Saturday 14 December 2019

মধ্যমেধার মধ্যবিত্তের রোজনামচা-১৪ই ডিসেম্বর,২০১৯

আমার তেত্রিশ কোটি দেবতার মধ্যে, মহঃ রফি একজন। আজ্ঞে হ্যাঁঁ, “আভি না যাও ছোড়কর, কে দিল আভি ভরা নেহি-”। এই পেলব অমৃতস্বরূপ স্বর স্বয়ং ঈশ্বর ছাড়া আর কার হতে পারে বলুন দিকি? কিশোরের সাথে খুনসুটি চলতে পারে, জমতে পারে হাল্কা ফুল্কা প্রেমও। মুকেশজীর সাথে গভীর সম্পৃক্ত প্রেম। কিন্তু রফি সাব? উনি এই তুচ্ছ সাধারণ মেয়েটার ধরা ছোঁয়ার বাইরে। যাঁর পদতলে করজোড়ে বসে মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে থাকতে মন চায়। যাঁর আত্মভোলা হাসিতে নত হয়ে যায় মম গর্বিত শির।
পকেটহীন হলুদ পাঞ্জাবি পরা, খালিপা এক বাংলাদেশী যুবার হাত ধরে, নীল শাড়ি পরে মিশে যেতে চাই জনসমুদ্রে। কদমফুল যাঁর ভীষণ প্রিয়। হস্তচুম্বন করতে চাই তাঁর স্রষ্টার। শরদ্বিন্দু বন্দোপাধ্যায়ের পর এত গভীর ভাবে কোন লেখকের অনুরাগিনী হইনি। আর সেই হেঁপো বুড়ো মিশির আলি, কি যে বলি তাঁকে নিয়ে? ভাগ করে নিয়েছি প্রিয় বান্ধবীদের সাথে। সবকটা তাঁর প্রেমে দিওয়ানা-
আর সেই সদ্য বিপত্নীক বৃদ্ধ, অবসর নেবার দিন যিনি বলেছিলেন, “ও আমার আরেকটা মেয়ে-”। আমার দুই বাপ ছাড়া এত ভালো আমায় কে বেসেছে? তিনিও তো ধর্মে মুসলমান। রোজা রাখতেন না বলে কত পিছনে লেগেছি, “আপনি ভুলভাল মুসলমান নজরুল সাহেব-”।  কান ধরে কবিতা পড়াতেন যিনি। কবিতার প্রতি যতটা ভালোবাসা,সবটুকুই তাঁর থেকে পাওয়া। আজও তাঁর তিরিশ সেকেণ্ডের হড়বড়ে ফোনে আদ্র হয়ে ওঠে উত্তেজিত শুষ্ক মন আর মাথা।

  সংবিধানের প্রস্তাবনা তো সেদিনের শিশু। ধর্মনিরপেক্ষতা আমার রক্তে। ক্রোমোজোমে। প্রপিতামহ ছিলেন চার্বাকপন্থী। ঋণং কৃত্বা ঘৃতং পিবেৎ।  লুকিয়ে অস্ত্র আনতে কালাপানি পেরিয়ে একঘরে হয়েছিলেন ঠাকুরদা। ইয়ে আজাদী ঝুটা হ্যায় বলেছিলেন ছোটদাদু। জেলখাটা নকশাল আমার বাবা। উদারমনা শ্বশুর-শাশুড়ী। ঘোরতর আস্তিক বটে,তবে আমার মতই উদার আমার ঠাকুর। এক স্যালুটেই খুশি। অতি ভক্তিতে কুঁচকে যায় তাঁর/তাঁদের ভ্রু।
বিশ্বাস করুন, এসব কথা আপনাদের শোনাচ্ছি না। শোনাচ্ছি নিজেকে। এহেন আমারও আজন্মলালিত সংস্কার, বিশ্বাস তথা মূল্যবোধের গোড়া নড়ে গেছে কালকে তথা আজকের নোংরামিতে। “নোংরামি”। আজ্ঞে হ্যাঁ, কান্নিককে(Spade) কান্নিক বলাই শ্রেয়। এটা প্রতিবাদ বা পোতিবাদ নয়, এটা সহজ সরল নোংরামি। সুদূর মুর্শিদাবাদ থেকে কানের কাছের উলুবেড়িয়া অবধি কেঁপে উঠল যে নোংরামিতে, তাজ্জব ব্যাপার আমাদের গোয়েন্দা সংস্থা গুলো ঘুণাক্ষরেও টের পেল না এতখানি সংঘবদ্ধ  প্রতিরোধের? আর আমাদের মূখ্য সংবাদপত্র কি লিখছেন, “- আইনের প্রতিবাদে সরব বাংলা”!  মাইরি সত্যি? শুধু সরব? তাহলে অরাজকতা তথা গুণ্ডামির সংজ্ঞাটা অনুগ্রহ করে জানাবেন দাদা/দিদি?
বাতানুকূল ঘরে, অনাগত শীতের অপেক্ষায় ওম্ পোহাতে পোহাতে ওমন কথা লেখা যায় বৈকি।ফেবুতে তপ্ত কুড়মুড়ে স্টেটাস্ লেখা যায়,“বেশ করেছে ভাঙচুর করেছে---। ওদের অস্তিত্ব বিপন্ন। এখন কি ভেবে ভেবে ডেমোক্রেটিক পথে ঝামেলা করবে---”।
আর আমার যে বন্ধু কাল সকালে চেন্নাই মেল ধরবে? সুস্থ ভাবে বাড়ি পৌঁছবে তো সে? বা যে লক্ষ্মীমন্ত বান্ধবীটির বর চাকরী করেন অশান্ত এলাকারই একটি স্কুলে? বিগত দাঙ্গায় বাইক ফেলে হামাগুড়ি দিয়ে ধানখেতের মধ্যে দিয়ে পালিয়ে এসেছিলেন, তাও টলেনি যাঁর ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতি আস্থা। আগামী পরশু থেকে নিয়মিত দপ্তরে যেতে পারবেন তো তিনি? ভগ্নীসমা যে আধিকারিককে কাল রাতে ধমকাচ্ছিলাম, “গুলি মারো বড় সাহেবকে।স্টেশন লিভের নিকুচি করেছে, আগে বাড়ি ফেরো-”, স্বাভাবিক ভাবে কোয়ার্টারে ফিরতে পারবে তো সে? আর ঐ আধিকারিকের স্ত্রী আর কন্যা, আজ থেকে বছর নয় দশ আগে ঐ জায়গাতে তো আমিই ছিলাম-।
নড়ে গেছে যাবতীয় বিশ্বাস আর সংহতির ভিত। ভুলে গেছি পিঁয়াজের দাম বা না পাওয়া ডিএর বেদনা। পড়েও দেখিনি বিহারে নিগৃহিত তথা নিহত বছর দশেকের শিশু কন্যার খবর, শুধু ঘিরে ধরেছে অপরিসীম আতঙ্ক।

No comments:

Post a Comment