Thursday 9 April 2020

Journey to Lhasa, The Diary of a Spy by Sarat Chandra Das

"He was a spy, who had fallen in love with the land of his mission and remained its lifelong lover.-  তিব্বত চিরকালই বহিরাগতদের সন্দেহের চোখে দেখে এসেছে। দুর্গম প্রাকৃতিক অবস্থান, সীমান্ত রক্ষায় সদাজাগ্রত দুর্দম, নৃশংস,শত্রুপরায়ন জনজাতি সভ্য জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন, অগম্য করে রেখেছিল তিব্বতকে। অগম্য বলেই হয়ত চরম রহস্যময়। উনবিংশ শতকের শুরু থেকেই সমগ্র এশিয়া জুড়ে ক্ষমতা বিস্তারে ব্যাপৃত হয় দুই মহাশক্তিধর  রাষ্ট্র বৃটেন আর রাশিয়া।  পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আরও আতঙ্কিত তথা সন্দেহপরায়ন হয়ে ওঠে তিব্বত। কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ করা হয় বহিরাগতদের অনুপ্রবেশ। শ্বেতাঙ্গ ছাড়ুন, সমতলবাসী ভারতীয়দেরও প্রবেশানুমতি  দিতে অস্বীকার করে তিব্বত।
যদিও, দুই দেশের মধ্যে স্মরণাতীত কাল থেকে চলে আসা ব্যবসাবাণিজে পড়েনি কোন প্রভাব। এই বাণিজ্য একতরফা ভাবে নিয়ন্ত্রণ করত তিব্বতীয় আর সীমান্তে বসবাসকারী কিছু পাহাড়ি উপজাতি। এরা ছাড়া প্রবেশাধিকার ছিল কেবল মাত্র বৌদ্ধ শ্রমণদের।  কয়েক শ বছর ধরে, অগণিত বৌদ্ধ শ্রমণের পদধূলি ধন্য এই পথ, বৃটিশদের জন্য এটাই ছিল লোহার বাসর ঘরের একমাত্র ছিদ্র। এই পথেই, গোপনে পাঠানো হত শ্রমণের ভেকধারী গুপ্তচরদের।  এদের বলা হত “পণ্ডিত।” মধ্য এশিয়ায় ব্যাপৃত বৃটেন আর রাশিয়ার ক্ষমতার দ্বন্দ্বে এরা ছিল  পাতি ক্রীড়ানক। অধিকাংশই দরিদ্র অশিক্ষিত পাহাড়ি জনজাতির মানুষ। জমিজরিপ সম্পর্কিত সামান্য প্রাথমিক শিক্ষানবিশী করেই এদের ঠেলে দেওয়া হত, সাংঘাতিক বিপজ্জনক মিশনে।হাতিয়ার বলতে থাকত বিশেষ ভাবে তৈরি কিছু যন্ত্রপাতি, যা ঝোলার মধ্যে লুকিয়ে, সীমান্তরক্ষীদের চোখে ধুলো দিয়ে ওপারে নিয়ে যেত এই গুপ্তচরের দল। সেক্সট্যান্ট, থিওডোলাইটের মত মাপন যন্ত্র লুকোনো থাকত বাক্সের কোন গোপন কক্ষে, ছড়ির ভেতর লুকানো থাকত কম্পাস, ফাঁকা জপযন্ত্রের মধ্যে লুকানো থাকত পাকানো কাগজ আর উচ্চতা মাপার হিপসোমিটার। জপমালায় ১০৮ এর পরিবর্তে থাকত ১০০খানা পুঁতি। পা গুনে গুনে দূরত্ব মাপত এরা, পরিমাপ-জরিপ করত তিব্বতের বিভিন্ন অঞ্চল। কয়েকজন পণ্ডিত যেমন অসাধারণ দক্ষতা তথা সাহসের পরিচয় দিয়েছিল, তেমনি পরাভূত, নির্যাতিত, নিহত পণ্ডিতের সংখ্যাও কিছু কম ছিল না। এমনি এক পণ্ডিত নয়ন সিং রাওয়াতকে, পরবর্তীকালে তাঁর অবিস্মরণীয় তথা দুঃসাহসিক কাজের জন্য স্বর্ণপদক দিয়ে সংবর্ধনা জানায় দা রয়াল জিওগ্রাফিক সোসাইটি।
তবে এদের মধ্যে প্রথাগত শিক্ষার অভাব থাকার জন্য, এরা কখনই তিব্বতের ভূপ্রকৃতি, জনজীবন বা সংস্কৃতি সম্বন্ধে বিশদ তথ্য যোগাড় করে উঠতে পারেননি। এই নিয়ে বৃটিশ সরকারের খেদ ছিল বরাবরই। পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত, বাস্তু প্রযুক্তিবিদ্ শরৎচন্দ্র দাস, তাই সরকার বাহাদুরের চোখে ছিলেন এই কাজের জন্য যোগ্যতম ব্যক্তি। তিব্বতের প্রতি তাঁরও ছিল অদম্য প্রেম।" 
“ঁশরৎচন্দ্র দাশের জন্ম, অধুনা বাংলাদেশের অন্তর্গত চট্টগ্রাম জিলায়। প্রেসিডেন্সী কলেজে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া কালীনই, তাঁর বুদ্ধিমত্তা আর অধ্যাবসায়, গোরা শিক্ষকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ডিগ্রী লাভের পূর্বেই তাঁকে প্রধান শিক্ষক হিসেবে পাঠানো হয়,সুদূর দার্জিলিং জেলার ভুটিয়া বোর্ডিং স্কুলে।

পাণ্ডববর্জিত জায়গায় পাহাড়ি ছেলেদের বোর্ডিং স্কুল, আর তার প্রধান শিক্ষক হিসেবে এক তরুণ বাঙালী ইঞ্জিনিয়ারের নিয়োগ আসলে ছিল বৃটিশ সরকারের এক গভীর চক্রান্তের সূচনা।

সিকিমের রিনচেনপং বৌদ্ধ বিহার থেকে আগত লামা উগেন গ্যাৎসো ছিলেন এই বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক। রিনচেনপং বিহারের সাথে, তিব্বতের শিগাটযের তাসিলহুনপো বিহারের সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত গভীর। মূলতঃ উগেনের উদ্যোগেই তাসিলহুনপো থেকে পাওয়া যায়, শরৎচন্দ্রের তিব্বতে প্রবেশের ছাড়পত্র। শুধু তাই নয়, শরৎচন্দ্রের তিব্বত যাত্রার অন্যতম সহযাত্রীও ছিলেন লামা উগেন গ্যাৎসো।

