দশ মিনিট অপেক্ষা করা, ঝক্কি কি কম। এসব নিয়ে আপাততঃ নীরব থাকাই ভালো। শৌভিক আপাততঃ ভুরু কুঁচকে সুটকেসের লাগে লাগেজ ট্যাগ লাগাচ্ছে। ফেভিস্টিক দিয়ে যতবার আটকাচ্ছে হড়কে নেমে আসছে প্রিন্ট করা লাগেজ ট্যাগ। দুবার শূণ্যে হাত ছুড়ল শৌভিক, “এই বাড়িতে কি একটা ঢঙের আঠাও থাকে না?” ওসব কথায় কান দিতে নেই, আঠা তো আমি নষ্ট করি না, করে ওর মেয়ে। আপাততঃ ঘুমিয়ে পড়ি, কাল আবার শ্যাম্পু করতে হবে, তারপর পাড়ি দেব হিন্দুস্তানের দিল দেখতে- 

অনির মধ্যপ্রদেশের ডাইরি, ১৫ই নভেম্বর, ২০২০

আদতে প্লেনটার কলকাতা ছাড়ার কথা ছিল সকাল নটা পঞ্চাশে। সেই মত দিন-ঘন্টা-সেকেন্ড গুনছিলাম আমি, এটা আমার বরাবরের অভ্যেস। কোন বিশেষ ঘটনা ঘটার আগে প্রতিটা মুহূর্তের হিসেব রাখি আমি। প্রতিটা মুহূর্তে নিজেকে মনে করাই, আর তো ব্যাস এত ঘন্টা- এত মিনিট আর এত সেকেণ্ড। আর তারপর- 


সব হিসেব গুলিয়ে প্লেনটা পিছিয়ে গেল পাক্কা একটি ঘন্টা। অর্থাৎ গোয়ালিয়রে পৌঁছাতে বেলা একটা। পরবর্তী গন্তব্য শিবপুরী। গোয়ালিয়র থেকে সড়কপথে ঘন্টা আড়াই থেকে তিন। অর্থাৎ কিনা বিকাল চারটে নাগাদ পৌঁছাব শিবপুরী। মাঝ নভেম্বরের কলকাতায় চারটে মানে ধূপছায়া। সুদূর পশ্চিমে হয়তো আরেকটু বেশী থাকবে আলো।  তবুও- কিই বা দেখা যাবে তাতে? নষ্টই হল আজকের দিনটা। 


গেল বারও অবশ্য তাই হয়েছিল। বেলাবেলি নেমেছিলাম ইন্দোরে, আর ওঁঙ্কারেশ্বর পৌঁছেছিলাম সন্ধ্যা পেরিয়ে। বাকিটা অবশ্যি ছিল নিখাদ স্বপ্ন।  গেল বারের মতই মধ্যপ্রদেশ ট্যুরিজমের গাড়ি আর ড্রাইভার এবারেও থাকবে আমাদের প্রতীক্ষায়। এয়ারপোর্ট থেকে তুলে আটদিন বাদে আবার এয়ারপোর্টে নামিয়ে দেওয়ার চুক্তি ওদের সাথে। গেল বার তো সরকারী বোর্ড লাগানো গাড়ি দিয়েছিল ওরা, এবার অবশ্য একটা এজেন্সীর সাথে বন্দোবস্ত, সেই এজেন্সীর মালিক এবং গাড়ির ড্রাইভার ত্যাগীজী গত কাল থেকে বার তিনেক ফোন করেছে শৌভিককে। যতই বিমারু রাজ্য বলে তাচ্ছিল্য করি আমরা, ভীষণ ভদ্র এদিকের মানুষজন। 


ভোর ভোর উঠে স্নান সেরে, হেভি ব্রেকফাস্ট করে বেরোতে বেরোতে বেলা গড়াল সাড়ে নয়। রাগে থমথম করছে শৌভিকের মুখ। সবকিছুর জন্য নাকি আমি দায়ী। বেড়াতে যাবার দিন কেউ শ্যাম্পু করে? নেহাৎ আমাদের বাড়ি থেকে বিমানবন্দর ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে নইলে নির্ঘাত ভস্ম হয়ে যেতাম। প্লেনে ওঠা নিয়ে কিঞ্চিৎ আতঙ্কে ছিলাম আমরা, নতুন কোভিড বিধি কি চালু হয়েছে ভালো জানতাম না। কার্যত দেখা গেল, ব্যবস্থাপনায় বিশেষ কোন পরিবর্তন আসেনি। শুধু বিমানবন্দরে প্রবেশের পূর্বে ব্যাগপত্তর গুলিকে ভালো করে স্যানিটাইজ করে দেওয়া হচ্ছে। স্যানিটাইজারের দাপটে স্যুটকেস ভিজে জবজবে। শৌভিকের সাধের লাগেজ ট্যাগ খসে পড়ল টুপটাপ- 


