Monday 20 January 2020

অনির ডাইরি ২০শে জানুয়ারী, ২০২০

বসে বসে মেয়ের কথাই ভাবছিলাম। সকালে বলছিলাম, আজ সিটু ডেপুটেশন দিতে আসবে। প্রশ্ন করল, “সিটু কি মা? টু সির উল্টো?” হঠাৎ চমক ভাঙল, “এ দিদি, টাইম ক্যা হুয়া?” প্রশ্নকর্ত্রীর বয়স পঞ্চাশের কোঠায়, কৃশাঙ্গী। চিমসে বললে বোধহয় ভালো হয়। পরণে সবুজ চকটকে শিফন। মাথায় বেশ হৃষ্টপুষ্ট  হাত খোঁপা। কপালে কমলা সিঁদুর আর কাঁচপোকার টিপ। কানে সস্তা ইমিটেশনের দুল। হাতে শাঁখাপলার ওপর মেরুন কাঁচের চুড়ি। পায়ে রবারের চপ্পল।

ঐ যে বাংলায় বাঙালীর সাথে বাংলা ভাষায় কথা বলুন- তাই বাংলাতেই বলতে গিয়ে আবিষ্কার করলাম, ঘড়ি ঘর মে ভুল আয়া। কোণাকুণি উল্টো দিকের লেডিজ সিটে এক জীর্ণা বয়ষ্কা রমণী বসে বসে ঘাড় থেকে উকুন বার করছে আর সিটে পিষে মারছে। বাপরেঃ উড়ে না আসে, মাথা ঢাকতে ঢাকতে বাঙালী সুলভ ঘ্যাম নিয়ে বললাম, “৬টা ১০। ” পরের প্রশ্ন, ভাঙা  বাংলায়, “ ফেরার ট্রেন কখন পাবো দিদি?” জানি না বলাতেও রেহাই নেই। “এই দিদি দেখো না, আমার মেকআপটা ঠিকঠাক আছে?” যত পাগল আমার কপালেই জোটে, তাই মাথা নেড়ে বললাম,“ভালোই তো। ” কমপ্যাক্ট পাউডার যে মেখেছে দিব্যি বোঝা যাচ্ছে। ঐটুকুই।
অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম, বিরাট অপরাধ করে ফেলেছি। মেয়ের প্রজেক্টের রঙীন ছবির প্রিন্ট আনতে ভুলে গেছি। মনে করাতে ফোনও করেছিল, এরপরও ভুলে যাওয়া, ফাঁসির যোগ্য অপরাধ। ভুলিনি, যদিও।  অফিসের একমাত্র রঙীন প্রিন্টারটি দেহ রেখেছে। আমাদের রমেশ আর প্রদীপ এসে বিস্তর খোঁচাখুঁচি করেছে, কালো কালির বোতল অর্ধেক খালি করেছে, তাও তাঁর মুখে বুলি ফোটেনি। দীপঙ্কর বাবু আর অনুতাপ পর্যন্ত ঘোল খেয়ে বাড়ি চলে গেল- এই সব ভাবছি, এমন সময়,“গোয়না পরিনি দিদি। সব সঙ্গে লিয়ে লিয়েছি। ” বলে যে ব্যাগটা দেখালেন, সেটা আমার পাশে অবহেলায় রাখা। বক্তা আমার সামনের সীটে। একগাল হেসে কইলেন, “বিয়ে বাড়ি যাচ্ছি তো। একেলা যাচ্ছি। ভয় লাগে দিদি। ” বললাম, ভয় লাগে তো ব্যাগটা সামলে রাখুন। নৈহাটি স্টেশনে চোর ছ্যাঁচড় কিছু কম নেই। ব্যাগটা কোলে নিয়ে আবার প্রশ্ন,“লাস টিরেন কটায় দিদি? একেলা ফিরব তো। ” বেশ। কোথায় নামবে জেনে অ্যাপ দেখে জানিয়ে দিলাম, “লাস্ টিরেন কটায়। ”