গোপন মিশনে যাবার প্রাক্কালে শরৎচন্দ্রের মাসিক বেতন এক ধাক্কায় ১৫০টাকা থেকে বেড়ে হয় ৩০০ টাকা। রওনা হবার পূর্বে, শরৎচন্দ্র তাঁর স্ত্রীকে শুধু জানিয়েছিলেন, যে তিনি আপিসের জরুরী  কাজে দিন কয়েকের জন্য শিগাটযে যাচ্ছেন। তাঁর স্ত্রী জানতেনও না, এই শিগাটযে কোথায়, বা কি তাঁর এই জরুরী কাজ। তিনি জানতেনও না যে, শরৎচন্দ্রের অকালমৃত্যু হলে তাঁর জন্য মাসিক ১০০টাকা পেনশন ধার্য করেছেন সরকার বাহাদুর।

শরৎচন্দ্র দুবার তিব্বত যান। প্রথম বার ১৮৭৯ সালে চার মাসের জন্য, আর দ্বিতীয়বার ১৮৮১ সালে চোদ্দ মাসের জন্য। মূলতঃ দ্বিতীয় অভিযানে তিনি যে বিশদ তথ্য যোগাড় করেছিলেন, তার উপর নির্ভর করে দুটি রিপোর্ট জমা করতে হয় তাঁকে, একটি রিপোর্ট গোয়েন্দা দপ্তরের জন্য আর দ্বিতীয়টি জমা করেন সার্ভে দপ্তরে। উনবিংশ শতকের অন্তিম ভাগেও এই দুইটি রিপোর্টই ছিল অত্যন্ত গোপনীয় এবং সংরক্ষিত। অবশেষে ১৯০২ সালে পুস্তকাকারে প্রকাশ পায়, “Journey to Lhasa, The Diary of a Spy”।  

তাঁর পূর্বসূরী ইউরোপীয় অভিযাত্রীদের থেকে শরৎচন্দ্রের  অভিজ্ঞতা ছিল অনেকটাই আলাদা। বলাইবাহুল্য শ্বেতাঙ্গদের তুলনায় তাঁর গ্রহণযোগ্যতা ছিল অনেক বেশী। খুব সহজেই তিনি মিশে গেছেন স্থানীয় অধিবাসীদের সাথে। শ্বেতাঙ্গ অভিযাত্রীদের তুলনায় ন্যূনতম বাজেটে,স্বল্প রশদ আর লোকবল নিয়ে যাত্রা করতে হয়েছে তাঁকে। কোথাও রাত্রিবাস করেছেন মেষপালকের কুটিরে,কোথাও বা পথের ধারে গ্রাম্য বিহারে। পথে সহযাত্রী ভৃত্য তথা কুলিদের সাথে গড়ে উঠেছে উষ্ণ সম্পর্ক। নভেম্বরের শীতে,সামান্যতম গরম পোশাকে, যন্ত্রপাতি বা আধুনিক উপকরণ ছাড়াই, যে ভাবে তাঁরা পার হয়েছেন একের পর এক দুর্গম গিরিখাত, তা রীতিমত বিস্ময়কর। তাজ্জব করে দেয় পেশাদার পর্বতারোহীদেরও।
যদিও দুর্গম পথের থেকেও বহুগুণ বিপজ্জনক ছিল, দুই দেশের সীমানা বরাবর বসবাসকারী উপজাতির দল। সর্বদাই অভিযাত্রীদের উপর যাদের ছিল তীক্ষ্ণ নজর। তিব্বতী ভাষায় তাঁর দক্ষতা আর বৌদ্ধ ধর্মতত্ত্ব সম্পর্কে তাঁর প্রগাঢ় জ্ঞানের দৌলতে, এই প্রহরী উপজাতিদের হাত থেকেও সহজেই গলে বেরিয়ে যান শরৎচন্দ্র। পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নেওয়া তথা একাত্ম হবার তাঁর ছিল এক অস্বাভাবিক সহজাত প্রবণতা।"   -শ্রী পরিমল ভট্টাচার্যের ভূমিকা থেকে খানিকটা বঙ্গানুবাদ।  Journey to Lhasa, The Diary of a Spy by Sarat Chandra Das

Wednesday 8 April 2020

অনির ডাইরি, ৮ই এপ্রিল, ২০২০


#lockdown #lockeddown
কি যে সব হচ্ছে-। সারা দেশ করোণা আতঙ্কে গর্তে সেঁদিয়েছে, আর আমার বৃদ্ধ বেরোচ্ছেন দুধ আনতে। শুধু দুধ? চেপে ধরলে, ট্রেনের ওয়াগনের মত আস্তে আস্তে বেরিয়ে আসে আরো কত কি? দই(টক এবং মিষ্টি), বাতাসা--।  বাতাসা? ঘচাং করে ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে পড়ে, সকালের ভিডিও কল। বাতাসা কি করতে অ্যাঁ? সুগারওলা লোকজনের বাড়িতে বাতাসা ঢোকে কেন? ধমকালে পাল্টা ধমকায় বৃদ্ধ। গলার জোর এবং বিক্রম দুইই বড় বেশী বৃদ্ধের।

মাঝপথে ফোন রাখতে বাধ্য হই, সদ্য কিনে আনা বাবার শেভিং ফোম, পাউডারের মত গালে মেখেছে আমার কন্যা। রীতিমত যুদ্ধ করে ফোম আর ক্ষুর কিনে এনেছে শৌভিক। ক্ষুর বললে, বড় রেগে যায় এরা শ্বশুর-জামাই। করোণার উৎপাতে মাথায় মুখে গজিয়েছে ঘণ জঙ্গল। বিগ বাস্কেটে নাপিত থুড়ি চুল-দাড়ি কাটার লোক পাবো কিনা জানতে চায় শৌভিক দুই বেলা। বাজারে গেলে করুণ চোখে তাকায়, বন্ধ সেলুনের দিকে। প্যাঁচ কষে, লক আউট উঠলেই, কাকডাকা ভোরে লাইন দেবে সেলুনের সামনে। কতবার বলেছি, আমিই পারব। ছোটবেলায় তো তুত্তুরীকে দিতাম কেটে খামচা কাট। তুত্তুরীর ঘণ আর কোঁকড়া চুল, কান কাটতাম, ধান হতো। মা অকারণ হাঁউমাউ জুড়ত। সে তুলনায় ছেলেদের চুল কাটা অনেক সহজ। এই তো সুকন্যা কি সুন্দর কেটে দিয়েছে উটোর চুল। দাড়িটাও কামিয়ে দেব, যদি আমার কাছে চুল কাটতে রাজি হয়- না হলেও দেব।  এদের বাপমেয়ে এত নাক উঁচু না, সেই দাড়ি কামালো, তাও আমাকে ক্ষুর চালাতে দিল না।  আবার বলে, করোণা যুদ্ধে প্রথম ক্যাজুয়ালিটি আমার দাড়ি।

দুপুর গুলো কাটে, রিপোর্ট আর তত্ত্বতলাশে। কোথায় কার বেতন হয়নি? কোথায় কে আটকে পড়েছে- সব মিটলে জেলা প্রশাসন থেকে আসে ফোন “যোগে ভুল আছে বুঝলেন তো। ১৭ জন কমবেশী আসছে। ” কি জ্বালা বাবা, করোণার সময় এক্সেলও যদি যোগে ভুল করে কি করি?

