Sunday 2 February 2020

কথা-

©Anindita Bhattacharya

-কথা বলো-
-এত রাতে? কি কথা?
-জানি না। যা মন চায়-।
-হুঁ।
-বিরক্ত হয়ো না প্লিজ। জানতে চাইছি না, তুমি আমায় ভালোবাসো কি না-,ইত্যাদি। ইত্যাদি। এমনি কথা বলো না,যা হোক কিছু-D
-হুঁ।
-সাদামাটা কথা। ঘর গেরস্থালির কথা। বা মন চায়- যদি মন চায়- আমার সাথে কইতে।
-হুঁ। সে বলাই যায়- কথা।
- তুমি কি জানো? রুবির মা একটি পাকা চোর? আজ রাতে ও তোমার জন্য দুটি পরোটা বানিয়েছিল- বাকি আটটা নিজের জন্য। তোমার নাকের ডগা দিয়ে ব্যাগে ভরে নিয়ে গেল- তুমি টেরটিও পেলে নাR।
- তাই নাকি?
- নয়তো কি? তোমার নাকি মাসে এক কিলো সার্ফ লাগে। লাগতে পারে? তোমার কি মনে হয়?
_ হুঁ । এটা আমারও মনে হয় মাঝে মধ্যে। আর তিন কিলো তেল আর দু কিলো চিনিটাও বাড়াবাড়ি যাই বলো। বুঁচকু থাকলেও না হয় মানা যেত-
- তবে? বোঝ তো সবই। কিছু বলো না কেন?
- ধুর। বুঁচকু বারবার বলে, “বাবা, আমার এখানে চলে এসো। ভাবছি, সত্যি কটা দিনের জন্য চলেই যাই-K
- চলে যাবে?
-হুঁ। কটা দিন থেকেই আসি না হয়। ওর বাচ্ছা গুলোও ছোট। আমি থাকলে একটু সুবিধে হয়-
-অ। চ-লে যা-বে।
অতঃপর? অন্তহীন নীরবতা। উঠে পড়লেন সুকুমার বাবু। গলায় বেশ ব্যথা করছে। রাত তিনটে। ঘুম আজ আর আসবে না। খুট করে জ্বলে উঠল রান্নাঘরের আলো। জ্বলল গ্যাস। মেপে জল নিলেন সস্ প্যানে। গ্যাসে চড়াবার আগের মুহূর্তে পিছন ফিরে জিজ্ঞাসা করলেন,“তুমি খাবে?” অখণ্ড নীরবতা। চরাচর যেন প্রাণহীন হয়ে পড়েছে। আরশোলা টিকটিকি, ব্যস্ত রাজপথ দিয়ে অনর্গল ছুটে চলা লরি বা বাসগুলোরও যেন লুপ্ত হয়েছে অস্তিত্ব। শ্বাস ছেড়ে চা বানাতে লাগলেন সুকুমার বাবু। অভিমান। অভিমান। কথায় কথায় অভিমান হয় এদের মা আর মেয়ের। ওদিকে মেয়ে ঠোঁট ফোলাচ্ছে, “আসছ না কেন বাবা?তুমি আমায় একটুও ভালোবাসো না।”  আর এদিকে মা-। দুজনেই চায় তাঁকে। দাঁড়িপাল্লার দুদিকে দুজনকে চাপিয়েই গোটা যৌবন কাটল সুকুমার বাবু। পান থেকে চুন খসলেই,পক্ষপাতিত্বর  অভিযোগ আনত অপরপক্ষ। অতঃপর চলত দুদ্ধর্ষ মান-অভিমানের পালা। নিজেকে বড় মূল্যবান বোধ হত তখন-। আজকাল সব কিছুই যেন কেমন বিমর্ষ, ধুসর, বিস্বাদ লাগে-। হাঁপিয়ে উঠছেন সুকুমার বাবু-।  বয়সটাও তো-
চায়ের কাপটা রাখলেন টেবিলের ওপর। বসলেন মৃণালিনীর মুখোমুখি। এক গাল হাসি দেখে জ্বলে গেল গা। সারাজীবন ঘুমোতে দিল না, মিনু ওকে। অল্পবয়সে চোখের পাতা জুড়লেই যত সোহাগ উথলে উঠত মিনুর। সেই “অল্পবয়স” চলেছে মধ্যপঞ্চাশ অবধি। তারপর শুরু হল রোগের বাহানা। পা ব্যথা, মাথা ব্যথা, অম্বল-গ্যাস-চোঁয়া ঢেঁকুর। জ্বর হলে তো কথাই নেই। সুকুমার বাবুর অসাক্ষাতে দিব্যি সব করে বেড়াত, যেই বুড়ো বরকে দেখত,অমনি কচি খুকি হয়ে যেত মিনু। কোলের কাছে গুটিসুটি হয়ে শুয়ে থাকতে চাইত-। মাঝে মাঝে চোখ বন্ধ থাকলেও হাত বাড়িয়ে দেখে নিত, সুকুমার আছে কি না। বাপের বাড়ি গেলেও আসত হুকুম- ফেরার পথে নিয়ে যেও কিন্তু।  সুকুমারকে ফেলে হাসপাতালেও গেল না মিনু- কি অনন্যসাধারণ লজিক,  না, “তোমাকে ছেড়ে গেলে তো এমনিই বাঁচব না-।” ঐ কথা আজকাল সুকুমারেরও বলতে ইচ্ছে হয়। বড় ইচ্ছে হয়- শুনবে কে? শুনছে কে? ডাইনিং রুমের দেওয়াল জোড়া সুন্দর সুন্দর ছবি, না না বয়সের মিনু। হাসি মুখে তাকিয়ে আছে সুকুমার বাবুর দিকে। বলেন। আজকাল ওদের সঙ্গেই কথা বলেন সুকুমার বাবু। ওদের সাথে কথা বলা সহজ।  সেই সব কথা, যা কখনও বলতে পারেননি মিনুকে। ভয় করত যে, দুর্বলতা দেখাতে- জানতে পারলে যদি কমে যায় মিনুর ভালোবাসা। তাই মিনুর সামনে কখনও বলতে পারেননি। আজও পারেন না। যখন স্বপ্নে মিনু আসে,ক্ষণিকের তরে- অব্যক্ত কথায় চাপে শুধু বড় ব্যথা করে গলা। বললেই যদি চলে যায় মিনু,চিরতরে-। স্বপ্নটুকুই তো শুধু সম্বল সুকুমার বাবুর- 
-