“ আমি কুথাও যাই না দিদি। আদমি খুব অসুস্থ। বহু বচ্ছর কোথাও যাই না। ভালো শাড়ি পরি না। ” বললাম, তাহলে আজ যাচ্ছ কেন? “কি করি, ওরা শুনল না। চাপাচাপি করতে লাগল- হামার একমাত্র ভাতিজা কি না। যাব কিন্তু খাব না। আজ আমার বাবার ব্রত। দ্বাদশ শিউ লিঙ্গের পূজা করি। নিরামিষ খাই। একটু চা পেলে খেতাম। কিন্তু পুইসা নেই-।”
বুঝলাম মাসির চা তেষ্টা পেয়েছে। মুস্কিল হল ট্রেনে এই সময় কোন চা ওয়ালা ওঠে না। অন্তত লেডিজে।
কোণাকুণি বসা উকুনঘাতিকার আতঙ্কে ঐসারির সব সিট খালি। যার অভিঘাত এসে পড়ছে আমাদের দিকে, চারজন বসার পরও কাউকে কোলে নিতে পারলে ভালো হয়। সবাই বলছে, উকুনেবুড়িকে নামিয়ে দাও। দেবে কে? দিতে গেলে যদি গায়ে দুটো ছেড়ে দেয়? বা তেনারা উড়ে আসে?
“ছোলা ওয়ালা উঠলে বলব পাঁচটাকার দাও।ইস্টিশনের ছোলাওয়ালাকে বললাম, ওদিলে না। বলল ১০টাকা দিতেই হোবে।  সকাল থেকে এক প্যাকেট বিস্কিট খেয়ে আছি। খিদে পায়নি যদিও। বাবার দয়ায় ভুখ পিয়াস রোগ বিমারি সব গায়েব-”। মনে পড়ল ব্যাগে একটা আপেল পড়ে আছে, ফেরৎ নিয়ে গেলে শৌভিক নির্ঘাত কান ধরে ওঠবস করাবে। “আমি কিনে আনি আর তুই নষ্ট করিস” অথবা “ হেলদি জিনিস কেন খাবি?” মনে পড়া মাত্র মাসির হাতে চালান করে দিলাম। ফল খাও। ফল তো খেতে পারো।
লাজুক হেসে মাসি বলল,“নাগো অ্যাসিড হয়ে যাবে না? কিছু খেয়ে খেলে হত-। ” ব্যাগে খানিক মুড়িও ছিল। তেল মশলা ছাড়া সাদা মুড়ি। বললাম খাও। তো জবাব পেলাম,“না গো। মুড়ি আমি চায়ের সঙ্গে খাই। ” অপশন শেষ। আবার ডুবে গেলাম নিজের মনের অলস বৃত্তে। মাঝে মাঝে মাসি হাতে হাত ঠেকিয়ে ডাকছে, টুকটাক কথা বলছে। একবার বলল,“ঐ পাঁপড়টা কেনো। তুমি অর্ধেক খাবে। আমি অর্ধেক। ” বললাম, আমি খাব না। তুমি খাও। কিনে দিচ্ছি। হেসে লুটিয়ে পড়ে বলে গেল,““তুমি না খেলে খাব না গো।” হ্যাঁ হ্যাঁ না না করতে করতে পাঁপড়ওয়ালা গায়েব-। ধুৎ মাসি তুমি না হোপলেস। “তুমি চিন্তা কোরো না গো। হামি গিয়ে এক কাপ চা খেয়ে লিব।ভাতিজার বউভাত বলে কথা-। চিকেন মাট্টন কত কি রান্না হবে-”।  মাসি নেমে গেছে কয়েকটা স্টেশন আগেই। না বন্ধ জানলার ফাঁক  গলে ছুটে আসছে হিমেল হাওয়া-। ছুটে চলা ট্রেনের বাইরে নিকষ আঁধার, আঁধারের ওপাড়ে আলোকজ্জ্বল সুখী সুখী ঘরবাড়ি- আবাসন-দোকানপাট- মল।  কেটে যাচ্ছে আরেকটা দিন। প্রতিটা দিনই যেন এক একটা না পড়া গল্প। কত অজস্র চরিত্র। কত আবেগ- বড় ভালোলাগে পড়তে এই বই। হে জীবন সত্যিই বড় রঙীন তুমি।