সব কেমন গড়বড় হয়ে যাচ্ছে। দুপুরে যারা ঘুমিয়েছিল, বিছানা তোলেনি কেউ। যত্ন করে, বালিশ চাদর বক্সে ভরে,সপাসপ ঝ্যাঁটালাম বিছানা। ভাবলাম,  বর খুশি হবে, সাবাশি দেবে। কচু। ঘেঁচু। কাঁচকলা। ষাঁড়ের মত চিৎকার করছে শৌভিক। রাতে শোবার জন্য বিছানা ঝেড়ে, সদ্য বালিশ-চাদর গুচিয়ে রেখেছিল- আমি নাকি কেঁচেগণ্ডুষ করেছি সব।

এবার ঘুমোতে যাব। এই লক ডাউনের বাজারেও এত ঘুম পায় কেন? তুত্তুরী রীতিমত ঈর্ষান্বিত। ঘুমিয়ে ঘুমিয়েও আপিসেরই স্বপ্ন দেখব, যেমন সেদিন দেখলাম, সারা দিন জুড়ে এজেন্ট-এসএলওদের ট্রেনিং। নব্যপ্রশাসনিক ভবনের গতিধারা হল কানায় কানায় ভর্তি। অথচ মূল ট্রেনার, ওরফে আমাদের এএলসি শ্রী সুখেন বর্মন, ট্রেনিং এর কথা বেমালুম ভুলে দার্জিলিং ঘুরতে চলে গেছেন। স্বপ্নে নিজের ধমকে নিজেই চমকে উঠি। সকালে বলাতে হেসে গড়াগড়ি যায় বর্মন। “ম্যাডাম আমি বলেছি, আমি ট্রেনিং হলের দরজার সামনে। আপনি ভুল শুনেছেন। ” সে তো গেল সেদিনের কথা। আজ আবার আমার দুই ইন্সপেক্টরকে স্বপ্ন দেখলাম- দেখলাম আমি দেখলাম সঞ্চিতা আর আমি গাছ কিনতে গেছি, কোন একটা নার্সারিতে। মালিকের সাথে কি নিয়ে যেন হাল্কা মতান্তর হল, ফলতঃ মালিক আমার গাছটা কেড়ে নিল। এই নিয়ে তুমুল ঝগড়া। তারপর নির্মলকে নিয়ে ইন্সপেকশন।  নির্মল যত বোঝাবার চেষ্টা করে,  ম্যাডাম, আপনার গাছটা কেড়ে নিয়েছে, এই অপরাধে মালিককে  কোর্টে তোলা যাবে না- ওর জেল-জরিমানাও হবে না।  ততো রেগে যাই আমি। স্বপ্নের মধ্যে বলেও দিলাম কি কি সব আইনে কেস দেওয়া যায়। মুস্কিল হচ্ছে যার একটাও নির্মলের পড়া নেই। “এ্যাইঃ  কাকে ধমকাচ্ছিস?” শৌভিকের গুঁতোয় যখন ঘুম ভাঙল, তখনও হেব্বি রাগ হচ্ছিল নির্মলের ওপর। হোক না স্বপ্ন। এত ফাঁকি কেউ মারে?

Monday 6 April 2020

অনির ডাইরি ৬ই এপ্রিল, ২০২০


#লকডাউন #লকড_ডাউন
ঐ যাঃ। জামাটা আবার ভিজে গেল। রান্নাঘরের কলটা এত জল ছিটোয়, ঐ জন্যই সবিতা মাসি বাসন মাজার সময়, একটা পুরোনো  মোজা জড়াত কলের মুখে। আজ সকালে আবার ফোন করেছিলাম সবিতা মাসিকে। বেতন দিতে পারিনি এখনও। ফোন করলেই মাসির এক কথা, “ কি করে যাব বওদি? লকডাউন কবে উঠিবে কিসু জানো গো বওদি? কি খেয়ে থাকব বলো তো?” টাকা মাসের প্রথম দিন থেকেই তুলে আলাদা করে রেখেছি। বারবার জানতে চাই, চেনা পরিচিত কেউ যদি অাসে এদিকে, যার হাতে পাঠাতে পারি বেতনটুকু। অন্য কোন কাজের দিদি বা সিকিউরিটির লোক। সিকিরিটির গুমটিটাও কদিন ধরে খালিই পড়ে আছে। শৌভিক মানতে নারাজ,কিন্তু  আমি জানি গৃহবন্দি সিকিউরিটি গার্ডেরাও। মনের সুখে রাজত্ব করছে কেলে-লেলের দল। সকালে দোকান সেরে ফেরার পথে দেখি, ল্যাজ খাড়া করে চিৎকার করছে লেলোটা। জনমানবশূন্য আবাসনের পথ। দাঁড়িয়ে রইলাম প্রায় মিনিট পাঁচেক, যদি কোন সঙ্গী পাই। মাস্ক পরা এক কাকু মাছের থলি নিয়ে যেই ঢুকলেন, সুড়সুড় করে তাঁকে অনুসরণ করলাম। থেমে গিয়ে পিছন ফিরে তাকালেন ভদ্রলোক, অতঃপর আশ্চর্য হয়ে জানতে চাইলেন, কি চাই? এইরে অনুপ্রবেশকারী ভাবল বোধহয়। চটজলদি বললাম, কুত্তায় আমার হেব্বি ভয়। আর যে ভাবে চিল্লাচ্ছে।পরিণাম এই হল, যে বাকি পথটা কাকু আমাকে কুকুরের ল্যাজ পুরাণ বোঝালেন।
আজকাল মাঝ রাতে উঠেও বাসন মাজি। খেয়ে উঠে আর ইচ্ছা করে না। ঘুমও তো আসে না ছাই। গতকাল রাত তিনটেয় ঘুমিয়েছি। রাতে ঘুম না এলেই বিকট খিদে পায়। পেট ভর্তি, তবু খিদে পায়। গতকাল সাড়ে বারোটার সময় উঠে, অবশিষ্ট রুটিটা মাখনচিনি দিয়ে খেয়ে ক্যাসারোলটা মেজে রাখলাম। ঠিক টের পায় শৌভিক। আমি ঘর থেকে বেরোলেই, পিছন থেকে জলদ গম্ভীর ধমক ভেসে আসে, “অ্যাই! কি খেতে যাচ্ছিস?” নিজের বাড়িতেও চোরের মত থাকতে হয় শা-
বাসন মেজে মেজে নখগুলোর অবস্থা খারাপ। মা দেখি নেলপালিশ পরেছে। আজ সকালে ভিডিওকল করতে গিয়ে দেখতে পেলাম। চীনের মুণ্ডপাত করছিল মা তখন, বিশেষতঃ চীনেদের খাদ্যাভাস নিয়ে মা দেখলাম বিশেষ বিব্রত এবং রাগাম্বিত। যে সব জিনিসপত্র চীনেরা খায় বলে মায়ের ধারণা দেখলাম, তা সোশাল মিডিয়ায় লিখলে চীন নির্ঘাত আমার নামে মানহানির মামলা ঠুকবে। কোন উৎসব, অনুষ্ঠানে তো পরে না, আজ হঠাৎ নেলপালিশ পরলে কেন? মা লাজুক হেসে জানাল, “ঐ তুই কিনে পাঠিয়ে দিয়েছিস। ” অনলাইন মাসকাবারির সাথে মাস কয়েক আগে মায়ের আবদারে একটা ল্যাকমের নেলপালিশ অর্ডার করেছিলাম বটে। সেটা শুকিয়ে যায়নি? ব্যাণ্ড এবং রঙটাও মা’ই ঠিক করে দিয়েছিল, লাল অথবা মেরুন। আজন্ম এই দুটি রঙই মায়ের পছন্দ। কেনে, কেনার পর আর রঙটা ভালো লাগে না, ফেলে রেখে শুকোয়। পরেছে দেখে আশ্বস্ত হলাম। রঙটা পছন্দ হয়েছে তাহলে? কপাল কুঁচকে মা জানাল, মোটেই না। কেমন যেন কেল্টে কেল্টে রঙটা। জানতে চাইলাম, তোমার কোন নেলপালিশ কোনদিন পছন্দ হয়? জবাব পেলাম, “তুই যেগুলো পরিস ঐ রঙগুলো পছন্দ হয়। তবে ওগুলো আমায় মানাবে না। ” আমি যেন কি পরি? বাঁ হাতের তর্জনী, মধ্যমা  আর বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠে লেগে থাকা হাল্কা আভা আর পায়ের আঙুলে খাপছাড়া ভাবে লেগে থাকা রঙ মনে করায় সপ্তাহ দুয়েক আগেও বেশ শৌখিন ছিলাম আমি-

