কুয়াশা ঘেরা আলসে শীতের ভোরে ঘুম ভাঙলে প্রথমেই যেটা মনে হয় , “জীবন জঞ্জাল হয়ে গেল মাইরি-”। মসৃণ কম্বলের মায়ামাখা ওম ফেলে নিজেকে তোলা, তারপর তুত্তুরীর সঙ্গে শুম্ভ-নিশুম্ভের যুদ্ধ।বার্ষিক পরীক্ষায় একজন রসোগেল্লা-পান্তুয়া পেতে বদ্ধপরিকর, অপরজন সেগুলোকে ল্যাংচা-চমচম বানাতে দৃঢ়মনস্ক।অতঃপর নাকেমুখে গুঁজে ট্রামে-বাসে বাদুড়ঝোলা। ট্রেনটা পাইয়ে দাও, হে ঠাকুর। যাঃ দুই নম্বর প্ল্যাটফর্মে দিল- সাড়ে দশটার লঞ্চটা পাইয়ে দাও ঠাকুর। ও রিক্সাওয়ালা থোড়া অউর জোর সে টানো বাপ-। রিক্সাদাদার মুখে ভুরভুরে দেশী ইয়ের সৌরভ- রাস্তা পেরোতে গিয়ে এই বুঝি মারল বাসে ধাক্কা-।
সরকারী দপ্তর, তাও আবার লেবার, পিলপিল করে আসে মানুষ। কারো আছে প্রশ্ন তো কারো অভিযোগ। সেদিন এক মহিলা এসে বেপোট চ্যাঁচালেন, সামাজিক মুক্তি কার্ডে নামের বানান ভুল। বেচারী সঞ্চিতা আর সোমনাথ যত বোঝায়, অ্যাপ্লিকেশন যিনি টাইপ করেছেন, ওটা তাঁর ভুল, চিন্তা নেই সংশোধন করা যাবে। পাল্লা দিয়ে বাড়ে মহিলার গলার স্বর। উনি বাড়ি বসে শায়া ব্লাউজ বানান, ওণার মেয়ে ফেলেছে অ্যাপ্লিকেশন। মেয়ে “গ্যাজুয়েট”। সে কি ভুল করতে পারে? ভুল আমাদেরই-।
গত পরশু যেমন, রমেশ আর প্রদীপ আমার সাধের প্রিন্টারটা নিয়ে খোঁচাখুচি করছে, এক অটো ড্রাইভার শুরু করলেন লাফাতে- তাঁর সময়ের দাম নেই? শ্রমদপ্তরে এমন মানুষ আসবে না তো কি শ্যুটেড বুটেড মানুষজন আসবে? তাঁরাও আসেন অবশ্যি মাঝেমধ্যে। অটোচালক বা কাজের মাসিদের সাথে বসেন একই ভিজিটরস্ চেয়ারে। মিলেমিশে একদর হয়ে যায় মুড়ি আর মিছরি-
এত কিছুর মধ্যেও আজকের দিনটা ছিল সামান্য ব্যতিক্রম। আজ আমরা গণেশ বাবুর টাকাটা দিতে পারলাম। তাহলে একটু খুলেই বলি- চুঁচুড়া কামারপাড়া তালতলা গলির গণেশ মাল পেশায় একজন নির্মাণকর্মী।উনি দীর্ঘদিন ধরে আমাদের তৎকালীন নির্মাণকর্মী কল্যাণ প্রকল্পের এক নথিভুক্ত শ্রমিক। নিয়মিত জমা করে আসছেন ত্রৈমাসিক বা বার্ষিক চাঁদা।
২০১৫ সালে জুলাই মাসে ওণার স্ত্রী শ্রীমতী শান্তি মাল, আচমকা আক্রান্ত হন হৃদরোগে। দীর্ঘ চিকিৎসার পর বসে পেসমেকার। খরচ হয় অনেক টাকা। ঐ বছরই সেপ্টেম্বর মাসে আবেদন করেন উনি। সাথে জমা করেন ৬১৪০০ টাকার বিল।
দিন আনা দিন খাটা মানুষের পক্ষে রোজ রোজ সরকারী অফিসের চক্কর কাটা অসম্ভব। তবু বেশ কয়েকবার উনি এসেছিলেন, হয়নি। উনিও আর আসেননি খবর নিতে।
