গতকাল মাসির জন্মদিন ছিল। মাসির আবার জন্মদিন। ভূতের আবার জন্মবার। আর পাঁচজন মাসির জীবনচরিতের মতই তুত্তুরীর মাসিরও জীবন পাক খেয়েছে একই পাকদণ্ডী বরাবর, যার গতিমুখ বড়ই উচ্চাবচ।
শৈশবে উদ্দাম মজা, ঝপাং করে ঝাঁপিয়ে পড়ে ডুব সাঁতারে জোড়া পুকুর এপাড়ওপাড়। মশারি দিয়ে বর্ষাকালে চুনো মাছ ধরা। জোড়া বিনুনী দুলিয়ে ইস্কুল যাওয়া। পথেই আলাপ তাঁর সাথে, যাঁকে কোন এককালে তুত্তুরী ডাকত মেসো। তারপর আর কি? গন্ধর্ব থুড়ি পালিয়ে গিয়ে বিয়ে। মাসির তখন সপ্তম শ্রেণী, মাসির সদ্য শাড়ি।
তারপর বড়দিদি,বড়দাদা এবং ছোটদিদি।সংসারের হামানদিস্তার বাড়ি খেয়ে ভালোবাসা পালাল জানলা গলে। শুরু হল সংগ্রাম। জীবন সংগ্রাম। বাড়ি বসে আচার-নাড়ু-পাটালি বানানো। ধূপ বানানো। চানাচুর বানানো।শায়া-ব্লাউজ বানানো। চেষ্টা তো করেছে মাসি অনেকই। হয়তো করেছিলেন মেসোও। আমরা তো এক পক্ষের গপ্প শুনি কেবল।
কোথায় যেন চাকরী পেয়েছিল মেসো, ছোট চাকরী,তবে সরকারী তো বটে। শুধু যেতে হত বহু দূর। মেসোর মা ছাড়েননি তাঁর আদরের দুলালকে। কেঁদে কেটে কাটিয়ে দিয়েছিলেন নাম। জীবনে কখনই আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেননি মেসো। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছিল সংসার, বাধ সাধল মেসোর বাবার হঠাৎ অসুস্থতা। ঘটি বাটি বেচেও বাঁচানো গেল না তাঁকে। কাজের ধান্ধায় স্থানীয় নার্সিংহোমে আয়ার কাজ সেই তখন থেকে-। আজও জনৈক স্বর্গীয় ডাক্তারের নাম করার সময় কপালে হাত ঠেকান মাসি। হাতে ধরে কাজ শিখিয়েছিলেন যে ডাক্তারবাবু।
তুত্তুরী তখন ছ দিন বয়স। সোমবারে জন্মেছে বটে,রবিবারের আগে ছাড়েননি বুড়ো ডাক্তারবাবু। মা প্রচুর কান্নাকাটি জুড়েছিল, বাড়ি যাবে বলে। ততোধিক ধমকেছিলেন ডাক্তারবাবু। অবশেষে রবিবার ভোরে বাড়ি ফেরা। উফ্ কি বৃষ্টি, ধুয়ে যাচ্ছে হাওড়া শহর। ঠাম্মাদাদুর কোলে চেপে হাওড়ার বাড়িতে ঢুকল তুত্তুরী। চকাস্(বড় মাসি), টুলটুল দাদা(বড় মেসো), বড় দাদু, আতুপাতু(বড় দিদা), দিদি(পিসি দিদা), দাদু,মামমাম(দিদা), ছোট দাদু, বড় মামা,বড় মামি সবাই মিলে সে কি টানাটানি। এ বলে আমায় দে। ও বলে আমায়। কত কি যে পেল তুত্তুরী, রূপোর টাকাই তো কতগুলো। আর বেশ কিছু পাঁচশ হাজারের নোট। যার দুটি এই সেদিন বের হল, মামমামের লক্ষ্মীর ঝাঁপি থেকে। দাদুর কি চিৎকার, কি বকল মামমামকে। ওগুলো নাকি পচা টাকা। টয়লেট পেপার সমতুল।
যাই হোক সবার আদরের মাঝে, ঐ বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে কে যেন এল। এসেই স্নান করে, ডেটল জলে কাচা জামাকাপড় পরে কোলে নিল তুত্তুরীকে। তাকিয়ে দেখল তুত্তুরী, ও মা!মাসি তো।
সেই থেকে বিগত নয় বছরে তু্ত্তুরীর জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ মাসি। যখনই তুত্তুরী কোন দুষ্টুমি করে, কারো সাথে কথা বলে না বা মিশতে চায় না। লোকে তো দুটো কথাই বলে, “ইশ্ মা কোন শিক্ষা দেয়নি! ইশ্ আয়ার কাছে মানুষ!” তাতে তুত্তুরীর ঘন্টা। তোমাদের কাছে আয়া হতে পারে,তুত্তুরীর পরিবার তো অসম্পূর্ণ মাসি ছাড়া।
কে তু্ত্তুরীর অপরিসীম বকবক মন দিয়ে শোনে?কে পড়ে শোনায় উপেন্দ্রকিশোর বা অবন ঠাকুর? কে তুত্তুরী দুর্ব্যবহার করে ক্ষমা চাইলেই এক কথায় মার্জনা করে দেয়? কে মায়ের চোখ বাঁচিয়ে এখনও ইউনিফর্ম বা জুতো পরিয়ে দেয়? মাখতে দেয় পমেটম? বানিয়ে দেয় মনের মত টিফিন? স্কুলে কারো সাথে তু্ত্তুরী ঝগড়া করলে কে বাড়ি এসে তার গুষ্ঠির মুণ্ডপাত করে? মাসিই তো।
মেসো যখন ঝপ করে পাড়ি দিল অন্য জগতে, কে সাদা শাড়ি পরতে দেয়নি মাসিকে? মাসি নিরামিষ খেলে কে রাগ দেখায় আজও? কে ধ্বংস করবে বলে স্মার্ট ফোন কিনেছে মাসি? কার অনুরোধে, বাড়ির শাড়ি ছেড়ে সুন্দর শাড়ি এবং টুপি পরে তৈরী হয়ে গেল মাসি কেক কাটতে? তুত্তুরীই তো। এত জটিল সম্পর্কের মধ্যে ঢুকে আমাদের কাজ নেই ভাই, মোদ্দা কথা হ্যাপি বার্থ ডে মাসি। এমনই থাকুক তোমার সম্পর্ক, আদরে আর অধিকারে মাখা।
No comments:
Post a Comment