Monday 16 December 2019

এক যে দেশে-

(c)Anindita Bhattacharya
৭৯৬৯৩৬০২ এর আজ আনন্দের শেষ নেই। আনন্দের ঢেউ গোটা মহল্লা জুড়েই। অবশেষে সেই বহু কাঙ্ক্ষিত ক্ষণ সমাসন্ন, সময় ঠিক মধ্যাহ্ন।  ভেসে এল মাননীয় দেশনেতার জলদগম্ভীর  কণ্ঠস্বর, “প্রিয় মিত্রগণ,অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে জানাচ্ছি, আমাদের বহু শতকের মেহনত ফলপ্রসূ হয়েছে। জম্বুদ্বীপ আজ আবার জগৎসভায় শ্রেষ্ঠাসনে আসীন। দেশ থেকে অবশেষে আমরা নির্মূল করতে পেরেছি, “ধর্ম” নামক বিষাক্ত নেশার গুষ্ঠি। ধর্মনিরপেক্ষ নয়,আজ থেকে আমরা নির্ধর্ম রাষ্ট্র। উল্লাস প্রিয় মিত্রগণ!“। দেশনেতার অমৃত বাণী  থামার সাথে সাথেই গর্জে উঠল দেশ, যার বিস্তার গিরিরাজের কপোল থেকে মহাসিন্ধুরD কিণারা অবধি। “উল্লাস”। নিছক উল্লাসে মেতে উঠল সমগ্র রাষ্ট্র।
ধর্ম নামক অসুখকে নির্মূল করতে অনেক যাতনা সয়েছে জম্বুদ্বীপ। ঝরেছে অনেক রক্ত। ৭৯৬৯৩৬০২ শুনেছে তার মায়ের মুখে,মায়ের প্রপিতামহের প্রপিতামহের সময় নাকি সমগ্র জম্বুদ্বীপে ছড়িয়ে পড়েছিল ভয়াবহ গৃহযুদ্ধ R।নির্বিচারে মারা পড়ছিল ছাপোষা মানুষ।
ধর্মের নেশায় বুঁদ ছিল সমগ্র রাষ্ট্র। তারপর এলেন তিনি।ইতিহাস যাঁকে চেনে ১ হিসেবে। অতি সাধারণ দেখতে ওণাকে, নাতি দীর্ঘ উচ্চতা, পাতলা হয়ে আসা চুলের মাঝে মাঝে চাকাচাকা চকচকে টাক,চোখে গোল ফ্রেমের চশমা, যার একটি ডাঁটি আবার ভাঙা, গৃহযুদ্ধের অভিঘাতে ভেঙেছিল, উনি সারাননি। সুতো দিয়ে বেঁধে পড়তেন। উনিই প্রথম ডাক ছিলেন, পরিত্যাগ করুন ধর্ম নামক বিষাক্ত  নেশা। তখন নাকি ধর্মানুসারে নাম হত মানুষের। উনি ত্যাগ করেন ওণার নামK। নামের বদলে ধারণ করেন সংখ্যা।বংশানুক্রমিক  ধর্মস্থানে খোলেন দাতব্য চিকিৎসালয় আর বিদ্যাচর্চার কেন্দ্র।
২ ওণার প্রথম অনুগামী। তারপর ৩-৪-৫-। নামের বদলে বাড়তে থাকে সংখ্যা। লুপ্ত হতে থাকে দেবস্থান আর ধর্মালয়।  আর আজ? আজ দেশ জোড়া শুধুই সংখ্যা। প্রায় এক শতাব্দীর অধিক পরিত্যক্ত পড়ে আছে সমস্ত উপাসনালয়। জ্বলেনি সাঁঝবাতি। ভেসে আসেনি প্রার্থনার মোহক সুর, যা রক্ত পিপাসু করে তুলত মানুষকে। দেবস্থানগুলির অনেক কটাই বর্তমানে সংগ্রহালয়। এমনই একটি সংগ্রহালয় দেখতে যাবে আজ ৭৯৬৯৩৬০২। মায়ের মুখে শুনেছে প্রায় এক শতাব্দী জুড়ে কয়েক লক্ষ মানুষের রক্ত খেয়েছে এই দেবালয়। গড়েছে এক পক্ষ,ভেঙেছে অপর। আবার তৈরি হয়েছে নতুন পক্ষ, আবার চলেছে ভাঙা-গড়ার খেলা। মাটির নীচে পরতে পরতে লুকিয়ে আছে এমন ভাঙা গড়ার গপ্প। আজ দেখবে ৭৯৬৯৩৬০২। আর ভাববে কতখানি নির্বোধ ছিল ওর পূর্বপুরুষ তথা পূর্বমহিলাগণ।

Saturday 14 December 2019

মধ্যমেধার মধ্যবিত্তের রোজনামচা-১৪ই ডিসেম্বর,২০১৯

আমার তেত্রিশ কোটি দেবতার মধ্যে, মহঃ রফি একজন। আজ্ঞে হ্যাঁঁ, “আভি না যাও ছোড়কর, কে দিল আভি ভরা নেহি-”। এই পেলব অমৃতস্বরূপ স্বর স্বয়ং ঈশ্বর ছাড়া আর কার হতে পারে বলুন দিকি? কিশোরের সাথে খুনসুটি চলতে পারে, জমতে পারে হাল্কা ফুল্কা প্রেমও। মুকেশজীর সাথে গভীর সম্পৃক্ত প্রেম। কিন্তু রফি সাব? উনি এই তুচ্ছ সাধারণ মেয়েটার ধরা ছোঁয়ার বাইরে। যাঁর পদতলে করজোড়ে বসে মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে থাকতে মন চায়। যাঁর আত্মভোলা হাসিতে নত হয়ে যায় মম গর্বিত শির।
পকেটহীন হলুদ পাঞ্জাবি পরা, খালিপা এক বাংলাদেশী যুবার হাত ধরে, নীল শাড়ি পরে মিশে যেতে চাই জনসমুদ্রে। কদমফুল যাঁর ভীষণ প্রিয়। হস্তচুম্বন করতে চাই তাঁর স্রষ্টার। শরদ্বিন্দু বন্দোপাধ্যায়ের পর এত গভীর ভাবে কোন লেখকের অনুরাগিনী হইনি। আর সেই হেঁপো বুড়ো মিশির আলি, কি যে বলি তাঁকে নিয়ে? ভাগ করে নিয়েছি প্রিয় বান্ধবীদের সাথে। সবকটা তাঁর প্রেমে দিওয়ানা-
আর সেই সদ্য বিপত্নীক বৃদ্ধ, অবসর নেবার দিন যিনি বলেছিলেন, “ও আমার আরেকটা মেয়ে-”। আমার দুই বাপ ছাড়া এত ভালো আমায় কে বেসেছে? তিনিও তো ধর্মে মুসলমান। রোজা রাখতেন না বলে কত পিছনে লেগেছি, “আপনি ভুলভাল মুসলমান নজরুল সাহেব-”।  কান ধরে কবিতা পড়াতেন যিনি। কবিতার প্রতি যতটা ভালোবাসা,সবটুকুই তাঁর থেকে পাওয়া। আজও তাঁর তিরিশ সেকেণ্ডের হড়বড়ে ফোনে আদ্র হয়ে ওঠে উত্তেজিত শুষ্ক মন আর মাথা।

