হৈমন্তী এক অলস দুপুর। দেড়শ বছরের বুড়ো বাড়িটায় বিরাজ করা অখণ্ড নিস্তব্ধতা ভেদ করে ভেসে আসছে, কার যেন কচি গলার মিঠে সুর। “সুও রানির বড় আদর। সুওরানি সাতমহল বাড়িতে থাকেন। সাতশ দাসী তার সেবা করে-”।অবন ঠাকুরের গল্প শোনার ঝোঁকে পশ্চিমের নিম গাছের ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া সবুজ পাতার ফাঁক গলে উকিঝুঁকি মারে মাঝবয়সী সূর্যটা।পাশের কাঁঠাল গাছের ডাল থেকে চিৎকার করে উঠল বায়স দম্পতি,-‘তাপ্পর, তুত্তুরী?তাপ্পর?”
“আর দুওরানি-বড়োরানি,তাঁর বড় অনাদর,বড় অযত্ন। রাজা বিষনয়নে দেখেন। ” হৈমন্তী রোদে আড়ামোড়া ভাঙল পোষা মেনি বেড়াল। পুবে সদগোপদের ছাতের ওপর উড়ে বেড়ানো নিতাইয়ের এক ঝাঁক পায়রার দিকে অলস লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে, বিকট হাই তুলে বলল,“কেন তুত্তুরী?কেন?” দখিনমুখো লাল সিমেন্টের রোয়াকে ফেলে রাখা পুরোনো ইনভার্টারের বাক্সের ওপর তখন জমিয়ে বসেছে তুত্তুরীর গল্পের আসর। মূল শ্রোতার বয়স মধ্য আশি অতিক্রান্ত।সম্পর্কে তো দাদুর দিদি। তবে তুত্তুরীর মা এমনকি তুত্তুরীও ডাকে দিদি বলেই। তিনপ্রজন্ম ধরে চাটুজ্জে বাড়ির বাচ্ছারা শৈশব থেকেই, “দিদিকে বলো”তে অভ্যস্ত।গল্প শুনবে? দিদিকে বলো। বল/বাঁশি বা বেলুন চাই? দিদিকে বলো। ফুচকা/ চকলেট খাবে? দিদিকে বলো। ঠাকুর দেখতে যাবে?দিদিকে বলো। মা কেলি- থুড়ি ঠেঙিয়েছে? দিদিকে বলো।
এহেন দিদি আপাততঃ হাতের প্লাস্টারটি নিয়ে কিঞ্চিৎ বিপর্যস্ত। বোঝা বইতে অভ্যস্ত দিদি। বোঝা হতে নয়। আর বিগত একমাস ধরে রান্না-ঘরের কাজ-দোকানবাজার দূরস্থান,স্নানটাও করিয়ে দেয় তুত্তুরীর মামমাম(দিদা)। বেঁধে দেয় চুলও। বাকিটা বড়মামি একাই সামলে দেয় দশভূজা হয়ে। হুঁ হুঁ বাওয়া চাটুজ্জে বাড়ির বড় গিন্নী বলে কতা-।
এত যত্ন,এত আদর- হাতের প্লাস্টার ভর্তি তুত্তুরী,বু্ল্লুদাদা,মা-মামাদের এত মেসেজ-“সেরে ওঠ দিদি। আমরা তোমায় ভীষণ ভালোবাসি দিদি-”। তাও দিদির মন খারাপ। একে এই পরমুখাপেক্ষীতা তারওপর কিঙ্কর আর শঙ্করের বদমাইশি। একজন ডেজিগনেটেড ঝাড়ুদার,অন্যজন মেথর। দিদি এতদিন নিজে দাঁড়িয়ে সাফ করাত সবকিছু। একটা শুকনো পাতা-একটা গজানো আগাছাও নজর এড়াত না দিদির। আর এখন? আশ মিটিয়ে ফাঁকি মারছে দুটোতে। কিঙ্কর তো তাও আসে,একটু আধটু নর্দমা সাফ করে,তারপর গপ্প জোড়ে দাদুর সাথে। চা খায়। তারপর “পর্ণাম পিসিমা” বলে ভাগল বা। আর শঙ্কর?তিনি তো লাটসাহেব। এমাসে একদিনও এলেন না? অথচ মাসশেষে কেমন কাঁচুমাচু মুখ করে দাদুর মাথায় হাত বুলিয়ে মাহিনাটা নিয়ে গেল। দিদিকে দেখে গোটা দুয়েক আগাছা উপড়েছে কেবল। ভাবতে ভাবতে অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে দিদি। কচি কচি একজোড়া হাত জড়িয়ে ধরে দিদির গলা, “দেখো না দিদি, বাঁদরটা এসে গেছে। এবার কপাল ফিরবে সুওরানির।” চটক ভাঙে দিদির, “কি বদ রাজারে। খালি সুও সুও করেই অস্থির-। ” বারন্দায় ভিজে কাপড় মেলে বড়মামি। ছ্যাঁক করে ডালে সম্বরা দেয় মামমাম। ভুরভুরে সৌরভে মথিত হয়ে ওঠে একতলার দালান। একরাশ সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে সোহাগী গলায় চায়ের আব্দার করে দাদু।আর এক অব্যক্ত সুখানুভূতিতে ছলছলিয়ে ওঠে তুত্তুরীর মায়ের হৃদয় পেয়ালা।
What ever I like...what ever I feel.... form movies to books... to music... to food...everything from my point of view.
Saturday, 30 November 2019
অনির ডাইরি, ৩০শে নভেম্বর, ২০১৯
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment