Monday 20 January 2020

অনির ডাইরি ২০শে জানুয়ারী, ২০২০

বসে বসে মেয়ের কথাই ভাবছিলাম। সকালে বলছিলাম, আজ সিটু ডেপুটেশন দিতে আসবে। প্রশ্ন করল, “সিটু কি মা? টু সির উল্টো?” হঠাৎ চমক ভাঙল, “এ দিদি, টাইম ক্যা হুয়া?” প্রশ্নকর্ত্রীর বয়স পঞ্চাশের কোঠায়, কৃশাঙ্গী। চিমসে বললে বোধহয় ভালো হয়। পরণে সবুজ চকটকে শিফন। মাথায় বেশ হৃষ্টপুষ্ট  হাত খোঁপা। কপালে কমলা সিঁদুর আর কাঁচপোকার টিপ। কানে সস্তা ইমিটেশনের দুল। হাতে শাঁখাপলার ওপর মেরুন কাঁচের চুড়ি। পায়ে রবারের চপ্পল।

ঐ যে বাংলায় বাঙালীর সাথে বাংলা ভাষায় কথা বলুন- তাই বাংলাতেই বলতে গিয়ে আবিষ্কার করলাম, ঘড়ি ঘর মে ভুল আয়া। কোণাকুণি উল্টো দিকের লেডিজ সিটে এক জীর্ণা বয়ষ্কা রমণী বসে বসে ঘাড় থেকে উকুন বার করছে আর সিটে পিষে মারছে। বাপরেঃ উড়ে না আসে, মাথা ঢাকতে ঢাকতে বাঙালী সুলভ ঘ্যাম নিয়ে বললাম, “৬টা ১০। ” পরের প্রশ্ন, ভাঙা  বাংলায়, “ ফেরার ট্রেন কখন পাবো দিদি?” জানি না বলাতেও রেহাই নেই। “এই দিদি দেখো না, আমার মেকআপটা ঠিকঠাক আছে?” যত পাগল আমার কপালেই জোটে, তাই মাথা নেড়ে বললাম,“ভালোই তো। ” কমপ্যাক্ট পাউডার যে মেখেছে দিব্যি বোঝা যাচ্ছে। ঐটুকুই।
অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম, বিরাট অপরাধ করে ফেলেছি। মেয়ের প্রজেক্টের রঙীন ছবির প্রিন্ট আনতে ভুলে গেছি। মনে করাতে ফোনও করেছিল, এরপরও ভুলে যাওয়া, ফাঁসির যোগ্য অপরাধ। ভুলিনি, যদিও।  অফিসের একমাত্র রঙীন প্রিন্টারটি দেহ রেখেছে। আমাদের রমেশ আর প্রদীপ এসে বিস্তর খোঁচাখুঁচি করেছে, কালো কালির বোতল অর্ধেক খালি করেছে, তাও তাঁর মুখে বুলি ফোটেনি। দীপঙ্কর বাবু আর অনুতাপ পর্যন্ত ঘোল খেয়ে বাড়ি চলে গেল- এই সব ভাবছি, এমন সময়,“গোয়না পরিনি দিদি। সব সঙ্গে লিয়ে লিয়েছি। ” বলে যে ব্যাগটা দেখালেন, সেটা আমার পাশে অবহেলায় রাখা। বক্তা আমার সামনের সীটে। একগাল হেসে কইলেন, “বিয়ে বাড়ি যাচ্ছি তো। একেলা যাচ্ছি। ভয় লাগে দিদি। ” বললাম, ভয় লাগে তো ব্যাগটা সামলে রাখুন। নৈহাটি স্টেশনে চোর ছ্যাঁচড় কিছু কম নেই। ব্যাগটা কোলে নিয়ে আবার প্রশ্ন,“লাস টিরেন কটায় দিদি? একেলা ফিরব তো। ” বেশ। কোথায় নামবে জেনে অ্যাপ দেখে জানিয়ে দিলাম, “লাস্ টিরেন কটায়। ”