  সংবিধানের প্রস্তাবনা তো সেদিনের শিশু। ধর্মনিরপেক্ষতা আমার রক্তে। ক্রোমোজোমে। প্রপিতামহ ছিলেন চার্বাকপন্থী। ঋণং কৃত্বা ঘৃতং পিবেৎ।  লুকিয়ে অস্ত্র আনতে কালাপানি পেরিয়ে একঘরে হয়েছিলেন ঠাকুরদা। ইয়ে আজাদী ঝুটা হ্যায় বলেছিলেন ছোটদাদু। জেলখাটা নকশাল আমার বাবা। উদারমনা শ্বশুর-শাশুড়ী। ঘোরতর আস্তিক বটে,তবে আমার মতই উদার আমার ঠাকুর। এক স্যালুটেই খুশি। অতি ভক্তিতে কুঁচকে যায় তাঁর/তাঁদের ভ্রু।
বিশ্বাস করুন, এসব কথা আপনাদের শোনাচ্ছি না। শোনাচ্ছি নিজেকে। এহেন আমারও আজন্মলালিত সংস্কার, বিশ্বাস তথা মূল্যবোধের গোড়া নড়ে গেছে কালকে তথা আজকের নোংরামিতে। “নোংরামি”। আজ্ঞে হ্যাঁ, কান্নিককে(Spade) কান্নিক বলাই শ্রেয়। এটা প্রতিবাদ বা পোতিবাদ নয়, এটা সহজ সরল নোংরামি। সুদূর মুর্শিদাবাদ থেকে কানের কাছের উলুবেড়িয়া অবধি কেঁপে উঠল যে নোংরামিতে, তাজ্জব ব্যাপার আমাদের গোয়েন্দা সংস্থা গুলো ঘুণাক্ষরেও টের পেল না এতখানি সংঘবদ্ধ  প্রতিরোধের? আর আমাদের মূখ্য সংবাদপত্র কি লিখছেন, “- আইনের প্রতিবাদে সরব বাংলা”!  মাইরি সত্যি? শুধু সরব? তাহলে অরাজকতা তথা গুণ্ডামির সংজ্ঞাটা অনুগ্রহ করে জানাবেন দাদা/দিদি?
বাতানুকূল ঘরে, অনাগত শীতের অপেক্ষায় ওম্ পোহাতে পোহাতে ওমন কথা লেখা যায় বৈকি।ফেবুতে তপ্ত কুড়মুড়ে স্টেটাস্ লেখা যায়,“বেশ করেছে ভাঙচুর করেছে---। ওদের অস্তিত্ব বিপন্ন। এখন কি ভেবে ভেবে ডেমোক্রেটিক পথে ঝামেলা করবে---”।
আর আমার যে বন্ধু কাল সকালে চেন্নাই মেল ধরবে? সুস্থ ভাবে বাড়ি পৌঁছবে তো সে? বা যে লক্ষ্মীমন্ত বান্ধবীটির বর চাকরী করেন অশান্ত এলাকারই একটি স্কুলে? বিগত দাঙ্গায় বাইক ফেলে হামাগুড়ি দিয়ে ধানখেতের মধ্যে দিয়ে পালিয়ে এসেছিলেন, তাও টলেনি যাঁর ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতি আস্থা। আগামী পরশু থেকে নিয়মিত দপ্তরে যেতে পারবেন তো তিনি? ভগ্নীসমা যে আধিকারিককে কাল রাতে ধমকাচ্ছিলাম, “গুলি মারো বড় সাহেবকে।স্টেশন লিভের নিকুচি করেছে, আগে বাড়ি ফেরো-”, স্বাভাবিক ভাবে কোয়ার্টারে ফিরতে পারবে তো সে? আর ঐ আধিকারিকের স্ত্রী আর কন্যা, আজ থেকে বছর নয় দশ আগে ঐ জায়গাতে তো আমিই ছিলাম-।
নড়ে গেছে যাবতীয় বিশ্বাস আর সংহতির ভিত। ভুলে গেছি পিঁয়াজের দাম বা না পাওয়া ডিএর বেদনা। পড়েও দেখিনি বিহারে নিগৃহিত তথা নিহত বছর দশেকের শিশু কন্যার খবর, শুধু ঘিরে ধরেছে অপরিসীম আতঙ্ক।