ইতিমধ্যে বদলে যায় তৎকালীন সমস্ত পদাধিকারী। ঠিকানা বদলায় অফিসও। আঞ্চলিক শ্রম দপ্তর চুঁচুড়া উঠে আসে মিউনিসিপ্যালিটি থেকে জেলা কালেক্টরেটে। নির্মাণকর্মী কল্যাণ প্রকল্প মিশে যায় সামাজিক সুরক্ষা যোজনার সাথে। বদলে যায় নিয়ম- ফর্ম-দস্তাবেজ। হয়তো গণেশ বাবু ভেবেছিলেন পরিসমাপ্তি ঘটেছে সকল আশার, কিন্তু ঐ যে বাদশা খান বলে গেছেন না,“ চলচ্চিত্র এখনও বাকি, বন্ধু-”।
ওণার সুপুত্র তাপস মাল, পেশায় মুদি দোকানের কর্মচারী। তিনি সম্প্রতি নথিভুক্ত হয়েছেন সামাজিক সুরক্ষা যোজনায়। কি যেন কাজে তিনি এসেছিলেন আমাদের দপ্তরে। নতুন প্রকল্পের সুযোগসুবিধা সম্পর্কে জানতে পেরে দুঃখ করে বলেছিলেন,“কিন্তু আমার মায়ের চিকিৎসার টাকাটা তো পায়নি আমার বাবা। ধার কর্জ করে মায়ের প্রাণ বাঁচানো হয়েছিল। টাকাটা পেলে খুব উপকার হত”।
আমাদের একজন নথিভুক্ত শ্রমিকের বেদনা, হজম হয়নি আমাদের। শুরু হয় তত্ত্বতলাশ।আমাদের সোমনাথ ঘাঁটতে বসল পুরানো দস্তাবেজ।বিস্তর ধুলো ঘেঁটে দেখা গেল , আগের আধিকারিকগণ তৎকালীন নিয়মানুসারে তাকে পাঠিয়েছিল কলকাতায়। ইতিমধ্যে কেটে গেছে প্রায় চার বছর। এতদিন তো পড়ে থাকার কথা নয় কলকাতায়। কবেই পাশ হয়ে গেছে সমসাময়িক অন্যান্য কেস। তবে কি রিজেক্ট হয়েছিল? আমাদের হয়তো জানানো হয়েছিল আমরা খেয়াল করিনি। অথবা হয়তো টাকাও পাঠিয়েছিল, আমরা খেয়াল করিনি। এমন কি হতে পারে? যদি হয়? বর্মণ সাহেবের তত্ত্বাবধানে তোলা হল চার বছরের ব্যাঙ্ক স্টেটমেন্ট- কলকাতায় দৌড়ল হুগলী চুঁচুড়া মিউনিসিপ্যালিটির ইন্সপেক্টর সঞ্চিতা। উৎসাহিত হয়ে দৌড়লেন তাপস বাবুও। যদি পাওয়া যায়-
সহযোগীতার হাত বাড়ায় কলকাতা অফিসও।কিছু ভাবে হয়তো হারিয়ে গিয়েছিল গণেশ বাবুর আবেদন পত্র। দীর্ঘ অন্বেষণের পর তাকে খুঁজে বার করে, অনুমোদন দিল বোর্ড। এতদিন বাদে একসাথে ৬০০০০টাকার অনুদান পেয়ে বেশ খুশি গণেশ বাবু। আর তাপস বাবুর উৎসাহ আর ধরে না, স্বয়ং এসেছিলেন ধন্যবাদ জানাতে। সঙ্গে ধরে এনেছিলেন পিতা গণেশ বাবুকেও- খুশি আমরাও। আমাদের সময়ের নয় বলে দায় এড়ায়নি আমার টিম। আর কেউ না জানুক দলপতি হিসেবে আমি জানি খেটেছে খুব।এই খাটা নিছক বেতনভূক সরকারী কর্মচারীর খাটা নয়, এই খাটা একদল মানুষের আরেকজন মানুষের জন্য- ঐ যে ভূপেন হাজারিকা মশাই বলে গেছেন না,“মানুষ যদি না হয় মানুষ-” ইত্যাদি ইত্যাদি-
No comments:
Post a Comment