Saturday 1 February 2020

অনির ডাইরি, ১লা ফেব্রুয়ারি,২০২০


সবে তো নাম দেখানো শুরু, এখনই সাজানো কাবার প্ল্যাটারের মত সদ্য কেনা বইয়ের ছবি দিচ্ছে জনগণ।কুয়াশা কুয়াশা ভোরে, গরম কফির কাপে ঠোঁট ডুবিয়ে শৌভিক বলল,“দাঁড়া, এখনও তো অমুক বইমেলায় যায়নি। দেখবি ছবি কাকে বলে-”। নিন্দুকে যাই বলুক, মন্দ লাগে না ব্যাপারটা। এদের মধ্যে কোথাও না কোথাও খুঁজে পাই, ফেলে আসা “আমি” কে। জীবনের প্রথম মোচি, (গুচি নয়) তাও ডিসকাউন্টে কিনে এমন পুলক জেগেছিল- সটান ছবি ফেবুতে। বিদিশা দি, সেই টুনটুনির গল্পে, টুনটুনি পাখি গেলা রাজার মত মুখ করে বলেছিল,“জুতোর ও ছবি দেয় মানুষ? অনিন্দিতা?” আহাঃ কি অপরূপ সুন্দর জুতো,পাক্কা ছয় ইঞ্চি হিল- শাশুড়ি মায়ের হাঁটুর ডাক্তার ওণার হাঁটু ফেলে হাঁ করে দেখেছিলেন আমার জুতো। অসাধারণ সুদর্শন মধ্যবয়সী ডাক্তারবাবু আবার সম্পর্কে আমার অন্যতম প্রিয় সখীর ভাসুরঠাকুর।  মস্তিষ্কস্থিত পদার্থটি সামান্য ধুসরতর হতেই সটান উড়িয়ে ছিলাম সেই ছবি। ছিছিছিছি ছিঃ।
তো যা বলছিলাম আর কি, বুঝলেন আসলে ব্যাপারটা আর কিছুই না, আমরা ঈর্ষান্বিত। সরস্বতী পুজো উপান্তে জমিয়ে বসেছে বইমেলা। বাতাসে এখনও মেলায়নি হিমের রেশ। মাননীয়া দিয়েছেন উপুড় করে ছুটির ভাণ্ড। মুস্কিল হচ্ছে,ব্যাপারটা অনেকটা তোমার ছুটি আমার নয় মত ব্যাপার। অনেক প্রশাসনিক দপ্তরই এই ছুটিতে খোলা- আর যে গুলি বন্ধ, তার হতভাগ্য কর্মীকুল বাড়ি বসেই সারছে কাজ।কারণ? আমার কাজ তো আমারই বাপ,তোমার তো নয়! যেমন শৌভিক দেখছে নির্বাচনে নাম তোলা বা পাল্টানোর আবেদনপত্র। আর আমি বসে বসে লিখছি গ্রাচুইটির অর্ডার। কাল মধ্যরাতে গিয়ে শেখ ইয়াকুবের (নামটা কাল্পনিক) হিসেব দাঁড়াল সুদ সমেত সাড়ে তিন লাখ। শৌভিক মুখ বেঁকিয়ে বলল, “দেবে? এত টাকা? মনে হয় না!“ বলবে নাই বা কেন? হতভাগা নচ্চার ম্যানেজার, লোকটার চাকরী জীবন থেকে, ২৩ খানা বছর সির্ফ ঝেড়ে ফেলে দিয়েছিল। দরিদ্র মূর্খ শ্রমিক, ডান থেকে বাঁয়ে সই করে নিজের নাম। সে নাকি ১৫বছর ধরে শিখেছে কাজ- আর বাকি ৮ বছরে মেরেছে ফাঁকি। তবুও ২৩বৎসরান্তে তাকে পার্মানেন্ট করেছে মালিক পক্ষ। গাঁজাখুরি  আর কাকে বলে- সরকারী চেয়ারে বসে তো আর দেওয়া যায় না খিস্তি- যেটা স্বচ্ছন্দে বলা যায় ডাইনিং টেবলে কাজ সারতে সারতে।
কাল শুতে শুতে রাত দেড়টা। ভোর বেলা ঘুমে ভারি চোখে দেখি জোর তাগাদা-পর্যায়ক্রমে সুবীরবাবু এবং রঞ্জন দার। আসতেই হবে বইমেলা। আজ আমাদের বইয়ের শুভ উদ্বোধন।  আমাদের বই! আজ্ঞে হ্যাঁ। সমগ্র ফেবু জুড়ে শয়ে শয়ে গ্রুপ। হাজারে হাজারে যার সদস্য। যার অনেকগুলিতে কে বা কারা যেন অ্যাডিয়েছে আমারে। কোথায় আঙুলও ছোঁয়াই না আমি। ব্যতিক্রম শুধু- হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা। কারণ? এটা আমাদের গ্রুপ। বছর ভর গ্রুপের দেওয়ালে ভাস্বরিত লেখা এবং ছবিগুলির সংকলন আজ প্রকাশ হবার কথা- সময় দুপুর তিনটে। স্টল-২১২র নান্দীমুখ।
আর দেখলাম জনৈক সুদূরপ্রবাসিনী প্রিয়তমা বান্ধবীর ভীষণ মন খারাপ। এবারের থিম বুঝি রাশিয়া- আমাদের শৈশব জুড়ে রাশি রাশি রাশিয়ার কথা। চকচকে সাদা পাতায় ঝকঝকে গল্প। রঙচঙে মলাট। পুজোর ছুটি হোক বা গ্রীষ্মের ছুটি, অথবা পরীক্ষা শেষের লম্বা ছুটি। নিঃসঙ্গ দুপুরে,ঘড়ঘড়ে পাখার তলায়,উপুড় হয়ে, পাতা উল্টোলেই গরমের দেশে লালিতপালিত একদল বাচ্ছা ঝপ্ করে গিয়ে পৌঁছত বরফের দেশে। তারপর? হত কত কি। কখনও তিমুর ও তার দলবলের সাথে অ্যাডভেঞ্চার- তো কখনও রাজপুত্র আর রাজকন্যার চিরকালীন প্রেম। কোথায় যেন হারিয়ে গেল বইগুলো, আমাদের ছোট বেলার মত- বন্ধু শুনেছে ঐ বইগুলোই নাকি পাওয়া যাচ্ছে বইমেলায়- রাশিয়ার স্টলে। অফিস-সংসার দশহাতে সামলে আর আসা হবে না এবছর। প্রচণ্ড দস্যি খুদেটার বোধহয় আর পড়া হল না কুড়ুলের জাউ বা দুষ্টু পেঁচার ছানার গল্প-

হোয়াটস্অ্যাপ বন্ধ করে ভাবলাম- নাঃ। এত চাপ নেওয়া যায় না। চালাও পানসি বইমেলা,ভায়া হাওড়া অবশ্যই। বাবা- মা- পিসিকে আলিঙ্গন করে, তরতরিয়ে বেড়ে ওঠা বুল্লু বাবুর, ফুটবল খেলে ফেরা নোংরা আঙুল কামড়ে খানিক থুঃ ছিটিয়ে(আহাঃ নজর না লাগে) পেটপুরে মায়ের হাতের মাংসভাত খেয়ে যখন বেরোচ্ছি, ছোট্ট কাগজে লেখা বাবার আব্দার- সৃষ্টিসুখ থেকে রোহন কুদ্দুসের লেখা রাজদ্রোহ বইটা যদি-।