Wednesday 11 December 2019

অনির ডাইরি ১০ডিসেম্বর ২০১৯


গতকাল মাসির জন্মদিন ছিল। মাসির আবার জন্মদিন। ভূতের আবার জন্মবার। আর পাঁচজন মাসির জীবনচরিতের মতই তুত্তুরীর মাসিরও জীবন পাক খেয়েছে একই পাকদণ্ডী বরাবর, যার গতিমুখ  বড়ই উচ্চাবচ।
শৈশবে উদ্দাম মজা, ঝপাং করে ঝাঁপিয়ে পড়ে ডুব সাঁতারে জোড়া পুকুর এপাড়ওপাড়। মশারি দিয়ে বর্ষাকালে চুনো মাছ ধরা। জোড়া বিনুনী দুলিয়ে ইস্কুল যাওয়া। পথেই আলাপ তাঁর সাথে, যাঁকে কোন এককালে তুত্তুরী ডাকত মেসো। তারপর আর কি? গন্ধর্ব থুড়ি পালিয়ে গিয়ে বিয়ে। মাসির তখন সপ্তম শ্রেণী, মাসির সদ্য শাড়ি।
তারপর বড়দিদি,বড়দাদা এবং ছোটদিদি।সংসারের হামানদিস্তার বাড়ি খেয়ে ভালোবাসা পালাল জানলা গলে। শুরু হল সংগ্রাম। জীবন সংগ্রাম। বাড়ি বসে আচার-নাড়ু-পাটালি বানানো। ধূপ বানানো। চানাচুর বানানো।শায়া-ব্লাউজ বানানো।  চেষ্টা তো করেছে মাসি অনেকই। হয়তো করেছিলেন মেসোও। আমরা তো এক পক্ষের গপ্প শুনি কেবল।
কোথায় যেন চাকরী পেয়েছিল মেসো, ছোট চাকরী,তবে সরকারী তো বটে। শুধু যেতে হত বহু দূর। মেসোর মা ছাড়েননি তাঁর আদরের দুলালকে। কেঁদে কেটে কাটিয়ে দিয়েছিলেন নাম। জীবনে কখনই আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেননি মেসো। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছিল সংসার, বাধ সাধল মেসোর বাবার হঠাৎ অসুস্থতা। ঘটি বাটি বেচেও বাঁচানো গেল না তাঁকে।  কাজের ধান্ধায় স্থানীয় নার্সিংহোমে আয়ার কাজ সেই তখন থেকে-। আজও জনৈক স্বর্গীয় ডাক্তারের নাম করার সময় কপালে হাত ঠেকান মাসি। হাতে ধরে কাজ শিখিয়েছিলেন যে ডাক্তারবাবু।

তুত্তুরী তখন ছ দিন বয়স। সোমবারে জন্মেছে বটে,রবিবারের আগে ছাড়েননি বুড়ো ডাক্তারবাবু। মা প্রচুর কান্নাকাটি  জুড়েছিল, বাড়ি যাবে বলে। ততোধিক ধমকেছিলেন ডাক্তারবাবু। অবশেষে রবিবার ভোরে বাড়ি ফেরা। উফ্ কি বৃষ্টি, ধুয়ে যাচ্ছে হাওড়া শহর। ঠাম্মাদাদুর কোলে চেপে হাওড়ার বাড়িতে ঢুকল তুত্তুরী। চকাস্(বড় মাসি), টুলটুল দাদা(বড় মেসো), বড় দাদু, আতুপাতু(বড় দিদা), দিদি(পিসি দিদা), দাদু,মামমাম(দিদা), ছোট দাদু, বড় মামা,বড় মামি সবাই মিলে সে কি টানাটানি। এ বলে আমায় দে। ও বলে আমায়। কত কি যে পেল তুত্তুরী, রূপোর টাকাই তো কতগুলো। আর বেশ কিছু পাঁচশ হাজারের নোট। যার দুটি এই সেদিন বের হল, মামমামের লক্ষ্মীর ঝাঁপি থেকে। দাদুর কি চিৎকার, কি বকল মামমামকে। ওগুলো নাকি পচা টাকা। টয়লেট পেপার সমতুল।
যাই হোক সবার আদরের মাঝে, ঐ বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে কে যেন এল। এসেই স্নান করে, ডেটল জলে কাচা জামাকাপড় পরে কোলে নিল তুত্তুরীকে। তাকিয়ে দেখল তুত্তুরী, ও মা!মাসি তো।

সেই থেকে বিগত নয় বছরে তু্ত্তুরীর জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ মাসি। যখনই তুত্তুরী কোন দুষ্টুমি করে, কারো সাথে কথা বলে না বা মিশতে চায় না। লোকে তো দুটো কথাই বলে, “ইশ্ মা কোন শিক্ষা দেয়নি! ইশ্ আয়ার কাছে মানুষ!” তাতে তুত্তুরীর ঘন্টা। তোমাদের কাছে আয়া হতে পারে,তুত্তুরীর পরিবার তো অসম্পূর্ণ মাসি ছাড়া।
কে তু্ত্তুরীর অপরিসীম বকবক মন দিয়ে শোনে?কে পড়ে শোনায় উপেন্দ্রকিশোর বা অবন ঠাকুর? কে তুত্তুরী দুর্ব্যবহার করে ক্ষমা চাইলেই এক কথায় মার্জনা করে দেয়? কে মায়ের চোখ বাঁচিয়ে এখনও ইউনিফর্ম বা জুতো পরিয়ে দেয়? মাখতে দেয় পমেটম? বানিয়ে দেয় মনের মত টিফিন? স্কুলে কারো সাথে তু্ত্তুরী ঝগড়া করলে কে বাড়ি এসে তার গুষ্ঠির মুণ্ডপাত করে? মাসিই তো।

