“ম্যাডাম, আপনি আমায় বকবেন বলেছেন?” হ্যাঁ বলে তো ছিলাম। চিৎকার করেই বলেছিলাম, বকব, নালিশ ঠুকব, নিজে হাতে ফাইল নিয়ে গিয়ে গোবিন্দপুরে পাঠাব। ভালোবাসি বলে যা ইচ্ছে তাই করবে না কি? আমার সঙ্গে পেঁয়াজি? ওরকম তো কতই বলি। যখন রাগ হয়, তখন নাকি জ্ঞান থাকে না। উঁহু সেয়ানা রাগ বাবা। যেটা বললে বেশী আহত হবে সেটাই বলি। প্রীতি প্রথমে ফোঁ ফোঁ করে, তারপর হাউমাউ করে কান্না জোড়ে। ধীমান ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলে। শুভজিৎ চোখ মোছে। সোমনাথের মাথা ধড় থেকে নেমে মাটিতে মিশে যায়। “সে কি সোমনাথ তুমি কাঁদছ না? তারমানে তুমি আমাকে অতটাও ভালোবাসো না-। ” মুস্কিল হচ্ছে রাগটা আমার কেমন যেন ক্ষুদ্র এবং ব্যাঁকা। খানিকপরে অনেক চেষ্টা করেও মনে করতে পারি না। শুধু মনে থাকে- এরা আমার দ্বিতীয় পরিবার। আমার তুত্তুরীর থেকেও বেশী সময় এরা আমায় ঘিরে থাকে। এদের ভালোবাসা এবং ঠ্যাঙানোর যুগপৎ অধিকার আমার আছে। আর সে অধিকার কোন চেয়ার আমায় দেয়নি। দিয়েছে এরাই।
দৃশ্যপট-২
মণ্ডপের বাইরে হ্যাণ্ডবিল বিলি করছিলেন বয়স্ক ভদ্রলোক। বিদ্যুৎ চিৎকার করে উঠল,“এই দেখুন ম্যাডাম- আমাদের বেনিফিশিয়ারি।আমি নিজে এর বই করে দিয়েছি। ” তাই নাকি? তা কি করেন দাদা? নার্ভাস হয়ে বললেন- মুন্সিপালিটিতে চাকরী করি আইজ্ঞা। সর্বনাশ। চাকরী করে? এমন লোক ঢুকিয়েছ? বিদ্যুৎ তুমি দেখছি আমার চাকরীটা আর রাখলে না। “না। না ম্যাম। ক্যাজুয়াল। পিএফ,ইএসআই নেই ওণার।” না হলে কেনই বা এতটা উজিয়ে ভিন্ন শহরে এসে হ্যান্ডবিল বিলি করছেন? তাও বটে। তা দাঁড়ান তো দাদা, একটা ছবি তুলি- আপনার আর আপনার এজেন্টের। কই লিফলেট গুলো কই? লিফলেটের গুচ্ছ ততোক্ষণে লুকিয়েছে ওণার পশ্চাৎদেশে। গোলাপী হয়ে বেগুনী বর্ণ হয়ে পড়ছেন প্রৌঢ়। কুঁতিয়ে কুঁতিয়ে বললেন “ডাক্তার বাবুর লিফলেট আইজ্ঞা-।” বুঝলাম ডঃ লোধ মার্কা কেস-। বিদ্যুৎটা যে কি করে না। আমরা কাটলুম দাদা। আপনি শান্তিতে বিলি করুন-।
দৃশ্যপট-৩
“আমার ছেলেটাকে ফিরিয়ে দিন ম্যাডাম”। বক্তা এক মধ্য ত্রিশের দীর্ঘাঙ্গী মহিলা। উস্কোখুস্কো চুল। উদভ্রান্ত দৃষ্টি। “ছেলেটা আমার বড্ড ছোট। আট বছর মাত্র। ” যাঃ বাবা। আমরা ছেলেধরা কবে হলাম? চাইল্ডলেবার ইন্সপেকশনের গল্প কি? মহিলা কেঁদেই যাচ্ছেন। “কুড়ি পঁচিশ দিন হয়ে গেল। আর পারছি না যে। আমারই দোষ। আমি কেন ওকে মারলাম-। না মারলে তো ও বাড়ি ছেড়ে যেত না”। মহিলার হৃদয়বিদারক কান্না ক্রমেই সংক্রামিত হচ্ছে আমারও মধ্যে।
