Friday 29 January 2021

মেলার ডাইরি ২০২১

 মেলার ডাইরি, ১৫ই জানুয়ারী, ২০২১

পর্ব ৯ক


জনৈকা আত্মীয়া একবার বলেছিলেন,‘তোর চাকরীটা বেশ ভালো। খালি সাজুগুজু আর ছবি তোলা“।  


১২ই জানুয়ারী বেলা দুটো- স্যারকে মেসেজ করতে গিয়েও বুঝতে পারলাম না কি লিখি। এমন জটিল পরিস্থিতিতে বাপের জন্মে পড়িনি। প্রতিবছরই মেলার আগের দিন গোলমাল বাঁধে। গত বছর যেমন গেটের সামনে লাগানো শোলার হাতি নিয়ে চূড়ান্ত রাজনৈতিক নোংরামো করেছিল এক স্থানীয় ব্যক্তি। একটা মাতাল আর পলকে জমে যাওয়া ভিড়ের সামনে ভয়ে জড়সড় আমার টিমের ছবি দীর্ঘদিন দুঃস্বপ্ন দেখেছি আমি। পেঁচো মস্তানের সাথে মস্তানি করে তাকে পুলিশের জিপে তোলাটা আজ অবধি নিজের বিশের বছরের অন্যতম কৃতিত্ব বলে মনে করি। তবে সেটা তো বিগত বছরের কথা। এ বারের সমস্যা যে তার থেকে শতগুণ জটিল। 


১২ই জানুয়ারী বেলা ২টো দশ-স্যারের ফোনটা বেজে গেল। ওণার অনুমতি ছাড়াই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। যুযুধান দুপক্ষের একজনকে পত্রপাঠ বাড়ি পাঠাব বলে ঠিক করলাম। আমরা যতই নিজেদের অপরিহার্য বলে মনে করি না কেন- আদতে সবাইকে ছাড়াই সব হতে পারে। যেমন আমার অন্যতম নির্ভরশীল ইন্সপেক্টর নির্মলকে ছাড়াই এবছর মেলা করার দিকে এগোচ্ছি আমরা। নিরূপায়। সদ্য প্রিয়জন হারানো নির্মল আপাততঃ কাছা পরেই অসুস্থ মাকে নিয়ে বসে আছে কলকাতার এক নামী হাসপাতালে।


বেলা তিনটে- সমস্যাটা কোন মতে মেটানো গেল। আমি কঠোর পদক্ষেপ নেবারই পক্ষপাতী ছিলাম। বর্মন সাহেব মিটমাট করার পক্ষে। শেষ পর্যন্ত রণং দেহির ওপর বিজয় প্রাপ্ত হলেন শান্তিরূপিনী। এখনও বাকি প্রচুর কাজ। সবাই ফিরে এসো মেলা মোডে। 

শ্যামল মুড়ি কই? 


বেলা সাড়ে তিনটে- এখনও অর্ধসমাপ্ত স্টেজ। মাঠে টানা হয়নি ছাউনি। লাগেনি কোন আলো। সমীর দৌড়ে এল, মাঠের বাইরে পোস্টার মেরেছে ওরা। মুড়ি খাওয়া হাতেই রাস্তায় গিয়ে দাঁড়ালাম সবাই। মাঠের উল্টো দিকের বাড়ির দেওয়ালে হাতে লেখা মেলা তথা সরকার বিরোধী না না শ্লোগান। যার কিছুকিছু বেশ আক্রমণাত্মক। শুধু তাই নয়, মাঠের সামনের রাজপথ বরাবর যতদূর নজর যায়- দুপাশের ল্যাম্পপোস্টে কারা যেন রাতারাতি লাগিয়ে গেছে বিশেষ রাজনৈতিক দলের ঝাণ্ডা। গণ্ডগোলের পূর্বাভাষ ছিলই। এসপি থেকে জেলা প্রশাসন হয়ে থানা সবজায়গায় চিঠি করে যথোপযুক্ত  ফোর্স পাঠানোর অনুরোধ করেই রেখেছি। গোপন সূত্র থেকে মুহূর্তে মুহূর্তে খবর আসছে, আজ ওণাদের মিটিং চলছে। আমাদের চন্দ্রাকেও ডেকেছিল ঐ মিটিং এ। মেলা থেকে বিশ মিনিট দূরত্বে জমায়েত হবে ওণাদের। সেখান থেকে ট্যাবলো এবং মিছিল নিয়ে এসে হাজির হবে আমাদের মেলায়। ইতিপূর্বে যথেষ্ট দুর্ঘটনা ঘটে গেছে অন্যান্য জেলায়। প্রচারিত হয়েছে কুৎসামূলক খবর। আর সর্বক্ষেত্রে আসামীর কাঠগোড়ায় দাঁড় করানো হয়েছে বেচারা আধিকারিককে। 