মেসো যখন ঝপ করে পাড়ি দিল অন্য জগতে, কে সাদা শাড়ি পরতে দেয়নি মাসিকে? মাসি নিরামিষ খেলে কে রাগ দেখায় আজও? কে ধ্বংস করবে বলে স্মার্ট ফোন কিনেছে মাসি? কার অনুরোধে, বাড়ির শাড়ি ছেড়ে সুন্দর শাড়ি এবং টুপি পরে তৈরী হয়ে গেল মাসি কেক কাটতে? তুত্তুরীই তো। এত জটিল সম্পর্কের মধ্যে ঢুকে আমাদের কাজ নেই ভাই, মোদ্দা কথা হ্যাপি বার্থ ডে মাসি। এমনই থাকুক তোমার সম্পর্ক, আদরে আর অধিকারে মাখা।

Saturday 30 November 2019

অনির ডাইরি, ৩০শে নভেম্বর, ২০১৯


হৈমন্তী এক অলস দুপুর। দেড়শ বছরের বুড়ো বাড়িটায় বিরাজ করা অখণ্ড নিস্তব্ধতা ভেদ করে ভেসে আসছে, কার যেন কচি গলার মিঠে সুর। “সুও রানির বড় আদর। সুওরানি সাতমহল বাড়িতে থাকেন। সাতশ দাসী তার সেবা করে-”।অবন ঠাকুরের গল্প শোনার ঝোঁকে পশ্চিমের নিম গাছের ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া সবুজ পাতার ফাঁক গলে উকিঝুঁকি মারে মাঝবয়সী সূর্যটা।পাশের কাঁঠাল গাছের ডাল থেকে চিৎকার করে উঠল বায়স দম্পতি,-‘তাপ্পর, তুত্তুরী?তাপ্পর?”
“আর দুওরানি-বড়োরানি,তাঁর বড় অনাদর,বড় অযত্ন। রাজা বিষনয়নে দেখেন। ” হৈমন্তী রোদে আড়ামোড়া ভাঙল পোষা মেনি বেড়াল। পুবে সদগোপদের ছাতের ওপর উড়ে বেড়ানো নিতাইয়ের এক ঝাঁক পায়রার দিকে অলস লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে, বিকট হাই তুলে বলল,“কেন তুত্তুরী?কেন?” দখিনমুখো লাল সিমেন্টের রোয়াকে ফেলে রাখা পুরোনো ইনভার্টারের বাক্সের ওপর তখন জমিয়ে বসেছে তুত্তুরীর গল্পের আসর। মূল শ্রোতার বয়স মধ্য আশি অতিক্রান্ত।সম্পর্কে তো দাদুর দিদি। তবে তুত্তুরীর মা এমনকি তুত্তুরীও ডাকে দিদি বলেই। তিনপ্রজন্ম ধরে চাটুজ্জে বাড়ির বাচ্ছারা শৈশব থেকেই, “দিদিকে বলো”তে অভ্যস্ত।গল্প শুনবে? দিদিকে বলো। বল/বাঁশি বা বেলুন চাই? দিদিকে বলো।  ফুচকা/ চকলেট খাবে? দিদিকে বলো। ঠাকুর দেখতে যাবে?দিদিকে বলো। মা কেলি- থুড়ি ঠেঙিয়েছে? দিদিকে বলো।
এহেন দিদি আপাততঃ হাতের প্লাস্টারটি নিয়ে কিঞ্চিৎ  বিপর্যস্ত। বোঝা বইতে অভ্যস্ত দিদি। বোঝা হতে নয়। আর বিগত একমাস ধরে রান্না-ঘরের কাজ-দোকানবাজার দূরস্থান,স্নানটাও করিয়ে দেয় তুত্তুরীর মামমাম(দিদা)। বেঁধে দেয় চুলও। বাকিটা বড়মামি একাই সামলে দেয় দশভূজা হয়ে। হুঁ হুঁ বাওয়া চাটুজ্জে বাড়ির বড় গিন্নী বলে কতা-।
এত যত্ন,এত আদর- হাতের প্লাস্টার ভর্তি তুত্তুরী,বু্ল্লুদাদা,মা-মামাদের এত মেসেজ-“সেরে ওঠ দিদি। আমরা তোমায় ভীষণ ভালোবাসি দিদি-”। তাও দিদির মন খারাপ। একে এই পরমুখাপেক্ষীতা তারওপর কিঙ্কর আর শঙ্করের বদমাইশি। একজন ডেজিগনেটেড ঝাড়ুদার,অন্যজন মেথর। দিদি এতদিন নিজে দাঁড়িয়ে সাফ করাত সবকিছু। একটা শুকনো পাতা-একটা গজানো আগাছাও নজর এড়াত না দিদির। আর এখন? আশ মিটিয়ে ফাঁকি মারছে দুটোতে। কিঙ্কর তো তাও আসে,একটু আধটু নর্দমা সাফ করে,তারপর গপ্প জোড়ে দাদুর সাথে। চা খায়। তারপর “পর্ণাম পিসিমা” বলে ভাগল বা। আর শঙ্কর?তিনি তো লাটসাহেব। এমাসে একদিনও এলেন না? অথচ মাসশেষে কেমন কাঁচুমাচু মুখ করে দাদুর মাথায় হাত বুলিয়ে মাহিনাটা নিয়ে গেল। দিদিকে দেখে গোটা দুয়েক আগাছা উপড়েছে কেবল। ভাবতে ভাবতে অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে দিদি। কচি কচি একজোড়া হাত জড়িয়ে ধরে দিদির গলা, “দেখো না দিদি, বাঁদরটা এসে গেছে। এবার কপাল ফিরবে সুওরানির।” চটক ভাঙে দিদির, “কি বদ রাজারে। খালি সুও সুও করেই অস্থির-। ” বারন্দায় ভিজে কাপড় মেলে বড়মামি। ছ্যাঁক করে ডালে সম্বরা দেয় মামমাম। ভুরভুরে সৌরভে মথিত হয়ে ওঠে একতলার দালান। একরাশ সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে সোহাগী  গলায় চায়ের আব্দার করে দাদু।আর এক অব্যক্ত সুখানুভূতিতে ছলছলিয়ে ওঠে তুত্তুরীর মায়ের হৃদয় পেয়ালা।