হল। হল। সবই হল। ঘোরাও হল।  কেনা হল রাজদ্রোহ। রূপম দা-শর্মিষ্ঠাদিদের সাথে দেখাও হল। সেই খড়্গপুর থেকে শুনে আসছি ওণাদের গল্প- দাদাদিদি বলব না স্যার-ম্যাডাম বলব, সেই টেনশনে বেশ খানিকক্ষণ ধ্যাড়ালাম দুজনে। থাকলাম সপরিবারে হারিয়ে যাওয়ার বই উদ্বোধনে। মাথায় টুপি পরে,সুবীর বাবু- অদিতি দি আর রঞ্জনদার মাত্রাতিরিক্ত খাতিরে, ভিআইপি সুলভ বেজায় বেজার মুখে বই উদ্বোধন করল তুত্তুরী। পাশ থেকে সুবীর বাবু বললেন,“ফিশফ্রাই খেলেই দিলখুশ হয়ে যাবে তুত্তুরীর-”। কে যেন জানতে চাইলেন, “ও কি খেতে চেয়েছিল-”। প্রবল হাসি চেপে বললাম, ও আসলে কিছু চায়নি। না চাইতেই কেনা হয়েছে বেশ কয়েকখনা বই। যা তুত্তুরীর হিসেবে অ-ন-এ-এ-ক। আঁতকে বলেছিল,  বাংলা তো তেমন পড়তে পারি না। বাবা দিয়েছে ধমকে হাঁকিয়ে । হাঁদাভোঁদা বা বাঁটুল তো দিব্যি পড়তে পারিস, শুধু বিভূতিভূষণ বা অবন ঠাকুর দেখলেই পারিস না? সবশেষে মা আবার যমজ বই কিনেছে,দুটো মোটকা মোটকা রাশিয়ার উপকথা। আঁতকে উঠেছে তুত্তুরী!দুটোই আমার? বলা হল,একটি সেই গুণধরের যিনি কিছুদিন আগে,চিমনি পরিষ্কার করতে আসা মিস্ত্রিকে,মায়ের দামী শাল কেটে সরবরাহ করেছিলেন-। সেই থেকে সমানে মাপছে তুত্তুরী। কোনটা পাতলা বেশী, সেটাতেই হোক তুত্তুরীর নাম লেখা-
আর হ্যাঁ, প্রিয় টাইগার, আপনাকে আমরা ভুলিনি। আজও নিভৃতে আপনার কথা বলেছি রঞ্জনদা আর আমি।কি বলেছি,বলুন দিকি? বলেছি, উহ শের থা সাব। অউর শের কো পাকড়ে কিসমে হ্যায় ইতনা দম- যেখানেই থাকুন, ভালো থাকবেন। 

অনির ডাইরি, ২৯শে জানুয়ারী ২০২০


মা, বড়মামার মুখে গল্প শুনেছে তুত্তুরী আর বুল্লু দাদা। সেই যে আশির দশকের গপ্প- যখন ঘুম ভাঙাত, “ইয়ে আকাশবাণী হ্যায়-”।ভোরের বাতাসে উনুনের ধোঁয়ার বাস-দুধ চিনি দেওয়া চায়ের সাথে থিন অ্যারোরুট আর আনন্দবাজার নাকি যুগান্তর- । ঘড়ি বেঁধে দূরদর্শন সম্প্রচার- মাঝে মাঝেই অনুষ্ঠান প্রচারে বিঘ্ন ঘটায় দুঃখিত। নিয়ম করে ঘুরত সূর্য- চন্দ্র। বদলাত ঋতু। হত ষাণ্মাসিক বা বার্ষিক পরীক্ষা। ঝুড়ি আর বস্তা করে নম্বর আনত ক্ষীরেরতলা গলির কাঁঠাল গাছ ওয়ালা চাটুজ্জে বাড়ির তিনটে ছানা- যেমন আনে তুত্তুরী। অতঃপর? মা আর মামাদের মাথায় পড়ত সটাসট্ চাঁটি আর ঠকাঠক গাঁট্টা। দিদি( আসলে দাদুর দিদি) বলত, “সরস্বতী পুজোর আগে কুল খেয়েছিলি?আর খেও না। মা সরস্বতী রাগ করেন-। ” এটা অবশ্য মাও বলে তুত্তুরীকে। পাশ থেকে ফোড়ন কাটে বাবা- “হ্যাঁরে? তুই সত্যি ফিজিক্স নিয়ে পড়েছিলি?”
 হিমেল রেশ থাকতে থাকতেই এসে পড়ত সরস্বতী পুজো। পাল্লা দিয়ে লাফাত খুদে মা আর মামাদের দল।  ঠাকুর আনবে কখন? ঠাকুর সাজাবো কখন? রিক্সা চেপে কোলে করে ঠাকুর আনত দাদু/ছোট দাদু। সাজানোর গুরুদায়িত্ব ছিল দাদুর একার। সহকারী তিন খুদে মাতব্বর। একতলার ঠাকুর ঘরের পলেস্তারা ওঠা দেওয়াল ঢাকা পড়ত মামমামের(দিদা) দামী সবুজ দক্ষিণী সিল্কের আবরণে। কালো ফুটিফাটা রোয়াকে দণ্ডায়মান দুই থামের গায়ে বাঁধা হত কলাগাছ। তার সামনে বসত স্বস্তিকা আঁকা মাটির ঘট আর সশীষ ডাব। প্রায় মধ্যরাত জুড়ে বাড়ি সাজাত দাদু। বছর ভর জমানো সিগারেটের বাক্স থেকে বেরিয়ে আসত রাঙতার পাহাড়। নিপুণ হাতে ফুল কাটত দাদু। অ্যালুমিনিয়ামের বাটিতে ময়দা ফুটিয়ে আঠা বানিয়ে দিত বড় দিদা। সটাসট চিপকাত ফুল। মাঝে ছোট্ট ব্রেক। আটটা থেকে দূরদর্শনে বাংলা সিরিয়াল- সেবার সিরিয়ালের মাঝপথে আচমকা বস্ত্র উন্মোচন করে সুইমিং পুলে নেমে গেলেন নায়ক এবং নায়িকা। যাঁদের একজন এখনও মাননীয় মন্ত্রী আর অপরজন পরাজিত সাংসদ। জলে নেমে প্রগাঢ় আলিঙ্গন এবং ইয়ে- । ফিকফিক করে হেসেই চলেছিল মা আর বড় মামা- ছোট মামা তখন বড্ডই ছোট। কান মুলে ভাগিয়ে দিয়েছিল ছোট দাদু। সেই গল্পও শুনিয়েছে মা- তুত্তুরী যে মায়ের প্রাণের বন্ধু।

গল্প শুনতে শুনতে মনে হয় যেন সাদা কালো চলচ্চিত্র দেখছে তুত্তুরী। বড় বাড়ি, যৌথ পরিবার। শতেক জটিলতা অস্বাচ্ছন্দ্য ছাপিয়ে উৎসবের অনাবিল আনন্দ। বড় রঙীন ছিল মা আর মামাদের শৈশব। আজও মায়ের চোখে-মনে লেগে আছে সেই রঙ। নিশ্বাসে ভালো লাগা তথা ভালো থাকার আস্বাদ। বড় সাধ হয় মায়ের,যদি ভাগ করে নিতে পারত ঐ আস্বাদ- তুত্তুরীর সাথে। সাধ তো হয়, কিন্তু কর্মক্ষেত্র আর ব্যক্তিগত জীবনের ভারসাম্য- ব্যাপারটা মায়ের একদমই বাগে আসে না। ট্রেনিং দেবার সময় তো মা দিব্যি শেখায়, দপ্তরী কাজই হোক বা বাড়ির কাজ নিজেকে নিঙড়ে দেবেন না, না বলতে শিখুন- দিনান্তে নিজেকে সময় দিতে কখনই ভুলবেন না, ইত্যাদি প্রভৃতি।
কিন্তু বাস্তব জীবনে কাজটা সাংঘাতিক দুরূহ। নাক কান মোলে মা।  সাংসারিক কাজকে অবহেলা করে যদি আপিসে মন বসায়, বাড়িটা হয়ে যায় শৌচাগার। আর শৌচাগারদ্বয় কি হয়, সে কথা নাই বা কইলাম। আর উল্টোপুরাণ পড়লে, অর্থাৎ দপ্তরী কাজকে পিছনে ফেলে যদি সংসারে মন বসায় মা- পরদিন অফিস যেতে নির্ঘাত ব্যথা করে পেট- জোড়ে নাকেকান্না। বাপরেঃ আপিসে গেলেই ঝাঁপিয়ে পড়বে কাজ। চামচ দিয়ে খুঁড়তে হবে পাহাড়।

এতদসত্ত্বেও উৎসবের সময় কেমন যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় মায়ের বাড়ি আর আপিস। আহাঃ ওটাও তো মায়ের পরিবারই। স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে বা বলতে পারেন গায়ে পড়েই এগিয়ে আসে সবাই- হয়েই যায় যোগাড়যন্ত্র। তুত্তুরীর বুজু সরস্বতী তো সাদা সেলোফেনের জামা পরে বসেই থাকে বছর ভর বইয়ের আলমারির মাথায়। বোতলে করে গঙ্গা জল এনে দেন ডিএম অাপিসের বৃদ্ধ অজিত দা। রমেশ আর বিদ্যুৎ মামা জোগাড় করে আনে পূজার যাবতীয়  উপকরণ। শাড়ির বস্তা নিয়ে হাজির হয় মাম্পি মাসি। “ম্যাডাম!হলুদ শাড়ি নেবেন না?তুত্তুরীর জন্য তো একটা নিন।  পয়সা না হয় নাই দিলেন-”। তুত্তুরীর যদিও একটা হলুদ শাড়ি আছে। প্রিয়াঙ্কা মাসি এসে শিখিয়ে যায় ভোগের খিচুড়ি রান্নার কৌশল- ঝুমা মাসি ঠেলে পাঠায় তুত্তুরীর জন্য হলুদ ঝুটো গয়না কিনতে।  “আমি পারব না-। ঝামেলা বাড়াস না তো” গজগজ করতে করতে করতে ফুল-ফল-বাজার করে আনে বাবা।ঝ্যাঁটা-ন্যাতার দাপটে পালায় ধুলো আর ময়লার গুষ্টি।  বাষট্টি বার ডাইনিং চেয়ারে ওঠানামা করে শিকলি টাঙায় মা আর তুত্তুরী- দরজায় দরজায় আঁকা হয় আল্পনা। ফ্ল্যাটের গ্রীলের গেটে বাঁধা হয় কলাগাছ- সকাল থেকে রান্না হয় খিচুড়ি- বেগুনী - কুলের অম্বল আর পায়েস। কুলের অম্বল রাঁধতে গিয়ে চক্ষু চড়কগাছ হয়ে যায় তুত্তুরীর মায়ের। এ কোন কুল এনেছে আমার বর? বোম্বাই কুল? এই কুলের অম্বল থুড়ি চাটনি রাঁধব? বাড়ি হয়ে যায় মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গেলর ম্যাচ- দ্বৈরথ চলতেই থাকে বাঙাল-ঘটির। স্নান সেরে টুকটুকে লাল শাড়ি পরে  ঘর আলো করে এলো চুলে ফল কাটতে থাকে তুত্তুরীর কাকিমা।নিপুণ হাতে সেজে ওঠে নৈবেদ্য। কাকাই এর পিছনে তেলের গামলা নিয়ে ঘোরে তুত্তুরী মা- “পুজোটা করে দে না টুকলু বাবা-সোনা ছেলে। ” বাঙাল-ঘটির দ্বৈরথ ভুলে সুর মেলায় তুত্তুরীর বাবা আর দাদুও। দাদু তো সটান হুমকিই দেয়-“বাড়ির পুজো বলে কথা। পরের বছর থেকে দায়িত্ব নাও টুকলু। ” কাকিমার মন খারাপ কাঁসর ঘন্টার জন্য। মা বুদ্ধি দেয়-“কাঁসার থালাকে বেলুন দিয়ে পেটা না বাপু- দিব্যি আওয়াজ হবে-”।  আর এত কিছুর মধ্যেই কোথা দিয়ে যেন মায়ের ছোটবেলায় পৌঁছে যায় তুত্তুরী-ধূপদীপ জ্বেলে ভুলভাল উচ্চারণে পাতি পাঁচালি খুলে পুজো করে মা- তুত্তুরী শোনে মা বলছে- “আই লাভ ইউ বুজু সরস্বতী। ভালো থেকো সোনা-”।

Saturday 25 January 2020

অনির ডাইরি ২৩শে জানুয়ারী, ২০২০


আপন আপন ব্যস্ত জীবনের গোলকধাঁধা থেকে কয়েক মুহূর্ত চুরি করে, যাঁরা কাল ভরিয়ে দিয়েছেন আমার ফেবুর দেওয়াল বা মেসেঞ্জারের ইনবক্স বা হোয়াটস্অ্যাপ,তাঁদের সকলকে অশেষ ধন্যবাদ।  অনেকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন একসাথে একাধিক মাধ্যমে, আর মাম্পির মত গুটি কয়েক পাগলি সবকিছুর পর আবার ফোন করেও--। কুর্নিশ আপনাদের সকলকে। আপনাদের শুভেচ্ছার জন্য বড় বেশী ভালো কেটেছে গতকাল দিনটা।
আর পাঁচটা বাঙালী মায়ের মত নাহলে হয়তো আমারও মনে হত, মায়ের আবার জন্মদিন! ভূতের আবার জম্মতিথি!প্রণম্য মহামানবের সাথে জন্মদিন ভাগ করে নেবার অন্যতম সুবিধে হল ছুটি। একটু বেলা করে ঘুম থেকে ওঠার অপরিসীম আনন্দ-।  অতঃপর? অন্যদিনের মতই, গাছেদের সাথে কথোপকথন-। শীত শেষ হয়ে আসতে চলল, এখনও বন্ধ্যা আমার পেটুনিয়া ওরফে পেটু। গায়ে গতরে বেড়েছে খুব, শুধু ফুল ফোটানোতেই এত অনীহা কেন বাপু? বেড়েছে গোলাপ ওরফে গোলাপীও-। জামাকাপড় শুকাতে দিতে গেলেই আমার বরকে তিনি সোহাগ করে কাঁটা ফুটিয়ে দাম্পত্যকলহ বাঁধান- এখনও নিষ্ফুল। বাড়ছে আদরের ক্রোটন যার ডাক নাম ক্রোটু, ছাঁটা সত্ত্বেও বাড়ছে এদিকওদিক দিয়ে পয়সাপাতা, এমনকি ক্যাকটাসও, বাড়ছে না কেবল সাধের ঘৃতকুমারী। আজ তো মায়ের জন্মদিন, আজ তো ফুল ফোটাও পেটু বা গোলাপী। 