আজকাল রান্না করতে করতে যা পাই মুখে লাগিয়ে নি। সকালবেলা টক দইয়ের কৌটটা মাজার আগে অবশিষ্টাংশ লাগিয়েছিলাম মুখে। বিকালেও তুত্তুরী বলছিল, “মা তুমি চুরি করে মাখন খেয়েছ? তোমার গায়ে মাখন মাখন গন্ধ কেন?” সত্যিটা চেপে যাই। দুর্দিনে খাবার জিনিস গায়ে মাখলে খুব রেগে যায় শৌভিক। কদিন আগে একচামচ টক দইয়ে হলুদ গুঁড়ো মিশিয়ে গায়ে মেখেছিলাম বলে খুব অশান্তি হয়েছে বাড়িতে। ভালো করে ধোওয়া সত্ত্বেও তোয়ালে এবং কাচা জামায় লাগছিল হলুদ রঙ। জামাকাপড় কাচার ওপর শৌভিকের মনোপলি আছে। ওয়াশিং মেশিনে হাতও দেবার অধিকার নেই আমার। কুকমি না এভারেষ্ট কার যেন ছিল হলুদটা, ভুলে গেছি, এত পাকা রঙ, শৌভিক ঘষে ঘষেও তুলতে পারেনি তোয়ালে থেকে। তাই আজকাল আর হলুদ মাখি না। তবে অন্য অনেককিছু মাখি যা শৌভিক টের পায় না। যেমন সন্ধেবেলা তরকারিতে দেবার জন্য টমেটো ঘষে তার ছালটা ঘষে ছিলাম মুখে। প্রথম দিকে বেশ চিড়বিড় করছিল, তারপর কাজের চাপে যথারীতি ভুলেছি ধুতে। এখন মুখ ধুতে গিয়ে বেশ জ্বালা করছে।  নাঃ টমেটো নির্দোষ, দোষ আমার হাতের। লঙ্কা কুচিয়ে ভুলে গেলে যা হয়। নাঃ বেশ জ্বলছে, নাইটক্রীমের বোতলটা নিয়ে শৌভিককেই ধরি, যদি একটু মুখে লাগিয়ে দেয়-