বিবাহবিচ্ছিন্না মহিলা একাই থাকেন দুই সন্তান সহ। অকপটে স্বীকার করলেন কনিষ্ঠটি ওণার স্বামীর নয়। “আমি নষ্ট মেয়ে নই ম্যাডাম। ” দিনে সরকারী ঠিকে কাজ করেন। ডিউটি শেষে তিন বাড়ি রান্না করেন। রাতে মারোয়াড়ি গদির খাতা লেখেন। ছেলে দুটি অবৈতনিক বিদ্যালয়ে পড়ে। ছোটটি বড় চঞ্চল। পড়াশোনায় মন নেই। স্কুল থেকে আসা নালিশের জেরেই ঠ্যাঙানি খেয়েছে খুদেটা।
মায়ের চেয়ে মাসির দরদ বেশী- সেই মাসিই শিশুটিকে মায়ের ঠ্যাঙানি থেকে বাঁচিয়ে নিয়ে চলে যায় সে যাত্রা। বড় মাসি। পনেরো দিন মা-ছেলের দেখা হয়নি। দেখা করতে দেয়নি মাসি। বড় ছেলেটিকে পাঠিয়ে খবর যোগাড়ের চেষ্টা করেছেন মহিলা। জবাবে বেড়েছে দুই বোনে অশান্তি। পনেরো দিনের মাথায় থানা থেকে খবর এসেছে, সরকারী হোমে আছে ছেলেটি। মা অত্যাচার করে। তাই কেড়ে নেওয়া হয়েছে মায়ের বুক থেকে।
কিছুই বুঝতে পারছি না। আপনার দিদি? তিনি ওকে বাঁচিয়ে নিয়ে গেলেন হোমে দেবার জন্য। এ কেমন ভালোবাসা? মহিলার গুমরে গুমরে কান্নায় ভারি ঘরের আবহ।খবর পেয়েই ছুটেছিলেন মা। হোমে ভালো নেই শিশুটি। মায়ের জন্য খুব মনখারাপ। গোটা গায়ে র ্যাশ। পিঠে ঘা।ছবি তুলে দৌড়ে এসেছে মা। বীজবীজে গোটায় ভরা অণ্ডকোষের ছবি দেখে আঁতকে উঠলাম। করাত দুঃস্বপ্ন দেখব জানি না। গিয়েছিলেন কোর্টে। “মুহুরী দাদা” পাঠিয়েছেন আমার ঘরে।
আমি কি করব? বলতে গিয়েও পারলাম না। সত্যমিথ্যা জানি না। তবে আমিও মা। আরেক মায়ের বেদনা ত্বক-পেশী-অস্থিমজ্জা ভেদ করে এফোঁড়ওফোঁড় করে দিচ্ছে আমাকে। কোনটা ঠিক,কোনটা অধিকার বহির্ভূত জানি না। জানি শুধু কিছু করতে হবে।
যাঁর নির্দেশনামায় ছেলেটি হোমে গেছে, তাঁর মুখ চেনা বটে,দিন কতক আগে কোন একটা মিটিং এ মুখোমুখি হয়েছিলাম বটে,তবে প্রতিপক্ষ স্বরূপ। আজ গায়ে পড়ে ফোন করলে কি ভাবতে পারেন,না ভেবেই ফোন করে বসলাম। কিছু করুন প্লিজ। নাহলে এবার আমিও কাঁদতে বসব মাইরি। পদ- দপ্তর- সরকার-বেসরকার সব ছাপিয়ে আমরা মানুষ। আবার অনুভব করলাম সেদিন। আশ্বস্ত হলাম। উনি দেখছেন। উনি দেখবেন। মাকে দিতে হবে একটি হলফনামা, যে তিনি সুস্থ এবং সন্তানের ভারবহনে সক্ষম। ফোন রেখে বললাম, কালই যান। ছেলেকে ফেরৎ পেয়ে জানিয়ে যাবেন কিন্তু। উনি বিহ্বল হয়ে হাতদুটো জড়িয়ে ধরলেন। চলে যাচ্ছেন যখন ধাতস্থ হয়ে, হঠাৎ প্রশ্ন করলাম, আপনার দিদি এমন কেন করলেন, জানেন? আর পনেরো দিনের মধ্যে আপনিই বা জোর করে কেড়ে আনেননি কেন আপনার ছেলে? জবাব পেলাম- “ছেলেটা তো আমার জামাইবাবুরই। নষ্ট করিনি।”
সেদিন মা কালীর দিব্যি করে গিয়েছিলেন,ছেলে পেলেই দেখা করে যাবেন। আশায় আশায় দিনগুণি আমি। আজ এক পক্ষ অতিক্রান্ত-। জীবন বড়ই বিচিত্র। মা কালীও কথা রাখেন না।
No comments:
Post a Comment