জন্মদিন মানেই স্মৃতিমেদুরতা, দেশবরেণ্য নেতার সাথে জন্মদিন ভাগ করে নেবার সুফল হল, প্রাক ফেবু যুগেও চট করে কেউ ভুলত না শুভেচ্ছা জানাতে। আর ভুলে গেলে? উথলে উঠত অভিমান। সাক্ষী সঞ্চিতা। কি রেগেই না গিয়েছিলাম সেবার প্রিয় বন্ধুর ওপর। বাড়তে থাকা বয়স আর চড়তে থাকা আত্মবিশ্বাস অবশ্য বহুকাল হল মুছে দিয়েছে ঐসব ছেলেমানুষী আবেগ। তবু আজও বসে থাকি কয়েকটা ফোনের অপেক্ষায়। তাদের ফোন, যারা তখন ছিল আসেপাশে, যখন দিগশূন্যপুরের মাঠে হারিয়েছিলাম খেই। 
সাদাকালো আশি-নব্বইয়ের দশক। হাওড়া ইছাপুরের সিংহ বাড়িতে ২৩শে জানুয়ারী দিনটা ছিল নিছক উৎসব। উৎসবের হাওয়া বইত গোটা মধ্যহাওড়া জুড়েই। সকাল থেকে বেরোত প্রভাত ফেরি। ছাতে ছাতে উড়ত ত্রিরঙা। অবসর সম্মিলনীর মাঠে, ঠিক মধ্যাহ্নে ফাটত বোমা। জীবিত থাকলে  তাঁর যত বছর বয়স হত, ততোগুলি বোমার সেলাম জানাত অবসর। বড়দার হাত ধরে দেখতে যেত সেদিনের ঝুনু। নেতাজীর সাথে সাথে ঐদিন গুনু আর ঝুনুরও জন্মতিথি ছিল যে। দিদা আদর করে ডাকত ঝুমি। ১৯৯৮এ দিদা চলে যাবার পর, আর কেউ ডাকেনি ঐ নামটা ধরে। চাইও না কেউ ডাকে- আবার যখন দেখা হবে, সেই তামুক পাতা চিবানো বৃদ্ধার সাথে, অন্য কোন দুনিয়ায়- আবার ডাকবে সে। শুধুই সে।

খাকি ব্যাগে, জোড়া বোতলে করে ভোর-ভোর আসত হরিণঘাটার দুধ। পায়েস রাঁধত বড়মাসি। ঘণ দুধের  পায়েসের মাঝে এক আধখানা কাজু। জন্মদিনে ভোর ভোর উঠে গুরুজনদের প্রণাম করা ছিল প্রাথমিক কর্তব্য।  মাঝে মাঝে বায়না জুড়তাম।  শাড়ি পরিয়ে দাও মা। পিসির হাত দিয়ে কাছেই শীতলাতলায় পুজো পাঠাত ঠাকুমা। প্রসাদ বলতে ছোট্ট গুজিয়া অথবা প্যাঁড়া। আগের রাতেই জ্যাঠাইমা এনে রাখত নলেন গুড়ের নরম পাকের সন্দেশ,কালোজাম আর পেস্ট্রি। সুগার এন স্পাইজ বা ক্যাথলিনের মত নামি দোকান তখনও হাওড়ায় বিস্তার করেনি শাখা? স্থানীয় বাজারেরে দাবার ছকের মত দেখতে পেস্ট্রি। তাই মনে হত অমৃত। জন্মদিনের একমাত্র দুঃখ ছিল মায়ের অফিস। কেন্দ্র সরকারী কর্মচারী, তাও পোস্ট আপিসে কাউন্টার ডিউটি।  কোন দিন ছুটি পায়নি মা। শুধু সে বছর বাদে, যে বছর শতবর্ষে উপনীত হন তিনি।
বড় মাসির বাড়ি যেতে দেরী হলে সাইকেল নিয়ে সটান হাজির হত বড়দা বা মেজদা। রডে বসে পা দোলাতে দোলাতে ইছাপুর। সোনা-মিন্টুদের বাড়িতে তখন ভাড়া থাকত বড়মাসিরা। একতলার অপরিসর দালানে মাসিদের হাতে তৈরি লাল-নীল উলের আসন পেতে বড় মাসিকে ঘিরে আয়তাকারে খেতে বসতাম আমরা পাঁচ ভাইবোন। রাজার মত বসতেন বড় মেসোমশাই।  টুক টুক করে কত কি যে রাঁধত বড়মাসি। খেতে খেতেও ঝগড়া করত “গুণু আর ঝুনু”। কি বোকাই না বানাতে ছোটদা তুমি আমায়! তখন ইমরান খাঁ-ওয়াসিম আক্রমের ইন্দ্রজাল আচ্ছন্ন ক্রিকেট জগৎ। মনে আছে, তুমি দাবী করতে তুমি পাকিস্তানের সমর্থক?  কম কিলিয়েছি রেগে গিয়ে? আর নাহলে বলত, ঝুনুকে নয়, গুণুকে সবাই বেশী ভালোবাসে। “জিজ্ঞেস করে দেখ-”। কি বোকাই না ছিলাম। সত্যিই জনে জনে প্রশ্ন করে বেড়াতাম। হ্যাঁ গো, তুমি কাকে বেশী ভালোবাসো? ছোটদাকে? না আমায়?
প্রতি জন্মদিনে বাঁধা উপহার ছোট বা সেজ মাসির হাতে বোনা সোয়েটার। নাক টানলে আজও পাই হাতে বোনা নতুন সোয়েটারের সুঘ্রাণ। একটাও বাতিল করেনি মা। যত্নে রাখা সেই সব সোয়েটার পরে আজও ঘোরে আমার কন্যা। আর মেজদা দিতে বই। হাওড়ার বাড়ির আলমারি ভর্তি যত বই, তার শতকরা ৭০ শতাংশই তো তুমি দিয়েছিলে মেজদা। শেক্সপীয়রই বলো বা শার্লক হোমস্ অথবা দেশী নিহাররঞ্জন বা হেমেন্দ্রকুমার রায়- তুমি না থাকলে জমতই না পরিচয়।
১৫ই জানুয়ারী ১৯৯৯, বড়দার বিয়ে, তারপর কেমন যেন গুরুত্ব হারাল ২৩তারিখটা। নবোঢ়া তন্বী শ্যামা বড় বৌদির চলনে-ঠমকে-গমকে মুগ্ধ সিংহ-ঘোষ তথা চাটুজ্জে বাড়ি। বৌদির নিঁখুত পরা শাড়ি, কাজলটানা চোখ, চুড়ির রিনিঝিনি, ২৩শে জানুয়ারীকে একডজন গোল দিল ১৫ই। বছর তিনেক বাদে ২৮শে ফেব্রুয়ারি এল মেজবৌদি। গুরুগম্ভীর মেজদা এত ফাজিল বউ কি করে জুটিয়েছিল কে জানে? বৌদি নয়তো ইয়ার। দাদাদের থেকে বৌদিরা কবে যেন অনেক বেশী কাছের লোক হয়ে উঠল। সেজদা-ছোটদা যখন টোপর পরছে, তখন পুরোদস্তুর জীবন সংগ্রামে ব্যাপৃত আমি। জন্মদিন পালনের সময় কোথায়? তবুও আসত ফোন। ঠিক এসে পৌঁছে যেত স্নেহোপহার। দূরাভাষের ওপাড় হতে কাতর অনুরোধ- আসিস একবার। পায়েস করেছি দুই ভাইবোনের জন্য-।
কবে যেন চাকরী পেলাম-কবে যেন তার সাথে আলাপ হল। বিয়ে হল। সেসব মনে হয় স্মরণাতীত কালের কথা। এখন তো শালকিয়ার ভট্টাচার্য পরিবারের মেজ বউ। জিতেন বাবুর আদরের বড় বৌমা- টুকলুর বউদি আর উমার স্নেহশীলা দিদিভাই। সবার ওপর- তুত্তুরীর মা। যে বোঝেই না,কেক ছাড়া আবার জন্মদিন কি করে হয়? দাদু,ছোটেদাদু,  ছোটো-মুষ্টু বা মামা-মামিদের সামান্য ফোনে কেন ছলছলিয়ে ওঠে মায়ের চোখ। কিন্তু ওঠে তো। কি করি? যতই কঠিন হোক আত্মবিশ্বাসের খোলস, সেদিনের ঝুনু যে আজও বেঁচে আছে আজকের অনির ভিতর। আর সে যে বড় ভালোবাসার কাঙাল- মাথার ওপর থেকে যে হারে সরছে গুরুজনদের স্নেহছায়া, বড় ভয় পায় সে, তাই তো জন্মদিনের শুভক্ষণে তার একটাই প্রার্থনা, তোমাদের সুস্থ থাকাটাই আমার সবথেকে বড় উপহার। আজকে শুধু আজকের দিনে আঁকড়ে ধরতে চাই আমার প্রতিটি প্রিয়জন, প্রতিটি প্রিয়বন্ধুকে, আর বলতে চাই- যাই হোক না কেন, আমায় ছেড়ে যেও না। সময় যত জোরেই দৌড়ক না কেন,বিশ্বাস করো, আমি বদলাইনি। তোমরাও যেন বদলে যেও না-।