Sunday 5 April 2020

অরণ্যে আমরা- (c)Anindita Bhattacharya


জঙ্গলের ভিতরে একটা গ্রাম আছে। নির্ঘাত আছে, কাল দেখেছি, কয়েকজন আদিবাসী মহিলা মাথায় শুকনো কাঠের ঝাঁকা নিয়ে জঙ্গলে মিলিয়ে গেল।  পিছু ধাওয়া করতে গেলাম, সু হাতটা টেনে ধরল, “অনি, বেশী সাহস দেখিও না। এটা হাতি করিডর। বিপজ্জনক এলাকা।” জঙ্গলের রাণীর কথা কি আর, ফেলা যায়? সকাল সকাল হাতে গড়া রুটি আর পেঁপের তরকারি দিয়ে প্রাতঃরাশ সেরে হাঁটতে বেরিয়েছি সবাই। চতুর্দিকে ঘন সবুজ ঢেউ খেলানো পাহাড়, আর গভীর জঙ্গল। মাঝখান দিয়ে একফালি সরু পিচরাস্তা। চরাচর ব্যাপী অখণ্ড নিস্তব্ধতা, কেমন যেন চেপে বসছে কানের পর্দার ওপর।  ফুসফুসকে চেপে ধরছে অজানা এক রহস্যময়তা।  কি জানি কি হয় মার্কাD অদ্ভুত এক ভয়। বিদিশা দি আর দেবশ্রী দি হাঁটছে সবার আগে। দুজনের পিঠে পিট্টু টাইপ ব্যাগ। ব্যাগে ভরা জলের বোতল। আর বাদাম পাটালি। বাদামপাটালি গুলো আসার পথে এক ছোট্ট গুমটি থেকে কেনা। এক অনামী পাহাড়ি ঝর্ণা দেখতে সবকটাকে নামিয়েছিল অর্ণব দা। লাল কাঁকড়ে পাহাড়ের বুক চিরে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল পুঁচকে জলরাশি। নভেম্বরের শেষ।R ক্রমশঃ শুকিয়ে আসছে জলধারা। ধারাপথে জেগে উঠছে বড় বড় গোলাকার পাথর। অনেকটা চড়াই-উতরাই ভেঙে ওঠানামা করে হাঁপিয়ে পড়েছিলাম সবাই।চাঙ্গা করতে ত্রিদিবেশ দার দাওয়াই ছিল, শশা। একটাই মাত্র গুমটিতে বসেছিল একজন কৃশকায় ব্যক্তি। গুটি কয়েক পাকা শশা আর সাতটা বাদাম পাটালি নিয়ে। ঝাল নুন মাখানো শশার ফালি সত্যিই ফিরিয়ে দিয়েছিল প্রাণ। বাদাম পাটালি খেতে চাইছিল তুত্তুরী। আমি পয়সার ব্যাগ নিয়ে নামিনি। দরকারও নেই। ত্রিদিবেশ মামা আর অর্ণব কাকু থাকতে বাবা -মায়ের খুব একটা প্রয়োজন পড়ে না তুত্তুরীর। ত্রিদিবেশ দা একটা বাদাম পাটালি কিনছিল, দেবশ্রীদি তুলে নিল সাতটাই। দেবশ্রীদির দূরদৃষ্টিK সীমাহীন। কি অসম্ভব ভালো খেতে পাটালি গুলো। চিবোতে চিবোতেই হাঁটছি আমরা। গতকাল রাতেও হাঁটতে বেরিয়েছিলাম। সুকন্যা আর আমি। চুপিচুপি। বরগুলো জানতে পারলেই চিল্লাবে।বাচ্ছাগুলো গল্প শুনছিল দেবশ্রীদির কাছে।খোলা বারন্দায় আলো নিভিয়ে গল্প জুড়েছিল ছেলেরা। বিদিশাদি বসেছিল কি যেন একটা বই নিয়ে।    আমি আর সু কোন দলেই ঠিক ফিট হলাম না। তাই আর কি-
বেরিয়েছিলাম গল্প করব বলে, বাংলোর চৌহদ্দি ছাড়াতেই বাকরুদ্ধ হয়ে পড়লাম। আকাশে  বিরাজমান পূর্ণচন্দ্র। শীতল বাতাসে জঙ্গলী ফুলের সুবাস, ভেসে আসা ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক। মনে হয়েছিল চতুর্দিকে কেউ যেন উল্টে দিয়েছে কালো কালির দোয়াত। আর সেই মসিকৃষ্ণ চরাচরের ওপর ছড়িয়ে পড়েছিল জোছনার রূপালী দোপাট্টা। মোহিত মন্ত্রমুগ্ধের মত হাঁটছিলাম আমরা। যেন ধ্বংস হয়ে যাওয়া পৃথিবীর অন্তিম দুই মানবী। খেয়াল করিনি, কারা যেন পিছু নিয়েছিল নিঃশব্দ চরণে। একটা বাঁকের মুখে পথ আটকাল তারা, “মেমসাহেব এবার ফিরে যান। এটা হাতি করিডর তো।ঐ দূরে দেখতে পাচ্ছেন ঐটা দলমা পাহাড়। ঐখান থেকে সটান নেমে আসেন তেনারা। মানুষ দেখলে খেপে যান আইজ্ঞা। ” কোন পাহাড়টা যে দেখালো বুঝলাম না, তবে মেমসাহেব অর্থাৎ সুকন্যার নিরাপত্তা নিয়ে ওরা যে বিশেষ উদ্বিগ্ন সেটা বুঝলাম। বিনা বিবাদে ফিরে গিয়ে ছিলাম আমরা। আজ তাই খোঁজার চেষ্টা করছি দলমা পাহাড় কোনটা। যেদিকে আঙুল দেখিয়েছিল সেদিকে ঢেউয়ের মত ছড়িয়ে পড়েছে সবুজ সবুজ পাহাড়। এদেরই কোনটা দলমা হবে-
পিছন ফিরে দেখলাম তিনটে বাচ্ছাকে গাছে চড়তে শেখাচ্ছে অর্ণব দা। উটো ফার্স্ট। প্রায় মগডালে উঠে বসে আছে শাখামৃগের মত। উজান অতি সাবধানী। অপেক্ষাকৃত নিরাপদ, মোটা দেখে ডালে বসেছে। তুত্তুরী এবার হাঁচোরপাঁচোর করে উঠছে। উটো কি যেন একটা বলল, রেগে গিয়ে হাওয়াতে হাত পা ছুঁড়ল তুত্তুরী। সবার পিছনে এত্ত বড় লেন্স নিয়ে ত্রিদিবেশ দা, ছবি তোলা নিয়ে কি যেন শেখাচ্ছে শৌভিককে। বাধ্য ছাত্রর মত ঘাড় ঘুরিয়ে শুনছে শৌভিক।
সুকন্যা কি যেন বলে উঠল, ওর দিকে ফিরে তাকালাম। অন্যমনস্ক ভাবে সুকন্যা বলছে,“আমার কেমন যেন মনে হচ্ছে আমি এই পথ ধরে আগেও হেঁটেছি। সেটাও তোমার সঙ্গেই।” বলতে গেলাম ডেজা ভ্যু। বলতে পারলাম না। সত্যিই তো এই দৃশ্যগুলো বড় বেশী চেনা। যেন মনে হয় আদি অনন্তকাল ধরে হেঁটে চলেছি এই পথ ধরে। ভাবতে ভাবতে অজানা আতঙ্কে কাঁটা দিয়ে উঠল গায়ে।
“ওঠ রে। বেড়াতে এসে কেউ এত ঘুমোয় নাকি। ” বলে ধাক্কা মারল শৌভিক। স্বপ্ন দেখছিলাম তাহলে। চটজলদি তৈরি হয়ে নীচে নেমে দেখি, অর্ণবদা বাদে বাকি সবার স্নান সারা। ক্যাসারোলে করে প্রাতঃরাশ দিয়ে গেছে। হঠাৎ ভীষণ শীত করতে লাগল আমার। আমি জানি কি আছে,ঐ ক্যাসারোলে। রুটি আর পেঁপের তরকারী। কালও তাই ছিল। তার আগের দিনও। তার আগের দিনও। না জানি কত শত সহস্র বছর ধরে তাই থেকে আসছে। আমি জানি, কেন আসে না কোন খবরের কাগজ। কেন চলে না মোবাইল। কেন চলে না টিভি। আমি জানি খেয়ে উঠেই হাঁটতে বেরোব আমরা। বিদিশা দি আর দেবশ্রীদি পিঠে নেবে পিট্টু। তাতে থাকবে জল আর বাদাম পাটালি। তিনটে বাচ্ছাকে গাছে চড়াবে অর্ণবদা। শৌভিককে ফটোগ্রাফি শেখাবে ত্রিদিবেশ দা। আমি জানি দীর্ঘপথে আসবে না একটাও গাড়ি। চোখে পড়বে না অন্য কোন জনমানব। ঠিক একটা বাঁকের মুখে সুকন্যা আবার বলে উঠবে, “আমার কেমন যেন মনে হচ্ছে আমি এই পথ ধরে আগেও হেঁটেছি।” আর তারপরই আবার ঘুম ভাঙাবে শৌভিকের ডাক। আবার প্রস্তুত হয়ে নামব আমি-। কাঁধে হাত রাখল সুকন্যা, “অত ভেবো না। এর থেকে ভালো আর কি হতে পারত-”।