ফাঁকায় ফাঁকায় সিকিউরিটি চেকিং সেরে, এয়ারলাইন্স কতৃপক্ষের প্রদত্ত মাস্ক এবং ফেসশিল্ড পরে বাসে চেপে যখন প্লেনের সামনে গিয়ে নামলাম, হাসি পেল। এমন একখান এরোপ্লেন তো তোলা আছে, আমাদের আলমারির মাথায়। তুত্তুরীর অন্নপ্রাশনের উপহার।  পুঁচকে প্লেনে সওয়ার হতে পারে মেরেকেটে জনা পঞ্চাশ যাত্রী। ওঠার জন্য লাগানো সিঁড়িটিও ছোট্ট।  ধাপ বড়জোর গোটা চার। 


বেলা পৌনে একটা নাগাদ গোয়ালিয়রের রাজমাতা বিজয়া রাজে সিন্ধিয়া এয়ার টার্মিনালে নামার কথা। কিন্তু কেন জানি না প্লেন আর নামেই না। প্রায় পৌনে একঘন্টা গোয়ালিয়রের আকাশে চক্কর কেটে প্লেন যখন নামাল তখন বাজে বেলা পৌনে দুটো।


 ছোট্ট প্লেনের মতই ছোট্ট এয়ারপোর্ট। প্লেনে থাকাকালীন একাধিকবার উচ্চারিত হয়েছে সতর্কতা বার্তা- এটি মিলিটারি এয়ারপোর্ট। এখানে সারাদিনে নামে কেবল হাতে গোণা কয়েকটি প্লেন। ছবি/ভিডিও তোলা ঘোরতর ভাবে নিষিদ্ধ। 


ছোট্ট উঠোনের মত রানওয়ে। পেরিয়ে যাওয়া যায় একদৌড়ে, তবুও প্লেন থেকে নামার পর লাইন দিয়ে দাঁড়াতে হল মিনিট খানেক, কারণ সামনে দাঁড়ানো প্লেনটি ব্যাক করছিল যে। 


ভিতরে একটিই কনভেয়ার বেল্ট। আমি আর তুত্তুরী দাঁড়ালাম লাগেজ নেবার জন্য আর শৌভিককে লেখাতে হল আমাদের বিশদ পরিচয়, কোথায় যাব, কেন এসেছি ইত্যাদি। আর্মির এয়িরপোর্ট যে। অন্যান্য এয়ারপোর্টের মত করপোরেট লুক নেই, তবে সাফসুতরো। বাইরের বাগানগুলিও অনেকটা আমাদের সরকারী অাপিসের বাগানের মত। যত্ন আছে, তবে আরেকটু যত্ন নিলে মন্দ কি?


ত্যাগীজীর গাড়িতে চেপে প্রবেশ গোয়ালিয়র শহরে। রাজাদের শহর। সব কিছুই বড় জমকালো এথা।   বড় বড় স্কুল, কলেজ, ইনস্টিটিউশন সবকিছুই সিন্ধিয়াদের নামে। দীপাবলীর পরদিন বলেই হয়তো বন্ধ অধিকাংশ দোকানপাট, রাস্তায় বিরল মানুষজন।  ত্যাগীজী জানালেন, এদিকে করোনা সচেতনতার হার প্রায় শূণ্য। আদালতের নির্দেশ অগ্রাহ্য করে গতকাল ভোর রাত অবধি দেদার বাজি পুড়িয়েছে গোয়ালিয়রবাসী। সেই ক্লান্তিতেই আপাততঃ গৃহবন্দী নগরবাসী। 


কোন সকালে খেয়ে আসা পাউরুটি, দুধ আর ডিম হজম হয়ে গেছে কখন। কিছু খেতে হবে। নেমে খেতে গেলেই নষ্ট হবে সময়। স্যান্ডউইচ জাতীয় কিছু কিনে নিতে পারলে ভালো হয়। এদিকে বন্ধ সব দোকানপাট। ভারী আকাশের মুখ। অচীরেই শুরু হল টিপটাপ বর্ষণ। বর্ষা আমার প্রিয়তম ঋতু। তাই বলে এই হেমন্তের শেষে বেড়াতে এসে আলাপ করতে আগ্রহী অকালবর্ষণ, অসহ্য।  ভিজতে ভিজতে স্টেশন লাগোয়া আধ খোলা বাজারের কফি হাউস থেকে চটজলদি কেনা ডিম স্যান্ডউইচ থুড়ি সিদ্ধ ডিম আর পাঁউরুটি খেতে খেতে ভিজে রাজপথ দিয়ে ছুটল গাড়ি শিবপুরীর দিকে। ত্যাগীজী জানালেন এদিকে কমার্সিয়াল গাড়ির গতিসীমা বাঁধা আশি কিমি/ঘন্টায়। ফলে উনি চাইলেও বাড়াতে পারবেন না গতি। পৌঁছাতে পৌঁছাতে নামবে বিকেল। তেমন কিছুই দেখা হবে না আজ। তবে পথেই পড়বে সিন্ধিয়াদের ছত্রী ওটা দেখে নিতে পারি আমরা। আর দেখতে পারি ভদাইয়া কুণ্ড।  