Wednesday 22 January 2020

অনির ডাইরি, ২২শে জানুয়ারী ২০২০




কুয়াশা ঘেরা আলসে শীতের ভোরে ঘুম ভাঙলে প্রথমেই যেটা মনে হয় , “জীবন জঞ্জাল হয়ে গেল মাইরি-”। মসৃণ কম্বলের মায়ামাখা ওম ফেলে নিজেকে তোলা, তারপর তুত্তুরীর সঙ্গে শুম্ভ-নিশুম্ভের যুদ্ধ।বার্ষিক পরীক্ষায় একজন রসোগেল্লা-পান্তুয়া পেতে বদ্ধপরিকর, অপরজন সেগুলোকে ল্যাংচা-চমচম বানাতে দৃঢ়মনস্ক।অতঃপর নাকেমুখে গুঁজে ট্রামে-বাসে বাদুড়ঝোলা। ট্রেনটা পাইয়ে দাও, হে ঠাকুর। যাঃ দুই নম্বর প্ল্যাটফর্মে দিল- সাড়ে দশটার লঞ্চটা পাইয়ে দাও ঠাকুর। ও রিক্সাওয়ালা থোড়া অউর জোর সে টানো বাপ-। রিক্সাদাদার মুখে ভুরভুরে দেশী ইয়ের সৌরভ- রাস্তা পেরোতে গিয়ে এই বুঝি মারল বাসে ধাক্কা-।
সরকারী দপ্তর, তাও আবার লেবার, পিলপিল করে আসে মানুষ। কারো আছে প্রশ্ন তো কারো অভিযোগ। সেদিন এক মহিলা এসে বেপোট চ্যাঁচালেন, সামাজিক মুক্তি কার্ডে নামের বানান ভুল। বেচারী সঞ্চিতা আর সোমনাথ যত বোঝায়, অ্যাপ্লিকেশন যিনি টাইপ করেছেন, ওটা তাঁর ভুল, চিন্তা নেই সংশোধন করা যাবে। পাল্লা দিয়ে বাড়ে মহিলার গলার স্বর। উনি বাড়ি বসে শায়া ব্লাউজ বানান, ওণার  মেয়ে ফেলেছে অ্যাপ্লিকেশন। মেয়ে “গ্যাজুয়েট”। সে কি ভুল করতে পারে? ভুল আমাদেরই-। 
গত পরশু যেমন, রমেশ আর প্রদীপ আমার সাধের প্রিন্টারটা নিয়ে খোঁচাখুচি করছে, এক অটো ড্রাইভার শুরু করলেন লাফাতে- তাঁর সময়ের দাম নেই? শ্রমদপ্তরে এমন মানুষ আসবে না তো কি শ্যুটেড বুটেড মানুষজন আসবে? তাঁরাও আসেন অবশ্যি মাঝেমধ্যে। অটোচালক বা কাজের মাসিদের সাথে বসেন একই ভিজিটরস্ চেয়ারে। মিলেমিশে একদর হয়ে যায় মুড়ি আর মিছরি-
 এত কিছুর মধ্যেও আজকের দিনটা ছিল সামান্য ব্যতিক্রম। আজ আমরা গণেশ বাবুর টাকাটা দিতে পারলাম। তাহলে একটু খুলেই বলি- চুঁচুড়া কামারপাড়া তালতলা গলির গণেশ মাল পেশায় একজন নির্মাণকর্মী।উনি দীর্ঘদিন ধরে আমাদের তৎকালীন নির্মাণকর্মী কল্যাণ প্রকল্পের এক নথিভুক্ত শ্রমিক। নিয়মিত জমা করে আসছেন ত্রৈমাসিক বা বার্ষিক চাঁদা। 
 ২০১৫ সালে জুলাই মাসে ওণার স্ত্রী শ্রীমতী শান্তি মাল, আচমকা আক্রান্ত হন হৃদরোগে।  দীর্ঘ চিকিৎসার পর বসে পেসমেকার। খরচ হয় অনেক টাকা। ঐ বছরই সেপ্টেম্বর মাসে আবেদন করেন উনি। সাথে জমা করেন ৬১৪০০ টাকার বিল।
দিন আনা দিন খাটা মানুষের পক্ষে রোজ রোজ সরকারী অফিসের চক্কর কাটা অসম্ভব। তবু বেশ কয়েকবার উনি এসেছিলেন, হয়নি। উনিও আর আসেননি খবর নিতে।
ইতিমধ্যে বদলে যায় তৎকালীন সমস্ত পদাধিকারী। ঠিকানা বদলায় অফিসও। আঞ্চলিক শ্রম দপ্তর চুঁচুড়া উঠে আসে মিউনিসিপ্যালিটি থেকে জেলা কালেক্টরেটে। নির্মাণকর্মী কল্যাণ প্রকল্প মিশে যায় সামাজিক সুরক্ষা যোজনার সাথে। বদলে যায় নিয়ম- ফর্ম-দস্তাবেজ। হয়তো গণেশ বাবু ভেবেছিলেন পরিসমাপ্তি ঘটেছে সকল আশার, কিন্তু ঐ যে বাদশা খান বলে গেছেন না,“ চলচ্চিত্র এখনও বাকি, বন্ধু-”।
ওণার সুপুত্র তাপস মাল, পেশায় মুদি দোকানের কর্মচারী। তিনি সম্প্রতি নথিভুক্ত  হয়েছেন সামাজিক সুরক্ষা যোজনায়। কি যেন কাজে তিনি এসেছিলেন আমাদের দপ্তরে। নতুন প্রকল্পের সুযোগসুবিধা সম্পর্কে জানতে পেরে দুঃখ করে বলেছিলেন,“কিন্তু আমার মায়ের চিকিৎসার টাকাটা তো পায়নি আমার বাবা। ধার কর্জ করে মায়ের প্রাণ বাঁচানো হয়েছিল। টাকাটা পেলে খুব উপকার হত”।
আমাদের একজন নথিভুক্ত শ্রমিকের বেদনা, হজম হয়নি আমাদের। শুরু হয় তত্ত্বতলাশ।আমাদের সোমনাথ ঘাঁটতে বসল পুরানো দস্তাবেজ।বিস্তর ধুলো ঘেঁটে দেখা গেল , আগের আধিকারিকগণ তৎকালীন নিয়মানুসারে তাকে পাঠিয়েছিল কলকাতায়। ইতিমধ্যে কেটে গেছে প্রায় চার বছর। এতদিন তো পড়ে থাকার কথা নয় কলকাতায়। কবেই পাশ হয়ে গেছে সমসাময়িক অন্যান্য কেস। তবে কি রিজেক্ট হয়েছিল? আমাদের হয়তো জানানো হয়েছিল আমরা খেয়াল করিনি। অথবা হয়তো টাকাও পাঠিয়েছিল, আমরা খেয়াল করিনি। এমন কি হতে পারে? যদি হয়? বর্মণ সাহেবের তত্ত্বাবধানে তোলা হল চার বছরের ব্যাঙ্ক স্টেটমেন্ট- কলকাতায় দৌড়ল হুগলী চুঁচুড়া মিউনিসিপ্যালিটির ইন্সপেক্টর সঞ্চিতা। উৎসাহিত হয়ে দৌড়লেন তাপস বাবুও। যদি পাওয়া যায়-
সহযোগীতার হাত বাড়ায় কলকাতা অফিসও।কিছু ভাবে হয়তো হারিয়ে গিয়েছিল গণেশ বাবুর আবেদন পত্র। দীর্ঘ অন্বেষণের পর তাকে খুঁজে বার করে, অনুমোদন দিল বোর্ড। এতদিন বাদে একসাথে ৬০০০০টাকার অনুদান পেয়ে বেশ খুশি গণেশ বাবু। আর তাপস বাবুর উৎসাহ আর ধরে না, স্বয়ং এসেছিলেন ধন্যবাদ জানাতে। সঙ্গে ধরে এনেছিলেন পিতা গণেশ বাবুকেও- খুশি আমরাও। আমাদের সময়ের নয় বলে দায় এড়ায়নি আমার টিম। আর কেউ না জানুক দলপতি হিসেবে আমি জানি খেটেছে খুব।এই খাটা নিছক বেতনভূক সরকারী কর্মচারীর খাটা নয়, এই খাটা একদল মানুষের আরেকজন মানুষের জন্য- ঐ যে ভূপেন হাজারিকা মশাই বলে গেছেন না,“মানুষ যদি না হয় মানুষ-” ইত্যাদি ইত্যাদি- 