পুনশ্চঃ সব চরিত্র কাল্পনিক। শুধু ধার নিয়েছি কিছু প্রিয়জনের নাম।

Saturday 4 April 2020

অনির ডাইরি, ৪ঠা এপ্রিল, ২০২০



ঘুম ভাঙলেই ছুটে যাই বারন্দায়। সূর্যের আলো তখন সদ্য এসে পড়ে সোনালী পয়সা পাতার ওপর। অকাতরে ঘুমায় আমার ঘৃতকুমারী। জলের ঝাপটায় আড়ামোড়া ভাঙে আধ ঘুমন্ত গোলাপ আর জবা।ঘুমঘুম চোখে মাথা তুলে তাকায় ঘণ সবুজ পয়সা পাতা। নয়নতারার শাখায় তখন গোলাপী আবিরের আঁকিবুকি। ভেজা মাটির সুবাসে মিশে যায় বেল ফুলের সৌরভ।এই মুহূর্ত আমার বড় প্রিয়। করিডরে রাখা ক্যাকটাস্, যাকে তুত্তুরী আদর করে নাম দিয়েছে ক্যাকটু, কে যেন ভেঙে দিয়ে গেছে তার শাখা প্রশাখা। শৌভিকের মতে গৃহবন্দী থাকতে থাকতে পাগলে গেছে মানুষজন। তাদেরই কেউ আর কি-

 যবে থেকে রজার ফেডেরার দেওয়ালে বল পেটানোর ভিডিও আপলোড করেছে, শৌভিক পদে পদে হেসে গড়াগড়ি যাচ্ছে। মুখে একটাই বুলি, “লকডাউনে পাগলে গেছে সবাই।” সাধের ক্যাকটাসের দুঃখ এত সহজে মরে না। দীর্ঘ অভিসম্পাতের ফাঁকেফোকরে মাথায় ঘোরে জটিল ষড়যন্ত্র তত্ত্ব। হত্যাকারী কে? দোতলায় সদ্য ভাড়া আসা অবাঙালি পরিবারের হনুমান মার্কা দুলাল, নাকি তিনতলার নিঃসঙ্গ বিধবা ভদ্রমহিলার সর্বক্ষণের সঙ্গী অল্পবয়সী গৃহপরিচারিকা? তুত্তুরীর মতে এটা লেলো-কেলোর কাজ। শৌভিক গ্যালারিতে বসে উপভোগ করে আমাদের চাপানউতোর। “দোতলা থেকে লোক সিঁড়ি ভেঙে আসবে, তোর গাছ ভাঙতে? হোঃ হোঃ।” নাঃ কুকুর নয়, কোন মানুষ অথবা মানুষীরই কাজ। এসেছিল একটা ডাল ভেঙে নিয়ে যেতে। জানে না তো আমাদের ক্যাকটু কি জিনিস। এমন কাঁটা ফুটিয়েছে বাপঃ বাপঃ বলে পালিয়েছে বাছাধন।

বাজারওয়ালার একগাল হাসিতেও যায় না বিরক্তি। মুড়ো ফেরৎ চাই আবুর কাছে। গোটা মাছ কেনা সত্ত্বেও কেন মুড়োটা দাওনি বলে ধমকাইও।  আবু একগাল হেসে জানায়, “বিশ্বাস করেন বউদি, আজ একটাও মুড়া নাই। কাল সকালে আমি নিজে মুড়া দিয়ে আসব আপনার বাড়ি। ”
মার্কেট আজ বেশ ফাঁকা। জনগণও নিরাপদ দূরত্বে লাইন দিয়ে শান্ত ভাবে কেনাকাটা করছে। রাস্তায় গাড়ির সংখ্যা কি একটু বাড়ল? অখণ্ড নীরবতার মাঝে দু একটা গাড়ির হর্ণের আওয়াজ আরও বিরক্তিজনক।  কেত মারা হাফপ্যান্ট আর হাতকাটা টি শার্ট পরা দোকানীর গা ভর্তি ট্যাটু। বিগলিত হেসে জানতে চায়, “বউদি, এ মাসের মাসকাবারিটা আমার থেকেই নিচ্ছেন তো?” দাদাকে আগেই পটিয়ে রেখেছে। আমাকে পটাতে পারলেই কেল্লা ফতে। মাল না দিয়ে মুণ্ডপাত করে বিগবাস্কেট আর গ্রোফার্সের। জানায় যা চাইব, তাই পাব ওর কাছে। দাদাকে এত ভালোবাসে, যে এই দূর্মূল্যের বাজারেও এমআরপির থেকে কমই নেবে সবকিছু। কাকুতি-মিনতি করে বলে চলে, “তেমন হলে বউদি চাল-ডালটা ওদের থেকে নিন। বাকি সব আমিই দিয়ে দেব”। ঠিক এই কথাটাই  গত রাত্রে শৌভিক বলছিল, বাতাসে গভীর ষড়যন্ত্রের গন্ধ পাই।  ব্যাগের মধ্যে মালপত্র গুলো গোছাতে গোছাতে বলে চলে দোকানদার,  “সব ভ্যারাইটি পাবেন বউদি। সব কিছুতে এমআরপির থেকে চার পাঁচ টাকা কম নেব। মাল গুছিয়ে আপনার বাড়ি পৌঁছে দেব, শুধু একবার জানিয়ে দেবেন কি চাই-”।  একহাত দূরে দাঁড়ানো ভদ্রলোক নির্বিকার মুখে বলে ওঠেন, “তাই? আমাকে এক বোতল ভ্যাট আর একটা ওল্ড মঙ্ক দিও তাহলে। ” এক গলা  জিভ কাটে ট্যাটুওয়ালা। “আরেঃ দাদা। ওটাই তো পারব না। সব খালি দাদা। আমার আবার রোজ একটু না খেলে পেট সাফ হয় না। কন্সটিপেশন হয়ে গেছে দাদা বিশ্বাস করুন। দুঃখের কথা কি জানেন? আমার বাড়িতে দুটো বোতল রাখা আছে, একটা টিচার্স আর একটা ডবল ব্ল্যাক। আমার এক বন্ধু কিনে রেখে গেছে। লকডাউনের জন্য ও আসতেও পারছে না বেচারা, নিতেও পারছে না। রোজ ফোন করে আর ধমকি দেয়, ‘সালে হাত ভি লাগায়া না, তো তেরা শির ফোড় দেগা।’কি মুস্কিল দাদা। ঘরেই আছে, অথচ খেতে পারছি না।  পেট সাফ হচ্ছে না দাদা।” খুচরো পয়সা ফেরৎ নিতেও ভুলে গিয়েছিলাম কয়েক মুহূর্তের জন্য। মুদির দোকানে লোকে মদ খুঁজছে? হরি হরি। পয়সা মিটিয়ে চলে আসছি, দোকানি ষড়যন্ত্রের সুরে বলেই চলেছে, “তবে ব্ল্যাকে পাওয়া যাবে দাদা। আপনি বলেন তো এনে দেব। তবে দাম একটু বেশী। এক বোতল ব্লেন্ডারস্ প্রাইড তিন হাজার মত পড়বে-”। ভদ্রলোকের জবাবটা আর শোনা হল না, বেলা বেড়ে যাচ্ছে। শৌভিক বোধহয় ঠিকই বলেছিল, লক ডাউনের বাজারে জনগণ সত্যিই পাগলে গেছে রে বাবা।

