Friday, 29 January 2021

অনির ডাইরি জানুয়ারী, ২০২১

 অনির ডাইরি ২৭শে জানুয়ারী, ২০২১


ঘোরতর আপিস টাইমে ফোন করেন তিনি,‘মা আমি একটা অপাট করেছি’। বিগত দশ বছরের অভিজ্ঞতা যাবতীয় অপাট সম্পর্কে মোরে করেছে অনেকটাই সহিষ্ণু। আজকাল আর আঁতকে উঠি না। কেজো গলায় জানতে চাই, কি ঘটিয়েছেন শ্রীমতী অঘটনঘটনপটিয়সী? উত্তর আসে, বাড়িতে পরার হাওয়াই চপ্পলখানি দেহ রেখেছেন। এতদিন কেন যে রাখেননি, তা পরমেশ্বরই জানেন। সারাদিন মোটামুটি খালি পায়েই তো ঘোরে তুত্তুরী। পায়ের তলায় মাখা থাকে দুনিয়ার কালিঝুলি। আর চপ্পল জোড়া বিমর্ষ হৃদয়ে পড়ে থাকে কখনও খাটের কোণায় তো কখনও খাবার টেবিলের নীচে। 


আজ তাঁরা দেহ রাখায় বড়ই বিমর্ষ কন্যা আমার, বারংবার আশ্বস্ত করে, ‘একটা ফেভিকুইক কিনে এনো তো। জোড়া যাবে মনে হয়। ’ দাঁত থাকতে যেমন বোঝা যায় না দাঁতের মর্ম, তেমনি হয়তো চপ্পল থাকতেও কেউ কেউ বোঝেন না-। তাঁরা মারা গেলে হঠাৎ বড় দীন, বড় শীতকাতুরে হয়ে ওঠেন কেউ কেউ। আপন মনে করুণ সুরে বিড়বিড় করে তুত্তুরী, ‘দাদু(মাতামহ) থাকলে ঠিক জুড়ে দিত।’ হয়তো দিতো। এসব ব্যাপারে দাদু সাক্ষাৎ বিশ্বকর্মা। যুগটাই যে অমন ছিল। প্রাচুর্য শব্দটাই বোধহয় ছিল সবথেকে দুষ্প্রাপ্য।   


তুত্তুরী জন্মের পর শ্বশুরমশাই একবার বলেছিলেন, ‘যা চাইবে সঙ্গে সঙ্গে দিও না। অভাববোধ যেন তৈরী হয়। ’ যিনি এই অমূল্য জ্ঞান দিয়েছিলেন, তুত্তুরী তাঁর প্রাণ। তিনি নিজে এই জ্ঞান ভুলে গেছেন কবেই। তবে তিনি না মানতে পারলেও, আমি থুড়ি আমরা দোঁহে মেনে চলি। থাক না একটু অভাব। তৈরী হোক না সামান্যতম মূল্যবোধ। 


 বাবামায়ের পেশাদারী ব্যস্ততার ফাঁকে মায়ের চপ্পল জোড়াই দখল করে তুত্তুরী। মাত্র কয়েক মুহূর্তের জন্য, তারপরই ফেরৎ দিয়ে যায়, আহাঃ মায়ের পায়ে ঠাণ্ডা লাগবে কি না। ছেঁড়া চপ্পল পরেই বাড়িময় ঘুরতে থাকেন তিনি, কর্মব্যস্ত মাকে অফিস বেরোনোর সময় আশ্বস্ত করেন তিনি,‘ মা এটা তো দিব্যি পরা যাচ্ছে। তোমায় চিন্তা করতে হবে না।’ কড়া আধিকারিক, বিস্তর (অ)জ্ঞানবতী মায়ের চোখের কোণা কেন যে ভিজে ওঠে অকারণে- 