Monday 20 January 2020

অনির ডাইরি ২০শে জানুয়ারী, ২০২০

বসে বসে মেয়ের কথাই ভাবছিলাম। সকালে বলছিলাম, আজ সিটু ডেপুটেশন দিতে আসবে। প্রশ্ন করল, “সিটু কি মা? টু সির উল্টো?” হঠাৎ চমক ভাঙল, “এ দিদি, টাইম ক্যা হুয়া?” প্রশ্নকর্ত্রীর বয়স পঞ্চাশের কোঠায়, কৃশাঙ্গী। চিমসে বললে বোধহয় ভালো হয়। পরণে সবুজ চকটকে শিফন। মাথায় বেশ হৃষ্টপুষ্ট  হাত খোঁপা। কপালে কমলা সিঁদুর আর কাঁচপোকার টিপ। কানে সস্তা ইমিটেশনের দুল। হাতে শাঁখাপলার ওপর মেরুন কাঁচের চুড়ি। পায়ে রবারের চপ্পল।

ঐ যে বাংলায় বাঙালীর সাথে বাংলা ভাষায় কথা বলুন- তাই বাংলাতেই বলতে গিয়ে আবিষ্কার করলাম, ঘড়ি ঘর মে ভুল আয়া। কোণাকুণি উল্টো দিকের লেডিজ সিটে এক জীর্ণা বয়ষ্কা রমণী বসে বসে ঘাড় থেকে উকুন বার করছে আর সিটে পিষে মারছে। বাপরেঃ উড়ে না আসে, মাথা ঢাকতে ঢাকতে বাঙালী সুলভ ঘ্যাম নিয়ে বললাম, “৬টা ১০। ” পরের প্রশ্ন, ভাঙা  বাংলায়, “ ফেরার ট্রেন কখন পাবো দিদি?” জানি না বলাতেও রেহাই নেই। “এই দিদি দেখো না, আমার মেকআপটা ঠিকঠাক আছে?” যত পাগল আমার কপালেই জোটে, তাই মাথা নেড়ে বললাম,“ভালোই তো। ” কমপ্যাক্ট পাউডার যে মেখেছে দিব্যি বোঝা যাচ্ছে। ঐটুকুই।
অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম, বিরাট অপরাধ করে ফেলেছি। মেয়ের প্রজেক্টের রঙীন ছবির প্রিন্ট আনতে ভুলে গেছি। মনে করাতে ফোনও করেছিল, এরপরও ভুলে যাওয়া, ফাঁসির যোগ্য অপরাধ। ভুলিনি, যদিও।  অফিসের একমাত্র রঙীন প্রিন্টারটি দেহ রেখেছে। আমাদের রমেশ আর প্রদীপ এসে বিস্তর খোঁচাখুঁচি করেছে, কালো কালির বোতল অর্ধেক খালি করেছে, তাও তাঁর মুখে বুলি ফোটেনি। দীপঙ্কর বাবু আর অনুতাপ পর্যন্ত ঘোল খেয়ে বাড়ি চলে গেল- এই সব ভাবছি, এমন সময়,“গোয়না পরিনি দিদি। সব সঙ্গে লিয়ে লিয়েছি। ” বলে যে ব্যাগটা দেখালেন, সেটা আমার পাশে অবহেলায় রাখা। বক্তা আমার সামনের সীটে। একগাল হেসে কইলেন, “বিয়ে বাড়ি যাচ্ছি তো। একেলা যাচ্ছি। ভয় লাগে দিদি। ” বললাম, ভয় লাগে তো ব্যাগটা সামলে রাখুন। নৈহাটি স্টেশনে চোর ছ্যাঁচড় কিছু কম নেই। ব্যাগটা কোলে নিয়ে আবার প্রশ্ন,“লাস টিরেন কটায় দিদি? একেলা ফিরব তো। ” বেশ। কোথায় নামবে জেনে অ্যাপ দেখে জানিয়ে দিলাম, “লাস্ টিরেন কটায়। ”
“ আমি কুথাও যাই না দিদি। আদমি খুব অসুস্থ। বহু বচ্ছর কোথাও যাই না। ভালো শাড়ি পরি না। ” বললাম, তাহলে আজ যাচ্ছ কেন? “কি করি, ওরা শুনল না। চাপাচাপি করতে লাগল- হামার একমাত্র ভাতিজা কি না। যাব কিন্তু খাব না। আজ আমার বাবার ব্রত। দ্বাদশ শিউ লিঙ্গের পূজা করি। নিরামিষ খাই। একটু চা পেলে খেতাম। কিন্তু পুইসা নেই-।”
বুঝলাম মাসির চা তেষ্টা পেয়েছে। মুস্কিল হল ট্রেনে এই সময় কোন চা ওয়ালা ওঠে না। অন্তত লেডিজে।
কোণাকুণি বসা উকুনঘাতিকার আতঙ্কে ঐসারির সব সিট খালি। যার অভিঘাত এসে পড়ছে আমাদের দিকে, চারজন বসার পরও কাউকে কোলে নিতে পারলে ভালো হয়। সবাই বলছে, উকুনেবুড়িকে নামিয়ে দাও। দেবে কে? দিতে গেলে যদি গায়ে দুটো ছেড়ে দেয়? বা তেনারা উড়ে আসে?
“ছোলা ওয়ালা উঠলে বলব পাঁচটাকার দাও।ইস্টিশনের ছোলাওয়ালাকে বললাম, ওদিলে না। বলল ১০টাকা দিতেই হোবে।  সকাল থেকে এক প্যাকেট বিস্কিট খেয়ে আছি। খিদে পায়নি যদিও। বাবার দয়ায় ভুখ পিয়াস রোগ বিমারি সব গায়েব-”। মনে পড়ল ব্যাগে একটা আপেল পড়ে আছে, ফেরৎ নিয়ে গেলে শৌভিক নির্ঘাত কান ধরে ওঠবস করাবে। “আমি কিনে আনি আর তুই নষ্ট করিস” অথবা “ হেলদি জিনিস কেন খাবি?” মনে পড়া মাত্র মাসির হাতে চালান করে দিলাম। ফল খাও। ফল তো খেতে পারো।
লাজুক হেসে মাসি বলল,“নাগো অ্যাসিড হয়ে যাবে না? কিছু খেয়ে খেলে হত-। ” ব্যাগে খানিক মুড়িও ছিল। তেল মশলা ছাড়া সাদা মুড়ি। বললাম খাও। তো জবাব পেলাম,“না গো। মুড়ি আমি চায়ের সঙ্গে খাই। ” অপশন শেষ। আবার ডুবে গেলাম নিজের মনের অলস বৃত্তে। মাঝে মাঝে মাসি হাতে হাত ঠেকিয়ে ডাকছে, টুকটাক কথা বলছে। একবার বলল,“ঐ পাঁপড়টা কেনো। তুমি অর্ধেক খাবে। আমি অর্ধেক। ” বললাম, আমি খাব না। তুমি খাও। কিনে দিচ্ছি। হেসে লুটিয়ে পড়ে বলে গেল,““তুমি না খেলে খাব না গো।” হ্যাঁ হ্যাঁ না না করতে করতে পাঁপড়ওয়ালা গায়েব-। ধুৎ মাসি তুমি না হোপলেস। “তুমি চিন্তা কোরো না গো। হামি গিয়ে এক কাপ চা খেয়ে লিব।ভাতিজার বউভাত বলে কথা-। চিকেন মাট্টন কত কি রান্না হবে-”।  মাসি নেমে গেছে কয়েকটা স্টেশন আগেই। না বন্ধ জানলার ফাঁক  গলে ছুটে আসছে হিমেল হাওয়া-। ছুটে চলা ট্রেনের বাইরে নিকষ আঁধার, আঁধারের ওপাড়ে আলোকজ্জ্বল সুখী সুখী ঘরবাড়ি- আবাসন-দোকানপাট- মল।  কেটে যাচ্ছে আরেকটা দিন। প্রতিটা দিনই যেন এক একটা না পড়া গল্প। কত অজস্র চরিত্র। কত আবেগ- বড় ভালোলাগে পড়তে এই বই। হে জীবন সত্যিই বড় রঙীন তুমি।

Monday 16 December 2019

এক যে দেশে-

(c)Anindita Bhattacharya
৭৯৬৯৩৬০২ এর আজ আনন্দের শেষ নেই। আনন্দের ঢেউ গোটা মহল্লা জুড়েই। অবশেষে সেই বহু কাঙ্ক্ষিত ক্ষণ সমাসন্ন, সময় ঠিক মধ্যাহ্ন।  ভেসে এল মাননীয় দেশনেতার জলদগম্ভীর  কণ্ঠস্বর, “প্রিয় মিত্রগণ,অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে জানাচ্ছি, আমাদের বহু শতকের মেহনত ফলপ্রসূ হয়েছে। জম্বুদ্বীপ আজ আবার জগৎসভায় শ্রেষ্ঠাসনে আসীন। দেশ থেকে অবশেষে আমরা নির্মূল করতে পেরেছি, “ধর্ম” নামক বিষাক্ত নেশার গুষ্ঠি। ধর্মনিরপেক্ষ নয়,আজ থেকে আমরা নির্ধর্ম রাষ্ট্র। উল্লাস প্রিয় মিত্রগণ!“। দেশনেতার অমৃত বাণী  থামার সাথে সাথেই গর্জে উঠল দেশ, যার বিস্তার গিরিরাজের কপোল থেকে মহাসিন্ধুরD কিণারা অবধি। “উল্লাস”। নিছক উল্লাসে মেতে উঠল সমগ্র রাষ্ট্র।
ধর্ম নামক অসুখকে নির্মূল করতে অনেক যাতনা সয়েছে জম্বুদ্বীপ। ঝরেছে অনেক রক্ত। ৭৯৬৯৩৬০২ শুনেছে তার মায়ের মুখে,মায়ের প্রপিতামহের প্রপিতামহের সময় নাকি সমগ্র জম্বুদ্বীপে ছড়িয়ে পড়েছিল ভয়াবহ গৃহযুদ্ধ R।নির্বিচারে মারা পড়ছিল ছাপোষা মানুষ।
ধর্মের নেশায় বুঁদ ছিল সমগ্র রাষ্ট্র। তারপর এলেন তিনি।ইতিহাস যাঁকে চেনে ১ হিসেবে। অতি সাধারণ দেখতে ওণাকে, নাতি দীর্ঘ উচ্চতা, পাতলা হয়ে আসা চুলের মাঝে মাঝে চাকাচাকা চকচকে টাক,চোখে গোল ফ্রেমের চশমা, যার একটি ডাঁটি আবার ভাঙা, গৃহযুদ্ধের অভিঘাতে ভেঙেছিল, উনি সারাননি। সুতো দিয়ে বেঁধে পড়তেন। উনিই প্রথম ডাক ছিলেন, পরিত্যাগ করুন ধর্ম নামক বিষাক্ত  নেশা। তখন নাকি ধর্মানুসারে নাম হত মানুষের। উনি ত্যাগ করেন ওণার নামK। নামের বদলে ধারণ করেন সংখ্যা।বংশানুক্রমিক  ধর্মস্থানে খোলেন দাতব্য চিকিৎসালয় আর বিদ্যাচর্চার কেন্দ্র।
২ ওণার প্রথম অনুগামী। তারপর ৩-৪-৫-। নামের বদলে বাড়তে থাকে সংখ্যা। লুপ্ত হতে থাকে দেবস্থান আর ধর্মালয়।  আর আজ? আজ দেশ জোড়া শুধুই সংখ্যা। প্রায় এক শতাব্দীর অধিক পরিত্যক্ত পড়ে আছে সমস্ত উপাসনালয়। জ্বলেনি সাঁঝবাতি। ভেসে আসেনি প্রার্থনার মোহক সুর, যা রক্ত পিপাসু করে তুলত মানুষকে। দেবস্থানগুলির অনেক কটাই বর্তমানে সংগ্রহালয়। এমনই একটি সংগ্রহালয় দেখতে যাবে আজ ৭৯৬৯৩৬০২। মায়ের মুখে শুনেছে প্রায় এক শতাব্দী জুড়ে কয়েক লক্ষ মানুষের রক্ত খেয়েছে এই দেবালয়। গড়েছে এক পক্ষ,ভেঙেছে অপর। আবার তৈরি হয়েছে নতুন পক্ষ, আবার চলেছে ভাঙা-গড়ার খেলা। মাটির নীচে পরতে পরতে লুকিয়ে আছে এমন ভাঙা গড়ার গপ্প। আজ দেখবে ৭৯৬৯৩৬০২। আর ভাববে কতখানি নির্বোধ ছিল ওর পূর্বপুরুষ তথা পূর্বমহিলাগণ।