Thursday 2 April 2020

অনির ডাইরি, ২রা এপ্রিল, ২০২০

হ্যাঁ, দশটা-পাঁচটার দমবন্ধ করা আপিসের সীমারেখাটা আপাততঃ বিলুপ্ত। ঘুম ভাঙার তাড়া নেই, আমার আগেই ওঠে সূর্য। আরাম করে চায়ের কাপে চুমুক মারতে বসে শুধু ছুঁয়ে যায় হাল্কা একটু দুশ্চিন্তা,বড় মূল্যবান এই সুগন্ধী চা। আপাততঃ দুষ্প্রাপ্য। মনে পড়ে যায় দোকানদারের দেওয়া হুঁশিয়ারি, “চা তো পাবেন দাদা। তবে টাটা টি। আর নইলে গ্রীন টি ব্যাগ।” দাদার চা নিয়ে কোন মাথা ব্যথা নেই, কফি নিয়ে আছে। কফির শিশি অমিল, আতঙ্কিত হয়ে দশটাকার কফির পাউচের মালা নিয়ে এসেছে শৌভিক। কেটে কেটে ঢেলে রাখতে হবে খালি হতে বসা শিশিতে। নইলে বড় জমে যায়। প্রথম প্রথম দুধ আনতে লাইন দিতাম। দুধ আর দইয়ের রেশনিং। এক প্যাকেটের বেশী কাউকে দেবে না। দইটা আবার শাশুড়ী মা আর তার ছেলে দুজনেরই বড় প্রিয়। নিয়ম মেনে দূরত্ব বজায় রেখে লাইন দি। পিছনের ভদ্রমহিলা, “আমার দুটো চাই” করতে করতে প্রায় উঠে আসতে চান ঘাড়ে। উনি মাস্ক পরেছেন। আমার নাকমুখ খালি। মাস্ক পরলে দমবন্ধ হয়ে আসে। তুত্তুরী ঠিকই বলে, মাস্ক পরলে নিজের নিশ্বাসের যাবতীয় সুবাস মিশে যায় প্রশ্বাসে। দুবার বললাম, আরেঃ সরে দাঁড়ান না দিদি। কাকস্য পরিবেদনা। চেটে দেওয়া দিদিই এদের যথার্থ ওষুধ। এক্কেবারে বাঘা তেঁতুল।
আমাকে দুধের লাইনে দাঁড় করিয়ে, বাজার গেছে শৌভিক। চাল নাকি কমতির দিকে। ওদিকে মাছওয়ালা আবু সকাল সকাল কুর্নিশ ঠুকেছে,“ ভালো মাছ এনিছি দাদা। জলদি আসেন।” শাহদাবও নাকি ছবি পাঠিয়েছে, টাটকা শিম-বিন-বরবটি-পেঁপে আর উচ্ছে এনিছি দাদা। জলদি আসেন।
শৌভিক ঝানু বাজারু, এখন তো আরও বিকশিত ওর প্রতিভা। চাল পায়নি, দু কেজি বাসমতী চালের প্যাকেট কিনেছে। মাছ কিনে মাথাটা ভুলে এসেছে। এই নিয়ে কিছু বলতে গেলেই শুনতে হচ্ছে পাতিলেবু দশটাকা পিস্। শাহদাব বলেছে, লেবু আসে চেন্নাই থেকে। এখন আসতে পারছে না, তাই আর কি-। অবশ্য কমলালেবু নাকি ভীষণ সস্তা এখন-। ভাতে মেখে খেলেই হয়। হায়রে মারিঁ আতোঁনিয়েৎ।