বেলা চারটে- নির্মলই সাধারণতঃ থানার সাথে কথা বলে, সে এখনও এসে পৌঁছায়নি কলকাতা থেকে।  নির্মল এলে সাথে চঞ্চল বা কৌশিককে থানায় পাঠানো হবে। আপাততঃ আরেকবার ঝালিয়েনি নিজেদের প্ল্যান। সামনের গেটে থাকবে দুজন জাঁদরেল মহিলা। বলাগড়ের প্রীতি শীল আর বাঁশবেড়িয়ার মহুয়া নাথ। শ্যামল আপত্তি করে, ‘মেয়েরা শুধু পারবে না। আমরা কজনও থাকি। ’ একসাথে মুখ ঝামটা দি আমরা। আমরাই পারি। ইন্সপেক্টর মৃণালের রিশেপসন টিম থাকবে প্রীতি দি আর মহুয়াদির পিছনে। দূরদূরান্ত থেকে আমাদের যে এসএলও বা কালেক্টিং এজেন্টরা লোক নিয়ে আসবেন, তাঁদের গেটের পাশে দাঁড় করিয়ে, এক একজন করে স্যানিটাইজার গেটের ভিতর দিয়ে ভিতরে ঢুকবে। মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক। মাস্ক পরে না এলে মাস্ক সরবরাহ করব আমরাই। সার্জিক্যাল মাস্কের বাণ্ডিল রাখা থাকবে মহুয়াদির কাছে। স্লোগান হবে, ‘মাস্ক পরুন, মেলা দেখুন’। 


আর যদি স্থানীয় মানুষ মেলা দেখতে আসেন। তাঁরা অবশ্যই স্বাগত। তাদের ছাড়পত্র দেবে বাঁশবেরিয়ার মহুয়াদি। অচেনা কেউ না। আর হ্যাঁ একবার ঢুকে পড়লে, উদ্বোধন শেষ না হওয়া পর্যন্ত বেরোতে দেওয়া হবে না। বাহির গেটে ডিউটি দেবে বাঁশবেড়িয়ারই নূপুরদি আর তরুণী মধুমিতা। 


যদি এদের চোখে ধুলো দিয়ে কোন বিক্ষোভকারী ঢুকেও পড়েন, তাঁকে সামলাবে মাঠ কমিটি। মাঠ কমিটির মাথায় থাকবে আমাদের ইন্সরেক্টর দর্প। আর তার সাথে থাকবে প্রদীপ, সমীর, প্রিয়াঙ্কা, শান্তনু আর আশিস। দূরত্ববিধি মেনে পাতা চেয়ারগুলির ফাঁক দিয়ে সমানে পায়চারি করবে এরা। যদি দেখা যায় কেউ ব্যাগ থেকে কোন ফেস্টুন বার করছে, তাকে বুঝিয়ে শান্ত করার দায়িত্ব এদের। 

এত উৎসাহী এই ছেলেমেয়েগুলো যে এদের সামলানো বেশ চাপ। বিশেষতঃ প্রিয়াঙ্কা তো একাই লড়তে চায় বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে। এ মেয়েকে সামলাতে আরও গুটি কতক মেয়েকে বলা হল, ওকে সামলে রেখো বাপ।   


বিকেল পাঁচটা- নির্মল এসে পৌঁছালো। ওর মাকে কালই ভর্তি করতে হবে  হাসপাতালে। এবারে আর নির্মল মেলা হবে না আমাদের। থাকতে পারবে না মেলার মূখ্য উদ্যোক্তা শ্রী নির্মল কুমার শেঠ। বাকি দুই ইন্সপেক্টর চঞ্চল আর কৌশিক আশ্বাস দিল, ‘আমরা সামলে নেবো ম্যাডাম’। বেশ। 


রাত পৌনে আটটা- থানা থেকে ফোন করল চঞ্চল। 'দুটো মেল আইডি পাঠাচ্ছি ম্যাডাম। বড় বাবু বলছেন একটা চিঠি করতে হবে। তবে ফোর্স চাইবেন ওণারা।’ সে আবার কি? এত রাতে আমি গাড়ি থেকে কি করে চিঠি করব? মেমো নম্বর পাব কোথা থেকে? আর এত যে চিঠি করলাম? সেগুলো কি অর্থহীন? অসহায় গলায় জবাব এল, 'সেই সব চিঠি এখনও ওণাদের কাছে নামেনি।'

অনির মেলার ডাইরি ১৫ই জানুয়ারী, ২০২১

পর্ব-৯ খ

https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=10222728040936852&id=1449214651  এর পর 


১২ই জানুয়ারী রাত আটটা- স্যারকে ফোন করলাম। মিটিং সেরে ফুলের লোক আর ফুল গাড়িতে তুলে মাঠে যাচ্ছেন স্যার। উনি আসছেন বলেই বাড়ির দিকে রওণা দিয়েছি আমি। ঠিক বাড়ি নয়। মেলার আগের রাতে হেয়ার স্পা করানোটা আমার বার্ষিক রিচুয়্যাল বলতে পারেন। একটা তুক থাকে না সকলেরই। 

স্যার আশ্বস্ত করলেন, ‘তুমি যাও। দরকার হলে মাঠে পৌঁছে হাতে চিঠি করে দেবো আমি। ’ এত চিঠি, ধাপে ধাপে ধাপে চিঠি করার পরও কেন চিঠি করব আমরা? ফোন করলাম অতিরিক্ত জেলা শাসক, সাধারণ মহাশয়কে। উনি স্বয়ং ফরোয়ার্ডিং চিঠি সমেত আমার চিঠিটি পাঠিয়েছিলেন পুলিশের কাছে। তার আর পর থাকতে পারে নাকি? 