শ্রীরামপুর শ্রমিকমেলার দপ্তরী দায়িত্ব সেরে, তড়িঘড়ি চপ্পলের দোকান খোঁজে মা। বাড়ি ফিরলেই প্রশ্ন করেন তিনি, ‘কি এনেছো মা?’ কোন মিটিং এর ঠাণ্ডা টিফিন প্যাকেটই হোক বা কোন উৎসবের শুঁটকে মার্কা স্টিক বুকে বা ছাপোষা আপদ উত্তরীয়, যেগুলি না পারা যায় বয়ে আনতে না পারি ফেরৎ দিতে, সব ঝেঁটিয়ে বাড়ি আনি আমি। তিনি খুশি হন যে।  আজ অবশ্য যথারীতি ফেলে এসেছি শ্রীরামপুর শ্রমিকমেলার উত্তরীয়টা। বৈদ্যবাটির ইন্সপেক্টর দেবারতির ইন্সপেক্টরগিরির হাতেখড়ি আমাদের চুঁচুড়ায়। আজ আর তার ওপর আমাদের কোন দপ্তরী অধিকার নেই বটে, তবে দপ্তরীয় সম্পর্কের বাইরেও রয়ে গেছে বেশ খানিকটা উষ্ণতা। শ্রীরামপুরের কোন অনুষ্ঠানে গেলেই আমি দেবারতিকে খুঁজি, আর ও আমায়। দেবারতিই পরিয়ে দিয়েছিল সাধ করে। দিব্যি গলায় পরে বসেও ছিলাম, শান্তশিষ্ট নক্ষ্মী অতিথি হিসেবে। তারপর যা হয় আর কি। কখন যে পাট করে পাশে রেখেছি আর মনে নেই।  


যথারীতি, মায়ের জলদি বাড়ি ফেরা তথা নতুন চপ্পল জোড়া উপহার পাওয়ার পরও তাঁর দুঃখ হল ফেলে আসা নীল সাদা উত্তরীয় খানার জন্য। অন্তত একটা নীলসাদা ওড়ণাও যদি মায়ের থাকত, গলায় পরে মান্যগণ্য অতিথি হয়ে ঘুরতেন তিনি। ধুত্তেরি! 

অতিথিবরণের ঝকমকে সোনালী জরি দেওয়া ব্যাজটা অবশ্য দিব্য পছন্দ হল তাঁর। যতো ঝকমকে ততো বেশী পছন্দ, বেশ বুঝলাম রাতে ঘুমাতে যাবার আগে ঐ ব্যাজটি খুলছেন না মাননীয় অতিথি। ব্যাজ পরিয়ে, হাতে পিটুনিয়ার টব ধরিয়ে বরণ করার পর মাননীয় অতিথির সাথে তুলতে হল খানকতক ছবিও। এবার মাননীয় অতিথির ভাষণ দেবার পালা- তবে সে তো অবশ্যি অন্য গল্প। এইভাবেই গড়াক না জীবন, অলসছন্দ প্রতি মুহূর্তে তৈরী করুক না নতুন নতুন গপ্প। ছড়িয়ে পড়ুক ভালোলাগা আর ভালোবাসার রঙ জীবনের প্রতিটি পল থেকে অনুপলে। দর্পনে নিজের প্রতিচ্ছবির মুখোমুখি হয়ে যাতে বলতে পারি,‘ এই বেশ ভালো আছি।’

অনির ডাইরি ২১শে জানুয়ারী, ২০২১


বেলা এগারোটার অ্যালার্ম বাজার সাথে সাথেই দিতে হয় হাজিরা। এগারোটা দশে আসবে লিঙ্ক। সেই লিঙ্ক পাঠাতে হবে অন্য একটা নম্বরে। বাড়িতে ল্যাপটপ খুলে বসে থাকবে একজন। তার নিজের তো ফোন নেই। মাসির ফোনে যায় লিঙ্ক। সেই লিঙ্ক দেখে নিজেই খোলে গুগল মিট। বসায় কোড। তারপর বসে ক্লাস করতে। এই ভাবেই গড়ায় দিন। 