বেলা বাড়ার সাথে সাথেই শুরু হবে অফিস। কটা কারখানা খোলা, কটা বন্ধ? যারা খোলা, তারা কি জেলাশাসকের অনুমতি নিয়ে খুলেছে? কতজন কাজ করে এই খোলা-বন্ধ কারখানায়? বেতন পেল কি তারা? পায়নি? কবে পাবে তাহলে? এরই মধ্যে ভেসে আসে কাতর আবেদন, “আমরা এতজন শ্রমিক, মজুরি পাই নাই ম্যাডাম। আমরা খাব কি?বউ ছেলে নিয়ে শুকিয়ে মরতে হবে আমাদের। ” ফোন ধরে না আপদ মালিক। অন্য নম্বর যোগাড় করতে বাড়ে বেলা। ধমকে ওঠে কোথাও ইন্সপেক্টর, কোথাও আমরা। “বেতন দেননি কেন?” ব্যাঙ্কের ওপর দায় চাপিয়ে পালাতে চায় মালিক। ব্যাঙ্ক ম্যানেজারের গলায় অসহায়তার সুর। দৈনিক দুজন কর্মী নিয়ে খোঁড়াচ্ছে চুঁচুড়ার বড় ব্যাঙ্ক। আপিসের সময় দশটা থেকে দুটো। অনুরোধ উপরোধ করে অবশেষে গৃহিত হয় ফাণ্ড ট্রান্সফারের আবেদন। সময় লাগবে দিন দুয়েক। তা হোক। তাতে আপত্তি নেই শ্রমিকদের।
জলখাবারে মাখন দিয়ে সেঁকা মুচমুচে পাঁউরুটি।  শৌভিক ফিসফিসিয়ে বলে বাজারে মাখন নেই কিন্তু। ডিমও মাত্র কটা পড়ে আছে। খেতে বসলেই মনে পড়ে সুকন্যার কথা। কালরাতেই বলছিল, “আমার খেতে বসলেই মনে পড়ে বাসন মাজতে হবে।” সত্যি ভিম আর প্রিলের সৌজন্যে রীতিমত খসখস করছে হাত। বাসনের হাত থেকে বাঁচতে, দুপুরে তুত্তুরীর প্রিয় পার্টি লাঞ্চ। প্রেশার কুকারে, চাল-মুসুর ডাল আর খামি খামি আলু নুন দিয়ে সিদ্ধ করে, গরম গরম ঘি ছড়িয়ে খাওয়া।  লক ডাউন উঠলে দরজা দিয়ে গলতে পারব তো?
দুটোর মধ্যে পাঠাতে হবে সব রিপোর্ট। বর্মন সাহেব আর শুভজিৎ সকাল থেকে পড়ে আছে রিপোর্ট বানাতে। রিপোর্ট পাঠাতে গিয়ে চোখ পড়ে, কোণে পড়ে থাকা এক রাজনৈতিক ব্যক্তির মেসেজ। অন্য সময় খুলি না। আজ পড়তে গিয়ে চোখ কপালে। অভুক্ত পড়ে আছে মুর্শিদাবাদ থেকে আসা কয়েকজন শ্রমিক। বন্ধ নির্মাণকাজ। কে দেবে মজুরী? দীর্ঘ প্রচেষ্টায় তাদের চাল-আলু পৌছিয়ে দিতে পেরে, সামান্য স্বস্তি।
দিন ঢলতে বসেছে। একতাড়া অর্ডার লেখা বাকি।  ফাইল পড়তে বসেছি, মহকুমা শাসকের ফোন। অমুক জায়গায় নাকি চলছে কোন ফ্যাক্টরি। কিসের ফ্যাক্টরি? যিনি লুকিয়ে খবর পাঠিয়েছেন, সেটা বলতে পারেননি। শুধু বলেছেন দুই আড়াইশ লোক খাটছে। সর্বনাশ! জ্বালিয়ে খেল এরা। খোঁজ, খোঁজ কোন ফ্যাক্টরি। ইন্সপেক্টর সাহেবের নির্দেশে স্থানীয় এসএলও মুখে মাস্ক আটকে রীতিমত স্টিং অপারেশন চালিয়ে খুঁজে বার করে ব্যাটাদের। আরেঃ এরা তো আমাদের রীতমত জানিয়ে ঘটা করে বন্ধ করেছিল ফ্যাক্টরি। আপৎকালীন পরিষেবাও তো দেয় না এরা-। গলা চড়াতে গিয়েও পারি না। জানি কাজ না করলে বসিয়ে মজুরী এরা দেবে না। আবেগ আর কর্তব্যে লেগে যায় ঝটাপটি। রীতিমত ক্লান্ত অবসন্ন লাগে নিজেকে।
ঢলে সন্ধ্যা।আকাশে মেঘেদের হুটোপাটি। কিছুটা ম্রিয়মান নবমীর চাঁদ।  গতকাল ছিল অন্নপূর্ণা অষ্টমী। সারা দিন সিদ্ধ মুগকড়াই খেয়ে কাটিয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছি আগামী ছ মাস আর তড়কার পথ মাড়াব না। আজ রামনবমী। আজ থেকে শুরু রামঠাকুরের উপাসনা। রামরাজাতলা সন্নিবিষ্ট মধ্যহাওড়ায় আজ বিশাল উৎসব হয়। পুরনারীরা কাকডাকা ভোরে পদব্রজে রওণা দেয় পুজো দিতে। এবার যদিও কোন উৎসব হবে না। দর্শনার্থীদের প্রবেশ নিষেধের নোটিশ ঝুলিয়েছে কতৃপক্ষ। বাবাকে ফোন করি, ভিডিও কলের দৌলতে অন্তত প্রত্যহ একদুবার দেখা হয় আমার বৃদ্ধ-বৃদ্ধার সাথে। ডানপিঠে বুড়ো বড়ই মনমরা। বাইরে বেরোতে না পেরে নাকি লকড্ হয়ে যাচ্ছে হাঁটু। শৌভিক পাশ থেকে ইন্ধন দেয়, “ঠিক বেরোচ্ছে দেখ। সিগারেট পাচ্ছে কোথা থেকে-”। এটা একটা চিন্তা বটে। বিগ বাস্কেটে সিগারেটের আব্দার জানিয়েছিল বৃদ্ধ। মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে বিগ বাস্কেট। বৃদ্ধ বলে, “সিগারেট নেই বাজারে। রেশন করতে হচ্ছে-”। কি করে জানলে নেই? প্রশ্ন করলে অভিমান হয় বৃদ্ধের। বড় নিঃসঙ্গ বোধ করে আজকাল। একে একে ঝরে গেছে সব বন্ধু। প্রাণোচ্ছল শিবু কাকু চলে গেছেন অনেকদিন। চলে গেছে, আপদে বিপদে ছুটে আসা সমীরকাকু।চলে গেছে অকৃতদার নেপাল ওরফে নেপু কাকু।ব্রজেশ কাকু। যোগাযোগ রাখে না ভূতনাথ কাকু।  দেবা কাকু বড় অসুস্থ। ভবাই কাকু হয়ে পড়েছেন স্থবির। জানতে চাই, “আর সেই যে কাকুটা? যোধপুর পার্কে বাড়ি? ” শুনতে পাই, তিনি ভুগছেন চূড়ান্ত মানসিক অবসাদে। ব্যাচের অন্যতম সেরা ছেলে হওয়া সত্ত্বেও উপার্জনের দিক থেকে তেমন সবল হতে পারেননি কখনও। বরাবর রেজাল্টে পিছিয়ে থাকা অমুক কাকু সেখানে বানাতে পেরেছিলেন বিশাল ধনসম্পত্তি। অমুক কাকুর স্ত্রীও ছিলেন করণিক থেকে পদোন্নীত আমলা। আর বেহালার কাকুর স্ত্রী ছিলেন সরকারী হাসপাতালের নার্স। এটাও নাকি অবসাদের কারণ। রেগে বলি, ওটা অবসাদ নয়। ছিট কাপড়। সরকারী হাসপাতালের নার্স অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তথা সম্মানীয় পদ। কত মানুষের জীবন বাঁচান ওণারা। পরিচিত বেশ কয়েকজন আমলা তথা অর্ধআমলার স্ত্রী নার্স। আর ঐ নার্স কাকিমাই তো এতকাল টেনে আসছেন সংসার।  বিরক্ত হয় বাবা। “আঃ আমি বলছি না। ও বলে। অমুকের সাথে পদে পদে নিজের তুলনা করে আর মশারি টাঙিয়ে বসে থাকে। ”
উত্তরবঙ্গ থেকে ফোন করে এক সার্ভিসতুতো ভাই। “কি ফাঁসান ফেঁসেছি দিদি”। বয়স্ক বাবা-মা পড়ে আছেন দক্ষিণবঙ্গে। আগামী কাল থেকে ছুটি নেওয়া ছিল। পরশু কাটা বিমানের টিকিট। বৃদ্ধ-বৃদ্ধাকে নিয়ে কটা দিন ঘুরতে যাবার বন্দোবস্ত সব পাকা। খরচা হয়ে গেছে অনেকগুলো টাকা। আপাততঃ আপদকালীন পরিস্থিতিতে বাতিল ছুটি। আর ছুটি থাকলেই বা কি হত? “কি করে যেতাম গো দিদি? হেঁটে হেঁটে”। ব্যাপারটা কল্পনা করে হো হো করে হেসে উঠি দুজনায়। ফোন রাখতে রাখতে প্রার্থনা করি, জলদি মিলিত হোক, বিচ্ছিন্ন পরিবার যত। তৃপ্ত হোক তৃষিত আত্মা যত। ফুসফুসে আরেক ঝলক ভরেনি প্রিয়জনদের দৈহিক সুবাস। দূরত্ব রাখতে পারলাম না বলে ধমকে ওঠে বর। স্যানিটাইজারের বোতল উপুড় করে তুত্তুরী। ওসবে কান দিতে নেই। যাই রান্না বসাই- কাল আবার একটা কর্মব্যস্ত দিন।