বিকাল চারটে নাগাদ গাড়ি গিয়ে থামল সিন্ধিয়াদের ছত্রীতে। ছত্রী বলতে সমাধি সৌধ। মুখোমুখি দুটি অনুপম সৌধ- একটি রাজমাতা শাক্য রাজে সিন্ধিয়ার স্মরণে নির্মাণ করেছিলেন তাঁর পুত্র মহারাজ মাধো রাও সিন্ধিয়া। অপরটি রাজা মাধো রাও সিন্ধিয়ার স্মৃতির উদ্দেশ্যে নির্মাণ করেছিলেন তাঁর পুত্র তথা উত্তরাধিকারী রাজা জিভাজী রাও সিন্ধিয়া। দুটি ছত্রীর মাঝে খনন করা এক অনুপম পুষ্করিণী। সমগ্র আঙিনাটি শ্বেত পাথরে মোড়া। আছে ঘন সবুজ কেয়ারি করা বাগিচা। মাত্র ৪৮ বছর বয়সে প্যারিতে মারা যান রাজা মাধোরাও সিন্ধিয়া। তাঁর সমাধিতে আছে আটখানা সলিড রূপার দরওয়াজা। ছাত থেকে ঝুলছে ভারি ভারি রূপার ঝাড়লণ্ঠন। ইতালীয়  মার্বেলের দেওয়ালে নানা সেমি প্রেশিয়াস স্টোনের অনুপম নক্সা কাটা। পাতি মোবাইল ক্যামেরায় একখান ভিডিও তুলেছিলাম- যদি দেখতে চান- https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=10222306300273599&id=1449214651

রাজমাতা শাক্য রাজে সিন্ধিয়ার ছত্রী- বাইরে থেকে

রাজমাতা শাক্য রাজে সিন্ধিয়ার ছত্রী- অভ্যন্তর ভাগ

রাজা মাধো রাও সিন্ধিয়ার ছত্রী- বাইরে থেকে

রাজা মাধো রাও সিন্ধিয়ার ছত্রী- অভ্যন্তর ভাগ

রাজা মাধো রাও সিন্ধিয়ার মূর্তি -

ভদাইয়া কুন্ড

গুগলে শিবপুরী লিখলেই প্রথমে যে ছবি ফুটে ওঠে, তা হল একতলা এক মন্দির যার মাথার ওপর থেকে আছড়ে পড়ছে প্রবল জলধারা। বড় মনোরম দৃশ্য। এই ভদাইয়া কুণ্ডের পাশেই ট্যুরিস্ট ভিলেজে আজ রাত কাটাব আমরা। খুব অল্প টাকার টিকিট কেটে বেশ খানিকটা নীচে নেমে ভদাইয়া কুণ্ডের সামনে দাঁড়িয়ে রীতিমত হতাশ হলাম। এবার বর্ষা ভালো হয়নি। ফলে তিরতির করে ক্ষীণ জলধারা ঝরে তো পড়ছে ভদাইয়া কুণ্ডের মাথা থেকে। তাতে খুলছে না রূপ। ভিতরের মন্দিরে ঢোকাও আপাততঃ নিষিদ্ধ। শ্যাওলায় আছাড় খেয়ে নাকি বড় আহত হয় পর্যটকরা। তাই বন্ধ ভিতরের কুঠুরি। 


ভদাইয়া কুণ্ডের উল্টো দিকে অবশ্য নয়ন জুড়ানো শাক্যসাগর লেক। টলটলে তার জল। পাড়ের কাছে ফুটে আছে সহস্র শতদল। অদূরে শাখা বিস্তার করেছে মাধো ন্যাশানাল পার্ক। কাল ভোর-ভোর দেখতে যাব আমরা। আপাততঃ দুদণ্ড জিরিয়ে নিই এই অনুপম লেকের ধারে। ফুসফুসে ভরেনি টাটকা জলো বাতাস। কানের পর্দায় সুড়সুড়ি দিক অখণ্ড নীরবতা, মাঝে মাঝে জলের ছলাৎ ছলাৎ আর সন্ধ্যে নামার মুখে কুলায় ফেরা পাখিদের কূজন। 

(ক্রমশঃ)

(ক্রমশঃ)