সব শুনে জানালেন, ‘তুমি সিম্পলি আমার চিঠিটার একটা হার্ড কপি থানায় পাঠিয়ে কি ফিড ব্যাক পাও আমায় জানাও।’


রাত সাড়ে আটটা-  মাঠে প্রিন্টার কোথায়? চিঠিটা থানার মেলে আর নির্মলকে হোয়াটস্অ্যাপে পাঠালাম। সামাজিক মুক্তি কার্ড আর পিপিও প্রিন্ট ল্যামিনেট করাতে গেছে রমেশ। তাকেই বলা হল, ওটার একটা প্রিন্ট এনে দে বাবা। শুনলাম সময় লাগবে। সব প্রিন্ট নিয়ে চুঁচুড়া থেকে বাঁশবেড়িয়া আসতেও লাগবে অন্তত আধঘন্টা। রাস্তা ভয়ানক খারাপ। আচ্ছা সামলে আয়। 


রাত সাড়ে নটা- রমেশের ফোন বন্ধ। বুঝলাম চার্জ শেষ। গোপন সূত্রে কিছু খবর পেলাম। সংবাদ প্রদানকারী আশ্বাস দিলেন, ‘মেলা বয়কট করবেন বটে,বানচাল করবেন না ওণারা। বিক্ষোভ দেখাবেনই। ’ বললাম দেখুন বিক্ষোভ দেখানো আপনাদের অধিকার। তাতে হস্তক্ষেপ করতে চাই না। তবে চার বছর এই জেলায় কাটিয়ে দেওয়ার পরও যদি ‘শ্রমিকবিহীন শ্রমিকমেলায় চলছে বিরিয়ানি উৎসব’ বা ‘সরকারী মেলায় চলছে চটুল অশ্লীল নাচগান’ মার্কা খবর পড়তে হয়, তার থেকে বেদনাদায়ক কিছু হতে পারে না। 


রাত দশটা- থানা থেকে ফোন করল চঞ্চল,‘ম্যাডাম আপনাকে খবরটা কে দিয়েছে? এণাদের কাছে কিন্তু খবর আছে বিরাট গণ্ডগোল হবে। সারাদিনের উত্তেজনা আর ক্লান্তি ঘুম হয়ে নেমে আসে ফোনের এপ্রান্তে। সোর্স কেউ জানায়? আমার যা করার আমি করেছি। এরপর যদি কিছু হয়, হবে। তুমি ফিরে এসো। কাল ভোর থেকে প্রচুর চাপ।  


রাত এগারোটা- মাঠ থেকে ফোন করল ডেকরেটর। ম্যাডাম গুটি তিন চ্যাঙড়া ছেলে এসে হুমকি দিচ্ছে কাল সব ভাঙচুর করবে। ক্লান্তি জড়ানো গলায় জানালাম, করুক। যার যা প্রাণ চায় করুক। শুধু যখন ভাঙচুর করতে আসবে, আপনি আপনার মূল্যবান জিনিসগুলি সরিয়ে রাখবেন। 


১৩ই জানুয়ারী ভোর ছটা- অ্যালার্মটাকে ঘুম জড়ানো হাতে বন্ধ করে জড়িয়ে ধরলাম ঘুমন্ত বরকে। আমি বেশ যাব না আজ। যার যা খুশি মারামারি  করে নিক। আধঘুমন্ত আলিঙ্গন সহ, ফিসফিস করে ভেসে এল সোহাগী বাণী,‘ সেই ভালো যাস না। বড় সাহেব আছেন তো। আর বর্মনও আছে।’


সকাল পৌনে আটটা- সাড়ে সাতটায় বেরোব ভেবেও দেরী হয়ে গেল। বের হবার আগে শৌভিককে দিয়ে একটা ছবি তোলানোটাও তুক বলে মনে করি আমি। কাজের সময় এমন বেয়াড়া আব্দারে ভয়ানক বিরক্ত হয় শৌভিক। তাকে পটাতে গিয়েই দেরী আর কি। 

 জলদি চালান সুবীরবাবু। এইসব দিনগুলোতে ভীষণ মৃত্যুচিন্তা নিয়ে খেলা করতে মন চায় আমার। কি হয়,যদি আজ রাস্তায় উল্টে যায় গাড়ি? ওরা অপেক্ষা করবে আমার জন্য। ফোন করবে বারে বারে। তারপর সামলে নেবে ধীরে ধীরে। টেনশন চেপেও চালিয়ে যাবে নিজ- নিজ দায়িত্ব। ঐ যে শেক্সপিয়র সাহেব বলে গেছেন না, কুশীলব বদলে গেলেও-‘দা শো মাস্ট গো অন’। দেখা যাক আজ কি শো থাকে কপালে- 

(চলবে)

No comments:

Post a Comment