Tuesday 26 November 2019

অনির ডাইরি ২৬শে নভেম্বর,২০১৯

“ম্যাডাম, আপনি আমায় বকবেন বলেছেন?” হ্যাঁ বলে তো ছিলাম। চিৎকার করেই বলেছিলাম, বকব, নালিশ ঠুকব, নিজে হাতে ফাইল নিয়ে গিয়ে গোবিন্দপুরে পাঠাব। ভালোবাসি বলে যা ইচ্ছে তাই করবে না কি? আমার সঙ্গে পেঁয়াজি? ওরকম তো কতই বলি। যখন রাগ হয়, তখন নাকি জ্ঞান থাকে না। উঁহু সেয়ানা রাগ বাবা। যেটা বললে বেশী আহত হবে সেটাই বলি। প্রীতি প্রথমে ফোঁ ফোঁ করে, তারপর হাউমাউ করে কান্না জোড়ে। ধীমান ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলে। শুভজিৎ চোখ মোছে। সোমনাথের মাথা ধড় থেকে নেমে মাটিতে মিশে যায়। “সে কি সোমনাথ তুমি কাঁদছ না? তারমানে তুমি আমাকে অতটাও ভালোবাসো না-। ” মুস্কিল হচ্ছে রাগটা আমার কেমন যেন ক্ষুদ্র এবং ব্যাঁকা। খানিকপরে অনেক চেষ্টা করেও মনে করতে পারি না। শুধু মনে থাকে- এরা আমার দ্বিতীয় পরিবার। আমার তুত্তুরীর থেকেও বেশী সময় এরা আমায় ঘিরে থাকে। এদের ভালোবাসা এবং ঠ্যাঙানোর যুগপৎ অধিকার আমার আছে। আর সে অধিকার কোন চেয়ার আমায় দেয়নি। দিয়েছে এরাই।

দৃশ্যপট-২
মণ্ডপের বাইরে হ্যাণ্ডবিল বিলি করছিলেন বয়স্ক ভদ্রলোক। বিদ্যুৎ চিৎকার করে উঠল,“এই দেখুন ম্যাডাম- আমাদের বেনিফিশিয়ারি।আমি নিজে এর বই করে দিয়েছি। ” তাই নাকি? তা কি করেন দাদা? নার্ভাস হয়ে বললেন- মুন্সিপালিটিতে চাকরী করি আইজ্ঞা। সর্বনাশ। চাকরী করে? এমন লোক ঢুকিয়েছ? বিদ্যুৎ তুমি দেখছি আমার চাকরীটা আর রাখলে না। “না। না ম্যাম। ক্যাজুয়াল। পিএফ,ইএসআই নেই ওণার।” না হলে কেনই বা এতটা উজিয়ে ভিন্ন শহরে এসে হ্যান্ডবিল বিলি করছেন? তাও বটে। তা দাঁড়ান তো দাদা, একটা ছবি তুলি- আপনার আর আপনার এজেন্টের। কই লিফলেট গুলো কই? লিফলেটের গুচ্ছ ততোক্ষণে লুকিয়েছে ওণার পশ্চাৎদেশে। গোলাপী হয়ে বেগুনী বর্ণ হয়ে পড়ছেন প্রৌঢ়। কুঁতিয়ে কুঁতিয়ে বললেন “ডাক্তার বাবুর লিফলেট আইজ্ঞা-।” বুঝলাম ডঃ লোধ মার্কা কেস-। বিদ্যুৎটা যে কি করে না। আমরা কাটলুম দাদা। আপনি শান্তিতে বিলি করুন-।