প্রতিটা দিনই নিজের সাথে বয়ে আনে নানা জটিলতা। কোনদিন আচমকা কিবোর্ডে হাত পড়ে গিয়ে উড়ে যায় দরকারী ফাইলপত্র। পাগলের মত তলাশ করে সে। মায়ের আপিসের ল্যাপটপ। মায়ের দরকারী ফাইলপত্র। হারিয়ে গেলে কি হবে? মা যে পড়ে যাবে ভয়ানক বিপদে। হাউহাউ করে কাঁদতে কাঁদতে ফোন করে সে। মা ব্যস্ত জরুরী মিটিং এ। কেজো সুরে ‘পরে করছি’ বলে রাখতে রাখতে হাত কাঁপে মায়ের। গুগল ক্রোমটাও বোধহয় খুঁজে পাচ্ছে না সে। ক্লাশ করবে কি করে। চটজলদি মেটেও না আপদ মিটিংগুলি। 


মিটিং শেষে মা যখন ফোন করে, সে বলে, ‘তুমি চিন্তা করো না মা। আমি ক্রোম খুঁজে বার করেছি। শুধু তোমার ফাইলগুলো খুঁজে পাচ্ছি না।’ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে মা শেখায়, যা হবার তা হবেই। সমস্যায় পড়লে মোকাবিলা করবে। অবলার মত কাঁদতে বসবে না। তবেই না শক্তপোক্ত হবে। 


কখনও বা হ্যাং হয়ে যায় বুড়ো কম্পুটার। কখনও অকারণে নিতেই থাকে আপডেট। আজকাল আর কাঁদে না কেউ। শুধু নার্ভাস গলায় ফোন করে জানতে চায়, ‘ক্লাস যে শুরু হয়ে গেল মা। সবে ৩৫ শতাংশ-’। ঠিক তখনিই দরজা ফাঁক করে মুখ গলায় কোন পরিচিত মুখ, তাড়া তাড়া বিল এসে জমে টেবিলের ওপর। পারে না মা সমস্যা মেটাতে। অসহায় অবলার মত বলে, একটু অপেক্ষা কর। আর ঠাকুর ডাক। সারাদিন এত যে ‘মুণ্ডমালা শোভিনী ভয়ংকরী ত্রিনয়নী’ গেয়ে বেড়াস। বিপদে পড়লে তাকে ডাকিস না কেন? বলতে বলতে বাড়তে থাকে মায়ের হীনমন্যতার মাত্রা। দপ্তরী কাজ করতে করতে মোবাইলের স্ক্রীনের দিকেই তাকিয়ে থাকে মা- কত শতাংশ হল?কিছু বলে না কেন? টুং করে নেচে ওঠে মুঠোফোন- কোন ভারিক্কি দপ্তরী গ্রুপে ভেসে উঠতে থাকে কাজের খতিয়ান। তারই ফাঁকে আসে প্রাণের বাণী, ‘৮৫ শতাংশ মা। তুমি চিন্তা করো না। এই তো খুলে গেল। ওয়াইফাইও লাগিয়ে নিলাম। এবার ক্লাশ করি। ’ কন্যার ক্ষুদ্রতম জয়েও ঝরে পড়তে চায় কড়া আধিকারিকের আনন্দাশ্রু। ঘর ফাঁকা হলে কাঁপা কাঁপা হাতে মেসেজ করে মা, ‘তোমার পাশে না থাকতে পারার বেদনা আমায় কুড়ে কুড়ে খায়। বড় ভালোবাসি যে তোমায়। বাবার থেকেও বেশী। ’ ক্লাস থামিয়ে ধমকে ওঠে মেয়ে, ‘কাজে মন দাও মা। আমি তো রইলামই।’  তাজ্জব মায়ের হৃদয় ভরে ওঠে কানায় কানায়, এমন গতিতে কি আদৌ ছোটার কথা ছিল জীবনের? এত উত্তেজনা- সাফল্য, এত উষ্ণতা, বিষণ্ণতা, হঠাৎ ব্যর্থতা, এত নির্ভরশীলতা,এত ভালোবাসা কি সত্যিই প্রাপ্য ছিল? প্রাপ্য ছিল চূড়ান্ত ঋণাত্মক পরিস্থিতির মধ্যেও এত আনন্দ? কিছুই তো পারতাম না আমি। আজও পারি না। পারি শুধু ভালবাসতে, ভাগ্যিস জীবন সমুদ্রসম, যত ভালোবাসি, ফিরে ফিরে আসে শতগুণ হয়ে।





No comments:

Post a Comment