“ আমি কুথাও যাই না দিদি। আদমি খুব অসুস্থ। বহু বচ্ছর কোথাও যাই না। ভালো শাড়ি পরি না। ” বললাম, তাহলে আজ যাচ্ছ কেন? “কি করি, ওরা শুনল না। চাপাচাপি করতে লাগল- হামার একমাত্র ভাতিজা কি না। যাব কিন্তু খাব না। আজ আমার বাবার ব্রত। দ্বাদশ শিউ লিঙ্গের পূজা করি। নিরামিষ খাই। একটু চা পেলে খেতাম। কিন্তু পুইসা নেই-।”
বুঝলাম মাসির চা তেষ্টা পেয়েছে। মুস্কিল হল ট্রেনে এই সময় কোন চা ওয়ালা ওঠে না। অন্তত লেডিজে।
কোণাকুণি বসা উকুনঘাতিকার আতঙ্কে ঐসারির সব সিট খালি। যার অভিঘাত এসে পড়ছে আমাদের দিকে, চারজন বসার পরও কাউকে কোলে নিতে পারলে ভালো হয়। সবাই বলছে, উকুনেবুড়িকে নামিয়ে দাও। দেবে কে? দিতে গেলে যদি গায়ে দুটো ছেড়ে দেয়? বা তেনারা উড়ে আসে?
“ছোলা ওয়ালা উঠলে বলব পাঁচটাকার দাও।ইস্টিশনের ছোলাওয়ালাকে বললাম, ওদিলে না। বলল ১০টাকা দিতেই হোবে।  সকাল থেকে এক প্যাকেট বিস্কিট খেয়ে আছি। খিদে পায়নি যদিও। বাবার দয়ায় ভুখ পিয়াস রোগ বিমারি সব গায়েব-”। মনে পড়ল ব্যাগে একটা আপেল পড়ে আছে, ফেরৎ নিয়ে গেলে শৌভিক নির্ঘাত কান ধরে ওঠবস করাবে। “আমি কিনে আনি আর তুই নষ্ট করিস” অথবা “ হেলদি জিনিস কেন খাবি?” মনে পড়া মাত্র মাসির হাতে চালান করে দিলাম। ফল খাও। ফল তো খেতে পারো।
লাজুক হেসে মাসি বলল,“নাগো অ্যাসিড হয়ে যাবে না? কিছু খেয়ে খেলে হত-। ” ব্যাগে খানিক মুড়িও ছিল। তেল মশলা ছাড়া সাদা মুড়ি। বললাম খাও। তো জবাব পেলাম,“না গো। মুড়ি আমি চায়ের সঙ্গে খাই। ” অপশন শেষ। আবার ডুবে গেলাম নিজের মনের অলস বৃত্তে। মাঝে মাঝে মাসি হাতে হাত ঠেকিয়ে ডাকছে, টুকটাক কথা বলছে। একবার বলল,“ঐ পাঁপড়টা কেনো। তুমি অর্ধেক খাবে। আমি অর্ধেক। ” বললাম, আমি খাব না। তুমি খাও। কিনে দিচ্ছি। হেসে লুটিয়ে পড়ে বলে গেল,““তুমি না খেলে খাব না গো।” হ্যাঁ হ্যাঁ না না করতে করতে পাঁপড়ওয়ালা গায়েব-। ধুৎ মাসি তুমি না হোপলেস। “তুমি চিন্তা কোরো না গো। হামি গিয়ে এক কাপ চা খেয়ে লিব।ভাতিজার বউভাত বলে কথা-। চিকেন মাট্টন কত কি রান্না হবে-”।  মাসি নেমে গেছে কয়েকটা স্টেশন আগেই। না বন্ধ জানলার ফাঁক  গলে ছুটে আসছে হিমেল হাওয়া-। ছুটে চলা ট্রেনের বাইরে নিকষ আঁধার, আঁধারের ওপাড়ে আলোকজ্জ্বল সুখী সুখী ঘরবাড়ি- আবাসন-দোকানপাট- মল।  কেটে যাচ্ছে আরেকটা দিন। প্রতিটা দিনই যেন এক একটা না পড়া গল্প। কত অজস্র চরিত্র। কত আবেগ- বড় ভালোলাগে পড়তে এই বই। হে জীবন সত্যিই বড় রঙীন তুমি।

No comments:

Post a Comment