দৃশ্যপট-৩
“আমার ছেলেটাকে ফিরিয়ে দিন ম্যাডাম”। বক্তা এক মধ্য ত্রিশের দীর্ঘাঙ্গী মহিলা। উস্কোখুস্কো চুল। উদভ্রান্ত  দৃষ্টি। “ছেলেটা আমার বড্ড ছোট। আট বছর মাত্র। ” যাঃ বাবা। আমরা ছেলেধরা কবে হলাম? চাইল্ডলেবার ইন্সপেকশনের গল্প কি? মহিলা কেঁদেই যাচ্ছেন। “কুড়ি পঁচিশ দিন হয়ে গেল। আর পারছি না যে। আমারই দোষ। আমি কেন ওকে মারলাম-।  না মারলে তো ও বাড়ি ছেড়ে যেত না”। মহিলার হৃদয়বিদারক কান্না ক্রমেই সংক্রামিত হচ্ছে আমারও মধ্যে।
বিবাহবিচ্ছিন্না মহিলা একাই থাকেন দুই সন্তান সহ। অকপটে স্বীকার করলেন কনিষ্ঠটি ওণার স্বামীর নয়। “আমি নষ্ট মেয়ে নই ম্যাডাম। ” দিনে সরকারী ঠিকে কাজ করেন। ডিউটি শেষে তিন বাড়ি রান্না করেন। রাতে মারোয়াড়ি গদির খাতা লেখেন। ছেলে দুটি অবৈতনিক বিদ্যালয়ে পড়ে। ছোটটি বড় চঞ্চল। পড়াশোনায় মন নেই। স্কুল থেকে আসা নালিশের জেরেই ঠ্যাঙানি খেয়েছে খুদেটা।
মায়ের চেয়ে মাসির দরদ বেশী- সেই মাসিই শিশুটিকে মায়ের ঠ্যাঙানি থেকে বাঁচিয়ে নিয়ে চলে যায় সে যাত্রা। বড় মাসি। পনেরো দিন মা-ছেলের দেখা হয়নি। দেখা করতে দেয়নি মাসি। বড় ছেলেটিকে পাঠিয়ে খবর যোগাড়ের চেষ্টা করেছেন মহিলা। জবাবে বেড়েছে দুই বোনে অশান্তি। পনেরো দিনের মাথায় থানা থেকে খবর এসেছে, সরকারী হোমে আছে ছেলেটি। মা অত্যাচার করে। তাই কেড়ে নেওয়া হয়েছে মায়ের বুক থেকে।
কিছুই বুঝতে পারছি না। আপনার দিদি? তিনি ওকে বাঁচিয়ে নিয়ে গেলেন হোমে দেবার জন্য। এ কেমন ভালোবাসা? মহিলার গুমরে গুমরে কান্নায় ভারি ঘরের আবহ।খবর পেয়েই ছুটেছিলেন মা।  হোমে ভালো নেই শিশুটি। মায়ের জন্য খুব মনখারাপ। গোটা গায়ে র ্যাশ। পিঠে ঘা।ছবি তুলে দৌড়ে এসেছে মা। বীজবীজে গোটায় ভরা অণ্ডকোষের ছবি দেখে আঁতকে উঠলাম। করাত দুঃস্বপ্ন দেখব জানি না। গিয়েছিলেন কোর্টে। “মুহুরী দাদা” পাঠিয়েছেন আমার ঘরে।
আমি কি করব? বলতে গিয়েও পারলাম না। সত্যমিথ্যা জানি না। তবে আমিও মা। আরেক মায়ের বেদনা ত্বক-পেশী-অস্থিমজ্জা ভেদ করে এফোঁড়ওফোঁড় করে দিচ্ছে আমাকে। কোনটা ঠিক,কোনটা অধিকার বহির্ভূত জানি না। জানি শুধু কিছু করতে হবে।
যাঁর নির্দেশনামায় ছেলেটি হোমে গেছে, তাঁর মুখ চেনা বটে,দিন কতক আগে কোন একটা মিটিং এ মুখোমুখি হয়েছিলাম বটে,তবে প্রতিপক্ষ স্বরূপ। আজ গায়ে পড়ে ফোন করলে কি ভাবতে পারেন,না ভেবেই ফোন করে বসলাম। কিছু করুন প্লিজ। নাহলে এবার আমিও কাঁদতে বসব মাইরি। পদ- দপ্তর- সরকার-বেসরকার সব ছাপিয়ে আমরা মানুষ। আবার অনুভব করলাম সেদিন। আশ্বস্ত হলাম। উনি দেখছেন। উনি দেখবেন। মাকে দিতে হবে একটি হলফনামা, যে তিনি সুস্থ এবং সন্তানের ভারবহনে সক্ষম। ফোন রেখে বললাম, কালই যান। ছেলেকে ফেরৎ পেয়ে জানিয়ে যাবেন কিন্তু।  উনি বিহ্বল হয়ে হাতদুটো জড়িয়ে ধরলেন। চলে যাচ্ছেন যখন ধাতস্থ হয়ে, হঠাৎ প্রশ্ন করলাম, আপনার দিদি এমন কেন করলেন, জানেন? আর পনেরো দিনের মধ্যে আপনিই বা জোর করে কেড়ে আনেননি কেন আপনার ছেলে? জবাব পেলাম- “ছেলেটা তো আমার জামাইবাবুরই। নষ্ট করিনি।”
সেদিন মা কালীর দিব্যি করে গিয়েছিলেন,ছেলে পেলেই দেখা করে যাবেন। আশায় আশায় দিনগুণি আমি। আজ এক পক্ষ অতিক্রান্ত-। জীবন বড়ই বিচিত্র। মা কালীও কথা রাখেন না।